নাসের মাথা গুঁজে একমনে সেলাই করছিলো।
করছিলো মানে বলা ভালো, করার চেষ্টা করছিলো। যা দিনকাল পড়েছে, এই অটোম্যাটিক সেলাই মেশিন গুলোর সে কিছুই বোঝেনা! তার ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে বলে পা দিয়ে ঠেকা দাও, কাপড়টা দাবিয়ে রাখো আর সরসর সরসর করে মেশিনের হাতল ঘুরিয়ে যাও, কাপড় তো সবচেয়ে ভালো ফোটে কাট আর ডিজাইনে, এই হড়বড়ানি মেশিনটা আপা, খালাম্মা আর নানিজানদের কিইবা কাজে আসে, তারপরেও এখন নতুন ফ্যাশন সব দোকানে, এই মার্কেটের সব বড় বড় টেইলরিং হাউজেই এই মেশিন, সে শুনেছে গারমেন্টসেও এই মেশিনের খুব কদর, তবে আরও বড়টা। হ্যাঁ, যেতে পারতো সে গারমেন্টসে, চাইলেই বদর ভাইকে বলে কয়ে আর পাঁচশো টাকা ঘুষ দিয়ে মাসকাবারি নাইট শিফটের একটা কাজ তার নিশ্চয়ই হয়ে যেতো। কিন্তু অতটা উচ্চাভিলাষী স্বপ্ন তার জগতকে এখনও গ্রাস করেনি, বিপুলা এ পৃথিবীর যতটুকু না জানলেই নয় সেই অসীম নিস্পৃহতায় সে ছোট্ট এই দর্জি দোকানের হাফ-টেইলর হয়েই আপাততঃ সুখে আছে। মাঝে মাঝে যদিও হাফ টেইলর ডাকটা তার বাইশের যৌবনোদ্যত রুক্ষতার জন্য খুবই চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়ায়, টেইলর মাস্টার বুড়ো হাসান মিয়া লোক ভালো, সে ছাড়া এইনামে তাকে বড় একটা কেউ ঘাঁটায় না। দোকানের অন্যান্যরা নাসের দর্জি, নাসেইরা নিদেনপক্ষে নাসের ভাই বলেও সাহায্য চায়, বিশেষতঃ মেয়েদের ব্লাউজ কাটায় তার পারদর্শিতা মিকেলেঞ্জেলোর ভাস্কর্য বানানোর মতই কিংবদন্তীসম খ্যাতিতে পৌঁছে গ্যাছে বলে।
বছর পনেরো বয়সে গায়ে জাতে একটু ব্যাটা ব্যাটা ভাব দেখা দিতেই কচি দুর্বা ঘাসের মত দাড়ি আর পুরুষাঙ্গের উত্থিত হবার মতো নিত্যনতুন ঘটনায় বেচাইন শরীর নিয়ে সে আবিষ্কার করে, যে কোনো পোশাকের কাট একবার দেখেই তার নির্ভুল মনে থাকে, রিকশার পেছনে আঁকা নায়িকার গায়ের আঁটসাঁট কাঁচুলি এমনকি টিভি চ্যানেলের উপস্থাপিকার সুগভীর গলার কাটের মাঝগগনে উঁকি দিয়ে যাওয়া চাঁদের ফালির মত এক টুকরো খাঁজের থেকেও বেশি মনে থাকে তার পিঠের বোতামের ঘরগুলোর গড়ন আর হাতের লেসের কারুকাজ। এই হঠাৎ পাওয়া আবিষ্কার তার খুবই আকস্মিক, বলা যায় দর্জি হবার সাধনায় হাতেখড়ি হবারও অনেক আগে।
চৌদ্দপুরুষের কেউ দর্জি ছিলোনা, বাপ জামাল মিয়ার নিষ্ফল আক্রোশ তাই বেরোবার পথ না পেয়ে রাতদিন শাপশাপান্তে ব্যয় হতো, রিটায়ার্ড স্কুল দারোয়ান হিসেবে তার আশা ছিলো ছেলেটা ম্যাট্রিক পাশ করে আরো পড়বে, অন্ততঃ একটা কেরানীর চাকরি করবে। সরকারী চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী বিষয়ে লোলুপতা ছিলো বাপের, অনেকবার এই সোনার হরিণ হাত থেকে ছিটকে গেছে। ছেলেকে দিয়ে আশায় বসতি নিঃসীম দুরাশায় পরিণত হলো যেদিন, নাসের সেদিন হালের ক'টা ফ্যাশন ম্যাগাজিনের পুরনো কপি সের দরে কিনে রান্নাঘরের পেছনে খুপরি ভাঁড়ারে স্তুপীকৃত ডাঁইয়ের ওপর ত্রিভঙ্গমুরারী। পুরুষত্বের নিরীক্ষায় ছটফটে হাত প্যান্টের চেইনের ভেতর ঢোকায় আর বের করে, অস্থির চিত্ত ওই প্রবল উত্তেজনার সময়েও পাশের ঘর থেকে ভেসে আসা বাপের গালিগালাজ আর চিৎকারে, এক হাতে ম্যাগাজিনের ছবি আর অন্যহাতে শরীরকে সুখ দেয়ার নিরন্তর মাপাজোকার টেনশনেও তার চোখে বিঁধে থাকে মডেলের বুকের কাছে ব্লাউজের কাটিং আর কালার কম্বিনেশন। বাপের চিৎকার যতই প্রবল হয়, উত্তেজনা ততই তুঙ্গে উঠে, আর নিরন্তর অসহায়তায় নাসের দেখতে পায় তার মাথার ভেতর ঢুকে গ্যাছে রঙ আর সুতোর ঠাসবুনন। যতই কাপড় বাদে দেহটিকে কল্পনা করে, ততই ডিজাইন, মেকিং আর রঙ মাথার মধ্যে আরও ঘোঁট পাকিয়ে যায়! কি অসহ্য এক কষ্টে মিনিট দশেক ধ্বস্তাধস্তির পর, আহ্হ্ শব্দে নির্গত শীৎকার আর গ্লানিকর স্খলনের মাঝে নাসের সবিস্ময়ে আবিষ্কার করে নিঁখুতভাবে ডিজাইনটা তার মাথায় বসে গ্যাছে! পরদিন কাঠ পেনসিলে বসে খবরের কাগজের উপর পটাপট এঁকে ফেলে ওই জামা আর সব আনুষাঙ্গিক।
সেই শুরু, তরপর থেকে তরতরিয়ে জামা, কামিজ, চুড়িদার বাচ্চাদের ফ্রক সবকিছুই খুব দ্রুততায় হাতে আসে তার। কিন্তু প্রথম দিনের ওই ঘটনায় হতবাক নাসের খুব শিগগীরই দেখতে পায়, ব্লাউজের কাট তার হাতে সবচেয়ে বেশি খোলে! আরও নিদারুণ কষ্টের ছটফটানিতে সে বোঝে, শরীরের উত্তেজনাটি ক্রমশই স্তিমিত হয় তার ব্লাউজ বানাতে গেলেই! যত বেশি সূক্ষ্ম তার কাজ, যত সূতার কারসাজি, যত গভীর তার কাট, হালফ্যাশনের মডেলদের যত বেশি আনাগোনা বাড়ে, তার নিস্তেজ পুংকেশর তাকে ততই অবজ্ঞা করে দূরে সরে যায়। নিতান্ত মুখচোরা সে এই চরম দুর্দিনেও খুব মনোযোগ দিয়ে গোটা দশেক ব্লাউজে ফোঁড় দিচ্ছিলো আজ, হঠাৎ তার দোকানের দরজা, যা এসি চালানোর কারণে মালিকের নির্দেশে বন্ধ থাকে, ঠেলে ঢোকে অনীতা।
অনীতার কথা এইবেলা বলে নেওয়া ভালো কেননা, অনীতা প্রেমে পড়েছে।
সেটা খুব বড় কোনো ব্যাপার নয়, আকছার পৃথিবীর প্রতিটি কোণেই চৌদ্দ থেকে চব্বিশ বয়সী একগাদা মেয়ে কিশোরী মায় উদ্ভিন্নযৌবনা পর্যন্ত প্রেমে পড়ছে, শুধু পড়ছে না, বলা ভালো ধপাধপ আছাড় খাচ্ছে। প্রেমের মতো এমন একটা সঘন স-আবেগ তদুপরি সলজ্জ ব্যাপারের সাথে আছাড় খাওয়ার মতো অমন আনকুথ ক্রিয়াশীলতার কথা ভাবতেই কেমন যেন তেতো অনুভূতি হয় মুখের মধ্যে ওর, কিন্তু ব্যাপার টা ঠিক ঐ রকমই আনকুথ বলা যায় একেবারে বিশ্রী রকমের আনকুথ হয়ে গ্যাছে। কারণ অনীতা, আমাদের সুন্দরী ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া চোখে হাফ কাট রিডিং গ্লাস দেওয়া, লেয়ার কাট চুল, স্মুথ হেয়ার সিল্কি শাইনিং স্কিন অনীতা, টম ক্রুজ লুক আর রালফ লরেন পোলো টি শার্ট বিশেষজ্ঞ অনীতা, সর্বোপরি শোভা দে আর সিডনী শেলডন গোগ্রাসে গিলে খাওয়া অনীতা হঠাৎ করে আছাড় খেয়েছে, থুক্কু, মন প্রাণ সবই সঁপে বসে আছে এই দর্জিকে!
এইরে! এবার বলা ভালো, আমাদের অনীতা আপারেন্টলি মোটেই শ্রেণী বিদ্বেষী নয়, ড্রাইভারের সাথে কোটিপতির একমাত্র কন্যা ইলোপ বা হবু শাশুড়ীর গর্ভে জামাইয়ের সন্তান অথবা নিদেন পক্ষে এরশাদের কোলে কে' জাতীয় অপরাধচিত্র পত্রিকার হেডিং গুলো যদিও সে সযতনে পরিহার করে চলে, তারপরও বেওয়ারিশ বেড়াল ছানাটাকে ডাস্টবিন থেকে তুলে এনে তুলো টুলো পুঁছিয়ে তার হাতে তুলে দেওয়া হলে সে বেশ আদরেই ওটাকে কোলে নেয়, সাগ্রহে তর্জনীতে দুধ তুলে নিয়ে আঙুল চুষে পুষিমেনিকে খেতেও দেয়, বাপে খেদানো মায়ে তাড়ানো বাচ্চাগুলোকে নিয়েও তার উৎসাহের কমতি নেই, এন্তার কাঠি লজেন্স, চক স্লেট দিয়ে এমনকি মাঝে মাঝে ছুটির দিনে হাফ ডে পড়ুয়ার পাঠশালা তৈরি করে সে বেশ একটা মাদার টেরেসা ন হোক অন্ততঃ সিস্টার অনীতা ইমেজ তৈরি করার খুব খুব চেষ্টা করেছে - তারপরেও দর্জির প্রেমে পড়া ব্যাপারটা তার সিস্টেমের সাথে এযুগের ভাষায় বললে ঠিক কমপ্যাটিবল্ হচ্ছেনা।
তারপর আবার এ দর্জি যে সে দর্জি নয়, এ হলো কেবল তার ব্লাউজ বানানোর দর্জি। আরও অস্ব:স্তির কথা হলো তার মা আর খালাদের ব্লাউজও এই একই লোকের হাত থেকে অনায়াস নিপুণতায় বের হয়!
ফ্রয়েড পড়া সিমোন দ্য বোভ্যায়ের এ একটু আলোকপ্রাপ্তা হিসেবে যৌন অবদমনের সংজ্ঞায় পা না পিছলোলেও বন্ধুসমাজে "দর্জি আমার প্রেম" জাতীয় বাংলা ছবির বিদ্রূপবাণের ইঙ্গিত হওয়ার ব্যাপারে সে অপরিসীম সচেতন। টেক্সাস এ এন্ড এম - এ পিএইচ ডি রত অয়নের সাথে বিয়ের কথা সব ঠিকঠাক ছ'মাস ধরেই, তারপরও চট্ করে বিয়েটা হচ্ছেনা অনীতার গড়িমসির কারণেই। প্রথম দেখায় অয়নকে তার মন্দ লাগেনি, খাঁটি মার্কিনি উচ্চারণের ফর্সা এবং স্মার্ট ফিয়াঁসে নিয়ে আত্মীয় স্বজন বন্ধু এবং পরিচিতজনদের ঈর্ষা বেশ একটু আত্নশ্লাঘা মতও জাগিয়েছিলো, কিন্তু আশুলিয়ায় সেদ্ধ গরমের মধ্যে প্রথম চুম্বনমাত্রই সেটি অন্তর্হিত হয়। অত্যন্ত নির্বিষ ঢোঁড়াসাপের মত সেই পারফরম্যান্সের পর অয়নের 'হাউ ওয়াজ ইট ফর ইউ'এর উত্তরে সে শুধু বেশ একটু নোনতা - ছাড়া কোনো কথা খুঁজে না পেয়ে আক্ষরিক অর্থেই তথদধ মেরে যায়!
এরপর থেকে বহুবার উল্টেপাল্টে নানা দিক থেকে নানারকম ফন্দিফিকির করে সে এই অদ্ভুত আকর্ষণ নিয়ে ভেবেছে। চাই কি একটু আধটু এক্সপেরিমেন্ট করতে ভীষণভাবে উদ্বেলিতও হয়েছে। তার বয়স রুচি শিক্ষা পছন্দ সবের সাথেই আপাত পারম্পর্যহীন এই রুক্ষকেশ শীর্ণ দরজিওয়ালা ছেলেটির প্রতি তার এই নিষিদ্ধ আকর্ষণ ছেলেটির জন্যো সমানভাবে শিহরণ জাগানিয়া কি'না, হ'লেও সেটি কতটা আকাশের চাঁদ পাবার সমান এ নিয়ে রাতের বেলা দুষ্ট স্বপ্নে সে অনেকগুলো প্রহরও নষ্ট করেছে।
সেই সন্দর্ভে অনীতা আজ ড্যাভিডাফের কুল ওয়াটার মেখে, চুলে স্ট্রবেরী সেরাম সুগন্ধী ঢেলে, তার সবসময়কার ক্যাজুয়াল বাট স্মার্ট লুকে পেটে খিদে মুখে লাজ ভাবকে যথা সম্ভব সুপ্ত রেখে কিছুটা তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে এগোয় নাসেরের দিকে।
বাজার ঘুরে কেনা একগাদা ব্লাউজপিস ধপ্ করে তার সামনে রেখে কিছুটা চিন্তিত স্বরে জিজ্ঞেস করে "মাস্টার টেইলর সাহেব নেই?" এমন ভাবে যেন সে মাস্টার টেইলরের খোঁজেই এসেছিলো আর কি পরম একটা ক্ষতি হয়ে গেলো না পেয়ে!
"আমাকে দেন আপা,আপনাদের সব ব্লাউজ তো আমিই কাটি, আমি পারবো। হাসান দাদা নাই, আসলে আমি সব গুছায় বলে দিবো। "
"পারবে তো তুমি?" প্রেমের চেয়েও কঠিন বন্ধন বোধ করি শ্রেণীসংসর্গ বিচ্যুতি, অনীতা তাই আপনি বলার শিষ্টতা দেখিয়ে তুমিত্বের স্পর্ধাকে বিলীন না হতে দেবার প্রাণপণ চেষ্টায় মুখ যথাসম্ভব কঠিন রেখেই প্রশ্ন করে।
"পারবো আপা, আপনি মাপ আনছেন? নাইলে খাড়ান,মাপটা নিয়া নি?"
অনীতার মধ্যবিত্তীয় অপরাধবোধ তার ফর্সা মুখকে লালচে করে দেয়, মাপ সে ইচ্ছে করেই আনেনি, এটাই তার আগ্রহের উত্তুঙ্গ জায়গা। সুযোগ পেয়ে সে একটু আলগা হবে আর তার অনুভূতি নাসেরকেও সংক্রমণ করে কি'না সেটি জানার অপরিসীম কৌতূহলে বুকের ছাতি ফাটবার অবস্থা হয় তার –
সেটিকে ঢোঁক গিলে বিরক্তির প্রলেপ দিয়ে বলে "নাহ্ আনা তো হয়নি, আচ্ছা নাও তাহলে মাপ। তাড়াতাড়ি করো কিন্তু!"
নাসের কথা না বাড়িয়ে টেইলরিং টেপ হাতে নিয়ে এগোয় অনীতার সামনে, কাঁধ থেকে বাহু, হাতের গোল, গলার ডিপ, সবই অতি কেজো ভঙ্গিতে চটপট সারে। বুকের মাপ নিতে এসে দু'জনে মুখোমুখি দাঁড়াবার যে ঘনত্ব, তাতেই অনীতা টের পায় দু উরুর কাছটা উষ্ণ হয়ে উঠছে, চোখ বুঁজে হালকা করে সে হাতের কব্জি আর তালুকে শরীরের দু'পাশে ছড়িয়ে দেয়, কিছুটা বা নাসেরের কোমরের কাছেও স্পর্শ করে। নাসের টের পায় চিরচেনা নিস্পৃহতা আবারও তাকে গ্রাস করছে, এই উদ্ভিন্নযৌবনার সংস্পর্শেও নুয়ে পড়ছে তার পৌরুষ – বারবার মাথায় ঘুরছে বোতাম, সেলাই, কাট, বোতাম, সেলাই, কাট, বোতাম, সেলাই, কাট ...
কী এক তীব্র বিকর্ষণে সে সহসা টেপটা অনীতার বুকের চারদিকে ঘুরিয়েও ছেড়ে দেয় ... অনীতার চোখ খুলে যায়, তার বিস্ফারিত দৃষ্টিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে গলার কাছে আটকে থাকা দলার মত বিবমিষা নিয়ে নাসের আস্তে করে বলে,
"আপা,টেপটা ছিঁড়া গেছে। আপনার আম্মার থেকা বুকের ছাতি ছয় ইঞ্চি ছোট কইরা বানায় দিমুনে, সব ঠিক থাকবো ...
আপনের আম্মারটা আমি জানি।"