এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ইস্পেশাল  উৎসব ২০১২

  • কুড়ি বছর পরে এগারো মাইল

    সাক্ষাৎকার লেখকের গ্রাহক হোন
    ইস্পেশাল | উৎসব ২০১২ | ২৩ নভেম্বর ২০১২ | ১১৩১ বার পঠিত
  • [রুচির জোশি কলকাতার ছেলে। ১৯৯০ সালে বাউলদের নিয়ে একটি তথ্যচিত্র তৈরি করেছিলেন, নাম এগারো মাইল। ১৯৯১ সালে প্যারিসে আন্তর্জাতিক তথ্যচিত্র উৎসব সিনেমা দ্যু রইল-এ ছবিটি আমন্ত্রণ পায় এবং অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছবি হিসেবে জরিস ইভান্স পুরস্কার পায়। সেই ছবির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলেন সুরজিত সেন। কুড়ি বছর পড়ে তাঁরা সেই ছবিটি নিয়ে কথা বলেছেন। - সম্পাদক ]

    সুরজিত: দীপকদা (মজুমদার) বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে একটি অফিসে বসতেন। সেখানে আমি প্রথম তোমাকে দেখি।

    রুচির: হ্যাঁ, ওটা ছিল রূপা (মেহতা)দের  (যাদের ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে সাশা নামে হ্যান্ডিক্রাফটসের দোকান আছে। ) বাড়ির গ্যারেজ। রুপা তো দীপকদার ছাত্রীও ছিল, মিডিয়া স্টাডিজ কোর্সে, চিত্রবাণীতে।

    সুরজিত: ওই অফিস থেকে উনি মুভক্রাফট নামে কাগজটা এডিট করতেন। ওখানে আমি প্রায়ই যেতাম।

    রুচির: কাগজটা তো সাশারই একটা মুখপত্র ছিল। কয়েকটা ইস্যুতে আমিও ডিজাইন করেছি। ওখানে কী করতে যেতে?   

    সুরজিত: খুব যে কিছু একটা করতে যেতাম তা নয়। তবে গেলেই কিছু না কিছু গজিয়ে উঠত। দীপকদা আমাকে দিয়ে বিভিন্ন টেক্সট থেকে কিছু অনুবাদ করিয়েছিলেন, ইংরেজি থেকে বাংলা, ওই কাগজের জন্য। সেখানেই একদিন তুমি গিয়েছিলে, আমিও ছিলাম,তোমার সঙ্গে একটা ক্যামেরা ছিল ... 

    রুচির: আমার অলিম্পাস ক্যামেরা।

    সুরজিত: তুমি তোমার তোলা কিছু ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট ছবি নিয়ে এসেছিলে ওনাকে দেখাতে। সেদিন দীপকদা আমাদের আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন। তোমরা তারপরের দিন মেদিনীপুরের নয়াগ্রামে দুখুশ্যাম চিত্রকরের বাড়িতে যাবে সেই নিয়ে কথা হচ্ছিল।

    রুচির: ১৯৮৬।

    সুরজিত: তোমার সঙ্গে দীপকদার আলাপ কী ভাবে?

    রুচির:  আমি আজমীরে মেয়ো কলেজে পড়েছি। বোর্ডিংএ থাকতাম। ১৯৭৭ সালে স্কুল শেষ  করে কলকাতায় এলাম। তখন এমার্জেন্সি উঠে গেছে, সেন্ট্রালে জনতা সরকার, এখানে লেফট ফ্রন্ট, চারপাশে বেশ একটা হাসিখুশি ভাব। প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হয়েছি কিন্তু ক্লাস শুরু হতে দেরি। কিছু করার নেই, বাবার একটা নিকন এফ ক্যামেরা ছিল, সেটা নিয়ে ছবি তুলে বেড়াতাম। তো ক্যামেরাটা খারাপ হয়ে ছিল। কেউ একজন আমাকে  বলল যে, তুমি লতিফের কাছে যাও, হি ইজ দ্য বেস্ট। লতিফের দোকান ছিল অস্টিন ডিস্ট্রিবিউটার্সের অফিসের পিছনে, আই টি সির অফিসের পাশে। ওই একটা করত ইয়ার্ডের মতো জায়গা, যেখানে গ্যারেজ আছে, গুমটি দোকান আছে, লোকও থাকে। তখন কলকাতায় এরকম স্পেস ছিল। যাই হোক, ক্যামেরাটা দিয়ে এলাম। যেদিন আনতে গেলাম সেদিন একটি সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে আলাপ হল, আমার থেকে একটু বড়, সেও ক্যামেরা সরাতে এসেছে। তার নাম মুনমুন সেন। আমি তো জানি না কে মুনমুন সেন, অনেক পরে জেনেছি। যাই হোক, কথায় কথায় মেয়েটাই বলল, ইফ ইউ আর ইন্টারেস্টেড ইন ফটোগ্রাফি, ইউ শ্যুড গো টু চিত্রবাণী। দে আর রানিং আ মিডিয়া কোর্স। চিত্রবাণীতে আমার বন্ধু আনন্দ লালের বাবা পি লাল তখন ওনার করা মহাভারতের ট্রান্সলেশনটা ওঁদের সাউন্ড স্টুডিওতে রেকর্ড করতেন, আমিও আনন্দর সাথে একবার দুবার গেছি। দেন শী সেড, মানে মুনমুন সেন, দেয়ার ইজ আ ম্যান কল্‌ড দীপকদা, মিট হিম। তো আমি গেলাম। এখন চিত্রবাণীর বিল্ডিংটা অন্যরকম হয়েছে।  

    সুরজিত: আগে গেট দিয়ে ঢুকে ডানদিকে চার্চ আর বাঁদিকে চিত্রবাণীর বিল্ডিং ছিল। ওদের লাইব্রেরিতে আমি বহুদিন গেছি।

    রুচির: হ্যাঁ, সেখানে ডিপ্লোমা ইন মিডিয়া স্টাডিজ কোর্সে ভর্তি হব বলে গেলাম। দোতলায় একদিকে সাউন্ড স্টুডিও, বাইরে একটা ছোট অন্ধকার ঘরে কালো রোগা করে একজন বসে আছে। আমি ঘরে ঢুকতেই তিনি বললেন, ইয়েস। এরকম একটা ব্যারিটোন ভয়েস শুনে বেশ চমকে গেলাম।     আমি বললাম, মি: মজুমদার? উনি বললেন, ইয়েস। আমি বললাম, মাই নেম ইজ রুচির জোশি। উনি বললেন, হোয়াট ডু ইউ ওয়ান্ট? বললাম, আই হ্যাভ কাম ফর মিডিয়া কোর্স। উনি বললেন, মিডিয়া কোর্স? সিট ডাউন। হোয়াট ডু ইউ নো অ্যাবাউট মিডিয়া? হোয়াট আর দ্য মেজর মিডিয়া? আমি ভাবছি, কী রে বাবা, একটা ছোটখাটো লোক এরকম একটা গলায় বেশ বসের মতো একের পার এক প্রশ্ন করে যাচ্ছে। আমি বললাম, নিউজ পেপার, প্রেস, ফিল্ম, টেলিভিশন .... তখন আরো জোরে বলে উঠলেন, রেডিও? রেডিও ইজ নট আ মেজর মিডিয়া অফ দিস কান্ট্রি? আমি বললাম, হ্যাঁ, রেডিও রেডিও। ওই ভয় দেখিয়ে দিল আর বুঝিয়ে দিল হু ইজ দ্য বস। এরপর কিছু ফর্ম্যালিটি ছিল ভর্তি হওয়ার সেগুলো করে আমি দীপকদার ছাত্র হয়ে গেলাম। এইভাবে দীপকদার সঙ্গে আলাপ, ১৯৭৭ সাল সেটা।

    সুরজিত: তো মিডিয়া স্টাডিজ শুরু হল?

    রুচির: হ্যাঁ, আমি চিত্রবাণীতে পড়ছি আর প্রেসিডেন্সিতে ইংলিশ লিটারেচার পড়ছি, এদিকে মনে মনে ইচ্ছে ফিল্ম মেকার হব। ফ্রেঞ্চ ফিল্ম মেকারদের, স্পেশালি গোদার, ক্রফোঁ এঁদের ছবি খুব ভালো লাগত। এখানে সত্যজিৎ রায় দেখেছি, ঋত্বিক ঘটকের নাম শুনেছি সবে, ছবি দেখিনি, আর বেনেগাল দেখেছি। চিত্রবাণীতে গিয়ে আলাপ হলো শিবা চাচি, গৌতম চ্যাটার্জির সঙ্গে। এইসময় আমেরিকান ডকুমেন্টারি ফিল্ম মেকার নিক ম্যানিং, যে নিউইয়র্কের ব্রুকলিনে প্র্যাট ইন্সটিটিউটে ডকুমেন্টারি ফিল্ম তৈরি শেখাত। সে পুণেতে এসেছিল, চিত্রবাণীর ফাদার রোবের্জ তাকে কলকাতায় আনে আমাদের ওয়ার্কশপে নেবার জন্য। নিকের সঙ্গে ছিল পুরনো আরি ক্যামেরা আর ১৬ মিমি ফিল্ম। ও আমাদের লেকচার দিল, ছবি দেখাল, কিন্তু ওর বক্তব্য ছিল, বেশি কথা বলে লাভ নেই, লেটস ডু। ও বলল, আমার কাছে ক্যামেরা আছে, অল্প ফিল্ম  আছে, আমরা কলকাতায় সারাদিনের একটা শ্যুট করি। আমি ফিরে গিয়ে ফিল্ম টা প্রসেস করে তোমাদের একটা প্রিন্ট পাঠাব। তো, একদিন সকালে আমার বাবার গাড়িতে আমি, গৌতমদা, শেখর দাশ আর নিক, আমরা সারাদিন কলকাতায় শ্যুট করলাম, কুমারটুলি, কফি হাউস আর ভিক্টোরিয়া। সবাই ক্যামেরা চালাল, আমরা সেদিন প্রথম মুভি ক্যামেরা হাতে নিলাম এবং ছবি তুললাম। আমি ওই ফিল্ম রোলিং এর ক্রি...র...র আওয়াজে এত থ্রিল্‌ড হয়েছিলাম যে কী বলব। তখনকার পুরোনো বোলেক্স, আরি বা বোলিও ক্যামেরাতে এই আওয়াজটা হত। শ্যুটের পরে নিকের সাথে আড্ডা দেওয়ার সময় ও বলল, ফিল্ম স্কুলে পড়ে ফিল্ম শেখা যাবে না। যদি ডকুমেন্টারি বানাতে চাই, বেগ বরো অর স্টিল দ্য মানি অ্যান্ড জাম্প ইনটু ইট। সব পড়ে শিখে ফিল্ম বানাতে গেলে অনেক দেরি হতে পারে। এটা আমার জীবনের সেরা উপদেশগুলোর মধ্যে একটা। যে জাস্ট নেমে পড়, লাফিয়ে পড়।  

    সুরজিত: আর বাউলদের সঙ্গে কীভাবে দেখা হল?

    রুচির: ইয়েস, বাউল। ইতিমধ্যে আমি দেখছি দীপকদা চিত্রবাণীতে বাউলদের নিয়ে কাজ করছে আর সেলিম পাল ছবি তুলছে।

    সুরজিত: কী কাজ করছে?

    রুচির: অত মন দিয়ে দেখিনি কী করছে। ওই রুরাল কমিউনিকেশন ... এটসেটরা। আমার কোনও ইন্টারেস্ট ছিল না। শহরের ছেলে, শহর ভালোবাসি। গ্রাম নিয়ে  আমার কোনও ইন্টারেস্ট নেই। গ্রামে কোনদিন যাইনি। হঠাৎ একদিন দীপকদা বললেন, আমরা দীনবন্ধু বাউলের বাড়ি যাচ্ছি। তুমি কি যাবে ?    

    সুরজিত: মানে হাওড়ায়।

    রুচির: হ্যাঁ, আমি রাজি হয়ে তো গেলাম। হাওড়া থেকে বিকেল চারটের সময় আমরা বাস ধরলাম আর রাত আটটার সময় পৌঁছলাম। আমরা মানে, আমি, দীপকদা, মেয়েদের মধ্যে রূপা আর শিবা, গৌতম চ্যাটার্জী, শেখর দাশ আর কারা ছিল মনে নেই। আমি ভাবছি গ্রামে আমরা কেন চাল, ডাল নিয়ে যাচ্ছি? ওখানেই তো ওগুলো চাষ হয়। দীপকদা বললেন, তুমি এসব বুঝবে না। আমরা এতগুলো লোক যাচ্ছি ওদের বাড়িতে, থাকব, খাব। সেটা আমার প্রথম চটি পায়ে গ্রামের আলপথ ধরে হাঁটা। খুব ঠাণ্ডা। ইট ওয়াজ জানুয়ারী, সেভেনটি এইট। সামনে একজন হ্যাজাক জ্বেলে নিয়ে হাঁটছে, পিছনে আমরা। চাঁদের আলোও আছে। আমি বেশ কয়েকবার হোঁচট খেলাম, একবার প্রায় পড়ে যাচ্ছিলাম। অনেকটা হেঁটে গিয়ে পৌঁছলাম দীনবন্ধুর বাড়ি। উনি আর ওনার স্ত্রী আমাদের যে কী আদর করে বসালেন। আমি তো ওভারহোয়েলমড; যে, আমাদের চেন না তুমি এত প্রেম কী করে দেখাচ্ছ? ওনাদের ছেলে গোষ্ঠগোপালও ছিল। গোষ্ঠর গান কমার্শিয়ালি হিট করেছিল, রেকর্ড, ক্যাসেট সব ছিল। এনি ওয়ে, রূপা আজও কথা উঠলে বলে, যে, রুচির গ্রামে গিয়ে ছটফট করছে কখন বাড়ি যাবে? এত অসুবিধার মধ্যে পড়েছে। ঠিকই। আমি ভাবছি এখানে থাকব কী করে? ইলেকট্রিসিটি নেই, টয়লেট নেই। উঠোনে আসন পেতে বসছি। কথাবার্তার মধ্যেই গাঁজার কলকে হাতে হাতে ঘুরতে শুরু করল, রামের বোতলও খোলা হল, এবার গান শুরু হল।  সেই প্রথম বাউল গান শুনলাম। তারপর রাতটা কোনরকমে কাটিয়ে আমি ভোরবেলা বাড়ি আসব। বাকিরা বলছে আমরা তো দু-তিন দিন পরে যাব। আমি বললাম, দু-তিন দিন! নো ওয়ে। আর আমি ওসব মাঠে পায়খানা করতে পারব না। মানে তখন আমি ভাবতেই পারি না। পরে এগারো মাইলের সময় ওসব আমরা করেছি তুমি তো জানো। তখন সবাই আমাদের নিয়ে হাসাহাসি শুরু করল। আমি তখন পালাতে পারলে বাঁচি। শিবাও খুব হাসছে, ও শহরের মেয়ে হলেও প্রচুর গ্রামে থেকেছে আর দীপকদা এটা নোট করে খুব খুশি, যে রুচির তুমি এটা নিতে পারলে না। শেষে বেলা বারোটার সময় আমি ফিরে এলাম। এই হল বাউলের সঙ্গে আমার প্রথম এনকাউন্টার।

    সুরজিত: তারপর তুমি বিদেশ চলে যাও।

    রুচির: আমি তখন প্রেসিডেন্সিতে ইংলিশ লিটারেচার পড়ে বোর হয়ে গেছি। মানে মানে বুঝতে পারছি এখানে বেশিদিন পড়লে আমার ইংরেজি সাহিত্যের প্রেমটা উবে যাবে। আর লেফট ফ্রন্ট পাওয়ারে এসেছে বটে, কিন্তু ওই সময় কয়েক মাস বম্বে ঘুরে এসে বুঝলাম, কোলকাতা ক্রমশ পিছিয়ে যাচ্ছে। এর মাঝে আমি আমেরিকার একটা কলেজ থেকে স্কলারশিপ পেলাম। ফিল্ম মেকিং শিখব। এটার নাম গডার্ড কলেজ। ছোটো একটা কালচারাল কলেজ। ভারমেন্টে। নিউইয়র্কের নর্থে, খুব ঠান্ডা     ওখানে।

    সুরজিত: ওখানে তো রবার্ট ফ্রস্ট থাকত।

    রুচির: রাইট। সলঝেনেৎসিন যখন রাশিয়া থেকে পালিয়ে আমেরিকায় আসেন, তখন উনিও ভারমেন্টে থাকতেন। আমি ওখানে তিন বছর ছিলাম। মাঝে একবার শীতের সময় কলকাতায় দুমাস ছিলাম। তখন আবার দীপকদার সঙ্গে দেখা হয়। বসুধা জোশীর সঙ্গে আলাপ হয়, প্রাণজয় গুহঠাকুরতার সঙ্গে আলাপ হয়। শিবা তখন দিল্লি ফিরে গেছে। গৌতমদা মহীনের ঘোড়াগুলির গান নিয়ে ব্যস্ত। আমাদের সঙ্গে বিবেক বেনেগাল, শ্যামের ভাইপো, মিডিয়া স্টাডিজ নিয়ে পড়ত, ও ডাক্তারি পড়তে চলে গেছে।    

    সুরজিত: দীপকদা তখনও চিত্রবাণীতেই?

    রুচির: হ্যাঁ। আমেরিকায় ফিরে যাবার আগে একদিন দেখা করতে গেছি ওনার সঙ্গে। দেখি দুটো গ্রামের ছেলে ওখানে বসে। একটু অদ্ভুত দুজনেই। একজনের চুল জিমি হেন্ড্রিকসের মতো। আর একজনের কোঁকড়া চুল, দুজনকে খুব মিষ্টি দেখতে, একজন বেশি কালো। বেঁটে, পাতলা, রোগা কিন্তু খুব বিউটিফুল। ওরা দাঁড়িয়ে আছে, দীপকদার সঙ্গে কথা বলছে। আমি ঘরে ঢুকলাম, দীপকদা বললেন, আরে এসো এসো, আলাপ করিয়ে দিই। এ হল আমার ছাত্র রুচির আর এ হলো পবনদাস আর এ হলো গৌর ক্ষেপা। দে আর ফ্যান্টাস্টিক বাউল সিংগার। আলাপ হল ওদের সঙ্গে। ততদিনে আমি ইন্টারেস্টেড ইন বাউল। আমি সেলিম পালের ছবি দেখেছি, দীপকদার সঙ্গে বাউলদের নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। আমেরিকায় গিয়ে আমার নিজের দেশের বাস্তবতা নিয়ে আমার উত্সাহ বাড়ল। ওয়েস্টে গিয়ে ওয়েস্টটা দেখার পর আমার মনে হল নিজের রুটটা কী সেটা জানা দরকার। দীপকদার কাছে শুনছি, যে জর্জ লুনো বলে এক ফ্রেঞ্চ ফিল্মমেকার এসে বাউলদের ওপর একটা ফিল্ম করে গেছে। এই করে ওদের সঙ্গে আমার আলাপ হলো। আমি চলে গেলাম আমেরিকা।

    সুরজিত: তুমি কেতন মেহতার ছবিতে কাজ করেছিলে না?

    রুচির: ঠিক, বলছি সেটা। ওখানে কোর্সটা শেষ হবার পর এক বছর নিউ ইয়র্কে ছিলাম। এই ওয়েটার আর সব ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে কাজটাজ করে চালাতাম। তারপর শুনলাম কেতন মেহতা একটা ফিচার ফিল্ম করছে নাম ‘হোলি’। আমাদের একটা খুব দূরের পারিবারিক যোগাযোগ ছিল। যাই হোক, আমি     ঠিক করি কেতনকে অ্যাসিস্ট করব। বিদেশ থেকে ফিরে আমেদাবাদে কিছুদিন ওর সঙ্গে কাজ করলাম, এরপর ওর ছবিটা বন্ধ হয়ে যায়। আমি কলকাতায় ফিরে আসি। পরে কেতন ছবিটা শেষ করে। সেটা ১৯৮৩। দীপকদা সুইত্জারল্যান্ডে একটা থিয়েটার গ্রুপের সঙ্গে ওয়ার্কশপ করেছিলেন। যাদের সঙ্গে দীপকদা ওখানে কাজ করেছেন, সেই থিয়েটারে ব্রুনো বলে একটা ছেলে, লম্বা রোগা অভিনেতা। ও এসেছে কলকাতায়। দীপকদা ওকে চেনে,  বাউলরাও চেনে। একইভাবে দীপকদা বলছে, যেমন দীনবন্ধুর বাড়ি যাবার বেলা বলেছিল, আমরা পাথরচাপুরির মেলায় যাব। তুমি যাবে? আমি বললাম, যাব। আমরা মানে আমি, বিবেক, ব্রুনো আর দীপকদা। আর যাবার সময় গৌরকে বোলপুর থেকে তুলে নেব। আমরা গেলাম প্রথমে গৌরের বাড়ি। সেখানে গৌর আর ওর বউ হরির সঙ্গে আলাপ হয়। আর ওদের সঙ্গে রামানন্দ ছিল। সেখানে আমার রামানন্দের সঙ্গে প্রথম আলাপ। সেই প্রথম আমি সামনে বসে গৌরের গান শুনি। আর আমার চোখটা খুলে যায়। গৌরের গান রেকর্ডিঙে শোনা, ছবিতে দেখা আর সামনে বসে শোনা এবং দেখাও। ইট ওয়জ আ ম্যাজিক। সেই ঘোরটা কাটতে সময় লেগেছিল।

    তারপর আমরা বাসের মাথায় চেপে পাথরচাপুরি গেলাম। ওই মেলায় আমি প্রচুর স্টিলস তুলেছিলাম। বাউল-ফকির-মানুষ। দুদিন আমরা ওখানে থেকে ফিরে এলাম।

    সুরজিত: এখন আমার মনে পড়ছে, দীপকদা তখন 'দেশ' পত্রিকায় 'ছুটি' নামে একটা কলাম লিখতেন। এই ট্রিপটা নিয়ে একটা কলাম লিখেছিলেন।

    রুচির: হ্যাঁ, দীপকদা বলেছিলেন, কিন্তু আমি তো বাংলা পড়তে পারি না। পাথরচাপুরি থেকে ফিরে এসে একদিন অলিম্পিয়া বারে পবন আর মিমলুর সঙ্গে দীপকদা আলাপ করিয়ে দিলেন। মানে পবনের সঙ্গে আগেই আলাপ ছিল, মিমলুর সঙ্গে আলাপ হল। তারপর থেকে মাঝেমাঝেই গৌর, পবন, মিমলুর সঙ্গে দেখা হয়। দীপকদা কখনো এই গ্যাদারিংগুলোয় আছেন বা নেই। এরপর পবনরা প্যারিস চলে গেল। 

    সুরজিত: কখন তোমার মনে হল যে, এদের নিয়ে একটা ছবি করবে?

    রুচির: আমি পুরনো নিউ মার্কেট (পুড়ে যাবার আগে) নিয়ে একটা ফিল্ম করেছিলাম। ১৬ মিমিতে। দীপকদা সেই ছবিটার ক্রিটিসাইজ করলেও খুব সাপোর্টিভ ছিলেন। ওই ছবিটা খুব কিছু হয় নি। এখানে শর্ত ফিল্ম ফেস্টিভালে সিলেকশনের জন্য দিলাম। আদুর গোপালকৃষ্ণন জুরি ছিলেন। উনি রিজেক্ট করলেন। আমার বেশ রাগ হল। 

    সুরজিত: তুমি তারপর কী করেছিলে ?

    রুচির:ওই চিত্রবাণীতে ইউ জি সির ছোটো ছোটো ছবি করতাম লো ব্যান্ড ইউম্যাটিকে। এই সময় আলাপ হয় সিনেমাটোগ্রাফার সম্বিত বসুর সঙ্গে। সে একদিন আলাপ করিয়ে দিল মহাদেব শী নামে এক এডিটরের সঙ্গে যে এফ টি আই আই থেকে পাস করে এসেছে। তো ওর সঙ্গে আমি একটা ইউ জি সির ছবি করলাম। আমাদের বেশ ভালো টিউনিং হলো। ভালো এডিটর আর ভালো ছেলে। তাড়াতাড়িই বন্ধুত্ব হয়ে গেল। এদিকে রঞ্জন পালিতের সঙ্গে আলাপ হল। রঞ্জনের তখন বেশ নাম। ও এফ টি আই আই থেকে পাস করে আনন্দ পটবর্ধনের 'হামারা শহর বোম্বাই' শ্যুট করে বেশ নাম করেছে। আর আমি ইউ জি সির ছবি করি। আমার রঞ্জনকে বলার সাহস নেই কি তুমি আমার জন্য শ্যুট করবে? ও তখন বসুধার (জোশী) সঙ্গে থাকছে, বসুধা আমার বন্ধু। আমি ওকে বললাম যে আমার খুব কম বাজেট, আমি তোমাকে কী করে শ্যুট করতে বলব? ওই ইউ জি সির ছবির জন্য। ও বলল যে, ফাইন, টাকাটা সব সময় ফ্যাক্টর নয়। আমি তোমার জন্য শ্যুট করব।

    সুরজিত: তখন এই করেই চালাচ্ছিলে?

    রুচির: ওই টেলিগ্রাফ কাগজে মাঝে মাঝে লিখতাম, কোনো স্টিল ফটোগ্রাফির কাজ পেলে করতাম আর ইউ জি সির ছবি। বাবা থাকতে খেতে দিচ্ছে আর একটু সাপোর্ট করছে। কোনও কাজ নেই। বাবা মায়ের বন্ধুরা বলছে তোমার ছেলে কী করবে? ওর তো কিছু হবে না। আমাকে বোম্বেতে অ্যাড ফার্মে কাজ করে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন তাঁরা। কিন্তু আমি তো হব আর্টিস্ট, ফিল্মমেকার। রয়ে গেলাম এখানে। তো, রঞ্জনের সঙ্গে ইউ জি সির কাজ করে বেশ ভালো লাগল। আর আমি দেখলাম, রঞ্জনের কাজটা আমার ভাবনাকে আরও রিচ করছে, মানে সমৃদ্ধ করছে। আমি তো ফটোগ্রাফি থেকে ফিল্ম করতে এসেছি আর রঞ্জনের ভিস্যুয়াল সেন্সটা আমার ফ্রেমে অনেক কিছু যোগ করছে।

    সুরজিত: তোমরা তিনজনে একটা টিম হলে? এই টিমটাই এগার মাইলে ছিল।

    রুচির: না, এগার মাইলে তুমিও এলে। চারজনের একটা টিম হল।

    সুরজিত: ওই বোড়ালে মিমলু উৎসব করেছিল, তখন মহাদেব আবার তোমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল। তুমি ভুলে গেছিলে কিন্তু আমার মনে ছিল।

    রুচির: তুমি মহাদেবকে চিনলে কী করে ?

    সুরজিত: তোমাদের এই মিন্টো পার্কে অশোকা হল স্কুলের পাশের বিল্ডিং এ ইনফোকম বলে একটা ভিডিও প্রডাকশন হাউস ছিল। ওরা টিভিতে নানারকম সিরিয়াল করত, সেই ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট টিভির যুগে, যখন ন্যাশনাল আর রিজিওনাল টিভি ছিল। বাংলা প্রোগ্রাম চলত সাড়ে ৬টা থেকে রাত ৮টা অবধি, তারপর দিল্লি দূরদর্শন। ওই ইনফোকমের একটি সিরিয়ালের একটা এপিসোড মহাদেবের গ্রাম, হাওড়া-তারকেশ্বর লাইনে দিয়াড়াতে শ্যুট হয়েছিল, সেই সময় শ্যুটিংএ আমিও গেছিলাম। তখন ভালো করে আলাপ হল।  

    রুচির: ও কে। ইট ওয়াজ নাইনটিন এইটটি এইট। মিমলু-পবন প্যারিস থেকে ফিরে এসেছে। দীপকদা চিত্রবাণী ছেড়ে দিয়েছেন, সাশার কাগজের এডিট করেন। মিমলু বলল যে, ওরা বোড়ালে একটা উৎসব করবে।

    সুরজিত: মিমলুর পারিবারিক সুত্রে পাওয়া জমি ওখানে আছে। ওরা থাকত ঝাউতলার বাড়িতে, মাঝে মাঝে ওখানে যেত।
    রুচির: হ্যাঁ, তো আমি ভাবলাম এই উৎসবটা নিয়ে যদি তিরিশ মিনিটের একটা ডকুমেন্টারি করি, হাই ব্যান্ড ইউম্যাটিক ভিডিওতে, তাহলে কেমন হয়। কারণ ফিল্মে করতে পারব না, ফিল্ম খুব এক্সপেনসিভ মিডিয়াম। তখন মিমলুকে বললাম, যে, ওই উৎসবটা আমি শ্যুট করব। ওটা ফেব্রুয়ারির শুরুতে হয়েছিল। কিন্তু জানুয়ারিতে আমরা(আমি, মা বাবা) বম্বে গিয়েছিলাম একটা পারিবারিক বিয়ে অ্যাটেন্ড করতে। সেখানে আমার বাবার ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক হয়। তারপর উনি সামলে নিলে, মা আর বাবা আমেদাবাদ চলে যান আর আমি কলকাতায় ফিরে আসি ওই উৎসবটা শ্যুট করব বলে। আমার মন খুব খারাপ, বিকজ অফ মাই ফাদার, কিন্তু বাউলদের ব্যাপারটা আমাকে ভীষণ হণ্ট করছিল।

    সুরজিত: কিন্তু আমরা তো বোড়ালে গোবিন্দ নিহলনির অ্যাটন ক্যামেরা দিয়ে ফিল্মে শ্যুট করেছিলাম, ভিডিওতে নয়। রঞ্জন ক্যামেরা করেছিল।

    রুচির: বলছি সেটা। আমি কলকাতায় ফিরলাম জানুয়ারি এন্ড। তখন মঞ্জিরা দত্ত, ডাকনাম তৃপ্তি, সে একটা ডকুমেন্টারি ফিল্ম করছিল তার নাম 'ডেথ অব বাবুলাল ভূঁইয়া'। বাবুলাল একজন পলিটিক্যাল অ্যাক্টিভিস্ট ছিলেন বিহারে কোল মাইন এরিয়ায়, কোল মাফিয়ারা তাঁকে খুন করে। বেশ ভাল ছবি। রঞ্জন সে ছবির ক্যামেরা করবে, ওরা তখন বিহারে শ্যুটের প্ল্যান করছে। শুনলাম গোবিন্দ নিহলনির দামি অ্যাটন ক্যামেরা আসছে শ্যুটিঙের জন্য। ওরা যেদিন শ্যুট শেষ করে বম্বে যাবে, তারপরের দিন বোড়াল উৎসব শুরু। রঞ্জন বলল, এই ক্যামেরাটা আছে, ফিল্মে শ্যুট করলে ভালো হয়। সিক্সটিন মিলিমিটার ফিল্মে শ্যুট করলে আমারও ভালো লাগবে। কিন্তু অত টাকা ছিল না। মহাদেব বলল, আমার কাছে কিছু টাকা আছে। আমার কাছেও কিছু টাকা ছিল। এইসব মিলিয়ে মিশিয়ে সাত / আট রোল ফিল্ম কেনা হল। আর কোয়ার্টার ইঞ্চ টেপ কিনলাম মেট্রো গলি থেকে।

    সুরজিত: আজও ওই একই দোকান থেকে টেপ কিনি।

    রুচির: আমিও দরকার পড়লে কিনি। তো রঞ্জন ফোনে নিহলনির সঙ্গে কথা বলে জানাল যে ক্যামেরার ভাড়া লাগবে না, কিন্তু যে দুদিন ক্রুরা হোটেলে থাকবে তার পয়সা দিতে হবে। আমি রাজি হয়ে গেলাম। কিন্তু শ্যুটের পর ফিল্মটা কোথায় এডিট করব, কত টাকা লাগবে, কোনও অঙ্ক নেই। শুধু একটা এক্সাইটমেণ্টের ঝোঁকে, ওই যে নিক ম্যানিং বলেছিল, লাফিয়ে পড়। তাই লাফিয়ে পড়লাম।
     
    সুরজিত: বোধহয় ফেব্রুয়ারির ছয় তারিখ ছিল সেটা।

    রুচির: হ্যাঁ। সেখানে তোমার সঙ্গে আবার আলাপ হয়। সুবলদা, হরি গোঁসাই, মা গোঁসাই এদের সঙ্গে আলাপ হয়।

    সুরজিত: সেই সময় তোমার সঙ্গে গীতা (সেহগল)-রও আলাপ হয়। আমার মনে আছে, সন্ধ্যেবেলা এই ঘরে বসে আমরা কাজ করছি বা মদ খাচ্ছি, আর ওই লাউঞ্জে একটা কালো ভারি টেলিফোন ছিল, সেটা ভীষণ জোরে বেজে উঠত রাত আটটা – সাড়ে আটটা নাগাদ। ওটা লন্ডন থেকে গীতার ফোন। তুমি কান খাড়া করে থাকতে কখন ফোনটা আসবে।

    রুচির: গীতার সঙ্গে আলাপ ওই জানুয়ারিতে যখন বম্বে গিয়েছিলাম তখন। বসুধা আর গীতা বন্ধু ছিল, ওরা লন্ডনে এক অর্গানাইজেশনে কাজ করত। কোম্পানির নাম বাণ্ডুং ফিল্মস। ডকুমেন্টারি ফিল্ম প্রোডিউস করত। বিখ্যাত মার্ক্সিস্ট লেখক অ্যাক্টিভিস্ট তারিক আলি আর ওয়েস্ট ইন্ডিজের মার্ক্সিস্ট অ্যান্ড অ্যাক্টিভিস্ট ডার্কস হাউজ এরা ওই কোম্পানিটা চালাত। গীতা আর বসুধা ওখানে রিসার্চার হিসেবে কাজ করত। গীতা বম্বেতে বাণ্ডুং এর জন্য কয়েকটা ছোটো ছোটো ফিল্ম বানাতে এসেছিল। রঞ্জনের এক্স ওয়াইফ রুমি ওর বাড়িতে একটা পার্টি দিয়েছিল, সেখানে গীতাও ছিল। রুমি রঞ্জন, বসুধা আর আমাকে ডেকেছিল। সেখানে গীতার সঙ্গে আমার আলাপ। আর আমাদের রিলেশনশিপটা স্টার্ট হয়।

    সুরজিত: বোড়ালে উৎসবটা ভালই হয়েছিল। প্রচুর গান হয়েছিল আর একটা সুন্দর ভাব ছিল পুরো ব্যপারটার মধ্যে।

    রুচির: আমরা বোড়ালে সকাল থেকে মাঝরাত পর্যন্ত শ্যুট করলাম বোড়ালে। পরেরদিন সন্ধ্যেবেলা রবীন্দ্র সরোবরের মঞ্চে।

    সুরজিত: তখন ওটা ওপেন এয়ার থিয়েটার ছিল। এখন তো ক্লোজড হল, নাম নজরুল মঞ্চ।

    রুচির: ওখানে কনসার্টটা ভালো জমেনি। যদিও সুবলদার ওই দিল দরিয়ার মাঝে দেখ / আছে মজার কারখানা গানটা ব্রিলিয়াণ্ট ছিল। ওটা আমরা ফিল্মে রেখেছিলাম। কিন্তু গৌর আসেনি, ওর পবনের সঙ্গে কী সব ঝগড়া হয়েছে। মানে ও তখন থেকেই এই ঝগড়ার ট্রিপটায় ঢুকে গেছে।

    সুরজিত: আর পবন গেয়েছিল চাই আনন্দ চাই প্রেম।

    রুচির: রঞ্জন খুব ভালো কাজ করেছিল হ্যান্ডহেল্ড ক্যামেরায়। আমি দেখলাম ট্রাইপড আছে, ব্যবহার করব। কিন্তু বাউলদের এই আনপ্রেডিকটিবিলিটি আর নানা রকম ভাব ধরতে গেলে এটা হ্যান্ডহেল্ড ক্যামেরা করতে হবে আর এটার একটা ফ্রি মুভমেন্ট চাই। যেটা রঞ্জন খুব ভালো করেছিল থ্রু আউট দ্য ফিল্ম। তো ক্যামেরা শেক ছিল, আন্ডার এক্সপোজ ছিল, আউট অব ফোকাস ছিল এসবই আমি ছবিতে ইনকরপোরেট করেছিলাম। বুঝেছিলাম বাউলদের নিয়ে ছবি করতে গেলে এগুলো হবে। সেটাই ফিল্মটার ক্যারেকটার। এখন তো এগুলো স্টাইল হয়েছে। তখন ফিল্মে এগুলো অ্যাভয়েড করা হত। আর তা ছাড়া আমি ঠিক করেছিলাম, একটা রিয়ালিস্টিক, এথনোগ্রাফিক স্ট্রেট ডকুমেন্টারি ফিল্ম বানাতে চাই না। আমি কী বানাবো আমি জানি না, কিন্তু আমি জানি, আমার কিছু কিছু স্টাইলাইজড লাগবে, কিছু কিছু আনরিয়ালিস্টিক লাগবে, আর কিছু কিছু রিয়ালিস্টিক লাগবে। বাউলদের নিয়ে কাজ করব, আমি দেওয়ালে একটা মাছির মতো, অদৃশ্য থাকব আর বাউলরা ওদের এক্সোটিক জিনিসগুলো করে যাচ্ছে, আমি সেইগুলো ক্যাপচার করেছি, সে রকম ছবি আমার করার ইচ্ছেও ছিল না, সম্ভবও ছিল না। গৌর, পবন, হরি গোঁসাই দে আর ভেরি মাচ ক্যামেরা কনশাস। তো ক্যমেরা নিয়ে ঢুকলেই জিনিসটা অন্য রকম হয়ে যাচ্ছে। এটা ভিডিও নয় যে, তুমি ক্যামেরাটা চালিয়ে ভুলে গেলে, তারপর দশ ঘন্টার একটা ফুটেজ থেকে তুমি একটা পঞ্চাশ মিনিটের দারুণ ছবি বানালে। সেটা এখানে হওয়ার কথা নয়। দশ মিনিটের রোল আমাকে সব সময় খেয়াল রাখতে হচ্ছে কখন ক্যামেরা অন করব আর কখন অফ করব। এখনকার এই ডিজিটাল জমানায় তো এটা কোনও সমস্যাই নয়।

    সুরজিত: তারপর ওই শ্যুটিং রাশটা সল্ট লেকে প্রিন্ট করা হয়েছিল।

    রুচির: রূপায়ণ। স্টেট গভর্নমেণ্টের। ওখানে চারজন তামিল কাজ করতো যারা নাকি ম্যাড্রাসের প্রসাদ ল্যাব থেকে এসেছিল। কিন্তু ওরা আমাদের ফিল্মটা প্রিন্ট করতে গিয়ে ড্যামেজ করেছিল। যেটা পরে অনেক টাকা খরচা করে ঠিক করতে হয়েছিল।

    সুরজিত: পয়সা ছিল না বলে আমরা রাশটা ব্ল্যাক অ্যাণ্ড হোয়াইটে প্রিন্ট করেছিলাম, তাই প্রিন্টের গোলমাল বোঝা যায়নি।

    রুচির: ইয়েস। ঐ এইট্টিএইটে, জুনের লাস্ট উইকে বাবার সেকেন্ড অ্যাটাক হয়, জুলাই চার তারিখে উনি মারা যান। তার আগে ম্যাক্সম্যুলার ভবনের প্রজেক্টরে একদিন বাবাকে ঐ বোড়াল আর রবীন্দ্র সরোবরের রাশগুলো দেখিয়েছিলাম। বাবার সিনেমা দেখার অভ্যাস ছিল, লেখক মানুষ, গুজরাতি ভাষায় ছোটগল্প লিখতেন।
     
    সুরজিত: তোমার বাবা, শিবকুমার জোশী, উনি তো সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার পেয়েছিলেন গুজরাতি ভাষার গল্পকার হিসেবে।

    রুচির: হ্যাঁ। বাবার বেশ কয়েকটা ছোটো গল্পের কালেকশন আছে। গুজরাতি সাহিত্যে ওনার লেখা লোকে পছন্দ করে। উনি দেখে বলেছিলেন, খুব ভালো জিনিস ধরেছ। এই ফিল্মটা কিছু একটা হবে। তো বাবা মারা গেলেন। আমি খুব আপসেট। ফ্রি লান্স করে চালাচ্ছি। এর মধ্যে আই টি সির সঙ্গে একটা যোগাযোগ হয়।
     
    সুরজিত: গোল্ড ফ্লেক কিংস ...

    রুচির: হ্যাঁ, ওরা কিছু টাকা দিতে পারে। ওদের একটা ২০/ ২৫ মিনিটের ছবি করে দিতে হবে, গোল্ড ফ্লেক কিংস প্রেজেন্টস...

    সুরজিত: এই জন্য তোমাকে সপ্তাহে ২/৩টে মিটিং করতে হত।

    রুচির: গোল্ড ফ্লেক কিংসের ব্র্যান্ড ম্যানেজার মিঃ হাসান, তার কাছে ভালো জামা কাপড় পরে মিটিং করতে যেতাম।

    সুরজিত: শুধু তাই নয়, প্রত্যেক বার যাবার আগে এক প্যাকেট গোল্ড ফ্লেক কিংস কিনে নিয়ে যেতে। একবার আমিও তোমার সঙ্গে গিয়েছিলাম।
     
    রুচির: ওদের ওই বাজে সিগারেটটা ব্র্যান্ড ম্যানেজারের সামনে বসে খেতে হোতো।ওরা চাইছিল বাউল –এথনিক মিউজিক –সেকুলারইজম এটসেটরা নিয়ে একটা ছবি। এরপর জিজ্ঞেস করেছিল, বাউলরা কি ফিল্মে গোল্ড ফ্লেক কিংস খাবে? আমি বললাম, না, গোল্ড ফ্লেক কিংস খাবে না, কিন্তু দে স্মোক। ওরা রাজি হল, আমাদের পঁচিশ হাজার টাকা দিয়েছিল। আমি একটা কিছু কাজ করে খানিকটা টাকা পেয়েছিলাম। দুটো মিলিয়ে আবার শ্যুটিং চালু।

    সুরজিত: ওই টাকা পাবার পর আমরা পবনকে নিয়ে একটা রাত পার্ক স্ট্রিটে শ্যুট করেছিলাম। গোরা তুই আমারে পাগল করিলি রে গানটা পবন গেয়ে ছিল।

    রুচির: তখন এন এফ ডি সির আরি এস আর ক্যামেরা নিয়ে শ্যুট করা হল। তখন আমি ভাবছি যে ছবিটা নিয়ে এগনো যাবে। এরা যে টাকাটা দিয়েছে সেটা দিয়ে একটা ট্রেলার করে অন্য কোথাও যদি ফান্ডের জন্য আপ্রোচ করা যায়।
     
    সুরজিত: তারপর থেকে কিছুদিন আমাদের বেহালা আর সল্ট লেক এর মাঝে দৌড়োদৌড়ি করতে হয়েছিল। তোমার ওই কালো মার্ক টু আম্বাসাডারটা ছিল আমাদের প্রোডাকশন কার।

    রুচির: WBJ 5874। আমার বাবার গাড়ি। আর আমি ড্রাইভার। তোমরা কেউ গাড়ি চালাতে জানো না। আমার ফিল্মের আমি ডিরেকটার আর শালা আমিই ড্রাইভার। তিন বছর ধরে এগারো মাইল তৈরি হয়েছে, বেশির ভাগ সময়টা আমাকে ড্রাইভারি করতে হয়েছে।

    সুরজিত: আর তুমি ড্রাইভ করতে পছন্দ করতে না। খালি বলতে ট্যাক্সি নেব। আর মহাদেব বলতো, না, না শুধু শুধু পয়সা খরচা করার দরকার নেই।
     
    রুচির: নট ওনলি দ্যাট, ও বলতো, এই রুচির তোর ট্যাক্সিটা নিয়ে চল না। আর কলকাতায় ড্রাইভ করা যে কী জিনিস। এনি ওয়ে ... বেহালায় এন এফ ডি সির স্টুডিওতে একটা স্টিনবেক এডিট মেশিন ছিল, সেখানে মহাদেব এডিট করতো আর সল্ট লেকে শ্যুটের রাশ প্রিন্ট করা হত।

    সুরজিত: পার্ক স্ট্রিটে কোডাকের দোকান থেকে র স্টকটা তুলতে হত।

    রুচির: তার আগে ক্যামাক স্ট্রিটে শান্তিনিকেতন বিল্ডিং এ এন এফ ডি সির অফিসে তেল মেরে ফিল্মের পারমিট তুলতে হত। ওরা এমন ভাব করতো যেন আমাকে পারমিট দিয়ে ধন্য করে দিচ্ছে অথচ কিনছি আমি।

    সুরজিত: কোডাকের দোকানে চক্রবর্তীবাবু বলে কালো রোগা করে এক ভদ্রলোক ছিলেন, খুব নিচু গলায় আস্তে আস্তে কথা বলতেন, উনি আমাদের খুব ফেভার করতেন। যখনই আমি স্টক তুলতে গেছি বলতেন, আরও দুটো রোল আপনাদের জন্য রেখেছি, পারমিট করিয়ে আনুন।

    রুচির: চক্রবর্তীবাবু আমাকে বলেছিলেন ওনার বাউল গান ভালো লাগে, আমি ওঁকে সেট করে রেখেছিলাম, যাতে স্টক এলেই আমরা প্রথম পাই। নইলে ওই সময় সিক্সটিন মিমি ফিল্মের যা ডিম্যাণ্ড ছিল, মানে ওই ফিচার ফিল্মের জন্য। উনি আমাদের কয়েকটা ফ্রি টেস্ট প্রিন্টার রোলও দিয়েছিলেন। তিনটে দিয়েছিলেন। একটা হাই স্পিড ফিল্ম, একটা ইন্টার মিডিয়েট ডে লাইট ব্যলান্সড ফিল্ম আর একটা ফিফটি এ এস এ-র রোল।
     
    সুরজিত: এরপর আমরা ডিসেম্বরে শান্তিনিকেতনে পৌষ মেলায় গেলাম।

    রুচির: রঞ্জন তখন কলকাতায় ছিল না। মহাদেব সাউন্ড করবে, আমি একটা পুরোনো আরিফ্লেক্স বি এল ক্যামেরা নিয়ে গেলাম। ইট ওয়াজ ডিসাসটার শ্যুট। সান গান নিয়ে যাচ্ছি, কিন্তু ক্যামেরাটা হ্যান্ডেল করাও আমার পক্ষে মুশকিল হচ্ছে। ও রকম একটা ভারি পাথরের মতো ক্যামেরা কাঁধে নিয়ে হ্যাণ্ডহেল্ড করার কোনও চান্স নেই। ট্রাইপডে আমার মুভমেন্ট খারাপ। গৌর নেই, পবন আর সুবলদা আছে। দিনের বেলা কিছু হচ্ছে না, রাতে যেটা হচ্ছে সেটা খুব বোরিং। একটাই ভালো জিনিস ছিল, এগেইন সুবলদা দিল দরিয়ার মাঝে গাইলেন। যেটা আমরা ফিল্মে ব্যবহার করতে পারলাম।
     
    সুরজিত: আমাদের সঙ্গে একটি পাকিস্তানি মেয়ে গিয়েছিল, সেহেবা, যে টেলিগ্রাফে কাজ করত।

    রুচির: ঠিক। এরপর জানুয়ারিতে আমরা জয়দেব যাই। শিবা চাচি দিল্লি থেকে এসেছিল তখন। ও আমাদের সঙ্গে জয়দেব গেল।

    সুরজিত: দীপকদার উত্‍সাহ ছিল ছবিটার জন্য।

    রুচির: হু ম ম ... ছিল। দীপকদার তখন ফিল্মের সঙ্গে সম্পর্কটা এই, যে, হ্যাঁ, তুমি কর, আমি বেশি কিছু বলতে চাই না। আর বাউলদের সঙ্গে ওনার নানা রকমের ডায়নামিকস ছিল। উনি বুঝেছিলেন, আমি যদি খুব ক্লোজলি এই ছবিতে জড়িয়ে পড়ি তাহলে রুচিরের প্রবলেম হবে। তাই উনি একটু দূর থেকে ব্যাপারটা দেখতেন। জানুয়ারিতে কারোর একটা পুরোনো আরি এস টি ক্যামেরা নিয়ে জয়দেব মেলায় যাই। সঙ্গে রঞ্জন আর মহাদেব। স্টুডিও পাড়ার গ্রিন রঙের ম্যাটাডোর নিয়ে আমরা রওনা দিলাম।

    সুরজিত: সেখানে আমাদের আলাপ হয় কার্তিকের সঙ্গে। জয়দেব মেলা নিয়ে খুব একসাইটেড ছিলাম আমরা।

    রুচির: কিন্তু জয়দেবে গিয়ে আরও প্রবলেম। ক্যামেরার ভেতর ফিল্মটা কী করে জানি পেঁচিয়ে যাচ্ছিল, খুলে দেখা গেল ভেতরে কাঁচা ফিল্মের একটা ফুল হয়েছে। জুম লেন্সটা হারিয়ে গেছে, তারপর কার্তিক ওটা হারাধন বাউলের কাছ থেকে উদ্ধার করে আনে। মাথা খারাপ হয়ে যাবার মতো অবস্থা। ক্যামেরার ব্যাটারির চার্জ করতে পারছি না, পাওয়ার কর্ডটা পাওয়া যাচ্ছে না। অ্যাটেন্ডেণ্ট সেটা আনতে ভুলে গেছে বা হারিয়ে ফেলেছে। টিপিক্যাল একটা বেঙ্গল প্রবলেম সিচুয়েশনের মধ্যে কোনও রকমে শ্যুট করছি। তার ওপর হেভি ক্রাউড, সাউন্ড রেকর্ড হচ্ছে ক্যাসেটে। তমালতলায় গৌর সুবলদাকে নিয়ে হাসাহাসি করছে। বলছে, উনি রসিক, উনি কিন্তু সালসাতে মালসা ভোগ খেয়ে থাকেন, বুঝেছ শিবা, হা হা হা। এর মধ্যেই শ্যুট চলছে। মনে হচ্ছে কিছুই পাচ্ছি না। তখন আবার মনে হলো, এটা একটা সুন্দর, ভালো ফুটেজ তোলা ফিল্ম হবে না। ওই টেনশনের মধ্যে ক্রিয়েটিভলি শ্যুট করার কোনও জায়গা নেই।

    সুরজিত: পৌষ মেলা আর জয়দেব মেলা বাইশ দিনের তফাতে দুটো শ্যুটই খুব ফ্রাস্ট্রেটিং হয়েছিল।

    রুচির: জয়দেব থেকে ফেরার পথে কার্তিক একটা জায়গায় নেমে গেল। বলল, এই জায়গাটার নাম এগারো মাইল। আমি বললাম, এর মানে কী? বলল, জায়গার নামই এগারো মাইল। বুঝলাম, এটা অনেক পুরোনো নাম। তখনই মহাদেবকে বললাম, এই ছবিটার নাম ইলেভেন মাইলস।

    সুরজিত: এই নামটা নিয়ে আমরা খুব এক্সাইটেড হয়েছিলাম। শুনে মনে হয়েছিল, যে, একটা এগিয়ে যাবার কথা এই শব্দটার মধ্যে লুকিয়ে আছে। আসলে আমরা বলছিলাম ইলেভেন মাইলস। গ্রাফিক্যালি ইলেভেন নাম্বারটা দেখলে মনে হয় দুটো পা, একটা হাঁটার অ্যাসোসিয়েশন আসে।
     
    রুচির: আর পাঁচটা ইন্দ্রিয় আর ছয়টা রিপু মিলেও এগারো হয়, যাদের বিষয়ে বিভিন্ন বাউল গানে বার বার সাবধান করা হয়েছে। সুবলদার একটা গানে আছে, চিরজীবন বাঁধা রইলি ছক্কা পাঞ্জার হাতেতে / এসেছ বসেছ ভবে তাস খেলিতে ... তো জয়দেব শ্যুটিঙে আমি খুব ডিসঅ্যাপয়েন্টেড।

    সুরজিত: পরে যখন রাশটা দেখে বোঝা গেল, তমালতলার অংশটা খুব ভাল এসেছিল।

    রুচির: আর ওই কার্তিক মন্দিরের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে, হাঁড়িগুলো রাখা আছে সেটাও খুব ভালো এসেছে .....রঞ্জন খুব ভাল শ্যুট করেছিল। জয়দেব মেলার পরে আমরা প্রেসিডেন্সি কলেজে বাউলদের গানের প্রোগ্রাম শ্যুট করলাম। এন এফ ডি সির আরি এস আর ক্যামেরা দিয়ে। সেটা খুব ভালো হয়েছিল।

    সুরজিত: সনাতন দাস গেয়েছিলেন এখনো এলো না কালিয়া। পুরো গানটার অডিও ভিসুয়াল তোমার কাছে আছে, এটা একটা রেয়ার ফুটেজ।

    রুচির: দেন উই ওয়েণ্ট টু মাটিয়ারি। গৌরের বাড়ি। তুমি সেই ট্রিপটায় ছিলে না।

    সুরজিত: আমার পারিবারিক সমস্যা ছিল সে সময় তাই যেতে পারিনি।

    রুচির: সেবার আমি, রঞ্জন আর মহাদেব। সঙ্গে ক্যামেরা নিয়ে এন এফ ডি সি র জয়ন্ত। খুব ভালো মেটিরিয়াল পেয়েছিলাম। গৌরের সেই একের পর এক গান, আবাদ হলো না দেহ জমি, মরণ কারোর কথা শোনে না, ঢাকা শহর ঢাকা যতক্ষণ, হরি দুখ দাও যেজনা রে। গৌর ওয়াজ ম্যাগনিফিসিয়েণ্ট। ওর বাড়িতে তখন ক্যাথরিন বলে একটি আমেরিকান মেয়ে, অ্যানথ্রপলজিস্ট, থাকে। সে গৌরের ঘর ঝাঁট দিত আর মুছতো রোজ। আর ছিল হরি আর ওর নয়টা বেড়াল। হরির মা মীরা মোহান্তির সঙ্গে আলাপ হলো। সেই শ্যুটটাতে আই ওয়াজ ভেরি হ্যাপি। আগের শ্যুটগুলোতে দেখছি যে, রঞ্জন খুব চমত্‍কার জুম লেন্সের ব্যবহার করেছে। এই শ্যুটটায় আমি চেয়েছিলাম একটা অন্য লুক পেতে, অন্য একটা ফ্রেমে বিষয়টা দেখতে। তাই মহাদেবের সঙ্গে ডিসকাস করে জয়ন্তকে বললাম, রঞ্জন জুম লেন্স চাইলে বলবে আনতে ভুলে গেছি। আমরা শুধু ব্লক লেন্স দিয়ে শ্যুট করব। তো শেষ পর্যন্ত রঞ্জনকে বলা হল যে, জুম লেন্স আছে, কিন্তু ব্লক লেন্সেই শ্যুট করতে চাই। ও মাঝে মাঝে বলছে, এই রুচির, নাও আই নিড টেলি, আমি বলছি, নো ডু ইট উইথ ব্লক লেন্স। রঞ্জন ব্লক লেন্সে যে ভাবে গৌরের সঙ্গে ইণ্ট্যারাক্ট করে ছিল, ইট ওয়াজ ব্রিলিয়ান্ট।

    সুরজিত: গৌরকে লিটন হোটেলে শ্যুট করাটা ভুলব না।

    রুচির: উফ, কী ঝামেলা। যেদিন আমরা লিটন হোটেলে শ্যুট করছি তার পরের দিন ভোরের ফ্লাইট ধরে ও যাবে লস আঞ্জেলিস, ক্যাথরিন ওকে নিয়ে যাবে। আমাদের সঙ্গে দীপকদাও ছিলেন। সেদিন গৌরের সঙ্গে দীপকদার প্রচণ্ড ঝগড়া লেগে গেল। ও আশট্রে ছুঁড়ে মারবে দীপকদাকে। ক্যামেরা ভেঙে যাবে এই ভয়ে আমি ক্যামেরাটা ঘরের বাইরে রাখলাম, কিন্তু সাউন্ড অন ছিল, পুরো ঝগড়াটা রেকর্ড করা আছে।

    সুরজিত: আচ্ছা, এবার চ্যানেল ফোরের সঙ্গে যোগাযোগের ব্যাপারটা বল।

    রুচির: ওই যে প্রথম শ্যুটটা হয়েছিল বোড়ালে আর রবীন্দ্র সরোবরে, তার কয়েকদিন পর রঞ্জন বম্বে যায় ওর কাজে, আমাদের শ্যুটের অডিওটা ও সঙ্গে করে নিয়ে যায় আনন্দ পটবর্ধনকে শোনাবে বলে। আনন্দের শুনে ভালো লেগেছিল। আনন্দের চ্যানেল ফোরের কমিশনিং এডিটর অ্যালেন ফাউন্টেনের সঙ্গে আলাপ ছিল। ও কথায় কথায় অ্যালেনকে বলে যে রুচির নামে একটি ছেলে বাউলদের নিয়ে একটা কাজ করছে, আমি সাউন্ডটা শুনেছি। বেশ ভালো লেগেছে। তারপর বেশ খানিকটা শ্যুট হবার পর আমি আর মহাদেব ঠিক করি যে একটা ট্রেলার তৈরি করে লোকজনকে দেখাব ফান্ডের জন্য। পয়সা বেশি ছিল না বলে ওটা পুরোটা কালারে করতে পারিনি, কিছুটা পোরশন কালারে ছিল, বাকিটা ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট। তো একটা ১৪ মিনিটের ট্রেলার করে বম্বেতে টেলিসিনে করিয়ে ইউম্যাটিকে ট্রান্সফার করে সেটা নিয়ে আমি লণ্ডন যাই। অ্যালেনের কমিশনিং তখন ছিল এক্সপেরিমেন্টাল ফিল্ম এন্ড ভিডিও। ট্রেলারটা দেখে ওর ভালো লেগেছিল। বিকজ ইট ওয়াজ নট স্ট্রেট ডকুমেন্টারি। অ্যালেন বলল, ও কে, আই ক্যান গিভ ইউ ফিনিশিং ফান্ড ফর ইট। এটা বেশ ভাল টাকা ছিল।

    সুরজিত: এরপর আমরা নিশ্চিন্তে শ্যুটিং আর পোস্ট প্রোডাকশনের কাজ করেছিলাম।

    রুচির: কোনও চাপ ছিল না, ফিল্ম রোল একটার বদলে দুটো কিনেছি, একটা স্টকে থাকবে। ক্যামেরা দরকার পড়লে একদিন বেশি রেখে দিয়েছি। তখন আমরা ফুল অন মুডে কাজ করেছি। কিন্তু গৌরের সঙ্গে কোনও কন্ট্যাক্ট নেই। এরপর আমরা আড়ংঘাটায় সুবলদার বাড়িতে শ্যুট করেছি, ওই গানটা গেয়েছিলেন, ওই যেটাতে ছক্কা-পাঞ্জার কথা আছে।

    সুরজিত: জ্ঞানানন্দের পদ, এসেছ বসেছ ভবে তাস খেলিতে / এক ব্রহ্ম টেক্কার মর্ম জেনে নে মন আগেতে।

    রুচির: হ্যাঁ, হ্যাঁ, তারপর নবাসনে হরিপদ গোঁসাই এর বাড়িতে ওনাকে আর মা গোঁসাই কে শ্যুট করা হলো.......

    সুরজিত: হরিপদ গোঁসাই আবার পাগলদের ওনার বাড়িতে রেখে চিকিৎসা করতেন। আমরা যখন গিয়েছিলাম তখন একটি ১৬ / ১৭ বছরের ছেলে ওনার কাছে ছিল, তার চিকিত্‍সা চলছিল। আমরা তাকেও শ্যুট করেছিলাম।

    রুচির: হ্যাঁ, এছাড়া আমরা শ্যুট করলাম দীপকদার সেকেন্ড ইন্টারভিউ......

    সুরজিত: গঙ্গায়, নৌকার ওপর।

    রুচির: দেন গৌরের বৌ হরিদাসি সুইসাইড করল। খবর পেয়ে আমরা গেলাম। এইসব করে এত মেটেরিয়াল নিয়ে আমরা তিন বছর ধরে ফিল্মটা করেছি। একটু করে শ্যুট করা হত সেটা এডিট করে আবার একটু শ্যুট করা হত। ওই যে সুবলদা আমার সম্পর্কে বলত, রুচির রিসার্চ করসে। সবাই এই জোকটা নিয়ে হাসাহাসি করতো। একটা সময় ভাবতাম এটা কবে শেষ করব? আমি কি এই সাবজেক্টটায় ট্র্যাপড হয়ে গেলাম? আসলে মাই ফিল্ম ওয়াজ আ ট্রিপ ইনটু দ্য বাউল ওয়ার্ল্ড।
     
    সুরজিত: এডিট থেকে ফিরে তোমার বাড়িতে, তোমার সেই রেমিংটন টাইপ রাইটারে রোজ সন্ধ্যায় আমরা ইলেভেন মাইলসের স্ট্রাকচার লিখতাম আর পরের দিন এডিট রুমে ওটা ছিঁড়ে ফেলা হতো। মহাদেব অসীম ধৈর্য নিয়ে আবার রি-এডিট করতো, মাঝে মাঝে যে ধৈর্যচ্যুতি ঘটত না, তা নয়। তখন ওই ঝগড়া, খিস্তি এইসব খানিকক্ষণ করার পর এগেইন ব্যাক টু এডিট। আমি ছিলাম মহাদেবের অ্যাসিসটেন্ট এডিটর। একটা বিরাট কালো ট্রাঙ্ক ভর্তি রাশ, কোনটা ৩ মিনিটের তো কোনটা ১০ মিনিটের। কোন সিকোয়েন্সটা কোথায় আছে, কোন রোলে কী আছে, সব আমাকে মনে রাখতে হত।

    রুচির: এর মাঝে এন এফ ডি সির স্টিনবেক মেশিন খারাপ হয়ে গেল আমরা সল্ট লেকে রূপায়ণে ফাইনাল এডিট করলাম। সেই সময় ডায়েরির আইডিয়াটা, ভয়েস ওভারের আইডিয়াটা মাথায় ঢুকেছে। যেটা পুরো ফিল্মটাকে কানেক্ট করেছে একটা জালের মতো। আমার মনে আছে এই ঘরে ক্যামেরা ট্রাইপডে রেখে আমার ডায়েরি লেখা, কথা, শ্যুট করা হয়েছে। আমি, তুমি আর অমরেশ (চক্রবর্তী) আমরা দু দিন শ্যুট করেছিলাম। যেটা ফিল্মটাকে একটা অন্য লেভেলে নিয়ে গেছে।

    সুরজিত: এই সময় ক্যারোলিন স্পায়ার নামে এক মহিলা চ্যানেল ফোর থেকে কলকাতায় এসেছিলেন। ছবিটা কদ্দুর কী হল সেটা দেখতে।

    রুচির: উনি অ্যালেন ফাউন্টেনের সঙ্গে কাজ করতেন। অ্যালেন ওঁকে পাঠায়। ওনাকে তিন ঘন্টার একটা রাফ কাট দেখানো হয়েছিল রূপায়ণে।

    সুরজিত: শেষে আমরা বম্বেতে গেলাম মিক্সিং করতে। ওখানে আমরা দু মাস ছিলাম, ভারসোভাতে রুমির ফ্ল্যাটে। ওই তিনতলায় হেঁটে ওঠা। লিফট নেই। বিশেষত মধ্যরাতে ফিরে ওই তিনতলায় ওঠাটা একটা শাস্তি ছিল।

    রুচির: আর ওই মাছের গন্ধ, মাঝে মাঝে জল থাকে না, সামনের দোকানে কোলাপুরি চিকেন আর পমফ্রেট ভাজা পাওয়া যেতো। দুটোই হরিবল। মহাদেব ওই পমফ্রেট খুব খেতো।

    সুরজিত: আমরা এডিট করতাম বিধু বিনোদ চোপড়ার বউ রেণু সালুজার এডিটিং স্টুডিয়োতে। দিনের বেলা কেতন মেহতা মায়া মেমসাব এডিট করতো আর রাতের শিফটগুলো আমরা পেতাম। কয়েক বছর পর শুনলাম রেণু ক্যান্সারে মারা
    গেছে।

    রুচির: রি-রেকর্ডিং হয়েছিল আরাধনা স্টুডিওতে, প্যাডি, পদ্মনাভন ছিল সাউন্ড রেকর্ডিস্ট, যে আবার ফেমাস পেন্টার কে জি সুব্রাহ্মনিয়ামের জামাই। ও খুব ভাল কাজ করেছিল। খুব মেটিকিউলাস ছিল।

    সুরজিত: বম্বের কাজ শেষ করে তুমি আর মহাদেব লণ্ডন গেলে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি।

    রুচির: হ্যাঁ, গীতা আমার জন্য লন্ডনে অপেক্ষা করছে। যেদিন আমি যাব, তার আগেরদিন গীতার দিদিমা বিজয়লক্ষ্মী পন্ডিত ভারতে মারা গেলেন। গীতা এখানে এল আর আমি লন্ডনে গেলাম। তার আগে নেগেটিভ কাটতে গিয়ে অ্যাডল্যাবের জলি বলল, মাটিয়ারির নেগেটিভে সাদা দাগ আছে। শুনে তো আমার মন খুব খারাপ। আর লণ্ডন যাবার সময় ভেবেছিলাম কাজটা প্রায় শেষ, তখনও জানি না সাড়ে তিন মাসের খাটনি আরও বাকি আছে।

    সুরজিত: ফিল্মটা তো ১৫৫ মিনিটের দাঁড়ালো। থ্রি পার্টস।

    রুচির: হ্যাঁ। আমি লন্ডনের সোহোতে গেলাম, যেখানে ফিল্মের সব কাজ হয়। সেখানে দুটো অস্ট্রেলিয়ান মেয়ে যারা ফিল্ম নেগেটিভ ক্লিন করায় এক্সপার্ট, তাদের কাছে গেলাম। মাটিয়ারির নেগেটিভ ক্লিন করাতে। ওরা একটা হিউজ টাকা চার্জ করেছিল। অনেকে বলে রুচির ইলেভেন মাইলস থেকে অনেক টাকা করেছে, ইটস নট ট্রু। লন্ডনে অতদিন কাজ করতে হয়েছিল সেটা একটা বিরাট খরচা। ইন দ্য মিন টাইম গীতা ফিরে এসেছে।

    সুরজিত: আমরা শ্যুটিঙে কোনও কম্প্রোমাইজ করিনি টাকার জন্য। কাজের সঙ্গে ফুর্তিফার্তাও হয়েছিল।

    রুচির: হ্যাঁ, আর ফুর্তি তো ভালই হয়েছিল। এনি ওয়ে, ওই মেয়ে দুটি ১২/১৪ দিন সাউন্ড ওয়েভ দিয়ে নেগেটিভটা ক্লিন করে। তারপর কোডাকের ল্যাবে কালার প্রিন্ট করা হয়েছে, সেটাও অনেক টাকা। এরপর ফাইনাল নেগেটিভ কাটও ওখানে করতে হয়েছে এবং সব পেমেন্ট পাউন্ডে হচ্ছে।

    সুরজিত: তোমাকে তো ফিল্মটা গ্রেড করতেও হয়েছিল।

    রুচির: সেটা আরেক ঝামেলা। বম্বেতে তখন কম্পিউটারাইজড কালার গ্রেডিং এসে গেছে। কিন্তু লন্ডনে সেই পুরোনো সিস্টেমে রেড গ্রিন ব্লু জেলাটিন দিয়ে গ্রেড করা হয়। রঞ্জন নেই,আমি দুজন বুড়ো সাদা কোর্ট পরা ব্রিটিশ ল্যাব টেকনিশিয়ানের সঙ্গে বসে দশ দিন ধরে কাজটা করেছিলাম। রোজ সাত ঘণ্টা কাজ করতে হতো। মহাদেব ছিল একমাস। আবার একবার ফাইনাল মিক্স করে মহাদেব চলে আসে। একটা প্রিন্ট বার হয়, অ্যালেন সেটা দেখে খুব খুশি। অ্যালেন আমাদের লাঞ্চে ডেকেছিল, মানে আমি, গীতা আর মহাদেব।

    সুরজিত: সিনেমা দ্যু রিয়েল এ কী ভাবে গেল ইলেভেন মাইলস?

    রুচির: এর মাঝে রঞ্জনের থ্রুতে দিলীপ বর্মা আর ওর বউ ডোমিনিকের সঙ্গে আলাপ। দিলীপ কলকাতার ছেলে, রঞ্জনের ব্যাচমেট পুণে ফিল্ম ইন্সটিট্যুটে, ফিল্ম মেকার, প্যারিসে থাকে। পরে কলকাতায় তোমার সঙ্গেও আলাপ হয়েছে। দিলীপ বলল, ফিল্মটা নিয়ে প্যারিসে এসো। সিনেমা দ্যু রিয়েল এর ডিরেক্টর তোমার ছবিটা দেখতে চায়, যদিও ওদের ফেস্টিভ্যালের জন্য ফিল্ম সিলেকশন ক্লোজ হয়ে গেছে কিন্তু অ্যালেনের কাছে শুনেছে এই ছবিটার ব্যাপারে, ওরা দেখতে চায়। আমি ফিল্মের তিনটে রিল নিয়ে ট্রেনে চেপে প্যারিসে গেলাম।

    সুরজিত: এবার ওই সিলেকশনের ব্যাপারটা বল।

    রুচির: শর্ট ফিল্ম হলে ওরা নিয়ে নিতো, কিন্তু ১৫৫ মিনিটের ছবি। ওরা না দেখে নেবে না। প্যারিসে ওই সময় শীতকাল, বৃষ্টি পড়ছে। আমি খুব নার্ভাস মানে ছবিটা নেবে কি নেবে না। তার ওপর ইংরাজি সাব টাইটেল করা নেই, মানে
    সময়ই পাইনি। দিলীপ বলল, ভাবিস না, মদ খা, যা হবার হবে। আমি তোমাকে বলছি,দ্যাট ওয়াজ দ্য হ্যাপিয়েস্ট মোমেন্ট অফ মাই লাইফ টিল নাও। ফেস্টিভ্যাল ডিরেক্টর সুসেত গ্লেনাডেল, গম্ভীর, বেঁটে, স্কোয়ার টাইপ, পাওয়ারফুল মহিলা, চেইন স্মোকার, আর ওর সহকারি মণিক, এই মেয়েটি অতো গম্ভীর নয়, এরা দুজন ছবিটা দেখবে। শুধু প্রথম রিলটা দেখবে, মানে ৪০ মিনিট। প্রোজেকশনিস্ট ছবি চালালো, আমি মুখে মুখে ইংরাজিতে সুসেতকে বলছি আর দিলীপ মণিককে বলছে। প্রথম রিলটা শেষ হবার পর সুসেত মণিকের দিকে তাকালো, ওরা এক সঙ্গে বলে উঠলো, সেবো। এর মানে কী আমি জানি না, ফ্রেঞ্চ জানি না তো, আমি দিলীপকে বললাম, এ লোগ কেয়া কহ রহে? দিলীপ বললো, এ লোগ কহ রহে ফিল্ম আচ্ছা হ্যায়। তারপরে ওরা পরের রিলটা দেখতে চায়। কিন্তু প্রোজেকশনিস্ট বললো, আমাকে ৪০ মিনিট বলা হয়েছিল, আমার অন্য স্ক্রিনিং আছে, আমি চলে যাবো। তখন দিলীপ রিলটা চালালো। মণিক আর সুসেত আমার দু পাশে, আমি ইংরাজিতে মুখে মুখে বলে যাচ্ছি। এই ভাবে ওরা পুরো ছবিটা দেখলো। বলল, হ্যাঁ, তোমার ফিল্মটা আমরা সিলেক্ট করলাম। কিন্তু সাবটাইটেল চাই। সময় বেশি নেই।

    সুরজিত: কিন্তু গানগুলো সব আমরা অনুবাদ করেছিলাম।

    রুচির: হ্যাঁ, সেগুলো আমার কাছে ছিল। কথাও আমরা অনুবাদ করেছিলাম। কিন্তু কথা আরও ছোটো করতে হয়েছিল। আমি লন্ডনে ফিরে এসে সাবটাইটেল করতে শুরু করলাম। চারপাশ তখন বরফে সাদা হয়ে আছে। অর্না কুসটো বলে একটি মেয়ের সঙ্গে বসে, ওর বাড়িতে, ওর মেশিনে সাব টাইটেল লেখা হতো। ওই পুরোনো ডেস্ক টপ কম্পে ও দুটো সাবটাইটেল লিখছে, একটা ফিল্মের জন্য আর একটা টিভির জন্য। দ্যাট ফাকিং ফিল্ম টুক আ মান্থ টু সাব টাইটেল। ওই মেয়েটি বেশ ভাল চার্জ করেছিল ফর দ্যাট জব। তখন একটা নেশার মতো কাজটা করে গেছি। নো বডি উইদ মি, না মহাদেব না রঞ্জন। আমি ভাবছি এই ছবিটা কি আমি এই জীবনে শেষ করতে পারব? আর সবাই যে যার কাজ করছে। রঞ্জন ওর কাজে ব্যস্ত, মহাদেব ওর কাজে ব্যস্ত, তুমিও অন্য কিছু একটা করছ। আমি একা ছবিটা নিয়ে মেতে আছি।

    সুরজিত: ফেস্টিভ্যালটা বোধহয় মার্চে হয়েছিলো। মহাদেবের কাছে সেরকমই শুনেছিলাম।

    রুচির: ইয়েস, মার্চে আবার প্যারিস। সেই সময় বেশ ঠান্ডা ওখানে। এবার স্ক্রিনিং এর সময় ওরা লাইভ ফ্রেঞ্চ সাব টাইটেলের ব্যবস্থা করেছিল। তারপর তো অ্যাওয়ার্ড পেল।

    সুরজিত: তখন তোমার মনে হলো যে এতো খাটনি, ঝামেলা সার্থক হলো।

    রুচির: তা মনে হলো, কিন্তু একটা কথা বলার আছে, এই রকম একটা ছবি করতে গেলে ইউ হ্যাভ টু ফাইট অন মেনি ডিফারেণ্ট ফ্রন্ট। একটা হচ্ছে বাউলরা আমাকে সন্দেহ করছে, আরেকটা হচ্ছে টাকার ব্যাপার। আর টাকা থাকলেও এ দেশে ডকুমেন্টারি ফিল্মকে যে ভাবে দেখা হয়; যে এটা একটা ফালতু কাজ। স্পেশালি যদি পলিটিক্যাল ইস্যু নিয়ে ছবি না হয়। তুমি একটা ফিচার ফিল্ম করছো, নাসির আছে, শাবানা, স্মিতা এরা সব আছে, এর মানে আছে, যে আর্ট ফিল্ম করছে। কিন্তু বাউলদের নিয়ে এত বড়ো ছবি করেছো, এর মানে কী?

    সুরজিত: দীপকদা এটা কী ভাবে দেখত?

    রুচির: আমি একটা জিনিস মনে করি যে, কেউ মারা গেলে তাকে ক্রিটিক করা যাবে না।

    সুরজিত: সে তো বটেই। না করাটা এক ধরণের মিডিওক্রিটি।
     
    রুচির: এটা আমি দীপকদার কাছেই শিখেছি। ওনার অনেক গুণ ছিল কিন্তু অনেক প্রবলেমও ছিল। দীপকদার নিজের জীবনেই একটা কনট্রাডিকশন আর হিপোক্রেসি ছিল। সেটা ওনার কাজের মধ্যেও ছিল। এখন আমি বুঝি যারা কাজ করে তারা কেউ পারফেক্ট নয়। আমরা সবাই ওই হিপোক্রেসি আর কনট্রাডিকশন নিয়েই কাজ করি। ওই সুবলদার গানে যেমন বলেছে, ছয়জনাতে করল চুরি বাঁধলো আমারে / তারা চুরি করে খালাস পেল আমায় দিলো জেলখানা / জনমদুখি কপাল পোড়া গুরু আমি একজনা। ছয়জনকে নিয়েই আমাদের চলতে হয়। দীপকদা ভেবেছিলেন, আমি এই সাবজেক্টটা হ্যান্ডেল করতে পারবো না। শহর নিয়ে ছবি করলে ওর কোনো প্রবলেম হতো না। কিন্তু এই বাউল বিষয়টা তো ওর কোর এরিয়া। আর দীপকদাই আমাকে এই বাউলের নেশাটা ধরিয়েছে।

    সুরজিত: মানে তুমি ওঁর জোনে ঢুকেছ বলে উনি ডিসকমফর্ট ফিল করছেন। আবার তোমাকে ভালোবাসতেনও।

    রুচির: ওঁর প্রবলেম হচ্ছে এই ছবিটা গৌতম (চ্যাটার্জি) করছে না, এই ছবিটা ভাস্কর (ভট্টাচার্য) করছে না,এই ছবিটা বিবেক (বেনেগাল) করছে না, এই ছবিটা রুচির করছে। একদিকে উনি ভাবছেন, যে, রুচির ফ্রেশ মাইন্ডে ব্যাপারটা দেখছে, রুচিরের ভেতর কিছু ব্ল্যাঙ্ক ক্যানভাস আছে যেখানে আমি আমার মতো রঙ করে দিতে পারি।

    সুরজিত: সেটা তো উনি করেও ছিলেন। আমি জানি।
     
    রুচির: হ্যাঁ, আমি সেটা অ্যাকসেপ্ট করেছি। কিন্তু উনি ভাবছেন রুচির যদি ঝোলায়, যদি বাজে ফিল্ম করে, অর ইফ আই মেক এনি ফাক আপ উইদ দ্য সাবজেক্ট। হি ডাসন্ট ওয়ান্ট টু বি অ্যাসোসিয়েটেড উইদ দ্য ফেলিওর।

    সুরজিত: ছবিটা তো উনি তোমাকে করতে বলেননি।

    রুচির: সেটাই তো কথা। ছবিটা তো আমিই করব বলে ঠিক করেছি। দীপকদা আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে, অনেক পরামর্শ, সাজেশন দিয়েছে, কিন্তু একটা জায়গায় টেনে রেখেছে। এমনকি দীপকদার প্রথম ইন্টারভিউটা যখন শ্যুট করি, হি ওয়াজ পারফর্মিং। গায়ে শাল দিয়ে আসনে বসে জ্ঞান দিচ্ছিল।

    সুরজিত: ওই দু হাত ওপরে তুলে বলছে, সুবল টেকস দ্য রিভার আপওয়ার্ডস।

    রুচির: তারপর যখন হরিদাসী মারা যায়, রামানন্দ মারা যায়। দীপকদা নিজেও তখন ভেতরে ভেতরে দুর্বল হয়ে পড়েন। উনি নিজেও জানতেন ওনার হাতে বেশি সময় নেই। শরীরটা খারাপ হয়ে গেছে। সাইকোলোজিকাল ড্যামেজ অনেকটা নিয়েছেন। তাই সেকেন্ড ইন্টারভিউটাতে হি ইজ মাচ মোর ওপেন, ভালনারেবল। আর আমি পুশ করছি, হরির ব্যাপারটা বলো, রামানন্দর ব্যাপারটা বলো। উনি বলছেন। বলতে বলতে উঠে দাঁড়িয়ে পড়েছেন।

    সুরজিত: গঙ্গায়, নৌকোর ওপরে।

    রুচির: তখন বলছে, গৌর ইজ লাইক আ টাইগার। এই যে সব বলছেন, এটা আমার কোনো গ্রেট স্কিল নয় যে আমি ওঁকে দিয়ে বলিয়ে নিচ্ছি। ওনার নিজের চারপাশের দেওয়ালগুলো ভেঙে গেছে তখন। তাই ওঁর ভেতরে ঢুকতে পারছি আমরা।
     
    সুরজিত: ১৯৯০তে ইন্টারভিউ দিলেন আর ১৯৯৩তে মারা গেলেন।

    রুচির: আমরা কেউই ভাবিনি উনি এত তাড়াতাড়ি চলে যাবেন। ফিল্মটা দেখে খুব খুশি হয়েছিলেন। তবে গৌর আর দীপকদার লিটন হোটেলের ঝগড়াটা ফিল্মে রেখেছিলাম। এটা আমার ক্রিটিক ওনার প্রতি যে, বাউলরাও তোমাকে একরকম দেখে। ওই যে গৌর দীপকদাকে বলছে, হে বন্ধু তোমার বন্ধুত্বের ওপর আমি পেচ্ছাপ করে দিই। ওটা গৌর শুধু ওনার ওপর নয়, আমরা যারা ছিলাম, আমি, তুমি, রঞ্জন, মহাদেব সবার ওপর পেচ্ছাপ করছে। হঠাৎ আমরা সবাই ওর দুশমন হয়ে গেলাম। ছবির এই অংশটা নিয়ে দীপকদা কিছু বলেননি, বাট আই থিংক হি হ্যাড মিক্সড ফিলিং আবাউট দ্যাট সিকোয়েন্স। ১৯৯১ এর এপ্রিলে ছবিটা দেখানো হয়েছিল। সে সময় হিজ ওন রিলেশনশিপ এন্ড ওন প্রজেক্ট উইদ বাউল ইজ ইন ট্রাবল। নিজে একরকম ভাবে একটা জিনিস চেষ্টা করেছেন। বাকিদের সাবধান করেছেন, তোমরা এদের এক্সপ্লয়েট করবে না, এক্সোটিসাইজ করবে না, চিপলি দেখবে না। একটা ডিপার লেভেলে, ডিপার স্ট্রাকচারে যাওয়া তোমাদের দরকার। তুমি যদি ওর কাছ থেকে কিছু চাও তাহলে তোমাকেও ওকে কিছু দিতে হবে। দীপকদা আবার একই সঙ্গে সেই লোক, যে ঋত্বিককে ডিফাইন করেছে। ঋত্বিকের ওই মদ খাওয়া, ব্যাড বিহেভিহার, কিন্তু ওই কষ্ট আর পেইন থেকে ঋত্বিকের যে কাজটা আমরা পেয়েছি, হোয়াট শ্যুড আই সে, গ্রেট আর্ট। একটা ম্যাভারিক, বোহেমিয়ান, ভল্তেরিয়ান, রাঁবোডিয়ান, ক্রেজিনেস অফ বেঙ্গলি সাইকি আছে। দীপকদা সেটা পছন্দ করতেন।

    সুরজিত: দীপকদার কাছে এটা ফ্যাক্টর ছিল না যে তুমি গুজরাতি কি জাঠ কি তামিল।

    রুচির: ও দেখত কেউ কিছু করছে তার মধ্যে ওই ম্যাডনেস আর কমিটমেন্ট আছে কিনা। তবে একটা কথা বলি, কলকাতায় একটা কথা চলত সেই সময় যে রুচির একটা গুজ্জু ছেলে ও বাউলের কী বোঝে? কিন্তু আমি দীর্ঘদিন দীপকদার সঙ্গে কাটিয়েছি, বাউলদের বাড়ি গেছি, মেলায় গেছি, আই গট আ সেন্স অফ বেঙ্গল। আমি জন্মেছি লেক গার্ডেন্সে। আমি বেড়ে উঠছি একটা বাঙালি কালচারের মধ্যে। পরিতোষ সেন আমার বাবার বন্ধু ছিলেন। আমার ব্যাপারটা হলো সাম ডেজ আই অ্যাম বেঙ্গলি, সাম ডেজ আই অ্যাম নট বেঙ্গলি। আমার বাবা মা ভক্তি ট্রাডিশনের থেকে এসেছিলেন, ছোট বেলায় দেখতাম ওনারা ভোরবেলা ভজন গাইছেন। এই যে নন বেদিক ভক্তি ট্রাডিশন, এই যে গুরুর জন্য পাগল, যাকে গুজরাতিতে বলে গেলুপন। এটা তো জানতাম। মীরার এটা ছিল। এই হলো ব্যাপার। এটা আমার মধ্যে আগে থেকে ছিল। তারপর যখন আমি এটা বেঙ্গলি ট্রাডিশনে দেখলাম, ইট অ্যাওয়েক্‌স মি। আই কানেক্ট টু দ্য বাউল বিকজ অফ জ্যাজ এন্ড ব্লুজ।

    রুচির: এবার আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করছি, ইলেভেন মাইলস যখন আমরা বানাচ্ছিলাম তখন তোমার কী মনে হচ্ছিল?

    সুরজিত: ইলেভেন মাইলস আমার জীবনের প্রথম ডকুমেন্টারি ফিল্ম। এর আগে আমি অমিতাভর ফিচার ফিল্ম কাল অভিরতিতে কাজ করেছি। তো ডকুমেন্টারি ফিল্মে এটা আমার প্রথম অভিজ্ঞতা আর বাউলদের সঙ্গেও আমার কাজ করার প্রথম অভিজ্ঞতা। দীপকদাকে আমি আগেই চিনতাম। কিন্তু শহুরে মানুষ হিসেবে বাউল বলতে পূর্ণদাস বাউলকে জানতাম আর ওরই গান শুনেছি, ওই বস্তাপচা গোলেমালে পীরিত কোরো না।
     
    রুচির: হ্যাঁ, শান্তিনিকেতনে ওনার বাড়ির নেমপ্লেটে লেখা ছিল ‘বাউল সম্রাট পূর্ণদাস বাউল’। রিডিকিউলাস।

    সুরজিত: আমার তখন পুরো জিনিসটা নিয়েই খুব উত্তেজনা। রোজ শ্যুটে যাচ্ছি আর রোজই ভাবছি আজ কী হবে। আর এত গান শুনছি, সেগুলো টেপ থেকে শুনে লিখছি। আমরা দুজনে বাংলা থেকে ইংরাজিতে অনুবাদ করছি, যার জন্য বারবার শুনতে হচ্ছে, বহু গান মুখস্থ হয়ে গেল। দীপকদা ওই সময় আমাকে একটা বই দিয়েছিলেন শশীভূষণ দাশগুপ্তর লেখা 'অবস্কিওর রিলিজিয়াস কাল্টস'। তখন বেশ কঠিন লেগেছিল, আপ্রাণ চেষ্টা করে অর্ধেকটা পড়েছিলাম। দীপকদা বইটা নিয়ে নানা কথা বলেছিলেন। তাতে বাউল দর্শন, সহজ সাধনা, ব্যাপারটা কিছুটা বুঝেছিলাম। আরও পরে আবার ওই বইটা পুরোটা পড়ে অনেক জিনিস বুঝেছিলাম। দীপকদার কাছে আরও একটা বই ছিল উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যর লেখা 'বাংলার বাউল ও বাউল গান'। সেটা একটা বারোশো পাতার বই। দীপকদা ওটা হাত ছাড়া করতেন না। বলতেন, পড়তে হলে আমার বাড়িতে বসে পড়। সেটা পড়ার উপায় ছিল না। ওই বইটার কথাও উনি খুব বলতেন, কিন্তু তখন বইটা আউট অফ প্রিন্ট ছিল। সেটা অনেক বছর পর আবার ছাপা হলো, তখন পড়লাম। এই বইটা কিন্তু বাউল দর্শনের ওপর আকর গ্রন্থ।

    রুচির: পরে তো তুমি বইও লিখেছ।

    সুরজিত: সে তো ১৭ বছর পরে, সেটা ফকিরদের নিয়ে। তার আগে অমিতাভ ফকিরদের নিয়ে যে ডকুমেন্টারি ফিল্মটা করেছিল, সেই বিশার ব্লুজ এও আমি রিসার্চারের কাজ করেছি। তখন ফকিরদের সঙ্গে দেহতত্ত্বের আলোচনা করতে গিয়ে অনেক জিনিস বুঝতে পেরেছি। গৌর যে গেয়েছিল, ঢাকা শহর ঢাকা যতক্ষণ, এই ঢাকা শহরটা কোথায় তখন বুঝলাম, বা সুবলদার যে গান, বৃন্দাবনের পথে যাব পথ দেখাবে কে, এই বৃন্দাবন যে নিত্য বৃন্দাবন এবং তা আমাদের শরীরের ভেতরেই আছে এসব জানতে পারলাম। ইলেভেন মাইলসের অনেক গান আমার কাছে ছিল, সেগুলো নতুন করে শুনলাম। দেহতত্ত্বের গানের সঙ্গে বোঝাপড়াটা বাড়ল। বিশার ব্লুজ শেষ হবার পর আমার এঁদের বিষয়ে আরও জানতে ইচ্ছে করলো, তখন ফকিরনামা বইটার ভাবনা মাথায় এলো। এসব কিছুর পিছনে ইলেভেন মাইলসের একটা বিরাট ভূমিকা ছিল। তবে আমরা ইলেভেন মাইলসে এই দেহতত্ত্বের বা সেক্সোয়োগিক প্র্যাকটিসের ব্যাপারটা ধরিনি।

    রুচির: সেক্সোয়োগিক প্র্যাকটিসের ব্যাপারটা আমরা পুরোটা না বুঝলেও কিছুটা বুঝেছিলাম। ওটাতে বেশি ঢুকতে চাইনি, আমরা যেমন পুরোটা বুঝিনি তেমন অডিয়েন্সকেও পুরোটা বোঝানোর কোনও দায় নেই। আমি যেটা বলতে চেয়েছি যে, এরকম একটা রিয়ালিটিতে তুমি ঢুকলে একজন শহরের লোক হিসেবে, তুমি কী ভাবে ইন্টার‍্যাক্ট করো, তোমার সঙ্গে কী ভাবে ইন্টার‍্যাকশনটা হয় বাউলদের, বা এই রকম সাব অলটার্ন পারফরম্যান্স ট্র্যাডিশনের সেটাই ছবিতে পোর্ট্রেট করা হয়েছে। দিস ফিল্ম ওয়াজ নট সাপোজ টু বি প্রাইমার অন দ্য বাউল। আমরা সেটা করতে চাইনি। তাহলে তো এক্সোটিক ইন্ডিয়া, সেক্স, বাউল নিয়ে একটা ছবি করতে পারতাম, বিক্রি করতে সুবিধে হতো।

    সুরজিত: একটা কথা মনে পড়ল বাউলদের প্রসঙ্গে তুমি অনেকবার বব ডিলানের কথা বলেছ। এটা কেন বল?

    রুচির: বাউলরা আমেরিকায় গেলে বব ডিলান ওদের সঙ্গে ইন্টার‍্যাক্ট করেন। দেখ, বিটলসরা রবিশংকরের সঙ্গে পরিচয় করে একরকম ভাবে এখনকার মিউজিকটা বুঝেছিল। বব ডিলান বিটলসদের জানেন। কিন্তু বাউলদের সঙ্গে মিশে উনি একটা অন্য উপলব্ধিতে পৌঁছেছিলেন। উনি আমাদের ভক্তি মুভমেণ্ট, সুফি ট্র্যাডিশন, বুদ্ধিস্ট প্র্যাকটিস আর তন্ত্র সবই নিজের মত করে বুঝেছিলেন। বাউলের বেসিক মেসেজটা বুঝেছিলেন, যে শরীরটাই হলো সাধনার একমাত্র মন্দির। ১৯৬৬ সালের জুলাই মাসে ডিলানের একটা মোটরবাইক আকসিডেণ্ট হয়। উনি এরপর নয় মাস পাবলিকের সামনে আসেননি। ১৯৬৭ সালে একটা অ্যালবাম করে উনি আবার লোকের সামনে আসেন। সেই আলবামটার নাম জন ওয়েসলি হার্ডিং। সেই আলবামটার কভারে দেখা যায় ডিলান কয়েকজন বাউলের সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছেন। গানগুলোতে কোনও বাউল ইনফ্লুয়েন্স নেই, সেগুলো ওয়েস্টার্ন কান্ট্রি মিউজিক, কিন্তু বাউলরা কভারে আছে। ডিলানও একজন মিস্টিক সিঙ্গার, আমার মনে হয় উনি হয়তো বাউলদের ওনার ফেলো ট্রাভেলার মনে করে ওঁদের সঙ্গে কোথাও একটা একাত্ম বোধ করতেন, তাই কভারে ওই ছবিটা দিয়েছিলেন।

    সুরজিত: বাউলরা ওয়েস্টের সঙ্গে কী ভাবে মেলামেশা করছে এটা আমরা ইলেভেন মাইলসে খানিকটা ধরেছিলাম।

    রুচির: লেট সেভেন্টিজ বা আর্লি এইট্টিজে গৌর ক্ষেপা, সুবলদাস এঁরা দীপকদার সঙ্গে বিদেশে যাচ্ছে বা পবন মিমলুর সঙ্গে প্যারিস যাচ্ছে, একটা অন্য ধরণের কেমিস্ট্রি হচ্ছে। আমরা এটাকে তিনটে সার্কেলে ধরতে চেয়েছি।

    1. একটা হচ্ছে কোর ইনার সার্কেল। যেটা প্রোটেকটিভ। যেখানে বাউলরা থাকেন, গুরুর আশ্রম, মেলা ইত্যাদি।
    2. সেকেন্ড সার্কেলটা হল, কলকাতা বা ছোটো মফস্বল শহর বা শান্তিনিকেতন যেখানে বাউলরা কোর ইনার সার্কেল থেকে বাইরে শহরের মানুষদের সঙ্গে মিশছে, বিদেশিদের সঙ্গে মিশছে। যেটা বাউলদের নিজেদের টেরিটরিও নয় আবার বিদেশও নয়।
    3. এই সার্কেলটা হল কলকাতার বাইরে বা বাংলার বাইরে। যেখানে লোকে বাংলায় কথা বলে না। যেটাকে আমি বলব আউটার সার্কেল, যেটা দিল্লি, বম্বে, বাঙ্গালোর বা চেন্নাই। এইট্টিজে এই সার্কেলটা হয়ে দাঁড়াল প্যারিস, নিউ ইয়র্ক, লসএঞ্জেলিস, ইটালি, টোকিও, সুইৎজারল্যান্ড, এক কথায় সারা পৃথিবী।


    সুরজিত: আর বিদেশে বিভিন্ন মানুষ যেন বাউলদের নতুন করে ‘আবিষ্কার’ করল। মানে এমন হল, একজন ফরাসি কলকাতায় এসে বলছে, কোথায় বাউলরা থাকে সেখানে যাব বা অমুক বাউল তো ওয়েল নোন, অন্য কারোর কাছে চল। একটা গানের জমায়েতে গেছি, কলকাতার লোক আছে কিছু বিদেশিও আছে। একজন তরুণ বাউলকে এমনও বলতে শুনেছি, সে আরেকজন বাউলকে জিজ্ঞেস করছে, কাকে ধরলে বিদেশ যাওয়া যাবে।

    রুচির: এই জিনিসটাই কখনো ট্র্যাজিক, কখনো বিজার সিচুয়েশন তৈরি করেছে। একজন তরুণ বাউল ফ্রান্সে গিয়ে এক ফরাসি মেয়ের সঙ্গে মেলামেশা করেছে। ফরাসি মেয়েটির কাছে সেটা একটা সাময়িক ব্যাপার, কিন্তু বাউল ছেলেটি ভাবছে এই সম্পর্কটা সারা জীবনের। কিন্তু সেই মেয়েটি তা ভাবেনি। সে ওই ব্যাপারটা নিয়ে আর ভাবেইনি। শেষ পর্যন্ত দেশে ফিরে ছেলেটি সুইসাইড করে।

    সুরজিত: তুমি পবনের ভাই স্বপনের কথা বলছো তো?

    রুচির: হ্যাঁ। এটা আমি দীপকদার কাছে শুনেছি, পবন যখন মিমলুর সঙ্গে প্রেম করছে, লক্ষণ দাস বিদেশে যাচ্ছে, নানা রকমের প্রেমালাপ চলছে বাউলদের ইউরোপিয়ান মেয়েদের সঙ্গে, স্বপন একটা ইয়াং ফ্রেঞ্চ মেয়ের প্রেমে পড়ে। মেয়েটাও বুঝতে পারেনি কী হচ্ছে। ওর স্বপনকে ভালো লেগেছে, কিন্তু ও বিয়ে করে সংসার করতে চায় না। স্বপন সেটা বুঝতে পারেনি। গৌতমদা আমাকে বলেছিল, হি শ্যুড হ্যাভ বিন প্রোটেক্টেড ফ্রম দ্যাট। ওই মেয়েটা অন্য সোশ্যাল ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে আসছে, সেটা স্বপনকে কেউ বুঝিয়ে দেয়নি। ইটস নট ক্যাজ্যুয়াল সেক্স এক্সজ্যাক্টলি, বাট ইট ডাজন্ট মিন শি ওয়ান্টস টু স্পেন্ড নাইন লাইভস উইদ হিম। তুমি ইউরোপ থেকে এই মদটা খেয়ে ফিরে, তারপর তুমি নিজেকে রিকনসাইল করতে পারছো না। মেয়েটা তোমার সঙ্গে আর কথা বলছে না। তুমি ভাবলে আর বেঁচে থেকে কী হবে? তুমি নিজের পেটটা কেটে দিলে।
     
    সুরজিত: এ তো হারাকিরি !

    রুচির: হ্যাঁ, কাস্তে দিয়ে পেটটা লেফ্ট টু রাইট চিরে দিয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে মারা যায়নি, অনেক কষ্ট পেয়ে এক সপ্তাহ হাসপাতলে থেকে মারা গেল। দ্য ওয়ার্স্ট ফাকিং ডেথ, হি ওয়াজ টোয়েন্টি টু - টোয়েন্টি থ্রি। উল্টোটাও হয়েছে, বিদেশিনী এসে বাউলের প্রেমে এমন জড়িয়ে পড়ল, উইদাউট আন্ডারস্ট্যান্ডিং ইট যে শী কুডন্ট হ্যান্ডেল দ্য সিচুয়েশন।

    সুরজিত: এই ব্যাপারটা হল সেই দীপকদা যেটাকে বলতেন বাউলের অ্যাটাক অ্যান্ড ইনভিটেশন।
     
    রুচির: দীপকদা বলতেন, এভরি এমব্রেস ইজ অ্যান অ্যাটাক অ্যান্ড ইনভিটেশন। তুমি যখন কাউকে জড়িয়ে ধরছো, আলিঙ্গন করছো, তুমি তাকে বলছো, এসো। কিন্তু তুমি তাকে হামলাও করছো। আগেকার দিনে তুমি কাউকে বিশ্বাস করে জড়িয়ে ধরছো, তুমি জানো না, তার হাতে একটা ছুরি থাকলে তোমার পিঠে মেরে দিতে পারে। তো একটা ডাউটের ব্যাপার আছে। আর ছুরিটা রিয়েল না হয়ে ইট ক্যান বি আ মেটফরিক ছুরি। তুমি ওই প্রেমালিঙ্গনের মধ্যে ঢুকে পড়লে, তখন ব্যাপারটা দাঁড়াল যে, ইটস অলসো অ্যান অ্যাটাক অন ইয়োর রিয়ালিটি। যে তোমাকে আমাকে অ্যাকসেপ্ট করতে হবে আর আমাকে তোমাকে অ্যাকসেপ্ট করতে হবে। তো বাউলও আমাদের ওভাবে আলিঙ্গন করছিলো। ট্রাস্ট করি কি করি না, জানি না, কিন্তু ওই সুবলদা বলতেন, রুচির রিসার্চ করসে। তো ওয়েস্টের সঙ্গে বাউলদের এই আলিঙ্গনটাও অ্যাট দ্য সেম টাইম ইটস অ্যান অ্যাটাক অ্যান্ড ইনভিটেশন।

    সুরজিত: কিছু কিছু পজিটিভ জিনিসও হয়েছিল। দীপকদা গৌরকে নিয়ে পোল্যাণ্ডে গিয়েছিল জের্সি গ্রোটাভস্কির থিয়েটার ওয়ার্কশপে।

    রুচির: ইয়েস, আই ক্যান ইমাজিন দোজ ম্যাজিক মোমেন্টস, যখন দীপকদা, গৌর আর গ্রোটাভস্কি নিজেদের মধ্যে ইন্টারকশন করছে।

    সুরজিত: দীপকদা পোল্যান্ডের একটা ঘটনার কথা বলেছিলেন, যে, ওয়ার্কশপ চলাকালীন গৌর এক পোলিশ অভিনেতার সঙ্গে ঝগড়া করেছে আর সেটা হাতাহাতি পর্যন্ত গড়িয়েছে এবং পোলিশ ছেলেটির গায়ের জোর বেশি, সে গৌরকে একটা ঘুঁষি মারবে বলে রেডি এমন সময় গৌর খমকে টং করে আওয়াজ তুলে গান ধরে মরণ কারোর কথা শোনে না / ও সে যখন তখন যেথায় সেথায় দিতে পারে সদাই হানা, ছেলেটি থেমে যায়, গৌর পুরো গানটা গায়, ওয়ার্কশপের বাকি অভিনেতারা স্পেলবাউন্ড। গান শেষে গৌর ওই ছেলেটিকে জড়িয়ে ধরে এবং দুজনেই কেঁদে ফেলে।

    রুচির: দেখো, এগেইন সেই এমব্রেস, আটাক এন্ড ইনভিটেশন। এছাড়াও বাউলরা ওয়েস্টে গিয়ে মিউজিশিয়ান, সিঙ্গার এদের সঙ্গে মেলমেশা করছে। ওরা দেখছে পৃথিবীতে ওদের মতো আরও খেপা আছে। সো দিজ বাউল-ওয়েস্ট ইন্টার‍্যাকশনস ওপেন আপ মেনি পসিবিলিটিজ। এটা নিয়ে কলকাতার অনেকের মনে হত যে ওয়েস্ট বাউলকে ডিসটর্ট করছে। আমি তা মনে করি না। প্রত্যেকে এই পৃথিবীতে নিজের মতো করে মেলামেশা করুক। একটা এতোদিনের ট্র্যাডিশনকে ওয়েস্ট কিছু করতে পারবে না। আর নইলে তোমাকে বাউলদের পাহারা দিয়ে রাখতে হয়। হুইচ ইজ রিডিকিউলাস। যে কোনও ট্র্যাডিশন তার বাইরের সমাজের সঙ্গে স্ট্রাগল করেই, সারভাইভ করে, বেঁচে থাকে। দেখো সুবলদা বা গৌরের মতো সিনিয়র বাউলরা এতবার বিদেশে গেছে,কিন্তু সেরকম টাকা করতে পারেনি, শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে, সুবলদা তো মারাই গেলেন। অথচ ওদের রেঞ্জে গায়ক নয়, এমন অনেক ইয়ং বাউল অনেক ভালো আছে। তো একটা কয়েকশো বছর বা তারও বেশি পুরোনো ট্র্যাডিশনে এরকম আপস এন্ড ডাউন থাকেই।

    সুরজিত: এই ধরণের ট্র্যাডিশন অনেকটা নদীর মতো আনপ্রেডিক্টেবল মুভমেন্টে চলে।

    রুচির: ইটস লাইক রিভার গোজ ওভারগ্রাউণ্ড, রিভার গোজ আন্ডারগ্রাউণ্ড, ইট ইমার্জস সাম হোয়ার কমপ্লিটলি ডিফারেন্ট, ইন আ সারপ্রাইজিং প্লেস, হোয়ার ইউ ডোন্ট এক্সপেক্ট ইট।

    সুরজিত: সুবলদা গানে বলছেন, দেহের মধ্যে নদী আছে। ট্র্যাডিশনটা নদীর মতো বইছে আর বাউল বলছে আমাদের শরীরের ভেতরও একটা নদী আছে।
     
    রুচির: সুবলদা এক আশ্চর্য মানুষ ছিলেন। এখন যত দিন যাচ্ছে আমি যখনই সুবলদার সঙ্গে আমার মেলামেশার কথা ভাবি, আমি ততই ওটাকে ভ্যালু করি। দীপকদা সুবল সম্পর্কে বলতেন যে, ও একটা পুরোনো ইন্দো-বার্মিজ ট্র্যাডিশনকে মেন্টেইন করছে। এটা নিয়ে আমরা তখন হাসাহাসি করতাম। কিন্তু এখন আমি বুঝতে পারি, সুবলদার কাছে কী ছিল, যা গৌর বা পবনের কাছে নেই। ও মানে সেই ইরাবতী থেকে গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্রর এই পুরো এলাকার ট্র্যাডিশন, সাম হাউ সুবলদার কাছে ম্যাগনেট করে ওর ভিতরে ঢুকেছিল।
     
    সুরজিত: সুবলদার গান করার যে ভঙ্গি, একতারাটা হাতে নিয়ে সোজা করে তুলে ধরে ডুগিটার ওপর চাপড় মেরে একপাক ঘুরে গিয়ে নাচের স্টেপটা যেভাবে ফেলতেন। সেটার কথা বলছো তো?

    রুচির: ইয়েস, দ্যাট বডি মুভমেন্ট ওয়াজ ব্রিলিয়ান্ট। ফিল্মে আমরা ওই মুভমেন্টটা রেখেছি।

    সুরজিত: সুবলদার একটা রাধা ভাবও ছিল।

    রুচির: রাধা ভাব, অ্যান্ড্রোজেনাস ভাব, অসাধারণ বডি ল্যাঙ্গুয়েজ। যেটা পবন মাঝে মাঝে ম্যানুফ্যাকচার করার চেষ্টা করে, আসলে কিন্তু ওর মধ্যে একটা ডিপ ম্যাচিসমো আছে। সুবলদার মধ্যে যেটা একদম ছিল না। সুবলদা হয়তো কাউকে বলল, যে, না এটা করতে পারব না। সেটা এরকম কোনও মেল অ্যারোগেন্স থেকে বলছে না। বলছে একজন অর্ধনারীশ্বর। মানে অথরিটি অফ দ্যাট কাইন্ড।
     
    সুরজিত: পবন, গৌর বা হরিপদ গোঁসাই এঁদের একটা মেল ব্যাপার আছে। যেটা সুবলদার একেবারেই ছিল না।

    রুচির: আর যে সুরটা ওর গলা থেকে বেরতো, সেটা শোনা একটা অদ্ভুত এক্সপিরিয়েন্স, যাঁরা শুনেছেন তাঁরা জানেন, যখন গাইছেন, দেহের মধ্যে নদী আছে/ সেই নদীতে বান ডেকেছে তখন একটা কম্যাণ্ড নিয়ে বলছেন আর যখন গাইছেন
     জনমদুখি কপাল পোড়া গুরু আমি একজনা তখন হি ইজ ক্রাইং।

    সুরজিত: গৌর হলো এর একদম বিপরীত। কিন্তু গৌরের ব্যাপারটা একটা ট্র্যাজেডি।

    রুচির: ওটা শুধু গৌরের জীবনের ট্র্যাজেডি নয়, আমাদের সবাইকার জীবনের ট্র্যাজেডি। গৌর কুড হ্যাভ বিন দ্য গ্রেটেস্ট। এখানে সবাই নুসরত ফতে আলি খানের কথা বলে, কিন্তু সাম হোয়ার ক্লোজ টু নুসরত, মানে গায়কির কথা বলছি না, একটা প্রেজেন্স, একটা স্পিরিচুয়ালিটির দিকে গানকে নিয়ে যাওয়া, এটা একমাত্র গৌর পারত। ওর প্রবলেম হল, ও কী সেটা ও দেখতে পেয়েছিল। পবন বা সুবলদা গ্রেটার পারসপেকটিভে নিজের পোটেনসিয়ালিটি অতো বুঝতে পারেনি। গৌর দেখে ফেলেছিল ও কে।

    সুরজিত: কিন্তু ও যে স্টার, সেটা জানার পর ও স্টারডমটাকে হ্যান্ডেল করতে পারেনি।

    রুচির: ওর যে আরও ভাব ছিল, জেণ্টেলনেস, লাফ, হিউমর, সেগুলো সব ও হারিয়ে ফেলেছে। এতো রাগ কেন? এতো অ্যাগ্রেসন কিসের? ইউ আর পসিবলি গ্রেটেস্ট, তুমি এগুলো ধরে রাখলে না কেন?
     
    সুরজিত: গৌর তোমার সঙ্গেও দুর্ব্যবহার করেছে।

    রুচির: করেছে। ওর কাছে ওটা কোনও ব্যাপার না।

    সুরজিত: তোমার সঙ্গে যখন প্রথম দুর্ব্যবহার করল তখন তোমার কী মনে হল?

    রুচির: মনে হয়েছিল ঠাসিয়ে একটা চড় মেরে বাড়ি থেকে বের করে দিই। পরমুহূর্তে ভাবতে লাগলাম কেন এই ট্রাজেডিটা হচ্ছে? বড় বড় রকস্টারের ডেথের কথা যখন ভাবি, জিম মরিসন, জিমি হেন্ড্রিক্স তারপর ওই মেয়েটি ... কী নাম যেন ...

    সুরজিত: জেনিস জপলিন। যারা ড্রাগ ওভারডোজে মারা গেছে।

    রুচির: এদের কথা যখন ভাবি, তখন আমার মনে হয়, যে গৌরকে আমি চিনতাম, সে ড্রাগ ওভারডোজে মারা গেছে। এখন যে গৌর চলে ফিরে বেড়ায় তাকে আমি চিনতে পারি না। যে গৌরকে আমরা ভালবাসতাম, যার ইমেন্স পসিবলিটি ছিল হি ইজ ডেড।
     
    সুরজিত: গৌরের ইংরেজি বলা, সম্পুর্ন ওর স্টাইলে বা ফিলসফিকালি জিনিসগুলো কনস্ট্রাকট করার ব্যপার, এসব ওর মধ্যে ছিল। গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা অর্গানিক ফুড, এসব নিয়ে গৌর কবে, সেই ১৯৮৯ এ বলেছিল। বলছে এই সূর্যটা গরম বেশি গরম করে দিচ্ছে। হয়তো ক্যাথরিনের কাছ থেকে জেনেছিল। কিন্তু ও একটা যেন মাস্টারের মতো এই যে একা একা বলে যেত, যেন ডিলিরিয়াম বা প্রলাপের মতো, এটা আমি বেশ কয়েক বার শুনেছি, ব্রিলিয়ান্ট।

    রুচির: গৌড় বলছে, একটা বাচ্চা তুমি দশ মাস দশ দিন পেটে ধরে জন্ম দেবে আর একটা বাচ্চা তুমি কেমিক্যালি জন্ম দেবে ... এই কথা কোন বাউল বলবে? মানে হাফ শুনেছে ইংরেজিতে, হাফ শুনেছে ফরাসিতে, হাফ শুনেছে জার্মানে, ধরতে পেরেছে ও। টেকনিকয়ালি হি ওয়াজ রিয়েলি গুড উইদ ফিক্সিং থিংস। হি হ্যাড আ গ্রেট মাইন্ড হুইচ হি ডেস্ট্রয়েড ইটসেলফ।

    সুরজিত: যে মন থেকে ও গেয়েছিল, এই দেহ টর্চলাইটে গুরু গো ভরে দাও জ্ঞানের ব্যাটারি / আমি দিনের বেলা রাস্তা কানা আর রাতে হোঁচট খেয়ে মরি।

    রুচির: সো গৌর ইজ ভেরি ডিফিকাল্ট টু টেক। অনেক ভালোবাসা আছে, এখন যখন ওর দাঁত পড়ে গেছে, গলাটা আগের মতো নেই, ও বুঝতে পেরেছে ওই বেশটা ধারণ করে এখন ওই বেশটা ফেলতে পারছে না। কিন্তু ফুললি খেলতেও
    পারছে না। এখন ও নখ দাঁত নেই এমন একটা পুরোনো বাঘ। কিন্তু সত্যি তো অনেক কিছু করে তুমি একটা পুরোনো বাঘ হতে পারতে। তা তো হলে না।

    সুরজিত: সেটা যে পারে নি তা কী আমাদের সবাইয়ের দোষ? তাই বা বলি কী করে?

    রুচির: কিন্তু একটা লেভেলে তুমি এই সোসাইটির স্ট্রাকচার একটা বাউলদের স্ট্রাকচারের মধ্যে তুমি কী ভাবে সারভাইভ করবে? আমার কাছে কোনো উত্তর নেই।

    সুরজিত: পবন কিন্তু যে ভাবেই হোক সময়ের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিলো।

    রুচির: পবনকে যখন প্রথম দেখি, কী সুন্দর গলা, কী মিষ্টি হাসি আর একটা বাচ্চা ছেলের মতো অভিমান রয়েছে।

    সুরজিত: খুব বায়না করতো। এই দাও, ওখানে চলো, ওকে ডাকো। তবে মিমলু ওকে প্রোটেক্ট করেছে।

    রুচির: এখন পবনকে দেখে আমার খুব ভালো লাগে। ওর একটা ম্যাচিওরিটি এসেছে, চুল পেকেছে, চশমা পরে, নাইস।
     
    সুরজিত: আজ থেকে পঞ্চাশ কী একশো বছর পরে বাউল গান কী ভাবে সারভাইভ করবে বলে তোমার মনে হয়?

    রুচির: জানি না। হতে পারে বাউল গান শুধু বেঁচে রইল ফিল্মে, অডিও রেকর্ডিংএ, সিডি বা ডিভিডিতে। কিন্তু এই ট্রাডিশনটার কিছু ম্যাজিক্যাল মোমেন্টস অন্য কোনও আর্ট ফর্মে ট্রান্সফর্মড হলো আর ওই ভাবেই সারভাইভ করবে। বাংলায় গ্রাম আর শহরের ডায়নামিক্সটা কোন দিকে যাবে তার ওপর অনেকটা নির্ভর করছে। এই বাউল ট্রাডিশন বাঁচিয়ে রাখার জন্য কোনও গভর্মেন্ট সাপোর্ট নেই, প্রাইভেট সাপোর্ট নেই, কোনো এন জি ও নেই। আগেও ছিলো না, কিন্তু আগে গ্রাম ছিলো একটা শেল্টার, এখন সে শেল্টারটা নেই, কারণ গ্রামেরও একটা শিফটিং হচ্ছে।

    সুরজিত: তুমি বেশ কয়েক বছর আগে সুইত্‍জারল্যাণ্ডে ছবিটা দেখালে লোকজন কী বলল?

    রুচির: নিউ জেনারেশনের ভালো লেগেছে। ওরা দেখছে ফিল্মের ডিভিডি কপি। যেটা ডিজিটাল ভিডিও নয়। যেটা স্মুদ নয়, জার্ক আছে, গ্রেইনস আছে, স্ক্র্যাচ আছে। তবু ওদের ভালো লেগেছে। আর যদি আমরা বাউল ট্রাডিশনের দিকে তাকাই তাহলে দেখব ওই ট্র্যাডিশনটাও আমার এই ফিল্মের মতো। দীপকদা বলতেন, বাউলদের সঙ্গ করা মানে ক্যাকটাসের সঙ্গে ঘর করা। কাঁটায় একটু ছড়ে যাবেই। পূর্ণদাস যেমন ক্যালিফোর্নিয়ায় বাউল আকাদেমি করেছে, সেখানে গেলে তোমার মনে হবে, বাউল ভীষণ নরম, মিষ্টি একটা জিনিস। বাউলরা মোটেও তা নয়। তারা অনেকেই বব মার্লের সমান, ইন টার্মস অফ ইনটেনসিটি অফ পারফরমেন্স, আঙ্গার, প্যাশন অ্যান্ড বিইং আবস্যালুটলি কনফ্রণ্টেশনাল হোয়েন দে নিড টু বি। এরপর যখন ওরা প্রেম দেবে তখন তুমি আরেকটা রূপ দেখবে। সেটা আসে ওদের ওই রাধা হয়ে কৃষ্ণ প্রেমের জন্য।


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ইস্পেশাল | ২৩ নভেম্বর ২০১২ | ১১৩১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • sweta | ***:*** | ২৮ নভেম্বর ২০১২ ০২:৪২89734
  • ভালো লাগলো । ধন্যবাদ।
  • কল্লোল | ***:*** | ২৮ নভেম্বর ২০১২ ০৭:২৯89733
  • এখন অন্ততঃ একটা এনজিও বাউল-ফকিরদের নিয়ে কাজ করছে। বাংলা নাটক ডট কম। এরা বাউল/ফকিরদের সাসটেনেন্সের দিকটা দেখছে। এদের দিয়ে দেশে বিদেশে অনুষ্ঠান করাচ্ছে।

    সুরজিতকে ধন্যবাদ দিলে সুরজিত আমার সুস্থতা নিয়ে সন্দেহ করতে পার, তাই দিলাম না। কিন্তু রেকর্ডেড কালিয়ার হদিশ দেবার জন্য পিঁপে ৯৬ পাওনা রইলো। রুচিরের সাথে যোগাযোগ হয়েছে। এই জানুয়ারী নাগাদ দেখা হবে। সব ঠিক থাকলে সনাতনদার কালিয়া শুনতে পাবে সব্বাই।
  • ranjan roy | ***:*** | ৩০ জুলাই ২০১৬ ১২:২১89735
  • কল্লোল সেরে উঠুক। তারপর কাবলিদার বাড়িতে ভাটে সনাতনদার কালিয়া শোনার ব্যবস্থা হবে নিশ্চয়ই; অন্ততঃ বইমেলার সময়!
    ইপি ও মামুর কাছে করবদ্ধ প্রার্থনা!!
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। চটপট মতামত দিন