এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  অপর বাংলা

  • রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে হাসান আজিজুল হক

    সাক্ষাৎকারঃ মুহিত হাসান লেখকের গ্রাহক হোন
    অপর বাংলা | ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১১ | ১২৩৪ বার পঠিত
  • মুহিত হাসান: আপনার ব্যক্তিগত জীবনের রবীন্দ্রনাথের কথা দিয়েই শুরু করা যাক। সেই ছোটবেলায় রবীন্দ্রনাথকে প্রথম কীভাবে পেলেন?

    হাসান আজিজুল হক: সম্প্রতি একজন আমার সাথে ঠিক এই বিষয়টা নিয়েই কথা বলেছে। যেন আমি কিছু বলি তাকে এ নিয়ে। তা আমি আমার স্মৃতি থেকে বলবার চেষ্টা করলাম তাকে কথাটা। কত বয়েস হবে তখন? দশ বছরও হয়েছে কিনা সন্দেহ। তখন পাঠশালাতে পড়ি , দ্বিতীয় শ্রেণী অথবা তৃতীয় শ্রেণীতে। তখন আমাদের খুব বড়, যাকে বলা যায় যৌথ পরিবার ছিলো। আর জ্ঞাতিগোষ্ঠীও প্রচুর ছিলো, প্রায় গ্রামের, আমাদের ভুবনপাড়ার অর্ধেকটা জুড়েই আমাদের জ্ঞাতিগোষ্ঠী। তা আমাদের বাড়ির ঠিক পাশেই তিনজন জ্ঞাতির বাড়ি ছিলো। একজনার সাথে আমাদের সর্ম্পক ভালো ছিলো না । তাদের বাড়িটা মাটির দেওয়াল দিয়ে ঘেরা। আলাদা। সে বাড়িতে আমরা বিশেষ যেতাম না। সে বাড়িরও কেউ এদিকে খুব একটা আসত না। আর পাশেই ছিলো পরপর দুটো বাড়ি। একটা আমার বাবার চাচাতো বড় ভাইয়ের বাড়ি, আর একটা হচ্ছে বাবার অন্য এক চাচার মেয়ের। তিনি বিধবা। সে বাড়িতে তিনি তার বড় ছেলে ও দুটি মেয়ে নিয়ে থাকতেন। আমাদের বুবু। যাইহোক, ঠিক পাশের বাড়ি থেকে, একজন স্কুলপড়ুয়া, আমার ঐ চাচার ছেলে ছিলেন---চাচার এক ছেলে, এক মেয়ে---তো উনি বোধ ক্লাস নাইনে কী টেনে পড়তেন---আমার বড় ভাই।

    ঐ যে স্কুলপড়ুয়া আমার যে বড় ভাই ছিলেন, চাচাতো ভাই---তাদের মনে হয় পাঠ্য ছিলো একটা বই---সে বইটা গল্পগুচ্ছ। কিন্তু আমার স্মৃতিতে এতটা স্পষ্ট নেই যে পুরো গল্পগুচ্ছের সব গল্পই---প্রথম খণ্ডে অন্তত---সব গল্প থাকার তো প্রশ্নই ওঠে না---তিন খণ্ডে তো পরবর্তীকালে গল্পগুচ্ছ বেরিয়েছে। প্রথম খণ্ডেরও সব কটি গল্প ছিলো কিনা তাতেও আমার সন্দেহ। আমার মনে হয়, প্রথম খণ্ড থেকে কিছু গল্প---সাত-আটটা গল্প হতে পারে আরকি--- আলাদা করে নিয়ে র্যাপিড -রিডার ধরণের কিছু একটা করা হয়েছিলো। রবীন্দ্রনাথেরই গল্পগুচ্ছ---তার মধ্যে যে গল্পগুলো ছিলো স্পষ্ট মনে আছে আমার। এবং যতদূর মনে হয় প্রথম খণ্ডের দুটো তিনটে গল্প সেখানে ছিলো না। সে জন্যই বলছি, গল্পগুচ্ছেরও ভেতর থেকে বাছাই করা কিছু গল্প। দ্রুতপঠনের জন্যে এ বইটা তৈরি করা হয়েছিলো। এই বইটা, যত্রতত্র যেখানে সেখানে পড়ে থাকতো। আমার ঐ ভাইয়ের পড়াশোনায় তো তেমন মন ছিলো না। বইপত্র কোথায় কী থাকত সেটার খবর রাখতেন না। এই গল্পগুচ্ছের প্রথম মলাটটা নেই। মলাটটা উঠে চলে গেছে, শুধু গল্পগুচ্ছ লেখা আছে---এটুকু মনে আছে। আর যত্রতত্র পড়ে থাকতো এটাও মনে আছে। কখনো হয়তো ঢেঁকির কাছে আছে, ঢেঁকিটা আছে উঠোনে। আঙিনার একপাশে ঢেঁকি, সেই ঢেঁকিটার ওপরে। কখনোবা ঢেঁকিটার পাশে। কখনো মাটির খুব চওড়া বিস্তৃত যে তাওয়া, সেই তাওয়ার কোনো একটা জায়গায়। কখনো ঘরের ভেতরে---এইরকম। আমি কিন্তু সেই বইটার প্রতি তেমন করে আকৃষ্ট হইনি। কিন্তু, আমার ঐ যে চাচা, তিনি আমার বাবার চেয়েও বয়সে একটু বড়---তাঁর চাচাতো ভাই আরকি--- সেদিক হতে আমার চাচা। উনি খুবই শিক্ষিত মানুষ ছিলেন তাও নয়। কিন্তু বড় অদ্ভুত ছিলো তখনকার গাঁয়ের অনেক মানুষ। খুব সামান্য শিক্ষিত মানুষও খানিকটা ফার্সিও জানতো। তারপরে শুভঙ্করের যেসমস্ত কবিতায় অঙ্কগুলো ছিলো, হিসেবের, সেগুলো সব তাদের মুখস্ত থাকতো। নানান রকমের ধাঁধাঁ জানতেন তারা। আর গল্প বলতে বলতে কত রকমেরই যে গল্প করতে পারতেন---তার কোনো অন্ত নেই। আরব্য উপন্যাসের গল্প হোক বা অন্য কিছুর গল্প হোক, জীবনের অভিজ্ঞতায় একবারে পাকা সার--- তাদের তৈরি হয়ে গেছে। গাছের যেমন সার থাকে--- সবটাই সেরকম, খুব সারি। এরকমটা কিছু মানুষকে দেখলে মনে হতো। অথচ সেই মানুষেরা বা আমার চাচা একেবারেই দেহাতী মানুষ, নিজের হাতে লাঙ্গল চালাতেন, নিজের হাতে গরুর জাবনা কাটতেন, খেতে দিতেন। খালি গায়েই থাকতেন। খালি পা তো বটেই। একটা ধুতি পড়তেন। একটু উঁচু করে, হাটুর ওপর কোমরে বেড় দিয়ে ধুতিটা পড়তেন। এটুকুই পোশাক। তিনি,মাঝেমাঝে এই বইটা নিয়ে জোরে জোরে গল্পগুলো পড়তেন। আর শ্রোতা ছিলাম আমি। উনি যে কখন পড়বেন তার কোনো ঠিক নেই। আমি হয়তো দেখছি তিনি বইটা নিয়ে দাওয়ায় বসেছেন। যখন বইটা খুলেছেন, তখনি আমি চলে এলাম। তখন উনি , এটা পরিস্কার মনে আছে, কাবুলিওয়ালার গল্পটাই বেশীরভাগ সময়ই তিনি পড়তেন। খুব পছন্দ করতেন। আর ঐ গল্প পড়ে নিজের মনে মনে হাসতেন, মজাটা উপভোগ করতেন। আর আমিও কিন্তু গল্পটা তখন অন্ততপক্ষে বুঝতে পারতাম যে ও আচ্ছা, এই গল্প। খুব ভালো করে না বুঝলেও বেশ বুঝতে পারতাম । এখন যদি আমায় কেউ বলে যে, আপনি সেই গল্পটা কতবার শুনেছিলেন? আমি তাহলে বলবো কতবার শুনেছিলাম তার হিসেব নেই। আর নিজে পড়তে পারার পরে যে কতবার পড়েছিলাম --- ঐ বইটা থেকে---তারও হিসেব নেই।

    ...যে কারণে প্রায় পুরো গল্পটা আমি গোড়া থেকে শেষ এখনো একরকম মুখস্তই বলতে পারি আরকি। এমন মনের মধ্যে দাগ কেটে গেছে। যখন আমাকে কেউ জিজ্ঞেস করে যে রবীন্দ্র-রচনার সাথে প্রথম পরিচয়টা কখন-কীভাবে, তখন এই গল্পটাই বলি। এবং তখনই আরো কিছু কিছু গল্প, যা ওখানে ছিলো, তিনি পড়তেন--- "রামকানাইয়ের নির্বুদ্ধিতা' পড়ে খুব হাসতেন, তারপরে "স্বর্ণমৃগ', "সম্পত্তি-সর্মপণ', "দেনা-পাওনা' এই গল্পগুলো ওখানে ছিলো। "মুক্তির উপায়', "ছুটি', "খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন' এগুলোও ওখানে ছিলো। তো সেগুলো গল্পও আমি---তখনই আমার একেবারে খুব ঘনিষ্ঠভাবে সবগুলো গল্পের সঙ্গে একটা পরিচয় হয়ে গিয়েছিলো । গল্পগুলো তো জানতামই। এবং রবীন্দ্রনাথের গল্প তো---খুবই মানবিক রসে ভরা---কাজেই খুব উপভোগ করেছি---বেশ মনে আছে। "ছুটি' গল্পটা কিংবা "রামকানাইয়ের র্নিবুদ্ধিতা' অথবা "স্বর্ণমৃগ', "সম্পত্তি-সর্মপন'--- এই গল্পগুলো ঐ চাচাই আস্তে আস্তে পড়তেন, থেকে-থেকে, একটু-একটু করে পড়তেন। এ হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের সাথে বোধহয় আমার প্রথম পরিচয়। আট-ন-দশ বছর বয়সে। সেই সময়ে আর অন্য একটু পরিচয় হতে পারে, হয়তো আমার বইতেই হতে পারে---রবীন্দ্রনাথের ছবি। এখানে তুমি মনে করতে পারো যে সবত্রই তো রবীন্দ্রনাথের ছবি থাকে, কেউ না কেউ তো দেখেই ফেলবে---আমাদের সময়ে, ওখানে সর্বত্র তা দেখা যেত না---তা সত্ত্বেও একটা ছবি খুব দেখতাম। আমার বড় ভাইদের পাঠ্যবইতে, এমনকি নিজেরও,আমাদের পাঠ্যবইয়ে রবীন্দ্রনাথের একটা অস্পষ্ট ছবি ছিলো, নজরুলেরও ছবি ছিলো। এসব মনে পড়ে আরকি। কিন্তু সেটা তো আরেকটু বড় হয়ে। সেগুলো তো আলাদা কথা। তবে প্রথম পরিচয়ের কথা বলতে গেলে তোমাকে যে গল্পটা বললাম সেটাই বলতে হবে।

    মুহিত হাসান: একটু সামনের দিকে আগাই। আরেকটু বড় হয়ে, যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন, তখন আবার রবীন্দ্রনাথকে কীরকম করে অনুভব করলেন?

    হাসান আজিজুল হক: এগুলো কী তোমাকে হিসেব করে বলা যায়? ভবিষ্যাতে যখন তোমারও অনেকটা বয়স হয়ে যাবে--- তারপরে কেউ যদি তোমাকে এ-কথাই জিজ্ঞেস করে তখন তুমিও দেখবে যে কিছু বলতে পারছো না, কোনো খেই পাবে না। এটা অনেকটা, বাণ্ডিলের সুতো আজকাল পাওয়া যায় না---আগে বাণ্ডিলের সুতো পাওয়া যেতো--- বাণ্ডিলের সুতোর একটা বিশেষ পদ্ধতি হলো উল্টোপাকে খোলা---উল্টোপাকে ঘুরিয়ে তারপরে খোলা যেতো আরকি। কেউ যদি সে কাজ করার সময় গোলমাল করে ফেলতো, বাণ্ডিল যদি ছেটে ফেলতো---তাহলে আর ঠিক করতে পারা যেতো না। ঠিক কোনদিক থেকে কতটা সুতো মিলবে বোঝা যেতো না। রবীন্দ্রনাথ সর্ম্পকেও ঠিক তা-ই হয়েছে। বুঝতে পেরেছো তো? বাণ্ডিলের সুতো, এত বড় একটা বাণ্ডিল হয়তো রয়েছে ঠিকই---কিন্তু কতদিক থেকে যে ছিঁড়ে-টিড়ে এটা-ওটা কতজন যে কী করেছে, তা বলা খুব মুশকিল। যদি কেউ এক-কথায় দু-কথায় বলতে যায় তাহলে তাকে একটা বানিয়ে কথা বলতে হবে--- এ-ই হলো আমার কাছে রবীন্দ্রনাথ! এসব বানানো কথা আজকাল খুব চলছে। আমি ওরকম করে বানিয়ে কোনো কথা বলতে চাই না তো। কাজেই তিল তিল করে সঞ্চয় করা রবীন্দ্রনাথ, তিল তিল করে খরচ করাও রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের খরচও তো করেছি, শুধু চেয়ে নিয়েছি তা তো নয়, আর নিজেও তো খরচ করেছি! তিলতিল করে তাকে সঞ্চয় করেছি, তিলতিল করে খরচও করেছি। যতদূর মনে পরে, "রবিরশ্মি' বলে একটি বই---এই পরবর্তীকালে যে রবিরশ্মি বেরিয়েছিলো ওটা নয়---ছোট্ট একটা "রবিরশ্মি', রবীন্দ্রনাথের জীবনী ছিলো সেটা। সেইটা মনে খুব দাগ কেটে আছে। এখন রবীন্দ্রনাথের যে সমস্ত অসাধারণ জীবনীগ্রন্থ বেরিয়েছে---প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় করেছেন, প্রশান্তকুমার পাল করেছেন---এগুলোর অন্য গুরুত্ব আছে। কিন্তু মনের মধ্যে খুব একটা প্রিয় জায়গা যদি দখল করে থাকে কোনো গ্রন্থ, তবে সেই বইটাই। কারণ সেখানে রবীন্দ্রনাথের ছোটবেলার কথা এমন সুন্দর করে দেওয়া আছে, রবীন্দ্রনাথের একেবারে ছোটবেলায় তাঁর কবিতা লেখার চেষ্টা, তাঁর ছড়া লেখার চেষ্টা, তাঁর নিজের একটা কাঠের সিংহ ছিলো---সেই সিংহটার সামনে তিনি বলিদান করবেন, কাঠের খাঁড়া হাতে নিয়ে বলবেন রবি বলি দেবে। সেজন্য উনি নিজে মন্ত্র তৈরি করেছিলেন। এইসব জিনিসগুলো এত সুন্দর করে মনের মধ্যে এখনো খুব স্পষ্ট ও পরিস্কার হয়ে আছে।

    আর ঐ সময়েই বোধহয় তাঁর একটা দুটো কবিতা পড়ছি, খুব সহজ কবিতাগুলো হয়তো তখন পড়ছি--- "অন্তর মম বিকশিত করো, অন্তরতর হে' বা এই জাতীয় কোনো কবিতা। আর একটু বড় হওয়ার পরে, আমি পড়া শুরু করেছি আমার বড় ভাইদের স্কুলপাঠ্য বইগুলো। এইগুলো তোমরা এখন হয়তো কল্পনাও করতে পারবে না, এখনকার বইগুলো এত রস-কষহীন, এত যান্ত্রিক, এত বিবমিষা-জাগানো হয়েছে যে সেটা ভাবা যায় না। যত সুন্দর দেখতে বই ততই অনার্কষণীয়। আমাদের সময়ে এই বইয়ের প্রকাশনা ওত ভালো ছিলো না ---আর আজকাল যেমন ছাপার উন্নতি হয়েছে তাতো ছিলোই না---কিন্তু একটা জিনিস ছিলো, পাঠ্যতা জিনিসটা অনেক বেশী ছিলো। তখনকার ঐ যে অক্ষর বসাতো---সিসের অক্ষর একটা একটা করে । যেটাকে বলে লেটারপ্রেস। একেকটা অক্ষর ধরে ধরে বসাতো। এগুলো কিন্তু চোখের জন্যে আরামের, পড়তে খুব ভালো লাগত। তা এইসমস্ত বই তো তখন চারপাশে খুব বেশী থাকতো না। যা থাকতো, বহুবার সেসব বই আমি পড়তাম। আমার রবীন্দ্রনাথ পড়া সেইজন্য যতদূর মনে পড়ে,"গুপ্তধন' গল্পটা কতবার যে পড়েছি! আমার বড় ভাই ক্লাস টেনে পড়তেন, আমার ফুফাতো বড় ভাই---তখন বইগুলো কত যত্ন করে ছাপা হতো---এ-ই-র-ক-ম মোটা ছিলো বাংলা পাঠ্য বইটা। এবং কাপড়ের মলাট দেওয়া। এরকমই মোটা বই ছিলো রমেশচন্দ্র মজুমদারের "ভারতবর্ষের ইতিহাস'। বৃহাদায়তন এবং কোনো রকমের অশ্রদ্ধা নেই যে ছোটরা পড়বে বুঝবে কিনা---তা নয়। আমরা তো বুঝেছি, তারা যদি কঠিন করেই লিখে থাকবে তাহলে আমরা বুঝলাম কী করে? আমি তো বেশ বুঝতে পেরেছিলাম। এখান থেকে আমি "মহাপ্রস্থানের পথে'র একটা অংশ পড়েছি---ক্লাস সেভেনের পাঠ্যবইতে---প্রবোধ স্যানালের লেখা। রবীন্দ্রনাথের অনেক কবিতা এ বই থেকেই পড়েছি। আর, যখন পুরোপুরি ওদের টেক্সটা দেওয়া হলো---ক্লাস নাইন-টেনের জন্যে---তখন আমার হাত থেকে বই কেড়ে নিতো সেই বড় ভাই---দেখলেই--- বলতো "রেখে দে'! কিন্তু আমি লুকিয়ে, আধো-অন্ধকারের মধ্যে বসে ঐ বই খুলে "গুপ্তধন গল্পটা পড়তাম---বিশেষ করে "গুপ্তধন' গল্পটাই! কেন যেন মনে পড়ে---"পায়ে ধরে সাধা/ রা নাহি দেয় রাধা/ শেষে দিলো রা/ পাগল ছাড়ো পা/তেঁতুল বটের কোলে/দক্ষিণে যাও চলে' ইত্যাদি ইত্যাদি--- এইসব গল্পগুলো কীভাবে কীভাবে মনে আছে এবং বলতে বললে আমি প্রায় মুখস্ত বলতে পারবো। এইতো বলছিও---কতবার যে পড়েছি! এইরকম করে আমার বড়দের অনেক পড়ার বিষয় বেশ অল্প বয়সেই কব্জায় এসে গিয়েছিলো---আমি তখন হয়তো ফাইভে পড়ছি কিংবা সিক্সে পড়ছি---তার বেশী হবে না---আমি তখনই ঐ বইগুলো পড়ে নিয়েছি আরকি।

    মুহিত হাসান: কত আগে "গোরা' নিয়ে লিখেছিলেন। সেই প্রবন্ধের ভাবনায় এখন কি কোনো পরিবর্তন আনতে চান? ঐ সিদ্ধান্তেই কী এখনো স্থির আছেন?

    হাসান আজিজুল হক: মানুষ তো বদলায়। "গোরা' নিয়ে যা লিখেছি---একটা বড় প্রবন্ধ---"রবীন্দ্রনাথের স্বদেশভাবনা: গোরা'। কথাসাহিত্যের কথকতা গ্রন্থে আছে। কোনো একটা উপলক্ষে লিখেছিলাম নিশ্চয়ই। লেখাটাকে হয়তো আমি এখন আরো বড় করবো। যাইহোক --- না, আমি তেমনকিছু বদলাবো না --- বোধহয় আমার কথা আমি এখনও ঐভাবেই বলতে চাই। কারণ সেখানে আমার জায়গাটা তো পরিস্কার করা আছে। বারবার আমি যে কথাটা বলি---রবীন্দ্রনাথকে খরচ করারও আছে,রবীন্দ্রনাথকে পুঁজি হিসেবে গ্রহণ করে সেটাকে আবার নিয়োগ করে কিছু উদ্বৃত্ত বের করার যে কাজ সেটাও আছে---সবই করি। কাজেই আমি ওখান থেকে আপাতত, ঐ অবস্থান থেকে, রবীন্দ্রনাথ সর্ম্পকে যে কথাগুলো বলেছি---ঐ অবস্থানটি থেকে এখন সরে দাঁড়ানোর কোনো উপলক্ষ বা কারণ ঘটেনি।

    মুহিত হাসান: ইদানীং বাংলাদেশের কিছু তথাকথিত তরুণ কথাসাহিত্যিকদের দেখা যায় যে তারা অকারণেই রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসকে খাটো করে দেখছেন। রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পকে তারা অস্বীকার করতে পারেন না মোটেও, কিন্তু তারা তাঁর উপন্যাসের প্রতি একটুখানি অমনোযোগীই। রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস পাঠ না করেই কখনো কখনো তারা এরকম কথা বলছেন। এ নিয়ে আপনি কী বলবেন?

    হাসান আজিজুল হক: (হাসি) তাতে আমি কী করবো বলো? আমি তো বলি যে বাংলা সাহিত্যে "গোরা'কে অতিক্রম করে যেতে পারে বা গিয়েছে এমন কোনো উপন্যাস এখনও পর্যন্ত লেখা হয়নি। বঙ্কিমচন্দ্রের কোনো উপন্যাসও নয়।"গোরা'র এই প্রসার, "গোরা'র এই বিস্তৃতি আর "গোরা'র এই সার্চ--- যে অনুসন্ধান---এটা আমাদের ধারণারও বাইরে। আমরা এখন খুব ছোট্ট জিনিস নিয়ে পড়ে আছি, খুব ক্ষুদ্র জায়গায় পড়ে আছি।

    মুহিত হাসান: এই ক্ষুদ্রতাটা কেন? কেন আমাদের এই দৈন্যতা?

    হাসান আজিজুল হক: হবে না কেন? হবেই তো। ক্রমাগত যে ক্ষুদ্র হয়েছি। পলিটিকালি ক্ষুদ্র হয়েছি, কালচারালি ক্ষুদ্র হয়েছি, দুই বাংলা ভাগ করে ক্ষুদ্র হয়েছি---ক্রমেই তো ক্ষুদ্র হচ্ছি! ফলেই রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে যে এই কথাগুলো---তারা কেন বলেন , কীজন্য বলেন, কী সমাচার আমি কিচ্ছু জানি না--- কারো থাকতেই পারে যেকোন বক্তব্য বা ভাবনা। কিন্তু আমার কথা এই, ঐ গদ্য পদাতিক গদ্য নয়, অশরীরি গদ্যও নয়--- সেটা গজবাহিনী গদ্য। বুঝতে পেরেছো তো? দীর্ঘ পা ফেলে চলা, যেমন গোরা পা ফেলেছে---লম্বা লম্বা পা। রবীন্দ্রনাথের গদ্যও ওখানে সেরকম। ব্যাপক, বিস্তৃত, অতিশয় সুন্দর গদ্য। কাজেই আমার নিজের ধারণা তো আমি বারবার বলেইছি যে রবীন্দ্রনাথ বলো আর যাই-ই বলো , উপন্যাস বা কোনো কিছুরই নির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই। কোনোদিনই ছিলো না, এখনও নেই, ভবিষ্যতে থাকবেও না। এবং কোনো লেখক সেরকম সংজ্ঞা মেনে চলবেনও না। আমি যেমন কোনো সংজ্ঞা মানি না। কাজেই উপন্যাস হিসেবে রবীন্দ্রনাথের কোনো লেখা ভালো নয় , একথা বললে উপন্যাস বিষয়ে আগে একটা ধারণা তৈরি করতে হয়---এরকম হলে উপন্যাস হয়, এরকম হলে উপন্যাস হয় না---এই জিনিসটার অস্তিত্তই আমি স্বীকার করি না। উপন্যাস সর্ম্পকিত কোনো সুর্নিদিষ্ট আকার বা ধারণা যে বাস্তবিকই নেই তা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ উপন্যাসগুলোর সাথে পরস্পরের তুলনা করলেই বুঝতে পারা যায়। আর এই চিন্তাটাও অজ্ঞতাপ্রসূত যে উপন্যাসের একটা নির্দিষ্ট আকার আছে, সে আকারের মধ্যে পড়লেই শুধু তাকে উপন্যাস বলা যায়। কাজেই আমি তো মনে করি, "গোরা' রবীন্দ্রনাথের একটা শ্রেষ্ঠ কাজ, অসাধারণ কাজ। আমি কারো ওপর আমার চিন্তা চাপিয়ে দিতে চাই না, তারা যদি এরকম কথা বলে তবে আমি খালি বলবো: না, মানলাম না---তুমি আমার সাথে কথা বলো, আমি বুঝিয়ে দেবো আমি কেন মানলাম না। আধুনিকতা থাকবে, নতুন কথা থাকবে, আমার বিরুদ্ধ মত থাকবে--- এটাতো খুব স্বাভাবিক। তবে ওজনটা আমি করবো, ওজন করে কোনটা হাতে নেবো আর কোনটা নেবো না সেটা ঠিক করবো --- এই পর্যন্তই। এটা ওই, ওটা এই বলে ঘোষণা করা--- এ হলো রায় দেওয়ার মনোভাব, রায় দেওয়ার মনোভাব সুপ্রীম কোর্টে খাটে, সাহিত্যে তা চলবে না। আমি দেখেছি, দেবেশ রায়কে এক অনুষ্ঠানে কেউ বলছিলো "আমার কিন্তু গোরাটা ততটা ভালো লাগে না'--- দেবেশ রায় তখন খাচ্ছিলেন, খাওয়াটা মুখের কাছে নিয়ে, প্রশ্নকর্তার দিকে তাকিয়ে বললেন,অত্যন্ত বিকৃত কণ্ঠে "পড়ো না! খারাপ লাগে? তো পড়ো না! তোমাকে পড়তে বলেছে কে? তুমি পড়ো না!' এই হলো দেবেশ রায়ের রিএ?যাকশন। আমিও তাই বলবো। ঘোষণা দেবার দরকার কী? যার ভালো লাগে না সে না পড়লেই পারে(উচ্চৈস্বরে হাসি)!

    মুহিত হাসান: ইদানীং আমার রবীন্দ্রনাথ বলে একটা কথা খুব শোনা যাচ্ছে। এখন আপনার সেই ব্যক্তিগত রবীন্দ্রনাথের কথাতেই আসি। আপনি রবীন্দ্রনাথকে কেন চান এবং কীভাবে?

    হাসান আজিজুল হক: ভালো বলেছো। "আমার রবীন্দ্রনাথ' শিরোনামে তো আমিই একটা বই করবো। শুরুতে তোমাকে যে কথাটা বললাম, ওটাকে কী বলতে পারি "আমার রবীন্দ্রনাথ'?

    মুহিত হাসান: তাতো অবশ্যই বলতে পারেন ।

    হাসান আজিজুল হক: যদি বলি আমার রবীন্দ্রনাথের কথা, যিনি আমার ব্যবহারের রবীন্দ্রনাথ নাকি ব্যক্তিগতভাবে একজন মানুষকে উপভোগ করা বা গ্রহণ বিষয়টা নিয়েই আমার রবীন্দ্রনাথ?

    মুহিত হাসান: ব্যক্তিগতভাবে গ্রহণ-বর্জনের বিষয়টাই ধরি।

    হাসান আজিজুল হক: কীভাবে তাকে নিয়েছি , এক দু কথায় কেমন করে এই প্রশ্নের জবাব দেবো? বলো? একটু আগেই তোমায় বললাম আমার ছোটবেলাকার "গল্পগুচ্ছ'টাকে ঐভাবে দেখার কথা, তারপরে ওর সাথে তখনি তো আমি জড়িয়ে গেলাম। এই জড়িয়ে যাওয়াটা কী কারো জ্ঞানের জন্যে? এই জড়িয়ে যাওয়াটা কেন? কেন ঘটছে? তাহলে বোঝো, যদি মানুষের প্রতি আমার আগ্রহ থাকে সেক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের রচনার প্রতিও আমার আগ্রহ থাকবে। কেননা রবীন্দ্রনাথ সারা জীবন যা কিছু করেছেন---এই মানুষের ওপরে যতই বলো শেষ অবধি আর কাউকেই ঐভাবে স্বীকার করেননি---সবচেয়ে বেশী মূল্য দিয়েছেন মানুষকেই। তার কাছে দেবতা, ঈশ্বর--- যেগুলোকে আমরা প্রায় বিমূর্ত ধারণা বলি---তার কাছে এইগুলো ছিলো না। রবীন্দ্রনাথের কবিতায়, নাটকে, ছোটগল্পে, উপন্যাসে মানুষের মিছিল হাজার লক্ষ হয়ে দাঁড়ায়। তাতে মানুষের অকল্পনীয় বিস্তারিত কর্মপ্রবাহেরও সামনা-সামনি দেখা মেলে। বড়, আরো বড়, ছোট, অতি ছোট, সূক্ষ্ণ আবার ঋজু সবল ---সবাই একসঙ্গেই চোখে পড়ে। মানবজীবনের উষ্ণতা, নিবিড়তা, নিবিষ্ট এক সান্নিধ্য-ঘনিষ্ঠতা পূর্ণতায় চরাচর পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। মানুষকে যদি কেউ চূড়ান্ত বলে গ্রহণ করেন, তারপরে আর কিছু নেই। তাতে কী বিশ্ব বাদ যায়? তাই সেই চিন্তাটাই তো বৈশ্বিক চিন্তা। কারণ পৃথিবীতে তো মানুষেরই বসবাস। মানুষকে পৃথিবী থেকে তুমি বাদ দিয়ে দাও,তাহলে পৃথিবী বলে আর কোনো বস্তর থাকবার দরকারও নেই---তুমি তাকে ছেড়ে দিয়ে অন্য গ্রহে চলে যাও।

    আর তাঁর গান তো আমি প্রতিনিয়তই শুনি---সবসময় শুনবোই আরকি---এর প্রতি কোনোদিন বীতশ্রদ্ধ হবো বলে মনেও হয় না। তো গান যেরকম করে তৈরি হয়---চট করে শোনা যায়। গল্পের বেলায় সেখানে অবসর লাগে, নিজেকে পরিশ্রম করে পড়তে হয়---কিন্তু তাঁর গল্পও তো আমি পড়বো---তাঁর উপন্যাসও আবার পড়বো---"গোরা' নিয়ে এত কথা হচ্ছে, কাজেই সেটাও আরেকবার পড়বো । তাঁর আঁকা ছবি দেখবো--- মূল ছবি আমি এখনো দেখিনি, কিন্তু খুব অসাধারণ সব রিপ্রিন্ট হয়েছে তো---সেগুলো দেখছি, দেখবও। রবীন্দ্রনাথের লেখা নাটক মঞ্চস্থ হলে তা আমি দেখবো, উপভোগ করবো। রবীন্দ্রনাথের ভাবনার অংশ নেবো তাঁর প্রচুর পরিমাণে সমাজচিন্তামূলক,দেশচিন্তামূলক যেসব লেখাপত্র আছে সেখান থেকে। রাষ্ট্রচিন্তামূলক ও সমগ্র পৃথিবীর মানুষের জগৎ সর্ম্পকিত রচনাগুলোর সবই দেখবো আমি। কাজেই এদিক থেকে বলা যায় যে রবীন্দ্রনাথ আমার কাছে কীভাবে গ্রহণযোগ্য সেকথার জবাব তো ঐভাবেই দিতে হবে। কত লোকই তো গ্রহণযোগ্য---রবীন্দ্রনাথও গ্রহণযোগ্য। এবং রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে আমি বলতে পারি, এতটা অপরিহার্য বিশেষ আর কাউকে মনে হয় না। মানে শিল্প-সাহিত্যের জগতে বা আমার জীবন-যাপনের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের মতো ওতটা অপরিহার্য আর তেমন কেউ নেই। অন্তত শিল্পী-সাহিত্যিকদের মধ্যে, লেখকদের মধ্যে, কবিদের মধ্যে নেই। হ্যঁ¡ হতে পারে, আমার ভাষার কবি বলে--- আরেকজন হয়তো বললো , না গ্যাটেকে আমি আরো অনেক বেশি কাছে পেতে চাই, হোমারকে পেতে চাই। আমি বলবো: না, ঠিকই আছে---কিন্তু যে কারণে রবীন্দ্রনাথকে সব চাইতে বেশি অন্তরঙ্গভাবে পাওয়া যায় বলে আমি মনে করি, সেটা হলো এই --- তিনি আমার ভাষার লেখক। এই সুবিধাটা আমি রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে পাচ্ছি।

    মুহিত হাসান: একটা কথা খুব শোনা যায়, পূর্ববঙ্গে না এলে নাকি রবীন্দ্রনাথ এই রবীন্দ্রনাথই হতেন না। এই মতকে আপনি কতটা যথার্থ মনে করেন?

    হাসান আজিজুল হক: এই কথাগুলো সব সাদা-কালোতে ভাগ করা। সাহিত্যের ক্ষেত্রে এ সমস্ত কথা অবান্তর। যারা এসব কথাগুলো বলে, তারা অবান্তর কথা বলে। আর যারা এসব নিয়ে ভাবে, তারাও অবান্তর কথা বলে। যা পাওয়া যায় সেটা বাদ দিয়ে, তর্ক-বিতর্ক করে সময়টা নষ্ট করে। হতেন কী হতেন-না ---গনৎকারের মতো এইসমস্ত কথাবার্তা বলার কোনো অর্থ হয় নাকি! কলকাতা শহরও খুব বড় জিনিস তার কাছে। শান্তিনিকেতনও, সেখানকার সেই উদার মাঠ এবং খরার রাঢ়বঙ্গ তার মনের ভেতরে আছে। আবার এইদিকে হলো উতলানো ছলছল নদীবহুল যে বাংলাদেশ---মধ্যবঙ্গের কথাও এসেছে। শুধু পূর্ববঙ্গ নয় কিন্তু! পূর্ববঙ্গের কিছু অংশ , মধ্যবঙ্গের কিছু অংশ , দক্ষিণবঙ্গ ও উত্তরবঙ্গের কিছু অল্পসল্প জায়গা বা ওদিকে, অন্যদিকের কিছু অঞ্চল, আরকান-টারাকান হতে পারে আরকি---এসব মিলিয়েই তাঁর ছোটগল্পের ভূগোল তৈরি হয়েছে।

    এসব জিনিস হলো খুব ভালো করে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করার মতো বিষয়। এখন যা ঘটছে তা হলো, যদি তেমন কোনো প্রসঙ্গ আসে বা তেমন কোনো মীমাংসার দরকার হয়---তখন আমরা দেখতে বসি যে রবীন্দ্রনাথ তাঁর সমগ্র-প্রতিভার কতভাগ কোন জায়গা থেকে নিয়েছেন। আমি বলবো এইসব ভাগের কোনো দরকার নেই। "ছিন্নপত্র' আমরা এ সমস্ত ভাগাভাগি ছাড়াই পড়তে পারি।

    মুহিত হাসান: এটাতো রবীন্দ্রচর্চার ক্ষেত্রে আমাদের একটা সংকীর্ণতারই পরিচয় দেয়।

    হাসান আজিজুল হক: অবশ্যই। এই যে খালি সাদা-কালো করা। অমুক হলে তমুক হতো না, তমুক হলে অমুক হতো না---এইসব কথাগুলো কে সবজান্তার মতো বলে আমি জানি না। যারা এই কথাগুলো বলে, সবজান্তার মতো বলে। বুঝতে পেরেছো তো? কথাবার্তা সবজান্তার মতো করে বললে কোনো লাভ হয় না।

    মুহিত হাসান: ইদানীংকার রবীন্দ্র-চর্চার ক্ষেত্রে কোনো নতুনত্ব কী আপনি দেখতে পান? বাংলাদেশে এখন যা হচ্ছে।

    হাসান আজিজুল হক: একটা কথা কী জানো, রবীন্দ্রনাথ একদিক থেকে আমাদের কাছে সম্পূর্ণভাবে একটা ক্লোজড চ্যাপ্টার ছিলো। কফিনে ভরা একটা জিনিস, পেরেক মারা একটা জিনিস---তেইশ বছর ধরে ছিলো আরকি। কাজেই, যে ফুল, তার সৌরভ কোনোদিন বিকশিত হয়ে আমাদের সামনে দেখা দিতে পারেনি--- সে যখন প্রথম দেখা দিতে শুরু করে---তখন তার উত্তেজনা তো হবেই। আমাদের রবীন্দ্র-চর্চার এককথায় মোট ভলিউম বা আয়তন যেটা--- সেটা এখন খুব স্ফীত হয়ে গেছে। এটা যদি আমি পাঁচের দশকে কিংবা ছয়ের দশকের সঙ্গে তুলনা করি, তাহলে বলাই যেতে পারে এটা কল্পনাও করা যাবে না যে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আমাদের আগ্রহ কতটা বেড়েছে। আর উপলক্ষও অনেক সময় আমাদের নতুন কর্ম-ধারার জন্ম দেয়---এবারের সার্ধশততম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আমি তো মনে করি একদিক থেকে বাংলাদেশ আর ভারতবর্ষ কেন, গোটা পৃথিবীই তো মেতে উঠেছে। তা খানিকটা বলা যায় বৈকি। কিন্তু তুমি যদি বলো যে এবারের লেখাগুলোর দিকে তাকান, কোনটাকে কী নতুন কথা বলা হয়েছে সেটা বিশ্লেষণ করুন---তা তো ভিন্ন কথা। তাহলে আমার তো মনে হয়, যে সমস্ত কথাগুলো আমরা বলতে এবং শুনতে অভ্যস্থ, যে সমস্ত কথাগুলো মূলত শব্দবহুল, এককথায় যেগুলোকে বাগাড়রম্বরপ্রধান বলা যায়---অথবা যে সমস্ত কথা বলতে বলতে যার ধারই নষ্ট হয়ে গেছে। এরকম কথাই বেশি থাকছে---এটা ঠিকই। যাকে বলা যায় নতুন নতুন জায়গা থেকে রবীন্দ্রনাথকে দেখার চেষ্টাটা, প্রশ্ন করাটা কম---এখানে প্রশ্ন করা নিয়ে একটু বিশেষ করে বলি---রবীন্দ্রনাথের অতি-প্রশংসা করা যেমন একটা চল, তেমনি রবীন্দ্রনাথের দুটো এমনি জিনিস নিয়ে প্রশ্ন করা বা তাঁকে নিয়ে কিছু নিন্দাসূচক কথা বলা, এটাও কিন্তু কমন হয়ে গেছে---এটাও নতুন কিছু নয়। একসময়ে এটা নতুন ছিলো। তখন ভাবতাম---বাপরে, রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে এইসমস্ত কথা কী বলা যায়! এখন এইসমস্ত কথাগুলো বলতে বলতে রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে বলা কথা আমার মনের মধ্যে কোনো দাগ কাটে না। মনেও হয় না যে খুব নতুন কথা শুনছি। আসলে এইসব বিতর্ক করার কোনো মানে হয় না। রবীন্দ্রনাথ কী জবাব দিতে আসবেন? এসে জবাবদিহি করবেন? বললাম তো, এইসমস্ত জিনিসগুলো হচ্ছে অবান্তর। এগুলো আলোচনায় আনারই কোনো অর্থ নেই। কারণ পৃথিবীতে সব লোকই যে দরকারী কাজ করছে তা তো নয়---যারা অদরকারী কাজ করে বেড়াচ্ছে তুমি কী তাকে কিছু বলতে পারছো? পারছো না। তবে আর কী। যারা বলছে বলুক, বলতেই পারে। আমার গুরুত্ব দেওয়ার দরকার নেই। তাদের ফেলে দেওয়ার দরকারও নেই, গুরুত্ব দেওয়ারও দরকার নেই।

    মুহিত হাসান: রবীন্দ্রনাথকে আমাদের কীভাবে পাঠ করা উচিত, আপনার দৃষ্টিতে?

    হাসান আজিজুল হক: আমার মনে হয় যে রবীন্দ্রনাথকে পাঠ করা উচিত নেবার জন্যে। এখন যদি বলো কী নিতে পারি---তাহলে বলবো তাঁর কাছ থেকে উপলদ্ধির গভীরতা নিতে পারি। আবার বোধের অতলস্পর্শী অনুভবটা কেমন সেটা বুঝবার চেষ্টা করতে পারি। গানগুলো খুব ভালো করে শুনতে পারি। আমি সুপ্রতি তাঁর গান নিয়েই লিখছি, কিন্তু গানের আমি কিছুই জানি না। আমি তাই গানের বাণী নিয়েই লিখি---রবীন্দ্রনাথের গানের বাণী আমি কীভাবে শুনি---আমি তো তাঁর গানের ঐ যে স্বর, অর্ধস্বর, স্পর্শস্বর এসব বিষয়ে (অর্থাৎ সংগীতের দিক থেকে) আমার সুনির্দিষ্ট কোনো পাণ্ডিত্য নেই। তবু আমি রবীন্দ্রনাথের গান শুনে তা সম্বন্ধে কথা বলতে পারি। রবীন্দ্রসংগীত থেকে কী পাওয়া যায়, আমারই হিসেবে সেটা ভাবতে পারি। আর তুমি যদি প্রশ্ন করো যে ওতে "সব-ই পান?' আমি বলবো: না, সবটা আর কী করে পাবো। আমি কী আর নিগ্রোদের গানের সেই সংগ্রামী সুরটা কী রবীন্দ্রনাথের গানে পাবো? পাবো না। সেজন্য তো যাচ্ছি না তাঁর কাছে---যার কাছে যা পাওয়া যাবে না, তাঁর কাছে সেইজন্যে যাবো না। তাছাড়া ব্যাপার হচ্ছে, আমি নিচ্ছি কেন--- যদি ভাবি সব রবীন্দ্রনাথ করে গিয়েছেন, তাহলে আমি লিখতে যাচ্ছি কীজন্য--- এইটা হিসেব করলেই তো হয়। যদি মনে করি যা হবার তার সবই করে ফেলেছেন রবীন্দ্রনাথ---তাহলে আমার জায়গা কই? তাহলে আমার নিজের জায়গাটা বজায় রাখতে হবে--- বজায় রেখেই তো রবীন্দ্রনাথকে নিতে হবে নাকি! তা যে জায়গাটা আমার বজায় আছে সে জায়গাটায় তো রবীন্দ্রনাথ নেই, সেখানে আমি আছি(হাসি)।

    এখন এইভাবে যদি তুমি দেখো , তাহলে বুঝবে--- প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমরা পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতের মধ্যে দিয়ে অগ্রসর হই। রবীন্দ্রনাথকেও আমি সেভাবেই গ্রহণ করেছি।

    মুহিত হাসান: তাঁকে কী আমরা বিশ্ব-মানবতার একটা অসামান্য প্রতীক হিসেবে দেখতে পারি না?

    হাসান আজিজুল হক: হ্যঁ¡, তা তো বটেই । আমাদের গড়পড়তা যে হিসেবগুলো করার আছে--- সে হিসেবগুলোর দিক থেকে তো বলাই যায়। মানব-সংস্কৃতির একটা সর্বোত্তম প্রকাশ ঘটেছে রবীন্দ্রনাথের মধ্যে। আমি এক জায়গায় বলেছি--- তিনি নিজে গঠনকারী ও নিজে গঠিত---দুটোই। আর এখন তুমি যদি বলো রবীন্দ্রনাথ সব দিয়েছেন, সে-কথাও ঠিক নয়---আবার তুমি যদি বলো রবীন্দ্রনাথ কিছুই দেননি,সে-কথাও ঠিক নয়। অথবা এ কথা যদি তুমি বলো যে রবীন্দ্রনাথ যা দিয়েছেন তা অন্যেও দিয়েছেন, তাও ঠিক নয়---বা রবীন্দ্রনাথ যা দিয়েছেন তা শুধুমাত্র রবীন্দ্রনাথই দিতে পারেন, আর কেউ পারেন না--- তাও ঠিক নয়। আমি এভাবেই তো রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে অগ্রসর হচ্ছি, তাঁকে দেখছি। প্রতিনিয়তই দেখছি। কথাবার্তা বলছি। রবীন্দ্রনাথের যেসমস্ত জিনিস নিয়ে আমার মনে হচ্ছে কোনো প্রশ্ন তুলবো, সেসব বিষয় নিয়ে প্রশ্নও তো তুলেছি --- প্রশ্ন যে আমি তুলি না তা তো আর নয়।

    মুহিত হাসান: রবীন্দ্রনাথের দর্শন নিয়ে আপনার ভাবনাটা কী?

    হাসান আজিজুল হক: একসময় আমি রবীন্দ্রনাথের দর্শন নিয়ে একটু ভাবতাম। পশ্চিমের দর্শন যেভাবে তৈরি হয়েছে, রবীন্দ্রনাথের দর্শনকে সেভাবে বিচার করা যায় না। বরং, ভারতীয় দর্শনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের দর্শনটাকে পাশাপাশি রাখলে বিবেচনা করা যায়। ইউরোপে যারা সাধারণভাবে দর্শনের মানুষ, তারা হয়তো ভারতীয় দর্শনটাকে দর্শনের পর্যায়ভুক্তই করেন না। তারা একে একধরণের নিচু চোখে দেখেন । যদি আমরা পশ্চিমা দর্শনের ইতিহাসের নির্মাণের রাস্তাটা দেখি---তাহলে বোঝা যাবে যে ওটা অত্যন্ত কঠিন বৌদ্ধিক পথে অগ্রসর হয়েছিলো। অত্যন্ত কঠিন বিশ্লেষণের পথে তা অগ্রসর হয়েছিলো। তন্নতন্ন করে খোঁজা, প্রশ্ন করা, জবাব পাওয়া এবং সব জিনিসকে বিশেষ করে ফেলে তারপরে দেখা। ভারতের ঐতিহ্যটা তা নয়, ওটা একধরণের সমগ্র আরকি। সেজন্যে সাধারণভাবে দেখা যায় পূর্বদেশীয়---প্রাচ্যের যে দর্শন--- সেটা পশ্চিমের চোখে, ওদের কাছে কোনো দর্শন নয়। এটাকে তারা মনে করে এক ধরণের কবিতাধর্মী জিনিস , এটা এক ধরণের Mysticism-এর মতো জিনিস--- ধরা-ছোঁয়ার মধ্যে নেই। এই-যে জিনিসটা---এটা রবীন্দ্রনাথকে খানিকটা প্রভাবিত করেছিলো। আমি নিজে কিন্তু এই পথে নই, আমি অন্য পথের---আমি সর্বদা মনে করি, যেটাকে বলে চিৎশক্তি, মানুষের এই চিৎশক্তিটাকে সর্বদা বাদ দিয়ে কোনটাকেই শেষ পর্যন্ত দেখা ঠিক নয়। চিৎশক্তি বা চিন্তাশক্তি--- চিন্তাশক্তি আমাদেরকে বিশেষ দেখায়, অভ্যন্তর দেখায়, অখণ্ড দেখায়---আর আমাদের যে মহৎ আবেগগুলো আছে, আমাদের অনুভূতি-উপলদ্ধিগুলো আছে, তাকে সমগ্র দেখায় ---পার্ট দেখায় না, অংশ দেখায় না।

    সেইভাবেই রবীন্দ্রনাথের দর্শনকে আমি একসময়ে দেখার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু পরে রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত জীবনের দিকে তাকিয়ে দেখেছি যে সেখানে কোনো অস্পষ্টতা নেই তাঁর---কোত্থাও নেই। অর্থাৎ ভারতীয় দর্শনের যে অস্পষ্টতার কথাটা পশ্চিমে অভিযোগ হিসেবে শোনা যায়, সে অস্পষ্টতার ব্যাপারটা রবীন্দ্রনাথের ভেতর কখনো আর আমি খুঁজে পাই না। রবীন্দ্রনাথের চিন্তার মধ্যেও আর অস্পষ্টতা দেখি না , জীবন-যাপনের ভেতরেও আর অস্পষ্টতা দেখি না। সবকিছুতে খুব স্পষ্টভাবেই চিন্তা করার ব্যাপারটা দেখি। মুহিত হাসান : রবীন্দ্রনাথের যে ব্যবহার ও উপযোগিতা, আমাদের ভেতরে--- সে সর্ম্পকে?

    হাসান আজিজুল হক: সে কথা তো আমি গত দশ বছর ধরে সর্বত্রই বলে বেড়াচ্ছি। প্রত্যেকে নিজেই নিজের রাস্তা খুঁজে নিক---রবীন্দ্রনাথের কাছে যাবার জন্য। এবং রবীন্দ্রনাথের উপযোগিতা আছে কি নেই, সেটা সবাই নিজেই বিচার করুক।

    আমি তো মনে তাঁর উপযোগিতা আছে, শুধু আছে নয়---খু-উ-ব আছে।

    মুহিত হাসান: সামগ্রিকভাবে রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পকে কীভাবে দেখেন? আপনার ছোটগল্প লিখবার পেছনে কী রবীন্দ্রনাথ কোনোভাবে প্রভাব ফেলেছেন?

    হাসান আজিজুল হক: শোনো, এগুলো এত ব্রড কোয়েশ্চেন! ব্রড কোয়েশ্চেনে মুশকিল আছে। তাহলে অনেক অসুবিধা হয়ে যাবে। বলতে পারে যে রবীন্দ্রনাথের গল্প যদি এতই ভালোবাসেন তবে রবীন্দ্রনাথের বিপরীতে যেসব গল্প লেখা সেসব কী ভালোবাসেন না? আপনি কী মঁপাসার গল্প ভালোবাসেন না? ও হেনরীর গল্প ভালোবাসেন না? তখন তো মুশকিলে পড়ে যাবো আমি! কাজেই, বহু-মত বহু-পথ। রবীন্দ্রনাথেরও একটা পথ। অসাধারণ। রবীন্দ্রনাথের লেখা, এই পথের জায়গা থেকে---আমি সেখানে তাঁর কোনো তুলনা পাই না। মানুষের অন্তরে যেসমস্ত সুবুদ্ধি আছে, মানবতার বোধ যেগুলো আছে, মানুষের মধ্যে ঐক্যের যে ধারণাটা আছে---এগুলো এত চমৎকারভাবে প্রকাশ করার ব্যাপারটা রবীন্দ্রনাথে যেভাবে ঘটেছে, তাঁর ছোটগল্পের মধ্যে ---সেটার তুলনা মেলা ভার। আবার, যারা এসব করতে যাননি---তাদের মধ্যেও অনেকে অসাধারণ গল্প লিখেছেন। সে-গল্প আমার সমান প্রিয়। আর আমার ব্যক্তিগত বিষয়, আমার তো মনে হয় না যে কোনো কিছুতে রবীন্দ্রনাথের ব্যাপারটা আমি সচেতনভাবে গ্রহণ করেছি। তবে দেখতে পারে---আমার লেখা যারা পড়ে--- সেই পাঠকেরা। এটা তাদের জন্য থাকবে---তারা বিচার করবে। আমার বলার তেমন কিছু নেই।

    মুহিত হাসান: রবীন্দ্রনাথের কবিতার ক্ষেত্রে যাই। আপনার ব্যক্তিগত মত এ বিষয়ে ?

    হাসান আজিজুল হক: আমার মত হচ্ছে, রবীন্দ্র-কবিতা চিরকালের---তাঁর বহু কবিতা চিরকালের কবিতা। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কবিতাগুলোর সাথে তুলনীয়! এই-তো!

    মুহিত হাসান: শেষ প্রশ্ন, দিনের শেষের যে রবীন্দ্রনাথ---তিনি আপনার কাছে কেমন?

    হাসান আজিজুল হক: দিনের শেষের রবীন্দ্রনাথকে আমার কাছে সব-চাইতে পরিণত, সব চেয়ে পরিণত মানুষ, অভিজ্ঞতার দ্বারা জর্জরিত, অভিজ্ঞতার দ্বারা ঋদ্ধ, বাস্তবকে সব চাইতে পরিস্কারভাবে দেখতে পাওয়া মানুষ---এ-ই মনে হয়। রবীন্দ্রনাথ সব চাইতে ঋদ্ধ হয়েছেন---আমার মতে---যত তাঁর বয়োবৃদ্ধি ঘটেছে। তাঁর সৃষ্টিক্ষমতারও বৃদ্ধি ঘটেছে বয়স বাড়বার সাথে সাথে। এবং এত অটুট সৃষ্টিক্ষমতা নিয়ে তিনি আশি বছর বয়সে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। এটা আমার কাছে একেবারেই একটা প্রাকৃতিক ঘটনার মতো। কোনো মানুষের পৃথিবীতে এটা সম্ভব বলে আমার মনে হয়নি। শেষ মূহুর্ত পর্যন্তও সৃষ্টির এই অসাধারণ ক্ষমতা! সেজন্য শেষ রবীন্দ্রনাথকেই আমার কাছে সবচেয়ে পরিণত, সব চাইতে গ্রহণযোগ্য, সব চাইতে ভাবনা-উদ্রেককারী । কখনো কখনো বলা যেতে পারে এক ধরণের ডিস্ট্রার্বিং অভিজ্ঞতা হয় রবীন্দ্রনাথ পড়লে। ব্যক্তিগতভাবে আমার "শেষ কথা'র অনেক কবিতার কথা প্রতিনিয়তই মনে পড়ে। একটা দুপুরের কথা মনে পড়ে। ভিক্তোরিয়া ওকাম্পো তাকে যে বিশাল চৌকিটা, ইজিচেয়ারটা রবীন্দ্রনাথকে দিয়েছিলেন--- সেটা তাঁর উদয়নের যে ঘরটায় তিনি থাকতেন, ওখানে পাতা ছিলো। তার পেছনের দেয়ালে সাঁটা ছিলো রবীন্দ্রনাথের হাতের লেখা। "শেষ লেখা'য় যা আছে, "রৌদ্রতাপ ঝাঁ-ঝাঁ করে/ জনহীন বেলা দুপহরে।/শূন্য চৌকির পানে চাহি,/সেথায় সান্ত্বনালেশ নাহি।' এই যে "রৌদ্রতাপ ঝাঁ-ঝাঁ করে' এটা---আমি মনে করি---রাঢ়ের দুপুরবেলায় না গেলে তুমি বুঝতে পারবে না কথাটা। আর তাঁর তখনকার গদ্যে আছে সমসাময়িক বিশ্বটাকে দেখা, মানুষের ভবিষ্যত নিয়ে অসম্ভব উৎকণ্ঠা-উদ্বেগ এবং হতাশা---সব আছে। তারপরেও পদ্যে তিনি আমাদের মধ্যে উদ্দীপনারই সৃষ্টি করতে চেয়েছেন। অনেক কবিতা তখন লিখেছিলেন, কাঁপা-কাঁপা হাতে। "ঐ মহামানব আসে'! হাতের লেখাটা দেখো, তখন তাঁর হাতের লেখা কাঁপে---ভালো করে লিখতে পারেন না। মহামানব মানে কী? এখানে মানুষই বোঝাচ্ছেন, কোনো ঈশ্বর, অলৌকিক সত্ত্বা বা পয়গম্বর--- মোটেই সেসবের কথা মনে করেননি। মানুষের মধ্যে যদি গড় করো , যদি তোমাকে আমি জিজ্ঞেস করি What is the idea of a man? তখন তুমি কী জবাব দেবে? তুমি বলতে পারবে? বলতে পারবে না। তাহলে বলবার এইভাবে চেষ্টা করা যায়, সব মানুষ তো স্বতন্ত্র---কিন্তু এই সব স্বতন্ত্র মানুষ একটা জায়গায় তো মানুষ---কী সেটা? সেইটাকেই আমি মানুষ বলি, মানুষের ধারণা বলি। গায়ের রঙ আলাদা, ভাষা আলাদা, আচরণ আলাদা---প্রত্যেকটা মানুষ স্বতন্ত্র। এত স্বাতন্ত্র্য সত্ত্বেও বলার সময় বলি মানুষ, কেন বলি? এত পার্থক্য রয়েছে তো মানুষ বলে চিহ্নিত করি কেন? তাহলে নিশ্চয়ই মানুষ বলে একটা জিনিস আছে---যা এই এত আলাদার ভেতরেও এক---সেইটাকেই যদি মানব বলি আমি---রবীন্দ্রনাথের চোখে তিনিই মহামানব। এইটা দেখলে, মানবিক জগতের বাইরে রবীন্দ্রনাথের আর কিচ্ছু নেই--- এই কথাটা কিন্তু মাথায় ঢুকিয়ে নিতে হবে। দেবতা, ঈশ্বর যতই বলুন উনি---শেষমেশ সেই মানুষই তাঁর কাছে সব হয়ে দেখা দেয়।

    রবীন্দ্রনাথ সারা জীবনে এত শূন্যতা বা পূর্ণতার কথা বলেছেন---তিনি পরিশেষেও সেই--- শূন্য ও পূর্ণ। অনি:শেষ।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • অপর বাংলা | ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১১ | ১২৩৪ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। মন শক্ত করে মতামত দিন