মৃত্যুদন্ড সম্পর্কিত গবেষণা প্রকল্প (ডেথ পেনাল্টি রিসার্চ প্রজেক্ট) সম্পন্ন করতে সময় লেগেছে প্রায় ১৬ মাস, ৩০ লাখ টাকা, নেওয়া হয়েছে ৪০০ সাক্ষাৎকার। এই প্রকল্পের অধিকর্তা, দিল্লীর ন্যাশনাল ল' ইউনিভার্সিটির অ্যাসিসটেন্ট প্রফেসার অনুপ সুরেন্দ্রনাথের সাথে কথা বলেছেন উত্তম সেনগুপ্ত, তারই কিছু অংশ।
হঠাৎ এরকম একটা প্রকল্প হাতে নেওয়ার কথা মনে হল কেন?
ভারতে প্রশাসনের তরফ থেকে মৃত্যুদন্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত আসামীদের নিয়ে সেরকম কোনও গবেষণামূলক সমীক্ষা করা হয় নি। যেটুকু যা গবেষণা হয়েছে সেটা হয়েছে সুপ্রীম কোর্টের দেওয়া জাজমেন্টের ওপর। কিন্তু আমাদের মনে হয়েছে যেভাবে ভারতে আসামীদের মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়, সেটা গভীরভাবে তলিয়ে দেখা প্রয়োজন। এটা করতে গিয়ে আমরা দেখলাম যে স্বাধীনতার পর থেকে সর্বমোট কতজন মানুষকে আইনতঃ মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়েছে, তার কোনও তথ্য নেই, মৃত্যুদন্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত আসামীদের আর্থসামাজিক অবস্থা সম্পর্কে এবং তাদের পরিবার সম্পর্কে ন্যুনতম কোনও তথ্য নেই, ফৌজদারী বিচার ব্যবস্থা সম্পর্কে তাদের অভিজ্ঞতারও কোনও বিবরণ নেই। আমরা দেখলাম তথ্য যা পাওয়া যাচ্ছে তা অধিকাংশই ভুল।আমাদের ভারতের সবকটি কারাগার, যারা মৃত্যুদন্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত আসামীদের রাখে, তাদের থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে হয়েছে। আক্ষরিক অর্থেই আমাদের একেবারে 'শেষ' পর্যন্ত যেতে হয়েছে তথ্য যাচাই করতে। ২০১৩ সাথে 'ন্যাশনাল লিগ্যাল সার্ভিস অথরিটি'র (যার তৎকালীন প্রধান ছিলেন পি সদাশিভন), সাথে যৌথভাবে কাজ শুরু করায় কাজটাও যেমন বৈধতা পায় তেমনি সহজগম্য হয় বিভিন্ন জেলও।
তা প্রকল্প শুরু করার পরে ১৬ মাস কেটে গেছে, কোথায় পৌঁছেছেন বলে মনে করছেন?
প্রায় ৪০০ জন মৃত্যুদন্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত আসামীর সাথে আমরা কথা বলেছি। আধিকাংশ রাজ্যই সহায়তা করেছে, যদিও সাক্ষাৎকারগুলো রেকর্ড করার অনুমতি ছিল না আমাদের, কথাবার্তা সব জেলকর্মীদের উপস্থিতিতে হয়েছে। আর সেটাও যে সবসময় খুব মসৃণভাবে হয়েছে তা নয়, এই যেমন মহারাষ্ট্র সরকার নানা ছুতোয় আমাদের প্রায় আটমাস ঠেকিয়ে রেখেছিল। তারপরেও সন্ত্রাসবাদে অভিযুক্ত ৪ জন আসামীর সাথে কথা বলার অনুমতি দেয় নি। তামিলনাড়ু সরকার আজ পর্যন্ত অনুমতি দেয় নি, তারা দিল্লীর নিরাপত্তা সংস্থার অনুমোদন না পেলে দেবেও না। কিন্তু এইসব ছাড়াও প্রকল্পের সবচেয়ে কঠিন অংশ হল মৃত্যুদন্ডের আসামীর পরিবার পরিজনেদের খুঁজে বের করা। এই খুঁজে বের করার কাজটার জন্য প্রায়শই দরকার হয় চুড়ান্ত শারীরিক সক্ষমতা, বিরুদ্ধতা এবং মানসিক চাপ সহ্য করার ক্ষমতা। আমাদের তরুণ ছাত্র গবেষকরা অসামান্য পারদর্শিতা দেখিয়েছেন এই কাজে। বহু বাধা এসেছে কাজের পথে, কিন্তু সেসব সত্ত্বেও আমরা আমাদের কাজটা করে যেতে পেরেছি।
এই প্রকল্প থেকে আপনারা কী কী গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেলেন?
মূল রিপোর্টটি প্রকাশ করার আগে খুব বেশি বিস্তারিত তথ্য আমি বলব না। এইটুকু বলতে পারি যে, মৃত্যুদন্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত আসামীদের বৃহৎ অংশই পিছিয়ে পড়া শ্রেণী, দলিত ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের থেকে এসেছে, এদের মধ্যে অনেকেরই আবার এটাই প্রথম অপরাধ। অথচ সাধারণ বিশ্বাস যে এরা আসলে স্বভাব-অপরাধী, একাধিক অপরাধ করেছে। বেশীরভাগই আবার গ্রেপ্তারের পর পুলিশ স্টেশানে করা 'স্বীকারোক্তি'র ভিত্তিতে অপরাধী সাব্যস্ত হয়েছে (অথচ আইনানুযায়ী এইরকম স্বীকারোক্তিকে 'প্রমাণ' হিসেবে ধরা যায় না)। এদের অন্তত ৮০ শতাংশই স্বীকারোক্তি আদায়ে পুলিশের অত্যাচারের শিকার এবং সকলেই আসলে অত্যন্ত গরীব। এই ব্যপারটা হয়ত অনেকেই মনে মনে অনুমান করতাম, কিন্তু আমরাই প্রথম এটা প্রকৃত তথ্য, বিভিন্ন কেস স্টাডি ও সংখ্যা দিয়ে সকলের সামনে তুলে ধরতে চলেছি। এছাড়াও অপরাধের প্রকৃতি, অর্থাৎ যার জন্য একজন মানুষকে প্রাণদন্ড দেওয়া হয়েছে, অপরাধ প্রমাণে ব্যবহৃত প্রমাণের নির্ভরযোগ্যতা, অপরাধীকে প্রদত্ত আইনি সহায়তার ধরণধারণ, কারাগারে অপরাধীদের প্রতি আচরণ ইত্যাদি বিষয়েও অনেক ইন্টারেস্টিং তথ্য আমরা পেয়েছি।
আপনি কি বলছেন দন্ডপ্রাপ্ত আসামীদের একটা বড় অংশ আসলে নিরপরাধ?
দেখুন, নিরপরাধ কিনা, এটা কখনই আমাদের জিজ্ঞাসাবাদের সময় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে নি। মৃত্যুদন্ড নিয়ে আমাদের গবেষণায় দন্ডপ্রাপ্ত আসামী অপরাধী না নিরপরাধ এটা ধরাই হয় নি। আমরা মূলতঃ জানতে আগ্রহী ছিলাম আমাদের এই সমাজে কাউকে মৃত্যুদন্ড দেবার সময় ফৌজদারী বিচার ব্যবস্থায় কি পর্যাপ্ত আইনী সুরক্ষা আছে? আর আইনে য্তটা সুরক্ষা আছে, সর্বোচ্চ শাস্তি,হিসেবে প্রাণদন্ড দেবার সময় সেটা কত্খানি অনুসরণ করা হয়?
আমরা এমন সব কেস দেখেছি যেখানে অবশ্যই আইনি সুবিচারের বড়সড় খেলাপ করা হয়েছে। কিন্তু মুশকিল হল আপনি যখন কেসটা দেখছেন ততদিনে ভারতের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রীম কোর্ট অপরাধীকে প্রাণদন্ড দিয়েই ফেলেছে, কিম্বা রাষ্ট্রপতি ইতিমধ্যেই তার প্রাণভিক্ষার আবেদন নামঞ্জুর করে দিয়েছেন, সেখানে সংগৃহীত প্রমাণগুলি আবার শুরু থেকে দেখে বিচারপ্রক্রিয়া আবার শুরু করার সম্ভাবনা প্রায় শুন্য, ফলে হাতে খুব একটা কিছু বিকল্প থাকে না।
অধিকাংশ আসামী কি নিজেদের নিরপরাধ বলে দাবী করেছে?
আমরা যখন ওদের সাথে কথা বলি তখন ওরা নিজেদের নিরপরাধ দাবী করেছে কি করেনি তার চেয়েও বেশী করে নির্দিষ্টভাবে যে জিনিষটা বেরিয়ে এসেছে সেটা হল, এই প্রথম ওরা কাউকে ওদের দিকের কথাটা নিজেরা নিজেদের মুখে বলছে। কেউই ওদের দিকের গল্প বোঝার জন্য মাথা ঘামায় নি। খুব অল্প কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া এমনকি ওদের নিজেদের উকিল, সে প্রাইভেট বা সরকার নিযুক্ত যাই হোক না কেন, সেই উকিলের সাথে যোগাযোগ বা কথোপকথনের অবস্থা ভয়াবহ, খুব খারাপ। যেমনটা চলচ্চিত্রে দেখা যায়, আসামী ও তার উকীলের মধ্যে লম্বা লম্বা আলোচনা, কেস লড়তে কীভাবে এগোন হবে সেই নিয়ে বিস্তারিত প্ল্যান সেসব কিছুই এই সব কেসে হয় নি। যেটা হয়ে থাকে সেটা হল ফৌজদারী ব্যবস্থা তার নিজস্ব নিয়ম ও ধারণার বশবর্তী হয়ে চলে বিচার সম্পন্ন করে ফ্যালে, যেখানে একজন আসামী হল সবচেয়ে গুরুত্বহীন ব্যক্তি
'একটা সুসংবদ্ধ পরিবর্তন দরকার' বলতে আপনি ঠিক কী বোঝাতে চাইছেন?
ভারতের বাস্তবতা হল এখানে ফৌজদারী ব্যবস্থা একেকজনের জন্য একেকরকমভাবে কাজ করে। পুলিশ একজন গ্রামপ্রধান বা উচ্চবর্ণের লোকের সাথে যেভাবে ব্যবহার করে নিম্নবর্ণের লোক বা গরীব মানুষের সাথে একেবারে অন্যভাবে ব্যবহার করে। এবং এটা শুধু পুলিশ নয় আমাদের গোটা ফৌজদারী বিচার ব্যবস্থায় ভীষণভাবে জাতপাত, শ্রেনী ও ধর্মের ভিত্তিতে,প্রান্তিক মানুষগুলিকে আরও বেশী করে অপরাধী সাব্যস্ত করার প্রবণতা অত্যন্ত বেশি। এবং এটা কিন্তু স্রেফ প্রচলিত ব্যবস্থাটাকে ওপর থেকে খানিক বদলে দিয়ে বদলানো যাবে না। আমাদের সমাজের একেবারে গভীরে সামাজিক ও অর্থনৈতিক একটা আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন। এমন নয় যে আপনি স্রেফ একটা নব ঘুরিয়ে কয়েকটা কী-কম্বিনেশান বদলে দিয়ে এই বাস্তবতাকে বদলাতে পারবেন। একটা উদাহরণ দিই। বিহারে একটা কেসে কিছু উচ্চবর্ণের লোক গ্রেপ্তার হয়েছিল কিছু দলিতকে হত্যার জন্য, অন্য আরেকটি কেসে কিছু দলিত গ্রেপ্তার হয় কিছু উচ্চবর্ণের লোককে হত্যার দায়ে। এই দুটো কেস কিন্তু একেবারে আলাদাভাবে পরিচালিত হয়। দলিতদের বিচার ও শাস্তি হয় টাডা আইনে, কিন্তু উচ্চবর্ণের লোকেদের ক্ষেত্রে বিচার ও শাস্তি হয় ভারতীয় দন্ডবিধির বিভিন্ন ধারা অনুযায়ী। একইরকম অপরাধ, যেখানে একই ধরণের প্রমাণ পাওয়া গেছে উভয় ক্ষেত্রেই, সেখানে বরা ম্যাসাকার কেসে দলিতদের প্রাণদন্ড দেয় নিম্ন আদালত এবং তা বহাল থাকে সুপ্রীম কোর্ট পর্যন্ত, অথচ লক্ষমনপুরা বাথ গণহত্যায় অপরাধীরা নিম্ন আদালতে প্রাণদন্ড ও যাবজ্জীবন পেলেও পাটনা হাই কোর্ট তাদের 'প্রমাণাভাবে' মুক্তির আদেশ দেন।
মূল লেখা http://www.outlookindia.com/