নাগরিক জীবনে লোকগানকে প্রবেশ করাতে পিট সিগারের বিশ্বব্যাপী যে ভূমিকা, অমর পাল বাংলায় সম্ভবত সেই কাজটিই করতে চেয়েছিলেন বললে অত্যুক্তি হয়না। মোট চব্বিশটা বাংলা ছবিতে গান গেয়েছেন। সত্যজিৎ রায় , উৎপল দত্ত , সলিল চৌধুরী, শচীন দেববর্মণ- রা যার গানের গুণগ্রাহী ছিলেন, তাঁর নামে একটি উইকি পেজও নেই।
সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন: অর্ক দেব
আপনার জন্ম তো কুমিল্লায়,আপনার ছোটবেলার কথা বলুন, বেড়ে ওঠার কালে লোকগান কীভাবে জড়িয়ে ছিল ?
ছোটবেলায় বাড়িতে ত্রিনাথের গান হত। বাপ ঠাকুরদা তাস খেলে সময় কাটাতেন। ভক্তিমূলক গান গাইতেন। ঘুমোতে যাওয়ার সময় মা গাইতেন ‘নিদ্রাবলী মায়ো আমার বাড়ি যায়ো’। ধান ভাঙতে ভাঙতে মেয়েবউরা সুর করে গাইত ‘ও ধান ভাঙিরে ঢেঁকিতে পা দিয়া ঢেঁকি নাচে আমি নাচি হেলিয়া দুলিয়া’। দুপুরে দুএকজন আসত পটের গান শোনাতে। তাদের দেখতাম হাত পা নেই অথবা চোখ অন্ধ। এরা জীবনে সৎপথে চলার প্রেরনা দিত। তোমাদের থেকে অনেক বেশি শক্তি ছিল শরীরে। তিন মাইল পথ পেরোতাম এক দৌড়ে। লঞ্চ পাল্লা দিতে পারত না। তিতাসে নৌকা বাইচ দেখেছি । দূর থেকে ভেসে এসেছে নৌকা বাইচের গান ‘কলিকাইল্যা বধূরে’। ছয় সাতজন মেয়ে মিলে ছাত পেটাতো আর দুই তিনজন বাদ্যযন্ত্র সহকারে ছাদ পেটাইয়ের গান গাইত। এইরকম গানে গানে ভরা ছিল শৈশব। আমার বারো বছর বয়েসে আমি যাত্রাদলে বিবেকের ভূমিকায় গাইতাম।
কলকাতায় এলেন কবে ?
কলকাতায় প্রথম আসি ১৯৩৪ নাগাদ। বড়বাজার এলাকায় থাকতাম। একদিন বারান্দায় বসে আছি হঠাৎ মনে হল দূরে একদল মেয়ে গান গাইতে গাইতে যাচ্ছে। নিরঞ্জনদাকে জিজ্ঞেস করলাম কারা গান গাইছে। নিরঞ্জনদা বলল কেউ মারা গেছে, সেই মরদেহর সাথে একদল মেয়ে সুর করে কাঁদতে কাঁদতে জগন্নাথ ঘাটে যাচ্ছে। তখন বুঝলাম বাঙালি মেয়ের কান্নায়ও সুর আছে। ‘মাধব যায়রে কাঠ কাটিতে’ এই লোকগানটি কিন্তু মৃত্যুর গান।
ছবির সাথে যোগাযোগ কবে থেকে আপনার ?
অল্প বয়েসে ছবি দেখার নেশা ছিল। প্রথম ছবি দেখি নিউ এম্পেয়ার থিয়েটারে। টিকিটের দাম ছিল দু আনা পয়সা। দু’ আনা পয়সা জোগাড় করা তখন খুব কঠিন ছিল। ঐখানেই বিদ্যাপতি ছবিটি দেখি। ওই ছবির পরিচালক দেবকীকুমার বসুই আমাকে দিয়ে গাওয়ালেন ‘আমি তার বিরহে বাউল হলাম গো’। আমার গাওয়া প্রথম ছবি অবশ্য ‘চাষী’। নায়ক, নায়িকা ছিলেন শম্ভু মিত্র ও তৃপ্তি মিত্র। গানটি ছিল ‘ধান কাটি ধান’।
আপনি লোকসঙ্গীতে কি ধরনের যন্ত্রানুসঙ্গ পছন্দ করেন ?
আব্বাসউদ্দিনের সময় বাঁশী দোতারা তবলা ঢোল ব্যবহার হত। আমার এটুকুই যথেষ্ট। আমার আশি শতাংশ গানেই এই যন্ত্রানুসঙ্গই ব্যবহৃত হয়েছে।
আমাদের সময়ে ছবির গানে যে ধরনের যন্ত্রানুসঙ্গের ব্যবহার , তা আপনার কেমন লাগে ?
দেখো অপ্রিয় সত্য বললে লোকে বলবে ব্যাকডেটেড, ব্যকডেটেড হয়ে ছিয়ানব্বই বছর কাটিয়ে দিলাম। মত পাল্টায়নি। আজকের জগঝম্প যন্ত্রের ব্যবহার আমার কাছে শ্রুতিমধুর নয়।
আর আজকের সিনেমায় লোকসঙ্গীতের ব্যবহার, সে বিষয়ে কি বলবেন ?
আমাদের সময়ে ‘রাই জাগো’ এই প্রভাতী গানটিকে সামান্য বদলানো নিয়ে কত বিতর্ক হয়েছিল ভাবতে পারবে না। এখন তো এসব আকছাড় হচ্ছে , পুরো গানটাই বদলে ফেলা হচ্ছে , অন্য ছাঁচে ফেলে গাওয়া হচ্ছে। লোকসঙ্গীতে অনেক বেশি ভেজাল মিশে গেছে।
মানুষের মাঝে গান গাওয়ার সময়ের শ্রেষ্ঠ স্মৃতি কোনটা ?
নানা স্মৃতি আছে, কোনটা ছেড়ে কোনটা বলব। একবার ওয়ারলেসের মাঠে গনগনে রোদে অনুষ্ঠান করছি। গান ধরলাম ‘আল্লাহ ম্যাঘ দে পানি দে ছায়া দে রে তুই – আকাশ কালো করে এলো। বাংলাদেশে নিজের গ্রামে গান গাইতে গেছি , দেড় ঘণ্টার ওপর গেয়ে ফেলেছি , মানুষ আরও শুনতে চায়। আবদুস সামাদ বলে এক অ্যাডভোকেট আমাকে হাত ধরে নামিয়ে আনলেন, চিৎকার করে বললেন মানুষটারে কি আপনারা মাইরা ফ্যালবেন ? এই ভালোবাসা মাথায় নিয়েই চলে যাব , জীবন থেকে আর কিছু চাওয়ার নাই।
সত্যজিৎ রায়ের সাথে আলাপ হল কীভাবে ?
১৯৭৯ সালে আমাকে অনুপ ঘোষাল নিয়ে যায় ওর কাছে। আমাকে উনিই প্রস্তাব দেন ওনার ছবিতে গাইতে। উনিই নিজেই কতই রঙ্গ দেখি দুনিয়ায় গানটিতে সুর দেন। পিয়ানোয় বাজিয়ে দু লাইন গেয়ে শোনান। উনি প্রায়শই বলতেন, অমরবাবু কী গান গেয়েছেন! মনরে হরি বল শুনে উৎপল দত্ত দেখা করতে চাইলেন। বিল ক্রোফোর্ড আমায় বলেছিলেন মি. পল আপনাকে দিয়ে আমি আমেরিকার ২৮ টা ইউনিভার্সিটিতে গাওয়াব।
গানটি শুনেছি রবীন মজুমদারের গাওয়ার কথা ছিল?
তুমি ঠিকই শুনেছো। সত্যজিৎ রায় তাঁকেই গাইতে অনুরোধ করেছিলেন এই গান। কিন্তু তত দিনে হাঁপের টানে গান ছেড়ে দিয়েছন উনি। চরণদাসের গানটি তখন আমায় দিয়ে গাওয়ান তিনি। লিপ দিয়েছেন রবীন মজুমদার। একটা অন্য কথা বলি, সত্যজিৎ রায় কিন্তু আমার ছোট্ট একটা অডিশন মতো নিয়েছিলেন। ‘এ ভব সাগর কেমনে দিব পাড়ি রে' গানটি তার সামনে খালি গলায় গেয়েছিলাম মনে আছে।
আমাদের সংরক্ষণের যত্নবান মন নেই । বহু লোকগান বেখেয়ালে হারিয়ে গেছে । কী ভাবে বাঁচবে লোকগান ?
লোকসঙ্গীত একটা জাতির শ্রেষ্ঠতর সম্পদ কারণ তা মানুষের কথা বলে। পল রোবসনের কথা ভাবো। পিট সিগারের কথা ভাবো। এদের মানুষ মাথায় করে রেখেছে। আমাদের এইখানে লোকগান বলতে অনেকে বোঝে ওইটা ভিক্ষাজীবীর গান। ফলে এত অযত্ন। তবে ব্যতিক্রমও আছে। যখন রাজ্য সংগীত অ্যাকাডেমির সাথে যুক্ত ছিলাম , উত্তরবঙ্গের ছেলেমেয়েদের গলায় গান শুনে বিভোর হয়ে যেতাম। আমার নিজের জীবনে লোকসঙ্গীত ছাড়া আর কিছু নাই। এই বয়েসে এসেও ‘মেঘ রাজারে মেঘের বাড়ি যাই’ গাইলে জাপানী মেয়েগুলো হাঁ হয়ে শোনে। জীবনের কাছে আমি কৃতজ্ঞ।