
কিছুই তো ফেলতে পারিনা।আর ফেলতে পারিনা বলেই গোছাতে পারিনা। এই বসে আছি বিছিয়ে, বিছানায়। বসে আছি ল্যাবের চেয়ারে, মাটিতে। কোথাও তো দাঁড়ি টানতে পারিনা। আর পারিনা বলেই গোটাতে পারিনা। এগোতে পারিনা।
এই যে, দাঁড়িয়ে আছি, স্থির।
শেষমেশ স্থির করলাম যে, যা কিছু ফেলার, তাকে আগে ফ্রেমবন্দি করব।
যা কিছু ফেলার, ফেলার পরেও কোথাও তো থাকবে।
যা কিছু না থাকলেও চলে বলে ধার্য করেছে সংসার। অতএব ফেলার।
কিছু হলদে পাতা।সাদা পাতা হলে এদ্দিনে তা হলদে হয়েই যেত বোধহয়। হলদে পাতা হলদে হলে টের পাওয়া দায়। হলদে পাতারা পুরোনো হয় না। লেখাগুলো পুরানো।
টুকরো টুকরো কিছু স্টিকি হলুদ পাতায় টুকরো টুকরো কিছু লেখা।
কিছু আঁচড়। স্টিকি। অনেক কিছু কথা, যা বলতে পারিনি, কিছু কিছু কথা, যা বলব ভেবেছিলাম, বা অল্প কিছু কথা, যা বলেছিলাম। বলতে পেরেছিলাম।
টুকরো টুকরো ক’রে।
আমি তাদের জমিয়ে রাখতে থাকি। ফ্রেমে।
তবু, কোথাও তো দাঁড়ি টানতে পারিনা। আর পারিনা বলেই গোটাতে পারিনা।
এগোতে পারিনা।
এই যে দাঁড়িয়ে আছি, স্থির, ক্যামেরার স্টিলে।
তবুও কেবলি দৃশ্যের জন্ম হয়ে চলে।
এক দৃশ্য আমাকে আরেক দৃশ্যে ঠেলে দ্যায়। দৃশ্যের গোলকধাঁধায়, আসলেতে আমি ঘুরপাক খেয়ে চলি।
এগোতে পারিনা।
চলচ্ছক্তিহীন হয়ে যাই, চলচ্ছক্তিহীন।
কেমন করে এগোব? দৃশ্যেরা কেবলি জন্মে চলে। একই গর্ভ, একই ঔরস থেকে জন্মানো সব আলাদা আলাদা ভ্রূণ।
সব আলাদা আলাদা ছবি।
সাবজেক্ট এক হলেই ছবি এক হতে হবে নাকি? সেই পাউলির এক্সক্লুশন প্রিন্সিপলের মতন, সেই এক স্টেট না হওয়া দুটো ইলেকট্রনের মতন, এক জিনিসের দুটো ছবিও পুরো এক হয়না।
আর আমার তাই আর এগোনোও হয় না।
স্থিরছবি আসলেতে আমাকেই এক জায়গায় স্থির করে দিয়েছে।
এই যে স্থির দাঁড়িয়ে আছি, বিছিয়ে।
বিছিয়ে আছে রাস্তা, বিছানো ছায়া, আবছায়া আলো।
বিছানো, যা কিছু ফেলে যাওয়ার কথা।
কিছুই তো ফেলতে পারিনা।
আমি তাদের জমিয়ে রাখতে থাকি। ফ্রেমে।
আমি চলতে থাকি, এক দৃশ্য থেকে আরেক দৃশ্যে। আর তারপর দেখি, আমি ঘুরে চলেছি, না, একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তে নয়, আমি ঘুরে চলে একের পর এক দৃশ্যের বৃত্তে। উপবৃত্ত, পরাবৃত্তে। দৃশ্যাবর্তে।
এগোতে পারিনা।
এক দৃশ্য কেবলি অন্য দৃশ্যের জন্ম দিয়ে চলে, ছায়ারা ছবির।
ফেলে যাবার কথা বলেই কি এত মায়া দিয়ে জড়িয়ে ধরে, এইসব ছায়ারা?
এই ভাঙ্গা রাস্তার জলে ভাঙ্গা চাঁদের ভাঙতে থাকা ছায়ারা।
সেই যে ছায়াদের সাথে ভাব করেছিলাম, এই শহরটাকে ভালোবাসতে গিয়ে। আসলেতে তো আসল শহরটা, ঝাঁ চকচকে ঝকঝকে তকতকে শহরটাকে আমি কোনোদিনই ভালবাসিনি। ছবির মতন সাজানো বাড়িঘর, লোকজন ...সেও ছিল ছবি থেকে ছবিতেই ঘুরে বেড়ানো, কিন্তু সে সুখের ছবি আমাকে সুখ দ্যায়নি, সে ঘুরে মরাও। আমি খুঁজছিলাম আমার শহরকে। পাইনি।
তারপর একদিন দেখলাম, বৃষ্টি হলে, ধুয়ে গেলে, জল এসে দাঁড়ালে, আমার যেমনটি ইচ্ছে শহরটা তেমনটিই হয়ে যায়!
গল্পরা কবিতা, মনে পড়ারা মন কেমন, ইতিহাসেরা রূপকথা, ফোটোগুলো হাতে আঁকা ছবি, ছায়াছবি।
কালো পিচঢালা শহরের নিচে আমি আমার শহরকে খুঁজে পেয়ে যাই। যে শহরের রাস্তায় নিটোল যুবতী চাঁদ টালমাটাল করে আর শেষ রাতে পড়ে থাকে তার ছেঁড়াখোঁড়া শরীর, রাস্তার ভাঁজে ভাঁজে, খাঁজে খাঁজে। লাল নীল সবুজ আলো ধুইয়ে দ্যায় যে শহরের রাস্তাকে। হ্যালোজেন বৃষ্টিতে রং দিয়ে সাঁঝবাতির রূপকথা লেখে যে শহরের রাস্তায়।
আর শুরু হয় সে শহরের সে রাস্তায়, আলোর ছায়ায় আমার ঘুরে মরা, সুখের ঘুরে মরা।
আমি আমার শহরকে খুঁজে পেয়ে যাই। ক্যামেরার চোখে।
তবু, সুখ তো সততই সুখের নয়।
শহর থেকে এই ফেরার বেলায়, ফেলে দেবার বেলায়, জমিয়ে রাখার উদগ্র তাড়নায় আমি প্রাণপণে ঘুরে চলি, ঘুরতেই থাকি, ঘুরতেই থাকি আর হাঁপাতে থাকি, হাঁপিয়ে পড়তে থাকি।
আমি প্রাণপণে শেষ করতে চাই। তাই আরো জোরে ঘুরতে থাকি, সেই ক্রিটিকাল ভেলোসিটির আশায়, যা আমাকে ছিটকে দেবে, এই দৃশ্যবৃত্তের স্পর্শক বরাবর। আর কোন অদৃশ্য কেন্দ্রাতিগ বল আমাকে সেই দৃশ্যের বৃত্তে কেবলি ছোটাতে থাকে, কেবলি ছোটাতে থাকে। কেবলি দৃশ্যের জন্ম দিতে থাকে।এক আশ্চর্যজনক হারে।
হাঁপাতে থাকি, হাঁপিয়ে পড়তে থাকি।
আর আমি কিছুই ফেলতে পারিনা, কেবলি জমাতে থাকি ফ্রেমে।
হাঁপাতে থাকি, হাঁপিয়ে পড়তে থাকি।
তাই খুঁজতে থাকি, শেষের সেই মুহূর্তকে, একটা নাটকীয় মুহূর্ত, তার আসার আশায় আশায় বসে থাকি। যে আমাকে বের করে আনবে।ইতি টানবে এই খেলায়।এই গল্পে।
এক জুতসই শেষের অপেক্ষায় বসে, না, না, ঘুরতে থাকি। এক অমোঘ দাঁড়ি।গল্পশেষের মাস্টারস্ট্রোক।
ল্যাবের করিডোরে অন্তহীন হেঁটে চলায় ক্লান্ত আমি কোনদিন দেখব আমার ছবিতে করিডোরের EXIT, এর সামনে জুড়ে গেছে NO, আর সে
ভাবি দি ফোটোশপ করে EXIT এর সামনে একটা NO জুড়ে। সে বড় নাটকীয় ছবি হবে। শেষ ছবি হিসেবে exit মোক্ষম।
ধুর! ফোটোশপের কপটতায় খুঁতখুঁতানি আসে।
আবারো দৃশ্য খুঁজে চলি। গল্প। গল্পের শেষ।
কিন্তু আমার জীবনে তেমন গল্প আসেনা।
কালচর রুমে মেঝের উপর পড়ে যাওয়া রক্ত মুছতে থাকি, মুছতেই থাকি, উঠতে থাকেনা, ক্লান্ত হয়ে যেতে থাকি আর দেখি আস্তে আস্তে রক্তের দাগ আরো গাঢ় হচ্ছে।
নাঃ, আসলেতে দেখিনা। বরং দাগটা পুরো উঠে যায়।
আমার ছাপোষা জীবনে নাটকীয় কোন শেষ পাইনা। তাই গল্প পাইনা। তাই বেরোতেও পারিনা।
শেষমেশ ঠিক করি, সেমি-ছাপোষা শেষই সই। ডিসির বৃষ্টিমরা চাঁদ আর আধমরা হ্যালোজেনের আলো আঁধারিতে গালে হাত দেওয়া ক্লান্ত মানুষের লার্জার দ্যান লাইফ মূর্তি আর তার ইভেন লার্জার ছায়ার ছবি তুলে তার সাথে নিজের ছায়া মিশিয়ে দিয়ে ভাবি এই বেশ, এই বুঝি শেষ।
আর তারপরেই সেই মরা আলোয় ভূতে পাওয়ার মত হেঁটে চলি রাস্তার কোণে একলা বসা শ্রোতাবিহীন স্যাক্সোফোনিস্টের দিকে। তার সুরের টান নাকি তার একলা সোঁদা আলোছায়ার টান। ক্যামেরাতে টান দিতে গিয়ে দেখি ব্যাটারি শেষ। ভাবি, বেশ। বেশ হয়েছে।এই শেষ। এই সেই মুহূর্ত। অপূর্ণতা না থাকলে আর শেষ কীসের!
আর তখনি হুড়মুড়িয়ে দৃশ্যেরা নামতে থাকে। বৃষ্টির ছাঁটের মত ছুটে।বড় বড় পষ্ট ফোঁটাদের সামনে এনে অফফোকাস হয়ে যায় যা কিছু বৃষ্টিতে ভিজেছিল। গাছের ডালের ফাঁকে উঁকি মারে পোস্টারের ভেজা চোখ, আধমরা ডালের নখ ছিঁড়েখূঁড়ে দ্যায় আধবুড়ি চাঁদের শরীর।আর বেনোজলে তার ছায়ায় ভেসে যায় আধোঘুমের শহর।
চমৎকার !
নাঃ, আর ভাবতে পারিনা বেশ। বেশ হয়েছে। এই শেষ।
গুলি মারি শেষে।
ভাবি, এইসব দৃশ্য তুলে রাখতে না পারা আমার করা পাপ সমূহের কিছুরই শাস্তি বোধহয়।কিন্তু এমন দৃশ্য ফেলে দিলে তো আরোই পাপ।
সাত মাইল উজিয়ে দোকানে যাই, ব্যাটারি কিনে আনি। টুপটাপ ছড়ানো সব ছবিদের, সব তো পাইনা, যেটুকু যা পাই আবার কুড়িয়ে নিই। যেগুলো হারালো, তাদের খুঁজতে বেরোই।
চমৎকার! ধরা যাক দু একটা দৃশ্য, আবার !
নাঃ, এই পথে মুক্তি নেই। এই ভেজা আলোর পথে। আমি অন্য রাস্তা দেখি। মুহূর্তকে বানাতে চাই। পথের পাশের ইউরোপীয়ান রেস্তোরায় দেখি এক টেবিলে একা এক ওয়েটার। অপেক্ষারত ?
পিছনের আশেপাশের ভরা টেবিলের লোকজনকে ব্লার করে দিয়ে আমি তার ছবি তুলি। আর অপেক্ষায় থাকি, সব লোকজন চলে গেলে তার একার ছবি তুলব। সেই একা ওয়েটারের জন্য অপেক্ষা আমাকে কেউ করতে দ্যায় না। সেই একা ওয়েটারকে আর আমি পাইনা। আমি তাকে খুঁজে চলি। আবার সেই ঘুরে চলা।আবার সেই খুঁজে চলা।আর চলতে চলতে...
বেঁচে যাই, ফেরার ফ্লাইটের সময় এলে। অবশেষে ঘেঁটি ধরে আমাকে বের করে আনলে।
কী নিশ্চিত, আরাম লাগে। ক্যামেরা ছুঁই না আর। অপার শান্তি।
আমার শহরে আমি। তাকে তো আর আমার ক্যামেরার চোখে খুঁজে দেখার দরকার নেই।
ছায়ার ছবির দরকার নেই।
আর তারপরেই বৃষ্টি নামে। নৌকা টলোমলো।
এই ভাঙ্গা রাস্তার জলে বুড়িচাঁদ পড়ে আছে অনন্তকাল, আমি তার অন্ত পাই সাধ্য কী!
শেষ নাহি পাই।
শেষ নাহি যে।

ফটোঃ লেখিকা, কোলাজঃ শ্রীপর্ণা।
4z | unkwn.***.*** | ২৩ নভেম্বর ২০১২ ০১:০৩89683
siki | unkwn.***.*** | ২৩ নভেম্বর ২০১২ ০৩:৫১89684
শ্রী সদা | unkwn.***.*** | ২৩ নভেম্বর ২০১২ ০৫:২২89685
sosen | unkwn.***.*** | ২৩ নভেম্বর ২০১২ ০৬:০৮89679
সিদ্ধার্থ | unkwn.***.*** | ২৩ নভেম্বর ২০১২ ০৮:৩০89686
kumu | unkwn.***.*** | ২৩ নভেম্বর ২০১২ ০৮:৩১89680
গান্ধী | unkwn.***.*** | ২৩ নভেম্বর ২০১২ ০৯:৫৪89681
একক | unkwn.***.*** | ২৩ নভেম্বর ২০১২ ১০:০৬89687
de | unkwn.***.*** | ২৩ নভেম্বর ২০১২ ১০:১৯89682
শ্রাবণী | unkwn.***.*** | ২৪ নভেম্বর ২০১২ ০৪:৩৪89689
Raju | unkwn.***.*** | ২৪ নভেম্বর ২০১২ ০৬:৩০89690
শিবাংশু | unkwn.***.*** | ২৪ নভেম্বর ২০১২ ০৭:৪২89691
aranya | unkwn.***.*** | ২৪ নভেম্বর ২০১২ ১২:০৪89688
i | unkwn.***.*** | ২৫ নভেম্বর ২০১২ ০১:২৮89692
siki | unkwn.***.*** | ২৫ নভেম্বর ২০১২ ০৫:১১89695
rivu | unkwn.***.*** | ২৫ নভেম্বর ২০১২ ০৮:২০89696
্রূপঙ্কর সরকার | unkwn.***.*** | ২৫ নভেম্বর ২০১২ ১০:০১89693
গান্ধী | unkwn.***.*** | ২৫ নভেম্বর ২০১২ ১১:০০89694
Nina | unkwn.***.*** | ২৬ নভেম্বর ২০১২ ০৩:১৮89697
চৈতালি | unkwn.***.*** | ২৭ নভেম্বর ২০১২ ০৫:০২89698
মৌ | unkwn.***.*** | ২৭ নভেম্বর ২০১২ ০৭:০২89699
swati | unkwn.***.*** | ২৮ নভেম্বর ২০১২ ০৭:০২89700
jhumjhumi | unkwn.***.*** | ২৯ নভেম্বর ২০১২ ১১:২১89701
শুদ্ধ | unkwn.***.*** | ০১ ডিসেম্বর ২০১২ ০৫:৪৭89702
sri | unkwn.***.*** | ০২ ডিসেম্বর ২০১২ ০১:০১89703
সুশান্ত | unkwn.***.*** | ০৫ ডিসেম্বর ২০১২ ০৩:১১89705
sanhita | unkwn.***.*** | ০৫ ডিসেম্বর ২০১২ ০৯:১৭89704
sumeru | unkwn.***.*** | ০৮ ডিসেম্বর ২০১২ ০৭:৩০89706
বিপ্লব রহমান | unkwn.***.*** | ০৯ ডিসেম্বর ২০১২ ০১:৩১89707
জ্যোতির্ময় | unkwn.***.*** | ১০ মার্চ ২০১৩ ০১:৪০89708