কী ছিল?
কিছু পরিসংখ্যানঃ প্রায় ৩১০ মিলিয়ন মানুষের এই দেশটিতে স্বাস্থ্যবিমাবিহীন লোকের সংখ্যা পঞ্চাশ মিলিয়নেরও বেশি। আমাদের পরিচিত হিসেবে বলতে গেলে, ৩১ কোটি মানুষের দেশে ৫ কোটি লোকের কোনও স্বাস্থ্যবিমা নেই। ২০০৯ এর হার্ভার্ডের একটা স্টাডির হিসেবে, স্বাস্থ্যবিমা না থাকার জন্য প্রতি বছর অন্তত ৪৫০০০ জন মারা যান। অর্থাৎ বিমা না থাকার ফলে, আর বিমাবিহীন চিকিৎসা এতই খরচসাপেক্ষ যে সেটা চালাতে পারেন না বলে, বিনা চিকিৎসায় প্রতি বছর ৪৫০০০ জন মারা যান। হয়তো বলবেন, অন্যান্য আর্থসামাজিক কারণ, আয়, ধূমপান, মদ্যপান ইত্যাদি বিষয়গুলোও তো আছে। আজ্ঞে হ্যাঁ, সেসব বিবেচনা করে তাদের সম্মিলিত প্রভাব বাদ দেবার পরেই এই ‘৪৫০০০ জন’ সংখ্যাটা, যাঁরা আর কোনও কারণে নয়, কেবল এবং কেবলমাত্র স্বাস্থ্যবিমার অভাবে চিকিৎসা হয়নি বলেই মারা যান। আরেকটি স্টাডি বলছে, বিমা নেই বলে ১.১ কোটিরও বেশি আমেরিকাবাসী তাঁদের নানা ক্রনিক অসুখ যেমন, ডায়াবেটিস, হার্টের অসুখ, এসবের জন্য কোনরকম চিকিৎসাই করাতে পারেন না। আর বিমা না থাকলে চিকিৎসার খরচ আগুনে হাত দেওয়ার সামিল।
তা হলে যাঁদের স্বাস্থ্যবিমা আছে, তাঁদের অবস্থা নিশ্চয় ভাল। তাই কি? হিসেব কী বলছে একটু দেখা যাক। যত মানুষ ঋণের দায়ে দেউলে বা সর্বস্বান্ত (ব্যাংকরাপ্ট) হন, তার ৬০% এর বেশির ক্ষেত্রে (২০০৭ এর হিসেবে ৬২%) কারণটা হল বিরাট অঙ্কের মেডিক্যাল বিল! শতাংশ ছেড়ে দেখা যাক সংখ্যাটা কত। বছরে প্রায় ৯ লাখ মানুষ! আর এদের মধ্যে মোটামুটি ৭৮% এর অসুস্থতার সময় স্বাস্থ্যবিমা ছিল! তার ৬০% এরই প্রাইভেট স্বাস্থ্যবিমা। অর্থাৎ এমন নয় এঁদের অবস্থা আগে থেকেই সেরকম খারাপ ছিল। হার্ভার্ডের স্টাডি বলছে, এই দেউলিয়া হয়ে যাওয়া লোকজনের দুই-তৃতীয়াংশই ছিলেন মধ্যবিত্ত, শিক্ষিত। কারণ, বিমা থাকা মানেই মাসে মাসে বিমার প্রিমিয়াম দেওয়া, কিন্তু তার মানে এই নয় যে, রোগ হলে বিমাকোম্পানি সব খরচ দেবে। চিকিৎসার খরচের একটা অংশ রোগীকেই দিতে হয় -‘কো পে’ (Co-pay) (অর্থাৎ, বিমা থাকলেও ডাক্তারের কাছে গেলে ডাক্তারের ফিজ বা ওষূধের খরচ হিসেবে যে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা পকেট থেকে দিতেই হবে) আর বিশাল পরিমাণের ডিডাক্টেবল (Deductable) (অর্থাৎ কোন মেডিক্যাল সার্ভিসের জন্য যে টাকার পরিমাণের সমান বা কম খরচ হলে তার পুরোটা নিজের পকেট থেকেই দিতে হবে, যেমন, কোন বিমা প্ল্যানে সিটি স্ক্যানে ৫০০ ডলার ডিডাক্টেবল থাকা মানে খরচ ৬০০ ডলার হলে নিজেকেই ৫০০ ডলার দিতে হবে), ওষুধের খরচা (সব ওষুধ বিমার আওতায় আসেনা) থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে না! আর এই প্রিমিয়াম আর ডিডাক্টিবল, কো পে র আবার ব্যস্তানুপাতিক সম্পর্ক। মানে, মাসে মাসে কম প্রিমিয়াম দেওয়া বিমা নিতে চাইলে ডিডাক্টিবল, কো পে র অঙ্কও লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকবে !
আর অসুস্থতার এক বড় অংশ যেখানে ‘আনকভারড’, অর্থাৎ নানা কারণে বা অজুহাতে মেডিক্যাল বিল-এর পুরোটা বিমাকোম্পানি মেটায় না, রোগীর ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়। আনকভারড অনেক ডাক্তারি পরিষেবাও, বিমার নেটওয়ার্কের মধ্যে নেই, এইধরণের কারণ দেখিয়ে।
রয়েছে তার উপর আছে অসুখের জন্য চাকরি চলে যাওয়া -- তার মানে তো চাকরিসূত্রে প্রাপ্ত স্বাস্থ্যবিমাও চলে যাওয়া।
এঁদের মেডিক্যাল বিলের নমুনা? একটি হিসেব বলছে, স্বাস্থ্যবিমা থাকলে গড়ে মোটামুটি ১৮,০০০ ডলার, আর স্বাস্থ্যবিমা না থাকলে ২৭,০০০ ডলারের আশপাশে। এই ‘আউট অব পকেট’ খরচের বোঝার ভারে ধুঁকছেন সাধারণ মানুষ। মধ্যবিত্ত পরিবারের আয়ের কুড়ি শতাংশেরও বেশি চলে যায় এই খরচে আর গরীব পরিবারের জন্য এই খরচটা কত? আয়ের ষাট শতাংশ! এই খরচের হিসেব বিমার জন্য মাসিক প্রদেয় খরচ বা ‘প্রিমিয়াম’ বাদেই।
এদিকে মাসের প্রিমিয়াম? জানা গেছে, গড়পড়তা মানুষের মাসিক খরচের এক-চতুর্থাংশ বেরিয়ে যায় এই প্রিমিয়াম দিতে। গত নয় বছরে চাকুরিদাতা-কৃত স্বাস্থ্যবিমাতে যে প্রিমিয়াম দিতে হয়, তার পরিমাণ বেড়েছে দু গুণেরও বেশি, আর এই বাড়ার রেট, মজুরি বাড়ার রেটের তিন গুণ! ‘চাকুরিদাতা-কৃত’ (এমপ্লয়ার স্পনসরড), কিন্তু আদতে দেখা যাচ্ছে চাকুরিকারীদের দিতে হচ্ছে গড়ে প্রায় ২৮% খরচ, আর এই পরিমাণটা গত এক দশকে বেড়েছে ১৩১%! ‘ইন্সিওরেন্সের ডিডাক্টেবল’, অর্থাৎ স্বাস্থ্যবিমা থাকা সত্ত্বেও অতিরিক্ত প্রদেয় খরচ, ১০০০ ডলারেরও বেশি দিতে হচ্ছে, এমন স্বাস্থ্য পরিষেবায় সংখ্যা ১০% থেকে বেড়ে গত পাঁচ ছয় বছরে ৩০% হয়ে গেছে । এদিকে ‘চাকুরিদাতা-কৃত’ (এমপ্লয়ার স্পনসরড) বিমার সংখ্যা কমেছে।
সামগ্রিক চালচিত্রঃ
কোন দেশের কথা হচ্ছে? আমেরিকার। পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী দেশগুলির মধ্যে একটি। শুধু তাই নয়, যেখানে স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় সর্বোচ্চ -- ২.৬ ট্রিলিয়ন, বা ২৬,০০ কোটি, ডলার, দেশের মোট জাতীয় উৎপাদনের (জিডিপি’র) প্রায় ১৭%! বা, মাথাপিছু স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় ৮০০০ ডলারেরও বেশি, যা, অন্যান্য উন্নত দেশের প্রায় দ্বিগুণ! এবং তার পরেও এই অবস্থা। উন্নত দেশগুলির মধ্যে তুলনামূলক এই ছবিটা দেখলে স্বাস্থ্যব্যবস্থার ছবি আরো কিছুটা স্পষ্ট হবে যে এই দেশে স্বাস্থ্যখাতে খরচ সবচেয়ে বেশি অথচ স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত নানাবিধ প্যারামিটারে স্থান সবচেয়ে নিচে।
পাদটিকাঃ *পূর্বানুমান। খরচ আমেরিকান ডলারে ক্রয়ক্ষমতার সম-মূল্য (purchase power parity) হিসাবে দেখানো হয়েছে।
তথ্য-উৎসঃ এই হিসাবটি করেছেন দ্য কমনওয়েলথ ফাণ্ড, এবং হিসাবের ভিত্তি হল ‘২০০৭ সালের আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্যনীতি সমীক্ষা’; ‘২০০৮ সালের অসুস্থতর প্রাপ্তবয়স্কদের ওপর আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্যনীতি সমীক্ষা’; ‘২০০৯ সালের প্রাথমিক পরিষেবা-প্রদানকারী চিকিৎসকদের ওপর আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্যনীতি সমীক্ষা’; উচুমানের কার্যকর স্বাস্থ্যব্যবস্থার জাতীয় স্কোরকার্ড বিষয়ে কমনওয়েলথ ফাণ্ড কমিশন; এবং অর্থনৈতিক সহযোগীতা ও উন্নতি সংগঠন (ও ই সি ডি) –এর ও ই সি ডি স্বাস্থ্য পরিসংখ্যান, ২০০৯ (প্যারি, ও ই সি ডি, নভেম্বর ২০০৯)
শুধু তাই নয়, ১৬ টি উন্নত দেশের মধ্যে, ‘preventable deaths’ এর বিচারে আমেরিকা সবার নিচে। উপরোক্ত হিসেবই শুধু নয়, স্বাস্থ্য সূচকের হিসেবে দেখতে গেলেও আমেরিকা পিছিয়ে পড়ে আছে। ২০১১-র বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) রিপোর্ট বলছে, গড় আয়ুর হিসেবে আমেরিকার স্থান ৩৩ নম্বরে, শিশুমৃত্যুর হারের দিক দিয়ে আমেরিকা ৪৩ নম্বরে; হ্যাঁ, সবচেয়ে বেশি খরচ করার পরেও! আর এর সাথেই রয়েছে স্বাস্থ্য-সূচকে চরম অসাম্য। দেশের দুটি জায়গার মধ্যে গড় আয়ুর তফাত ৩৩ বছরের, এমনও আছে! দেশের আফ্রিকান-আমেরিকান, লাতিনো ও আদি বাসিন্দা আমেরিকান-ইণ্ডিয়ান জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য-সূচকগুলি তুলনা করলে বৈষম্য সুস্পষ্ট হয়ে যাবে। আর শুধু তুলনামূলক ভাবেই নয়, এমনিতেও সেগু্লোর মান যথেষ্ট খারাপ।
কী হয়েছে?
‘নাগালের মধ্যে স্বাস্থ্য’ – নতুন আইন নিয়ে দু’চার কথাঃ এসব মেরামেতির জন্য ওবামা সাহেব অনেক কাঠ খড় পুড়িয়ে সম্প্রতি এনেছেন ‘নাগালের মধ্যে স্বাস্থ্য’ এই নতুন আইন (আফোর্ডেবল কেয়ার অ্যাক্ট)। এই আইন স্বাস্থ্যবিমা-বিহীন লোকের সংখ্যা কমানোর জন্য, স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় কমানোর জন্যও। এইখানে ছোট করে আমেরিকার স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিয়ে আরও দু-চার কথা বলে নেওয়া যেতে পারে। না, সমস্তটাই প্রাইভেট ইন্সিওরেন্সের গল্প এমন নয়। সরকারি ইন্সিওরেন্সও রয়েছে; তার মধ্যে মেডিকেইড হল গরীব মানুষের জন্য; আর মেডিকেয়ার হচ্ছে ৬৫ বছরের অধিক বয়সীদের জন্য। তো, ওবামার নতুন আক্টে এই মেডিকেইডকে আরো বিস্তৃত করা হচ্ছে।
দারিদ্র্য-সীমার যে রোজগার ধরা হয়েছে তার ১৩৩% এর কম রোজগার করেন যাঁরা, তাঁরাও সরকারি মেডিকেইডের আওতায় আসবেন। এর ফলে ১.৬ কোটি স্বাস্থ্যবিমা-বিহীন লোক এই সুবিধা পাবেন। এটা একটা ভাল পদক্ষেপ। এছাড়া বলা হয়েছে, ঐ রোজগার-সীমার ১৩৩% এর ওপরে কিন্তু ৪০০% এর মধ্যে রোজগার করেন এমন মানুষের জন্যও সরকারি ভর্তুকি দেওয়া হবে, যাতে কম খরচে তাঁরা প্রাইভেট স্বাস্থ্যবিমা কিনতে পারেন। এরকম মানুষের সংখ্যাও প্রায় ১.৬ কোটি। এঁদের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিমা বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে; না করলে ট্যাক্স পেনাল্টি। চাকুরিদাতাদের বলা হচ্ছে, ৫০ জন কর্মি থাকলে তাঁদের জন্য প্রাইভেট স্বাস্থ্যবিমা কিনতে হবেই, নচেৎ সেই পেনাল্টির গল্প। এভাবে স্বাস্থ্যবিমা-বিহীন লোকের সংখ্যা অনেকটাই কমিয়ে আনা যাবে বলে বলা হচ্ছে।
আগে থাকতে ছিল এমন রোগের ক্ষেত্রে (প্রি-এক্সিস্টিং কণ্ডিশন) জন্য বিমার পয়সা পাওয়া যাবেনা, এইটা আগে ইন্সিওরেন্স কোম্পানিগুলোর পেজোমি করার একটা বড় হাতিয়ার ছিল। এবারের অ্যাক্টে সেটা অনেকটা আটকানো যাবে। আর মোট কত টাকা একটি বিমাকোম্পানি স্বাস্থ্যবিমা-খাতে বিমাকারীকে দিল (ভল্যুম অব সার্ভিস), তার চেয়ে বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে কোম্পানি কতটা ঠিকঠাক ভাবে কম হয়রানি করে পয়সা দিচ্ছে (কোয়ালিটি অফ সার্ভিস), সেটার ওপর । এটা করার জন্য সরকার উৎসাহ ও শাস্তি (গাজর ও লাঠি) – এ দুই পথই নিয়েছে। আর তাই হাসপাতালে অ্যাডমিশন রেট কমানো, কাজ পিছু পয়সা (ফি ফর সার্ভিস)-এর বদলে সব সার্ভিসের জন্য একসাথে পয়সা নেওয়া (বাণ্ডলড পেমেন্ট), নানা বিভাগের মধ্যে যথাযথ বোঝাপড়ার মাধ্যমে পরিষেবা (কো-অর্ডিনেটেড কেয়ার), রোগ-প্রতিরোধের উপর বেশি জোর দেওয়া, আলতু ফালতু পরিচালনা (অ্যাডমিনিস্ট্রেশন) খাতে খরচ কমানো, চিকিৎসাকর্মে ঠকবাজি (মেডিক্যাল ফ্রড) নিয়ে অনেক বেশি কঠোর হওয়া – সরকার এসব পথ নেবার চেষ্টা করছে। এগুলো ঠিকঠাক ভাবে হলে এতে করে স্বাস্থ্য পরিষেবার গুণমান বাড়া ও খরচ কমা উচিত। বলা হচ্ছে জীবন-শেষের সময়ের পরিষেবার (এন্ড অফ লাইফ কেয়ার)-এর কথা। আই সি ইউ –তে কোনোভাবে জীবন টিকিয়ে রাখার পরিষেবার চেয়ে বাড়িতে বা হসপিস-এ শান্তিতে যন্ত্রনা কমানোর প্যালিয়েটিভ পরিষেবা যে অনেক বেশি শ্রেয়, সেকথা জোর দিয়ে বোঝানো হচ্ছে।
এর সাথে আরো একটি জিনিসের উপর নতুন করে জোর দেওয়া হচ্ছে, তা হল জনস্বাস্থ্য (পাবলিক হেলথ), অর্থাৎ মূলত রোগ-প্রতিরোধ। স্বাস্থ্য মানে শুধু অসুখ সারানো নয়, অসুখ আদৌ না হওয়াটাই স্বাস্থ্যের গোড়ার কথা, আর জনস্বাস্থ্য সেই কথাই বলে। ‘প্রিভেনশান ইজ বেটার দ্যান কিওর’ আপ্তবাক্য জানা থাকলেও আজ হেলথ কেয়ারের হাল দেখে তা আর স্মরণে আছে বলে তো মনে হয়না। বিশেষ করে মুনাফাকামী হেলথ কেয়ার ‘ইন্ডাস্ট্রি’ যেখানে অসুস্থ হবার উপর দাঁড়িয়েই মুনাফা লুটছে। এব্যাপারে আমেরিকান পাবলিক হেলথ অ্যাসোসিয়েশনের ডায়রেক্টর Georges C. Benjamin এর মন্তব্য এই প্রসঙ্গে প্রণিধানযোগ্য –
“একটি দেশ হিসেবে, আমরা স্বাস্থ্য-পরিষেবার যে লড়াইটা করি সেটার মূলেই ভুল রয়েছে। রোগ-প্রতিরোধ করলে যে কম খরচে বেশি প্রাণ বাঁচে এটার সপক্ষে হাজার সাক্ষ্য-প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও স্বাস্থ্য-পরিষেবায় খরচ করা প্রতিটি ডলারের সিংহভাগ রোগ হবার পরে তার চিকিৎসার জন্য ব্যয় করা হচ্ছে। মোদ্দা কথা হল, স্বাস্থ্যখাতে সংস্কারের ক্ষেত্রে রোগ-প্রতিরোধের ওপর মূল জোর পড়া দরকার।“
নতুন অ্যাক্টে এসব নিয়ে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তৈরি করা হয়েছে প্রিভেনশন কাউন্সিল, প্রিভেনশন আন্ড পাবলিক হেলথ ফান্ড। অসুস্থতা তৈরি হবার পিছনে কাজ করে নানা আর্থ-সামাজিক কারণ, যে জন্য দেখা দেয় নানা প্রকার বৈষম্য। হ্যাঁ, অসুস্থতার জাতিগত বৈষম্যের পিছনেও কাজ করছে এমনই নানা কারণ। শারীরবৃত্তীয় কারণের বাইরে গিয়ে এইসব নানা কারণের সন্ধান ও সমাধান খোঁজে জনস্বাস্থ্য। দেশের বিভিন্ন জায়গায় ও বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে স্বাস্থ্যবৈষম্য দূর করার জন্য তাই এবারে নেওয়া হচ্ছে নানা পদক্ষেপ, জনস্বাস্থ্য-বিষয়ে নানা নতুন নীতি আনা হচ্ছে। সংখ্যালঘু স্বাস্থ্য পাচ্ছে বিশেষ অগ্রাধিকার। বলা হচ্ছে, ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’ – এই নীতি অনুসরণ করার কথা। কারণ, স্বাস্থ্য কেবলমাত্র আমাদের সংজ্ঞাত স্বাস্থ্যব্যবস্থার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, শিক্ষা, খাদ্য, বাসস্থান, পরিবহন, পরিবেশ ইত্যাদি সব সেক্টরের সাথেই স্বাস্থ্য জড়িত। সেগুলোর প্রতি নজর না দিলে এই বৈষম্য দূর হওয়া দূরস্থান, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অন্য অসুখ দূর করাও দূর অস্ত।
কী হতে চলেছে?
নতুন আইনের পক্ষে-বিপক্ষেঃ হ্যাঁ, এই রিফর্মগুলি আনতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে ও এখনো হচ্ছে, কারণ দেশের রক্ষণশীল রিপাব্লিকান দলের আপত্তি অনেক পয়েন্টেই। আর এই হেলথ কেয়ার অ্যাক্টকে ব্যাঙ্গ করে তাঁরা নাম দিয়েছেন, ‘ওবামাকেয়ার’। যেন জনস্বাস্থ্য, মেডিকেইড, মেডিকেয়ারের পিছনে সরকারি খরচ চূড়ান্ত অপব্যয়! রিপাব্লিকান দলের মূল প্রচার ছিল, আকাশচুম্বী স্বাস্থ্য-ব্যয়ের পিছনে মূল কারণ হল দেশের বেআইনি ইমিগ্রাণ্টরা, যারা কিনা এমারজেন্সী পরিষেবা ব্যবহার করে খরচ বাড়িয়ে দেয়। এদিকে এনিয়ে নানাবিধ স্টাডি বলছে, এরকম কোন প্রমাণ আদৌ পাওয়া যায়না। বরং কোন কোন রাজ্যের স্টাডি দেখিয়েছে, এই বাবদ খরচ মোট খরচের ১% মাত্র! এই তথাকথিত ‘কারণ’-টি মিথ্যা গালগল্প।
বিমা কেনা বাধ্যতামূলক করা নিয়ে রিপাব্লিকান দলের এবং সাধারণ আমেরিকাবাসীদের একটা বড় অংশের আপত্তি ছিল। বিমা না কিনলে দণ্ড দিতে হবে -- এটাকে তাঁরা ব্যক্তিগত অধিকারে হস্তক্ষেপ ও সেহেতু অসাংবিধানিক মনে করেন। টানটান আইনি লড়াইএর পর সুপ্রীম কোর্ট অবশ্য গত বছর জুলাই মাসে জানিয়ে দিয়েছে, এটি অসাংবিধানিক নয়। যদিও তাতেই এই আইন লাগু হয়ে যাবে, এমনটা মনে করার কোন কারণ নেই। কেননা মেডিকেইড সম্প্রসারিত করার ভার রাজ্যের হাতে আর অনেক রাজ্যই আবার এর বিরুদ্ধে; দেশের স্বাস্থ্যবিমা-হীন মানুষের অনেকেই আবার এইসব রাজ্যে!
এই বাধ্যতামূলক বিমা প্রকল্প নিয়ে আপত্তি উঠেছে অন্যান্য অংশ থেকেও, তবে সেটি সম্পূর্ণ অন্য কারণে। রিপাব্লিকান দলের আপত্তির উলটো কারণেও বলা চলে। বেসরকারিকরণ আরো বেশি করে হোক, এমনটিই চান রিপাব্লিকানরা। সরকারি মেডিকেইড, মেডিকেয়ার নিয়েও তাঁদের বিস্তর আপত্তি, কেননা রিপাব্লিকান দলের মতে এসব ক্ষেত্রে সরকারি হস্তক্ষেপ কমানো দরকার, ওবামা-সরকার সেটাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। রিপাব্লিকান পথের ঠিক উল্টোমুখের যাত্রী, আমেরিকা দেশের কিছু র্যামডিকাল অংশও বাধ্যতামূলক বিমা প্রকল্প নিয়ে আপত্তি তুলেছে, কেননা তা বেসরকারি বিমাকোম্পানির অংশগ্রহণ বাড়াবে। PNHP, মানে Physicians for a National Health Program, আমেরিকার প্রায় ১৮০০০ ডাক্তারদের অ্যাসোসিয়েশন এর ঘোর বিরোধী। এঁরা বহুদিন ধরে বলে আসছেন, এই অ্যাক্ট আমেরিকান স্বাস্থ্যব্যবস্থার অসুখের চিকিৎসার সঠিক প্রেসক্রিপশন নয়। বা, বড়জোর, ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য মরফিন গোত্রীয়।
কেন? এক তো এটা দিয়ে এর পরেও সমস্ত মানুষকে চিকিৎসার নিশ্চয়তা দেওয়া যাবে না। র্যাডিকল-রা হিসেব করে দেখিয়েছেন, আড়াই-তিন কোটি মানুষ এর পরেও স্বাস্থ্যবিমার আওতার বাইরে থেকে যাবেন। আর এতে করে আমেরিকান স্বাস্থ্যব্যবস্থার অন্য যে মুখ্য সমস্যা, ক্রমবর্ধমান খরচ, তারও বিশেষ সুরাহা হবেনা। কেউ কেউ এও বলছেন, শুধু সুরাহা হবে না, তাই নয়, এতে করে কিছু ক্ষেত্রে আরো বিপদকেই ডেকে আনা হল।
(আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)
('স্বাস্থ্যের বৃত্তে' পত্রিকায় প্রকাশিত লেখার পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত রূপ)