এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ধারাবাহিক  কাব্য

  • হরিতকী ফলের মতন ...(প্রথম কিস্তি)

    শিবাংশু দে লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | কাব্য | ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১২ | ১৩৪৯ বার পঠিত
  • ১. 

    '.... সংগোপন লিপ্সাময়ী, কম্পিত প্রেমিকা- তোমার কবিতা, কাব্য ;'

    সেটা ছিলো অঘ্রাণের শেষ বেলা। সাকিন  জামশেদ্পুর বই মেলার ধূসর আঙিনা। তখনও বাঁধানো হাট, ঘাসের কালিন পাতা অভিরাম ঠিকানায় যায়নি আমাদের বছরকার বইয়ের সঙ্গে রোমাঞ্চিত সাতদিন।

    যেসব বন্ধুদের সঙ্গে সময়হীন আড্ডা দেবার ইচ্ছে হয়, তারা তো সারা বছর এভাবে এক জায়গায় পঞ্চায়তের বটতলা পাততে পারেনা  এই কাজের শহরে। প্রসঙ্গ-অপ্রসঙ্গ-প্রসঙ্গান্তর কথার মেঘে ভিজে সাতটি সন্ধেবেলা। প্রসঙ্গ তো নয়, সঙ্গই সেখানে মুখ্য লিপ্সা। আমার এক বন্ধু, মুষ্টিমেয় একজন, যার সঙ্গে মুখোস না পরে পদ্য নিয়ে আলোচনা করা যায়, তাকে বলি বিনয় মজুমদার শেষ কবে পড়েছো? আসলে'ফিরে এসো চাকা' অনেকদিন ছাপা ছিলোনা। হঠাৎ'শতাব্দীর সেরা ভূতের গল্প','বিখ্যাত' শিল্পীদের আঁকা ছবিসহ প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য আরব্য উপন্যাস জাতীয় বইয়ের পাহাড়ের মধ্যে থেকে রোগা, ম্লান, হলুদ পাতার বইটি মুখ দেখালো, অরুণা প্রকাশন থেকে  ১৯৮৩ সালের সংস্করন। দাম চারটাকা। নামপাতাটি ওল্টালেই সেই বিখ্যাত নিবেদন,'উৎসর্গ, গায়ত্রী চক্রবর্তী'। তৎক্ষণাৎ'উৎসর্গ,  পর্ণা' লিখে তাকে খুঁজে বেড়ানো ভিড়ের মধ্যে। এই সময়ই সেই বন্ধু, কী নিলে?

    'ফিরে এসো'
    সে কী? এতোদিন পরে?
    আরে না না, একজনকে দিতে হবে।
    তখনই তাকে জিগাই, শেষ কবে পড়েছো, বিনয় মজুমদার?
    এভাবে গড়িয়ে যায় তার সঙ্গে কবিতার আলাপ। কতোশত ঘাসজমি, লেগুন, মোহানা পেরিয়ে কবিতার স্রোত বয়ে যায় শব্দের ছলে। সময়ও যায়...
    হঠাৎ দেখি অসিতদা এসে হন্তদন্ত, আরে শিবাজি চলো চলো, 
    বলি, কোথায়?
    ঐ স্টেজে দেখছো না, গান গাইতে হবে...
    বিপন্ন হয়ে এদিকওদিক....  দেখি পকেটে হাত দিয়ে সুদীপ দাঁড়িয়ে আছে। এইতো পাওয়া গেছে। 
    য়্যাই সুদীপ শোন শোন,
    কী হলো? এগিয়ে আসে সে...
    অসিতদা, সুদীপ খুব ভালো গায়। আজ ওকে দিয়ে গাওয়ান, আমি কাল আছি...
    সুদীপ হতভম্ব, মানে?
    যা না বে, আর নখড়া করিসনা....

    অসিতদা গ্রেফ্তার করে নিয়ে যান সুদীপকে, আমি বাঁচি তখনকার মতো। একটা স্টেজ বাঁধা হয় সেখানে। সবাই নিজের মতো করে বাংলা গান, পদ্য, কথা বলে মাইকের সামনে। পা ব্যথা হলে অনেকে জমিয়ে শোনে, মাঝে মাঝে আবার উঠে বইয়ের স্টলে ঢুকে যায়।

    আজ এসেছে কি? কোথায় গেলো তাহলে?
     মাঝে মাঝে কবিতা নিয়ে বেশ ভাবিত হয়ে পড়ে সে।  
     একবার প্রশ্ন করেছিলো, কবিতা বোঝার কোনও সরল নিয়ম আছে কি? না  যে কোনও রকম নিজস্ব নিয়মে তাকে বুঝে নিতে হয়? 

    আমি বলেছিলুম, কবিতা তো বোঝার জন্য নয়, ছোঁয়ার জন্য। বোঝার জন্য বানানো'বোঝা' মানুষ অনেক জড়ো করেছে। ঐ ভার থেকে মুক্তি পাবার জন্যই তো কবিতা। কোনও বুঝদার লোককে কখনো কবিতা পড়তে দেখেছো? হ্যাঁ, অনেক বাংলার অধ্যাপক পাবে, পার্ট টাইম নানা ব্যবসার ফাঁকে সুকুমারমতি বালকবালিকাদের কবিতার ব্যাখ্যা লিখিয়ে দেন। পরীক্ষায় আসবে এই প্যারাটা, গ্যারান্টি.... 

    এই সব দেখেই তো সেই বরিশালের বাঙাল অধ্যাপকটি পদ্যের মাংসকৃমি খোঁটা নিয়ে ব্যাকুল হয়ে পড়েন, ঝরে যান....

    'সংশয়ে, সন্দেহে দুলে দুলে তুমি নিজে ঝরে গেছ, হরিতকী ফলের মতন।'

    বরিশালে তো আমার মামার বাড়ি। তুমি কোন অধ্যাপকের কথা বলছো?
    সুযোগ যখন পাওয়া গেছে, আমার প্রিয়তম সেই কবিতাটি শোনাবার সুযোগ কি ছেড়ে দেওয়া যায়?  

    ৩রা মার্চ,১৯৬২

    ধূসর জীবনানন্দ, তোমার প্রথম বিস্ফোরণে
    কতিপয় চিল শুধু বলেছিল,'এই জন্মদিন'।
    এবং গণনাতীত পারাবত মেঘের স্বরূপ
    দর্শনে বিফল বলে, ভেবেছিলো, অক্ষমের গান।
    সংশয়ে সন্দেহে দুলে একই রূপ বিভিন্ন আলোকে
    দেখে দেখে জিজ্ঞাসায় জীর্ণ হয়ে তুমি অবশেষে
    একদিন সচেতন হরিতকী ফলের মতন
    ঝরে গেলে অকস্মাৎ, রক্তাপ্লুত ট্রাম থেমে গেল।'.......
    কবিতাটি আমি বলি, সে শোনে, কয়েক মূহুর্ত হরিতকী ফলের মতন ঝরে যায়। মনে হয় শুনি সুদূর থেকে সে বলে, 
    কার লেখা?
    আগে বলো, তুমি কি শুধু'বুঝতে' পেরেছো না শব্দগুলো কোথাও ছুঁয়েছে তোমাকে?
    স্বগতোক্তির মতো বলে ওঠে, ছুঁয়েছে, ছুঁয়েছে....
    এই কবিতাটা বিনয় মজুমদারের, ওনার বিখ্যাত সংকলন'ফিরে এসো চাকা'তে রয়েছে। 
    তুমি বইটা আমাকে এনে দেবো?
    নিশ্চয় দেবো, যদি খুঁজে পাই..... 

    ২.

    ......তবু বেদনায় নিজ হাতে রাখি
    মৃত্যুর প্রস্তর, যাতে কাউকে না ভালোবেসে ফেলি।'
    কয়েকদিন তেনার খোঁজ খবর নেই। ফোনের নাগালের বাইরে থাকেন তিনি। একটা জায়গায় পাওয়া যাবে নিশ্চিত। বুধবারে একবার ট্রাই নেওয়া যাবে।
     পর্ণা প্রতি বুধবার বিকেলদিকে একবার ডি এম লাইব্রেরিতে নিশ্চয় আসে, রবীন্দ্রভবন থেকে গান শিখে ফেরার পথে। স্ট্রেট মাইল রোডে লাইব্রেরির উল্টোদিকে ডাক্তার চ্যাটার্জির বাড়ির সামনে কৃষ্ণচূড়া গাছটির নিচে অফিস পালিয়ে অপেক্ষা করি। তিনি এলেন শেষ পর্যন্ত।  দেখতে পাননি আমাকে। একটু অন্যমনস্ক, অহংকারী পা ফেলা, নীলকালো কামিজ, কাঁধের ব্যাগে গানের খাতা। বাইরেই অপেক্ষা করি। বেরিয়ে এসে বাস স্ট্যান্ডের এগোতে থাকে। নিঃশব্দে পাশে পাশে হাঁটি। দেখেছে, কিন্তু তাকাচ্ছে না। কী হলো আবার ? মনে হয় কিঞ্চিৎ গুরুতর ব্যাপার।
    কী ব্যাপার, সব নিমন বা নু?
    হ্যাঁ, দেখছই তো, ভালো আছি...
    পর তনি গড়বড় লাগত....
    না কোনও গড়বড় নেই...
    চলো পার্কে একটু বসি
    নাহ, তাড়া আছে, আজ এখুনি বাড়ি ফিরতে হবে 
    তা ফিরবে, আমি পৌঁছে দেবো। এখানে এক মিনিট দাঁড়াও, আমি বাইকটা নিয়ে আসি...
    বলছিনা, আজ বসবো না কোথাও
    তুমি বসবে, আজ, এখুনি, আর কোনও কথা হবেনা

    থমকে দাঁড়ায়, এতক্ষণ পরে মুখ তুলে তাকায় আমার দিকে,
    কীসের জোর এতো তোমার? কীসের? 
    সেটা বলবার জন্যই তোমাকে যেতে বলছি...

    কিছু বলেনা, কিন্তু দাঁড়িয়ে যায়

    একটু পরে জুবিলি পার্কের টাটাবাবার মূর্তির নামোদিকে দেবদারুর সারি দিয়ে ঘেরা ঘাসজাজিমে দুজনে মুখোমুখি বসে থাকি অন্তঃস্বত্ব মৌনতায়।
    বলি, কিছু বলবে?
    হুঁ, গত বিষ্যুদবার তোমাকে বিষ্টুপুরে মেঘানির সামনে দেখলাম, কারুর সঙ্গে কথা বলছিলে...
    এতোক্ষণে স্পষ্ট হয় রহস্য। হা হা করে হেসে উঠি। তুমি কোথা থেকে দেখলে আমাকে?
    আমি আর পরমা হিন্দুস্তান বিল্ডিঙের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম
    আমায় ডাকলে না কেন?
    তোমাকে ডা-ক-বো? অতো ব্যস্ত ছিলে তুমি, হেসে হেসে.... মেয়েটা কিন্তু খুব সুন্দর...ও-ই কি মধুরিমা?
    ঠিক বলেছো
    তবে আর কী, আজ উঠি...
    আরে বসো, বসো.... একটা ছোট্টো কবিতা শুনিয়ে তোমাকে ছেড়ে দিচ্ছি,
    কার কবিতা?
    সেটাই তো তুমি বলবে...
    বেশ..

    ' ভালোবাসা দিতে পারি, তোমরা কি গ্রহণে সক্ষম?
    লীলাময়ী করপুটে তোমাদের সবই ঝরে যায়-
    হাসি, জ্যোৎস্না, ব্যথা, স্মৃতি, অবশিষ্ট কিছুই থাকে না।
    এ আমার অভিজ্ঞতা। পারাবতগুলি জ্যোৎস্নায়
    কখনো ওড়েনা; তবে ভালোবাসা দিতে পারি আমি।
    শাশ্বত, সহজতম এই দান-শুধু অঙ্কুরের
    উদ্গমে বাধা না দেওয়া, নিষ্পেষিত অনালোকে রেখে
    ফ্যাকাশে হলুদবর্ণ না করে শ্যামল হতে দেওয়া।
    এতই সহজ,তবু বেদনায় নিজ হাতে রাখি
    মৃত্যুর প্রস্তর, যাতে কাউকে না ভালোবেসে ফেলি।
    গ্রহণে সক্ষম নও। পারাবত, বৃক্ষচূড়া থেকে
    পতন হলেও তুমি আঘাত পাওনা, উড়ে যাবে।
    প্রাচীন চিত্রের মতো চিরস্থায়ী হাসি নিয়ে তুমি
    চলে যাবে; ক্ষত নিয়ে যন্ত্রনায় স্তব্ধ হব আমি।

    কিছুক্ষণ চুপ করে বলে, এটাতো আমার কবিতা; তুমি বলছো কেন?
    তাইতো, আমি ভাবলাম এটা আমার কথা তোমাকে শোনাই......
    এবার হেসে ওঠে নির্ঝরের মতো শব্দ করে, অনেকক্ষণ....

    মনে হচ্ছে শব্দগুলি স্পর্শ করেছে তোমায়
    করেছে, খুব করেছে, জীবনানন্দের মতো, কিন্তু জীবনানন্দ নয়.....
    ঠিক বলেছো, রক্তাপ্লুত ট্রাম মনে পড়ে?
    হ্যাঁ, বিনয় মজুমদার........
    ফুল মার্ক্স পেলে। 

    ৩.

    এরূপ বিরহ ভালো; কবিতার প্রথম পাঠের
    পরবর্তী কাল যদি নিদ্রিতের মতো থাকা যায়,
    স্বপ্নাচ্ছন্ন, কাল্পনিক; দীর্ঘকাল পরে পুনরায়
    পাঠের সময়ে যদি শাশ্বত ফুলের মতো স্মিত,
    রূপ, ঘ্রাণ ঝরে পড়ে তবে সার্থক সব ব্যথা,
    সকল বিরহ, স্বপ্ন; মদিরা বুদ্বুদের মতো
    মৃদু শব্দে সমাচ্ছন্ন, কবিতা, তোমার অপ্রণয়।
    হাসির মতন তুমি মিলিয়ে গিয়েছ সিন্ধুপারে ...... 

    অনেক ছোটো ছিলুম তখন। বাবার বিশাল বইয়ের ভার গুছিয়ে রাখার দায় নিজেই নিয়েছিলুম জাস্ট বই ঘাঁটার আনন্দ পেতে। পদ্যের বইগুলোর মধ্যেও তেষট্টি সালের ছাপা এই সংকলনটি ছিলো প্রায় নেই হয়েই। অনেকটা পাড়াগাঁর বাসর ঘরের সব চেয়ে গোধূলিমদির মেয়েটির মতো। বারো তেরো বছর বয়েসে নিশ্চয় বিনয় মজুমদারকে ছুঁয়ে থাকার মতো এলেম আমার ছিলোনা। কিন্তু পদ্যগুলি ছিলো শুধু পড়ে যাওয়ার জন্য। সব তন্তুজাল উড়িয়ে দিয়ে আটপৌরে বা তৎসম শব্দগুলিকে হৃদমাঝারে গড়িয়ে দেবার যে মসৃণ পাকদন্ডি বিনয় আবিষ্কার  করেছিলেন, তার জাদু সেই বয়েসেই অনুভব করেছিলুম। তোমার মোহনরূপে কে রয় ভুলে.....? বাবাকে প্রশ্ন করেছিলুম এই কবিতাগুলি কবে বুঝতে পারবো? তিনি বলেছিলেন, বোঝার চেষ্টা কোরোনা, কাছে যাওয়ার কথা ভেবো। তার জন্য সময় দিতে হবে, নিজেকে দিতে হবে মগ্নতা। বৈষ্ণবের কৃষ্ণপ্রাপ্তির মতো অনুভব হবে একদিন, সেটাই কবিতার কাছে আমাদের প্রার্থনা।

    তার পরেও সম্ভবত সিগনেট থেকে একটা তন্বী সংস্করন প্রকাশ করা হয়েছিলো, সেটা আমরা আমাদের শহরে পাইনি। 

    এটা নিয়ে একটা তুমুল তর্ক চলতো জীবনানন্দের আসল উত্তরাধিকারী কে ? দাবিদার আমার প্রিয়তম দুই কবি, বিনয় ও শক্তি। তখন কবিতাকে বা বলা ভালো বিভিন্ন কবিতার ধারার উৎস হিসেবে একজন বড়ো কবিকে নির্দিষ্ট করে দেওয়ার প্রবণতা বড্ডো প্রকট ছিলো।  'রবীন্দ্র অনুসারী' বা অন্যরকম মূঢ় তকমাও ছিলো খুব সুলভ। একটু সরব হয়ে মানুষের দুঃখসুখ নিয়ে চর্চা করতেন যেসব কবি তাঁরা ছিলেন'সংগ্রামী', কেউ ছিলেন মাতাল, আর কেউ বা  পদ্যবণিক। বুদ্ধদেব বসুর'মতো' যাঁরা, তাঁরা'বৌদ্ধ' আর বিষ্ণু দের কাছাকাছি ছিলেন'বৈষ্ণব'রা। 

    জীবনানন্দ যে ধারাটায়, অর্থাৎ পদ্যের যে প্রতিমায় শেষ পর্যন্ত স্থিত হয়েছিলেন তা কিন্তু একেবারেই'ঘোর'সৃজনী পন্থা ছিলোনা। তাঁর জীবৎকালে তাঁর সম্বন্ধে যা কিছু বলা হয়েছে, পরবর্তীকালে দেখি  সবই সত্যের থেকে দূরে। তাঁর কাছে শব্দ, শব্দবন্ধ, রূপক, প্রতীক, প্রত্নচিণ্হ সবই আসতো অনেক শ্রমের পর। কিন্তু কবিতাটির অবয়ব স্থির হয়ে গেলে কোনও সীবনচিণ্হ খুঁজে পাওয়া যেতোনা। একজন প্রকৃত শিল্পীই পারেন এরকম। একজন সফল মৃৎশিল্পীর প্রতিমায় পাওয়া যায়না খড়ের ভঙ্গুর নির্মাণ বা একজন সফল কণ্ঠশিল্পীর তানকারি পরিবেশনায় থাকেনা অকারণ সরগমের চমক দেওয়া ভেল্কি।
    সমর সেনের সঙ্গে সুনীল গঙ্গো  বা প্রেমেন্দ্র মিত্রের সঙ্গে অলোকরঞ্জন, এভাবে সমান্তরাল খোঁজার খেলা  ছিলো পদ্য পাগলদের মধ্যে।  জীবনানন্দের সঙ্গে বিনয় বা শক্তির সমান্তরাল টানা ছিলো অত্যন্ত সুলভ ব্যসন। এর কারণ কি যেহেতু জীবনানন্দ জীবৎকালে ছিলেন একজন দুরূহ কবি বা তদুপরি একজন নিজের মুদ্রাদোষে সম্পূর্ণ আলাদা হওয়া এক মানুষ, তাই কলকাতার মহানাগরিক  মননের অংক তাঁকে নিজের সুবিধের জন্য একটা বিশেষ গোত্রে ফেলে দিলো। বুদ্ধদেব বসু বলেছিলেন, জীবনানন্দ একজন আদ্যন্ত কবি এবং কবিতা ছাড়া তিনি কিছু লেখেন না। অর্থাৎ,একজন সাবেক'কবি'র  ছাঁচে ফেলা হলো তাঁকে, আলুলায়িত যুক্তিবোধ ও বলগাহীন আবেগতাড়িত শব্দের বাজিকর হিসেবে, যেটা হয়তো কবিদের সম্বন্ধে সমাজের অধিকাংশ লোকেরই ধারণা। কবিও যে সর্ব অর্থে  একজন শ্রমিক, সেই বোধটা বেশ বিরল। তাঁর ইতিহাসচেতনা, সামাজিক বোধির স্বরূপ সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের মাপের একজন ধীমান কবিও বুঝতে পারেননি। অন্য পরে কা কথা? তথাকথিত'বামপন্থী' বিশ্লেষণে অবক্ষয়ের সাবেক ছাপ দাগানো হয়েছিলো  তাঁর উপর। তাই জীবনানন্দের প্রকৃত উত্তরসূরি হয়ে আসেন একজন'পাগল' ও একজন'মাতাল', দুই বরেণ্য উৎকেন্দ্রিক,  সরকারে দরকার নেই, তাই নিজের সুড়ঙ্গে  স্বচ্ছন্দ থাকাই তাঁদের  ভবিতব্য। তাঁদের স্ব আরোপিত ট্র্যান্সের মুগ্ধ অমরাপুরীতে স্বপ্ননির্বাসন দেওয়া হলো?   

    কবিতা পড়ার বা শোনার আগে এতো কচকচি কি অনিবার্য? এতো সব নিয়ে চর্চা না করলে, ঘাম না ঝরালে কি কবিতা উপভোগ করার অধিকার জন্মায় না? কবিতা তো এভাবেই মানুষের থেকে দূরে চলে যায়। 

    পর্ণা আমাকে এই প্রশ্ন করেছিলো  একদিন। কিছু সন্দিগ্ধ, কিছু নিরাশ। আমি ভাবি, সত্যিই তো, যাঁরা পদ্য আর লিটল ম্যাগ নিয়ে  সতত নানা নিরীক্ষায় ব্যস্ত তাঁরা ছাড়া কি কবিতায় আর কারো অধিকার নেই?  জনপ্রিয় না হলেই কি তা'প্রকৃত' কবিতা হবে? অংকটা কি এতই সহজ?

    ( চলবে )
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ধারাবাহিক | ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১২ | ১৩৪৯ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • pharida | ***:*** | ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১২ ০৫:২৬89402
  • চলুক, আমরা জলের পাশে বসে থাকি....
  • ranjan roy | ***:*** | ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১২ ০৮:৩৬89401
  • অংকটা কি এতই সহজ? কত ? কত্টুকু ?
  • dukhe | ***:*** | ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১২ ০৬:০২89403
  • "বুদ্ধদেব বসু বলেছিলেন, জীবনানন্দ একজন আদ্যন্ত কবি এবং কবিতা ছাড়া তিনি কিছু লেখেন না। অর্থাৎ,একজন সাবেক 'কবি'র ছাঁচে ফেলা হলো তাঁকে, আলুলায়িত যুক্তিবোধ ও বলগাহীন আবেগতাড়িত শব্দের বাজিকর হিসেবে , যেটা হয়তো কবিদের সম্বন্ধে সমাজের অধিকাংশ লোকেরই ধারণা। কবিও যে সর্ব অর্থে একজন শ্রমিক, সেই বোধটা বেশ বিরল।"

    হেইডা ঠিক লাগলো না । বুব তো নিজেই লিখে গেছেন - "কবিতা লেখাও একটা কাজ, মাথার ঘাম পায়ে ফেলার অর্থে কাজ ।"
  • শিবাংশু | ***:*** | ২০ সেপ্টেম্বর ২০১২ ০৭:৪৯89404
  • দুখে,

    'শ্রমিক' একটা সামাজিক অবস্থান। বুদ্ধদেবের কবিতার ক্ষেত্রে কবির 'মাথার ঘাম ফেলা' ব্যাপারটি ব্যক্তিগত উদ্যোগ। কারণ তিনি বলেছিলেন, 'তাই পবিত্র,যা ব্যক্তিগত'। এই ছাঁচে তিনি জীবনানন্দকেও ফেলতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সময় সেটা গ্রহণ করেনি। যে কবির সামাজিক অবস্থান স্পষ্ট নয়, সে কখনও জীবনানন্দের স্তরের স্বীকৃতি অর্জন করতে পারেনা।
  • শিবাংশু | ***:*** | ২১ সেপ্টেম্বর ২০১২ ০৫:২৮89406
  • ম্যাক্সিমিন,

    এই লেখাটায় শক্তি নেই। এক খাপে দুটো তলওয়ার কী করে আঁটবে? ঃ-)

    এবার 'বুঝদার' প্রসঙ্গ।

    আমার কাছে 'বুঝদার' মানে একজন বুদ্ধিমান ব্যক্তি,যাঁর যাবতীয় যাপনের সব কোণ-কুলুঙ্গিতে আত্মবিশ্বাসের আলো জ্বেলে রাখতে পারেন। যাঁর তিরিশ বছর পরের বেঁচে থাকার পরিপ্রেক্ষিত এই মূহুর্তে স্পষ্ট। জীবনের প্রতিটি মূহুর্তকে কীভাবে অর্থসম্পদ সমুজ্জ্বল করে রাখা যায়, সেই জাদু যাঁর আয়ত্বে আছে। তিনি হতে পারেন একজন প্রোমোটার, লৌহব্যবসায়ী বা আবগারি দারোগা।

    এরকম কেউ কি কবিতার সঙ্গ করেন ? ঃ-)

    জানিনা....
  • ম্যাক্সিমিন | ***:*** | ২১ সেপ্টেম্বর ২০১২ ১২:৫৫89405
  • বিনয় মজুমদারের সুন্দর পড়িয়েছেন। এবারে শক্তিকেও পড়াবেন। হয়তো অন্য কবিদেরও। কৌতুহল রইল।

    মূল জায়গাটা নিয়ে সংশয় থেকে যাচ্ছে -- 'কোনও বুঝদার লোককে কখনো কবিতা পড়তে দেখেছো?' আমার যেন মনে দেখেছি।
  • ranjan roy | ***:*** | ২২ সেপ্টেম্বর ২০১২ ১২:২৯89407
  • শিবাংশু,
    আমার প্রার্থনা আপনি 'সারাজীবন অবুঝ' থেকে যান!
  • ranjan roy | ***:*** | ২২ সেপ্টেম্বর ২০১২ ১২:৩০89408
  • দ্বিতীয় কিস্তির অপেক্ষায় আছি!
  • ম্যাক্সিমিন | ***:*** | ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১২ ০৭:৫৬89409
  • যাবতীয় যাপনের সব কোণ-কুলুঙ্গিতে আত্মবিশ্বাসের আলো জ্বেলে রাখতে পারেন। বাঃ কী সুন্দর বললেন। এইবারে বুঝলাম।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভ্যাবাচ্যাকা না খেয়ে মতামত দিন