ম্যাডামের হেব্বি অভিমান হয়েছে। খুব খার। মনের আনন্দে খেলাঘর সাজাতে বসেছিলেন তিনি, ফেলে ছড়িয়ে খাবার তেমন অভ্যেস নেই, তবু যেখানে যতটুকু না দিলে নয়, ততটুকুই দিয়ে-থুয়ে খাচ্ছিলেন তিনি, আর বদ্তমিজ দিল্লিওয়ালারা কিনা তাঁর সমস্ত মনোগত বাসনায় বাসন-ধোয়া জল ঢেলে দিল? অকালকুষ্মাণ্ড মিডিয়াগুলো কিনা আবার তাঁর পেছনে হাম্পু দেবার জন্য উঠে পড়ে লেগে গেছে? ... আর, এবারে তাদের কিছুতেই থামানো যাচ্ছে না, এদিকে মুখ-চাপা দেওয়া হয় তো ওদিকে ফাঁক পেয়ে বেরিয়ে পড়ে আওয়াজ, এদের কি নিজের শহরের প্রতি, শহরের সুনামের প্রতি এতটুকুও মায়ামমতা নেই? ড্যাংডেঙিয়ে নেচে চলেছে, ঐ আখবরওলারা যেমন নাচাচ্ছে সেইভাবে?
ম্যাডাম, মানে, শিলু ম্যাডাম। আরে বুঝলেন না? শীলা দীক্ষিত, দিল্লির মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী। সেই অশোক মালহোত্রার কেসটা মনে আছে তো? দিল্লি সেক্রেটারিয়েটের ক্যান্টিনে চা বেচত। বছর তিনেক আগে সেই চা-ওলার বাড়িতে হানা দিয়ে তো চক্ষু চড়কগাছ সিবিআই টিমের। সতেরোটা টপ টপ মডেলের লাক্সারি গাড়ি, ছটা মোটরসাইকেল, প্রত্যেকটার ভিভিআইপি নাম্বারপ্লেট, সতেরো লক্ষ ক্যাশ, আর নগদ সাত ভরি সোনা সমেত সেই মালহোত্রাবাবুকে যখন গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হল, শোনা গেছিল একান্তে ইনভেস্টিগেশনে তিনি কিছু রাঘব বোয়ালের নাম করেছিলেন, যার মধ্যে একটা নাম শীলা দীক্ষিতেরও ছিল বলে কানাঘুষোয় শোনা গেছিল।
কিন্তু ওসব বিরোধীদের অপপ্রচার। শীলা দীক্ষিতরা জানেন এসব অপবাদের কেমন করে জবাব দিতে হয়। তাই তিনি, নয় তো তাঁর বাঁ হাত, কেউ ফোন টোন করে বসে সিবিআইয়ের দফতরে। জরুরি কয়েকটা ছোটোখাটো লোকাল কলও সেরে নিতে হয়েছিল অবশ্য সাথে, এই সব আখবরওলাদের আপিসে, জাস্ট দুদিনের বেশি টিকতে পারেনি অশোক মালহোত্রা সংক্রান্ত খবর মিডিয়ার হাইলাইটে। তিনদিনের মধ্যে সবাই সব ভুলে গেল।
কিন্তু এবারের কেসটা আলাদা। চারদিক থেকে টাকার ফোয়ারা আসছে। দেশি স্পনসর, বিদেশি স্পনসর, কমনওয়েল্থ গেম্স ফেডারেশন, অলিম্পিক কমিটি, এনটিপিসি, পাওয়ারগ্রিড, কে দিচ্ছে না পয়সা? পেপসি কোকাকোলাকে না-হয় বাদই দিলাম। সেই বিরাশির এশিয়ান গেম্সের পর এই দুহাজার দশ সালে আবার দিল্লির বুকে হতে চলেছে খেলাধূলোর এক মেগা ইভেন্ট, বিনীতভাবে টাকা চাইলে কেউ কি না করতে পারে? সাথে তো আছেই জনতার ট্যাক্সের পয়সা। সবই তো কমন ওয়েলথ! তা সেই টাকায় হাড়ভাঙা খাটুনি দিয়ে দিল্লিকে সাজিয়ে তোলার যৎসামান্য পারিশ্রমিক হিসেবে কেউ যদি কয়েক কোটি টাকাএকটু এদিক ওদিক করে থাকে, তাই নিয়ে এত কিছু ধরতে আছে? তৈরি হচ্ছে না দিল্লি জুড়ে ফ্লাইওভার? দিল্লিকে এফোঁড় ওফোঁড় করে হুশহুশিয়ে চলছে না সাধের মেট্রো রেল? রাস্তার ধারে, ডিভাইডারে লাগছে না বাহারি ফুলের গাছ? প্রগতি ময়দানের সামনে ফুট ওভারব্রিজটা দেখেছিস, কেমন লিফটে করে চড়তে হয়, তারপর টুক করে হেঁটে পার হয়ে আবর লিফটে করে নামতে হয়? দেখেছিস কখনো এমন জিনিস, বাপের জম্মে? দেখবি কখনো আর? এর পরেও টাকাপয়সা নিয়ে খুঁতখুঁতুনি তোদের যায় না?
নিতান্তই সামান্য কিছু খরচা। ইন্টারন্যাশনাল লেভেলের একটা গেমিং ইভেন্টকে দিল্লিতে সফলভাবে অর্গানাইজ করতে হলে পরে ইন্টারন্যাশনাল লেভেলে কিছু খরচাপাতি করতে হয়। ইন্টারন্যাশনাল টেন্ডার ডেকে একটা দু'টনের এসি ভাড়া করতে গেলে ইন্ডিয়ান কারেন্সিতে এক লাখ ন'হাজার টাকা লাগতেই পারে, একটা SUV গাড়ির পনেরো দিনের ভাড়া ৫ লাখ ৭০ হাজার হতেই পারে, একটা টিস্যু পেপার রোলের দাম চার হাজার টাকা হতেই পারে, চেয়ারের ভাড়া ছ'হাজার টাকাই বা এমন বেশি কী এমন?
আজ্ঞে হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন। এগুলো কেনার দাম নয়। ভাড়া। পনেরো দিনের ভাড়া। পনেরো দিন শেষে জিনিস আবার ডিলারের কাছে ফেরৎ যাবে।
আরো কীর্তি করে রেখেছেন সুরেশ কালমাডি। কমনওয়েল্থ গেম্স অর্গানাইজিং কমিটির প্রেসিডেন্ট। কূটকচালে সাংবাদিকের দল লন্ডন পর্যন্ত গিয়ে খোঁজখবর নিয়ে বের করেছে লন্ডনে আর ভারতে কুইন্স ব্যাটন রিলে-সংক্রান্ত যত প্রচার কভারেজ গাড়ি ইত্যাদির ব্যবস্থা করার জন্য যে দুটি সংস্থাকে বরাত দেওয়া হয়েছিল, কোটি কোটি টাকা খরচ করে, সেই দুটি সংস্থাই ভুয়ো; লন্ডনের যে ঠিকানা দেওয়া হয়েছিল, সেই ঠিকানায় কোনও সংস্থারই অস্তিত্ব নেই, খেলাধূলো থেকে বহুদূরের জগতে থাকা নিতান্তই দুটি সাধারণ গেরস্তবাড়ির ঠিকানা ছিল সেগুলো। আর ইন্টারন্যাশনাল টেন্ডার ডেকে ভাড়া নেওয়া যে সব ইকুইপমেন্ট্স, সে সমস্ত এসেছে দিল্লিরই বিভিন্ন ডিলারের কাছ থেকে। যে এসি কিনে ফেলা যায় পঁচিশ থেকে তিরিশ হাজার টাকায়, সেটা ভাড়া নেওয়া হয়েছে দিল্লিরই ডিলারের কাছ থেকে, পার পিস এক লক্ষ ন'হাজার টাকায়।
এসব নতুন কিছু খবর নয় আপনাদের কাছে, রোজই খবরের কাগজের প্রথম পাতায় বেরোচ্ছে এসব নিউজ। আপনারা, যারা দিল্লিতে থাকেন না, জানেন কি, কেমনভাবে সেজে উঠছে দিল্লি? কোন খরচের বিনিময়ে?
প্রথমে বলি পিডব্লুডির কথা। বিদ্যুতের সাশ্রয় করার জন্য অনেকদিন ধরেই দিল্লি সরকার উৎসাহ দিয়ে আসছে দিল্লিবাসীকে, সিএফএল ল্যাম্প কেনার জন্য। সেই দিল্লি সরকারের উৎসাহেই পিডব্লুডি দিল্লির সমস্ত স্ট্রিটলাইট পাল্টে ফেলল। নতুন ল্যাম্পপোস্ট, নতুন ডিজাইন, নতুন ওয়্যারিং, নতুন ল্যাম্প। জানা গেল, এই নতুন ধরণের ল্যাম্পে, সরকারের স্ট্রিটলাইটিং বাবদ খরচা বেড়ে গেছে আগের তুলনায় তিরিশ পার্সেন্ট। নতুন বাল্ব পুরনো বাল্বের থেকে বেশি বিজলি খায়। সমস্ত খবরে বেরিয়ে যাবার পরে এখন পিডব্লুডি আঙুল তুলছে সরকারের দিকে, আর সরকার তুলছে পিডব্লুডির দিকে। এখন আর সে সমস্ত বাল্ব পাল্টানো মুশকিল হি নহী, না-মুমকিন হ্যায়।
এর পর দিল্লি শহরের ফেসলিফটের গল্প। সেই এশিয়ান গেমসের সময়ে শেষবার সেজে উঠেছিল দিল্লি। কিন্তু তখন সময় আলাদা ছিল, জনসংখ্যার চাপও এখনকার মত ছিল না। আজকের দিল্লির তো শুধু লোকের চাপে নাভিশ্বাস উঠে যাবার জোগাড়। সেই ভিড় ঠেলে কাজ করা কি মুখের কথা? কিন্তু করছে বটে কাজ।
প্রথম কাজ, শহরের রাজপথ থেকে সমস্ত ভিখারি হঠানো। ভিক্ষাবৃত্তি এমনিতেই দিল্লিতে বেআইনি, কিন্তু সে নিয়ম এতদিন সেভাবে মানা হত না। এখন হঠাৎ করে অনেকগুলো সাদা চামড়া এসে পড়ার সময়ে টনক নড়েছে সরকারের। ভিখিরিদের ধরে জিজ্ঞেস করা চলছে, অ্যাই তুই কোন রাজ্য থেকে এইচিস রে? ভিখিরি, বেচারা, লাল পাগড়ি পুলিশ দেখলে এমনিতেই প্যান্টুলে হিসি করে ফেলে, সে আর কী বলবে? অতএব লোকজন নিজেদের প্রতিভা লাগাচ্ছে। এ মালটা বাংলায় কথা বলছে? পাঠিয়ে দাও পশ্চিমবঙ্গে। ঐ ভিখিরিটা হিন্দিতে কথা বলছে? নির্ঘাৎ বিহার কি ইউপি থেকে এসেছে।
হাসবেন না। সত্যি কয়েকশো ভিখারির লিস্টি এসেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছে, যারা দিল্লির রাস্তায় ভিক্ষে করে বেড়ায়। পবঙ্গ সরকারকে দিল্লি সরকার আর্জি করেছে, এদের ফেরত নিয়ে যাও, আমরা এদের দিল্লি থেকে বের করে দিচ্ছি।
দিল্লির ইতিহাস যাঁরা জানেন, তাঁরা জানেন যে, দেশভগের সময়ে আজকের গ্রেটার কৈলাশ, চিত্তরঞ্জন পার্ক, সাউথ এক্সটেনশনের মত নামী-দামি পশ জায়গাগুলো ছিল জঙ্গলে ভরা জমি, বানজারা ল্যান্ড। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে রাতারাতি সব-হারানো উদ্বাস্তুদের দলের অনেকে এসে উঠেছিল সেখানে, সরকারের কাছ থেকে পেয়েছিল জমি। আজ এইসব জায়গা দিল্লির সবচেয়ে দামি জায়গা। চোখধাঁধানো সব আলিশান বাংলো আর হাই ফাই সব মার্কেটে ভরা আজকের সাউথ এক্স।
কিন্তু প্রদীপের নিচে অন্ধকারের মত, এত বৈভবের পাশেই, একটু ভেতরের দিকে এমন অনেক ঘর লোক থাকেন, যাঁরা আজও দিন-আনি-দিন-খাই জীবন যাপন করেন। সাকিন তাঁদেরও সাউথ এক্স, কিন্তু লাইফস্টাইল নিম্নমধ্যবিত্তের। বাপ ঠাকুদ্দা সেই দেশ স্বাধীন হবার পর এসে এখানে কোনওরকমে একটা মাথা গোঁজবার ঠাঁই বানিয়েছিলেন। তাঁদের আজকের বংশধরদের তেমন সৌভাগ্য হয় নি সেই সব ঠাঁইকে বৈভবের বাসভূমিতে রূপান্তরিত করার। সেইসব কোঠিবাড়ি নিতান্তই বেমানানের মত বাংলোগুলোর পাশেই সহাবস্থান করছিল।
সম্প্রতি দিল্লি সরকারের মনে হয়েছে, বাড়িগুলি সত্যিই কুদর্শন। দিল্লির মত ওয়র্ল্ড ক্লাস সিটিতে, যেখানে আর কদিন পরেই সাদা চামড়ার সায়েবে ছেয়ে যাবে রাস্তাঘাট, সেখানে এমনতরো বাড়িঘরদোর কোনওমতে রাখতে দেওয়া যায় না এইসব সোয়্যাংকি হাভেলি আর শপিং মলের পাশে। লোকগুলোকে রাতারাতি আরেকবারের জন্য উদ্বাস্তু করে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে যমুনাপাড়ের ফ্লাড রিহ্যাবিলিয়েশন ক্যাম্পে, যেখানে অতিবৃষ্টিতে যমুনার পাড় ভেসে গেলে তীরবর্তী মানুষদের জন্য অস্থায়ী থাকার বন্দোবস্ত করে রাখা হয়। তাদের কুদর্শন কোঠিবাড়িগুলো ভেঙে ফেলা হয়েছে। কোনও বাংলো বা শপিং মলের গায়ে অবশ্য হাত পড়ে নি।
শুধু এইসব পোড়াকপাল লোকগুলোই নয়। হাত পড়েছে দিল্লির বিভিন্ন কলেজ হস্টেলে থাকা ছাত্রছাত্রীদের ওপরেও। দিল্লি ইউনিভার্সিটির নর্থ ক্যাম্পাসের সমস্ত কলেজের ছাত্রছাত্রীদের, যারা হস্টেলে থাকে, আদেশ দেওয়া হয়েছে হস্টেল খালি করার জন্য। রিনোভেশন হবে, এবং গেম্স চলাকালীন সেখানে অতিথিদের রাখা হবে। আর, ছাত্রছাত্রীরা কোথায় থাকবে?
সে ভাবনা তাদের। সরকারের অত সময় নেই যে ছাত্রছাত্রীদের কথা, তাদের পড়াশোনার অসুবিধের কথা ভাবতে বসবে। এখন গেম্স সফল করাই বড় মাথাব্যথা।
এইভাবে দিল্লির বিভিন্ন এলাকা থেকে অদৃশ্য করে ফেলা হচ্ছে বিভিন্ন ঠেলা নিয়ে বসা ফেরিওলা, অস্থায়ী দোকানদারদেরও। গেম্স শুরু হতে আর মাত্র বিয়াল্লিশ দিন বাকি। তার মধ্যে রাজ্যের কোথাও যেন দৃষ্টিকটূ কিছু না থাকে।
কোনও সিনেমার আদল মাথায় আসছে? জরুরি অবস্থার সময়ে, মানিকবাবুর বানানো?
হাঁইহাঁই করে কাজ চলছে সর্বত্র। রাস্তা তৈরি হচ্ছে, চওড়া হচ্ছে। কিন্তু মুচকি হাসিটি হেসে ফেলেছেন মণিশংকর আইয়ারবাবু। রাজ্যে, বিশেষত উত্তর ভারতে এবার পর্যাপ্ত বৃষ্টি হওয়ায় তিনি খুশি, কারণ, এতে কৃষির উন্নতি হবে, আর কমনওয়েলথ গেম্স ভেস্তে যাবে। শুরু থেকেই এই লোকটি কমনওয়েল্থ গেম্স দিল্লিতে করার বিরোধী ছিলেন। তাঁর যুক্তিগুলো সমস্তই ভ্যালিড। ভারতের মতন দেশে, যেখানে সরকার এখনও প্রতিটি নাগরিকের মুখে খাবার তুলে দিতে পারে না, প্রপার ম্যানেজমেন্টের অভাবে লাখ লাখ টন আনাজ শস্য গোডাউনে পচে নষ্ট হয়ে যায়, খেলোয়াড়দের সুযোগ্য ট্রেনিং কোচিংয়ের ব্যবস্থা করা যায় না, সেখানে কমনওয়েলথ গেম্সের নামে এত টাকার নয়ছয় করার ঘোর বিরোধী ছিলেন তিনি। আজও আছেন। এই টাকায় দেশে বেশ কিছু গেম্স কোচিং ইনস্টিট্যুট বানানোর পক্ষপাতি ছিলেন তিনি, যাতে ছেলেমেয়েরা ভালোভাবে ট্রেনিং পেয়ে অলিম্পিকে এশিয়াডে আরো বেশি বেশি করে মেডেল জিতে আসতে পারে।
যা বলছিলাম। তা বৃষ্টি হচ্ছেও এবারে দিল্লিতে। প্রায় বন্যাপরিস্থিতি। লাগাতার আকাশের মুখ ভার, ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি হয়েই চলেছে একটানা। আর লাখ লাখ টাকা খরচা করে বানানো সব নতুন রাস্তারা মুখ থুবড়ে পড়ছে এখানে সেখানে। বড় বড় গর্ত তৈরি হয়ে ধসে যাচ্ছে রাস্তা। গত তিরিশ দিনে পঁচিশখানা জায়গায় এমন ক্রেটার তৈরি হয়েছে। হাঁকুপাঁকু পিডব্লুডি দ্রুততার সঙ্গে মেরামত করেছে সেইসব গর্ত। পরের দিনের বৃষ্টিতে আবার সেইখানেই গর্ত। এবার আরো বড় সাইজে।
কনট প্লেস। দিল্লির কেন্দ্রস্থল। সমস্ত প্রাণের কেন্দ্রবিন্দু। তার হেরিটেজ লুক ফিরিয়ে আনার জন্য কাজ শুরু তো হয়েছিল বহুদিন আগে। চতুর্দিক আগাপাস্তলা খুঁড়ে ফেলার পরে এই দুদিন আগে জানা গেল, কাজের যা অগ্রগতি, গেম্স তো ভুলে যাও, ২০১১ সালের ডিসেম্বরের আগে কনট প্লেস তার স্বাভাবিক ছন্দে ফিরতে পারবে না। কনট প্লেসের দোকানদারেরা জানাচ্ছেন, অত্যধিক খোঁড়াখুঁড়ির ফলে তাঁদের ব্যবসা এমনিতেই মার খেয়েছে, এখন ২০১১ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হলে তাঁদের দোকান তুলে অন্যত্র শিফট করা ছাড়া গত্যন্তর নেই।
গ্যাঁড়ার ফ্লোরেই এক প্রতিবেশী কাজ করতেন একটি ইলেকট্রিকাল ইকুইপমেন্ট্স বিক্রি করার সংস্থায়। কীভাবে চ্যানেল লাগিয়ে কমনওয়েল্থের সঙ্গে যুক্ত দু একটি জায়গায় ইলেকট্রিফিকেশনের কাজের বরাত পেয়ে গিয়ে তিনি চাকরি ছেড়ে নিজের বিজনেস শুরু করেছেন। অলরেডি লাখের অঙ্কে কামাতে শুরু করেছেন, চাকচিক্য ফিরে গেছে তাঁর ফ্ল্যাটের।
গ্যাঁড়াদের ব্লকেরই আরেক বাঙালি ভদ্রলোক, যুক্ত আছেন GMRএর সঙ্গে। এই কোম্পানি দায়িত্বে আছে দিল্লির নতুন ইন্টিগ্রেটেড এয়ারপোর্ট টার্মিনাল বানানো এবং দৈনন্দিন অপারেশনের। গত প্রায় এক বছর ধরে লোকটা বাড়ি ফেরার জাস্ট সময় পায় না। নাওয়া খাওয়া হাল্কা ঘুমনো সমস্ত অফিসে। এই লেভেলের ফাইটিং দিয়েও, নতুন টার্মিনাল, T3 নামে যা বিখ্যাত হয়ে গেছে অলরেডি, চালু করা গেছে কেবলমাত্র ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইটের জন্য। ডোমেস্টিক উড়ান শুরু হবার কথা ছিল সাতাশে আগস্ট থেকে, আপাতত প্রবল বৃষ্টিতে T3, যা সম্ভবত এশিয়ার বৃহত্তম এয়ারপোর্ট টার্মিনাল হতে চলেছে, তার এত বেশি জায়গায় ছাদ ফুটো হয়ে জল পড়তে শুরু করেছে যে, GMRএর লোকজন বলে দিয়েছে ডোমেস্টিক অপারেশন গেম্স শুরু হবার আগে তো নয়ই, গেম্স শেষ হবার আগেও শুরু করা সম্ভব নয়। আপাতত কেবল ইন্টারন্যাশনাল অপারেশনই চলবে সেখানে। দোমেস্টিক উড়ানসমূহ চলবে সেই পুরনো এয়ারপোর্ট থেকেই।
এই খবর তবুও স্বস্তির। কারণ পুরনো এয়ারপোর্টে অটোরিক্সা যায়। নতুন এয়ারপোর্টের দু কিলোমিটারের মধ্যে অটোরিক্সা ঢোকা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অর্থাৎ, এয়ারপোর্ট যাত্রীকে সেখানে পৌঁছতে হলে হয় নিজের গাড়ি, নয় ট্যাক্সি, নয় মেট্রো রেলের সাহায্য নিতে হবে। অটোরিক্সা-চাপা ন্যাস্টি মিডলক্লাস লোকজনের জন্য নয় নতুন এয়ারপোর্ট। নিজের গাড়ি নিয়ে গেলে, আধ ঘণ্টার পার্কিং চার্জ ষাট টাকা, দু ঘন্টার একশো কুড়ি টাকা, ছ ঘন্টার জন্য চার্জ আটশো টাকা। নতুন এয়ারপোর্টে জল কিনে খেতে হলে এক লিটার জলের জন্য দিতে হবে আশি টাকা। আর যদি মেট্রোয় করে যান; এখনও মেট্রোর লাইন চালু হয় নি, কাজ চলছে, তবে শুরু হয়ে যাবে খুব শিগগিরই; কনট প্লেস থেকে এয়ারপোর্ট এক্সপ্রেস লাইনে করে এয়ারপোর্টে পৌঁছতে গেলে আপনাকে কাটতে হবে একটা আড়াইশো টাকার টিকিট। চোদ্দ কিলোমিটারের জন্য।
গেম্সের মাঝেই পড়েছে নবরাত্রি এবং দুর্গাপুজো। সরকার বলে দিয়েছেন, সমস্ত পুজো এবং রামলীলা-মেলার আয়োজনে কাটছাঁট করতে, নমো-নমো করে এবারের পুজোটা সারতে, গেম্সের কাজে ব্যস্ত থাকবে সমস্ত পুলিশ, পুজোয় দেবার মত লোকবল নেই সরকারের। যথারীতি কোনও মেলা কমিটি বা পুজো কমিটি রাজি হয় নি এই প্রস্তাবে। বচ্ছরকার দিনের উৎসব, কে-ই বা চাইবে নমো-নমো করে সারতে? সংঘাত বেধে গেছে তাই নিয়ে।
পরশুদিনে খবর এসেছে নিউ দিল্লির শিবাজি স্টেডিয়ামে এত বেশি কাজ বাকি রয়ে গেছে, তা গেম্সের আগে শেষ করা যাবে না। ... যমুনা স্পোর্টস কমপ্লেক্স গ্যাঁড়ার বাড়ির খুব কাছেই, সেদিন নিজের চোখে গ্যাঁড়া দেখে এসেছে স্টেডিয়ামটাকে চোখে দেখা যাচ্ছে না, রাস্তা থেকে জল শুরু হয়েছে, গোটা কমপ্লেক্সটা একটা আস্ত সুইমিং পুল হয়ে আছে। কাজ করার মতন কোনও জায়গাই নেই। জওহরলাল নেহরু স্টেডিয়ামের ছাদ চুঁইয়ে এখনো জল পড়ছে। ধ্যানচাঁদ স্টেডিয়ামের জন্য স্পেশাল কোয়ালিটির ঘাস আসার ছিল গাজিয়াবাদের হাপুড় থেকে, সিকিওরিটি এজেন্সি বলেছে ঘাস যদি হাপুড় থেকে সীল্ড হয়ে আসে, তা হলে কোনও কথা নাই, কিন্তু খোলা অবস্থায় এলে প্রতিটা ঘাস চেক করে তবে ছাড়া হবে। এখন তাই নিয়ে আইনী লড়ালড়িতে ন্যাড়া হয়ে পড়ে আছে ধ্যানচাঁদ স্টেডিয়াম, ঘাস শুকোচ্ছে হাপুড়ের ট্র্যাক্টরে।
গেম্স মিনিস্টার বলেছেন ভগবান আমাদের সাথে আছেন, ইন্শ্আল্লাহ্, আমরা গেম্স সফল করবই।
শিলু ম্যাডাম বলেছেন, দিল্লির লোকজন, সাংবাদিকরা যথেষ্ট প্যাট্রিওটিক নয়, দেশপ্রেমিক নয়, নইলে দিল্লির এই সংকটকালে কোথায় অর্গানাইজিং কমিটির পাশে এসে দাঁড়াবে, সমস্ত দুর্নীতির তথ্য ধামাচাপা দিয়ে কেবল কীভাবে গেম্স সফল করা যায় তাই নিয়ে ভাববে, তা না ... আসলে দিল্লির প্রতি এদের কোনওরকমের ভালোবাসা নেই।
সনিয়া ম্যাডাম বলেছেন, সব ভুলে গিয়ে এখন গেম্সকে সফল করার জন্য লেগে থাকুন সমস্ত দিল্লিবাসী। আমি আছি তো, দোষীরা ঠিক শাস্তি পাবে।
কালমাডি বলেছেন, সব বিরোধীদের অপপ্রচার। আমি কিছুই জানি না আর্থিক অনিয়মের ব্যাপারে। সব কিছুই নিয়ম মেনে হয়েছে। তদন্ত হলে হোক। কিন্তু আমি পদত্যাগ করব না।
ব্যাপক আর্থিক দুর্নীতির খবর পেয়ে আপাতত সরে দাঁড়িয়েছে তিন বড় বড় স্পনসর; এনটিপিসি, পাওয়ারগ্রিড, এবং ইন্ডিয়ান রেল। প্রায় কয়েকশো কোটির অনুদান আটকে গেছে। আশি টাকার জলের বোতল বেচে আর কত টাকা উঠবে কে জানে!
পরিস্থিতি বেগতিক দেখে কালমাডির ডানা ছেঁটে অর্গানাইজিং কমিটির ক®¾ট্রাল নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং।
কিন্তু তাতেও কি শেষরক্ষা হবে? স্বাধীনতা দিবসের দিনে, লালকেল্লায় জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিচ্ছিলেন মনমোহনদাদু। দিল্লির যাবতীয় পুলিশ সেদিন ব্যস্ত ছিল দাদুর মাথায় ছাতা ধরতে। সেই সুযোগে, শুধু দিল্লি থেকে সেদিন চুরি হয়েছে ১৬০খানা গাড়ি। আজ্ঞে হ্যাঁ, একশো ষাট। ... একদিনের সমারোহেই আম দিল্লিবাসীর এই অবস্থা। পনেরো দিনের কমনওয়েলথ গেম্সে, যখন দিল্লির সমস্ত সিকিওরিটি ব্যস্ত থাকবে বিদেশী অতিথিদের নিরাপত্তার জন্য, ঠিক কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে দিল্লিবাসীদের নিরাপত্তার হাল, একবার ভেবে দেখুন।
গ্যাঁড়া তো থাকছে না, পালাচ্ছে দিল্লি ছেড়ে, ঐ কদিনের জন্য। আপনার কী প্ল্যান?
২৩ শে অগস্ট, ২০১০