এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  বিবিধ

  • লা-জওয়াব দিল্লি ঃ এক্সট্রা কোচ ৩

    শমীক মুখোপাধ্যায় লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বিবিধ | ২৭ জুন ২০১০ | ৯৩২ বার পঠিত
  • দিল্লিওয়ালারা বুক বাজিয়ে বলে থাকে, দিল্লি দিলোয়ালোঁ কা শহর হ্যায়। সেই দিলের গভীরতা বা প্রসারতার মাপ নেবার জন্য যে ধরণের মস্তিষ্ক থাকা দরকার, বা, না-থাকা দরকার, তা হয় তো গ্যাঁড়া গেঁড়ি দুজনের কারুরই নেই। দিলদরাজির নমুনা এদের খুব সহজেই মেলে। সকালবেলায় ঘন্টা নেড়ে হনুমান সাঁইবাবা আর শেরাওয়ালীর পুজো সারতে সারতে পাশে বসা বন্ধুর সঙ্গে ব্যাহেনচোদ মাদারচোদ শব্দসমৃদ্ধ ভাষায় গল্প করা, অচেনা অজানা তো দূরে থাক, চেনা-জানা লোকজনের কাঁধে হাত রেখে তার সর্বস্ব লুটে নেওয়া, সামান্য কিছু টাকা বা পার্কিং লটে গাড়ি রাখার জন্য কাউকে খুন করে ফেলা, এদের দিলদরাজির নমুনা। এরা আবার বড়, বড় বেশি বিপজ্জনক রকমের সমাজসচেতন, সমাজ তথা পরিবারের সম্মান রক্ষার্থে এরা আরামসে খুন করে ফেলতে পারে নিজের দিদি, বোন বা মেয়েকে, কিংবা তার সঙ্গীকে।

    সম্মান রক্ষার্থে হত্যা। বা অনার কিলিং। এই শব্দবন্ধ এখন ধাক্কা খাচ্ছে দিল্লির অলিতে-গলিতে, রাজপথে। ব্যাপারটা কিন্তু আনকোরা নতুন কিছু নয়। আশেপাশের হরিয়ানা, রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশের গ্রামে গ্রামে এই সম্মান-হত্যার ঘটনা অনেকদিন ধরেই হয়ে চলেছে, হচ্ছে। নেহাৎ জায়গাগুলো রাষ্ট্রীয় রাজধানী ক্ষেত্রের মধ্যে পড়ে না, তাই তারা কখনো খবরের কাগজের প্রথম পাতায় জায়গা পায় নি। খাপছাড়াভাবে তারা এসেছে চার কি পাঁচের পাতায়, কিংবা দুপুর বেলার কোনও নিউজ চ্যানেলে। এই প্রথমবার, দিল্লিতে পরপর ঘটে গেল এতগুলো খুনের ঘটনা, যার প্রতিটাই অনার কিলিংঅএর জ্বলন্ত উদাহরণ।

    অনার কিলিং নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই, উত্তর ভারতের বিভিন্ন ছোট-ছোট গ্রামে থাকে সমাজরক্ষকের দল, মূলত এরাই তৈরি করে সেই সব গ্রাম বা মহল্লার পঞ্চায়েত, যার নাম "খাপ'। এই খাপের বিধান প্রায় সর্বত্রই এক রকমের, কেবল অপরাধের মূলটা এক এক জায়গায় এক এক রকমে কাস্টমাইজ্‌ড। কোথাও এক গ্রাম, কোথাও এক মহল্লা, কোথাও এক গোত্র, কোথাও আলাদা গোত্র, কোথাও অন্য কোনও হিসেবে এক সমষ্টির ছেলেমেয়েদের "ভাইবোন' হিসেবে ট্রিট করা হয়, এবং যেহেতু তারা ভাই-বোন, সেহেতু ঐ কমিউনিটির মধ্যে একটি ছেলে এবং একটি মেয়ে পরস্পরের প্রেমে পড়লে তা হয় ভয়ঙ্কর অপরাধ, বিয়ে করে ফেললে তা হয় আরো ভয়ঙ্কর। বাড়ি বা সমাজের সম্মতি তো পাওয়া যায়ই না, বেশির ভাগ সময়েই নিজের গ্রাম বা মহল্লা ছেড়ে অন্য জায়গায় গিয়ে ঘর বাঁধলেও পার পায় না নবদম্পতি। কারণ, খাপের হুকুমে এমনতরো অপরাধের শাস্তি একটাই, মৃত্যু। পুলিশ আইন আদালত কারুর পরোয়া নেই, দণ্ডদাতা বনে যায় অপরাধী ছেলে বা মেয়ের বাড়িরই লোক, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মেয়ের ভাই, কিংবা বাবা। কোনও অনুতাপ, অনুশোচনা থাকে না, নিজেরই আত্মজ-আত্মজা-অগ্রজাকে অপরাধের শাস্তি দেয় বারো বছরের ছেলে থেকে শুরু করে প্রৌঢ় বাবা। গায়ে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে, কাস্তে বা অন্য কিছু দিয়ে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে কেটে, নিতান্ত গলা টিপে, কখনো গলার নলি কেটে, দিল্লির মত শহরাঞ্চলের গ্রামে ইলেকট্রিকের তার গায়ে জড়িয়ে বেঁধে তার মধ্যে দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহ ঘটিয়ে ... পরিবারের সম্মান, সমাজের সম্মান বলে কথা। যে করতে পারে, সে সেই মহল্লায় নায়ক বনে যায়। শুরুতে কিছুদিন পালিয়ে বেড়াতে হয় অবশ্য, পুলিশের হাত থেকে, বা ধরা পড়লে জেলেও যেতে হয়, কিন্তু তাতে সেই হত্যাকারীর নায়কোচিত সম্মানপ্রাপ্তিতে কোনও বাধা পড়ে না।

    রাজস্থান, হরিয়ানা, পঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশ ইত্যাদি প্রতিবেশি রাজ্যের এক বিশাল জনসমষ্টির মিশ্রণ হল দিল্লিওয়ালা। এই সমষ্টির মধ্যে আছে অশিক্ষিত জনগণ, অল্পশিক্ষিত এবং উচ্চশিক্ষিত জনগণ। দিল্লির আনাচে কানাচে এবং দিল্লির আশেপাশে রয়েছে অনেক ছোটো ছোটো গ্রাম, এই অল্পশিক্ষিত এবং অশিক্ষিত জনতার ভিড় সেই সব জায়গাতেই, এবং এখনও পর্যন্ত হওয়া অনার কিলিংয়ের সমস্ত ঘটনাগুলৈ ঘটেছে এই সমস্ত ঘেটোর মধ্যে।

    শিক্ষার প্রসার যেখানে সীমিত, অপরাধের প্রসার সেখানে বাড়বেই, কিন্তু কী বলছে দিল্লির তথাকথিত উচ্চশিক্ষিত মহল?

    গ্যাঁড়ার আপিসের প্রজেক্ট টিমটা বেশ বড়সড়। প্রায় রোজই তারা বিকেলের দিকে একসাথে বেরোয় নিকটবর্তী ঝুপ্সে চা-পকোড়া খেতে। সেদিন, চায়ের কাপে, অবধারিতভাবেই প্রসং উঠল এই অনার কিলিং নিয়ে। টিমের ম্যানেজার ছেলেটি গ্যাঁড়ারই বয়েসী, সে যথারীতি দোকানেও খাপ খুলল, এক গোত্রে বিয়ে শাদি জেনেটিক্যালি সায়েন্টিফিক নয়, ওতে জিনের বিকাশ ঘটে না, বাচ্চার শরীরে রোগব্যধির প্রকোপ বাড়ে ইত্যাদি ইত্যাদি। গ্যাঁড়া কিছুক্ষণ চুপই ছিল, বাকিরাও হুঁ-হাঁ জাতীয় নীরব সম্মতিতে ছিল, কিন্তু এর পরে বেশিক্ষণ চুপ থাকা গেল না, প্রশ্নটা পেড়েই ফেলল, তুমি কি বস এক গোত্র মানে ব্লাড রিলেশন বোঝাতে চাইছো? তুমি কি জানো গোত্র ব্যাপারটার উৎপত্তি কোথা থেকে এসেছে? কী বেসিসে তুমি বললে জেনেটিক্যালি সায়েন্টিফিক নয়?

    দেখা গেল, ম্যানেজার নেতাগোত্রীয় হওয়া সত্ত্বেও এ বিষয়ে বিশেষ কিছু আলোকপাত করতে পারলেন না। গ্যাঁড়া থামল না, এক গোত্র না-হয় ছেড়েই দিলাম, এক গ্রামের লোক কী করে একে অপরের ভাই-বোন হয়? কোন জেনেটিক সায়েন্সের দৌলতে?

    অপর একজন মুখ খুলল, ভাই গাঁওমে কুছ চীজে মানি জাতি হ্যায়, লোগ উস্কি ইজ্জত করতে হ্যায়। বঁহাকা সমাজমে অগর ইয়ে মানা জাতা হ্যায় কি এক মোহল্লে মে সব আপসমে ভাই-ব্যাহেন হ্যায়, তো উসে মাননা চাহিয়ে।

    মাননা চাহিয়ে-র ওপর তো কোনও কথা চলে না। যে জিনিসের কোনো মাথামুণ্ডু নেই, কেউ বললেই সেটা মেনে নিতে হবে? আর মানতে না-চাইলে তার শাস্তি মৃত্যু?

    পরিবার এবং সমাজ, উত্তর ভারতে বড় পোক্ত জিনিস। সমাজকে অসম্মান করার কথা সাধারণত কেউ ভাবতে পারে না স্বপনেও। এই যেমন বিহারে আজকালকার ছেলেপুলেরা, জানে দহেজ নেওয়া খুব খারাপ জিনিস, কিন্তু আমি তো চাইনি, আমার বাবা চেয়েছিল, বাবাকে কী করে মানা করি, তাই শ্বশুর যা দিয়েছে নিয়েছি, ঠিক সেই রকমেরই রেসপন্স।

    তা, সমাজ তো এ-ও বলে, যেখানে সেখানে প্যান্টের চেন খুলে হিসি করা খারাপ জিনিস, যেখানে সেখানে গুটখা খেয়ে থুতু ফেলা খারাপ জিনিস, মেয়েদের প্রতি অশ্লীল ইঙ্গিত করা খারাপ জিনিস। তা হলে এর পরে তুমি যদি কখনও রাস্তার ধারে হিসি করতে দাঁড়াও, তা হলে সমাজকে অমান্য করার অপরাধে আমি তোমার গলার নলীটা কেটে ফাঁক করে দিতে পারি? থুতু ফেললে আমি তোমাকে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে কাটতে পারি?

    ম্যানেজার হে-হে করে হেসে উঠল, আরে ইয়ার তুম বঙ্গালী লোগ, হর চীজপে ইতনা সিরিয়াস হো জাতে হো, গ্রামের ব্যাপার, ওদের লোককে ওরা মেরেছে, আমাদের তাতে কী?

    ২০০৭-এ, যেদিন নন্দীগ্রামের ঘটনাটা ঘটেছিল, সেদিন নিজের উদ্বেগ বন্ধুদের সাথে ভাগ করে নিতে গিয়ে খানিকটা এই রকম কথা শুনেছিল গ্যাঁড়া। সেই মেয়েটি অবশ্য হরিয়ানভি কি উত্তরপ্রদেশীয় ছিল না, ছিল খাঁটি বাঙালী, গ্যাঁড়ার অনেক দিনের পুরনো বন্ধু। ই-মেলে যে রকমভাবে হাসা যায়, সেই রকমভাবে হেসে লিখেছিল, গ্রামের লোকে কাটাকাটি করে মরছে বলে শহরে বসে আহা-উহু করাটা এক ধরণের রোম্যান্টিসিজ্‌ম, বাজে ভাট না বকে নিজের কাজ কর্গে যা; আমি এখন টিসিএস আর ওএনজিসির শেয়ার নিয়ে ব্যস্ত আছি, কোনটা রাখব, কোনটা বেচব ...

    অনেক দিনের বন্ধুর সঙ্গে ঐ দিনই সম্পর্ক ছেদ করে দিতে একবারের জন্যও দ্বিধা বোধ করে নি গ্যাঁড়া। আজও সেই মেয়ের সাথে আর কোনওরকম যোগাযোগ রাখে না।

    গ্রামের লোক কাটাকাটি করে মরছে, আমাদের তাতে কী? তার সাথেই, ওদের খাপ পঞ্চায়েত যে সব ফতোয়া দিয়েছে, আমি তাকে সমর্থন করি। সুন্দর সহাবস্থান। দিল্লির তথাকথিত উচ্চশিক্ষিত সমাজে।

    গ্যাঁড়ার চাকরি প্রাইভেট কোম্পানিতে। আর গেঁড়ির অফিস? কেন্দ্রীয় সরকারের খোদ সদর দফতরে?

    তার সেকশনের বিহারি ছেলেটি তিন সপ্তাহের ছুটিতে দেশে গেছিল। একটু আলাভোলা টাইপের ছেলে, জগতের খবর বিশেষ রাখে না। ফিরে এসে খবরের কাগজ উলটে প্রথমেই তার চোখে পড়েছে অনার কিলিংঅএর খবর। সে হাতের কাছে আর কাউকে না-পেয়ে গেঁড়িকেই জিজ্ঞেস করে বসেছে, ইয়ে অনার কিলিং ক্যা হোতা হ্যায়?

    অফিস আফটার অল, তার ওপরে জিনিসটা সেন্সিটিভ, এ যেন সেই দাঙ্গা লাগার পরে শহরের অবস্থার মত, চারিদিকে কাউকে বিশ্বাস নেই, কে হিন্দু, কে মুসলমান, কে অনার কিলিংকে মনে মনে সমর্থন করে, কে করে না। রেখে ঢেকে দু-চার কথায় যা বোঝানো সম্ভব গেঁড়ি বোঝালো, বলতে গিয়ে কথার মাঝে দু-চারবার দিল্লি-হরিয়ানা আর রাজস্থানের উল্লেখ হয়েছে, খেয়াল করে নি, ঘরেরই আরেক কোণে আরেক ইউডিসি বসে আছে, যে নিজে হরিয়ানার লোক। ঘাড় গঁজ করে নিজের স্টেটের নিন্দেমন্দ শুনতে শুনতে আর থাকতে পারল না, সরব হয়ে উঠল, কেঁও জী, সব্ব কুছ হরয়াণা মে হী হোত্তা হ্যায়, ক্যা আপকে বঙ্গাল স্টেট মে কুছ নাহী হোতা?

    গেঁড়ী কিছু বলার আগেই চমকিতস্বরে বিহারী ছেলেটি বলে উঠল, নহী জি, দেখো, জাতপাত, ধরম গোত্র কা কিস্‌সা তো হমারে বিহার মে ভি হ্যায়, বহুৎ জাদা হি হ্যায়, লেকিন কৈ দুসরে গোত্র মে ইয়া এক গোত্রমে শাদি কর রহে হ্যায়, অউর উসকে লিয়ে উসিকা মা-বাপ-ভাই উসকা জান লে রহা হ্যায়, অ্যায়সি বাত তো হম বিহার মে ভি নহী সুনা হ্যায়।

    হরিয়ানভী তখন জোশ পেয়ে গেছে, হান্‌জী, দোষ তো শুধু বাবা মায়েরই হয়, আর যে বাবা মা তাকে পালা-পোষা করে বড় করল, সে যখন ওমুক গোত্রের ছেলের গলায় মালা দিয়ে নিজের বাপ মায়ের নাক কান কাটালো, তার কিছু দোষ হয় না। সব দোষ বাপ-মায়ের!

    এবার বাঙালি বিহারি মিলে তাকে বোঝাতে বসল, অন্য গোত্রে শাদি করলে বাপ মায়ের নাক কান কাটা গেল, এমন কথা মনে করছেই বা কেন? কী হয়ে যায় একজন রাজপুত একজন গুজ্জরকে বিয়ে করলে? একজন পঞ্জাবী একজন বাঙালিকে বিয়ে করতে পারে, একজন তামিল একজন জার্মানকে বিয়ে করতে পারে, একজন জাঠ আরেকজন জাঠকে বিয়ে করতে পারে না কেবল তারা এক গ্রামে থাকে বলে? এ কোন ধরণের ফতোয়া?

    কিন্তু হরিয়ানভির গোঁ। তাকে ভোলায় কার সাধ্যি? কেঁও জী, আপকে বঁহা পে জব কৈ লড়কা লড়কী মা-বাপকে মর্জি কে খিলাফ শাদি করতে হ্যায়, তো বাচ্চে কী মা-বাপ কুছ নহী কহতে হ্যায় ক্যা? অ্যায়সে হি ছোড় দেতে হ্যায় ক্যা?

    গেঁড়ী বলতে গেছিল, বলবে না কেন? ঝগড়া হয়, মুখ দেখাদেখি বন্ধ হয়ে যায়, রোনাধোনা হয়, কিন্তু তাই বলে বাবা-মা ছেলে মেয়েকে মেরে ফেলার কথা কী করে ভাবতে পারে? বাবা-মায়ের অনুমতি নিয়ে আজকাল কটা বিয়েশাদী হয়?

    হরিয়ানভী অনড়। আপকে বঁহা পে ইয়ে সব চলতা হোগা, য়ঁহা কা সমাজ অলগ হ্যায়, ইধর অ্যায়সা নহী চলতা। জিসনে ভি মারা ও দোনো কো, কুলদীপ অউর মোনিকা, সহি কিয়া। সমাজ কে লিয়ে অ্যায়সা এক সন্দেশ ভেজনা জরুরি থা, জিসনে ভি মারা, উসকো তো নেতা বনা দেনা চাহিয়ে, পলিটিক্স মে লানা চাহিয়ে, তব জাকে সুধরেগা ইয়ে দেশ। ভ্রষ্টাচার নে বরবাদ কর রহা হ্যায় ইস সমাজ কো, অ্যায়সি লোগোঁ কি জরুরত হ্যায় আজ।

    মাথা নিচু হয়ে আসে। দেশের রাজধানীর সবচেয়ে হাই প্রোফাইল জায়গা, সাউথ ব্লকে চাকরি করা একজন সরকারি কর্মচারির মুখে এই কথা।
    কথা কিছু আলাদা হয় না যখন স্টার নিউজ বা এনডিটিভির ক্যামেরা বুম করে দিল্লির অশোক বিহারের সেই মহল্লায়, যেখানে গুজ্জর হয়ে রাজপুতকে বিয়ে করার অপরাধে মরতে হয়েছে মোনিকা আর কুলদীপকে, আর অন্য গোত্রে শুধু প্রেম করার অপরাধে মরতে হয়েছে মোনিকার বোনকেও, একই দিনে। মহল্লারই একজন জুগিয়েছে অস্ত্র, মারবার জন্য, একজন জুগিয়েছে গাড়ি, মারার পরে মৃতদেহ ডাম্প করে আসার জন্য। আজ, দু হাজার দশ সালের চব্বিশে জুন, সেই মহল্লার সমস্ত লোক ভেঙে পড়েছে ক্যামেরার সামনে।

    কী বলছে তারা?

    বলছে, মনদীপ নাগর, অঙ্কিত চৌধরি, আর নকুল খারি, যে তিনজন খুন করেছে মোনিকা, কুলদীপ আর শোভাকে, তারা এই গ্রামের হিরো। গ্রামবাসীরা তাদের পাশেই আছে, থাকবে। তখনও পর্যন্ত তিন খুনী ফেরার, তাদের না-ধরা পর্যন্ত পুলিশের পক্ষে প্রমাণ করা সম্ভব হচ্ছে না তারাই খুনী, পুলিশের এই অসহায়তায় গ্রামবাসীর সে কী উল্লাস! সবাইকে ঠেলে সামনে এগিয়ে এল মনদীপের কাকা, জ্ঞকে খুন করেছে সেটা আপনারা খুঁজে বের করুন, কিন্তু যে-ই করে থাকুক, এক্কেবারে সাচ্চা কাম করেছে, একেবারে ঠিক কাজ করেছে। এই ধরণের ভ্রষ্টাচার সমাজে বাড়তে বাড়তে সমাজকে নষ্ট করে দিচ্ছিল, এদের মৃত্যুই প্রাপ্য ছিল, বেশ হয়েছে এরা মরেছে, ইয়ে লোগ সমাজ কে কীড়ে মাকোড়ে হোতে হ্যায়। জিসনে ভি মারা ইন তিনোঁ কো, বহ হমারে গাঁও কি হিরো হ্যায়, অ্যায়সে লোগোঁ কো হি রাজনীতি মে লানা চাহিয়ে, য়েহি লোগ সমাজ কো সুধারনে কা ঠেকা সম্ভালা হ্যায়।

    কিন্তু আইন? আদালত? পুলিশ? তারা যে বলছে এই কাজ অন্যায়? তারা যে ধরতে পারলে এদের বিরুদ্ধে খুনের মামলা লাগাবে? ... শীতাতপনিয়ন্ত্রিত স্টুডিওর ভেতর থেকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন সাংবাদিক। মনদীপের কাকার গলার স্বর আরো তীব্র হয়ে উঠল, পুলিশ কে কেহ্নে পর ক্যা আ জাতা হ্যায়? কোর্ট? বকিল? কোর্ট ক্যা সমাজ চলাতা হ্যায়? সমাজ তো হম চলাতে হ্যায়, হম, আম আদমি। কোর্ট সমাজ কে বারে মে ক্যা জানতি হ্যায়? পুলিশ সমাজ কে বারে মে ক্যা সমঝতি হ্যায়? পুলিশ কো কিসনে ঠেকা দিয়া হমারে সামাজিক রীতিয়োঁ মে চুনা লগানে কি? অগর উন তিন বচ্চোঁ কো (তিন খুনী) ছোড়া নহি জাতা তো আগে হম অওর আন্দোলন কে রাস্তা চুনেঙ্গে।

    গ্যাঁড়ার মনে পড়ে যাচ্ছিল অনেক অনেক বছর আগেকার, সেই উনবিংশ শতকের এক কাহিনি, বেঁটে নাস্তিক এক বাঁড়ুজ্জে বামুনের বিরুদ্ধে ঠিক এই রকমই ঝাল ঝেড়েছিল ভাটপাড়া থেকে কলকাতার অচলায়তন সমাজের পণ্ডিতের দল, ও ব্যাটা নাস্তিক ধর্মের বোঝে কী? আমাদের সমাজের রীতিনীতি ওর আর কটা ফিরিঙ্গি জজ ম্যাজিস্টরের কথায় বদলে যাবে? এত সহজে ছেড়ে দেব ওকে আমরা? কুৎসা রটাও, প্রাণের ভয় দেখাও, দরকার হলে আরো বড় আন্দোলনের পথে যাবে বাংলার ব্রাহ্মণকূল।

    গল্প পড়েছিল গ্যাঁড়া। উনিশ শতকের। আর আজ একুশ শতকে তারই পুনরাবৃত্তি দেখছে গ্যাঁড়া, টিভির চ্যানেলে।

    এই লেখা যখন শেষের মুখে, তখনই খবর এল ধরা পড়েছে মনদীপ, অঙ্কিত আর নকুল, গাজিয়াবাদের কাছে গড়মুক্তেশ্বরে। স্বীকারও করেছে খুনের কথা। বোনেরা গুজ্জর হয়ে রাজপুতকে বিয়ে করেছিল, এজন্য গ্রামের লোকেদের কাছে যথেষ্ট হ্যাটা হতে হচ্ছিল তাদের। সেই হ্যাটা, সেই অপমান তাদের আর সহ্য হচ্ছিল না। তাই পরিবারের সম্মান রক্ষার কথা তাদের মাথায় আসে। খুন হয় একে একে কুলদীপ আর মোনিকা।

    শোভা, অনার কিলিংঅএর তিন নম্বর ভিক্টিম, তার অপরাধ ছিল আরো গুরুতর। এক সময়ে সে একটি মুসলিম ছেলেকে ভালোবেসে পালিয়েছিল, কিন্তু পরে সেই প্রেম ভেঙে যায় ও শোভা ফিরে আসে। এর পরে শোভা আর তার বোন খুশবু মডেলিং করার দিকে পা বাড়ায়, এবং রবি নামে একজন কাশ্মীরি মডেলিং কোঅর্ডিনেটরের প্রেমে পড়ে ছোটো বোন খুশবু। প্রেমিকের সাথে খুশবুকে পালাতে সাহায্য করে এই বড় বোন শোভা। এক সময়ে দিদির প্রেম করে পালিয়ে যাওয়ার ফলে অপদস্থতা মেনে নিতে পারে নি তাদের ভাই মনদীপ। চার বছর ধরে সেই রাগ পুষে রেখেছিল সে। এবার বোনও সে পথে পা বাড়ানোয়, এবং দিদির সেই ঘটনায় প্রত্যক্ষ মদত থাকার কথা জানতে পেরে প্রতিহিংসার আগুনে জ্বলতে থাকে মনদীপ। পুলিশের কাছে জাল ম্যারেজ সার্টিফিকেট দেখিয়ে বোনের বিরুদ্ধে এফআইআর করতে যায় মনদীপ, কিন্তু পুলিশ সহজেই ধরে ফেলে যে ঐ ম্যারেজ সার্টিফিকেটটি জাল। পুলিশের কাছেও কোনো সুরাহা না হওয়ায়, অবশেষে সে সিদ্ধান্ত নেয় দিদিকে খুন করার। সাথে কুলদীপ আর মোনিকাকেও খুন করার পরামর্শ দেয় তার বন্ধু অঙ্কিত। পরপর খুন হয় শোভা, মোনিকা, কুলদীপ।

    পুলিশ মনদীপের কাকা, ও আরও একজন গ্রামবাসীকে গ্রেপ্তার করেছে, প্রকাশ্যে উস্কানিমূলক মন্তব্য করবার জন্যে। কেস চলবে।

    অনার কিলারদের ধরা গেল, কিন্তু অনার কিলিং কি শেষ হবে? সেই গ্রামের লোকেরা এখন খুঁজে বেড়াচ্ছে খুশবুকে, তাদের সন্দেহ খুশবুই পুলিশকে জানিয়েছে এই খুনের ব্যাপারে, খুশবুই নিজের ভাইয়ের বিরুদ্ধে নালিশ করেছে।

    দর্শক, তৈরি থাকুন, খুব শীগগিরই আমরা আরও একটি অনার কিলিং এর খবর পেতে চলেছি।

    ২৭শে জুন, ২০১০
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ২৭ জুন ২০১০ | ৯৩২ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। পড়তে পড়তে মতামত দিন