বাঁদর নিয়ে উৎসাহটা কিন্তু শুধু আমাদের মত মুখপোড়াদের একচেটিয়া নয়, বরং পশ্চিমি সাহেব-মেমদের এদের নিয়ে অনুরাগ, অনুকম্পা আর জ্ঞানের ঘনঘটা অনেক বেশি। অবশ্য বাঁদরেরা পশ্চিমের জলহাওয়া একেবারেই পছন্দ করে না, পৃথিবীতে সব বাঁদরই ভারতের মত গরমদেশের নাগরিক। কিন্তু সাহেবদের ভিনদেশি বাঁদর নিয়ে উৎসাহ কেন? একটা গোদা কারণ হল যে সাহেবদের কলোনি সবই তো আবার গরম দেশগুলো। সেই সব এক্সোটিক দেশগুলোর মানুষ, পশু-পাখি, গাছপালা (ছোটবেলায় সাহেবদের প্রেতাত্মা আমাদের দিয়ে আমপাতা, বেলপাতার হারবেরিয়াম বানিয়ে নেয় এখনো) ইত্যাদির খবরাখবর কলোনির প্রভুদের রাখতে হয়েছে। তাই এলিফ্যান্ট গডের দেশের বাঁদরের খবরও রাখতে হয়েছে। অন্যদিকে ক্যারোলাস লিনিয়াস নামের এক সুইডিস বিজ্ঞানী তাঁর "সিস্টেমা ন্যাচুরা' বইটিতে জীবজগতের একটা হায়ারার্কিকাল তালিকা বানিয়েছিলেন এবং সেখানে "সবার উপরে মানুষ (সত্য), তাহার উপরে নাই'। কিন্তু মানুষের ঠিক নিচেই ছিল বিভিন্নরকম বাঁদরেরা। ফলে বৈজ্ঞানিক থিয়োরি অনুযায়ী বাঁদরেরা হল পশুজগতে মানুষের নিকটতম আত্মীয়। তারপর ডারউয়িন দিলেন বিবর্তনের তত্ত্ব, বললেন এক প্রজাতি থেকে অন্য প্রজাতিতে পরিবর্তন হওয়া সম্ভব। নববর্ষার লাউ পল্লবের মতন বেড়ে চলা পল্লবগ্রাহীর দল মিলিয়ে দিলেন লিনিয়াস আর ডারউইনকে। তৃতীয় ছাগশিশুর মত আমরাও নেচে উঠলাম এই জেনে যে মানুষ একদিন বাঁদর ছিল, বাঁদর আমাদের পূর্বপুরুষ (পূর্বনারী ছাড়া এত মানুষ জন্মালো কি করে, কে জানে) ইত্যাদি প্রভৃতি। এবার বলিউডি সিনেমার স্টাইলে জারজ সন্তানের পিতৃপরিচয় সন্ধানের অসীম তাড়নায় পশ্চিম কোমর বেঁধে নেমে পড়ল বাঁদরামির জ্ঞানতাত্ত্বিক নির্মাণে। ডোনা হারাওয়ে তাঁর Primate Visions বইটিতে এই নির্মাণের অনেক গল্প আমাদের শুনিয়েছেন। আফ্রিকার কালো মানুষ আর বাঁদরের তাত্ত্বিক সমাপতন এই নির্মাণেরই এক প্রকল্প - Primatology is simian orientalism।
বাঁদরামির জ্ঞানের নির্মাণে আর একটি জায়গা ছিল মানুষের সত্তা বা এসেন্স বা লোগোসের খোঁজ। প্রশ্নটা পুরোনো - "মানুষ' বলতে আমরা কি বুঝি? মানুষের শাঁসটা কি আর খোসাটাই বা কি (এখানে অবশ্য ধরে নেওয়া হচ্ছে যে শাঁস আর খোসা আলাদা বিষয়)? এই প্রশ্নের জবাবে পশ্চিম একটা ভাবনার স্ট্রাকচার বানায় যার নাম ডুয়ালিজম বা দ্বিত্ত্ববাদ। অনেক ডুয়ালিস্ট মডেলের সাথে আমরা পরিচিত, যেমন পুরুষ/নারী, প্রকৃতি/সংস্কৃতি, পূর্ব/পশ্চিম, মন/শরীর, আমি/তুমি, সুস্থ/পাগল, শাঁস/খোসা ইত্যাদি। এবার "মানুষ' নামের তাত্ত্বিক সমস্যাতে ফেরা যাক। মানুষ একদিকে যেমন জৈবিক, প্রাকৃতিক আবার সে একইসাথে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিও বটে। এখন প্রশ্ন হল এই ডুয়ালিটিতে কোনটা শাঁস, কোনটা খোসা? পশ্চিম বাছাই করে আমাদের বলে দিয়েছে যে দুর্গামূর্তির খড়ের গোঁজের মত জৈবিক সত্তাটাই মানুষের এসেন্স আর মূর্তির ওপরের রংচং আসলে সংস্কৃতি। মানুষের প্রকৃতি আসলে জৈবিক, বায়লজিকাল। এই স্বত:সিদ্ধ থেকে তাই বলা যেতেই পারে যে যেহেতু বাঁদর মানুষের পূর্বপুরুষ, তার মধ্যেও সেই একই জৈবিক বৈশিষ্ট্য থাকবে। অর্থাৎ মানুষ আর বাঁদরের হার্ডওয়্যারটা একই, পার্থক্য শুধু সফটওয়্যারে। তাই বাঁদরামির গবেষণা পশ্চিমি সাহেব-মেমদের আত্মানুসন্ধানের চেষ্টা (গবেষণা করা ব্যাপারটা প্রাকৃতিক না সাংস্কৃতিক?)।
তা হলে এর মধ্যে রাজনীতিটা কোথায়? গোদা করে বলা যায়, বাঁদরের তত্ত্ব নির্মাণের মধ্যে দিয়ে তৃতীয় বিশ্বের মানুষদের এক হোমিনিড পশু হিসেবে ভাবা হয়েছে। কিন্তু উত্তর ঔপনিবেশিক পৃথিবীতে বাঁদরামির আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান আছে। বাঁদরামির গল্পটি বৈজ্ঞানিক ডিসকোর্সের অংশ। তাই তা বৈধ এবং সর্বজনগ্রাহ্য। কেউ যদি এখন বাঁদুরে গবেষণা করে "দেখান' কোন মানবিক বিষয়, যেমন প্রেম, ঘৃণা, ভয়, লোভ, ধর্ষণ, শোষণ ইত্যাদি আদতে জৈবিক এবং প্রাকৃতিক, সেই মুহূর্তে সকল রাজনীতির সম্ভাবনা নি:শেষ হয়ে যায় (লোক-"দেখানো' কি প্রাকৃতিক?)। কারণ, যা জৈবিক এবং প্রাকৃতিক তা অপরিবর্তনীয়, অপৌরুষেয়, সংজ্ঞানুসারেই তা সকল মানবিক কর্মকান্ডের বাইরে। অপরদিকে রাজনীতি সম্পূর্ণভাবেই একটি মানবিক সংস্কৃতি। তাই "পালটে যায় মাও সে তুঙের চীন' কিন্তু চীনাদের বাঁদরামি পালটাতে পারে না। একইভাবে "অস্তিত্ত্বের জন্য সংগ্রাম' যদি প্রাকৃতিক হয়, মানুষের হিংস্রতাও প্রাকৃতিক (ডারউইনের তত্ত্বের আর এক পল্লবগ্রাহী নমুনা)। ফলে পশ্চিমিদের তৃতীয় বিশ্বের ওপর কলোনি স্থাপনও প্রাকৃতিক এবং তা অপরিবর্তনশীল।
মানুষের কর্মকান্ডের অনেকটাই যদি প্রাকৃতিক হয়, তা হলে স্বাভাবিকভাবেই রাজনীতির পরিসরটা অনেক ছোট হয়ে যায়। আমরা আপাতত ছোট্ট করে বাঁদরামির একটি ক্রিটিক রাখছি রবীন্দ্রনাথকে ধরে। আইনস্টাইনের সাথে আলোচনায় ডুয়ালিজমকে তিনি একহাত নেন। রবীন্দ্রনাথের মতে মহাবিশ্বের সমস্ত জ্ঞানের (এর মধ্যে বাঁদুরে জ্ঞানও এসে যাচ্ছে) উৎস হল মানুষ স্বয়ং - The infinite personality of man comprehends the universe. There cannot be anything that cannot be subsumed by the human personality, and this proves that the truth of the universe is human truth। দার্শনিক পরিভাষায় রবীন্দ্রনাথ এখানে এক রিলেটিভিজমের কথা বলছেন। আমাদের চেতনার রঙেই পান্না সবুজ আর চুনী লাল রঙ নেয়। অপরদিকে আমরা বলতে পারি যে বাঁদুরে গবেষণার প্রতিটি প্রাকৃতিক ব্যাখ্যা পূর্বনির্ধারিত থিয়োরির অনুপস্থিতিতে হওয়া অসম্ভব। যে কোন বৈজ্ঞানিক এক্সপেরিমেন্ট আগে থেকে ঠিক করা কিছু থিয়োরি আর স্বত:সিদ্ধের ওপরে দাঁড়িয়েই করতে হয়। বিজ্ঞানের ইতিহাসে অসংখ্য উদাহরণ আছে যে থিয়োরি পালটে দিলে এক্সপেরিমেন্টের ব্যাখ্যাও পালটে যায়। এর দার্শনিক পরিভাষাটি হল theory ladenness of observation বা অবনির্ধারণ (underdetermination)। তা হলে ব্যাপারটা কি দাঁড়ালো? বাঁদুরে গবেষণা করে যাই ফলাফল বিজ্ঞানীরা পেয়েছেন তার মধ্যেই কোন না কোন থিয়োরির ভূত always already রয়ে গেছে। কোন বিশুদ্ধ অবজেকটিভ বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা বলে আদতে কিছুই হয় না। কোন মানবিক বিষয়কে প্রাকৃতিক বলার মুহূর্তটিতেই সেই প্রাকৃতিক ক্যাটিগরিটি মানবিকতা দিয়ে "দূষিত' হয়ে যায়।
পুনশ্চ: পুরো লেখাটাতেই আমরা আবার ডুয়ালিজমের মধ্যে ঢুকেই যুক্তি সাজাবার চেষ্টা করেছি। আমরা যেমন বলার চেষ্টা করেছি বাঁদরামি শুধুমাত্র প্রাকৃতিক নয়, সাংস্কৃতিকও। সবসময় পূর্ব/পশ্চিমের ভাগ করেছি। ডুয়ালিজমের ভূত এই লেখার ছত্রে ছত্রে। ডুয়ালিজমের "মানবিক' নির্মাণটির ধ্বংসসাধনের ওপর ভবিষ্যতের "মানবিক' রাজনীতি নির্ভর করছে।