মাননীয় জেলা শাসক মহোদয়,
কোচবিহার জেলা
পশ্চিমবঙ্গ
ভারত।
বিষয়ঃ মশালডাঙ্গা, মুন্সির ছিট, বাতৃগাছি, গয়াবাড়ি...... ছিটমহলের নাগরিকগণের নিবেদনপত্র।
মহাশয়,
যথাবিহিত সম্মানপ্রদর্শন পূবর্ক নিবেদন এই যে, আমরা নিম্ন স্বাক্ষরকারী উল্লেখিত ছিটের বাসিন্দা এই মর্মে অভিযোগ করিতেছি যে গত শতাব্দীর ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের জন্ম হইতে কী এক অজ্ঞাত কারণে ভারতীয় ভূখন্ডে অবস্থিত উল্লেখিত মৌজাগুলিকে পকিস্তান বলিয়া দাগিয়া দেওয়া হইয়াছে। পরবর্তী কালে সেই পাকিস্তান বাংলাদেশে পরিণত হওয়ার পর আমরা উল্লেখিত ছিটের বাসিন্দাগণ বাংলাদেশি হইয়াছি।
কেন হইয়াছি, তাহা আমাদিগের কপাল। কপাল না হইলে পাশের গ্রাম মদনাগুড়ি ইন্ডিয়া হয়, সেইখানে গ্রাম পঞ্চায়েত হয়, ভোটার কার্ড হয়, ঠিকানা হয়, চিঠি হয় কিন্তু আমাদের কিছুই হয় না। অথচ আমাদের পুরানো মসজিদে তাহারা, মদনাগুড়ি ইন্ডিয়ার বাসিন্দারা নমাজ আদায় দিতে আসেন। আমাদিগের মসজিদের আজান তাঁহারা শুনেন, ইমামের ঘর মদনাগুড়িই বটে। মাননীয় জেলা শাসক মহাশয়, আমাদের জেলা শাসক আপনি হয়েন, বাংলাদেশের লালমনির হাট, নীলফামারি কিংবা রংপুর কোনো জেলার জেলা শাসক আমাদের জেলা শাসক হইতে পারেন না। আমরা তাহা মানিব না। কেন না সে বহুদূর। একটা দেশ পেরিয়ে কাঁটাতারের বেড়া পেরিয়ে আর একটা দেশ। আমরা বাংলাদেশের ছিটের বাসিন্দা হইলেও সেই বাংলাদেশ অন্য দেশ। আমরা তাহা দেখি নাই। এই কারণে আপনার নিকটে আমাদের এই একান্ত নিবেদন।
মহাশয়, আমাদিগের কপালে পাকিস্তান হইয়াছিল কেন তাহা লইয়া কত কথাই না শুনা যায়। শুনা যায় মোগলদিগের সহিত কোচবিহারের মহামান্য নৃপতির যুদ্ধ হইয়াছিল। মোগলের প্রতিনিধি রংপুর ঘোড়াঘাটের নবাব সৌলৎ জং এসে আমাদিগের মহারাজা উপেন্দ্রনারায়নকে ঝাড় সিংহেশ্বরের প্রান্তরে লড়াই করে হারিয়ে দিল এক কালে। সেই যুদ্ধে আমাদিগের মহারাজার অন্দরমহলের বিভীষণ এক জ্ঞাতি ভাই দীনেন্দ্রনারায়ণ সিংহাসনের লোভে মোগলদিগের সহিত গোপনে যোগাযোগ করেন। এবং আমাদিগের মহারাজা উপেন্দ্রনারায়ণ পরাস্ত হন ঝাড় সিংহেশ্বরের যুদ্ধে। সেই লোভী জ্ঞাতিভাই দীনেন্দ্রনারায়ণকে সিংহাসনে বসায় মোগল সম্রাটের তরফে ঘোড়াঘাট-রংপুরের নবাব সৌলৎ জং। কিন্তু পরের বছরই আমাদিগের পরাজিত মহারাজা আবার যুদ্ধ করেন ভূটান রাজার সাহায্য লইয়া। এবং তাঁহার জয় হয়। জয় হয় বটে কিন্তু কিছু মৌজার প্রজা নাকি সাবেক শাসক মোগলদের প্রতি তাঁহাদের আনুগত্য বজায় রাখেন। কেন, না তাঁহারা নাকি মোগল সৈন্য ছিলেন। প্রথম যুদ্ধের পর মোগলের হাতে কোচবিহার গেলে এই সমস্ত অঞ্চলে বসবাস করিতে থাকে মোগল সৈন্যদের কিছু অংশ। মোগল প্রতিনিধি রংপুরের নবাবের নিকট তাঁহারা খাজনা দিতে থাকেন। কোচবিহারের মহারাজা তাঁহার উদারতায় এই বিষয়ে আর দৃকপাত করেন নাই। সামান্য কয়েকটি গ্রাম যদি খাজনা না দেয়, কী যায় আসে। আমাদিগের পূবর্পুরুষ মোগল সৈন্য ছিল কি না জানা নাই, কিন্তু কৃষিই ছিল তাঁহাদের মূল জীবিকা তা আমাদিগের অবগত। স্বাধীনতার পর রংপুরের নবাব যেহেতু পাকিস্তানে মত দান করেন, সেই কারণে ভারতে থাকিয়াও আমরা পাকিস্তানি হইয়া গেলাম। ইহাতে আমাদিগের দোষ কী? আমাদিগের কাহারো কাহারো নিকট রংপুরের নবাবের প্রজা হিসাবে খাজনার রসিদ রইয়াছে সত্য, কিন্তু তাহা স্বাধীনতার আগের কথা। স্বাধীনতার পর আমরা আর খাজনা দিই নাই রংপুরে গিয়া। আমরা কোচবিহার রাজাকেও খাজনা দিতে পারি নাই, কেন না রাজার প্রজার তালিকা হইতে আমরা বাদ ছিলাম সত্য।
মাননীয় জেলা শাসক মহোদয়, আমরা কোচবিহার রাজার রাজত্বের সীমার ভিতর থাকিয়াও কী করিয়া রংপুরের জমিদারের প্রজা হইলাম, তাহা লইয়া বিস্তর গোলযোগ রহিয়াছে। কেন না আমাদের পূবর্পুরুষ যে যুদ্ধ করিতে ভিন দেশ হইতে এদেশে আসিয়াছিলেন, সে বিষয়ে কোনো কথা শোনা যায় না আমাদিগের দাদি বা নানি হইতে, নানা বা দাদা হইতে। বরং আমাদিগের নানি বা দাদি অন্য কথা কহেন, সেই কথা হইল কপালের কথা, ভাগ্যের কথা। শোনা যায় কোচবিহারের মহামান্য মহারাজা এবং রংপুরের নবাবের খেয়ালে ইহা ঘটিয়াছে। আমরা মহামান্য কোচবিহার রাজার প্রজা ছিলাম। আর রাজার প্রজা হিসাবে সুখে দুঃখে দিনপাত করিতাম। রংপুরের নবাব তথা ঢাকার নবাবের সহিত আমাদিগের কোনও সম্পর্ক ছিল না। রংপুর কোথায় তাহা আমাদিগের পূবর্পুরুষ জানিতেন বলিয়া শুনা যায় না। শুনা যায়, রংপুর আর কোচবিহারের দুই ভাগ্য বিধাতা পাশা খেলিতে খুব ভালবাসিতেন। তখন তো ব্রিটিশ শাসন। সে আমলের মতো রাজায় রাজায় যুদ্ধ নাই। ইংল্যান্ডেশ্বরী যাহা কহিবেন, তাহাই হইবে। কিন্তু যুদ্ধে যেমন হয়, এক পক্ষ অন্য পক্ষের ভূমি দখল করে। অন্য পক্ষ তা উদ্ধার করে যুদ্ধ করিয়া। প্রজারা একবার ওপক্ষের দখলে যায়, আবার ফিরিয়া আসে পুরাতন প্রভুর নিকটে। তাহাতে প্রজার জীবন বিড়ম্বিত হইলেও, প্রভুর জীবনে রোমাঞ্চ থাকে। সেই রোমাঞ্চ আর ছিল না তাই তাঁহারা পাশা খেলিতে বসিলেন, দুই ভাগ্য বিধাতা। ভাগ্য বিধাতাই কহিব, তাঁহাদের খেয়ালে আমাদিগের এই ভাগ্য রচিত হইয়াছে।
মাননীয় জেলা শাসক মহোদয়, আপনি কি দ্যূত ক্রীড়া ভালবাসেন? আমরা জানি মহাভারতের যুগে ইহা ছিল বিনোদনের মস্ত উপায়। ইহা তো রাজা-রাজড়ার খেলাই বটে। বাজি রাখিয়া খেলা হয়। মহাভারতে পাশার চালে পাণ্ডবগণ সবর্হারা হন, নিজেদের রাজ্য হারাইয়া স্ত্রী দ্রৌপদীকে বাজি ধরিয়া হারিয়া যান। ভূমি এবং নারী, উভয়ই সম্পদ বলিয়া গণ্য হইত সেই সময়। আর এক্ষণে তাহার ব্যতিক্রম ঘটিয়াছে বলিয়া জানা নাই। শুনা যায়কোনো এক সুফসলের সুভিক্ষার বছরে রংপুরের নবাব কোচবিহার আসেন সৌজন্য সাক্ষাৎকারে। সেই সাক্ষাৎকারের কথা আমাদিগের দাদির মুখে শুনিয়াছি। দাদি কহিতেন, এমনিতে তাঁহারা দুই মহারাজ হইলেও তাঁহারা নিজ নিজ রাজ্য সুখেই রাখিয়াছিলেন। ঢাকার নবাব খাজনা লইতেন রংপুর হইতে। ঢাকার নবাব কর দিতেন মহামান্য মহারানিকে। মহারানির শাসনে তখন এই দেশ। কোচবিহারের রাজাও কর দিতেন মহারানি তথা ব্রিটিশ সম্রাটকে। তখন দুই রাজার ভিতরে যুদ্ধ ছিল না, প্রজার জীবনে অনিশ্চয়তা ছিল না, যুদ্ধে যাইতে হত না ঢাল তলোয়ার লইয়া।
রংপুরের নবাব আসিয়াছিলেন ঘোড়ায়। সঙ্গে কত ঘোড়সওয়ার। কোচবিহার রাজা হাতির পিঠে চাপিয়া তাঁহাকে স্বাগত জানাইয়াছিলেন নিজ রাজধানীতে। তূয, ভেরি বাজিয়াছিল। প্রজারা খুশি হইয়াছিল। রাজ্যে কোনো আড়ম্বর ঘটিলে প্রজাদিগের আনন্দ হইয়া থাকে। তাহাদের ভাগ্যে তখন কিছু জুটিয়া যায়। তখন ছিল শীতকাল। হিমালয় পবর্ত হইতে হিম কুয়াশা নামিয়া আসিত বেলা পড়িতেই। কিন্তু দিনমান ছিল সুন্দর, রৌদ্রকরোজ্জ্বল। আমাদিগের সৌভাগ্য যাইবার পথে এই স্থানে তাঁবু ফেলিয়াছিল নবাবের লোক লস্কর। শোনা যায় লোকলস্কর লইয়া রংপুরের নবাব কোচবিহার রাজার নিকট যাইবার কালে এইখানে গরিব দুঃখীদের অন্ন ও বস্ত্র বিতরণ করিয়াছিলেন। আসলে তিনি পবিত্র রমজান মাস ও ইদল ফেতর শেষ হইবার পর আসিয়াছিলেন। লোকজন দুহাত তুলিয়া আশীবার্দ করিয়াছিল রংপুরের নবাবকে। ইহাতে কি আমাদের মহামান্য প্রভুর মান গিয়াছিল ? কে জানিবে তাহা ? দাদি কহিতেন, সেই সময়ই আমরা রংপুরের প্রজা হইয়া যাই। কী করিয়া তাহা হইল? দুই প্রভুর দেখা হইবার পর তাঁহারা ক’দিন ধরিয়া নাকি পাশা খেলিতে থাকেন। আনন্দ খুব এই খেলায়। ধন-সম্পত্তি, ভূমি ও নারীকে বাজি রাখা যায়। শোনা যায়, কোচবিহারের রাজা এবং রংপুরের জমিদার যুদ্ধ নাই বলিয়া দুঃখ প্রকাশ করিয়াছিলেন পরস্পর পরস্পরের নিকটে। কামান বন্দুকের ব্যবহার নাই, ইহা বড় দুঃখের তাহা বলিয়াছিলেন রংপুরের জমিদার। ইহা শোনা কথা। ইহার কোনো ভিত্তি নাই। কিন্তু দাদি কহিতেন ইহা সত্য হইলেও হইতে পারে। রংপুরের নবাব ঢাকার নবাবের সুরে কহিয়াছিলেন, যুদ্ধ নাই, বড় দুঃখের কথা। যুদ্ধে কত কী ঘটিয়া থাকে, আমার মাটি তুমি দখল করিয়া লও, তোমার মাটি আমি দখল করিয়া লই। উত্তেজনা থাকিবে জীবনে। তাহা আর নাই যখন দুই প্রভু পাশা খেলিতে লাগিলেন। কহিলেন উহাই একমাত্র যুদ্ধের বিকল্প হইতে পারে। পাশা খেলিতে খেলিতে উভয়েই তাহাদের অধীনস্ত মৌজা বাজি ধরিলেন।
রংপুরের নবাব কহিলেনঃ আমি রাখিলাম অঙ্গারপোতা।
কোচবিহারের রাজা কহিলেনঃ আমার বাজি মশালডাঙা।
নবাব কহিলেনঃ দহগ্রাম।
রাজা কহিলেনঃ বাতৃগাছ......
এক প্রকার যুদ্ধের মতো হইলো তাহা। কোচবিহারের রাজার মৌজা রংপুরের নবাব জিতিয়া লইলে, রংপুরের লোকলস্কর ভেরি বাজাইয়া উল্লাস করিল। আকাশের মেঘের দিকে তাক করিয়া গুলি ছুড়িল। শুনা যায় ইহার ফলে সেই শীতকালেও নাকি আকাশের মেঘ ভেদ করে গুলি এবং মশালডাঙায় বজ্রপাতসহ বৃষ্টি নামিয়াছিল। তাহাতে ঘরে আগুন লাগিয়াছিল, মানুষ বজ্রাহত হইয়া মরিয়াছিল, ফসল নষ্ট হইয়াছিল। যুদ্ধে যেমন হইয়া থাকে। ইহার পরে রংপুরের নবাবের মৌজা কোচবিহার-রাজা জিতিয়া লইলেন পাশার মোক্ষম চাল দিয়া। উল্লাসে তিনি আকাশের দিকে নাকি কামান দাগিয়াছিলেন। তাহার ফলে রাজার বাড়ির মাথায়ও নাকি মেঘ ভাঙিয়া পড়িয়াছিল। শীতের তামাক চাষ, সরিষা চাষ নষ্ট হইয়াছিল। নীল আকাশ ফাটিয়া বজ্র নামিয়াছিল। মানুষ হত হইয়াছিল কম নহে। যুদ্ধে তো অমন ঘটিয়া থাকে। মানুষ হত হয়, ফসল নষ্ট নয়। দাদি কহিতেন যে যে মৌজায় অকালে বৃষ্টি নামিয়াছিল, সেই সেই মৌজার ভাগ্য বদল হইয়া গিয়াছিল। ইহার ফলে রংপুরের নবাব তথা ঢাকার নবাবের জমি কোচবিহার রাজা অধিকার করিলেন এবং কোচবিহার রাজার জমি রংপুরের জমিদার অধিকার করিলেন। তবে একটি কথা সত্য, রংপুরের নবাব পাশা খেলায় তেমন কৌশলী না হওয়ার কারণে তিনি পাইলেন কম আর কোচবিহার রাজা পাইলেন বেশি। রংপুরের নবাব সঙ্গে আনিয়াছিলেন গাদা বন্দুক, তাহা আর কতখানি মেঘ ফাটাইতে পারে, তাহার ফলেও তিনি জিতিলেন কম। আর কোচবিহার রাজার জয়ে হস্তির বৃংহিত, অশ্বের হ্রেষা এবং কামানের গুমগুম একই সঙ্গে ধ্বনিত হইতে লাগিল। অকাল বরিষণে মৌজাগুলি ভাসিয়া গেল। তখন অঘ্রাণ মাস। ধান কাটা হইয়াছিল বটে, কিন্তু মাঠের ধান ঘরে আসে নাই। পাকা ধান মাঠেই ঝরিল। চাষীরা কপালে করাঘাত করিয়া কাঁদিতে লাগিল।
মাননীয় জেলা শাসক মহোদয়, ইহা দাদিরা কহিতেন বটে, কিন্তু এও কহিতেন সমস্তটা যে সত্য হইবে এমন নহে। ইহা বদ মানুষের রটনা মাত্র। রাজচন্দ্রে কলঙ্ক স্বরূপ। কিন্তু সেকালে প্রভুরা আকাশের মেঘ ফুটো করিয়া বৃষ্টি নামাইতে পারিতেন ইহা শোনা যায়। দক্ষ বন্দুকবাজ আর কামানবাজ ছিল নবাব আর রাজার হেফাজতে। যাহা হউক, আমাদিগের ভাগ্য সেই পাশা খেলায় নির্ধারণ হইয়া গিয়াছিল। এখন যে আমরা ভারতের ভিতরে বাংলাদেশ হইয়া আছি এবং ওপারে অনেক মৌজা বাংলাদেশের ভিতরে ভারত হইয়া রহিয়াছে, তাহার কারণ সেই সেই বন্দুক এবং কামানের উল্লাস। অশ্বের হ্রেষা ও হস্তির বৃংহিত। তাঁহাদের সেই খেলা খেলা যুদ্ধে আমাদের কপাল পুড়িল।
মাননীয় মহোদয়, আমাদিগের দেশ নাই। দেশ নাই তাই কিছুই নাই। হাসপাতাল, ইস্কুল, ব্লক আপিস, পঞ্চায়েত, থানা, চৌকি, রেশন কার্ড, ইলেকট্রিক, জল কিছুই নাই। মোবাইলের সিমও নাই। ফলে গ্রাম হইতে বাহিরে ইন্ডিয়া গেলে ভয় হয় কখন অনুপ্রবেশের দায়ে ধরা পড়ি। অথচ আমরা তো ইন্ডিয়াই হইতাম, ভাগ্যের ফেরে হই নাই। অকাল বৃষ্টি আমাদিগে এই করিয়াছে। ইন্ডিয়ার ইস্কুল কলেজে পড়ার কোনো উপায় নাই মিথ্যা পরিচয় গ্রহণ করা ব্যতীত। ছিটমহলের কন্যার জন্য ইন্ডিয়া বা বাংলাদেশ, কোথাও পাত্র পাইবার উপায় নাই। ছিটমহলের পাত্রকে কেহ কন্যাদান করিতে চাহে না। যাহার কোনো দেশ নাই, তাহার চালও নাই, চুলাও নাই, তাহাদের মাথার আকাশ ফুটা হইয়াই আছে, ফলে গ্রীষ্মে প্রখর রৌদ্র, বর্ষায় প্রবল ধারাপাত হইয়াই থাকে। জানি দেশ পাইলে ইহা আর থাকিবে না। অনাথের নাথ হইবে।
আমাদিগের পাশের গ্রাম মদনাগুড়ির সব রহিয়াছে। সেই যুদ্ধের সময় মদনাগুড়ির আকাশ ভেঙে অকাল বৃষ্টি হয় নাই। তাই ফসলও মরে নাই। এখন মদনাগুড়ি যাইতে বাতৃগাছ পার হইতে হইবে। বাতৃগাছ বাংলাদেশ, মদনাগুড়ি ইন্ডিয়া। তাহার পাশে সিঙিমারি নদী ইন্ডিয়া। নদী লইয়া বাজি ধরেন নাই প্রভুগণ। কেন না নদীর ভিতরে প্রজা নাই। খাজনা দিবে কোনজন? মানুষ সমেত গ্রাম হস্তান্তরে সুখ অনেক।
অভিযোগ এই যে গত দুই সপ্তাহ আগে তিন ব্যক্তি আসে এখানে মোটর সাইকেলে করিয়া। তাহারা ইন্ডিয়ার বাসিন্দা। দিনহাটায় ঘর। তাহারা অপরাহ্ণবেলায় সঙ্গে করিয়া একটি তরুণীকে লইয়া আসিয়াছিল ঘোমটায় মুখ ঢাকিয়া। সে কাঁদিতেছিল বিন বিন করিয়া। কী করিয়া আনিল কে বলিবে? পুলিশ সীমান্তরক্ষী থাকিতেও ইহা হইয়া থাকে। আমরা সেই তরুণীর মুখ তখন দেখি নাই। তাহারা গ্রামে পৌঁছিয়াই ফসলের ক্ষেতের দিকে চলিতে লাগিল। একজন পকেট হইতে চীনা পিস্তল বাহির করিয়া নির্মেঘ আকাশের দিকে তাক করিয়া গুড়ুম করিল। ইহাতে আমাদিগের বুক হিম হইয়া গেল। দাদি নানিরা ভয়ে কাঁদিয়া উঠিল। যুবতীরা ঘরের কোনে গিয়া আত্মগোপন করিল। পুরুষেরা কপাল চাপড়াইতে লাগিল। আবার যুদ্ধ, মানুষ মরিবে বজ্রাঘাতে। অকাল বৃষ্টি নামিল প্রায়। মেঘ ফুটো হয়ে গেছে নিশ্চিত। ফসল আর থাকিবে না।
ক্রমে অন্ধকার নামিল। মাঠ হইতে স্ত্রী কন্ঠের আর্তনাদ শুনা গেল একবার। তারপর সব চুপ। পরদিন ভোর বেলায় আমরা এক তরুণীকে দেখি ছিন্নভিন্ন অবস্থায় ক্ষেতের ভিতর পড়িয়া রহিয়াছে। তাহাকে যে তিন ব্যক্তি অপহরণ করিয়া আমাদের ছিটমহলের গ্রামে আনিয়াছিল। সমস্ত রাত ধরিয়া ধর্ষণ করিয়া অতঃপর হত্যা করিয়া মধ্য রাতে চলিয়া যায় তিনটি মোটর সাইকেলে। মহাশয়, এই ঘটনা ঘটিবার পর আমরা চারদিন ধরিয়া দেখিলাম সেই লাশ পচিতে লাগিল, খবর গেল কিন্তু ইন্ডিয়া ঢুকিতে পারিল না বাংলাদেশে। ইহা আপনার সম্পূর্ণ জ্ঞাত রহিয়াছে যে শেষ পযর্ন্ত বাংলাদেশের পুলিশ ও কর্তাব্যক্তিদের লইয়া ইন্ডিয়ার পুলিশ ভিতরে আসিয়া লাশ লইয়া গেল। এবং সঙ্গে লইয়া গেল ছিটের নিরীহ তিন যুবক, নইম, রহিম, আর মইনকে। তাহাদের বর্ডারের নিকট অবধি লইয়া গিয়া কী মনে হওয়ায় ছাড়িয়া দিতে ইন্ডিয়ার পুলিশ ধরিল অনুপ্রবেশকারী হিসাবে। তাহারা কী করিল যে আলিপুরদুয়ার জেলখানায় বন্দী রহিল? ইহার সাতদিন পর দুই ব্যক্তি আসিয়া শাসাইয়া গেল, যদি কিছু বলি কাহাকেও, গ্রামে আগুন দিয়া ঘর পুড়াইয়া দিবে। ‘ডবকা মেয়েছেলে’ যা আছে কেউ রক্ষা পাবে না। তুলে নিয়ে যাবে অন্য ছিটে। ইতিমধ্যে সেই লাশ বাংলাদেশ ইন্ডিয়াকে দিয়া গিয়াছে কেন না সেই তরুণী ভারতেরই। আগের দিন হইতে উধাও হইয়াছিল। যেহেতু ঘটনাটি বাংলাদেশ ছিটে ঘটিয়াছে বিচার বাংলাদেশের আদালতে হইবে। অপরাধী যেহেতু ইন্ডিয়ার অথবা বাংলাদেশের তা পরিষ্কার ভাবে জানা যায় না, সেই কারণে বিচারের বানী নীরবে নিভৃতে কাঁদিবে।
মাননীয় জেলা শাসক মহোদয়, সেই তরুণীর পিতা নীলকন্ঠ আঁধিয়ার একদিন আমাদের গ্রামে আসিয়া কাঁদিতে লাগিল। বলিতে লাগিল, ইহা যদি ইন্ডিয়া হইতো, তবে বিচার ইন্ডিয়ায় হইত। ইহা যদি ইন্ডিয়া হইত, তবে তাহারা এইখানে আসিয়া পরম নিশ্চিন্তে মেয়েটিকে ধর্ষণ ও হত্যা করিতে পারিত না। পুলিশ খবর পেয়েছিল মেয়েটিকে নিয়ে দুষ্কৃতিরা ছিট বাতৃগাছ এ প্রবেশ করেছে। কিন্তু ছিটমহল যেহেতু বাংলাদেশ, অন্য রাষ্ট্র, পুলিশ প্রবেশ করিতে সাহস পায় নাই। ছিটে প্রবেশ করা পুলিশকে যদি হত্যা করে কেহ, ইন্ডিয়ার পুলিশ কিছু করিতে পারিবে না ভিন্ন রাষ্ট্র বলিয়া। অথচ আমাদিগের রাষ্ট্র কোথায় ? আমাদিগের না আছে ইন্ডিয়া, না আছে বাংলাদেশ। শঙ্কিত হইয়া আছি কবে তাহারা আসিয়া আমাদের ঘর পুড়াইয়া স্ত্রী ধন লুট করিয়া আর এক ছিটে প্রবেশ করে। নীলকন্ঠ রাজবংশী এখন ছিট বাতৃগাছ ছাড়িয়া যাইতে চাহে না। ইন্ডিয়ার লোক তাহার ভোটার কার্ড পরিচয়পত্র নিজ দেশে রাখিয়া বাংলাদেশে প্রবেশ করিয়াছে। মা মরা মেয়েটির জন্য রোদন করে। তাহার সহিত আমাদিগের বিবি ও মেয়েরাও রোদন করে। আপনি আসিয়া দেখিয়া যান পুরাকালের নকল যুদ্ধ, পাশাখেলার যুদ্ধের পরিণাম কী? কুরুক্ষেত্রে আঠারো দিনের যুদ্ধের পর যে ক্রন্দনধ্বনি শুনিয়াছিল জগতবাসী, তাই শুনিতেছে ছিটের মানুষ।
অতএব মহোদয়, আপনি বিবেচনা করিয়া সিদ্ধান্ত লইয়া আমাদিগের ক্লেশ দূর করিবেন সেই আশায় এই পত্র লিখন। পুরাকালে যে যুদ্ধ, না যুদ্ধের মহড়া, না নকল যুদ্ধ, না কি শুধুই আনন্দ প্রকাশের জন্য আকাশের মেঘ ভাঙা হইয়াছিল কামান বন্দুকে তাহা জানা নাই, কিন্তু আমাদিগের নিকট তাহা অনন্ত এক যুদ্ধক্ষেত্র দিয়া গিয়াছে তাহা বলিবার অপেক্ষা রাখে না সত্য।
নমস্কার লইবেন।
ইতি
মনসুর মিঞা, হাতেম মিঞা, কোরবান আলি ইত্যাদি ও নীলকন্ঠ রাজবংশী। সাকিন ছিট বাতৃগাছ, মুনসির ছিট, মশালডাঙা.........।
# # # #
পুনশ্চ নিবেদন এই যে, সেই ব্যক্তি নীলকন্ঠ আঁধিয়ার সেই গ্রামেই রয়ে গেছে। তাহার ভারতীয় ভোটার কার্ড, রেশন কার্ড সব ভারতেই রয়ে গেছে। মেয়ে মরেছে যেখানে সেখানে সে পরিচয়হীন হয়েই মরবে। মরবেই। সে জানে সেই ধর্ষক তিন ব্যক্তি আসিয়া তাহাকে হত্যা করিয়া যাইবে একদিন না একদিন। কেন না সে হত্যাকারীদের চেনে। আর নীলকন্ঠ আঁধিয়ার হত হইলে সেই চারদিন ধরিয়া তাহার লাশও পচিবে এখানে। সে তো ইন্ডিয়ার লোক, কিন্তু বাংলাদেশে যাইয়া মরিবার অধিকার তাহার আছে কি? স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক, বিদেশ মন্ত্রক ইহাতে মত দান করিবে জানি, কিন্তু আমাদিগের নিকট এই বিষয়ে আপনার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত হইবে। আমরা সেই সিদ্ধান্তের জন্যই অপেক্ষা করিতে থাকিব, এত বছর তো অপেক্ষাই করিলাম। নীলকন্ঠের অপেক্ষা আরম্ভ হইল সবে। নিবির্ঘ্নে হত হইবার জন্যই সে দেশহীন হইয়াছে।