মহর্ষি বৈশম্পায়নের আশ্রমটি বড় মনোহর। তপ্ত দ্বিপ্রহরেও রবিকরনিদাঘের লেশমাত্র অনুভূত হয় না, সর্বত্র মৃদুমন্দ ঈষদুষ্ণ সমীরণ বহিয়া যাইতেছে, তাহাতে শীতলবোধ না হউক, গাত্রে ঘর্ম বসিতে দেয় না। অনতিদূরে শীর্ণকায়া নদী সুমধুর ছলছল শব্দে বহিয়া যাইতেছে। রাজা জনমেজয় যখন আশ্রমের দ্বারে আসিয়া উপনীত হইলেন, তখন তাপকাতর পাখিদের কলকাকলিতে বিন্দুমাত্র বিচলিত না হইয়া মহর্ষি বৈশম্পায়ন আশ্রমের প্রাঙ্গণে একমনে বসিয়া একটি পুরাতন বাঙ্গালা কিতাব পঠনে নিমগ্ন ছিলেন। রাজা ঋষির সম্মুখে আসিয়া নত হইয়া নমস্কার জানাইলেন। ঋষি কিতাব হইতে চক্ষু সরাইয়া মধুর হাসিয়া রাজাকে সম্ভাষণপুর্বক স্বাগত জানাইলেন। অপরূপা আশ্রমবালিকা আসিয়া রাজার নিমিত্ত আসন, পানীয় এবং মিষ্টান্নাদি আনিয়া দিয়া, তৎক্ষণাৎ আশ্রমাভ্যন্তরে অন্তর্হিত হইল।
রাজা আলাপ শুরু করিলেন ঋষির সঙ্গে।
- বলুন রাজন, কী সংবাদ?
- হে ঋষিবর, রাজজ্যোতিষীর মুখে এক নতুন উপযুগের খবর শুনলাম। শুনে অবধি মন বড় কূতুহলী হয়ে আছে। তাই ছুটে এলাম আপনার কাছে।
- উপযুগ? সে কোন যুগের অন্তর্গত, রাজন?
জনমেজয় গেলাস হইতে শেষ বারিবিন্দুটুকু নিঃশেষিত করিয়া বলিলেন - কলিযুগের উপান্তে এক উপযুগের সূচনার কথা বলেছেন জ্যোতিষী। সে যুগের নাম নাকি "আচ্ছে দিন"। বোধ করি পাপাবৃত অন্ধকার যুগের শেষভাগে নতুন করে শুভদিনের সূচনার কোনও ইঙ্গিত দিয়েছেন তিনি। আপনি ভবিষ্যৎদ্রষ্টা ঋষিশ্রেষ্ঠ, আপনি বলুন, এই উপযুগ সম্বন্ধে আপনি কী জানেন।
ইঙ্গিত পাইবামাত্র মহর্ষি বৈশম্পায়নের মুখমণ্ডল উদ্ভাসিত হইয়া উঠিল, কিয়ৎকাল নিকটস্থ আম্রবৃক্ষের শাখায় পাকিয়া ওঠা একজোড়া পীতাভ আম্রের দিকে অন্যমনস্ক দৃষ্টিপাত করিয়া, ধীরে ধীরে ঋষি শুরু করিলেন আচ্ছে দিনের জয়গাথা।
- জ্যোতিষী তোমায় সঠিক সন্ধানই দিয়েছেন, রাজন। এই যুগের সূচনা কলিযুগের উপান্তেই বটে। সসাগরা এই জম্বুদ্বীপ তৎপূর্বে গান্ধী রাজবংশের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ নামক যৌথবাহিনীর শাসনাধীন থাকবে দীর্ঘ দশ বৎসর। এই সময়কালে জম্বুদ্বীপে অন্যায় অত্যাচার পাপ বিকৃতাচারের সীমা থাকবে না। প্রজাকূল অতিষ্ঠ হয়ে উঠবে দিনে দিনে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির দাম হু-হু করে বাড়তে থাকবে, কিন্তু রাজা বা মন্ত্রীরা এই বিষয়ে সম্পূর্ণ নির্মোহ হয়ে থাকবেন। স্থানে স্থানে বিক্ষোভের সূচনা হবে। রাজার প্রধান অমাত্য, দৈনিক সপ্তবিংশতি মুদ্রার অধিক ব্যয় করতে সক্ষম এমন প্রজাকে দরিদ্র বলে মানতে রাজি হতেন না, অষ্টবিংশতি মুদ্রা উপার্জন করলেও সে হতভাগ্যের দারিদ্র্যহেতু রাজানুগ্রহ লাভের সুযোগ থাকবে না, যদিও বিদেশি কোষাগারে রাজা-মন্ত্রী অমাত্যদের নামে ও বেনামে অর্বুদ পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা সঞ্চিত থাকবে, তবু তার কিঞ্চিত ছিটেফোঁটাও হতভাগ্য প্রজাদের কল্যাণের কাজে বর্ষিত হবে না। দেশপ্রেমী বণিকের দল দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ লুন্ঠন করে দেশহিতার্থে কারখানা ও নিজহিতার্থে ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স বাড়াতে প্রবৃত্ত হলে জম্বুদ্বীপের সর্বোচ্চ ন্যায়ালয় তাদের ভর্ৎসনা করবে, দেশের বাণিজ্যবিস্তার ব্যাহত করবে।
হে রাজন, এই ঘোর দুঃসময়ে, যখন পাশ্চাত্য শিক্ষা সংস্কৃতির প্রভাবে স্বদেশী ধ্যানধারণার জলাঞ্জলী ঘটবে, পাশ্চাত্য কুশিক্ষার প্রভাবে কিছু মানুষ সমকামী, লিঙ্গান্তরকামী প্রভৃতি বিকৃতরুচির অমানুষদের সমাজের মূলস্রোতে আনবার কুচেষ্টায় রত হবে, তখন, তখন সূচনা হবে এই আচ্ছে দিন উপযুগের।
হে মহারাজ, এই যুগের উত্থান ঘটবে গুর্জর প্রদেশে এক অতিপ্রতিভাশালী এবং শক্তিশালী নেতার হাত ধরে। এই নেতা শৈশবে দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করলেও পরে সন্ন্যাস সংকল্প করবেন, কিন্তু হালে পানি না পাওয়ায় অতঃপর তিনি হিন্দু রাজনীতিতে যোগদান করবেন। জম্বুদ্বীপ সাধারণ অর্থে ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হিসেবে ভুবনে পরিচিত হলেও এই হিন্দু রাজনীতির নেতারা জম্বুদ্বীপকে হিন্দুপ্রধান দেশ বলে মনে করবেন, হিন্দু ব্যতীত অন্য ধর্মের মানুষদের এঁরা তৃণাদপি তুচ্ছ জ্ঞান করবেন। ম্লেচ্ছজাতির গণকমান অনুযায়ী বিংশ শতকের শেষভাগে এই নেতার মনে হিন্দুভাব প্রকট হয়ে ওঠে এবং নিজ প্রদেশকে যবনমুক্ত করবার জন্য কিছু নিরপরাধ হিন্দুর শোচনীয় মৃত্যুর দায় তিনি যবনজাতির উপর চাপিয়ে দেবেন এবং হাজারে হাজারে যবনপুত্রকন্যাকে তাঁর অনুগামীরা বিবিধ উপায়ে আহত, নিহত, ধর্ষণ এবং গণধর্ষণ করে দীর্ঘকালের জন্য একেবারে চুপ করিয়ে দিতে সক্ষম হবেন।
হে রাজন, এর পরেই হিন্দু সমাজে এই ধর্মনিষ্ঠ হিন্দুনেতার জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকবে এবং একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে বিপুল জনসমর্থনের উপর ভিত্তি করে, সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এই প্রবলপ্রতাপশালী নেতা আচ্ছে দিনের সূচনা করবেন। জম্বুদ্বীপ নতুন পথের দিশা পাবে। সম্পূর্ণ হিন্দুমতে, হিন্দুপথে।
বৈশম্পায়ন থামিলেন। শ্মশ্রুগুম্ফের অন্তরাল হইতে এক পলকের স্মিতহাস্য দেখা দিয়াই চকিতে মিলাইয়া গেল, তিনি দেখিলেন, রাজা জনমেজয় তদ্গত চিত্তে আচ্ছে দিনের উত্থানকাহিনী শ্রবণ করিতেছেন। কিয়ৎক্ষণ পরে, সম্বিৎ ফিরিলে রাজা পুনরায় যুক্তকরে ঋষিকে শুধাইলেন - অপূর্ব্ব! হে রাজন, আমি মুগ্ধ, বাক্রহিত। কলিযুগের ধর্মহীন অন্ধকার কাল কেটে গিয়ে কি এর পরে সত্যই হিন্দুধর্ম আপন মহিমায় ভাস্বর হয়ে উঠবে এই মহাপুরুষের নেতৃত্বে?
কর্ণপটাহের প্রান্ত হইতে একটি পক্ককেশ উৎপাটন করিয়া বৈশম্পায়ন কহিলেন, - উঠবে বৈকি, হে রাজন! যুগের ভেতর এ এক নবযুগের সূচনা হবে। আচ্ছে দিনের বিরুদ্ধে যে সকল প্রজা বা প্রজাগোষ্ঠী বিন্দুমাত্র সন্দেহপোষণ করবেন, তাঁদের বলপূর্বক পার্শ্ববর্তী শত্রুদেশে স্থানান্তরিত করবার পরামর্শও দেবেন কিছু অমাত্য; হিন্দুযুগের পুনরুত্থানের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াক, এমন কিছুই সইতে তাঁরা রাজি থাকবেন না। এক খ্যাতনামা দ্রাবিড়দেশজ লেখক এই হিন্দুনেতার দ্রুত উত্থানে আশঙ্কিত হবেন, তাঁর নেতৃত্বের বিরুদ্ধে উষ্মা প্রকাশ করবেন তাঁর লেখনীতে, অতঃপর তাঁর বাটিকার চতুর্পার্শ্বে হিন্দুনেতার অনুগামীরা জমায়েত হয়ে তাঁকে যৎপরোনাস্তি ভর্ৎসনা করবে। উষ্মা প্রকাশ করবেন আরও অনেকে, এক খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ, এক প্রখ্যাত চিন্তাবিদ দার্শনিক, ভাগ্যক্রমে তাঁরা জম্বুদ্বীপের বাসিন্দা না হওয়ায় তাঁদের শত্রুদেশে পুনর্বাসনের চেষ্টা কেউ করবেন না।
- অতঃপর ঋষিবর? হিন্দুত্বের নির্বিরোধ জয়যাত্রা?
- নির্বিরোধ। দ্যাট ইজ দা ওয়ার্ড, হে রাজন, অতঃপর, শিক্ষানীতি, স্বাস্থ্যনীতি, অর্থনীতি, এবং সর্বোপরি রাজনীতি, সব কিছুই নির্ধারিত হবে হিন্দুত্বের আলোকে। গুর্জর প্রদেশ, পূর্বতন শতাব্দীর ন্যায় এই শতাব্দীতেও এই সংক্রান্ত পরীক্ষার পরীক্ষাগার হিসেবে চিহ্নিত হবে।
- হে মহর্ষি, দয়া করে পরীক্ষার প্রকার বিস্তার করুন।
- হে রাজন, শুনুন তবে। জম্বুদ্বীপের দায়িত্ব পেয়ে হিন্দুনেতা তাঁর দলকে নির্দেশ দেবেন শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর। সেই অনুযায়ী গুর্জর প্রদেশের বিদ্যালয়ে বিদ্যালয়ে বিনামূল্যে বিতরিত হবে নয়খানি কিতাব। শিশুমানসে ধর্মভাব জাগিয়ে তোলার উদ্দেশ্যে। এই কিতাবে বিরচিত হবে কীরূপে গো-সেবা করলে পুত্রহীন মাতার গর্ভে পুত্রোৎপাদন হতে পারে ...
- গো-সেবা করলে? কিন্তু হে ঋষি, পুত্রহীনতার চিকিৎসা তো ...
- রাজন, আপনি কলিযুগের প্রাক্কালে এসে পৌঁছেছেন, তাই সনাতন হিন্দুধর্মের অ্যানেকডোট অপেক্ষা আপনার পাশ্চাত্য ব্যাখ্যা বেশি যুক্তিগ্রাহ্য মনে হচ্ছে, কলিযুগের করাল কালো ছায়া আপনার দৃষ্টিপথকে আবৃত করছে, আপনি বুঝতে পারছেন না ...
- ক্ষমা করবেন প্রভু, আমি অকারণে সন্দেহ প্রকাশ করে অন্যায় করেছি, আপনি বিধৃত করুন।
- গো-সেবার পুণ্য নিঃসন্তান দম্পতিকে সন্তান ধারণের ক্ষমতা জোগায়, শিক্ষককে প্রফেসর না বলে আচার্য বললে শিক্ষককে প্রকৃত সম্মান দেওয়া হয়, জম্বুদ্বীপের অধীশ্বর হিন্দুনেতা বাল্যকালে জঙ্গলের আড়াল থেকে মারুতি হনুমানের দর্শন পেয়েছিলেন, পবিত্র এই সমস্ত কথাকাহিনীর মাধ্যমে সুকুমারমতি বালকবালিকাদের মনে হিন্দুত্বের স্ফুরণ ঘটাতে সাহায্য করবে এই সকল কিতাব। দীনানাথ বাত্রা নাম্নী এক বর্ণহিন্দু আচার্য এই সমস্ত মহান কিতাব লিখে এবং বিদ্যালয়ে বিদ্যালয়ে বিতরণ করে আচ্ছে দিন আনতে সাহায্য করবেন।
হে রাজন, আচ্ছে দিন আসবার বহু পূর্ব থেকেই জম্বুদ্বীপের প্রজামাত্রে জানবেন, গুর্জর প্রদেশের সবকিছু ভালো। হিন্দুনেতার পূর্বতন সুশাসনকালের প্রভাবে গুর্জরপ্রদেশব্যাপী রাজপথ অতি মসৃণ, মনোহর, গুর্জর গ্রামগুলি রূপকথার ছবির মত, গুর্জর বণিকরা দেশের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ, নিজ মুনাফার পাশাপাশি তাঁরা অতিমাত্রায় ধর্ম ও দেশপ্রেমীও বটে, গুর্জর প্রশাসন প্রজাহিতে সদাসচেষ্ট, অন্যত্র অন্যরাজ্যে কুরাজনীতির প্রভাবে গাড়িকারখানার প্রস্তাবের অকালমৃত্যু ঘটলে, তা গুর্জর দেশে এসে নবজীবন লাভ করবে, গুর্জরদেশে দারিদ্র্য নেই, লোডশেডিং নেই, সিন্ধুঘোটক নেই, মানে এক কথায় ত্রেতাযুগে ভগবান শ্রীরামচন্দ্রের অযোধ্যাশাসনকাল যেরূপে সম্পূর্ণ সুচারু, বিরোধীহীন এবং ত্রুটিহীন ছিল, কলিযুগে গুর্জর শাসনকাল তদপেক্ষা ত্রুটিহীন হবে। রাজানুগ্রহ লাভ করা কৃতবিদ্য অর্থনীতিবিদরা এর নাম দেবেন গুজরাত মডেল।
রাজা জনমেজয় যত শুনিতেছিলেন, উত্তরোত্তর সম্মোহিত হইয়া যাইতেছিলেন। স্নানান্তে অপরূপা আশ্রমবালিকা প্রাঙ্গণের শিউলিশাখায় গামছা মেলিতেছিলেন, রাজা সেই স্নিগ্ধ রূপের দিকে বিন্দুমাত্র না চাহিয়া, আবেগরুদ্ধ কণ্ঠে ঋষিপ্রবরকে কহিলেন, - হে ঋষি, আরও বলুন আমাকে গুজরাত মডেল সম্পর্কে।
- তবে শুনুন, হে রাজন, গণতান্ত্রিক নির্বাচনপ্রক্রিয়ার পূর্বে, স্থানে স্থানে জনসভা করে নমো জম্বুদ্বীপবাসীদের জানাবেন, দ্বীপবাসীরা যদি গান্ধীসাম্রাজ্যের পতন ঘটিয়ে তাঁকে এই সুবিশাল রাষ্ট্রের একচ্ছত্র রাজচক্রবর্তী বানান, তবে তিনি সমগ্র জম্বুদ্বীপে এই গুজরাত মডেলের ইমপ্লিমেন্টেশন ঘটাবেন। অতঃপর সসাগরা এই রাষ্ট্রে সর্বত্র রাজপথ হবে মসৃণ, কোনও স্টেশনে ট্রেন লেট করবে না, দৈনন্দিন দ্রব্যাদি এবং ইন্ধন তেলের দাম বাড়বে না, দ্বীপবাসীরা লোডশেডিং ভুলে যাবেন, অন্যায় অত্যাচার সব অতীতের দুঃস্বপ্ন হয়ে দেশে সত্যিকারের সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে।
- ঋষিপ্রবর, নমো কে? ইনিই কি সেই মহান ...
- আপনার অনুমান নির্ভুল, হে রাজন। ... যা বলছিলাম, অভ্যুত্থানের পূর্বে এমত প্রতিশ্রুতিতে তিনি ভরিয়ে ফেলবেন জম্বুদ্বীপের সমস্ত অধিবাসীর কর্ণকুহর, রাজপথের পার্শ্বে প্রতিটি বিলবোর্ড, নাগরিকদের ক্ষুদ্রদূরভাষে মেসেজের পর মেসেজ আসতে থাকবে, আচ্ছে দিন আনেওয়ালে হ্যায়। বিরোধীদের কণ্ঠস্বর ক্ষীণ হতে ক্ষীণতর হতে থাকবে, নগরপ্রান্তের ভিক্ষুক হতে গগনচুম্বী কর্মশালার আইটি প্রো সকলে একবাক্যে সমস্বরে বলে উঠবে, আমরা নমো চাই, গান্ধী রাজবংশের অবসান চাই। সে সমবেত গর্জনে বঙ্গোপসাগরের কিছু জল ছল্কে ভারত মহাসাগরে মিশে যাবে, স্বয়ং মহর্ষি অগস্ত্য সেই বিপুল জলোচ্ছ্বাস দেখলে ভয় পেতেন।
জনমেজয় রোমাঞ্চিত হইলেন সে সুবিশাল জনজোয়ার কল্পনা করিয়া। এতক্ষণে দ্বিপ্রহরের নিদাঘ প্রশমিত হইয়া আসিয়াছে, প্রচ্ছায়ারা দীর্ঘতর হইতেছে। সে দিকে দৃক্পাত না করিয়া বৈশম্পায়ন বলিতে লাগিলেন, - নির্বাচিত হবেন গুর্জরহৃদয়াধিপতি। সসাগরা জম্বুদ্বীপের অধীশ্বর হবেন। প্রজাকূল আচ্ছে দিনের স্বপ্ন দেখবার প্রত্যাশায় ঘুমোতে যাবে। সেই অবসরে হিন্দুহৃদয়সম্রাট তাঁর পাত্রমিত্রঅমাত্য বেছে রাজদরবার বসাবেন। রাজপুতানার এক অমাত্য বলবেন, সমকামিতা পশ্চিমী বিকৃতি, জম্বুদ্বীপে এসব ধারণাপ্রশ্রয় দেওয়া ঠিক হবে না। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলবেন, যৌনরোগ ঠেকাতে জন্মনিরোধক নয়, প্রয়োজন দেশজ সংযমের মূল্যবোধ। অর্থমন্ত্রী বাষ্পশকটের ভাড়া চতুর্দশ শতাংশ বাড়িয়ে দেবেন, কিন্তু দূরগামী শকটে যাত্রীদের প্রদেয় খাবারের মানে কোনওরূপ পরিবর্তন ঘটবে না। যাত্রীরা প্রধান শকটে ইন্টারনেট পাবেন, পরিবর্তে খাদ্যদ্রব্য পচা মিললেও মিলতে পারে। আচ্ছে দিনের উদাহরণস্বরূপ একদিন তিনি জানিয়েছিলেন, অধিপতি হলে তিনি ইউপিএ যৌথবাহিনীর বিভিন্ন কূলপতির বিদেশী কোষাগারে সঞ্চিত অবৈধ ধনরত্ন উদ্ধার করে আনবেন, সে প্রতিশ্রুতি তিনি নিজেই ভুলে যাবেন, কারণ আচ্ছে দিন আনবার সংকল্পে এর থেকেও গুরুত্বপূর্ণ কাজ তাঁকে করে যেতে হবে।
হে রাজন, মণিমুক্তাখচিত তাঁর পারিষদরা জম্বুদ্বীপকে হিন্দু সংস্কৃতিতে উত্তমরূপে ধৌত করবার লক্ষ্যে অবিচল থাকবেন। কোঙ্কনপ্রদেশের মহামাত্য জানাবেন, মহামান্য অধিপতি জম্বুদ্বীপকে হিন্দুরাষ্ট্রে পরিবর্তিত করবার লক্ষ্যে দিবারাত্র পরিশ্রম করে চলেছেন। অপর মহামাত্য জানাবেন, লক্ষ্যে সকলেই উপনীত। জম্বুদ্বীপ শুরু থেকেই হিন্দুরাষ্ট্র, এখানকার ম্লেচ্ছরা হিন্দুম্লেচ্ছ, এখানকার যবনরা হিন্দু-যবন। এ রাষ্ট্রের বাতাস হিন্দু-বাতাস, এ দেশের জল হবে হিন্দুবারি। হিন্দুমহাগোষ্ঠীর এক শিবাসদৃশ নেতা জম্বুদ্বীপের যবনদের মনে করিয়ে দেবেন একদিন কেমন করে গুর্জরপ্রদেশকে যবনশূন্য করবার প্রচেষ্টা হয়েছিল - যবনরা যেন সে কথা ভুলে না যান, ভুলে গেলে তাঁদের মনে করিয়ে দেবার জন্য অনুরূপ ঘটনা ঘটানো হয়েছে আচ্ছে দিন আসবার কিয়ৎদিন আগেই - উত্তর প্রদেশের মুজফফরনগর জনপদে। অতএব, সমগ্র জম্বুদ্বীপের যবনেরা যেন অবিলম্বে হিন্দুত্বে সাবস্ক্রাইব করে, গুজরাত মডেলের নামে জয়ধ্বনি করে।
হে রাজন, মুজফফরনগরে কতিপয় যবন নারী হিন্দুত্বের নামে জয়ধ্বনি না দেবার কারণে প্রবলভাবে লাঞ্ছিত হবেন, তাঁদের নিকটজনদের হত্যা করা হবে, কিন্তু লাঞ্ছনাকারী বা হত্যাকারীদের ধৃত করতে বা শাস্তিপ্রদান করতে কেউই উদ্যোগী হবে না, কারণ সবাই জানবে, তারা হিন্দুত্বের প্রসার ঘটানোর কারণেই বাধ্য হয়েছিল সেই যবনদের হত্যা করতে, নারীদের তুমুল লাঞ্ছনা করতে। হিন্দুত্বের প্রসারণের জন্য এটুকু অপরাধ কোল্যাটেরাল ড্যামেজ হিসেবে ক্ষমার্হ হবে। যাবনিক ধর্ম অনুযায়ী একমাসব্যাপী দিবাকালীন ধর্মীয় উপবাসকালে এক যবনের মুখে খাদ্যদ্রব্য ঠেসে ঢুকিয়ে দেবেন এক উগ্রহিন্দু নেতা। নিন্দুকেরা নিন্দা করবে, কিন্তু গোষ্ঠীর অভ্যন্তরে বিপুলভাবে সমর্থিত হবেন সেই নেতা। হিন্দুধর্মের মাহাত্ম্য সম্বন্ধে যারাই অবহিত, তারাই জানবে, এইভাবে যবনদের লাঞ্ছনা করার নির্দেশ স্বয়ং শ্রীরামচন্দ্র দিয়ে গেছেন।
এইরূপে, হে রাজন, ঘটনা হতে ঘটনান্তরে আচ্ছে দিনের প্রতিচ্ছায়া দেখা যেতে থাকবে। এর মাঝে অবশ্য ইন্ধন তেল, বিলাইতি বেগুন, পেঁয়াজ ইত্যাদি দ্রব্যের দাম বাড়বে এবং জম্বুদ্বীপ-অধিপতির সুচতুর অর্থমন্ত্রী জনগণকে বুঝাতে সক্ষম হবেন যে দীর্ঘকালীন আচ্ছে দিনের প্রত্যাশায় সাময়িকভাবে কিছু তিক্ত ঔষধ খেতে হতে পারে দেশবাসীকে। এই মূল্যবৃদ্ধি সেই তিক্ত ঔষধস্বরূপ। স্বয়ং ভগবান শ্রীশ্রীমদ্ভগবত গীতায় বলে গেছেন, তিক্তং আশুফলপ্রদং। জনগণ যত বেশিমাত্রায় তিক্ত ঔষধ খাবে, আচ্ছে দিন তত তাড়াতাড়ি আসবে।
আচ্ছে দিনের সুখস্বপ্নে মোহাবিষ্ট হয়ে, হে রাজন, প্রজাকূল নিজ নিজ ঘরে ফিরে যাবেন, অর্থমন্ত্রী বিপুল কর্মের বোঝা অর্ধসমাপ্ত করে বিলেতদেশে ছুটি কাটাতে যাবেন। কেবল দিনান্তে দু একজন ব্যাদড়া নাগরিকের মনে পড়িবে, আগের রাজার রাজত্বেও একই কথা বলা হত দ্রব্যসামগ্রীর দাম বাড়ার পরে, কেবল তখন 'আচ্ছে দিন'এর পরিবর্তে 'বেটার ডেজ' বলা হয়ে থাকত। সন্দেহের অবকাশ থাকবে না, তদপেক্ষা আচ্ছে দিন অধিক শক্তিশালী এবং আশু ফলপ্রদ।
ভবিষ্যৎদ্রষ্টা ঋষির সুবচনে রাজা জনমেজয় এরূপ মোহিত হইয়া পড়িয়াছিলেন, কখন সন্ধ্যা নামিয়া গিয়াছে, তিনি লক্ষ্য করেন নাই। হাঁ-মুখব্যাদানের ভিতর দুইটি মশক আপনমনে প্রেমালাপে মত্ত ছিল, এক্ষনে মুখব্যাদান বন্ধ হইবার উপক্রম করিতে তাহারা প্রমাদ গণিয়া বাহির হইয়া আসিল। অদূরে আশ্রমপ্রাঙ্গনের বাহিরে রাজার রথের অশ্বেরা অধৈর্য হয়ে পা ঠুকিতেছিল এবং মৃদু হ্রেষারবে জানাইবার চেষ্টা করিতেছিল, ফিরিতে হইবে।
যুক্তকরে বৈশম্পায়নকে প্রণাম জানিয়ে রাজা বলিলেন, - কালরহিত হয়ে গেছিলাম আপনার বিবরণ শুনে, হে ঋষিবর। এ যে বাস্তবিক বড় অপূর্ব দিনের কথা শোনালেন আমায়। আক্ষেপ রয়ে যাবে, আচ্ছে দিন দেখবার জন্য আমি বেঁচে থাকব না। মহামতি ভীষ্মের ন্যায় ইচ্ছামৃত্যুর সৌভাগ্য যদি থাকত আমার, একবার এই আচ্ছে দিন দেখেই মরতাম। ... আজ সন্ধ্যা হয়ে গেছে, আপনার আহ্নিকের কাল হয়ে গেল, কাহিনী সম্পূর্ণ শোনার আশা অপূর্ণ হয়ে গেল, আমি রাজকার্য থেকে সময় বের করে আবার একদিন আসব আপনার কাছে, বাকি কাহিনী শুনতে। আজ তবে আমাকে অনুমতি দিন, মহর্ষি।
স্মিতহাস্যের সহিত দক্ষিণহস্ত বরাভয়মুদ্রায় প্রসারিত করিয়া রাজাকে আশীর্বাদ করিলেন ঋষি বৈশম্পায়ন। অনতিদীর্ঘ আশ্রমপ্রাঙ্গণ অতিক্রম করিবার মুহূর্তে রাজা দেখিলেন, আশ্রমের অভ্যন্তর হইতে বাহির হইয়া আসিয়াছে আশ্রমবালিকা। পরিধানে কাষায়শাড়ি, আলুলায়িত কেশ, দুইহস্তে বিদ্ধৃত একটি মৃত্তিকার প্রদীপ। বালিকা চলিয়াছে তুলসীমঞ্চে সান্ধ্যকালীন আরতি করিতে। প্রদীপের কম্পিত আলোকাভাসে একসাথে আলোছায়া খেলা করিতেছে আশ্রমবালিকার সুকুমার মুখমণ্ডলে, চূর্ণকুন্তল আসিয়া পড়িয়াছে তাহার বাম গণ্ডদেশে, ভীরু পদছন্দে যেন শশকের ব্যাকুলতা।
রাজা প্রস্তরবৎ নিশ্চল হইয়া দেখিতে লাগিলেন।