সাধারণভাবে কোনও বই পড়া শুরু করার আগে আলাদা করে কোনও মানসিক প্রস্তুতি নেবার দরকার হয় না – কিন্তু এই বইটা পড়ার আগে আমাকে মানসিকভাবে প্রস্তুত হতে হয়েছিল। বইটা পড়ার জন্য হয় তো আগে থেকে ঘটনাটার কিছু না জানলেই ভালো হত, একটা নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে বইটা পড়ে একটা মতামতে পৌঁছনো যেত। কিন্তু এটা কোনও কাল্পনিক গল্পের বই নয়, কঠিন বাস্তবের ন্যারেশন। এই ন্যারেশনের একটা অংশ আমি জানি, জানতাম, ঘটনার শুরু থেকেই আমি নজরে রেখেছিলাম, নিজের মত করে খবর জোগাড় করতাম, পড়তাম, ফলে নিজের অজান্তেই একটা মত – সহজ ইংরেজিতে যাকে বলে ওপিনিয়ন, আমার তৈরি হয়ে ছিল। ফলে পুরোপুরি নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গী থেকে এই বই পড়া আমার পক্ষে আর কোনওভাবেই সম্ভব ছিল না। আমি জানতাম, বইটা পড়ে ফেলার পরে আমি ঠিক আগের মত স্বাভাবিক থাকতে পারব না, বইটা আমাকে ধাক্কা মারবে জোরে, আর হন্ট করে চলবে অনেকদিন ধরে। পড়বার পরে বুঝেছিলাম, আমার এই ধারণা অমূলক ছিল না।
হন্ট করে বেড়াচ্ছে আমাকে বইটা, সত্যিই – অভিরূক সেনের বই, আরুষি। তার বেশ কিছু কারণ আছে। আমার আত্মজা সেই স্কুলেই পড়ে, যেখানে আরুষি পড়ত। ফলে, মনের অজান্তে কোথায় যেন আমি নিজেকে রাজেশ তলওয়ারের সঙ্গে একটা জায়গায় রিলেট করি। এই অবচেতনের ধারণাটা আমাকে নিরপেক্ষ থাকতে বড় বাধা দিয়েছে সর্বক্ষণ। এই বইয়ের প্রায় সমস্ত ঘটনাপ্রবাহ যে সমস্ত এলাকা ঘিরে, সেগুলো সবই আমার বাড়ির খুব কাছাকাছি। নয়ডা সেক্টর পঁচিশের জলবায়ু বিহার, যেখানে একসময়ে আমার প্রচুর যাতায়াত ছিল, আজও যাই মাঝেমধ্যে – সেইখানেই আরুষিদের বাড়ি। এই জলবায়ু বিহারের মার্কেটেই নয়ডার অন্যতম নামকরা বাঙালি মিষ্টির দোকান – মিষ্টিমুখ, যেখানে একসময়ে গুরুচন্ডালির বইপত্র রাখা হত। আরুষিদের বাড়ি থেকে ঢিল-ছোঁড়া দূরত্বে। বইয়ের একটা দীর্ঘ অংশ জুড়ে থেকেছে আইনি প্রক্রিয়ার বিস্তারিত বিবরণ, তলওয়ারদের মামলার শুনানি, গাজিয়াবাদ কোর্টে। এই গাজিয়াবাদ কোর্টেই একসময়ে আমাকে দিন ছয়েক চক্কর কাটতে হয়েছিল আমার চুরি যাওয়া মোটরসাইকেলের এফআইআরের ক্লোজার রিপোর্ট বের করার জন্য, সে এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতা, আমি তার সামান্য অংশ লিখেছিলাম আমার “লা-জবাব দিল্লি” বইতে, ওই ছটা দিন আমার পক্ষে এ জীবনে ভোলা খুব মুশকিলের ব্যাপার হবে – অভিরূক সেনের বই আমার সেই কদিনের ভীতিপ্রদ অভিজ্ঞতার স্মৃতি আবার জাগিয়ে তুলল।
সব মিলিয়ে মিশিয়ে বইটা আমাকে খুবসে নাড়িয়ে দিয়েছে। একটা দমচাপা ভয় তৈরি হয়ে গেছে মনের মধ্যে। পড়তে পড়তে বার বার ভেবেছি, এ বই নিয়ে লিখতেই হবে, লোককে খুব বেশি করে জানানো দরকার বইটার ব্যাপারে, আরো আরো লোকের পড়া দরকার। সবচেয়ে বড় কথা, বইটা তো কোনও ফিকশনধর্মী উপন্যাস নয়, আদ্যোপান্ত সত্যি ঘটনা। রহস্যময় সেই হত্যাকাণ্ডের দায়ে অভিযুক্ত দুজন, আরুষির বাবা আর মা, রাজেশ আর নূপুর তলওয়ার আজও গাজিয়াবাদের শেষপ্রান্তে দাসনা জেলের এক কোণায় শাস্তিভোগ করছেন, সম্পূর্ণভাবে আইনব্যবস্থা আর বিচারপ্রক্রিয়ার গাফিলতি আর অক্ষমতার কারণে। যদ্দূর জানি, খুব তাড়াতাড়ি তাঁদের নিজেদের ডিফেন্ড করবার উপায় নেই, এ জীবনের জন্য তাঁদের জেলের বাইরে বেরোনর সমস্ত রাস্তা বন্ধ – যদি না খুব অভাবনীয় কিছু মির্যাকল হয়। অপরাধ প্রমাণিত হয় নি, তবু শাস্তি ঘোষিত হয়ে গেছে, যে শাস্তিকে চ্যালেঞ্জ জানানোর সমস্ত চেষ্টা গত দু বছরে ব্যর্থ হয়েছে, কবে সফল হবে, আদৌ সফল হবে কিনা, তা হয় তো একমাত্র সময়ই বলতে পারবে।
আমি জানি না, আমি সম্পূর্ণ নিস্পৃহ, নিরপেক্ষভাবে এই বইয়ের সম্বন্ধে কিছু লিখতে পারব কিনা, হয় তো আমি বায়াসড হয়ে যাব, রাজেশ আর নূপুরের প্রতি, সেইজন্য বইটা শেষ করে ফেলার পরেও অন্তত দুই তিন চার সপ্তাহ আমি এটা নিয়ে লেখার সাহস করি নি। কিন্তু আর পারলাম না। এটা নিয়ে লিখতে না পারলে আমি শান্তি পাচ্ছি না। আমাকে সত্যি সত্যি আজও, বই শেষ করার দুই-আড়াই সপ্তাহ পরেও, আজও প্রায় প্রতিদিন ঘুমের মধ্যে জাগিয়ে তুলছে বইটা, কেমন একটা আতঙ্ক জাগিয়ে তুলছে মনের মধ্যে। কী বলা যায় এটাকে, মিসক্যারেজ অফ জাস্টিস নাকি ডিনায়াল অফ জাস্টিস, আমার জানা নেই। আসলে এই বইটা শুধু আরুষির হত্যাকাণ্ডের ওপর তো নয়, এটা প্রচণ্ড প্রকটভাবে দেখিয়েছে এই মামলাটাকে ঘিরে – ভারতীয় আইনব্যবস্থা, ইন্ডিয়ান জুডিশিয়ারি কতদূর নীচ, কতটা নির্মম হতে পারে; একটা আপাত-সুখী, সফল পরিবার একেবারে শেষপ্রান্ত পর্যন্ত তছনছ হয়ে যেতে পারে একটা অস্বাভাবিক মৃত্যুকে কেন্দ্র করে, দোষী হিসেবে যারা হয় তো অভিযুক্ত হতেও পারত, তারা স্রেফ সঠিক সময়ে চার্জশীট পেশ না হবার কারণে মুক্তি পেয়ে গায়েব হয়ে গেল, আর দোষী সাব্যস্ত হয়ে গেল এমন দুজন, যারা হয় তো অপরাধের সঙ্গে কোনওভাবে যুক্ত ছিল না।
না। তলওয়ারদের নির্দোষ প্রমাণ করবার উদ্দেশ্য নিয়ে আমি এ লেখা লিখতে বসি নি, অভিরূকের বইয়ের উদ্দেশ্যও তাঁদের নির্দোষ বা দোষী প্রমাণিত করা নয়। প্রত্যক্ষ কোনও প্রমাণ পাওয়া যায় নি। সিবিআই এবং বিচারপ্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত কিছু এক্সপার্ট চরিত্রদের বানিয়ে তোলা গল্পে, “পারিপার্শ্বিক তথ্যপ্রমাণ” বা “সারকামস্ট্যানশিয়াল এভিডেন্স”এর ওপর ভিত্তি করে কীভাবে ভারতীয় আইনব্যবস্থা কাউকে চরম অপরাধী বানিয়ে ফেলতে পারে, তার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ এই আরুষি হত্যাকাণ্ড মামলা। পড়তে পড়তে কেবল মনে হচ্ছিল, কোনওদিন তো তা হলে এই রকম অভিজ্ঞতা আমার সাথেও হয়ে যেতেই পারে, ইচ্ছে করলেই যে কেউ তছনছ করে ফেলতে পারে আমার জীবন, সম্পদ, পরিবার, ভবিষ্যত – ভারতীয় পুলিশ আর আইনব্যবস্থার কাছে আমরা প্রত্যেকে সত্যিই এতটাই এক্সপোজড, এতটা অসহায়!
সিনেমায়, কিংবা নিউজ চ্যানেলের পর্দায় আমরা অনেকবার দেখেছি জননেতাকে পুলিশের হাতে ঘটনাচক্রে অ্যারেস্ট হবার পরে কুটিল হাসি হেসে বলতে, আই হ্যাভ ফুল ফেথ অন জুডিশিয়ারি।
ফুল ফেথ অন জুডিশিয়ারি। আইনপ্রক্রিয়ার ওপর সম্পূর্ণ আস্থা। এই বইটা পড়বার পরে, আমি জানি না, আর কোনওদিন, কোনও অবস্থাতেই বলতে পারব কিনা, আইনপ্রক্রিয়ার ওপর আমার পুরো আস্থা আছে। নাঃ, আমার আস্থা টলে গেছে।
আরুষি হত্যাকাণ্ডের প্রথম দিন থেকেই এই কেসটা আমি নিয়মিত ফলো করেছিলাম, মূলত খবরের কাগজ আর নিউজ চ্যানেলের মাধ্যমে, এখন অভিরূকের বইটা পড়ে ফেলার পরে বুঝলাম, আমি আসলে কিছুই জানতাম না, কিছুই জানতে পারি নি – যা জেনেছিলাম, তা ছিল কিছু মোটাদাগের ফ্যাক্ট। তার বাইরেও অনেক ঘটনা, অনেক অবিচার, অনেক অন্যায় ঘটে গেছে, যা মিডিয়াতে আসে নি। কতটা লিখব এই বই সম্বন্ধে, তাও ভেবে উঠতে পারছি না, কারণ, লিখতে গেলে, মনে হচ্ছে পুরো বইটাই অনুবাদ করে ফেলা দরকার, একটা প্যারাগ্রাফও বাদ না রেখে, এতটাই নিখুঁত বিস্তারে বর্ণনা করেছেন অভিরূক। আর এই বিস্তারিত ঘটনাপ্রবাহ সবিস্তারে না জানলে কেসটা সম্বন্ধে অনেক কিছুই অজানা থেকে যায়। আমি এই নিবন্ধে তাই পুরো ঘটনা এবং বিচারপ্রক্রিয়ার মূল অংশগুলো তুলে ধরব, পুরো কেসটা সম্বন্ধে জানার জন্য, অতি অবশ্যই এই বইটা পড়ে ফেলতে অনুরোধ করব, সবাইকে।
টাইমলাইন
দু হাজার আট সালের ষোলই মে ভোরবেলা আরুষি তলওয়ারকে তার ঘরের বিছানায় মৃত অবস্থায় আবিষ্কার করেন আরুষির বাবা মা, রাজেশ তলওয়ার আর নূপুর তলওয়ার। আরুষির গলার নলি কাটা ছিল, মাথার খুলি ভারী কিছুর আঘাতে ভেঙে গেছিল। পোস্টমর্টেম রিপোর্টে তার শরীরে কোনওরকমের ধর্ষণ বা সঙ্গমের চিহ্ন পাওয়া যায় নি – কিন্তু সে তো পরের কথা। তলওয়ারদের কাজের লোক হেমরাজের ওপর সন্দেহ এসে পড়ে, কারণ সেদিন ভোর থেকেই সে নিপাত্তা, তার মোবাইলও সুইচড অফ ছিল। পুলিশ এসে ক্রাইম সীন কর্ডন অফ করে ফেলার আগেই অসংখ্য বাইরের লোক, মূলত প্রতিবেশি, কিছু শুভানুধ্যায়ী এবং অতি উৎসাহীর দল এসে ভিড় করে ঢুকে পড়েছিল তলওয়ারদের ঘরে, নয়ডার পুলিশ তাদের আটকাতে বা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য, যেমন রক্তের দাগ বা হাতের ছাপ ইত্যাদি, সংরক্ষণ করতে অসমর্থ হয়। সাধারণ বুদ্ধিতে সবাইই যখন হেমরাজকেই দোষী সাব্যস্ত করছে, তখন, সতেরোই মে, আরুষির মৃতদেহ আবিষ্কার হবার ঠিক একদিন পরে, তলওয়ারদেরই বাড়ির তালাবন্ধ টেরেসে, তালা ভেঙে আবিষ্কৃত হয় হেমরাজের মৃতদেহ। একইরকম ভাবে গলার নলি কাটা আর ভারী কিছু দিয়ে মাথার খুলি ভেঙে দেওয়া। সামনে এমনভাবে একটা বেডকভার ঝোলানো ছিল, আশেপাশের বাড়ির জানলা বা বারান্দা থেকে কোনওভাবেই বোঝা যায় নি এখানে একটা মৃতদেহ পড়ে আছে।
সন্দেহের তির এর পরে ঘুরে যায় রাজেশ তলওয়ারের দিকে, এবং উত্তর ভারতের রীতি অনুযায়ী একটি অনার-কিলিং-এর তত্ত্ব খাড়া করা হয়। নয়ডা পুলিশ ২৩শে মে রাজেশকে অ্যারেস্ট করে। কিন্তু ততক্ষণে নয়ডা পুলিশের অপদার্থতা পদে পদে ফুটে উঠতে শুরু করেছে। লোকজনের ভিড়ে সমস্ত গুরুত্বপুর্ণ ফরেনসিক তথ্য লোপাট, চোখের সামনে তালাবন্ধ টেরেস দেখতে পেয়েও তার তালা ভাঙতে প্রায় দেড় দিন দেরি করা – সব মিলিয়ে নয়ডা পুলিশের এই কেসে বিশেষ কিছু করার ছিল না। বিশেষ কিছু ইনফ্লুয়েনশিয়াল লোকের সহায়তায় সিবিআই এই কেসের দায়িত্ব নেয় ৩১শে মে। তারা পর পর কিছু অ্যারেস্ট করে, মূলত হেমরাজের সঙ্গী, ওই এলাকারই অন্যান্য বাড়িতে ভৃত্যের কাজ করা কৃষ্ণ (কৃষ্ণা), রাজকুমার এবং দেড় মাস পরে অ্যারেস্ট করে আরেকজন ভৃত্য, বিজয় মণ্ডলকে। কৃষ্ণার ঘর থেকে একটি কুকরি এবং একটি রক্তমাখা পিলো-কভার বা বালিশের ওয়াড় পাওয়া যায়। প্রাথমিক জেরা ইত্যাদির পরে কৃষ্ণা তার দোষ কবুল করে, এগারোই জুলাই ২০০৮, রাজেশ তলওয়ার মুক্তি পান।
এই অবধি পড়লে মনে হয়, সবই তো ঠিক আছে। অপরাধী কে জানা গেল, অপরাধের অস্ত্র পাওয়া গেল, প্রমাণ পাওয়া গেল, আর কী চাই?
সিবিআই নিজেও সেই রকমই ভেবেছিল, অন্তত সিবিআইয়ের তরফে ইনভেস্টিগেটিং অফিসারও সেই রকম ভেবেছিলেন। কিন্তু ততদিনে এই কেস মিডিয়ার নজরে এসে গেছে। মিডিয়া বিভিন্ন ভাবে ঘটনার নাট্য রূপান্তর দেখিয়ে, অনার কিলিং-এর ওপর টক শো অর্গানাইজ করে ব্যাপারটাকে এমন একটা সেনসেশনাল পর্যায়ে নিয়ে গেছিল, যে মিডিয়া-ট্রায়ালে মুগ্ধ আমজনতা “হয়-তো” এই রকমের একটি জোলো এন্ডিং এই কেসের জন্য মেনে নিতে পারত না। সিবিআইয়ের তৎকালীন ডিরেক্টরও মেনে নিতে পারেন নি। তিনি ইনভেস্টিগেটিং অফিসারকে কেস ফাইল বানিয়ে কেস “ক্লোজ” করার অনুমতি দেন না – তাঁর সন্দেহ ছিল, ভৃত্যরা নয়, স্বয়ং রাজেশ আর নূপুরই তাঁদের মেয়ে আরুষি আর চাকর হেমরাজের মৃত্যুর জন্য দায়ী।
এই সন্দেহকে সত্যি প্রমাণ করার জন্য এর পর তিনি বহুদূর যাবেন, এবং সময়মত কেস ফাইল তৈরি করতে না পারার কারণে দু হাজার আটের চৌঠা সেপ্টেম্বর বিজয় মণ্ডল, এবং বারোই সেপ্টেম্বর কৃষ্ণা আর রাজকুমারও ছাড়া পেয়ে যায়। এরই মধ্যে দিল্লির এইমস থেকে ফাইনাল পোস্টমর্টেম রিপোর্ট আসে, যাতে লেখা ছিল, মৃতদের মাথার আঘাত কুকরির আকারের সাথে ম্যাচ করছে, এবং হায়দরাবাদের ফরেনসিক ল্যাব থেকে ফাইনাল রিপোর্ট আসে, কৃষ্ণার ঘর থেকে উদ্ধার হওয়া রক্তমাখা বালিশের ওয়াড়ে হেমরাজের রক্ত লেগে আছে।
এত কিছুর পরেও, সিবিআইয়ের ডিরেক্টর এই সিদ্ধান্তেই অটল থাকেন যে, কৃষ্ণা বা রাজকুমার নয়, তলওয়ার দম্পতিই অনার কিলিং করিয়েছেন নিজের মেয়ে এবং হেমরাজকে। এবং এই তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করার জন্য যা যা করা দরকার, তার সমস্তই তিনি করতে থাকেন ধীরে ধীরে, ক্রমশ সন্দেহের কাঁটা ঘোরাতে থাকেন তলওয়ার দম্পতির দিকে। বিভিন্ন ব্যক্তির বয়ান – যা শুরুতেই রেকর্ড করা হয়েছিল, তার দ্বিতীয় ভার্সন আসতে শুরু করে, প্রায় সকলের ক্ষেত্রেই, যে সব লোকেদের বয়ান বদলানো সম্ভব হয় নি, তাদের বয়ান বাদই দিয়ে দেওয়া হয় কেস থেকে। খুনের অস্ত্র, মার্ডার ওয়েপন কুকরি থেকে সরে গিয়ে কখনও হয়ে দাঁড়ায় গলফ ক্লাব, কখনও সার্জিকাল নাইফ, যা গলফ-খেলা ডেন্টিস্ট রাজেশ তলওয়ারের বাড়ি থেকে সহজেই উদ্ধার করে ফেলা সম্ভব হয়। মৃত্যুর প্রায় এক বছর পরে নতুন টেস্টিমনির মাধ্যমে জানা যায় আরুষি খুন হবার আগে ধর্ষিত হয়েছিল কিংবা সঙ্গম করেছিল, জানান সেই ব্যক্তি যিনি আরুষির দেহের পোস্ট মর্টেম করেছিলেন এবং শুরুতেই জানিয়েছিলেন কোনওরকমের যৌন সঙ্গম বা বলাৎকারের চিহ্ন পাওয়া যায় নি আরুষির শরীরে বা যৌনাঙ্গে। প্রসঙ্গত, মৃত্যুর সময়ে আরুষি ছিল তার চোদ্দতম জন্মদিন থেকে মাত্রই কয়েকদিন দূরে। যাকে কেন্দ্র করে এই অনার কিলিং-এর তত্ত্ব, সেই হেমরাজের বয়েস ছিল মোটামুটি পঁয়তাল্লিশ-ছেচল্লিশ বছর।
বয়ান বদলের পরে আরও জানা যায় তলওয়ার দম্পতি নাকি ধর্ষণের কেচ্ছাটি জানতেন এবং রাজেশ নাকি বিশেষভাবে পুলিশকে অনুরোধ করেছিলেন যাতে পোস্টমর্টেম রিপোর্টে “ধর্ষণ” বিষয়টির উল্লেখ না থাকে – পারিবারিক সম্মানের খাতিরে। জানা যায় যে রাজেশ আর নূপুর নাকি “যথেষ্ট” শোক প্রকাশ করেন নি মেয়ের মৃতদেহ আবিষ্কারের পরে, ঘরভর্তি উৎসুক জনতার কেউই নাকি তলওয়ার দম্পতিকে “সেইভাবে” শোকগ্রস্ত অবস্থায় দেখেন নি। আরও জানা যায় যে পুলিশ নাকি প্রথম দিনই টেরেসের দরজার তালা ভেঙে হেমরাজের মৃতদেহ উদ্ধার করে ফেলতে পারত, রাজেশই নাকি তাদের ভুলিয়েভালিয়ে টেরেসের সিঁড়ির দিকে এগনো থেকে বিরত রাখেন। এই রকমের আরও অনেক কিছুই জানা যায় পর পর। হতবাক তলওয়ার দম্পতি সমস্ত পরিবর্তনকে চ্যালেঞ্জ জানাতে শুরু করেন, কিন্তু সিবিআইয়ের ডিরেক্টরকে টলানো সম্ভব হয় নি।
কিন্তু এত করেও শেষমেশ সিবিআই অনার কিলিং-এর তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হল না। প্রতিটা বয়ানের বদলকে লিঙ্ক করতে গেলে যে ঠাসবুনোট কাহিনির প্রয়োজন হয়, সেই কাহিনি বানাতে অপারগ হয় সিবিআই। অবশেষে রাজেশ আর নূপুর তলওয়ারকে গুজরাতের গান্ধীনগর নিয়ে যাওয়া হয় তাঁদের নারকো-অ্যানালিসিস টেস্ট এবং ব্রেন ম্যাপিং-এর জন্য। এতেও তলওয়াররা নির্দোষ সাব্যস্ত হন। ইতিমধ্যে ২০১০ সালের জুন মাসে সিবিআইয়ের ডিরেক্টর বদল হয়। নতুন ডিরেক্টর পুরো কেস পর্যবেক্ষণ করে অবশেষে ইনভেস্টিগেটিং অফিসারকে এই মর্মে কেস বন্ধ করতে বলেন – যে, রাজেশ তলওয়ার বা অন্য কাউকে দোষী সাব্যস্ত করার মত যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় নি।
২৯শে ডিসেম্বর সিবিআই ক্লোজার রিপোর্ট জমা দেয় এই মর্মে। কেস বন্ধ হয়।
তা হলে কে মেরেছে আমাদের আদরের মেয়ে আরুষিকে? কে মেরেছে হেমরাজকে? – প্রশ্ন করেন রাজেশ তলওয়ার, নূপুর তলওয়ার। উত্তর মেলে না, ঠিক সেই ‘নো ওয়ান কিলড জেসিকা’র মত করে নতুন করে রাজেশ আর নূপুর জানতে হয়, নো ওয়ান কিলড আরুষি।
২০১১ সালের জানুয়ারি মাসে গাজিয়াবাদ কোর্টে রাজেশ তলওয়ার সিবিআইয়ের ক্লোজার রিপোর্টের বিরুদ্ধে পিটিশন দাখিল করেন এবং কেসকে আবার ওপেন করার দাবি জানান। সেই দিনই, গাজিয়াবাদ কোর্ট চত্ত্বরে এক অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তি একটি মাংস-কাটার ছুরি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে রাজেশ তলওয়ারের ওপর। রাজেশ গুরুতর আহত হন। অনেকেরই হয় তো মনে থাকবে – সেই সময়ে কাগজে নিয়মিত বেরোত এই কেসের খুঁটিনাটি।
গাজিয়াবাদের কোর্টে সিবিআইয়েরও একটি স্পেশাল কোর্ট আছে। সেখানকার স্পেশাল জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে যখন এই পিটিশন পৌঁছয়, তিনি দুটিকেই খারিজ করে দেন। দুটিকেই – একদিকে রাজেশের পিটিশন কেস আবার ওপেন করার জন্য, অন্যদিকে সিবিআইয়ের ক্লোজার রিপোর্ট, উলটে তিনি সিবিআইকে পরামর্শ দেন যে রিপোর্টের শেষে ‘ক্লোজড’ কথাটা না লিখে এটাকেই চার্জশীটে পরিণত করতে। ফাইলে তলওয়ারদের বিরুদ্ধে যে গল্প সাজানো হয়েছিল, যা সিবিআইয়ের ইনভেস্টিগেটিং অফিসারদের নিজেদের কাছেই বিশ্বাসযোগ্য লাগে নি, বিচারক সেই গল্পগুলোকেই রাজেশ আর নূপুর তলওয়ারের বিরুদ্ধে অকাট্য প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করে তাদের নামে চার্জশীট বানানোর নির্দেশ দেন সিবিআইকে।
সচ্ছল বাড়ির প্রতিষ্ঠিত ডাক্তার দম্পতি। তাদের একমাত্র মেয়ে এবং একটি চাকর রহস্যজনকভাবে খুন। উত্তর ভারত এমন একটা জায়গা – এখানে এটা অনার কিলিং-এর গল্প তৈরি করতে এবং সেটা এই ঘটনার তদন্তপ্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত অথবা যুক্ত নয়, সেই সব লোকজনকে বিশ্বাস করাতে খুব বেশি বেগ পেতে হয় না। তা যতই কেসে লুপহোল থাকুক না কেন। আরুষির কেসে এই ব্যাপারটা বার বার দেখা গেছে যে ইনভেস্টিগেটিং অফিসার, কিংবা জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট অথবা অন্য কোনও অথরিটি, একটা প্রি-অকুপায়েড মাইন্ড নিয়ে কেস রিভিউ করতে আসছেন – ইট মাস্ট বি আ কেস অফ অনার কিলিং – আর তারপরে ছকগুলোকে অনার কিলিং-এর তত্ত্বে মেলানোর চেষ্টা করছেন। যেখানেই ছক মিলছে না, সেখানে অদ্ভূত অদ্ভূত সব গোঁজামিল দেওয়া হয়েছে। বয়ান বদলে দেওয়া হয়েছে।
অনার কিলিং-এর থিওরি অনুযায়ী, রাজেশ ঘটনার দিন রাতে আরুষির ঘরে আরুষি এবং হেমরাজকে “আপত্তিজনক অবস্থায়” দেখতে পান, এবং তাই দেখে তাঁর মাথায় খুন চেপে যায়। তিনি সার্জিকাল স্ক্যালপেল (ডেন্টিস্টের কাছে যা থাকে, যা দিয়ে দাঁতের নিচের মাড়ি কাটা হয়, এবং যা দিয়ে গলার নলি কাটা রীতিমত কষ্টসাধ্য ব্যাপার, যদি না অসাধ্য হয়) দিয়ে আরুষি আর হেমরাজ দুজনকেই খুন করেন, এবং গলফ ক্লাব দিয়ে বাড়ি মেরে দুজনকারই মাথা ফাটিয়ে দেন। এই ছিল সিবিআইয়ের রিপোর্টে লেখা। সঙ্গতভাবেই প্রশ্ন উঠে আসে – আরুষি আর হেমরাজ কি একই ঘরে খুন হয়েছিল? সিবিআইয়ের প্রাথমিক যুক্তি – হ্যাঁ। একই ঘরে আরুষি আর হেমরাজ খুন হয়। পরে হেমরাজের ডেডবডি রাজেশ আর নূপুর মিলে টেরেসে নিয়ে যান।
কিন্তু রহস্য তাতে বাড়ে বই কমে না। যদি সেই ঘরেই হেমরাজ খুন হয়, তা হলে ঘরে বিছানায় শুধুমাত্র আরুষিরই ব্লাড স্যাম্পল পাওয়া গেল কেন, কেন হেমরাজের রক্তের একটা বিন্দুও ওই ঘরে পাওয়া যায় নি? সিবিআইয়ের যুক্তি – দে (রাজেশ আর নূপুর) ড্রেসড আপ দা ক্রাইম সীন। তারা নাকি বেছে বেছে হেমরাজের রক্তের সমস্ত চিহ্ন মুছে শুধু আরুষির রক্তের চিহ্নগুলোকে রেখে দিয়েছিলেন বিশ্বাসযোগ্যতা আনবার জন্য।
একবার ভেবে দেখুন। বিছানায়, বা ঘরের মধ্যে দুটি মানুষকে বীভৎসভাবে খুন করা হয়েছে, প্রথমে গলা কেটে, তার পরে মাথার খুলি ফাটিয়ে। ঘরের মধ্যে রক্তগঙ্গা বয়ে যাবার কথা, এখন, কত উন্নতমানের ডাক্তার হলে সেই রক্তের মধ্যে দাঁড়িয়ে একটি বিশেষ গ্রুপের রক্তের দাগ মুছে অন্য গ্রুপের রক্তের দাগটি অবিকৃত রেখে দিতে পারেন? হেমরাজ আর আরুষির রক্তের গ্রুপ ছিল আলাদা। ঘরের মধ্যে হেমরাজের গ্রুপের এক বিন্দু রক্তও পাওয়া যায় নি।
সিবিআইয়ের রিপোর্টে এর কোনও যৌক্তিক উত্তর মেলে নি, কিন্তু সিবিআই কোর্টের স্পেশাল জাজ এই তত্ত্বে কোনও অসঙ্গতি খুঁজে পান নি। সমস্যার এখানেই শেষ নয়। যদি ধরেও নেওয়া যায় মৃত হেমরাজকে রাজেশ আর নূপুরই চ্যাংদোলা করে টেরেসে রেখে আসেন, তা হলে সিঁড়িতে, রেলিং-এ – কোথাও রক্তের কোনও চিহ্ন নেই কেন? সিবিআইয়ের যুক্তি ছিল, মৃতদেহ বেডকভারে মুড়ে ছাদে রেখে আসা হয়েছিল, তাই কোথাও রক্তের দাগ মেলে নি।
ক্রিমিনাল কেসে সীন রিক্রিয়েট করার একটা প্রসিডিওর থাকে, ঠিক কীভাবে অপরাধটা সংগঠিত হয়েছিল তার একটা হুবহু ড্রিল করা হয় যাতে যে তত্ত্বের ওপর আধার করে কেস সাজানো হচ্ছে, সেই তত্ত্ব যৌক্তিকতা পায়। এই কেসের দায়িত্বে ছিলেন যে ফরেনসিক অফিসার, তিনি এই সীন রিক্রিয়েট করার ব্যাপারে বিশেষ পারদর্শি ছিলেন। গুজরাতের গোধরা হত্যাকাণ্ডের সীন রিক্রিয়েট করে তিনিই প্রথম এই তত্ত্বটি জানান যে, বাইরে থেকে নয়, করসেবকরা ট্রেনের ভেতরেই স্টোভ জ্বালিয়ে রান্না করছিল, সেখান থেকেই নাকি ট্রেনে আগুন ছড়ায়। অবিশ্যি, পরে তদন্তপ্রক্রিয়ায় তাঁর এই সীন রিক্রিয়েটের তত্ত্ব ধোপে টেকে নি গোধরা কেসে, বাইরে থেকে ট্রেনে আগুন লাগার তথ্য এখন নানাবতী কমিশনের হাতেই রয়েছে। তো, সেই একই ব্যক্তি এখানেও সীন রিক্রিয়েট করার চেষ্টা করেছিলেন – হেমরাজের সমান ওজনের একটি কনস্টেবলকে বেডকভারে শুইয়ে দুজন পুলিশকে দিয়ে তিনি সিঁড়ি ভেঙে ওই বেডকভারশুদ্ধ কনস্টেবলকে বয়ে টেরেসে রেখে আসার অভিনয় করিয়েছিলেন। দেখা গেছিল, দুজনের পক্ষে ওইভাবে একজন মৃত মানুষকে চাদরে বেঁধে, কোথাও রক্তের কোনও চিহ্ন না লাগিয়ে, সিঁড়ি ভেঙে ছাদে রেখে আসা খুবই অসম্ভব কাজ। দুটি খুনের অব্যবহিত পরে রাজেশ এবং নূপুর তলওয়ারের পক্ষে যা করা ফিজিকালি সম্ভব ছিল না।
তা হলে কি হেমরাজকে জীবন্ত অবস্থায় ছাদে নিয়ে গিয়ে খুন করা হয়েছে? সে তলওয়ারদের সঙ্গে ছাদে গেছিল? ততক্ষণে কি আরুষি খুন হয়ে গেছে? যদি খুন হয়ে গিয়েই থাকে, তা হলে সেই খুন দেখার পরেও হেমরাজ বিনা প্রতিবাদে কী করে ছাদে গেল তলওয়ারদের সাথে? কোনও ধ্বস্তাধস্তির চিহ্ন নেই কোথাও – কী করে হতে পারে? যদি আরুষি আর হেমরাজ এক ঘরেই থেকে থাকে, তা হলে যে কোনও একজনের খুন অন্যজনের পক্ষে দেখতে পাবার কথা, আর মৃত্যুভয়ে অন্যজন আপ্রাণ চেষ্টা করবেই হত্যাকারীর থেকে মুক্তি পাবার – সে হত্যাকারী যে-ই হোক না কেন। কিন্তু কারুর তরফেই প্রতিরোধের কোনও চিহ্ন পাওয়া যায় নি। তার মানে কি দুজনকে আলাদা ভাবে, অথবা আলাদা সময়ে খুন করা হয়েছে?
এই সমস্ত ফাঁক সিবিআই তার রিপোর্টে বোজাতে পারে নি। কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে তারা সেই ক্লোজার রিপোর্টকে বদলালো চার্জশীটে।
রাজেশ আর নূপুর এলাহাবাদ হাইকোর্টে গেলেন এই বদলকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে, কিন্তু লাভ হল না। এইখানে একটা গুরুত্বপূর্ণ রোল ছিল সেই বালিশের ওয়াড়ের। আমরা আগেই জেনেছি যে, আরুষির ঘরে হেমরাজের রক্তের একটি কণাও পাওয়া যায় নি। কিন্তু হেমরাজের রক্ত পাওয়া গেছিল একটি বালিশের ওয়াড়ে, যেটা লুকনো ছিল কৃষ্ণার ঘরে, সিবিআই আগেই উদ্ধার করেছিল সেটা, একটা কুকরির সঙ্গে। রাজেশ আর নূপুরের সাথে কৃষ্ণা আর রাজকুমারেরও নারকো-অ্যানালিসিস টেস্ট হয়, এবং সেখানে অবচেতনে তারা স্বীকার করে আরুষির প্রতি তাদের দুর্বলতার কথা, হেমরাজকে খুন করার কথা।
প্রথমে নয়ডা পুলিশ, পরে সিবিআই – কেস হাতে নেবার পরে অনেক জিনিসই সীজ করে তলওয়ারদের বাড়ি থেকে এবং কৃষ্ণার আস্তানা থেকে, এভিডেন্স হিসেবে। আরুষির ঘর থেকে সীজ হয় আরুষির বালিশের ওয়াড়, যাতে আরুষির রক্তের দাগ ছিল, আর কৃষ্ণার ঘর থেকে সীজ হয় কৃষ্ণার বালিশের ওয়াড়, যাতে ছিল হেমরাজের রক্ত। ক্লোজার রিপোর্ট যখন চার্জশীটে বদলে গেল, রাজেশ আর নূপুর সবিস্ময়ে দেখলেন – এই দুটি বালিশের ওয়াড় পরস্পরের জায়গা বদলাবদলি করে নিয়েছে, অর্থাৎ, নতুন এভিডেন্সের লিস্ট অনুযায়ী, আরুষির ঘর থেকে সীজ হওয়া বালিশের ওয়াড়ে রয়েছে হেমরাজের রক্ত।
কী ভাবে হল এই বদলাবদলি? কে বদলালো সীল করা এভিডেন্সের প্যাকেট? এলাহাবাদ হাইকোর্টে এই প্রশ্ন রাখলেন তলওয়ার দম্পতি। কিন্তু, হাইকোর্ট তাঁদের এই দাবীকে নস্যাৎ করে দিয়ে জানালেন – এটা নিতান্তই একটি টাইপোগ্রাফিকাল এরর, আগে ভুল লেখা হয়েছিল, এখন ঠিক লেখা আছে। … কিন্তু দুটো বালিশের ওয়াড়ের যে ডিজাইন আলাদা! এই ওয়াড় আরুষির ঘরে আসতেই পারে না, অন্তত তাঁরা যখন ওই ঘরে উপস্থিত ছিলেন, তখনও এই ওয়াড় ওই ঘরে ছিল না, বরং তাঁদের স্পষ্টই মনে আছে, ওয়াড়টি কৃষ্ণার ঘর থেকে বাজেয়াপ্ত হয়েছিল।
কিন্তু মহামান্য হাইকোর্ট সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন – টাইপো। কার কত ক্ষমতা তাকে বদলায়? তিনি গাজিয়াবাদ কোর্টের রায়কেই বহাল রাখলেন, সাথে সিবিআইকে বললেন, খোঁজ নিয়ে দ্যাখো তো বাপু, কারা এই টাইপোটি করেছিল? সিবিআই প্রশ্নটি পাঠিয়ে দিল হায়দরাবাদের ফরেনসিক ল্যাবের অধিকর্তাকে, কিছুদিনের মধ্যেই হায়দরাবাদ থেকে উত্তর এসে গেল, হ্যাঁ, আমাদের কাছেই টাইপো হয়েছিল। অর্থাৎ কিনা, ফরেনসিক ল্যাবরেটরির নতুন বয়ান অনুযায়ী হেমরাজের রক্তমাখা বালিশের ওয়াড়, আসলে আরুষির ঘর থেকেই উদ্ধার হয়েছিল।
মেয়ের মৃত্যুর পরে একদিনের জন্যেও শোক করার অবকাশ পান নি তলওয়ারেরা। কিন্তু এত বড় ঘাপলাকে শুধু টাইপোগ্রাফিকাল এরর বলে ছেড়ে দেওয়া তো নিতান্তই মূর্খতা! খুব জেনেবুঝেই কেউ এই কাজটা করেছে, যাতে প্রমাণ করা যায় যে আরুষির ঘরে হেমরাজের ব্লাড স্যাম্পল পাওয়া গেছে, যা আসলে অনার কিলিং-এর তত্ত্বকেই প্রতিষ্ঠিত করবে – সিবিআইয়ের যেটা আসল লক্ষ্য।
মরিয়া হয়ে তলওয়াররা অ্যাপিল করলেন সুপ্রিম কোর্টে। তাঁরা জানালেন, তাঁদের সন্দেহ হচ্ছে গাজিয়াবাদের কোর্টে ফেয়ার ট্রায়াল হচ্ছে না, এবং এভিডেন্স ট্যাম্পার করা হচ্ছে তাঁদের বিরুদ্ধে কেস সাজাবার জন্য। তাঁরা অনুরোধ জানালেন, কেস যেন গাজিয়াবাদ থেকে বের করে এনে দিল্লির কোনও কোর্টে করা হয়, প্রথমত তাঁদের পক্ষে দিল্লি থেকে গাজিয়াবাদের কোর্টে যাতায়াত করা সময়সাপেক্ষ হয়ে দাঁড়াচ্ছে, দ্বিতীয়ত দিল্লির কোর্টে হলে তাঁদের পক্ষে কেস ভালোভাবে নজরে রাখা সম্ভব হবে।
তলওয়ারদের কথা শোনার বদলে, তলওয়াররা পেলেন সর্বোচ্চ আদালতের পবিত্র ক্রোধ। তুমি একজন সাধারণ ইন্ডিয়ান সাবজেক্ট, তোমার এত বড় সাহস হয় কী করে একটি আদালতের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রকাশ করার? তাকে বায়াসড বলবার? শুধু এই চার্জে তোমাকে দিয়ে জেলের ঘানি ঘোরানো যায়, নেহাত তুমি প্রথমবার এই অনুরোধ করেছো, তাই তোমাকে ছাড় দেওয়া হল। আর কখনও কোনও আদালতের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রকাশ করার সাহস দেখিও না।
মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট গাজিয়াবাদ কোর্টেই মামলার প্রসিডিংস বহাল রাখলেন, শুধু এইটুকু স্বস্তি দিলেন, যে চার্জশীট পেশ হলেও কেস শেষ না হওয়া পর্যন্ত রাজেশ আর নূপুর তলওয়ার জামিনে থাকতে পারবেন। পুলিশ তাঁদের অ্যারেস্ট করবে না।
কিন্তু আইনের হাত থেকে বাঁচা এত সহজ ছিল না তলওয়ারদের পক্ষে। সুপ্রিম কোর্টে দৌড়োদৌড়ি করতে গিয়ে নূপুর গাজিয়াবাদের কোর্টে হাজিরা দেবার একটি ডেট মিস করে ফেলেছিলেন, ফলে সিবিআইয়ের তরফে তাঁর নামে নন-বেলেবল ওয়ারান্ট জারি হল। নূপুর আত্মসমর্পণ করলেন ৩০শে এপ্রিল ২০১২। বেলের জন্য অ্যাপ্লাই করলেন। কিন্তু বেল পেলেন না, অ্যারেস্ট হলেন। ইতিমধ্যে গাজিয়াবাদ কোর্টে সিবিআইয়ের স্পেশাল বেঞ্চে এই মামলার শুনানি শুরু হল – রাজেশ আর নূপুরকে খুনী হিসেবে চার্জ করে। সিবিআই একের পর এক সাক্ষী নিয়ে আসতে থাকল, ফরেনসিক এক্সপার্ট, পোস্টমর্টেম করা ডাক্তার, ঘটনার দিন হাজির হওয়া স্থানীয় কনস্টেবল, বন্ধু, কাজের লোক। এবার সক্কলের বয়ান বদলে যেতে থাকল। সবার সমস্ত বয়ান তলওয়ারদের বিরুদ্ধে যেতে থাকল। ফরেনসিক ল্যাবের এক্সপার্ট সেখানে প্রমাণ করতে ব্যর্থ হলেন যে হেমরাজের রক্তমাখা বালিশের ওয়াড়টি আরুষির ঘরে পাওয়া গেছিল। প্রকারান্তরে তিনি স্বীকার করতে বাধ্য হলেন যে এই ওয়াড়টি হেমরাজ বা কৃষ্ণার ঘর থেকেই পাওয়া গেছিল। এই একটি স্বীকারোক্তি ছাড়া আর কোনও সাক্ষ্যই তলওয়ারদের পক্ষে গেল না। এমনকি তলওয়ারদের বাড়িতে কাজ করা মহিলা, ভারতী মণ্ডলের জবানবন্দীও বদলে গেছিল সুচারুভাবে। অবশ্য ভারতী জবানবন্দী দেবার শুরুতেই শপথ নিয়ে বলেছিলেন, আমাকে যা “শেখানো” হয়েছে আমি শুধু তা-ই বলব।
২৫শে সেপ্টেম্বর ২০১২, নূপুর তলওয়ার সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপে ছাড়া পান।
কেস গড়িয়ে চলে ২০১৩ সালে। মে মাস পর্যন্ত একের পর এক সাক্ষীর জবানবন্দী নেওয়া হয় সিবিআইয়ের তরফে।
(এর পর পরের পর্বে)