তলওয়ারদের কেসটা ছিল একটু আলাদা। একদিকে যখন সুপ্রিম কোর্ট থেকে প্রায় কোনও সাহায্যই পান নি তলওয়াররা, ইনভেস্টিগেটিং অফিসার থেকে বিচারক – সকলেই অনার কিলিং-এর তত্ত্বটিকেই পালিশ করে চকচকে করে তুলতে ব্যস্ত ছিলেন, সেইখানে দিল্লির কিছু নামকরা লইয়ার, স্রেফ কেসটির মেরিট বিবেচনা করে, তলওয়ারদের স্বার্থে, বিনা পয়সায় কেসটিতে তাদের হয়ে সওয়াল করতে রাজি হয়েছিলেন। এঁদের মধ্যে একজন ছিলেন হরিশ সালভে, ভারত সরকারের প্রাক্তন সলিসিটর জেনারেল। সালভের ফীজ ভরার সাধ্য তলওয়ারদের ছিল না, কিন্তু কেসটি ততদিনে বিতর্কের এমন একটা মাত্রায় উঠে বসেছিল, সালভে এক পয়সা না নিয়ে এই কেসে কাজ করতে রাজি হয়েছিলেন। এমনি আরেকজন ছিলেন মুকুল রোহতাগি, যিনি পরে ভারত সরকারের অ্যাটর্নি জেনারেল হন। মূলত এঁদের সওয়ালেই নূপুর সেপ্টেম্বর মাসে মুক্তি পান।
অবশ্য সবাই এতটা উদার হতে পারেন নি। তলওয়ারদের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন উকিলের সাহায্য নিতে হয়েছে। কেউ বিনা পয়সায়, কেউ সাধারণ ফি-এর চেয়ে কম রেটে তলওয়ারদের জন্য কাজ করেছেন। এর পাশাপাশি ছিলেন গাজিয়াবাদ কোর্টের উকিলরা – সব মিলিয়ে তলওয়ারদের প্রতি মাসে খরচ হয়ে চলেছিল পঞ্চাশ হাজার থেকে এক লাখ – শুধু কেস চালানোর জন্য। এটা মূলত সম্ভব হচ্ছিল রাজেশ আর নূপুরের নিজস্ব পেশেন্টদের জন্য। না, কেউ তাঁদের টাকাপয়সা দানধ্যান করেন নি, রাজেশ আর নূপুর, জেলের বাইরে, কেসের শুনানির বাইরে যতবার নিজেদের চেম্বারে বসেছেন, পেশেন্টরা এসেছেন নিজেদের দাঁতের সমস্যা নিয়ে, রোজগার বন্ধ হয় নি তলওয়ারদের। এর বাইরে নয়ডার জলবায়ু বিহারের ফ্ল্যাটটি ভাড়া দিয়ে তাঁদের মাসে আয় হচ্ছিল মাসে কুড়ি হাজার টাকা। নয়ডার চেম্বারটি তাঁরা বিক্রি করতে বাধ্য হন – সেই বিক্রির টাকায় চলেছিল কিছুদিন। শেষে হাউজ খাসে তাঁদের ডেন্টাল চেম্বারও তাঁরা ভাড়া দিয়ে দেন, তাতেও টাকার সমস্যা মিটছিল না। বাকি টাকার জোগান দেন রাজেশ নূপুরের কিছু বন্ধু, এবং নিকটাত্মীয়রা।
জুন মাসে ডিফেন্স লইয়ার, তনভীর আহমেদ মীর তাঁর ট্রায়াল শুরু করেন। ক্রিমিনাল লইয়ার হিসেবে রীতিমত খ্যাতিমান মীর এই কেসে যুক্ত হন ২০১২ সালের শেষদিকে। ডিফেন্সের এভিডেন্স হিসেবে তিনি কৃষ্ণা আর রাজকুমারের নারকো-অ্যানালিসিস রিপোর্ট আর সমস্ত ডিএনএ স্যাম্পল চেয়ে পাঠান। সেই মর্মে এলাহাবাদ হাইকোর্টে আবেদন করেন তলওয়ারেরা। কিন্তু সিবিআই রাজি হয় না সেই সমস্ত তথ্য তলওয়ারদের দিতে। রাজেশ সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেন যাতে সুপ্রিম কোর্ট সিবিআইকে বাধ্য করে সেই সমস্ত রিপোর্ট দিতে। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট সিবিআইকে কিছু বলবার আগেই সিবিআই সুপ্রিম কোর্টকে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে জানায় যে তলওয়ারেরা শুধুমুধু কেসকে ডিলে করানোর জন্যই এইসব এভিডেন্স চাইছেন – এগুলো শুধু তাঁদের জেলের বাইরে বেশিদিন থাকার ছল। সুপ্রিম কোর্ট এতটুকুও সময় নিল না সিবিআইয়ের অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করতে। তলওয়ারদের জানানো হল, তোমরা মহামান্য কোর্টের সময় নষ্ট করছো, শুধুমুধু কোর্টের কাজকর্মের দেরি ঘটাচ্ছো এই সমস্ত জিনিস চেয়ে। কিচ্ছু দেওয়া হবে না তোমাদের।
তিনটি কোর্টের মধ্যে নিরন্তর দৌড়োদৌড়ি সুবিচারের আশায় – একটি দিল্লিতে, একটি গাজিয়াবাদে, আরেকটি এলাহাবাদে। শুধু যাওয়া আসাতেই দৈনিক খরচ হয়ে যাচ্ছিল হাজার হাজার টাকা।
সমস্ত আশা হারালেও, আশা হারান নি তনভীর আহমেদ মীর। ২৪শে অক্টোবর ২০১৩, তিনি তলওয়ারদের হয়ে ফাইনাল আর্গুমেন্ট রাখা শুরু করলেন।
কিন্তু জাজ স্বয়ং খুব একটা শোনবার মুডে ছিলেন না। যিনি এতদিন ধরে সিবিআইয়ের সমস্ত শুনানি মন দিয়ে শুনেছেন, নোট নিয়েছেন, তিনি এখন ডিফেন্সের আর্গুমেন্ট শোনার আগে ধৈর্য হারিয়ে বসছেন, বারবার বলছেন – আরে এত বলার কী আছে? তাড়াতাড়ি শেষ করুন। আর কত বাকি আছে, মীর সাহাব? সময় কম।
সময় সত্যিই কম। গাজিয়াবাদের স্পেশাল কোর্টের জাজ শ্যাম লাল নভেম্বর মাসের ৬ তারিখে ৬০ বছর পূর্ণ করবেন, নভেম্বর মাসেই তাঁর রিটায়ারমেন্ট। চাইলেই তিনি পরের জাজের হাতে কেসের দায়ভার দিয়ে যেতে পারতেন, কিন্তু তিনি চেয়েছিলেন বিচারকের আসনে বসে থাকা অবস্থায় আরুষি হত্যাকাণ্ডের জাজমেন্ট শুনিয়ে যেতে।
২৪শে নভেম্বর ২০১৩ তনভীর মীরের আর্গুমেন্ট শেষ হয়, ২৫ তারিখে জাস্টিস শ্যাম লাল রাজেশ এবং নূপুরকে দোষী সাব্যস্ত করেন। ২৬ তারিখে তিনি তাঁর ২১০ পাতার রায় পড়ে শোনান – মেয়ে আরুষি আর ভৃত্য হেমরাজকে খুন করার দায়ে দুজনকার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।
রাজেশ আর নূপুর এখনও দিন কাটাচ্ছেন গাজিয়াবাদের প্রান্তে দাসনা জেলে। অ্যাপিল করেছেন গাজিয়াবাদ কোর্টের রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে – কিন্তু কবে তাঁদের কেস হাইকোর্টে উঠবে, তাঁরা নিজেরাও জানেন না। ২০১৪ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী এলাহাবাদ হাইকোর্টে ১৯৮২-৮৩ সালের মামলার শুনানি চলছে। এত বিশাল রাজ্য উত্তরপ্রদেশ, তার এত লাখ লাখ মামলা, ব্যাকলগ প্রতিদিনই বেড়ে চলেছে, কোনও মামলাকে আলাদা করে প্রাধান্য দেবার কোনও ক্ষমতাই নেই কারুর। সুতরাং ২০১৩ সালে জমা হওয়া মামলার পিটিশন আদৌ একুশ শতকের কোনও বছরে সেখানে শুনানির সুযোগ পাবে কিনা, সে উত্তর দিতে পারে একমাত্র ভবিষ্যত।
সিবিআই এবং জিমেল
কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা, সিবিআই। অফিশিয়ালি তারা কোনও কেস টেকআপ করে, অফিশিয়ালি সেই কেসের তদন্ত করে, অভিযুক্ত, সাক্ষী বা অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ লোকেদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। ফোনে, বা ইমেলে। সিবিআইয়ের নিজস্ব সরকারি ইমেল আইডি আছে, নিয়মমতে সমস্ত অফিশিয়াল কাজকর্ম, যেখানে ইমেল করবার দরকার হয়, সেখানে সিবিআই নিজেদের অফিশিয়াল ইমেল আইডিই ব্যবহার করে থাকে। কিন্তু কেসের প্রয়োজনে, অফিশিয়াল কমিউনিকেশন, সিবিআই করছে জিমেল অ্যাকাউন্ট খুলে – এ জিনিস কেউ কখনও শুনেছে বলে মনে হয় না।
সম্ভবত সিবিআই নিজেও শোনে নি। কিন্তু এই ঘটনাই ঘটেছে এই আরুষি হত্যাকাণ্ডের তদন্তে। ২০১০ সালের শেষদিকে, সিবিআই ইনভেস্টিগেটিং অফিসার কৌল মোটামুটি ছক কষেই ফেলেছেন এই ঘটনাকে অনার কিলিং-এর তকমা লাগিয়ে সলভ করতে হবে। সমস্যা হচ্ছে, ক্রিমিনাল কেসে তদন্তের ফলাফল আগেই ভেবে রাখলে সেই অনুযায়ী ঘটনাক্রমকে সাজাতে হয়। এখন সরাসরি তথ্যপ্রমাণ, যেগুলো বা যারা কথা বলে না, যেমন বালিশের ওয়াড়, বিছানার চাদর, কিংবা বোতলে বা গ্লাসে আঙুলের ছাপ, সিঁড়িতে রক্তের দাগ – এদের বয়ান তো বদলে ফেলা যায় না, এরা যে অবস্থায় রেকর্ডেড হয়েছিল, সেইভাবেই রেকর্ডেড থাকে। এর চেয়ে অনেক সহজ, সাক্ষীদের বয়ান বদলে ফেলা। তা, সে ব্যাপারে কৌল খুবই সফল হচ্ছিলেন, একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীদের বয়ান ততদিনে বদল হয়ে আসছিল, কিন্তু কৌল পড়লেন স্বয়ং নূপুর তলওয়ারকে নিয়ে। মৃত আরুষির শরীর ঢাকা ছিল একটি সাদার ওপর গোল ডিজাইন করা চাদর দিয়ে। কৌল সেটিকে দাবি করেন সাদা চাদর, এবং সেই সম্বন্ধে বিস্তারিত গল্প ফাঁদতে গিয়ে তিনি নূপুরের ওপর চাপ দিতে শুরু করেন, যাতে নূপুর স্বীকার করেন, চাদরের ব্যাপারে তিনি কৌলকে আগে “মিথ্যে কথা” বলেছিলেন। নূপুর অস্বীকার করেন – তিনি প্রথম থেকেই চাদরের সঠিক বর্ণনা দিয়েছিলেন, সে চাদর বেশ কয়েকবার টিভি চ্যানেলে দেখানোও হয়ে গেছে, এখন কৌল সাদা বললেই নূপুরকে তা মেনে নিতে হবে কেন? নূপুর পরিষ্কার জানান, তিনি বয়ান বদল করবেন না, তিনি মিথ্যে বলেন নি কখনওই। কৌল, এমনকি নূপুরকে ভয় দেখান যে, তিনি নূপুরের বিরুদ্ধে কুড়িজন সাক্ষী দাঁড় করিয়ে দেবেন নূপুরকে মিথ্যেবাদী প্রমাণিত করার জন্য।
তাতেও নূপুরের বয়ান বদল করতে পারেন নি তিনি। এর পরে কৌল এক নতুন ফন্দী আঁটেন। সিবিআইয়ের ইতিহাসে যা সম্ভবত আগে কখনও হয় নি। hemraj.jalvayuvihar@gmail.com নামে একটি ইমেল অ্যাকাউন্ট খুলে সেইখান থেকে তিনি মেল করতে শুরু করেন রাজেশ এবং নূপুরকে। উদ্দেশ্য মহৎ – সাইকোলজিকাল চাপ তৈরি করে রাজেশ নূপুরকে ফ্যাসাদে ফেলা। এবং, শুধুই মানসিক চাপ তৈরির খেলা নয়, এই বিশেষ জিমেল আইডিটি থেকে সিবিআই তার সমস্ত অফিশিয়াল কমিউনিকেশনও পাঠাত তলওয়ারদের – উদাহরণস্বরূপ, তলওয়ারদের হাজিরার জন্য সমনও পাঠানো হত এই hemraj.jalvayuvihar@gmail.com আইডি থেকে। খুবই মহৎ উদ্দেশ্য, নিঃসন্দেহে – এমন একটি ব্যক্তির নাম নিয়ে তলওয়ারদের মেল পাঠানো হচ্ছে – যে ব্যক্তিটিকে, সিবিআইয়ের সন্দেহ অনুযায়ী তলওয়াররাই খুন করেছেন। উত্তমকুমার অভিনীত ‘শেষ অঙ্ক’ সিনেমাটার কথা মনে আছে? ১৯৭৫ সালে মুক্তি পাওয়া এই বাংলা ছবিটি কৌল দেখেছিলেন কিনা, তা অবশ্য জানা যায় নি।
পয়লা মে ২০১১ সালের ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস কাগজে প্রথম এই ভূতুড়ে ইমেল আইডির রিপোর্ট ছাপা হয়। সিবিআই সাথে সাথে অফিশিয়াল স্টেটমেন্ট দিয়ে সিবিআইয়ের তরফে এই ধরণের কোনও মেল আইডি দিয়ে তলওয়ারদের সাথে যোগাযোগের কথা অস্বীকার করে। এই অস্বীকারের পেছনেও ছিল একটি নিরীহ “টাইপো” – প্রিন্টিং মিসটেক। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের রিপোর্টে ইমেল আইডিটি ভুল করে ছাপা হয়েছিল hemraj.jalvayuvihar.com@gmail.com। এই বাড়তি একটি ডট কম-এর চক্করে সিবিআইয়ের পক্ষে গোটা ঘটনাটা ডিনাই করা, অফিশিয়ালি, অনেক অনেক সহজ হয়ে গেছিল। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস এই টাইপোটি না ঘটালে সিবিআইয়ের কী রেসপন্স হত, তা বোধ হয় আর জানা যাবে না।
কিন্তু সিবিআই স্বীকার করুক বা না করুক, এই আইডি থেকে নিয়মিত মেল আসত রাজেশ আর নূপুর তলওয়ারের কাছে। রাজেশ এই সব মেলের রিপ্লাই করতেন “মিঃ কৌল” নামে। এবং এই মেলের মাধ্যমে হওয়া সমস্ত কমিউনিকেশন কোর্টে একেবারেই লুকোবার চেষ্টা করা হয় নি। শুধু সমন পাঠানো নয়, রাজেশ নূপুরের নারকো টেস্টের জন্য তাদের সম্মতিও চাওয়া হয়েছিল এই মেল আইডির মাধ্যমে। কোর্টে সেই সংক্রান্ত সমস্ত দলিল দস্তাবেজ আজও রাখা আছে।
এই কেসের বাকি সমস্ত অফিশিয়াল কমিউনিকেশন কিন্তু এই জিমেল আইডি থেকে করা হয় নি। আরুষি আর হেমরাজের মোবাইলের কল ডিটেল চেয়ে যে সমস্ত মেল সিবিআই এয়ারটেল আর ভোডাফোনকে পাঠিয়েছিল, সেখানে সিবিআইয়ের অফিশিয়াল মেল @cbi.gov.in দিয়েই ছিল। শুধুমাত্র রাজেশ আর নূপুরের সাথে মেল করা হত এই জিমেল আইডিটি থেকে।
সিবিআইয়ের চিফ ইনফর্মেশন অফিসার ধারিনী মিশ্র বরাবরই অস্বীকার করে এসেছেন যে সিবিআই কখনও জিমেল ইউজ করে অফিশিয়াল কাজকর্ম করতে পারে। অভিরূক যখন ধারিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন, তখনও তিনি অস্বীকার করেই চলেছিলেন, কিন্তু অভিরূক ততদিনে কোর্টের কাগজপত্র অনেকটাই পড়ে ফেলেছেন, এবং যখন তিনি ধারিনীকে জানান যে কোর্টে সিবিআইয়ের পেশ করা ডকুমেন্টে এই ইমেল আইডি জ্বলজ্বল করছে, ধারিনী মিশ্র “দশ মিনিট পরে কল করছি” বলে লাইন কেটে দেন।
দশ মিনিট পরে তিনি কল করেন অভিরূককে – এবং জানান – “Okay, I have spoken to the officers. They say they have used this email ID for some time due to some very special reason.” অভিরূক জানান যে তাঁর এই বয়ান বদল ঠিক কী কারণে সেটা তিনি জানতে ইচ্ছুক, এবং আগে যে তিনি অস্বীকার করছিলেন – সেটা ভুল কিনা। ধারিনী প্রথমে ব্যাপারটাকে তুচ্ছ ঘটনা বলে উড়িয়ে দিতে চেষ্টা করেন, তার পরে অভিরূক যখন বলেন যে তিনি তাঁর বইতে এই ব্যাপারটা নিয়ে লিখবেন, ধারিনী ফোনেই অভিরূককে প্রথমে অনুরোধ করেন না লিখতে, তারপরে ধমক দেওয়া শুরু করেন – আমি মুম্বই মিররকে (অভিরূক যেখানে কাজ করতেন) তোমার নামে কমপ্লেন করব, তারও পরে জানান যে এটা কোনও অফিশিয়াল স্টেটমেন্ট নয় তাঁর তরফে, তাঁর অফিশিয়াল স্টেটমেন্ট তিনি একটু পরেই অভিরূককে এসএমএস এবং ইমেল করে জানিয়ে দেবেন।
মেসেজ এসেছিল। গতানুগতিক ছকে বাঁধাঃ “Regarding your query in the Aarushi case—the matter is sub judice therefore CBI will not comment on court proceedings, evidence in court etc.” এবং “Regarding your query about issuance of summons by e-mail—the same is normally done by official email. In rare occasions, personal or other e-mail ID can be used.”
এর পর একটি নিউজ এজেন্সিকে ফোন করে একটি দু লাইনের স্টেটমেন্ট ইস্যু করে সিবিআই – যে সিবিআই সত্যিই এই মেল আইডিটি বানিয়েছিল তদন্তের স্বার্থে।
তদন্তের স্বার্থে – তাই কোনও প্রশ্ন উচ্চারিত হয় নি। ব্যাপারটি ওখানেই ধামাচাপা পড়ে যায়। কেউ প্রশ্ন করল না, তদন্তের স্বার্থে জিমেল ব্যবহার করে সিবিআই কাউকে সমন পাঠাতে পারে কিনা, নারকো টেস্টের সম্মতি চাইতে পারে কিনা, বিশেষত যে ব্যক্তির খুন নিয়ে তদন্ত চলছে, সেই মৃত ব্যক্তির নামে ইমেল আইডি বানিয়ে কাউকে সেই মৃত ব্যক্তির নাম নিয়ে কারুর সাথে ইমেলে যোগাযোগ করতে পারে কিনা। কোনও প্রশ্নও উঠল না, তাই উত্তরের প্রয়োজনও নেই।
কৌল একা নন, তৎকালীন সিবিআইয়ের ডিরেক্টরও এই মেল আইডি ব্যবহার করেছেন বেশ কয়েকবার, মেলে কপিইড হয়েছেন বেশ কয়েকবার। কৌলের উর্ধ্বতন অফিসার এবং অধস্তন অফিসারও এই মেল আইডি ব্যবহার করে নূপুরের সঙ্গে একাধিকবার বার্তালাপ চালিয়ে গেছেন। সিবিআইয়ের ডিরেক্টর থেকে ইনস্পেক্টর – এতগুলো লেভেলে এই ফেক ইমেল আইডি ব্যবহার করে একটা গুরুত্বপূর্ণ মামলার তদন্ত করার উদাহরণ – আর বোধ হয় একটিও নেই।
কোথাও কোনও সন্দেহ তৈরি হয় নি। যে কাজের জন্য সিবিআইকে কোর্টের কাঠগড়ায় প্রশ্নের মুখে দাঁড় করানো যেত – সেই কাজের জন্য কোনও উকিল, কোনও বিচারক কখনও অবজেকশন তোলেন নি। খুব স্বাভাবিকভাবে উল্লেখ করা হয়েছে বার বার এই মেলের বিভিন্ন বক্তব্য, চার্জশীটে, ক্লোজার রিপোর্টে, আর্গুমেন্টে এবং অন্তিম জাজমেন্টেও। যেন এটাই স্বাভাবিক, এমনটা তো হয়েই থাকে।
সত্যি বলতে, জিমেল ব্যবহার করে কেসের ইনভেস্টিগেশন করার আইনি অধিকার সিবিআইয়ের নেই। এমন কোনও প্রিসিডেন্সও নেই, না আরুষি মামলার আগে, না তার পরে।
মিডিয়া ট্রায়াল
অভিরূক সেনের আরুষি বইটা, শুধুই বিচারের নামে প্রহসনের কথা তুলে ধরে নি। এই বইটা – অভিরূকের নিজের কথায় বলতে গেলে, আজকের ভারতের একটা বহুমাত্রিক প্রতিফলন। এই বইয়ের পাতায় প্রতিফলিত হয়েছে আজ, এই একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকের ভারতের সমাজচিত্র, তার হায়ারার্কি, ভারতের গণতন্ত্রের কয়েকটি প্রধান প্রতিষ্ঠান, যেমন জুডিশিয়ারি, পুলিশ, এ ছাড়াও প্রতিফলিত হয়েছে ভারতের শহর আর গ্রামের বিভাজন, যাকে আমরা বলি ইন্ডিয়া বনাম ভারত, তাদের মধ্যেকার কনফ্লিক্ট, এবং, সবশেষে, ভারতের মিডিয়া। গণতন্ত্রের কাঠামোয় যাদের চতুর্থ স্তম্ভ বলা হয়ে থাকে।
মিডিয়া ট্রায়াল বস্তুটির সঙ্গে আমরা পরিচিত হয়ে গেছি অনেকদিন হল। তদন্ত সঠিক হোক বা বেঠিক, তার গতিপ্রকৃতি যেদিকেই হোক না কেন – মিডিয়া তার নিজের মত করে কাহিনির একটা প্লট বানায়। অ্যামেচার অভিনেতাদের দিয়ে তার “নাট্য-রূপান্তর”ও তৈরি করে, সেগুলো প্রাইম টাইমে টিভির চ্যানেলে বা সকালে খবরের কাগজে গরমাগরম পরিবেশন করা হয়, জনমত বানানো হয়। গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভটি, চতুর্থ স্তম্ভ হবার কারণে অনেক রকমের প্রিভিলেজ ভোগ করে – এই জনমত তৈরি করা এবং নিজেদের পছন্দমত “এক্সপার্ট”দের নিয়ে টিভি চ্যানেলের স্টুডিওতে ক্যাঙারু-কোর্ট বসানো – আজকালকার বেশির ভাগ তথাকথিত নিউজ চ্যানেলদের কাছে এগুলো বেশ জলভাত।
আজ থেকে সাত বছর আগে, ব্যাপারগুলো আজকের তুলনায় একটু বেশিই অপরিশীলিত ছিল। সেই সময়টা ছিল মিডিয়ার পক্ষে একটা বুমিং ফেজ। পর পর বেশ কিছু ট্যাবলয়েড এবং নিউজ চ্যানেল খুলেছিল সেই সময়েই, এবং নিজেদের বাজার তৈরি করতে, টিকিয়ে রাখতে এবং বিস্তৃত করতে এই নিউজ চ্যানেলগুলো যতদূর যা করা সম্ভব, তাইই করত। কোন ঘটনা নিয়ে কত সেনসেশনাল স্টোরি বানানো যায় – তার একটা প্রতিযোগিতা চলত এদের মধ্যে, উদ্দেশ্য, টিআরপি বাড়ানো।
সেই রকমের অবস্থায় কিছু বাজারি মিডিয়া আরুষির গল্পটাকে তুলে নিল। প্রায় চোদ্দ বছর বয়েসের একটি কিশোরীর অস্বাভাবিক মৃত্যু, সঙ্গে একটি চাকরের মৃত্যু – এই প্লটে বিভিন্ন রকমের গল্প হয়। আসুন, আমরা সে রকমের কিছু গল্প জেনে নিই। মিডিয়া এথিকস যাক চুলোয় – ভিউয়ারশিপ আর রিডারশিপ বাড়ানোটাই আসল কথা – তার জন্য যা দরকার সব করতে রাজি এই হঠাৎ বেড়ে যাওয়া মিডিয়াকূল। রহস্যময় হত্যার সঙ্গে যদি একটু সেক্সের চাটনি দেওয়া যায়, তা হলে লোকে দারুণ খায়। সেই সেক্সকে যদি আরও একটু মনের মাধুরী মিশিয়ে বিকৃত যৌনতার রূপ দেওয়া যায়, টিআরপি আরও বাড়ে।
দিল্লির ট্যাবলয়েড “মেল টুডে” – ১৭ই মে ২০০৮এর রিপোর্টে লিখল, স্কুলগার্ল কিলড অ্যাট নয়ডা হোম, ফিঙ্গার অফ সাসপিশন পয়েন্টস অ্যাট মিসিং সারভেন্ট। ১৭ তারিখ সকালে লোকে যখন এই রিপোর্ট পড়ছে, নয়ডার সেই বাড়ির টেরেস থেকে ঠিক তখনই উদ্ধার হচ্ছে হেমরাজের মৃতদেহ, ঘটনার একদিন পরে। মিডিয়া আরও পাগল হয়ে গেল পরের দিন থেকে। জড়িয়ে ফেলা হল ১৫ বছরের একটি কিশোরকে, আরুষির সাথে নাকি তার গোপন প্রণয় ছিল। সেই প্রণয় কতদূর ছিল? শুধুই ফোনকল আর এসএমএস? নাকি দৈহিক?
নয়ডা পুলিশ নিজে কিছু করে উঠতে পারছিল না, এখন তারা খবরের কাগজ দ্বারা পরিচালিত হতে থাকল। এই রিপোর্ট বেরোবার পরে তারা কিশোরটিকে তুলে নিয়ে যায়, সম্ভাব্য অসম্ভাব্য অনেক প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য করা হয় বাচ্চা ছেলেটিকে। তাকে যখন তুলে নিয়ে যাওয়া হয়, তার বাবা-মা-কে জানানোর প্রয়োজনও বোধ করে নি নয়ডা পুলিশ।
এর কিছুদিন পরে নয়ডা পুলিশ রাজেশ আর নূপুরকে তুলে নিয়ে যায় ইনভেস্টিগেশনের জন্য, পেছনে লাইন দিয়ে চলে সারি সারি মিডিয়া ভ্যান। হঠাৎ মাঝপথে তাদের জানানো হয় যে আজ ইনভেস্টিগেশন হবে না। রাজেশ নূপুর, ফিরে আসেন – তাঁদের ফলো করে ফেরে মিডিয়ার ভ্যানেরা। সেদিন টিভিতে দেখানো হয় এসব। সেই ফুটেজ হাতে নিয়ে পরদিন রাজেশকে আবার পুলিশ লাইনে ডেকে পাঠায় নয়ডা পুলিশ। ফুটেজ দেখিয়ে জানানো হয় রাজেশ নাকি পুলিশের হাত থেকে “পালাবার চেষ্টা” করছিলেন। সাধারণত ঠাণ্ডা মাথার রাজেশ, এর পরে মেজাজ হারিয়ে চিৎকার শুরু করেন, তখন নয়ডা পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে, মেয়ে এবং চাকরকে খুন করার অপরাধে। তেইশে মে।
মীরাট রেঞ্জের ইনস্পেক্টর জেনারেল অফ পুলিশ গুরদর্শন সিং, এর পরদিন একটি প্রেস কনফারেন্স করেন। দাবি করেন মামলা শেষ। অভিযুক্ত ধরা পড়ে গেছে। “শ্রুতির বাবা (হ্যাঁ, আইজিপি সাহেব সারা প্রেস কনফারেন্স জুড়ে আরুষিকে ‘শ্রুতি’ বলে উল্লেখ করেছেন, যে মেয়েটির খুনের তদন্ত চালাচ্ছিল তার পুলিশবাহিনি, যে খুনের মামলার প্রেস ব্রিফ দিচ্ছিলেন তিনি, সেই মেয়েটির নামই জানতেন না তিনি) রাজেশ তলওয়ারের একটি বিবাহবহির্ভূত যৌন সম্পর্ক ছিল শ্রুতির এক প্রিয় বন্ধুর মায়ের সঙ্গে। সেই মহিলার নামটিও তিনি উল্লেখ করেন প্রেস কনফারেন্সে – অনিতা দুরানি। ‘শ্রুতি’, বাবার এই এক্সট্রা ম্যারিটাল সম্পর্ক মেনে নিতে না পেরে নিজে একটি অবৈধ সম্পর্ক তৈরি করার কথা ভাবে – তার থেকে বয়েসে অনেক বড় চাকর হেমরাজের সঙ্গে।”
আইজিপি প্রেস কনফারেন্সে বলে চলেন, “ঘটনার রাতে ১১টার সময়ে রাজেশ আরুষির ঘরে ঢুকে আরুষি আর হেমরাজকে আপত্তিজনক অবস্থায় দেখেন। হেমরাজকে তিনি টেনে ছাদে নিয়ে যান, হাতুড়ি আর স্ক্যালপেল দিয়ে খুন করেন। নিচে নেমে তিনি কয়েক পেগ মদ খান, তারপরে নিজের মেয়েকে একইভাবে সম্মানরক্ষার্থে হত্যা (অনার কিলিং) করেন।”
প্রমাণ? হ্যাঁ, প্রমাণ আছে তো! ওই হাতুড়ি আর স্ক্যালপেল পাওয়া যায় নি। তার মানেই অপরাধী ওগুলো হয় নষ্ট করে ফেলেছে নয় তো লুকিয়ে ফেলেছে। এটাই তো অপরাধের প্রমাণ! অপরাধী না হলে তো হাতুড়ি আর স্ক্যালপেল দেখতে পাওয়া যেত!
এক ঢিলে কতগুলো পাখি মারা হয়ে গেল। মৃত মেয়েটি “ক্যারেক্টারলেস” ছিল। তার বাবা ক্যারেক্টারলেস, এমনকি আরও এক মহিলাও ক্যারেক্টারলেস। সেক্স হি সেক্স।
সেদিন আইপিএলের একটা গুরুত্বপূর্ণ খেলা ছিল। কিন্তু টিআরপি বলছে, সেই দিনটিতে বেশি লোক টিভিতে মীরাট রেঞ্জের আইজিপির প্রেস কনফারেন্স দেখছিল, খেলা দেখছিল খুব কম লোক।
মহিলা ও শিশুসুরক্ষা বিষয়ক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রেণুকা চৌধুরী এই প্রেস স্টেটমেন্টের প্রতিবাদ জানান – আইজিপি প্রেস কাউন্সিল গাইডলাইনের সমস্ত নিয়ম লঙ্ঘন করেছেন এই জাতীয় স্টেটমেন্ট দিয়ে। আইজিপি পরদিন তাঁর স্টেটমেন্টে বদল ঘটাতে বাধ্য হন। নতুন থিওরি অনুযায়ী – না, আরুষির সাথে হেমরাজের যৌনগন্ধী সম্পর্ক ছিল না। বাবার যৌন-কেচ্ছার খবরে মানসিকভাবে বিধ্বস্ত আরুষিকে জড়িয়ে ধরে হেমরাজ সান্ত্বনা জানাচ্ছিল – সেই সময়ে রাজেশ এদের দেখে ফেলেন এবং ভুল ধারণা করে – ইত্যাদি ইত্যাদি।
কিন্তু ততক্ষণে যা হবার, তা হয়ে গেছে। যৌনতাবুভুক্ষু মিডিয়া রক্তের স্বাদ পেয়ে গেছে। পর দিন টাইমস অফ ইন্ডিয়ার হেডলাইন হল – ড্যাড কিলড আরুষি। “কুডন্ট টলারেট হার অবজেকশন টু হিজ এক্সট্রাম্যারিটাল অ্যাফেয়ার উইথ ফেলো ডেন্টিস্ট।” এর পরে জানা গেল “অ্যাটাক শো’ড ক্লিনিকাল প্রিসিশন অ্যান্ড প্ল্যানিং”, এবং পরের দিনে হেডলাইন হল – “ডক্টর ডেথ অ্যান্ড হাউস অফ হরর।”
প্রিন্ট মিডিয়াতে যদি টাইমস অফ ইন্ডিয়া, তো ভিজুয়াল মিডিয়াতে জি নিউজ। কেসটি “ক্র্যাক” করা হয়ে গেছে – এই বয়ানে ২৫শে মে জি নিউজ পুলিশের স্টেটমেন্টের একটি নাট্য রূপান্তর দেখালো, কীভাবে রাজেশ আরেকজন মহিলার সঙ্গে “ঢলানি” করছেন, কীভাবে তিনি হেমরাজকে খুন করছেন, আরুষিকে খুন করছেন। আর বার বার দেখানো হচ্ছিল সেক্স, ভায়োলেন্স, ডেথ। যৌনতার লালসা কীভাবে একটি বাচ্চা মেয়েকে শেষ করে দিতে পারে, দর্শকরা সবাই চোখ বিস্ফারিত করে দেখুন।
জি নিউজ একা ছিল না এই লিস্টে। একই গোত্রের আরও বেশ কয়েকটি নিউজ চ্যানেল তাদের নিজস্ব পছন্দমত যৌনতার আচার দিয়ে খবর পরিবেশন করছিল সেই সময়ে – নামকরা সাংবাদিক বীর সাংভি তাঁর কাউন্টারপয়েন্ট কলামে লেখেন একটি ঘটনার কথা, কীভাবে একজন অ্যাঙ্কর, রক্তের ব্যাপ্তি বোঝাতে নিজের হাত লাল রঙের পেন্টে চুবিয়ে ক্যামেরার সামনে তুলে ধরেছিলেন।
নয়ডা পুলিশও চুপ করে বসে ছিল না। এমন একটা রগরগে গল্পের পরে, তারা মিডিয়ার হাতে তুলে দিল আরুষির সমস্ত ব্যক্তিগত টেক্সট মেসেজ, তার সোসাল নেটওয়ার্কিং-এর পাতা, সেখানকার সমস্ত পোস্ট এবং ব্যক্তিগত চ্যাটিং-এর ট্র্যান্সস্ক্রিপ্ট। এমনিতে সেগুলো পড়লে একটি টিনএজ কিশোরীর উচ্ছলতার বাইরে আর কিছুই নজরে পড়ে না, কিন্তু পুলিশের নজর কিনা আলাদা হয়, তাই তারা এর মাধ্যমেই (অনেকবার LOL লেখা ছিল চ্যাটে) মিডিয়াকে বুঝিয়ে ছাড়ল, মেয়েটি জীবদ্দশায় কতখানি ক্যারেক্টারলেস ছিল।
শুধু মিডিয়া চ্যানেল নয়, এন্টারটেনমেন্ট চ্যানেলরাও ঝাঁপিয়ে পড়েছিল আরুষির মৃতদেহের ওপর। একতা কাপুর তাঁর জনপ্রিয় সোপ “কহানি ঘর ঘর কি”তে এই খুনের ঘটনার ওপর একটি স্পেশাল এপিসোড বানান। অবশ্য ন্যাশনাল কমিশন ফর প্রোটেকশন অফ চাইল্ডস রাইটস-এর হস্তক্ষেপে তৎকালীন তথ্য-সম্প্রচারমন্ত্রী প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সী স্টার প্লাস চ্যানেলের সাথে যোগাযোগ করেন এবং তাদের থেকে লিখিত প্রতিশ্রুতি আদায় করেন যে এই আপিসোডটি কখনওই টিভিতে দেখানো হবে না।
পুলিশ দু হাত উপুড় করে মিডিয়ার থলিতে ঢেলে দিচ্ছিল রগরগে কাহিনির রসদ, আর তারা সমানে তলওয়ারদের বারণ করে যাচ্ছিল, মিডিয়ার কাছে মুখ না খুলতে। কিন্তু অবশেষে, নিয়ম ভাঙলেন নূপুর তলওয়ার। ২৫শে মে, সকলের বারণ অগ্রাহ্য করে তিনি এনডিটিভির ইংরেজি চ্যানেলে একটি ইন্টারভিউ দিলেন। উদ্দেশ্য ছিল, নয়ডা পুলিশ এবং মীরাট রেঞ্জের আইজিপি যে অসত্য গল্প ছড়িয়ে বেড়াচ্ছেন মিডিয়া এবং জনগণের কাছে, সেইসব মিথ্যে জনতার সামনে প্রকাশ করা। কিন্তু ফল হল উলটো।
রাজেশ তখন বন্দী। নূপুরকে পুলিশ তখনও পর্যন্ত কোনও সন্দেহই করে নি। কিন্তু নিউজ চ্যানেলে প্রকাশ্যে পুলিশের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দেবার পরে নূপুরকেও সন্দেহের তালিকায় যুক্ত করা হল। নূপুর, মেয়ের মৃত্যুর মাত্র দেড় সপ্তাহের মধ্যে কী করে অত শান্তভাবে ইন্টারভিউ দিলেন? তাঁকে ইন্টারভিউতে একবারও কাঁদতে দেখা গেল না কেন? নূপুরের চোখে জল নেই কেন? এর মানে নূপুর অবশ্যই মেয়ের মৃত্যুতে শোকগ্রস্ত নন! তার মানে তিনিও অপরাধী!!
দেখুন, সেই ইন্টারভিউ।
ও হ্যাঁ, শুধু ইন্টারভিউটা দেখে থেমে যাবেন না, তার নিচে ভিউয়ারদের কমেন্টগুলোও পড়ুন। আজও কমেন্ট যুক্ত হচ্ছে এই ভিডিওর নিচে। গত সাত বছর ধরে। প্রথম দিনের মতই – আজও অধিকাংশ দর্শক শ্রোতাদের মূল বক্তব্য ছিল – এবং, আছে, একই রকমের – নূপুর তলওয়ার ইমোশনলেস, ফেক। অতএব, অবশ্যই খুনী।
এর কিছুদিন পরেই উত্তর প্রদেশের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী মায়াবতী এই কেস সিবিআইয়ের হাতে সঁপে দেন। কিন্তু সেক্স নিয়ে চর্চা তাতে বাড়ল বই কমল না। আইজিপি-র স্টেটমেন্ট শুধু রাজেশ তলওয়ারের বিয়ে-বহির্ভূত সম্পর্কেই সীমাবদ্ধ ছিল, এর পরে পুলিশ, মিডিয়া এবং ট্যাবলয়েডদের দৌলতে জানা যাবে রাজেশ নূপুর গ্রুপ-সেক্সে জড়িত ছিলেন, বিভিন্ন ধরণের অর্গি-পার্টিতে তাঁরা নিয়মিতই যেতেন, শুধু তাই নয়, জানা যাবে চোদ্দ বছরের আরুষিরও একাধিক “বয়ফ্রেন্ড” ছিল। এমনকি আরুষি আদৌ রাজেশ আর নূপুরের “বায়োলজিকাল” সন্তান ছিল কিনা, সে প্রশ্নও উঠতে শুরু করবে, আর সহ্য করতে না পেরে বীর সাংভি আবার কলম ধরেন, পুলিশের উদ্দেশ্যে চাঁচাছোলা ভাষায় লেখেন, এই পুলিশ গল্প বানাতে ওস্তাদ আর এদের সমস্ত গল্পেই অদ্ভূতভাবে সেক্সের অ্যাঙ্গল চলে আসে। এরা যে শুধু অকর্মণ্য পুলিশ – তাইই নয়, এরা আসলে যৌনবুভুক্ষু, সেক্স-স্টার্ভড। বিশেষত আইজিপি মহাশয়ের কোনও স্পেশালিস্ট ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া খুবই দরকার।
“Most worrying of all is the IGP’s obsession with sex. Every possible motive leads back to sex. First, there was the extraordinary statement that Rajesh Talwar found his daughter in an objectionable position with Hemraj, the servant. As Aarushi and Hemraj are dead, and Rajesh Talwar denies the incident how could the IGP possibly have known about the incident? Then there’s the suggestion that Rajesh Talwar was having an affair with a colleague and that his daughter objected; off the record, the police have painted the parents as orgy goers and wife swappers. And now, the cops are claiming that the father was motivated by Aarushi’s relations with various boyfriends.
This is not a sex crime. So why is the Noida police going on and on about sex, ruining the reputations of the dead and the living without a shred of evidence? My guess is that they are not just incompetent, they are also sex starved. Perhaps the IGP needs professional help.”
মিডিয়া যেমন খোলা বাজারে প্রকাশ্যে কারুর জামাকাপড় খুলে নেবার ব্যাপারে এক সেকেন্ডও সময় লাগায় না, তেমনি পালটি খেতেও ওই … এক রাতের বেশি সময় লাগায় না। পয়লা জুন মায়াবতী কেস সিবিআইয়ের হাতে দিয়ে দেন, পরের দিন ওই একই মিডিয়া হেডলাইন বানায় – নয়ডা পুলিশ থিওরি ট্র্যাশড্। কিন্তু সিবিআই দায়িত্ব নিলেও কি মৃতদেহ নিয়ে ব্যবসা থেমে থাকে? একইসঙ্গে বাজারে স্পেকুলেশন ছড়াতে থাকে, তলওয়ারদের পলিটিকাল স্ট্রংহোল্ড আছে, নইলে কি আর মায়াবতী ওদের কথা ভেবে সিবিআইকে কেস দেন? ওই যে নূপুর তলওয়ার, উনি মায়াবতীর দাঁতের চিকিৎসা করতেন, মায়াবতী ওঁর খুব পরিচিত।
নূপুর, অন্য একজন সিনিয়র ডেন্টিস্ট ডক্টর সিদ্ধার্থ মেহতার সার্জিকাল অ্যাসিস্ট্যান্ট ছিলেন। ডক্টর মেহতা একসময়ে মায়াবতীর দাঁতের চিকিৎসা করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু সেই সময়ে নূপুর তাঁর অ্যাসিস্টেন্ট ছিলেন না। নূপুর মায়াবতীকে কখনও চোখেও দেখেন নি, চেনা তো পরের কথা।
হিন্দুস্তান টাইমস এই সময়ে দেশের ছটি বড় বড় শহরে এই কেসের ব্যাপারে একটি সার্ভে চালায়। সার্ভের রেজাল্ট জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহে প্রকাশিত হয়।
নব্বই শতাংশ লোক মনে করেছিল, মিডিয়া কেসটা নিয়ে “অবসেসড”।
পঁচাত্তর শতাংশ লোক জানিয়েছিল, তারা কেসটা নিয়মিত ফলো করছে, মিডিয়ার মাধ্যমে।
পঁচাত্তর শতাংশ লোক এ-ও মনে করছিল, মিডিয়াই আগেভাগে রাজেশ তলওয়ারকে দোষী বানিয়ে দিয়েছে।
চৌষট্টি শতাংশ লোক মনে করছিল, মিডিয়ার এই অত্যধিক কভারেজ, তদন্ত এবং আদালতের বিচারপ্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করবে।
এক মাসের মধ্যে একটা পরিবারের, কয়েকটা মানুষের বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম যতটা সম্মান পাওয়া দরকারি, সেটাও হারিয়ে ফেলেছিলেন তলওয়ারেরা। রাজেশকে একাধিকবার লাই ডিটেক্টর টেস্টে বসতে হয়, প্রতিবারই তিনি নির্দোষ হিসেবে সাব্যস্ত হন, কিন্তু মিডিয়া তাঁকে ভিলেন বানাতে ছাড়ে নি এক দিনের জন্যেও। মুম্বইয়ের জনপ্রিয় ট্যাবলয়েড মিড-ডে জুন মাসের শেষে এক “গোপন সূত্রে পাওয়া খবর” অনুযায়ী রিপোর্ট প্রকাশ করে, তলওয়ার দম্পতি নিয়মিত সেক্স-পার্টিতে যেতেন, ওয়াইফ-সোয়্যাপিং-এর খেলা খেলতেন অন্যান্য পুরুষদের সঙ্গে। তলওয়ারের প্রতিবেশিরা “নাকি” অনেকদিন আগে থেকেই “আন্দাজ” করতেন, তলওয়ারদের বাড়িতে বিশেষ ধরণের পার্টি চলছে, আর যখন পার্টি “চলত” – আরুষিকে নাকি একটা ঘরে লক্ করে রাখা হত।
এই কাহিনি মিড-ডে থেকে হাত ঘুরে পৌঁছয় হেডলাইনস টুডে-তে, তার পরে আজ তক, জি নিউজ এর আবার একটা নাট্য রূপান্তর তৈরি করে দেখিয়েও দেয়, সেখান থেকে খবরটা ছাপা হয় মেইল টুডে-তে – ততক্ষণে চাল হয়ে গেছে বিরিয়ানি। খবরের সোর্স হিসেবে সেখানে লেখা হয়েছে সিবিআইয়ের নাম।
বিধ্বস্ত নূপুর, এর পরে সিবিআইকে চিঠি লেখেন এর সত্যতা জানতে চেয়ে। সিবিআই অফিশিয়ালি লিখে জানায়, তারা এ ধরণের কোনও খবর কোনও চ্যানেল বা ট্যাবলয়েডকে পাঠায় নি।
সিবিআইয়ের এই অফিশিয়াল উত্তরটা অবশ্য, কোনও চ্যানেলে এর পরে দেখানো হয় নি। কোনও কাগজে ছাপানো হয় নি। ক্যারেক্টার অ্যাসাসিনেশন এর পরেও চলতে থেকেছে। আজও চলছে। অভিযুক্ত বা সন্দেহের তালিকায় থাকা কোনও ব্যক্তির ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট তৈরি করে দেওয়া, সম্ভবত আজও, মিডিয়ার অন্যতম ফেভারিট টাইমপাস।
এর পর পরের পর্বে