মুখ্য চরিত্রে
দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে চলা এই ঘটনার তদন্তপ্রক্রিয়ায় বেশ কিছু মুখ উঠে এসেছে, যাদের সম্বন্ধে অভিরূক যথাসম্ভব বিস্তারিত তথ্য জোগাড় করেছেন এই বইতে, যেখানে সম্ভব হয়েছে, সেখানে অভিরূক নিজে গিয়ে কথা বলেছেন সেইসব ব্যক্তিদের সঙ্গে। এই মুখগুলি মূলত কয়েকটা ক্যাটাগরিতে বিভক্ত, এক, যাঁরা বিচারপ্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত, দুই, যাঁরা তদন্তপ্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত, আর তিন, বাকিরা – যাঁরা অভিযুক্ত, যাঁরা সাক্ষী, যাঁরা কোনও না কোনওভাবে এই কেসের সঙ্গে যুক্ত। আমরা তাদের কয়েকজনকে নিয়ে আলোচনা করব এখানে।
১। ভারতী মণ্ডল – নয়ডার একটি তত-পশ-নয় সেক্টরের এক বস্তির বাসিন্দা। বিভিন্ন লোকের বাড়িতে ঘর পরিষ্কার করা, বাসন মাজা ইত্যাদি দৈনিক কাজকর্ম করে – যাদেরকে আমরা বলি “ঠিকে কাজের লোক”। ভারতী ছিল আরুষির মৃতদেহের প্রথম সাক্ষী। ভোরবেলা কাজ করতে এসে সে অন্যান্য দিনের মতই তলওয়ারদের দরজাতে নক্ করে ডাকে। সাধারণত হেমরাজ দরজা খুলে দেয়, কিন্তু সেদিন নূপুর তলওয়ার দরজা খুলতে গিয়ে টের পান যে – বাইরের দরজাটা বাইরের দিক থেকে লক করা। প্রথমে নূপুর এবং ভারতী ভাবেন যে হেমরাজ নিশ্চয়ই মাদার ডেয়ারি থেকে দুধ আনতে বেরিয়েছে, দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে। ভারতী নূপুরকে জানায় যে সে নিচে যাচ্ছে – নূপুর যেন ব্যালকনি থেকে তাকে চাবিটা ছুঁড়ে দেন। এর পরে চাবি নিয়ে উঠে দরজা খুলে ভারতী তলওয়ারদের ঘরে ঢুকে দেখে, শ্রীমতি তলওয়ার প্রচণ্ড কান্নাকাটি করছেন, ভারতী হতবাক হয়ে কারণ জিজ্ঞেস করাতে নূপুর তাকে নিয়ে আরুষির বেডরুমে নিয়ে গিয়ে দেখান আরুষির মৃতদেহ। নূপুরও মাত্র তখনই মৃতদেহটা আবিষ্কার করেছিলেন। আরুষির গলা কাটা ছিল, মাথার একটা দিক ভারি কিছুর আঘাতে থেঁতলে দেওয়া ছিল।
প্রথম প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে ভারতীকে এরপরে অসংখ্যবার তুলে নিয়ে যায় পুলিশ, তার বয়ান লিপিবদ্ধ করানো হয়। এবং, অদ্ভুতভাবে পরে সিবিআইয়ের রিপোর্টে ভারতীর এই “দরজা বাইরে থেকে বন্ধ ছিল” বয়ান আমূল পালটে যায়, সিকোয়েন্স এমনভাবে প্রেজেন্ট করা হয় তার বয়ানের মাধ্যমে যে পরিবর্তিত বয়ানে জানা যায়, বাইরের দরজাটা খোলাই ছিল, ভারতীকে চাবি দিয়ে খুলতে হয় নি, বাড়ির ভেতরের দিকের দরজা আর মাঝে আরেকটা দরজা ভেতর থেকেই বন্ধ ছিল – অর্থাৎ বাইরে থেকে কেউই আসে নি আরুষিদের বাড়িতে।
পরে ভারতীর সঙ্গে বিস্তারিত কথা বলেন অভিরূক। ভারতী, কাজের সন্ধানে এসেছিল মালদা থেকে। যেমন প্রতি বছর অসংখ্য বাঙলাভাষী চলে আসে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলা থেকে। ভারতী নিরক্ষর। সে তার প্রথম বয়ানও পড়তে পারে নি, পরের বয়ানও নয়। সে শুধু তার বক্তব্য জানিয়েছিল পুলিশকে, সিবিআইকে, একাধিকবার। কিন্তু পুলিশ বা সিবিআই কী লিখেছিল, তা সে জানে না। সাক্ষী হিসেবেও তাকে যখনই কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছিল, সিবিআইয়ের উকিল তাকে জেরা করত, তাকে আগে থেকেই শিখিয়ে পড়িয়ে দেওয়া হত কী কী প্রশ্ন করা হবে আর তার কী উত্তর দিতে হবে। এইজন্য জবানবন্দী দেবার সময়ে সে কোর্টে বলেছিল – “আমাকে যা শেখানো হয়েছে, আমি শুধু তাইই বলব”।
আইন আদালত সম্পর্কে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ এই মহিলাটি এর পরে বুঝতেও পারে নি, এর প্রথম বয়ানের “তালা খুলে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢোকা”-র ঘটনা এইভাবেই কখন “দরজা ঠেলে ভেতরে ঢোকা” হয়ে গেছে। পরে সে লোকমুখে জানতে পারে, মূলত তার সাক্ষ্যের ভিত্তিতেই তলওয়ারদের যাবজ্জীবনের শাস্তি হয়েছে।
২। কে কে গৌতম – নয়ডার জনৈক রিটায়ার্ড পুলিশ অফিসার। সারাজীবন পুলিশে কাজ করার সুবাদে তিনি প্রচুর লোককে চিনতেন, বিভিন্ন লেভেলের। চেনাপরিচিতির সুবাদে এঁর কিঞ্চিত পরোপকারের নেশা আছে। সামান্য হিন্ট পেলেই তিনি অকুস্থলে পৌঁছে যান উদ্দিষ্ট ব্যক্তিকে “সাহায্য” করতে। মূলত এঁর পুলিশি দৃষ্টিতে ধরা পড়ে যে টেরেসের তালাটা দুদিনেও ভাঙা হয় নি, এবং টেরেসের সিঁড়ির রেলিং-এ রক্তের দাগ লেগে। অভিরূকের সঙ্গে কথা বলার সময়েও এই পয়েন্টটা বার বার তিনি কনফার্ম করেছিলেন – সিঁড়িতে কোনও রক্তের দাগ ছিল না, কেবল দাগ ছিল সিঁড়ির রেলিং-এ। এঁর উদ্যোগেই টেরেসের তালা দ্বিতীয় দিনে ভাঙা হয় এবং হেমরাজের মৃতদেহ ইনিই প্রথম দেখতে পান, যা আগের দিন থেকে নয়ডা পুলিশ উদ্ধার করতে পারে নি। টেরেস না খুললেও রেলিং-এ এই রক্তের দাগ নয়ডা পুলিশ দেখতে পায় নি বা তার স্যাম্পল নেবার চেষ্টা করে নি।
অভিরূকের সঙ্গে কথোপকথনে এই কেসের অনেক লজিকাল পয়েন্ট তুলে ধরেন শ্রী গৌতম – যা রাজেশ বা নূপুরকে সন্দেহের তালিকা থেকে বাইরে রাখতে পারত। কিন্তু এই কেসে তিনি সরাসরি যুক্ত ছিলেন না কখনওই – না নয়ডা পুলিশের তরফে, না সিবিআইয়ের তরফে। সিবিআই শুধু “উইটনেস” হিসেবে তাঁর সাক্ষ্য নেয়, যে সাক্ষ্যের বয়ান পরে বিপুলভাবে বদলে যায় সিবিআইয়ের দস্তাবেজে।
কেন তিনি পরে বয়ান বদল করেছিলেন? প্রশ্নের উত্তরে অভিজ্ঞ প্রাক্তন পুলিশ অফিসারটি চুপ করে যান।
I asked him whether he was under pressure from Kaul to change his testimony because Kaul had some personal information on him.
Gautam gave me another long look. ‘It is best we don’t discuss this.’
‘So were you put under pressure?’
‘Why not drop this subject?’
‘It is important that I know from you.’
‘You know everything already. Please let us not discuss this anymore.’
৩। বিজয় মণ্ডল, কৃষ্ণা এবং রাজকুমার – নয়ডা জলবায়ু বিহার এলাকার অন্যান্য কিছু বাড়ির কাজের লোক। হেমরাজের সঙ্গী। প্রাথমিক সন্দেহের তালিকায় এদের নাম ছিল। নয়ডা পুলিশ এদের তুলে নিয়ে যায়। পরে এদের নারকোঅ্যানালিসিস এবং পলিগ্রাফ টেস্টও হয়। দুজনকার বয়ানই কমবেশি একই রকম ছিল, হেমরাজের সঙ্গে তারা হেমরাজের ঘরে বসে মদ খাচ্ছিল, এর পরে কোনও বিষয় নিয়ে ঝগড়া হয়, হেমরাজকে টেরেসে নিয়ে গিয়ে কৃষ্ণা কুকরি দিয়ে হেমরাজের গলা কেটে ফাঁক করে দেয়, তার পরে মাথা ভেঙে দেয়। এর পরে মাতাল অবস্থায় তারা আরুষির ঘরে হানা দেয়। আরুষির ঘরের দরজা বাইরে থেকে বন্ধ ছিল, কিন্তু বাইরের ঘরের একটি কমন বাথরুমের দ্বিতীয় দরজা খুলে আরুষির ঘরে সহজেই পৌঁছে যাওয়া যেত, এটা কৃষ্ণা আর রাজকুমার জানত, সেভাবেই তারা আরুষির ঘরে ঢোকে এবং তাকে ধর্ষণ করতে যায়, আরুষি জেগে উঠে বাধা দেয়, কিন্তু সে চীৎকার করে ওঠার আগেই কুকরি দিয়ে আরুষিরও গলা কেটে, একইভাবে তার মাথাতেও ভারী অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে তাকে মেরে ফেলা হয়। পাশের ঘরে ঘুমিয়ে থাকা রাজেশ আর নূপুর তলওয়ার এর কিছুই বুঝতে পারেন নি সারারাতে।
কুকরি পাওয়া যায় রাজকুমারের ঘর থেকে, হেমরাজের রক্তমাখা বালিশের ওয়াড় উদ্ধার হয় কৃষ্ণার ঘর থেকে, এবং তিনটে গ্লাসও পাওয়া যায় হেমরাজের ঘর থেকে, যেখানে বসে সে কৃষ্ণা আর রাজকুমারের সঙ্গে মদ খেয়েছিল বলে এরা জানিয়েছিল। গ্লাসগুলোর কোনও ফরেনসিক টেস্ট হয় নি, বালিশের ওয়াড় সিবিআইয়ের হাতসাফাইয়ে পরে ডকুমেন্টেড হয় “আরুষির ঘর থেকে উদ্ধার হওয়া” জিনিস হিসেবে।
রাজকুমারের নজর পড়েছিল আরুষির ওপর – সে আরুষিকে কামনা করত। পনেরোই মে-র রাতে হেমরাজকে অনুরোধ করেছিল সে – “সেটিং” করিয়ে দেবার জন্য, কিন্তু ছেচল্লিশ বছর বয়স্ক হেমরাজ সরাসরি জানিয়েছিল, আরুষি তার মেয়ের মত, আরুষির কোনও ক্ষতি সে বরদাস্ত করবে না। এর পরেই ঝগড়া বাড়ে এবং হেমরাজ খুন হয়।
খুনের রাতে সরানো আরুষির মোবাইল এর বেশ কিছুদিন পরে একজনের কাছে পাওয়া যায়, সে জানায় মোবাইলটা একটা পার্কে পড়ে থাকতে দেখেছিল সে।
হেমরাজের মোবাইল, খুনের ঘটনার বেশ কয়েক মাস পরে পাঞ্জাবে অ্যাকটিভেটেড অবস্থায় ট্রেস করা হয়। কিন্তু পুলিশ বা সিবিআই – কেউই সেই মোবাইল নিয়ে আর মাথা ঘামায় নি – হয় তো কোনও ক্লু বেরোতেও পারত, কিন্তু কেউ আর হেমরাজের মোবাইল নিয়ে মাথা ঘামায় নি। হেমরাজের মোবাইল সিবিআইয়ের আর দরকার ছিল না হয় তো।
গ্রেফতার করার কয়েক মাসের মধ্যেও পুলিশ বা সিবিআই কৃষ্ণা আর রাজকুমারের নামে চার্জশীট ফাইল করতে অক্ষম হয়, ফলে সেপ্টেম্বর মাসে এরা দুজনেই ছাড়া পেয়ে যায়। পরে গাজিয়াবাদের স্পেশাল কোর্টে তলওয়াররা বার বার অনুরোধ করেন ওদের পলিগ্রাফ আর নারকোঅ্যানালিসিস টেস্টের রেজাল্ট আদালতে পেশ করবার অনুমতি চেয়ে, কিন্তু কোনও কোর্ট তাদের সেই অনুমতি দেয় নি, বরং জানানো হয়েছে, এইভাবে বার বার এই রিপোর্ট ওই রিপোর্ট চেয়ে চেয়ে তলওয়ারেরা ইচ্ছে করে কেসটায় ডিলে ঘটাচ্ছেন, আদালতের মূল্যবান সময় নষ্ট করছেন। গাজিয়াবাদ কোর্ট, এলাহাবাদ হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট, তিন জায়গা থেকে একই উত্তর আসে। কৃষ্ণা আর রাজকুমারের জবানবন্দীর রিপোর্ট তলওয়ারেরা ট্রায়াল চলাকালীন কখনওই হাতে পান নি।
ছাড়া পাবার পরেই কৃষ্ণা, বিজয় আর রাজকুমার অ্যাবস্কন্ডিং হয়ে যায়, তাদের আর ট্রেস করা যায় নি। কৃষ্ণা আর রাজকুমার সম্ভবত নেপাল চলে গেছে, বিজয়ের খবর জানা যায় নি একেবারেই। তাদের আর কেউই ট্রেস করার চেষ্টা করে নি।
৪। এ জি এল কৌল – সম্ভবত আরুষির ঘটনায় সবচেয়ে অন্ধকার চরিত্র। সিবিআইয়ের ইনস্পেক্টর কৌল আরুষি তদন্ত হাতে নেন ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে, এবং বিচারের শেষ রায় বেরোনর দিন পর্যন্ত তিনি এই কেসের সাথে যুক্ত ছিলেন। ইনিই সম্ভবত একমাত্র ব্যক্তি, যিনি কোনও না কোনও সময়ে বাকি সমস্ত চরিত্রদের সাথে যুক্ত হয়েছেন বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন উদ্দেশ্যে। সাক্ষী, পুলিশ, ফরেনসিক এক্সপার্ট, বিচারক, উকিল, অভিযুক্ত, প্রমাণাভাবে মুক্ত, সমস্ত চরিত্রের সাথে এই কৌল কোনও না কোনও ভাবে যুক্ত ছিলেন। সিবিআই, যে প্রতিষ্ঠানের নামটার ওপর আপামর ভারতের মানুষ প্রায় অন্ধভাবে ভরসা করে, সেই সিবিআই আসলে কীভাবে চালিত হয়, তা আমাদের হাতে ধরে দেখিয়ে দেন শ্রী কৌল।
সিবিআইয়ের ভেতরে কৌলের রেপুটেশন খুব একটা ভালো ছিল না। সিবিআই যেহেতু সবসময়েই হাই প্রোফাইল এবং হাইলি সেন্সিটিভ কেস নিয়ে নাড়াচাড়া করে, এই সংস্থার অফিসারদের অনেকেই বিশেষ কিছু ইনফ্লুয়েনশিয়াল লোকের আওতায় চলে আসেন, বিশ্বাস্য অবিশ্বাস্য অনেক রকমের অফার আসে তাঁদের কাছে, সম্ভাব্য অভিযুক্তকে বাঁচানোর জন্য, বা তার বদলে অন্য কাউকে স্কেপগোট বানানোর জন্য। সিবিআই সে ব্যাপারে জানে না, তা নয়, এর জন্য, সিবিআইয়ের ভেতরেই এই অফিসারদের ওপর বিশেষ নজর রাখা হয়, এদের সমস্ত কার্যকলাপের একটা লিস্ট মেনটেন করতে থাকা হয়। এই লিস্টের নাম হল ওডিআই – অফিসার্স অফ ডাউটফুল ইন্টিগ্রিটি।
কৌল সর্বদাই এই ওডিআই লিস্টে ছিলেন, তাঁর সিবিআই কর্মজীবনে। দু দুবার তাঁর প্রাপ্য প্রমোশন থেকে তিনি বঞ্চিত হয়েছেন, তাঁর বিরুদ্ধে আসা কনফিডেনশিয়াল রিপোর্টের ভিত্তিতে। এই ব্যক্তিটি নিজে সিবিআইয়ের ভেতরেও খুব একটা জনপ্রিয় ছিলেন না। আরুষির কেস হাতে নেবার কিছুদিন আগেই কৌলের নামে একটি ডাউরি ডেথের কেসে অভিযুক্তদের বাঁচানোর জন্য তাদের থেকে মোটা টাকা নেবার অভিযোগ জমা পড়েছিল সিবিআইয়ের কাছে। সাধারণভাবে এই ধরণের লোকেদের চাকরি চলে যাওয়া স্বাভাবিক, কিন্তু সিবিআই ঠিক প্রচলিত ধারণার ভিত্তিতে চলে না। এই ধরণের লোকেদেরও দরকার হয় বৈকি তদন্তের ক্ষেত্রে, বিশেষত কৌলের একটি রেপুটেশন ছিল উনি যে কোনও কেস হাতে নিলে, তা ‘ক্লোজ’ করে ছাড়তেন, যেভাবেই হোক।
কৌলের পছন্দের বিষয় ছিল, সেক্স। তিনি জানতেন একটি খুনের কেসের সঙ্গে সঠিক পরিমাণে সেক্সের গল্প জুড়ে দিতে পারলে মিডিয়াও খুউব খুশি হয়, কেস ক্লোজ করতেও সুবিধে হয়। মধ্যপ্রদেশের ভোপালে মানবাধিকার কর্মী শেহ্লা মাসুদের হত্যাকাণ্ডের কথা মনে আছে নিশ্চয়ই অনেকের। সিবিআইয়ের তরফে এই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করেছিলেন কৌল। তদন্তভার হাতে নেবার দুদিনের মধ্যেই আপাত-অভিযুক্ত জাহিদা পারভেজের একটি গোপন ডায়েরি মিডিয়ার হাতে চলে আসে, যাতে জাহিদা, শেহ্লা এবং এক রাজনীতিকের ত্রিকোণ প্রেমের সম্পর্কের ইঙ্গিত ছিল। কৌল তাতে যোগ করেন যৌনতার চাটনি এবং সবচেয়ে খুশি হয় মিডিয়া।
এ রকম আরও মণিমুক্তো রয়েছে কৌলের কেরিয়ার জুড়ে। কৌলের সুপিরিয়ররাও তাঁকে চিনতেন ভালো করেই। সমসাময়িক নয়ডার নিঠারি হত্যাকাণ্ডের মামলাও সিবিআই যখন হাতে নেয়, কৌলকে সেই তদন্তে একটা সামান্য রোল দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কৌলকে সুচারুভাবে কাজে লাগানো হয় আরুষির মামলায়, কৌলের এই বিশেষ বিশেষ বিষয়গুলোতে পারদর্শিতার জন্যেই। সিবিআই ততদিনে ক্লুলেস হয়ে গেছে। প্রাথমিক তথ্যপ্রমাণ যা পাওয়া যেতে পারত তলওয়ারদের বাড়ি থেকে, নয়ডা পুলিশের অকর্মণ্যতায় তার বেশির ভাগই নষ্ট হয়ে গেছে। তখনও পর্যন্ত সন্দেহের তালিকায় থাকা পাড়ার কাজের লোক – কৃষ্ণা আর রাজকুমার ছাড়া পাবার পর থেকেই নিরুদ্দেশ, এই অবস্থায় সমাধানসূত্র খুঁজে আসল অপরাধীকে ধরা সিবিআইয়ের কাছে প্রায় অসম্ভব মনে হয়েছিল। অতএব, কেস যেভাবেই হোক, ‘ক্লোজ’ করা জরুরি ছিল। তো, ক্লোজ করার ব্যাপারে সিবিআইয়ে সবচেয়ে পারদর্শী আর কে হতে পারেন, এ জি এল কৌল ছাড়া?
কৌল তাঁর নাম রেখেছিলেন। দু দুবার প্রমোশন মিস হয়ে যাওয়া কৌলের কাছে সফলভাবে একটা কেস ক্লোজ করা, চ্যালেঞ্জের মত ছিল। সেই চ্যালেঞ্জ তিনি জিতে গেছেন। মৃত হেমরাজের নামে জিমেল আইডি তৈরি করে তাই দিয়ে তলওয়ারদের সঙ্গে কমিউনিকেশন চালানো, অনার কিলিং-এর তত্ত্ব খাড়া করা এবং তা প্রমাণ করবার জন্য সমস্ত রকমভাবে তদন্তকে প্রভাবিত করা, সাক্ষীদের বয়ান পালটানো (আরেকবার পড়ে দেখুন কে কে গৌতমের শেষ কথাগুলো), এমনকি ফরেনসিক ল্যাবে গিয়ে রাতারাতি দুটো বালিশের ওয়াড় অদলবদল করে ফেলা, – যার প্রভাবে গোটা কাহিনিটাই অন্য মোড় নিয়ে নিয়েছিল এবং রাজেশ নূপুরকে কনভিক্ট করা আদালতের পক্ষে সহজ হয়েছিল – প্রতিটা ব্যাপারে হাত ছিল এই কৌলের। কৌলের বিরুদ্ধে আঙুল তুলতে সিবিআইয়ের পে-রোলের লোকেরা সাহস পেতেন না, সঙ্গত কারণেই রিটায়ারমেন্টের পর, আরুষি মামলা শেষ হয়ে যাবার পরেও গৌতম সরাসরি কৌলের নাম নিতে সাহস পান নি। সাহস পান নি ফরেনসিক ল্যাবের অধিকর্তাও।
প্রসঙ্গত, কৌল এই তদন্তের দায়িত্বভার নেবার কিছুদিন পরেই জানা যায় হেমরাজের ফোন পাঞ্জাবে চালু থাকার কথা। কৌল নিজেই এই তথ্যটি জানিয়েছিলেন। অথচ, পরে যখন সংশ্লিষ্ট সার্ভিস প্রোভাইডারের প্রতিনিধি আদালতে বয়ান দিতে আসেন, প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানা যে হেমরাজের ফোন ট্রেস করার জন্য সিবিআইয়ের তরফে তাঁদের কাছে কোনও অনুরোধই করা হয় নি।
২০১৪ সালের অক্টোবর মাসে, অভিরূক যখন এই বই সদ্য লিখে শেষ করেছেন, এ জি এল কৌল হঠাৎ হার্ট অ্যাটাকে মারা যান।
৫। জাস্টিস শ্যাম লাল – সম্ভবত আরুষি হত্যাকাণ্ড মামলার সঙ্গে জড়িত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, এবং একইসঙ্গে একটি ইন্টারেস্টিং চরিত্র। গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে, গাজিয়াবাদের স্পেশাল কোর্টে ইনিই দীর্ঘ এক বছর ধরে এই কেসের সমস্ত পক্ষের তথ্য প্রমাণ সাক্ষ্য ইত্যাদি শুনেছেন, দেখেছেন, বিবেচনা করেছেন, এবং শেষে রাজেশ আর নূপুর তলওয়ারকে দোষী সাব্যস্ত করে ২১০ পাতার একটি রায় দেন, যাতে দুই অভিযুক্তের জন্য শাস্তি ছিলঃ যাবজ্জীবন কারাবাস।
শ্যাম লালের একটি নিকনেম চালু ছিল গাজিয়াবাদের আদালতে। সাজা লাল। দীর্ঘ বিচারকজীবনে, কখনও কোনও অভিযুক্তই নাকি তাঁর বিচারপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে মুক্তি পায় নি। প্রত্যেকেই শাস্তি পেয়েছে তাঁর জাজমেন্টে। শ্যাম লাল নিজে যদিও দাবি করেন অনেকেই তাঁর রায়ে মুক্তি পেয়েছেন বা নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছেন, কিন্তু এ রকম একটা কেসের রেফারেন্সও তিনি দিতে পারেন নি। আরুষি হত্যাকাণ্ডের কেস তাঁর কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল সম্ভবত এই কারণে, ন্যায় প্রদানের থেকেও এই কেসে তাঁর কাছে জরুরি ছিল এই কেসের দায়িত্ব শেষ পর্যন্ত পালন করে ইতিহাসের পাতায় নিজের নাম তোলার। “শেষ পর্যন্ত” কথাটি অবশ্যই ব্যঞ্জনামূলক, কারণ, শেষ করার জন্য কোনও চাপ তাঁর ওপর ছিল না, চাপটা ছিল তাঁর নিজের কাছেই। আরুষি হত্যার রায় প্রকাশের ছদিন পরেই শ্যাম লাল অবসর নেন। দেশের সমস্ত মিডিয়া যখন গভীর আগ্রহের সঙ্গে এই কেসটা ফলো করছিল, একটা সঠিক বিচার হওয়া খুব দরকার ছিল, কিন্তু শ্যাম লালের হাতে বেশি সময় ছিল না। অবসর নেবার আগেই তাঁকে মামলার শুনানি শেষ করে জাজমেন্ট শুনিয়ে যেতে হত। শ্যাম লাল চাইলেই কেসটি আরও শুনানির জন্য পরবর্তী বিচারকের হাতে ছেড়ে যেতে পারতেন, শেষ করার জন্য কোনও চাপ ছিল না, কিন্তু তিনি সে পথে হাঁটেন নি।
অবসর নেবার পরের দিনই তিনি নিজের বাড়িতে ফিরে যান। অসংখ্য মিডিয়া তাঁর সাক্ষাৎকার নিতে চেয়েছিল এর পরে – কিন্তু তিনি একটি ইন্টারভিউও দেন নি অবসর নেবার পর দিন থেকে। একটিও না। আর হ্যাঁ, নিজের উদ্যোগে আরুষি হত্যার জাজমেন্টের কপি যত্ন করে হার্ডবাউন্ড করে তিনি বিলি করেছিলেন তাঁর পরিচিত সমস্ত বিচারকদের কাছে এবং এলাহাবার হাইকোর্ট বার কাউন্সিলের মেম্বারদের কাছে। অভিরূকের বই রচনার পেছনে সবচেয়ে বড় সাফল্যের কারণ এইটাই – তিনি শ্যাম লালের কাছ পর্যন্ত পৌঁছতে পেরেছিলেন, তাঁর সঙ্গে কথা বলতে পেরেছিলেন, তাঁর মতামত জানতে পেরেছিলেন। না, বিশেষ কোনও আগ্রহ শ্যাম লাল দেখান নি আরুষির মামলার ব্যাপারে, সারা জীবনে অনেক মামলার বিচারপ্রক্রিয়ায় যুক্ত ছিলেন তিনি, আরুষির মামলা আলাদা করে মনে রাখার মত কিছু বলে তাঁর মনে হয় নি, কিন্তু তিনি বিশেষ গর্ব প্রকাশ করেছিলেন জাজমেন্টে ব্যবহার করা ইংরেজি শব্দ এবং ফ্রেজের ব্যবহার নিয়ে। একটি হত্যাকাণ্ড মামলার জাজমেন্ট, একটি আইনি দলিল, সেখানে যৌক্তিক কাটাছেঁড়ার বদলে তিনি আগাগোড়া জোর দিয়ে গেছেন অদ্ভূত ইংরেজি ভাষায় তাঁর তথাকথিত “দক্ষতা”র ওপর। উদাহরণস্বরূপ – হত্যার দেড়দিন পরে আবিষ্কার হওয়া হেমরাজের মৃতদেহের বেশির ভাগ অংশই বিকৃত হয়ে গেছিল, ফুলে গেছিল বীভৎসভাবে, চেনার উপায় ছিল না প্রায়। তার যৌনাঙ্গও ফুলে গেছিল – শ্যাম লালের জাজমেন্টে Penis-এর বদলে লেখা হয়েছে এই রকমের শব্দবন্ধঃ Hemraj’s ‘willy was turgid’; his ‘pecker was swollen’।
যতক্ষণ তিনি অভিরূকের সাথে কথা বলেছেন, কেসের মেরিটের থেকে তাঁর বেশি আগ্রহ ছিল কীভাবে প্রচন্ড খাটাখাটনি করে তিনি আর তাঁর ছেলে মিলে একটা একটা করে ইংরেজি শব্দ চয়ন করেছেন, কী কী ইংরেজি বই তিনি পড়েছেন (যদিও সমসাময়িক কোনও ইংরেজি ভাষার সাহিত্যিকের লেখা তিনি পড়েছেন বলে মনে করতে পারেন নি, কেবলমাত্র শেকসপিয়র, মিলটন, শেলি, কিটসের নাম তিনি মনে করতে পেরেছিলেন) – সেইসব জানানো। বার বার তিনি মনে করিয়েছেন তিনি ইংরেজিতে এম এ করেছিলেন।
একজন বিচারককে শুধুই আইনের বই পড়লে চলে না, সাথে সাথে বিভিন্ন ল্যান্ডমার্ক, গুরুত্বপূর্ণ এবং কম গুরুত্বপূর্ণ জাজমেন্টও পড়তে হয়, এইগুলোই বিচারকের গ্রহণযোগ্যতার মাপকাঠি বলে বিবেচিত হয় সাধারণত। কিন্তু গর্বের সাথে শ্যাম লাল জানান, তিনি হাইকোর্টের জাজমেন্ট পড়েন না – তিনি শুধুই সুপ্রিম কোর্টের জাজমেন্ট পড়েন। এমনিতে তিনি দশ মিনিটে এক পাতা ইংরেজি লিখে ফেলতে পারেন, কিন্তু শুধুমাত্র আরুষি কেসটির জন্য, ২১০ পাতার দীর্ঘ রায় লেখার জন্য তাঁকে তাঁর আইনজীবি ছেলে আশুতোষ লালের সাহায্য নিতে হয়েছিল। সময় নিয়ে, ধৈর্য ধরে প্রতিটা শব্দ, প্রতিটা ফ্রেজ, প্রতিটা বাক্য তাঁরা চয়ন করেছেন, লিখেছেন। লেখা শেষ হলে টাইপ করিয়েছেন।
সত্যিই, খুবই খাটাখাটনির ব্যাপার। তা, কতদিন লেগেছিল এই পুরো জাজমেন্ট লিখে উঠতে?
শ্যাম লাল মুখ খোলার আগেই তাঁর ছেলে আশুতোষ জানান, পুরো এক মাস লেগেছিল।
অভিরূক খুব কষ্টে “কিছুই-বুঝতে-পারি-নি” মুখ করে এর পরেও কথোপকথন চালিয়ে গেলেন, কিন্তু আসল উত্তর ততক্ষণে বোঝা হয়ে গেছে। পাঠকদের জন্য টাইমলাইন আরেকবার মনে করিয়ে দেওয়া যাক – ২৪শে অক্টোবর ২০১৩ তলওয়ারদের তরফে ডিফেন্স লইয়ার নিজের আর্গুমেন্ট শুরু করেন, তথ্যপ্রমাণ দিয়ে বোঝাবার চেষ্টা করেন কীভাবে ডেন্টিস্টের স্ক্যালপেল দিয়ে মানুষের গলা কাটা অসম্ভব, কীভাবে সিবিআই ভুল গলফ স্টিক নিয়ে সন্দেহ করে চলেছে মার্ডার ওয়েপন হিসেবে। … আরুষি মামলার ভার্ডিক্ট বেরোয় ২৫শে নভেম্বর – ভার্ডিক্ট টাইপ করে তৈরি করতে ‘পুরো’ এক মাস লেগেছিল, তার মানে …?
তার মানে কি এইই দাঁড়ায় না, ডিফেন্স লইয়ার নিজের আর্গুমেন্ট পেশ করবার আগেই ভার্ডিক্ট লেখার কাজ শুরু হয়ে গেছিল? রাজেশ তলওয়ার, নূপুর তলওয়ার, আর তনভীর আহমেদ মীর মিলে এক মাস ধরে আদালতে যা যা প্রমাণ করার চেষ্টা করছিলেন, তা আসলে বিচারক শ্যাম লালের কানেই ঢুকছিল না, উনি তার আগেই রায় তৈরি করে ফেলেছিলেন? অভিরূকের মনে পড়ছিল, তনভীরের আর্গুমেন্ট শোনার সময়ে বিরক্ত শ্যাম লাল মাঝে মাঝেই বলতেন, তাড়াতাড়ি করুন – আর কত বাকি আছে? – বা – লিখে জমা দিয়ে দিন। তনভীরের আর্গুমেন্ট শোনার ব্যাপারে একেবারেই আগ্রহী ছিলেন না শ্যাম লাল। তাঁর রিটায়ারমেন্টের সময় এগিয়ে আসছিল খুব কাছে। ইংরেজি শব্দের সম্ভার সাজানোর জন্যেও সময় দিতে হচ্ছিল তাঁকে।
২৫শে নভেম্বরের জাজমেন্টের অংশঃ Undaunted by their unsuccess in the Supreme Court, they have now approached the High Court. The application has been oppugnated by CBI tooth and nail on the fulcrum of putting unwarranted road blocks in the surge of an urge for expeditious trial as mandated by the Supreme Court.
…Procrastination is the thief of time. Now the time has come to see that the syndrome of delay does not erode the concept of expeditious justice which is a constitutional demand. Sir Francis Bacon in his aphoristic style said ‘hope is a good breakfast, but it is a bad supper’.
জাজমেন্টের পুরো কপিটি পাওয়া যাচ্ছে এখানেঃ
আরও অনেকের সম্বন্ধে বলা হল না – দাহিয়া, এস এল ভায়া, অরুণ কুমার, বিজয় শঙ্কর, কিংবা নরেশ যাদব – এই কেসের সঙ্গে যুক্ত প্রতিটা চরিত্র গুরুত্বপূর্ণ আলাদা আলাদা কারণে, আলাদা আলাদা ভাবে। পুরো জানতে গেলে বইটা পড়া ছাড়া গতি নেই।
কে মারল আরুষিকে?
না, এটা কোনও সুলিখিত ক্রাইম ফিকশন নয়, যে, শেষপাতে একটা বুদ্ধিদীপ্ত “whodunnit” চ্যাপ্টার দিয়ে বই শেষ হবে। এটি একটি ক্রাইম নন-ফিকশন। আদালতের রায় অনুযায়ী, রাজেশ আর নূপুর তলওয়ার, জোড়া খুনের অপরাধে দোষী। কিন্তু হত্যার দিন থেকে শেষ রায় বেরোনর দিন পর্যন্ত, পদে পদে এত বেশিমাত্রায় তদন্তপ্রক্রিয়ায় ফাঁকফোঁকর দেখা গেছে এবং যাচ্ছে, যে এই রায়ের ওপর সম্পূর্ণভাবে ভরসা রাখা যায় না। আদালতও শেষ পর্যন্ত প্রমাণ করতে পারে নি আরুষি বা হেমরাজ কার হাতে কী পরিস্থিতিতে খুন হয়েছিল। এই কেসে রাজেশ আর নূপুর তলওয়ারকে দোষী সাব্যস্ত করা হয় “পারিপার্শ্বিক তথ্যপ্রমাণ” বা সারকামস্ট্যানশিয়াল এভিডেন্সের ভিত্তিতে। একটি বাড়ি, তার দরজা ভেতর থেকে বন্ধ, বাড়ির ভেতর চারটি মানুষ, দুজন খুন হয়ে গেল এক রাতে, এখন যে হেতু বাইরে থেকে অন্য কোনও লোক ঘরে ঢোকার সম্ভাবনা নেই, অতএব, বাকি দুজনের কোনও একজন, বা দুজন ছাড়া আর কেউ খুনী হতেই পারে না। অতএব, এই দুজনের ওপরেই দায় বর্তায় ব্যাখ্যা করার যে, খুন কী করে হল।
সেইভাবেই রায় লেখা হয়েছে। যে হেতু এই দুজন ছাড়া আর কেউ খুনী হতেই পারে না, অতএব, এই দুজনই খুনী। খুনের পরে রাজেশ রক্তমাখা স্ক্যালপেল হাপিস করে ফেলেছেন, গলফ ক্লাব ধুয়েমুছে পরিষ্কার করে লফটে তুলে রেখেছেন, এবং নিষ্পাপ মুখে মেয়ের মৃত্যুর তদন্তের দাবি জানিয়েছেন। বিভিন্ন সময়ে যতজন, যতভাবে দুজনকে দোষী সাব্যস্ত করেছেন, কৌল, বা দাহিয়া বা অন্যরা – কেউই নিরঙ্কুশভাবে প্রমাণ করতে পারেন নি খুনের প্রক্রিয়া, খুনের উদ্দেশ্য বা মোটিভ এবং খুনের অস্ত্র। তদন্তের ফাঁক বোজাতে কখনও সাক্ষীর বয়ান বদলাতে হয়েছে, কখনও গল্প তৈরি করতে হয়েছে, কখনও মিডিয়ার মাধ্যমে জনমত বানানো হয়েছে সেইসব গল্প “বিশ্বাস” করার জন্য।
অথচ শুরুর দিকে কিন্তু প্রক্রিয়াটা এতটা ঘাঁটা ছিল না। রাজকুমার আর কৃষ্ণার পলিগ্রাফ আর নারকো টেস্টের বিস্তারিত রিপোর্ট হাতে পাবার পরে সিবিআইয়ের কাছে যথেষ্ট কারণ ছিল, এই দুজনকে আটকে রেখে আরও জিজ্ঞাসাবাদ চালিয়ে যাওয়া। শুরুর দিকে এই সব রিপোর্টের কথা মিডিয়াতেও এসেছিল, কিন্তু এ জি এল কৌল একবার দায়িত্ব নিয়ে নেবার পরে – এই সমস্ত রিপোর্ট চিরদিনের মত সমাধিস্থ হয়ে যায়। পরেও, যখনই সিবিআই বাধ্য হয়েছে এই টেস্টের রিপোর্ট জমা দিতে, কৌলের নির্দেশে সব সময়ে জমা পড়েছে এই সব রিপোর্টের প্রথম দু তিন পাতা, যাতে কনটেন্ট ছিল না, কেবল হেডলাইন আর কিছু রেফারেন্স ছিল। গাজিয়াবাদের আদালতে শুনানি চলাকালীন তলওয়াররা বার বার চেয়েছেন এই রিপোর্টের সম্পূর্ণ কপি, তাঁদের দেওয়া হয় নি, বরং ভর্ৎসনা করা হয়েছে – তাঁরা আলফাল জিনিস চেয়ে আদালতের মূল্যবান সময় নষ্ট করছেন – বলে। হয় তো সেই সমস্ত রিপোর্টের ভিত্তিতে তদন্ত এগনো গেলে কেসটার অন্য পরিণতি হতে পারত, কিন্তু একবার কৌল তদন্তের ভার নিয়ে নেবার পরে, সে আশা আর একেবারেই রইল না।
তেরো বছরের মেয়েটাকে কীভাবে, কে মারল, এই প্রশ্নের উত্তর হয়তো আর কোনও দিনই মিলবে না। হাইকোর্টের ব্যাকলগ কাটার অপেক্ষায় তলওয়ারদের জীবন কেটে যাচ্ছে গাজিয়াবাদের প্রান্তে দাসনা জেলের কুঠুরিতে।
অবশ্য জীবনের কথা বলে ফেলার পক্ষে এ উপযুক্ত সময় নয়। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাস, যখন এই নিবন্ধ লিখছি, তখন গাজিয়াবাদের দাসনা জেলে রাজেশ আর নূপুর তলওয়ার তাঁদের কারাজীবনের দু বছর পূর্ণ করার দিকে এগিয়ে চলেছেন, এবং তনভীর আহমেদ মীর, তাঁদের তরফের আইনজীবি, কোনওরকমের ফাঁক না রেখে কেসটি নতুন করে তৈরি করছেন এলাহাবাদ হাইকোর্টে নতুন পিটিশন দাখিল করবার জন্য, যাতে হাইকোর্টে কেসের পরবর্তী শুনানি না হওয়া পর্যন্ত তলওয়ারদের শাস্তি “আপহেল্ড” করে রাখা যায়, তাঁদের জামিনে মুক্ত রাখা যায়।
দাসনা জেলের ডায়েরি
আমি আজ পর্যন্ত মেয়ের জন্য একটু শোক করারও সময় পাই নি – এত ব্যস্ত ছিলাম। – নূপুর তলওয়ারের বক্তব্য, প্রথম যেদিন অভিরূক তাঁদের সাথে দেখা করতে যান দাসনা জেলে।
পুরুষদের সেলে থাকেন রাজেশ, মহিলাদের সেলে থাকেন নূপুর। গাজিয়াবাদের দাসনা জেল তৈরি ১৭০০ বন্দীর থাকার জন্য, সেখানে এখন থাকে ৩৪০০ বন্দী। প্রতি বন্দীর জন্য বরাদ্দ জায়গা তিন ফুট বাই ছ ফুট। তার মধ্যেই শুতে হয়, তার মধ্যেই নিজের জিনিসের পুঁটলি রাখতে হয়। রাতে ঘুমের মধ্যে একজনের গায়ে অন্যজনের পা লেগে গেলে অশ্রাব্য ভাষায় রাত জুড়ে গালিগালাজ চলে। শীতকালে শীত লাগে, অন্য সময়ে মশা কামড়ায়, কখনও কখনও মশা মারার কয়েল জোটে, ক্ষণিকের স্বস্তি, কিন্তু তা লাগানোর জন্য মেটালের স্ট্যান্ড পাওয়া যায় না, কারণ ওটি সিকিওরিটি থ্রেট। ওই স্ট্যান্ড ব্যবহার করে কেউ নিজেকে বা অন্যকে আহত করতে পারে। পোটেনশিয়াল ওয়েপন। কয়েল না জুটলে মশার কামড় খাওয়া ভবিতব্য।
রাজেশ তলওয়ারের ভাগ্য খারাপ বলা যাবে না। ডেন্টিস্টের বিদ্যা কাজে লাগিয়ে তিনি জেলের ভেতরে একটি ডেন্টাল চেম্বার খোলার অনুমতি পেয়েছেন। সমস্ত যন্ত্রপাতি কিনে সেখানে সেটআপ করা হয়েছে। রাজেশ আর নূপুরের সহযোগিতায় সেখানে দাসনা জেলের পুলিশ এবং অন্যান্য বন্দীদের দাঁতের চিকিৎসা করেন।
নূপুর কাজ করেন ‘ইংলিশ অফিসে’। এখানে জেলের বেশির ভাগ অফিশিয়াল কাজকর্ম চলে, যেখানে ইংরেজি জানা কর্মীর দরকার হয়। বিভিন্ন রায়, চার্জশীট ইত্যাদির প্রতিলিপি, ইংরেজি অনুবাদ বা ইংরেজি থেকে হিন্দিতে অনুবাদের কাজ করেন নূপুর।
জনৈক “মন্ত্রীজি” কোনও এক স্ক্যামে ফেঁসে গিয়ে দাসনা জেলে বন্দী ছিলেন কিছুদিন। অল্পদিনেই রাজেশ তাঁর প্রিয়পাত্র হয়ে যান, মূলত মন্ত্রীজির সুপারিশেই ছাড়া পাবার পরেও রাজেশ একটু বেশি খাতিরযত্ন পান – একজন বন্দীর পক্ষে যতটা পাওয়া সম্ভব আর কি। এখনও মন্ত্রীজিকে মাঝে মাঝে দাসনা জেলে আসতে হয় হাজিরার কারণে, তখন তিনি রাজেশের জন্য বাড়িতে বানানো খাবার দাবার নিয়ে আসেন।
আর আসেন বিকাশ শেঠি, রাজেশের প্রিয় বন্ধু, ঘটনার বহু আগে থেকে রাজেশের সাথে যাঁর হৃদ্যতার সম্পর্ক। খাবার নিয়ে আসেন, কিছু টাকা নিয়ে আসেন, বন্দী অবস্থায় হাতে কিছু টাকা সময়বিশেষে প্রয়োজনীয় হয় বৈকি, ভারতীয় কারাগারের সাথে যাঁরা পরিচিত, তাঁরাই জানেন।
মাঝে মাঝে মন্ত্রীসান্ত্রী আসেন, জেল খাটতে নয় – জেলে থাকা বন্দীদের দেখতে। অন্যান্য বন্দীদের সাথে তখন রাজেশকে প্যারেড করানো হয় সেই সব হাই প্রোফাইল রাজনৈতিক নেতাদের সামনে।
ডায়েরি লেখেন রাজেশ। ডায়েরিতে লিখেছেন, নিজেকে চিড়িয়াখানার জন্তু মনে হচ্ছিল, চেনে বেঁধে আমাদের দর্শকদের সামনে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখানো হচ্ছে।
সেই ডায়েরি অভিরূকের হাতে তুলে দিয়েছেন রাজেশ তলওয়ার। ডায়েরির কিছু অংশ আমাদের পড়বার জন্য এই বইয়ের শেষে তুলে দিয়েছেন অভিরূক।
পড়ে ফেলুন। পড়া দরকার বইটা। সব্বার।
তথ্যসূত্রঃ