প্রথম পর্বঃ http://www.guruchandali.com/default/2013/07/26/1374810450163.html
দ্বিতীয় পর্বঃ http://www.guruchandali.com/default/2013/08/12/1376321015276.html
১২ বছর বাদে আবার জেগে উঠেছে ইশরাত জাহানের ভূত। ভারতের অন্যতম মোস্ট ওয়ান্টেড টেররিস্ট ডেভিড কোলম্যান হেডলির হাত ধরে।
গল্পটা সকলেই জানেন। হেডলি ধরা পড়েছে আমেরিকার হাতে, সেখানে তার দীর্ঘ জেলবাসের সাজাও হয়ে গেছে। ভারত দীর্ঘদিন ধরে হেডলিকে জেরা করবার দাবি জানিয়ে আসছিল আমেরিকার কাছে, অতি সম্প্রতি, ভারতের হাতে হেডলিকে তুলে দেওয়া হবে না, এই শর্তে আমেরিকাতে বসেই ভিডিও কনফারেন্সিং-এর মাধ্যমে হেডলির জবানবন্দী দেওয়া চলছে। জবানবন্দী নিচ্ছে মুম্বাই পুলিশ, এবং এটিএস – যাদের নাগালের মধ্যে হেডলি নেই। মাধ্যম কেবলমাত্র ভিডিও কনফারেন্স, কোনওরকমের মানসিক চাপ ছাড়াই হেডলি শান্ত মনে দু-তিনদিন ধরে দিয়ে চলেছে তার অপরাধী জীবনের ধারাবিবরণী। তৃতীয় দিনে সেই ধারাবিবরণীর অংশ হিসেবেই উঠে এল আবার, ইশরাত জাহানের নাম।
অফিস যাবো বলে খেতে বসেছিলাম। পর্দায় তখন ফ্ল্যাশ হচ্ছে ব্রেকিং নিউজ, হেডলির স্বীকারোক্তি, ইশরাত জাহান লশকর-এ-তোইবার মাইনে করা ফিদায়েঁ বা সুইসাইড বম্বার ছিল। তাকে ভারতে পাঠানো হয়েছিল ধ্বংসাত্মক ক্রিয়াকলাপ চালাবার জন্য। টিভিতে দেখলাম বিজেপি মন্ত্রী শাহনওয়াজ হোসেনের উল্লসিত মুখ, আশা করি বিরোধীদের মুখ এবার শান্ত হবে। যাঁরা অমিত শাহজীকে জড়িয়ে, একে ফেক এনকাউন্টার নাম দিয়ে দোষারোপ করছিলেন এতদিন, আশা করি তাঁরা এইবারে ক্ষমা চাইবেন। গুজরাত পুলিশ একজন টেররিস্টকেই মেরেছে, কোনও নিরীহ মানুষকে মারে নি, তা আবার প্রমাণ হল।
চোয়াল শক্ত হল। সত্যিই, আমরা কি সবাই তা হলে একই অসুখে আক্রান্ত? আমরা তা-ই বিশ্বাস করি, যা আমরা বিশ্বাস করতে ভালোবাসি?
নিউজ চ্যানেলের একটা আধঘন্টার অনুষ্ঠানে অন্তত দুটো অ্যাড ব্রেক থাকে, কিন্তু এই আধঘন্টায় একটিও ব্রেক পড়ল না। ফোনে ধরা হল বৃন্দা গ্রোভারকে, যিনি ইশরাত জাহান হত্যাকাণ্ড মামলায় ইশরাতের মায়ের তরফের আইনজীবি। কিন্তু কথোপকথন শুরু হবার আগেই একটা জিনিস আমার মাথায় খেলে গেল, যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নিই, হ্যাঁ, ইশরাত সন্ত্রাসবাদী ছিল, সুইসাইড বম্বার ছিল, তা হলেও – এনকাউন্টারটা তো ফেক! ইশরাত তো কোথাও সন্ত্রাসবাদী হামলা চালায় নি! অপরাধ করার আগেই কাউকে কি অপরাধী সন্দেহে মেরে দেওয়া যায় নাকি? ইশরাত সন্ত্রাসবাদী হোক বা না হোক, ইশরাতের হত্যাকাণ্ডটা একটা সুপরিকল্পিত রাষ্ট্র-পরিচালিত রাষ্ট্র-নির্দেশিত হত্যাকাণ্ড, তাতে তো আজও কোনও সন্দেহ নেই। কেউ চুরি করবে, এটা সন্দেহ করে কি পুলিশ কখনও কাউকে জেলে ঢোকাতে পারে, যদি চুরিই সংঘটিত না হয় আদৌ?
বৃন্দা গ্রোভার দেখলাম, স্পষ্টতই উত্তেজিত। বার বার বললেন, হেডলির এই বয়ান আসলে টুইস্ট করে প্রচার চালানো হচ্ছে সরকারি মাধ্যমে এবং বেশির ভাগ মিডিয়াতে, আমি আগে যে বক্তব্য পেশ করেছিলাম কোর্টের সামনে, এখনও সেই বক্তব্যেই স্টিক করে থাকছি, ইশরাত হাজান একজন নির্দোষ মেয়ে, সে সন্ত্রাসবাদী নয়, নয়, নয়। সে পাকিস্তান থেকে আসে নি, মুম্বাইয়ের মুম্ব্রার বাসিন্দা, কোনও সন্ত্রাসবাদী ট্রেনিং-ও সে পায় নি পাকিস্তানের থেকে। একটা নির্জলা ফেক এনকাউন্টারকে ধামাচাপা দেবার জন্য একটা নির্দোষ মৃত মেয়েকে সন্ত্রাসবাদী তকমা দেবার এবং সেটাকে জাস্টিফাই করার চেষ্টা চলছে, যাতে এই এনকাউন্টারের সাথে যুক্ত কোনও বড় মাপের পলিটিকাল নেতা, যিনি এই মুহূর্তে দেশের একটা অন্যতম উঁচু পলিটিকাল পদে আসীন, তাঁকে বাঁচানো যায়।
ইঙ্গিতটি স্পষ্ট। সে নিয়ে আমরা আগেও আলোচনা করেছি। ইশরাত জাহানের মৃত্যুর ঘটনাও আগে আলোচনা হয়েছে, দেখানো হয়েছে কী কী কারণে এই এনকাউন্টারকে ফেক বলে সন্দেহ করা হচ্ছে, সিবিআই পর্যন্ত এই এনকাউন্টারকে "জেনুইন" বলে তকমা দিতে পারে নি। কিন্তু তার পরে কী হয়েছিল?
লশকর-এ-তোইবার ওয়েবসাইটে "শহীদ" হিসেবে নাম দেওয়া হয় ইশরাত জাহানের, যা বিজেপি নেতৃত্বের বক্তব্যের সাথে খাপে খাপে মিলে যায়। যদি ধরে নিই লশকর মিথ্যে কথা লিখেছিল, ইশরাত তাদের কেউ ছিল না, স্রেফ একটি মুসলিম নাম পেয়ে তারা তাদের মত করে গল্প বানিয়েছিল, তা হলে একটি দুটি প্রশ্ন ওঠে – লশকরের এই মিথ্যে প্রোপাগান্ডার পেছনে কি বিজেপির কোনও হাত ছিল? লশকর বা বিজেপির কী স্বার্থসিদ্ধি হল এই প্রোপাগান্ডা করে?
এতদিন এদিকে কেউ আলো ফেলে নি, তাই এগুলোর উত্তর জানা নেই। জানি না, কোনওদিন জানা যাবে কিনা।
২০১১ সালে হেডলিকে যখন জেরা করবার সুযোগ পেয়েছিল এনআইএ, তখনও একবার ইশরাত জাহানের নাম উঠে এসেছিল। প্রায় পাঁচ বছর আগে নেওয়া সেই জবানবন্দী এনআইএ-র রিপোর্টে লিপিবদ্ধ রয়েছে। বর্তমান ঘটনায় ঢোকার আগে একবার দেখে নেওয়া যাক সেই রিপোর্টের ১৬৮ এবং ১৬৯ প্যারাতে হেডলি কী বলেছিল।
১৬৮। ইশরাত জাহান সম্পর্কে যখন জিজ্ঞেস করা হয়, তখন আমি (হেডলি) জানাই যে, ২০০৫ সালের শেষদিকে জাকিউর রহমান লখভি আমাকে মুজাম্মিলের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছিল, এবং লশকর কম্যান্ডার হিসেবে মুজাম্মিলের বিভিন্ন কীর্তিকলাপ আমাকে শুনিয়েছিল। সেই সময়েই লখভি ঠাট্টার ছলে আমাকে জানায় যে মুজাম্মিল একজন "টপ কম্যান্ডার" যার কোনও বড় প্রজেক্টই আজ পর্যন্ত সফল হয় নি। এই প্রসঙ্গেই জাকিউর আমাকে ইশরাত জাহান মডিউলের কথা বলে যা ছিল মুজাম্মিলের পরিচালনায় আরেকটি অসফল অপারেশন (Botched-up Operation)।
১৬৯। হেডলি জানায় যে এর বাইরে ইশরাত জাহান সম্বন্ধে সে আর কিছু শোনে নি, আর কোনও তথ্য সে জানে না।
বয়ান থেকে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে যে, হেডলির সঙ্গে মুজাম্মিলের (মুজাম্মিল বাট) আলাপ হয়েছিল ২০০৫-এর শেষের দিকে, আলাপ করিয়েছিল জাকিউর রহমান লখভি, আর তখনই সে এই "বচড-আপ অপারেশন"এর কথা শোনে। যদিও, ওই একই রিপোর্টের প্যারা ১৭ এবং ২৮-এ সম্পূর্ণ বিপরীত কথা লেখা আছে। আসুন, দেখে নেওয়া যাক সেগুলোও।
১৭। ২০০২ সালে আমার সাথে মুজাম্মিল বাটের দেখা হয়। সে ছিল মুজফফরাবাদের এক কাশ্মিরী। আবু দুজানা আমাকে মুজাম্মিলের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। মুজাম্মিল আর আবু একসাথে কাশ্মীরে থাকত। মুজাম্মিল লশকর-এ-তোইবার একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিল। কাশ্মীরে থাকাকালীন সে ভারতীয় সিকিওরিটি ফোর্সের ওপর হওয়া একঝাঁক হামলার সাথে যুক্ত ছিল। একবার মুজাম্মিল আমাকে গল্প শুনিয়েছিল, কীভাবে তৎকালীন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টনের ভারত আগমনের আগে সে কাশ্মীরের একটা গ্রামে গিয়ে অনেক নিরপরাধ সাধারণ কাশ্মীরিকে মেরেছিল। মুজফফরাবাদে আসার পরে তাকে মূলত ভারতে অপারেশনের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
২৮। পাকিস্তানে ট্রেনিং শেষ হবার পরে আগস্ট ২০০৪ নাগাদ আমি জাকিউর রহমানের সাথে দেখা করি এবং তাকে অনুরোধ করি মার হ্যান্ডলার বদলে দেবার জন্য - আমি আমার হ্যান্ডলার ইয়াকুবের সাথে স্বচ্ছন্দ ছিলাম না। জাকি তখন আমাকে মুজাম্মিলের হাতে তুলে দেয়। আবদুর রহমানও মুজাম্মিলের সাথে তখন কাজ করছিল।
কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে না? একই রিপোর্টে একবার বলা হচ্ছে সে মুজাম্মিলের সাথে পরিচিত হয়েছিল ২০০৫-এর শেষের দিকে, আবার অন্য জায়গায় বলা হচ্ছে মুজাম্মিলকে সে ২০০২ সাল থেকেই চিনত। আইন ছেড়ে দিন, শুদ্ধ ইংরেজি ভাষায় একে বলা হয়, “ইনকনসিস্টেন্সি”। শুধু একটা জিনিসই কনসিস্টেন্ট এখানে, সেটা হচ্ছে ইশরাত জাহান নামটা হেডলি শুনেছিল অন্য কারুর রেফারেন্সে। সে ইশরাতকে চিনত না, তাকে কখনও চোখেও দ্যাখে নি, এবং যদি ধরে নিই হেডলি অক্ষরে অক্ষরে সমস্ত সত্যি বলেছে বা এনআইএ-র রিপোর্টে একদম যা শোনা হয়েছিল তাইই লেখা হয়েছে, তা হলে এটাও বলতে হবে যে ইশরাত জাহানের নামটা উঠে এসেছে জাস্ট একটা অপারেশনের নাম হিসেবে – “...জাকিউর আমাকে ইশরাত জাহান মডিউলের কথা বলে যা ছিল মুজাম্মিলের পরিচালনায় আরেকটি অসফল অপারেশন”। একবারও বলা নেই যে ইশরাত লশকরেরই অপারেটিভ ছিল। ভারতে এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে তখনই হইচই হয়েছিল, সমস্ত কাগজে খবরটা উঠে এসেছিল “ইশরাত জাহান এনকাউন্টার” বা “ইশরাত জাহান ফেক এনকাউন্টার” শিরোনামে। জাকিউর সেটাকেই লুজলি “ইশরাত জাহান মডিউল” বলেছিল কিনা সেটা একবারের জন্যেও ভেরিফাই করবার প্রয়োজন তখন বোধ করে নি এনআইএ। অর্থাৎ, হেডলি কোট করেছে অন্য একজনের কথা, এনআইএ কোট করেছে হেডলিকে এবং সরকার আর মিডিয়া কোট করেছে এনআইএ-র রিপোর্টকে। কোর্টে এটাকে কোনওভাবেই “প্রমাণ” বা “ডিরেক্ট এভিডেন্স” হিসেবে দাখিল করা যায় না।
... এই সংক্রান্ত ফ্যালাসির চমৎকার উদাহরণ একবার দিয়েছিলেন রঞ্জনদা। আমি, ঘরে আমার বউকে খুন করে থানায় গিয়ে বললাম, আমি আমার বউকে খুন করেছি। এই দেখুন রক্তমাখা ছুরি, এই দেখুন আমার জামায় রক্তের দাগ। – পুলিশ কি আমাকে তক্ষুনি অ্যারেস্ট করবে? আপাতদৃষ্টিতে সত্যিই মনে হবে আমি একটি হত্যাকাণ্ড ঘরে ঘটিয়ে থানায় গিয়ে আত্মসমর্পণ করেছি। কিন্তু পুলিশ বড়জোর আমাকে কাস্টডিতে নিতে পারে এই এভিডেন্সের ভিত্তিতে, এখনও ডিরেক্ট এভিডেন্স পাওয়া যায় নি যে! পুলিশ তাই আমাকে অ্যারেস্ট করতে পারবে না। পুলিশ তদন্ত চালাবে, আমার ঘরে যাবে, গিয়ে দেখবে আমার বউয়ের রক্তমাখা মৃতদেহ - কিন্তু তাতেও প্রমাণ হবে না যে আমিই, এই ছুরিটা দিয়েই আমার বউকে খুন করেছি। ডিরেক্ট এভিডেন্স নেই। মৃতদেহের আঘাতের চিহ্নের সাথে আমার দেওয়া ছুরির প্যাটার্নের মিল থাকতে হবে, তার পরে জানতে হবে যে আমার জামায় বা ছুরিতে যে রক্তের দাগ, তার গ্রুপ মৃতদেহের গ্রুপের সঙ্গে মেলে কিনা, তার পরে জানতে হবে মোটিভ। আমিই খুন করেছি কিনা। করলে কেন করেছি, কোনও উইটনেস আছে কিনা, যে কোনও ঝগড়া বা চিৎকারের আওয়াজ শুনেছে, বা লুকিয়ে লুকিয়ে খুনটা হতে দেখেছে আমার হাতে, বা এমন কোনও অকাট্য তথ্যপ্রমাণ যাতে সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণ করা যায় যে আর কেউ নয়, আমিই আমার বউয়ের খুনের জন্য দায়ী। কেবলমাত্র তখনই আমার নামে খুনের চার্জ আনা যেতে পারে।
ডিরেক্ট এভিডেন্স। উইটনেস। ক্রিমিনাল প্রসিকিউশনে বড় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আজমল কসাভের সময়ে যার অভাব পড়ে নি। প্রচুর লোক স্বচক্ষে দেখেছে কসাভকে গুলি চালাতে, মানুষ মারতে। তার পরেও দীর্ঘ ট্রায়াল চালিয়ে তথ্যপ্রমাণ একত্র করে তবে কসাভের ফাঁসি হয়। যে কারণে কসাভের ট্রায়াল প্রসেস নিয়ে কখনও কোনও প্রশ্ন ওঠে নি, আর যে কারণেই বারবার প্রশ্ন উঠছে ইশরাত জাহান এনকাউন্টারের ঘটনায়, আরুশি তলওয়ার হত্যাকাণ্ডের ঘটনায়, আফজল গুরুর বিচারপ্রক্রিয়ার ঘটনায়। ডিরেক্ট এভিডেন্স-এর অভাব।
কী বলেছে ডেভিড কোলম্যান হেডলি, এইবারে তার জবানবন্দীর তৃতীয় দিনে? আসুন, একবার পড়ে নেওয়া যাক। প্রশ্ন করছেন পাবলিক প্রসিকিউটর উজ্জ্বল নিকম, যিনি এই বছর পদ্ম সম্মানে ভূষিত হয়েছেন।
পাবলিক প্রসিকিউটরের প্রশ্নঃ এলইটি-র কোনও মহিলা শাখা আছে?
ডেভিড হেডলিঃ হ্যাঁ।
প্রশ্নঃ কে আছেন তার শীর্ষে?
হেডলিঃ আবু আইমানের মা।
প্রশ্নঃ লশকরের কি কোনও মহিলা ফিদায়েঁ কর্মী ছিল?
ডেভিড হেডলিঃ না, আমি জানি না।
প্রশ্নঃ একজন মহিলা সুইসাইড বম্বারের নাম বলতে পারবেন?
হেডলিঃ না, আমি পারব না।
...
প্রশ্নঃ আপনি কি লশকরের কোনও অসফল অপারেশনের (Botched Up Operation) কথা কখনও শুনেছেন?
হেডলিঃ হ্যাঁ, আমি একবার একটা বাক্যালাপ শুনছিলাম (overhear) জাকিউর রহমান লাখভি আর মুজাম্মিল ভাটের মধ্যে। তারা একটা অসফল অপারেশনের ব্যাপারে কথা বলছিল। পরে আমি মুজাম্মিলকে জিজ্ঞেস করে জানি, তাদের একজন মহিলা সদস্য কোনও একটা নাকায় পুলিশের গুলিতে মারা গেছে। সেটা এক্স্যাক্টলি কোন জায়গাতে, আমার মনে নেই।
এর পরে পাবলিক প্রসিকিউটর উজ্জ্বল নিকম হেডলিকে প্রশ্ন করেন, সেই মহিলা সদস্যের নাম তিনি জানেন কিনা।
হেডলি জানান, না, তিনি জানেন না। মনে নেই।
প্রসিকিউটর বলেন, আমি আপনাকে তিনটে নাম বলছি, এর মধ্যে কোনটা? নূর বেগম, ইশরাত জাহান, মুমতাজ।
হেডলিঃ ইশরাত জাহান।
আইনি প্রক্রিয়া সম্বন্ধে যাঁরা মোটামুটি অবহিত, তাঁরাই বুঝবেন, আগাগোড়া জানি না, মনে নেই, বলতে পারব না বলা একজন হঠাৎ যখন তিনটে নামের মধ্যে একটা নাম বেছে নেয়, তখন সেটাকে কনফার্ম করার জন্য আরও প্রশ্নের দরকার হয় – সে প্রশ্ন আর করা হয় নি, ইশরাতের নাম পাওয়া মাত্র এই সংক্রান্ত প্রশ্ন থামিয়ে দেওয়া হয়, এবং দেশজুড়ে খবর ছড়িয়ে দেওয়া হয় – হেডলি জানিয়েছে, ইশরাত লশকরের সুইসাইড বম্বার ছিল।
এবং, আগের উক্তির সঙ্গে আবারও ইনকনসিস্টেন্সি। এনআইএ-র পুরনো রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে হেডলি জানিয়েছে জাকিউর রহমান তাকে নিজে বলছে মুজাম্মিলের “বচড-আপ অপারেশন”এর কথা, মুজাম্মিলের সাথে আলাপ করিয়ে দেবার সময়ে, আবার সাম্প্রতিক জবানবন্দীতে সে বলছে কথোপকথন চলছিল জাকিউর আর মুজাম্মিলের মধ্যে – সে পাশ থেকে শুনেছে – “overhear” করেছে।
বৃন্দা গ্রোভার সম্পূর্ণ কথোপকথনটিকে নস্যাৎ করে জানিয়েছেন, এই উক্তি কোর্টে টিকবে না। প্রমাণ হিসেবে এটাকে কোনওভাবেই দেখা যেতে পারে না। কোর্টের নির্ধারিত সংজ্ঞা অনুযায়ী, একজন “উইটনেস” হিসেবে কোর্টের সামনে তখনই নিজেকে ডিপোজ করতে পারে, যখন সে ঘটনাটা ঘটতে শুনেছে, বা দেখেছে বা পুরো ঘটনা বা তার অংশবিশেষ নিজে করেছে। একজন জাস্ট শুনল অন্য দুটো লোক কিছু বলছে, সেইটা সে কোর্টে বললে সেটা উইটনেস হিসেবে কোর্টে গৃহীত হয় না। হেডলি যতক্ষণ জানিয়েছে সে নিজে লশকরের সাথে যুক্ত ছিল, এগে একাধিকবার মুম্বাইতে এসেছিল, রেকি করে গেছিল, সে লশকর অপারেটিভ আর আইএসআইয়ের থেকে এত টাকা পেত, সেটা মুম্বাইয়ের অমুক ব্যাঙ্কের অমুক ব্র্যাঞ্চ থেকে সে তুলত, ততক্ষণ সেগুলো সাক্ষ্যপ্রমাণ। কারণ সে নিজে থেকেছে, নিজে টাকা পেয়েছে, নিজে এসেছে, নিজে গেছে, কিন্তু ইশরাতের কেসে সে কিছুই জানত না – শুধু জেনেছে দুজনের কথোপকথন পাশ থেকে শুনে। হিয়ারসে এভিডেন্স-কে এভিডেন্স হিসেবে গ্রাহ্য করে না আদালত। আর, পাবলিক প্রসিকিউটর কি অমিতাভ বচ্চন নাকি, যে উনি কেবিসির হট সীটে বসে কম্পিটিটরকে তিনটে অপশন দিয়ে তার মধ্যে একটা পছন্দ করে নিতে বলছেন? এইভাবে জেরা হয় নাকি?
মনে রাখতে হবে, পনেরোই জুন, দু হাজার চার সালে আমেদাবাদের রাস্তায় একা ইশরাত খুন হয় নি, হয়েছিল তার সাথে আরও তিনজন – জীশান, আহমেদ আর জাভেদ। তাদের জন্য এত শোরগোল ওঠে নি কারণ সন্ত্রাসবাদ বা লশকর-এ-তোইবার সাথে তাদের যোগাযোগের কথা সন্দেহাতীতভাবে না হলেও, প্রমাণিত, অন্তত এরা যে সন্ত্রাসবাদের দিকে অনেকটাই ঝুঁকে ছিল, সে ব্যাপারে তথ্যপ্রমাণ পাওয়া গেছে, কিন্তু ইশরাতের ব্যাপারে কোনও প্রমাণ আজ অবধি পাওয়া যায় নি। লশকরের দাবি ছিল ইশরাত পাকিস্তান থেকে এসেছে, এদিকে ইশরাতের মা, বোন দীর্ঘদিন ধরে মুম্বাইয়ের মুম্ব্রা এলাকার বাসিন্দা। ইশরাতও তাই।
প্রশ্নটা কিন্তু থেকেই যায়। ইশরাতের সঙ্গীরা সন্ত্রাসবাদী হোক বা না হোক, ইশরাত নিজেও সন্ত্রাসবাদী হোক বা না হোক, পুলিশ বা এটিএসের প্রধান কাজ হওয়া উচিত ছিল তাদের ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করা। তাদের মেরে ফেলা কোনও আইনেই সমর্থনযোগ্য নয়, বিশেষত যখন এমন কোনও প্রমাণ পাওয়া যায় নি যে তারা গুলি চালিয়েছিল বা বোমা গুলি সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছিল বা তারা পুলিশকে অ্যাটাক করেছিল। সেই পরিস্থিতিতে পুলিশ গুলি চালালে এনকাউন্টার খাটত। মুম্বাই হামলার সময়ে বন্দুকধারী সন্ত্রাসবাদীদের মোকাবিলায় পুলিশ আর এটিএস জওয়ানরা মিলে প্রায় সমস্ত সন্ত্রাসবাদীকেই মেরেছিল, কেবলমাত্র কসাভকে জ্যান্ত ধরা গেছিল, সেই সমস্ত হত্যাকাণ্ড নিয়ে কখনও কোনও প্রশ্ন ওঠে নি। প্রসঙ্গত, ইশরাত জাহান সন্ত্রাসবাদী ছিল কি ছিল না, এটা ভারতের কোনও কোর্টেই বিচারাধীন বিষয় নয়। এই নিয়ে কোনও কেস কোনওদিন চলে নি, আজও চলছে না। কেস চলছে এনকাউন্টার নিয়ে। সেখানে হেডলি ইশরাতকে সন্ত্রাসবাদী হিসেবে মান্যতা দিল কি দিল না, তাতে কেসের মেরিটের কোনও পরিবর্তন হয় না, কারণ এই বিষয়টা কেসের বিষয়ের অন্তর্ভূক্তই নয়। গান-ব্যাটল, জীবন-সংশয়ের মত পরিস্থিতির উদ্ভব হলে তবেই পুলিশ এনকাউন্টারে কাউকে মারতে পারে, নিরস্ত্র অবস্থায় কাউকে মেরে ফেলার আইনি কোনও রকমের অনুমতি ভারতের কোনও সিকিওরিটি এজেন্সির নেই। ইশরাত বা তার সঙ্গীরা কোনওভাবে পুলিশের “নাকা” বা চেকপোস্টে আক্রমণ করেছিল বলে খবর পাওয়া যায় নি, এবং পারিপার্শ্বিক তথ্যপ্রমাণ এটিকে ফেক এনকাউন্টার হিসেবেই চিহ্নিত করে। এখন উগ্র দেশপ্রেমের জোয়ার অনেক খুনকেই বৈধতা দিয়ে দেয়, এখানেও সেই প্রক্রিয়াই চলছে সরকারি এবং অন্যান্য স্তরে। পশ্চিমবঙ্গেও এই রকমের এনকাউন্টারের মাধ্যমে খুনের লেজিটিমেসি আমরা দেখেছি কিষেনজি হত্যাকাণ্ডে – যা এখনও তৃণমূলের দু-একজন নেতার বেফাঁস মন্তব্যে প্রকাশিত হয়ে চলেছে।
ডেভিড হেডলির এই মন্তব্যের ঢেউ এখন অনেকদূর অবধি ছড়াবে, বিভিন্ন মহল থেকে বিভিন্ন ধরণের প্রতিক্রিয়া আসতে থাকবে আগামী কদিন – এটাই ধরে নেওয়া যায় আপাতত, তবে তা বিচারপ্রক্রিয়ায় কতদূর সাহায্য করবে, তা এখনই বলা যাচ্ছে না। ইশরাত জাহানের ফেক এনকাউন্টার মামলা কিন্তু আজও আদালতে চলছে।
হেডলির প্রথম জবানবন্দীর পূর্ণ বিবরণঃ এইখানে।
বাড়তি তথ্যসূত্রঃ http://www.truthofgujarat.com/headleys-new-statement-on-ishrat-more-fabrication-more-inconsistencies/ - লিখেছেন প্রতীক সিনহা।