ফরিদা আমাকে মাঝেমধ্যেই ফোন করে, আমার আর কাউকেই করে ওঠা হয় না। কী এক অদ্ভূত সমস্যা হয়েছে আমার, কারুর সাথেই কথা বলতে ইচ্ছে করে না। নিকটজন, প্রিয়জন, ক্যাজুয়াল কলীগ – কারুর সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করে না। অথচ প্রফেশনাল জগতে আমার কাজটাই কথা বলার। কোচিং, ফেসিলিটেশন, গ্রুমিং, মেন্টরিং – এর বাইরেও বিভিন্ন লেভেলের ম্যানেজমেন্ট, প্রজেক্ট, পোর্টফোলিও, ডেলিভারি।
ফরিদা সেদিনও ফোন করেছিল। একথা সেকথা বলার পরে আমাকে বলল, সিকি, তুমি ব্যাটা বড্ড বেশি পলিটিকাল জিনিসপত্রে ইনভলভড হয়ে যাচ্ছো। দুনিয়ার আর কিচ্ছুতে তোমার নজর পড়ছে না, খেয়াল করে দেখেছো?
ইন্ট্রোস্পেকশন। নিজে নিজে হয় তো হয়ে উঠছিল না, ফরিদাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখাল – তোমার ফেসবুকের টাইমলাইন জুড়ে দ্যাখো, পর পর পলিটিকাল মেসেজ, এবং প্রতিটাই বেশ জোরদার মেসেজ, কখনও সারকাস্টিক টোনে, কখনও সিরিয়াস টোনে, তোমার নিজের লেখা, নিজের মতন লেখা যে আমরা খুব মিস করছি, সেটা ভেবে দেখেছো কখনও?
ততদিনে আমার ফেসবুক মেসেঞ্জারে পিনাকী আর সৈকতের পিং এসে গেছে, সিকি, ভোটের জন্য কিছু লিখতে পারবে? আমি বলেছি, পারব না। সময়ের অভাব। মিথ্যে বলি নি। অফিসের চাপ ভয়ঙ্কর চলছে, এবং চলছেই। সকাল সোয়া আটটায় বেরোই, বাড়ি ফেরার কোনও নির্দিষ্ট সময় নেই, বিকেল বা সন্ধ্যের দিকে কোনওক্রমে আধঘণ্টার ব্রেক পেলেই অফিস থেকে বেরিয়ে পড়ি, বাড়ি ঢুকতে ঢুকতে পরের কলের সময় হয়ে যায়। চলে রাত সাড়ে নটা, দশটা, এগারোটা। এমনও হয়েছে, আলু পেঁয়াজ ফুরিয়ে গেছে ঘরে, জানার পরেও পরপর তিনদিন আমি অফিস থেকে ফেরার পথে আলু পেঁয়াজ কিনে আনার মতও সময় পাই নি।
না, অজুহাত দেবার জন্য গপ্পো ফেঁদে বসি নি। সারাদিনে যতটুকু সময় জোটে, সেই ভাবে কোনও সৃষ্টিমূলক কাজে লাগাতে পারি না, চটজলদি হোয়াটস্যাপ মেসেজ আর ফেসবুক টাইমলাইনে চোখ বুলিয়ে দু চারটে কমেন্ট আর একটা দুটো পোস্ট করার বেশি কিছু করেও ওঠা হয় না। তবু কি পরিবর্তন টের পাই না?
ফরিদা যেটা বলছিল, সেটা আমি নিজেও খেয়াল করছিলাম কদিন। হেট মেসেজ, উগ্র ন্যাশনালিজম আর ফেক জিনিসপত্রের কাউন্টার করতে করতে কখন যেন আমি নিজেও ইতরদের ঘেন্নার রাজনীতির অংশ হয়ে গেছি। আমি তাদের টার্মেই খেলছি। বিজেপি বা আরেসেসের সঙ্গে সামান্যতম সম্পর্ক আছে, বা তাদের প্রতি সামান্যতম দুর্বলতা আছে, এমন লোক দেখতে পেলেই তাদের ব্লক করছি। কী যেন একটা অশান্তি ভেতর থেকে আমাকে কুরে কুরে খেয়ে নিচ্ছে। চারপাশে যে ধরণের মাইন্ডসেট, যে সব কথাবার্তা দেখছি, শুনছি, পড়ছি – আরও আরও বেশি নিরাশ হয়ে পড়ছি। শুধু কথা বলাই নয়, আমার আর গান শুনতে ইচ্ছে করে না, বই পড়তে ইচ্ছে করে না, সিনেমা দেখতে ইচ্ছে করে না, সৃষ্টিশীল কিছু লিখতে ইচ্ছে করে না, ভোররাতে বেরিয়ে পড়ার ডাক আর শুনতে পাই না, জগতের কোনওকিছুতেই আর আসক্তি খুঁজে পাই না। ভুল করেও যদি কখনও ব্যতিক্রমী একটা দুটো ঘণ্টা পেয়ে যাই, আমার, একলার, নিজের মত – থম হয়ে বসে থাকি ঘরের বিছানায়। কিছু করতে ইচ্ছে করে না। কুমুদির ফোনের উত্তর দেব ভেবেও দেওয়া হয় না, পিনাকীর মেল পড়ে থাকে ইনবক্সে তার নিজের মত, উত্তর দিতে ইচ্ছে হয় না। ... এরা তো বাইরের লোক, এই লেখাটা, আজ নয়ই এপ্রিল লেখার সময়, মনে করে দেখলাম, গত দু সপ্তাহ আমার বাবা-মাকে ফোন করা হয়ে ওঠে নি।
ইচ্ছে করে না।
সেই ইচ্ছে করে না-র কারণেই বলেছিলাম, কিছু লিখব না। কিন্তু লিখব না বললেই কি মন মানে? অন্ধকার ঘরে, যখন সবাই ঘুমের অতলে, আমি জেগে শুয়ে থাকি, মাথায় এতোল বেতোল লেখারা ঘোরাঘুরি করে। লাইনের সাথে লাইন জুড়বার চেষ্টা করি, প্যারাগ্রাফের শেপ আন্দাজ করার চেষ্টা করি অন্ধকারের গভীরে, তারা জুড়তে চায় না। তারা ভেঙে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায়।
তিন বছর আগে কেমন একটা ঘোরের বশে পর পর তিন পর্বে লিখে গেছিলাম মন কি বাত, এক দেশদ্রোহীর জবানবন্দী। অনেকবার ভেবেছি, ঐ শিরোনামেই কিছু লিখি আবার, চতুর্থ পর্ব নাম দিয়ে। ইচ্ছে করে নি। একটা একটা করে ঘটনা ঘটেছে, ভেবেছি, এইবারে লিখব। ডিমনিটাইজেশন এল, এদিক ওদিক খিল্লি করেছি, প্যারডি মীম সব বানিয়েছি, লিখি নি। কত লোক মরল গরুর নামে, ধর্মের নামে, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক একদিন গুনতি শেষ করে জানাল – যত নোট বাতিল হয়েছিল, তার প্রায় সবটাই ফিরে এসেছে ব্যাঙ্কের ঝুলিতে, কালো টাকার সন্ধান পাওয়া যায় নি। লাল পতাকা নিয়ে কৃষকরা মার্চ করে গেলেন মহারাষ্ট্রে, রাজস্থানে, দিল্লি এলেন, আমি যাবার সময় করে উঠতে পারি নি। ঘোরের মধ্যে চলছিলাম। সকালে অফিস, সন্ধ্যেয় অফিস, মাঝরাতে অফিস, শেষরাতে অফিস, ফাঁকে ফাঁকে ফেসবুক আর হোয়াটস্যাপ। ঘরে বসে সংক্ষিপ্ত সময়ের পরিসরে যতটুকু বিপ্লব করা যায়, ততটুকুর বেশি করার সাধ্য আমার ছিল না – আজও নেই হয় তো।
উত্তরপ্রদেশে পালাবদল হল, অজয় সিংহ বিস্ট ওরফে যোগী আদিত্যনাথ নামক ক্রিমিনালটি উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হয়ে এলেন, তার পরের কয়েকদিন ঝড় বয়ে গেল আমাদের পাড়ার মাছমাংসের বাজারটির ওপর দিয়ে। ছুটকোছাটকা কয়েক প্যারাগ্রাফ লিখেছিলাম বটে, কিন্তু সেভাবে লেখা হয়ে ওঠে নি। ভেবেছিলাম, এখনও সময় হয় নি লেখার। লিখব, যখন মন থেকে ডাক আসবে। অক্ষরেরা, শব্দেরা তখনও জমাট বাঁধছিল না একলা সময়ের মুহূর্তগুলোতে। অক্ষমতা রাগ হয়ে ফুটে বেরোত আমার র্যান্ডম পোস্টে, হয় তো বা কখনও আমার ব্যবহারেও।
পুলওয়ামার ঘটনা ঘটল এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে। জাতীয়তাবাদের ঢেউ আছড়ে পড়তে দেখলাম আমার পাড়ায়, হাউজিং সোসাইটিতে, অফিসের ডেস্কের আড্ডায়। অফিসে আমি শুধু এবং শুধুমাত্র কাজ করি, কোনও রকমের রাজনৈতিক তরজায় অংশ নিই না, শুধু কানদুটো খোলা রাখি। তর্কে অংশ নিলে মজা অনেকটাই নষ্ট হয়ে যায়।
নয় নয় করে ষোল বছর হয়ে গেল দিল্লিবাসের। কম দিন তো দেখছি না এই সুবিশাল শহরের লোকগুলোকে, তাদের একজন হয়ে উঠতে পারি নি অবশ্য আজও। কখনও রাজনৈতিক আলোচনা, পাবলিক পরিসরে এ শহরের মানুষকে করতে দেখি নি। এ অঞ্চলের গয়নার ডিজাইন বা মিষ্টির কোয়ালিটির মতই এদের রাজনৈতিক বোধও খুবই মোটাদাগের লাগে, অন্তত আমার কাছে। এদের কাছে আগে রাজনীতির কোনও ডেফিনিশনই ছিল না। কমিউনিস্ট মানে ছিল নকশালী মাওবাদী, আর তার বাইরে ভাজপা / বিজেপি এবং কংগ্রেস ছাড়া আর কারুর অস্তিত্বই ছিল না। ভোটের দিন এ শহর সপরিবারে ছুটি কাটাতে যেত। অফিসে রাজনীতির আলোচনা বা মেরুকরণের প্রক্রিয়া, কখনও দেখি নি।
যতদিন না ২০১৪ এল।
বদল একটু একটু করে দেখতে পাচ্ছিলাম। প্রথমে ২০১২র নির্ভয়া কাণ্ড, তার হাত ধরে তুমুল বিক্ষোভ দিল্লি জুড়ে, ধর্ষণ সংক্রান্ত আইনের বদল এবং শীলা দীক্ষিতের অসহায়তার মধ্যে থেকেই ধীরে ধীরে মাথা তুলছিল লোকপালের দাবিতে আর “ভ্রষ্টাচার” হটানোর দাবিতে আন্না হাজারের অনশন, সাথে একটা দুটো চারটে নতুন নাম – অরবিন্দ কেজরিওয়াল, যোগেন্দ্র যাদব, মনীশ সিসোদিয়া, প্রশান্ত ভূষণ। ততদিন পর্যন্ত ঠেঁট দিল্লিওয়ালা একটাদুটো কথার পরেই তৃতীয় বাক্যে চলে যেত প্রপার্টি সংক্রান্ত আলোচনায়।
সেই সময় থেকে মেনস্ট্রিম আলোচনায় চলে এল পলিটিক্স। কেজরিওয়াল। আম আদমি পার্টি। কংগ্রেসের প্রতি বিদ্রূপ শুরু হল। শীলা দীক্ষিত নিজে তার জন্য অনেকাংশেই দায়ী ছিলেন, দুর্নীতির বটগাছ গজিয়ে তুলেছিলেন তিনি নিজের রাজত্বে, অবশ্য কাজও হয়েছিল প্রচুর। সিএনজি বাস ট্যাক্সি, দিল্লি মেট্রো তার মধ্যে একটা দুটো। কিন্তু সত্তর বছরের ডাইন্যাস্টি পলিটিক্সের ন্যারেটিভ তখনও শুরু হয় নি।
শুরু হল ২০১৪ সালে।
ছাপ্পান্ন ইঞ্চির বিকাশপুরুষ দিল্লির মসনদে বসার পর থেকেই খুব তাড়াতাড়ি বদলে যেতে থাকল আমাদের চারপাশ, আমাদের চেতনা। ইনভিজিবল রাজনীতি ভিজিবল হয়ে দেখা দিল আমার চোখে। দিল্লিতে দেওয়াল লিখন হয় না, পতাকা কাঁধে মিটিং মিছিল হয় না, চৌরাস্তার মোড়ে মাইক বেঁধে জ্বালাময়ী বক্তৃতাও হয় না। কিন্তু বদলে গেল ২০১৪র পর থেকে।
বদলে যাচ্ছিলাম আমিও। চিরদিন রাজনীতি থেকে দূরে থাকা আমি উন্মাদের মত ছুটে গেলাম, মিছিলে পা মেলালাম জীবনে প্রথমবার, কানহাইয়া তখন জেলে, মাত্র দুদিন আগে আদালত চত্বরে উকিলের বেশধারী কিছু গুণ্ডা তাকে নির্মমভাবে মেরেছে। দিল্লি এনসিআরে লাল পতাকার মিছিল আমি কখনও দেখি নি, যা পশ্চিমবঙ্গে আমার ছোট্ট থেকে বেড়ে ওঠার দৃশ্যকল্পের এক নিয়মিত অংশ ছিল। সেদিন দেখলাম। বিভিন্ন নাম লেখা পতাকা হাতে হাজারে হাজারে ছেলেমেয়ের দল বারাখাম্বা রোডের ওপর আছড়াচ্ছে, গজরাচ্ছে, চীৎকার করছে। আশপাশের লোকজন আমার মতই হতভম্ব, এ জিনিস বোধ হয় দিল্লি কখনও দেখে নি। শ্লোগান দিতে গিয়েই আমি ভিড়ে গেলাম দলে। সেদিন প্রথম ভেতর দিয়ে অনুভব করলাম, অরাজনৈতিক বলে এ জগতে কিচ্ছু হয় না। আমার চাল ডালের দাম, আমার প্রেম, আমার গান, আমার বই – সব, সবকিছুই রাজনীতির অংশ হয়, হতে পারে।
ততদিনে আখলাক খুন হয়েছেন। জেনেছি, ফ্রীজের খাবারও রাজনীতির অংশ হতে পারে।
স্মৃতিচারণ থাক। এ বছরেই ফিরে আসি। প্রথমে পুলওয়ামা, তারপরে সার্জিকাল স্ট্রাইক এবং সেই সংক্রান্ত জাতীয়তাবাদের ঢল, ইতিউতি শুনতে পাওয়া অমুকের চাকরি চলে গেছে “শহীদ” নিয়ে কমেন্ট করার জন্য, তমুক ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন বিপরীত মত পোষণ করার জন্য, অমুকের বাড়ি গিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় তাঁকে বাধ্য করা হয়েছে “ভারত মাতা কি জয়” বলতে, কারণ তিনি সার্জিকাল স্ট্রাইকের সত্যতায় সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন।
রাতারাতি অফিসে ক্যাফেটেরিয়ায় সক্কলে কী বিষম লেভেলের বিশেষজ্ঞ হয়ে গেল। সকাল সকাল অফিস গিয়ে শুনি ছাপ্পান্ন ইঞ্চির প্রশংসা, অ্যায়সা হি হোনা চাহিয়ে পাকিস্তান কে সাথ। প্রতিবার পাকিস্তান শব্দটা বলার সাথে সাথে সেই রকমের ঘেন্না বেরিয়ে আসছিল, যেমন ঘেন্না বেরোয় বাংলাদেশের উগ্র ধর্মান্ধের মুখে “নাস্তিক” শব্দ উচ্চারণে বা কোনও আম দিল্লিওয়ালার মুখে “কমিউনিস্ট” শব্দের উচ্চারণে। খাবার টেবিলে শুনছি বিশেষজ্ঞের ডিবেট চলছে – কার্পেট বম্বিং না রকেট লঞ্চার – কোনটা বেশি এফেক্টিভ হতে পারে পাকিস্তানকে “মু-তোড়” জবাব দেবার জন্য।
সেদিন সন্ধের মুখে অভিনন্দন বর্তমানের ধরা পড়ার খবরটা কনফার্মড হল। ততক্ষণে আমি অফিস থেকে চলে এসেছি। পরদিন অফিসে পৌঁছে দেখি জাতীয়তাবাদের জোয়ার প্রায় পুরোপুরিই স্তিমিত, রাতারাতি সক্কলে কার্পেট বম্বিং এক্সপার্ট থেকে বদলে হয়ে গেছে জেনিভা কনভেনশন এক্সপার্ট।
অভিনন্দন চা খেয়ে ভারতে ফিরে এলেন, ন্যারেটিভ কিন্তু বদল হল না। ভক্তের দল একটিবারের জন্যেও সেই প্রশ্নগুলো তুলল না, যেগুলো তোলা আদতে দরকার ছিল। কী করে পুলওয়ামার ঘটনা ঘটতে পারল, কেন জওয়ানদের প্লেনে বা হেলিকপ্টারে শিফট করা গেল না, কেন ইনটেলিজেন্সের কাছে খবর থাকা সত্ত্বেও কিছু আটকানো গেল না, কোনও প্রশ্ন নেই। চুয়াল্লিশটা প্রাণ চলে গেল, ছাপ্পান্ন ইঞ্চির তরফে অ্যাঙ্গার বিল্ড আপ করা হল দেশজুড়ে, এবং সার্জিকাল স্ট্রাইক। তাতে এফ সিক্সটিন মরেছিল না কাক, তাই নিয়ে অবশ্য ধোঁয়াশা এখনও কাটে নি।
এ সব আর নতুন কিছু নয়। আপনারাও জানেন, তাই আলাদা করে আর কিছু লিখি নি। নিজের ফেসবুক টাইমলাইনের দিকে তাকিয়ে এখন সত্যিই আমার খারাপ লাগছে, সত্যিই তো, আমিও তা হলে ওদের ঐ ঘেন্নার রাজনীতির অংশ বনে গেলাম।
না, যেটুকু বদল চোখে দেখা যায়, যেটুকু বদল ফেসবুকের টাইমলাইনে দেখা যায়, শুধু সেইটুকু বদলই আমার হয় নি। ছোট থেকে আমি রাজনীতির থেকে দূরে থাকা মানুষ ছিলাম। কলেজে কোনও পার্টি ইউনিয়ন ছিল না, চাকরি করতে ঢুকেও কখনও ভোট দেবার কথা মাথাতেই আসে নি। কী হবে দিয়ে, সবই তো ইয়ের এপিঠ আর ওপিঠ, দেখলাম তো, বুঝলাম তো – এই রকমের মাইন্ডসেট ছিল আমার। ভোটার কার্ডই বানাই নি। একটা ভোটের কতটা মূল্য, সত্যি বুঝি নি কোনওদিন।
এই পাঁচটা বছর বুঝিয়ে দিল। বদলে দিল। বিজেপি যখন ঘরের দোরগোড়ায় চলে এল, তখন বুঝলাম গণতন্ত্রকে, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিকে অবজ্ঞা করার ফল কতটা ভয়ানক হতে পারে। এই পাঁচটা বছরের প্রতি আমি আজীবন কৃতজ্ঞ থাকব। এই পাঁচটা বছর আমাকে রাজনীতি চেনাল, আমি জানলাম রাজনীতির বাইরে কিছু হয় না, কিচ্ছু হয় না। আমি জানলাম, আমার চারপাশে কত ক্লোজেট থেকে বেরনো লোকজন ঘুরে বেড়াচ্ছেন, উচ্চশিক্ষিত, সাদা কলারের লোকজন, যাঁরা সব দেখেশুনেও অন্ধভাবে সাপোর্ট করেন যোগীকে, ছাপ্পান্ন ইঞ্চিকে। মনে করেন এঁরাই আচ্ছে দিন আনবেন, এখনও, মনে করেন, এঁরাই বিকাশ আনবেন। এঁরা মনে করেন, মুসলমানরা তো “ওরকমই”। নিচু জাতকে তো “পায়ের তলাতেই” রাখতে হয়, নইলে মাথায় চড়ে বসে। “ওদের” সাথে তো “ওদের” ভাষাতেই কথা বলতে হয়। “ওরা” তো আমাদের থেকে আলাদাই, ওরা শুধু জুতোয় সোজা।
এই পাঁচটা বছরে কত মানুষকে চিনলাম। লিবারালিজমেরও কত শেড চিনলাম। রাস্তায় নামলাম, মিছিলে পা মেলালাম, সামনে থেকে শুনলাম যোগেন্দ্র যাদব, কানহাইয়া কুমার, সীতারাম ইয়েচুরির বক্তৃতা। মুগ্ধ হয়ে শুনেছিলাম শেহলা রশিদকে – সে মুগ্ধতাও অবশ্য কেটে গেছে বেশ কিছুকাল আগেই।
এই পাঁচটা বছর আরেকটা কাজ করিয়ে নিল আমাকে দিয়ে। জীবনে প্রথমবারের জন্য, আমি ভোটার কার্ড বানিয়েছি। জীবনে প্রথমবারের জন্য, আমি ভোট দেব। ফেসবুকে নিজের ইন্ট্রোতে নিজেকে দেশদ্রোহী হিসেবে ঘোষিত করে রেখেও, দিনের শেষে, একলা, নির্জনে, এই দেশটাকে যে আমি কতটা ভালোবাসি, তা অনুভব করতে পেরেছি। সেই ভালোবাসার দাগ আমি নিয়ে আসব নিজের আঙুলে, স্বেচ্ছায়। এই দেশকে ফ্যাসিবাদের চারণভূমি আমি হতে দেব না। কিছুতেই না।
আর দুটি রাত পোয়ালেই ভোট। সক্কাল সক্কাল চলে যাব বুথে। আপনারাও যাবেন তো সব, যারা দেশে আছেন?
মনে রাখবেন, লোকসভা নির্বাচন, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচন নয়। এটি আপনার এলাকার, আপনার লোকসভা ক্ষেত্রের প্রতিনিধির নির্বাচন। দল না দেখে, কাজ দেখুন। কে ঘেন্না ছড়ায় না, কে বিদ্বেষের বীজ বোনে না, সেই মানুষটিকে বাছুন।
রাষ্ট্রকে ভালো না বেসেও দেশকে ভালোবাসা যায়। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জারি রেখেও দেশপ্রেমিক হওয়া যায়। ওরা এটাকেই গুলিয়ে দিতে চাইছে। ওরা যুগে যুগে তাইই চায়। উনিশশো তিরিশের দশকের জার্মানিতে, দু হাজার দুইয়ের গুজরাতে, দুহাজার চোদ্দ-পরবর্তী ভারতে। প্যাটার্নটা চিনতে শিখুন। রাইখস্ট্যাগের আগুন, গোধরার দুর্ঘটনা আর পুলওয়ামার বিস্ফোরণের মধ্যে প্যাটার্নের একটা মিল আছে। ভোট দিতে যাবার আগে সেই প্যাটার্নের মিলটা বুঝে নেবার চেষ্টা করুন।
খুব কঠিন নয় কিন্তু।
পুনশ্চঃ লেখা শেষ করতে গিয়ে মনে পড়ল এখনকার হাল হকিকত নিয়েই কিছু লেখা হল না।
বাড়ির কাছে মেট্রো স্টেশনের সামনে রোজ সকাল আটটা থেকে একগুচ্ছ লোক (আট থেকে ন জন) দাঁড়িয়ে হাততালি দিয়ে শ্লোগান দিচ্ছে। হাতে লম্বা লম্বা খেঁটো লাঠি, চার পাঁচজনের পরণে সাদা শার্ট আর সেই বিখ্যাত হাফপ্যান্ট – আরএসএস। বাকিরা সাধারণ পোশাকে, হাতে বিজেপির পতাকা। কালও দেখেছিলাম। আজও দেখলাম। হয় তো আজই শেষ, কারণ পরশুই ভোট।
ন্যাশনাল হাইওয়ে চওড়া হচ্ছে। যানজট, ডাইভার্সন। তার মাঝে চোখ মেলে দেখলাম ছাপ্পান্ন ইঞ্চির বিশাল বড় মুখওলা বিলবোর্ড, তাতে লেখা, আতঙ্কবাদীওঁ কো ঘর পর ঘুষকে মারা – ভাজপা কো ভোট দেঁ।
নয়ডা শহরের মধ্যে এদিক ওদিক অনেক ছোট ছোট গ্রাম আছে। গ্রেটার নয়ডাতেও। তাদের বেশির ভাগই রীতিমত ব্যানার টাঙিয়ে দিয়েছে গ্রামে ঢোকার রাস্তায় – বিজেপির “প্রত্যাশী” মহেশ শর্মা যেন এই গ্রামে না ঢোকেন।
মহেশ শর্মা এখন সেক্টর সাতাত্তর আটাত্তরের বড়লোকি সোসাইটিগুলোতে ঘুরে বেড়িয়ে নিজের বেস বাড়াচ্ছেন। সোসাইটিগুলোর একটার নাম, মহাগুণ মডার্ণ। এই মুহূর্তে সেটা আরএসএসের স্ট্রংহোল্ড। রামমন্দির তৈরি হচ্ছে সোসাইটির মধ্যে।