সব ভোটের আগেই চাদ্দিক দেখে মনে হতে থাকে এবারের ভোট বুঝি এই নশ্বর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভোট l ভোটারের কাছেও যেমন, রাষ্ট্রের কাছেও তেমন, দলগুলোর কাছে তো বটেই l ২০১৪ ভোটও সেদিক থেকে ব্যতিক্রম নয় l ভাজপা আসবে কিনা, তাকে আটকানোর জন্যে কংগ্রেসকে সমর্থন করা উচিত কিনা – আর অঙ্গরাজ্য পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দাদের কুশাসনের প্রতীক তৃণমূল কিম্বা বামফ্রন্টকে অনেক ভোটে জয়ী করানো উচিত কিনা – সে নিয়ে মূল লড়াই l সাবসেটও আছে l সেগুলোও জরুরি বটে ! এগুলো বোঝা যায় ! আবার অনেক কিছু বোঝা যায় না l ধরুন, ২০০৯ সনে পবিত্র পরিবর্তনের ডাক বুঝে উঠতে পারিনি l লোকসভা ভোটে রাজ্যে কেন পরিবর্তনের ডাক উঠলো – সে নিয়ে বিদগ্ধজনেরা নানা বাণী বিতরণ করেছেন – কিন্তু সে সব উত্তর শুনে বা পড়ে মনে হয়েছে – ওই যুক্তিগুলো তাঁরা নিজেরাও বিশ্বাস করে ওঠেননি l মনে হয়েছিল একটা এজেন্ডা যা আগে থেকে ঠিক করা, সেই এজেন্ডার হাওয়াই চটিতে পা গলিয়ে ফেলেছেন অনেকে l
সে যাক ! এই ১৪ সালের ভোট ফের জরুরি নিশ্চিত ! এক এক রকম সেট অফ জনতার কাছে এক এক রকম কারণে l এদের মধ্যে অন্যতম একদল হলেন বাংলাদেশের হিন্দুরা l তাঁদের মনে হচ্ছে এখানে মোদী সরকার এলে কড়া হিন্দুত্বের একটা আবহ তৈরী হবে, যার ফলে বাংলাদেশের উগ্র মুসলিমরা চাপে থাকবে l বাংলাদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা একটু কম বিপন্ন থাকবেন l আরেক দল হল – প্রত্যাশী ভারতীয় l এনারা হিসেব কষেন যে কোন দল ক্ষমতায় এলে ইন্টারেস্ট রেটের কীরকম অদলবদল হবে – ভারতীয় মুদ্রা বিশ্ববাজারে কী দামে বিকোবে – এবং তার সঙ্গে তাঁদের জীবনের ওঠাপড়া কত মোলায়েম ভাবে গায়ে লাগবে ইত্যাদি l আছেন কল্যাণকামী রাষ্ট্রের স্বপ্নাতুর বন্ধুজনেরা l তাঁরা বিভিন্ন ভাবে প্রেশার গ্রুপ তৈরি করতে থাকেন – এই আশায় যে সংসদে তাঁদের দাবি-দাওয়া সম্বন্ধে আলাপ আলোচনা হবে l আছেন দলীয় রাজনীতির প্রচণ্ড সমর্থকরা – যাঁরা ভিন্ন মতাবলম্বীদের একদম উড়িয়ে পুড়িয়ে দিতে চান – ভোট এলে, যেন তেন প্রকারেণ l এই সাবসেটের সবাই একটা জিনিস বিশ্বাস করেন – যে ভোট অতি জরুরি বিষয় l বিশ্বাস করেন যে ভোট দিয়ে এগুলো ঠিক হয় বা বদলানো যায় l প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের এই ধাঁচা তাই ক্রমশ এমন একটা লেজিটিমাইজড খাঁচা হয়ে ওঠে যে তার বাইরে আর কেউ কিছু ভাবতে পারেননা l এক্ষুনি যে প্রশ্ন চলে আসবে – সেটা হল, বিকল্প কী ? উত্তর হল জানি না l কিন্তু এনেকডোট হল – বিকল্প খোঁজার প্রক্রিয়াটা শেষ না করে দেওয়াই ভালো l
ভোটের জরুরিপনা সর্বাধিক প্রচারিত ও প্রকাশিত হয় কোথায় ? আমার একটি উত্তর আছে l মিডিয়ায় l যে নিজেকে সবচেয়ে বেশি বিক্রি করে ভোটের সময়ে l ভোটের সময়েই একবগ্গা একটা লোক চিত্কার করে যায় – দ্য নেশন ওয়ান্টস টু নো – আর ভোটার সেই চমত্কার রিয়ালিটি শো দেখতেই থাকে l ভোটের সময়েই কেউ বলতে পারে, আপনার মত আপনি ঠিক করুন আমার প্রকাশিত মাধ্যম দেখে, শুনে, পড়ে l কয়লা কেলেঙ্কারি নিয়ে কেস খাওয়া সাংসদ মিডিয়ায় বিনিয়োগ করতে শুরু করেন ভোট আসার বছর খানেক আগে থেকে, আর কেস খাওয়া মিডিয়া আস্তিন গুটোতে থাকে সমস্ত শক্তি সমভিব্যহারে l কেস দেবে বলে – আবার l মিডিয়া ঠিক করে – কে বসবে চ্যানেলে পক্ষে কিম্বা প্রতিপক্ষে – আগে ঠিক হয় কে কোন পক্ষ – পক্ষগুলো জানা থাকে, মানুষগুলো ঠিক থাকে, পরিচয় পরে দেওয়া হয় – ঠিক জুতসই কোনো পরিচয় না পেলে লাগিয়ে দেওয়া হয় বুদ্ধিজীবীর ট্যাগ l অজান্তে জনতা ধরে নিতে থাকে ইনি বুঝি সুশীল বলে গণ্য l আপ ভি খুশ, উও ভি খুশ ! পৈসা ভসুল ! (এ ছিল রিগ্যাল সিনেমার লাইন l ওখানে বিভিন্ন সিনেমা দেখা হত – যথা জওয়ানি ১৬ সাল কি, কিন্তু তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য সিন থাকত না – তাই নাইট শোতে ব্লু ফিল্মের একটা সিন লাগিয়ে দেওয়া হত মাঝে মাঝে – সিনেমার সঙ্গে সম্পূর্ণ সাযুজ্যবিহীন ভাবে একটি রতিদৃশ্য হঠাৎ চলল, ফের সিনেমাতে ফিরে আসা – সবাই খুশি l লাইটম্যান বলেছিলেন “আপ ভি খুশ, উও ভি খুশ ! পৈসা ভসুল !”) ভোটের বাজার এঁদের কাছেও কম জরুরি নয় বটে !
তাহলে ভোটে জেতার বা হারার প্রক্রিয়া বা পদ্ধতি কী? হিসেব মোটামুটি এরকম – জোর যার মুলুক তার ! এই গণতন্ত্রে আপনার বা আমার ভোট জরুরি বটে – কিন্তু তার চেয়েও জরুরি হল রিগিং/বুথ ক্যাপচার/পয়সা ছড়ানোর প্রক্রিয়া l এসব নিয়ে আপত্তি থাকতেই পারে – কিন্তু বাস্তবত সে সব আপত্তিতে খুব কিছু এসে যায় না l এসবই চলবে – যেমন চলবে আশা সৃষ্টিকারী সাচ্চা গণতন্ত্রমুখী দলের ভোটব্যাঙ্ক খুঁজতে নানান রকম আশাভঙ্গকারী পদক্ষেপ গ্রহণ l মুশকিল হয় – ভোট যাঁরা খোঁজেন, তাঁরা ভোট খোঁজার প্রক্রিয়াতেও গলতি করতে থাকেন l কিছুতেই তাঁরা ভোটারদের কাছে পৌঁছতে চান না – বরং চান মসনদটি বজায় রাখতে – এবারের মতন l ফলে মানুষ যখন নিজের মত পরিবর্তন করছেন – পরিস্থিতি যখন পাল্টাচ্ছে, তখন সেখানে পরিস্থিতি বুঝে পদক্ষেপ গ্রহণ করার চাইতে সস্তায় বাজিমাত করার চেষ্টায় থাকেন l ২০০৯ এর ভোটের আগে বিভিন্ন স্কুল পরিচালন সমিতির ভোটে যখন বাম প্রার্থীরা পশ্চিমবঙ্গের দিকে দিকে হারছিলেন, তখন প্রাজ্ঞরা সাবধান করেছিলেন, কিন্তু কানে তোলেননি অতি নিশ্চিত বামফ্রন্ট নেতৃত্ব – আর সেসব পরাজয়ের খবরের দিকে চোখ তুলে তাকানোর সুযোগই পাননি দুঁদে সমর্থকরা l গোটা জঙ্গলমহল ঘিরে যখন ক্রমে বাড়ছিল মাওবাদীদের প্রভাব – তখন নেহাৎ তাকে আইনশৃঙ্খলার সমস্যা ভেবে বসেছিলেন যাঁরা – তাঁরা শুধু আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্যেই আজও আওড়ে চলেন – এসবই আসলে বিরোধীদের চক্রান্ত l মনকে চোখ ঠেরে এঁরা দেখতেই পান না, সম্ভবত নিজের কাছেও দেখতে পান না, যে এই সিস্টেমে রাজ চালানোর জন্যে এঁরাই একসময়ে ওই মাওবাদীদের অস্ত্রভাণ্ডারের ও অস্ত্রচালকদের শরণ নিয়েছিলেন l এই সিস্টেম l এ-ই হল সিস্টেম l এবং এঁরা এই সিস্টেমটিকেও ঠিকভাবে আয়ত্ত করে রাখতে পারেন না – অতিনিশ্চিতির কারণে l কোনো জায়গায় তা বামফ্রন্ট রূপে আসে, কোনো জায়গায় সে অতিনিশ্চিতি দেখা দেয় রাজা কিম্বা সুরেশ নামে l দ্য ওভার কনফিডেন্ট গাইজ l রাজা/সুরেশ/বামফ্রন্ট এঁদের পতনের ফলে যাঁরা ভাবেন – যে গণতন্ত্র কোনো না কোনভাবে শেষ পর্যন্ত জিতলো – তাঁদের সঙ্গে আমি একমত নই l নই – কারণ আমার স্থির বিশ্বাস যে আসলে এ সবই হল মায়াঞ্জন পরিয়ে রাখার একটা খেলা l একটা তুকতাক l সিস্টেমের প্রতি আস্থা বাঁচিয়ে রাখার জন্যে l উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় শক্তি যদি নিজের জনতার কাছেই বার বার প্রত্যাখ্যাত হতে থাকে – ভোটদানের শতকরা হিসেব যদি নিম্নগ হয়, তবে প্রথমত সে বিশ্বদরবারে পরের লোন নেওয়ার যোগ্যতা হারায় আর নিজের সম্প্রসারণবাদকে লাগু করতে গেলে বৃহৎ শক্তিসমূহের কাছে ঝাঁটা লাথি খাওয়ার পরিস্থিতি তৈরী করে l এইখানে আমি একটা চক্রান্তের গন্ধ পাই l ব্যালট থেকে ইভিয়েম l ব্যালটে ভোট ছিল যতদিন, ততদিন একাধিক জায়গায় ছাপ মেরে নিজের ভোট বাতিলের সুযোগ থাকত l একাধিক ভোটের কাউন্টিং এজেন্ট হওয়ার সুবাদে দেখেছি, ব্যালটের পেছনে ভোটার নিজের বাতিল ভোটের সম্পক্ষে যুক্তি লিখে এসেছেন, কিম্বা সিম্পল খিস্তি l বাতিল ভোট তখন একটা বেশ ভালো পার্সেন্টেজ পেত l ইভিয়েম সে সুযোগ থেকে নাগরিককে বঞ্চিত করেছিল l একসঙ্গে দুটো বোতাম টেপা যেত না l টিপলেও ফ্র্যাকশন অফ সেকেন্ডের ফারাক বুঝতে পারত মেশিন আর প্রথম ভোটকে কাউন্ট করত l ২০১৪র ভোট এদিক থেকে জরুরি হয়ে উঠেছে l এই প্রথম ভারত দেশ না-ভোটের অধিকার দিয়েছে l একটা স্টেপ যাকে অস্বীকার করে আর থাকা যায়নি l কিন্তু রাইট টু রিকল নেই, এখনো l আর এখনো বুঝে উঠতে পারিনি যে কী করে আমার সব সামাজিক ইস্যুর প্রতিনিধি হয়ে উঠতে পারেন একজন ব্যক্তি – পাঁচ পাঁচ বছরের জন্যে l আমার প্রতিটি রিয়াকশন কী ভাবে পৌঁছয় একজন প্রতিনিধির কাছে ! আর যাঁরা মনে করেন, যে ন্যূনতম হলেও পৌঁছয় – একজন প্রতিনিধি অন্তত থকা জরুরি – তাঁদের কাছেও আমার জিজ্ঞাসা – এই প্রতিনিধিরা সর্বোচ্চ স্তরে যাওয়ার আগে কিম্বা পরে এমন লেভেলের ব্যক্তিগত আক্রমণে যান, যে তাঁদের দেউলিয়া মনে হতে থাকে l এঁদের ঠেকাতে তখন আবার পুলিশ লাগে কিম্বা কমিশন – যারা আবার সকাল সাড়ে ৯ টায় সেন্ট পার্সেন্ট পোলিং হয়ে গেলেও বলতে থাকেন – ভোট হয়েছে যথাযথ l আর সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছে গিয়ে একজন আরেকজনের বক্তব্যই শোনেন না l শুধু তাই নয় – খিস্তি করেন, মারামারি করেন, এবং তাঁদের মারামারি ঠেকাতে বারের মত বাউন্সার লাগে, যাদের নাম হয় মার্শাল l এঁরা এ-ও জানেন যে এঁদের সমস্ত কীর্তি কলাপ টিভিতে দেখা যাচ্ছে – লাইভ l কিন্তু এঁরা একই সঙ্গে এ-ও জানেন যে ভোটারদের সঙ্গে তাঁদের বিচ্ছেদ ঘটে গেছে l যে ভোটারদের নিয়ে প্রতিনিধি মিছিল করেন বা করতে চান l ক্রমশ মানুষ ও মিছিল আলাদা হয়ে যায় l
আর মিছিলে যাঁরা হাঁটেন, কিম্বা হাঁটেন না – তাঁদের প্রতিদিনের বাঁচা দূরতম ভ্রমণশেষে ঘরে ফিরে আসার মতন l তাঁদের প্রতিদিনের বাঁচা এক স্বাধীন সার্বভৌম স্বরাট স্বাবলম্বী বাঁচা l তাঁর বাঁচার বা ভ্রমণের সঙ্গে প্রতিনিধির বাঁচার কোনো যোগসাজস নেই l থাকে না l সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশবাসী প্রায় প্রতিদিনের বাঁচাই এক গোটা জীবন বাঁচার মতন l বিছিন্ন, কিন্তু বিচ্ছিন্নতাবাদী নয় l তার কোনো বাদ থাকে না l কিন্তু এই বিচ্ছিন্নতা বা এই বাদহীনতা তার পক্ষে গৌরবের নয় l অপমানের l বড় বেশি অপমানের l এখানে, এই ভূমিতে, আমাদের মতন যারা কালি কলম কমিপউটার ব্যবহার করতে পারে বা জানে, তারা জানে না এই অপমান বা বিচ্ছিন্নতার কাহিনী ঠিক কোন অক্ষরে লেখা উচিত l
তাই আমার আর তাদের প্রতিনিধিরা ক্রমাগত মিথ্যা বলতে থাকেন, মিথ্যা চিত্কার করতে থাকেন, মিথ্যা প্রতিনিধিত্ব করতে থাকেন l আমার সঙ্গে মিছিল নেই, আমার সঙ্গে মানুষ নেই, মিছিলের সঙ্গে প্রতিনিধি নেই, প্রতিনিধির সঙ্গে মানুষ নেই l
আমি ভোট বয়কট করিনি l ভোট আমাকে বয়কট করেছে l ভোট আর প্রতিনিধি এক হয়ে গেছে l আমি আর মানুষ একাকার হইনি l
*এ লেখার শেষাঙ্গে যাঁর দীর্ঘ ছায়ার আভাস গুটিকয় মানুষ চিনতে পারছেন, দেবেশ রায়ের সেই নিবিড় সহপাঠকদের কুর্নিশ জানাই l