এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  গপ্পো

  • নাটকটাটক

    জয়ন্তী অধিকারী লেখকের গ্রাহক হোন
    গপ্পো | ২৭ জানুয়ারি ২০১৫ | ১০১৬ বার পঠিত
  • প্রায় দুই দশক আগেকার এক সোনারোদ পুজোআসছে শরতের সকাল। তখন আকাশের নীলিমা গভীরতর ছিল, শিউলি তাড়াতাড়ি ও বেশী ফুটত, আসন্ন পুজোর গন্ধে বড় আনন্দ ছিল, পুজোর ধুমধাম অনেক দীর্ঘস্থায়ী ছিল, দিল্লীর বাঙালী ক্লাবসমূহে প্রচুর মেম্বার ছিল, “নাটকটাটকে” আবালবৃদ্ধবনিতার প্রবল উৎসাহ ছিল, সর্বোপরি সকলের ওজন ও রক্তচিনি দুইই অনেক কম ছিল।

    যথারীতি প্রচুর গবেষণা, ঝগড়া, তিনটি রেজিগনেশন পেশকরণ ও সামান্য সাধাসাধির পর প্রত্যাহার নেওন ইত্যাদির পর "গান্ধারীর আবেদন" বিপুল ভোটে জয়ী হল। ধৃতরাষ্ট্র, দুর্যোধন ইত্যাদি কাষ্টিং হয়ে গেছে, ভানুমতীও রেডী, কেবল গান্ধারী তখনো ফাইনাল হয়নি।

    রোব্বারের সকাল - মিটিং শুরু হবে, ঠিক এগারোটায়। আমি ও অর্পিতা ( দুই সম্ভাব্য গান্ধারী) ছেলেমেয়েদের ক্যারাটে ক্লাশে পৌঁছে দিয়ে একটু বাজার করতে গেলাম। দুজনেই মনে মনে ছক কষচি কিভাবে অন্যজনের ঘাড়ে কৌরবসম্রাজ্ঞীর গৌরবময় ভূমিকাটি চালান করে দেয়া যায়।

    নানারকম আশকথাপাশকথা (ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা, কর্ত্তাদের অপদার্থতা, কলকাতার তুলনায় দিল্লীতে শাড়ীর ভ্যারাইটি ও কোয়ালিটির অসম্ভব নিম্নমান ইত্যাদি ইত্যাদি) বলতে বলতে আমরা অন্যবাজার সেরে ফলের দোকানের সামনে দাঁড়ালাম। আর সময় নেই, রিহার্সালে যাওয়ার আগেই একটি ফয়সালা হওয়া দরকার। অতএব, আপেল বাছতে বাছতে আমাদের মধ্যে এমত বাক্যালাপ হল -

    - "দেখ জয়ন্তী, তোর মত এমন লম্বা চুল (এত বাড়িয়ে বলতে পারে) আর কারো আছে যে সে গান্ধারী সাজবে? আমার এই ছোট চুলে গান্ধারী মানায় কখনো? "

    - "চুল দেখে গান্ধারীর পার্ট দিতে হলে দাড়ি দেখে ধৃতরাষ্ট্রের পার্ট দিতে হয়, ব্যানার্জিদা যুধিষ্ঠির সাজছে কেন তবে?"

    - "আরে, ব্যানার্জিদা ঐটুকু পার্টই মনে রাখতে পারবে না। ছড়িয়ে একসা করবে। ভেবে দ্যাখ তুই মহারাণীর সাজে আপাদমস্তক হীরেমুক্তো বেনারসী ইত্যাদি জ্বলজ্বলিয়ে ধৃতরাষ্ট্রকে বলছিস 'নিবেদন আছে শ্রীচরণে, অনুনয় রক্ষা করো তাত'"

    - "তাত? সে আবার কী? নাথ তো। আমার চেয়ে ছইঞ্চি বেঁটে ঐ কোহিনূর সান্যালকে আমি নাথ ফাথ বলতে পারব না। তোর তো হাইট নামে জিনিস নেই, তোর সঙ্গেই ওকে বেশ মানাবে।"

    - "আরে আমি নিয়মিত রিহার্সালে আসতেই পারব না, সংসারের ঊনকোটি চৌষট্টি সামলে, তার ওপর মেয়ের পরীক্ষা।"

    - "আমিও পারব না, আমারো ছেলের পরীক্ষা"

    কী এক কায়দার চুন্নী পরেছিল, এমন সিরিয়াস আলোচনার মধ্যে কেবলি উড়ে উড়ে যাচ্ছিল।

    হাতে সময় নেই মোটে, ছেলেকে ক্যারাটে ক্লাশ থেকে তুলতে হবে, ইদিকে অর্পিতার গোঁয়ার্ত্তুমির কারণে সামান্য একটা জিনিসের সমাধান তো হচ্চেই না, বরম আলোচনা কেমন একটা সহিংস রূপ নিচ্চে।

    দুজনেরি আপেল কেনা কখন হয়ে গেছে, তাই ফলওলার সামনে থেকে একটু ডানদিকে সরে এসে হাত মুখ নেড়ে আমরা তক্কো করছিলাম। এবং এটাও ডকুমেন্টেড থাকা উচিত যে অত উত্তেজনার মধ্যেও আমি তিনবার অর্পিতাকে বলেছিলাম ঐ হতচ্ছাড়া চুন্নী কোমরে বা মাথায় বেঁধে নিতে, যাতে বারে বারে উড়ে আমার গায়ে না পড়ে।

    নিয়তির অমোঘ ও কুটিল চক্রান্তে পাশেই এক ভালোমানুষের-দিন-নেই চেহারার পেশীবহুল গরু মন দিয়ে ছোলে বাটুরে খাচ্ছিল, নিজেদের সমস্যায় অতিরিক্ত ভারাক্রান্ত থাকায় আমরা তার ফোঁস ফোঁস দীর্ঘশ্বাস, হিংস্র চাউনি, কঠিন ভ্রুকুঞ্চন কিছুই খেয়াল করিনি।

    - "অত লম্বা লম্বা ডায়্লগ মুখস্ত করব বসে বসে? আমাকে পেয়েছিস কী?"

    - "এইসা দেব একটা কানের গোড়ায়, টেপ বাজবে তো, মুখস্ত করতে লাগে?"

    সেকেন্ডের ভগ্নাংশের মধ্যে যা ঘটল বর্ণনার অতীত। অর্পিতা বোধহয় ভাবল আমি সত্যি মারব, রিফ্লেক্সে হাত ছুঁড়ল, কী করে কে জানে চুন্নী উড়ে গিয়ে গরুর মাথায় পড়ল, শুধু শুনলাম ভয়ংকর হাড়হিম করা এক গর্জন আর, ফলওলার আর্ত্তনাদ

    - ভাগো, ভাগো জলদি ভাগো ও ও

    অত জোরে জীবনে কোন দিন ছুটিনি, সেও শাড়ি পরে। প্রাণ হাতে করে দৌড় কাকে বলে সেদিন বুঝলাম। চুমকি বসানো, মরুবিজয়ের কেতনের মত নীল চুন্নী শিঙে উড়চে-গরুর এবম্বিধ চেহারা যতবার মনে আসছে তত স্পীড বেড়েযাচ্ছে, এদিকে দুহাত ভর্ত্তি বাজার। রাস্তার লোকেরা হৈহৈ করে উঠেছে, কিন্তু কোনদিকে তাকাতে বা থামতে পারছি না, এদিকে দম ফুরিয়ে আসছে।

    পাড়ায় এক বিপুলবপু কমলাচুলের ডাক্তার ছিলেন, তিনি অ্যাসিস্ট্যান্ট রেখেছিলেন এক ইঞ্জেকশনপটু তরুণীকে। ফলে অসুখ যত সামান্যই হোক, ওনার কাছে গেলেই অন্তত ৫ টি ছুঁচ অবধারিত। মহল্লার সকলেই এটি জেনে যাওয়াতে রুগীপত্র বিশেষ হত না, যদিও চেম্বার রোব্বারেও খোলা থাকত। ডাক্তার আর সুঁইকুমারী রাস্তায় দাঁড়িয়ে লোকজন দেখে সময় কাটাতেন।

    সেদিনো দুজনে হাসি হাসি মুখে দাঁড়িয়েছিলেন - চোখে পড়তেই কেউ কিছু বোঝার আগেই অর্পিতা একহাতে আমাকে টেনে নিয়ে ফুটবল খেলার কায়দায় দুজনের মাঝখান দিয়ে গলে গিয়ে চেম্বারে ঢুকে ধড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিল। ডাক্তার আর সুঁইকুমারী বাইরে রয়ে গেলেন।

    সংসার করিয়ে গিন্নীরা যেখানে যে অবস্থায় যত সুকঠিন প্যাঁচের মধ্যেই থাকুক তাদের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে সাংসারিক (অ)কর্ত্তব্যের ছবিটি (ঠাকুরও মনে হয় এইধরনের কিছু বলেছিলেন)।

    বাইরে ডাক্তার ও সুঁইকুমারীর সমবেত গগনভেদী আর্ত্তনাদ, লোকজনের হৈচৈ,পাড়াতুতো কুকুরবাহিনীর উচ্চস্বরে প্রতিবাদ - এতসবের মধ্যেও চেম্বারে ঢুকে প্রথমেই নজরে পড়ল ডাক্তারবাবুর ফোনটি - ততক্ষণে আমরা নিজেদের মধ্যে ফিরে এসেচি, এ দরজা ভেঙে ঢোকার ক্ষমতা গরুর হবে না। অকম্পিত হাতে ফোন তুলে দৃঢ়স্বরে বাড়ীতে বলে দিলাম বাচ্চাদের নিয়ে আসতে। কর্ত্তা যথারীতি সামান্য প্রতিবাদ করছিলেন, তোমরা কোথায় আছ? আমি তো ঠিক চিনি না ক্যারাটে ম্যাডামের বাড়ী ( পড়ুন - এক্ষুনি টিভিতে ম্যাচ) এইসব। তার উত্তরে আরও দৃঢ়স্বরে জানিয়ে দিলাম যে আমাদের গরু তাড়া করেছে, এ জীবনে বাড়ী ফেরা হবে কিনা তার কোন নিশ্চয়তা নেই। ফিরতে না পারলে সবুজ ব্যাগে ব্যাংকের বই ও টাকা রাখা আছে।

    বাইরের ডাক্তার ও সুঁইকুমারীর হাহাকার ক্রমেই ভয়ানক মর্মভেদী রূপ নিচ্ছিল, যেন আমরা ওনার সব ওষুধ ইত্যাদি খেয়ে নেব, হায়, শরণাগতদীনার্তকে আশ্রয় দেবার কনসেপ্টই আর নাই!! কিন্তু আমরা দুজনে বেরোবার সাহসও ঠিক পাচ্ছিলাম না। হেনকালে কাকে দেখে যেন ডাক্তার প্রায় কেঁদে ফেল্লেন, "দেখিয়ে না, দো বংগালী ছোকরী মেরা চেম্বারকা সত্যনাশ কর দিয়া, হাউমাউ হাউমাউ, পেশেন্ট ওয়াপসি চলা গিয়া (১০০% মিথ্যে কথা)।"

    - "বংগালী ছোকরী?" ক্লাবের প্রেসিডেন্ট বর্মন জেঠুর হতভম্ব প্রশ্ন শোনা গেল।

    জেঠুর আওয়াজ পেয়ে গুটি গুটি দুজনে বেরোলাম, কিন্তু আমাদের দেখেই তিনি মহারাগে ফেটে পড়লেন।

    - "দেখা আপলোগোনে? আজকালকা ইয়ে - কোই দায়িত্বজ্ঞান নেহী। এগারো বজে রিহার্সাল আর ইয়ে দোনো ইধার ঘাপটি মারকে বৈঠা হ্যায় !!!!"

    এত্ত লোকজন, অপমানের একশেষ।

    তবে মিচকি হেসে শেষ কথা বলল ফলওয়ালা - "গায় তো উহাঁপরই ব্যয়ঠা থা। আপলোগ বেকারমে ভাগী"।

    জেঠুর সঙ্গে পায়ে পায়ে হেঁটে দুজনে ক্লাব ঘরের দিকে রওনা দিলুম। একটু গিয়েই সেই ভয়ংকর ডাইনোসরের খুড়্তুতো বোনকে দেখা গেল, চোখ বন্ধ করে ড্রাগনের মত নিশ্বাস ফেলচে, পিঠে নীল ওড়নার চুমকিতে রোদ পড়ে ঝিলমিল করচে।

    ক্লাবে পৌঁছেই অবশ্য আবার আমাদের হাড্ডাহাড্ডি ঝগড়া শুরু হয়ে গেল - একটা রক্তারক্তি হয় দেখে জেঠু থামিয়ে দিয়ে বল্লেন যে টসে যে জিতবে তাকেই গান্ধারী সাজতে হবে।

    ক্লাবে উপস্থিত জনতাও ততক্ষণে দুদলে ভাগ হয়ে গেছে। তবে ব্যাপারটা একটু গোলমেলে। যারা অর্পিতাকে গান্ধারী সাজাতে চায় আমি তাদের নেত্রী। এবং ভাইসি ভার্সা।

    টানটান শ্বাসরোধকারী উত্তেজনার মধ্যে জেঠু টস করলেন-

    ঢিংকাচিকা ঢিংকাচিকা ঢিংকাচিকা ---

    অর্পিতা জিতেছে, মানে ওকেই গান্ধারী করতে হবে - এ-এ-এ।

    কিন্তু বিধি বাম। জেঠু ফতোয়া দিলেন আমাকেও নাকি রোজ রিহার্সালে যেতে হবে।

    পরের রোব্বার সকাল দশটা থেকে রিহার্সাল।

    ******************************************************************

    দেখতে দেখতে পরের রোব্বার এসে পড়ল। কিশোরীরা করবে চিত্রাঙ্গদা। গান্ধারীর আবেদনে শেষ দৃশ্যে যুধিষ্ঠির চার ভাই ও দ্রৌপদীকে নিয়ে বিরস বদনে এসে দাঁড়াবেন। পাঁচ জনের মুখে কথাটি নেই, হেঁটমুন্ডে দাইড়ে থাকা ছাড়া কোন কাজও নেই, স্বভাবতই ঐ সব ভূমিকায় অভিনয় করার জন্য কাউকে পাওয়া যাচ্ছিল না। জেঠু তাই প্রচুর ভেবেচিন্তে চিত্রাঙ্গদার অর্জুনকেই বলেছিলেন একটু গোঁপটোপ লাগিয়ে যুধিষ্ঠিরের অনুগামী হতে, অর্জুন তো অর্জুনই থাকচে। ঐদিকের মদনকেও বোধহয় নকুল বা সহদেব সাজানোর ইচ্ছে ছিল, তার আগেই এই পরিকল্পনা জানতে পেরে অর্জুনের মা (বিশ্বভারতী) জেঠুকে ফোন করে নাটকের শুদ্ধতা,পবিত্রতা আরও কী কী সব উচ্চ উচ্চ ব্যপার সম্বন্ধে দেড় ঘন্টা ধরে এক বক্তৃতা দেন যা শোনার পর জেঠুর শরীর ও ব্যক্তিত্বের ওজন যথাক্রমে ২৫ ও ৪০ শতাংশ কমে যায়।

    ভীম, অর্জুন(গা আ), নকুল ও সহদেব পাওয়া যায় নি। প্রতিহারীও না।

    ক্লাবের এই সংকট দেখে অবশ্য আমি দ্রৌপদী করতে চেয়েছিলাম, হাজার হোক কর্ত্তব্য বলে একটা কথা আছে। কিন্তু একে তো যুধিষ্ঠির আমার চেয়ে বেঁটে হয়ে যাচ্ছে তাছাড়া গান্ধারী বল্ল আমকে দেখলে তার বিছুটি দিতে ইচ্ছে হচ্ছে। "ভূলুন্ঠিতা স্বর্ণলতা হে বৎসে আমার,হে আমার রাহুগ্রস্ত শশি, একবার তোলো মুখ,বাক্য মোর করো অবধান" - এত ভাল ভাল কথা বলা জাস্ট সম্ভব না।

    জেঠু নিজেই প্রতিহারী সাজবেন বলছেন - এই শুনে ধৃতরাষ্ট্র অবশ্য প্রবল উৎসাহে লাফিয়ে এসেছিল "জেঠু আপনি বরম ধৃতরাষ্ট্র করুন, আমি প্রতিহারীটা দেখি"।

    - "অ, আমি চক্ষু বুজে বসে থাকলে তোমাদের সামলাবে কে?"

    - "না, আপনি সিনিয়র মানুষ ,ঐটুকু পার্ট করবেন, কেমন একটা লাগে"

    - "যে পারে সে একলাইনেই পারে, বুঝলে হে ছোকরা"---

    ******************************************************************

    "প্রতিহারী - মহারাজ, মহিষী গান্ধারী দর্শনপ্রার্থিনী পদে।"

    ধৃতরাষ্ট্র - রহিনু তাঁহারি প্রতীক্ষায়।"

    “ইকি, তুমি অমন হাসি হাসি মুখ করে বসলে ক্যানো? দুর্যোধন এতক্ষণ ধরে এত ভালোমন্দ শুনিয়েছে, এখন আবার মহারাণী এসে কী বলেন তার ঠিক নাই, এই কি তোমার অমন প্রসন্নবদন হওয়ার সময়?”

    আবার হোক।

    "মহারাজ, মহিষী গান্ধারী দর্শনপ্রার্থিনী" ইত্যাদি।

    “ওঃহো ,তাই বলে অমন মুখ পেঁচকে গালে হাত দিয়ে বসতে হবে? গান্ধারী তোমায় মারতে তো আসছে না - “

    প্রচুর তোড়জোড় করে প্রথম দিনের রিহার্সাল শুরু হয়েচে। জ্যেঠুর পড়ার ও জেঠিমার গোঁসাঘর পুজোর আগে হয়ে গেছে ক্লাবের রিহার্সালরুম। আর জেঠুর রোদে বসে দাড়িকামানোর তিনঠেঙ্গে টুলটিতে আপাতত ধৃতরাষ্ট্র যথাসম্ভব রাজকীয় মর্যাদায় সাবধানে ভারসাম্য রেখে বসে আছেন। দুর্যোধন ও যুধিষ্ঠিরকে জেঠু কোন কাজে পাঠিয়েছেন, অগত্যা মাঝখান থেকে রিহার্সাল শুরু হচ্চে। কিন্তু বারবার এমন বাগড়া পড়াতে মহারাজের ধৈর্য্য থাকে না।

    "কেমন করে বসব দেখিয়ে দিন তবে নয়তো অন্য কাউকে দেখুন, আমার দ্বারা হবে না - "

    "হ্যাঁ, এই তোমাদের এক হয়েছে, কথায় কথায় রাগ অভিমান। কোন কুক্ষণে যে আমি নাটকে হাত দিয়েছিলাম। পান থেকে চুনটি খসেচে কি খসেনি অমনি হুমকি দিচ্চেন বাবুরা"

    জেঠুর কথা শেষ হওয়ার আগেই হাঁপাতে হাঁপাতে যুধিষ্ঠির এসে স্টেজে মানে সতরঞ্চির এরিয়ায় ঢুকে পড়ে, কিন্তু, তার পেছনে দুর্যোধনকে দেখা যায় না।

    "একি, তুমি আবার এখন ঢুকছ কেন? তোমার এন্ট্রি তো সেই শেষকালে, কোন কুক্ষণে যে আমি"

    "পাড়ার সব দোকানে ছোলেপুরী শেষ" কাঁদোকাঁদো মুখে ধর্মরাজ জানান।

    জেঠিমা আঁতকে ওঠেন, "সে কী কথা রে। এতগুলো মানুষ এখন খাবে কী? জয়ন্তী বরং ময়দা মেখে দিক, আমি আলুচ্চ্চড়ি বসিয়ে দিই।"

    "ও ময়দা মাখলে আমি লুচি খাব না বলে দিচ্ছি" অর্পিতার ঘোষণা শোনা যায়।

    "ধুত্তেরি দুলাইন রিহার্সাল এগোলো না, আলুচচ্চড়ির ব্যাবস্থা হচ্চে - " জেঠু এবার সিরিয়াসলি রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে ওঠেন, আর সেই আগুনে ঘৃতাহুতি দিতে রঙ্গমঞ্চে প্রবেশ করেন পারঙ্গমা সেন, অর্থাৎ চিত্রাঙ্গদার পরিচালিকা।

    "কী, কেমন এগোচ্ছে আপনাদের মহড়া? আমার মেয়েরা তো অর্ধেকের বেশী নাচ তুলে ফেলেছে। সুরূপার এক্সপ্রেশন দেখলে অবাক হয়ে যাবেন। দর্শক এই মেয়েকে ভুলতে পারবে না, জানেন, আমিই অবাক হয়ে যাচ্ছি, কেমন করে ঐটুকু মেয়ে ভূমিকাটি এত আত্মস্থ করে ফেল্ল, আশ্চর্য!!"

    মিসেস সেনের অসাধারণ ভাব এসে গেছিল আরও অনেকক্ষণ বলে যেতে পারতেন, কিন্তু তাঁকে কনুইএর গুঁতোয় প্রায় ঠেলে ফেলে দিয়ে ছোলে পুরীর গন্ধে পাড়া আমোদিত করে এবার ঢুকে আসে ক্লান্ত হাক্লান্ত দুর্যোধন।

    "ওঃ, সে-এ-ই রাজৌরী গার্ডেন থেকে ছোলে নিয়ে এলাম জেঠু। আর পাড়ায় ঢুকেচি কি ঢুকিনি, আমার বাইকটি দেহ রাখল। একহাতে বাইক ঠেলচি অন্যহাতে এই রাবণের গুষ্টির খাবার, ভাবা যায়? ওরে বাবারে, একটু না শুতে পেলে এক্ষুনি মরে যাবো রে!! সরুন, সরুন দেখি সব, দাঁড়ান প্যান্টটা খুলি - "

    “একি একি প্যান্ট খোলে কেন, ও জেঠু রোদ লেগে গেছে বোধহয়, এই মল্লিকা একটা ঠান্ডা জলের বোতল আন না, একি প্যান্ট খুলচ কেন, মেয়েরা রয়েচে, কোন কুক্ষণে যে আমি, আরে, কথা শোনে না দেখো, এই মেয়েরা চোখ বোজো সব, চোখ বোজো বলচি” -

    সকলের চক্ষু মুদ্রিত করন, ৩০ সেকেন্ডের সূচীভেদ্য অসহনীয় নীরবতা পালন, জেঠিমার বিস্মিত প্রশ্ন, "এ কি, তোমরা সব চোখ বুজে রয়েচ কেন? আর এই অভিষেক, পাজামা পরে শুয়ে আছ কেন?"

    পাজামা? সকলের ধড়ে প্রাণ ফিরে আসে।

    "একটা কাজ কর্তে গিয়ে গলদঘর্ম, আবার ভিরকুটি করে প্যান্টের নীচে পাজামা পরে আসা হয়েচে!! কোন কুক্ষণে যে আমি --- "

    ************************************************

    সেই ঝালমুড়িবেলার বন্ধুর পেটে এত প্রতিহিংসে জমেছিল?

    বহুবিধ মান-অভিমান, ঘটনা-দুর্ঘটনা, তর্কাতর্কি, ঝগড়াঝগড়ি, আয়লাসুনামী, সাধাসাধি, হাতাহাতি (প্রায়) ইত্যাদির মহাসমুদ্র পার হয়ে এসে গেল নাটকের দিন। অর্পিতা ওর দিদিমার দেওয়া অলওভার সোনার কাজ করা বেনারসী, ৫ কেজি মত হীরেমুক্তোসোনা ইত্যাদি একটি একটি করে পরার পর মেকাপদিদি ভারী যত্ন করে ভুরু আঁকতে লেগেচেন, আমি আনন্দিতমুখে দেখচি, হেনকালে মহারাণীর খেয়াল হল - "আরে, ভুরুফুরু এঁকে কী হবে? চোখ তো বাঁধা থাকবে। কী দিয়ে বাঁধব, অ জেঠিমা - "

    "এই রে, গামছাটা তো আনতে মনে নেই গো, মানে রিহার্সালে যেটা বাঁধতে সেইটে চাইছো তো" - মেকাপরূমের অন্যপ্রান্তথেকে ভীমের ধুতিবাঁধনরত জেঠিমার করুণকন্ঠ শোনা যায়।

    "আহা, সে তো রিহার্সালের সময়, এখন স্টেজে বেনারসীর সাথে মানানসই নেত্রবন্ধনী চাই তো।

    "ওহ, এই তো পেয়েচি-ই"

    প্রতিবাদের ন্যুনতম সময়টুকু না দিয়ে হতবাক আমার কোমরে বাঁধা পুজোর নতুন ওড়না খুলে পড়পড় করে আধখানা করে ছিঁড়ে একটু নাক মুছে নিয়ে মহারাণী সেটি চোখে বেঁধে ফেলেন।

    বাকী আধখানা দিয়ে চোখের জল মুছতে যাচ্চি ,এমনসময় রাজমহিষী দ্বিতীয় চালটি চালেন -

    "অঁ জেঠিমাঁ, কিঁচ্ছু দেখতে পাচ্চি নাঁ - "

    প্রবল সাধ্যসাধনা, ভরসাদান (স্টেজে একবারটি উটলে দেকবে সব জলের মত পরিষ্কার দেকচো) অপশন প্রদান (তবে কি দৌড়ে গিয়ে গামছটাই নিয়ে আসা হবে? খবদ্দার না, সে তোমরা খুঁজে পাবে না, মধ্যে থেকে সমস্ত তোলমাটি ঘোল। চুলমোছার গামছা কি আলমারীতে তুলে রেখেচো?) ইত্যাদি প্রবল হেলাভরে তাচ্ছিল্য করে রাজ্ঞী ঘোষণা করেন "জয়ন্তী আমার কিংকরী হোক। স্টেজে হাত ধরে ধরে নিয়ে যাবে - "

    হাতে সময়ও নেই, যা বলল তাইতেই রাজী হতে হল, ভাবুন একবার।

    ********************************************

    নাটক কেমন হল? আমায় জিগাবেন না। যাকে ঠেলে কুমড়োগড়ান গড়িয়ে দেওয়ার বাসনা বুকের মধ্যে হাঁকপাক কচ্ছে তাকেই হাত ধরে সযত্নে নিয়ে যেতে হচ্চে, হেন সংকট্কালে আর অন্যদিকে মন দেওয়া সম্ভব না।

    শুনেছিলাম দিব্য হয়েছিল - ধৃতরাষ্ট্রের সামান্য লেংচে চলা (আগের দিন বেড়াল তাড়ানোর ফল), ভানুমতীর তুলনায় গান্ধারীর গয়্নাধিক্য, যুধিষ্ঠিরের ফিঁচফিঁচ হাঁচি, ও গান্ধারীর অকারণ হাসিহাসি মুখ বাদ দিলে।

    শেষটাও লিখি -

    নাটকটাটক শেষ, ঝগড়া ভুলে পোঁটলাপুঁটলি নিয়ে হাসিমুখে আমি ও অর্পিতা বাড়ীর পথে, এমন সময় ইস্কুলবেলার অর্পিতা আমার কুনুই ধরে টানে - "ঐ দ্যাখ"।

    দেখি একটু দূরে দুর্যোধন ও চিত্রাঙ্গদা - চিরন্তন
    ফুলডোরে বাঁধা ঝুলনাটিতে, বিভোর।

    "সে কি রে, এতদিন বুঝতে পারি নি তো"

    "হাঁদিই রয়ে গেলি" - অর্পিতা সস্নেহে হাসে।
    -------------------------------------------------------
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • গপ্পো | ২৭ জানুয়ারি ২০১৫ | ১০১৬ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। কল্পনাতীত মতামত দিন