(এই লেখা প্রথম প্রকাশিত হয় ‘দি ইলাস্ট্রেটেট উইকলি অফ ইন্ডিয়া’ র ‘মার্চ ২৩, ১৯৮৬’ সংখ্যায়; বিষয়টি আজও প্রাসঙ্গিক - সম্পাঃ)
১৯৮২ সালে যোজনা কমিশনের উপ-সভাপতি এবং মন্ত্রিসভার বিজ্ঞান-বিষয়ক উপদেষ্টা কমিটির সভাপতি ডঃ এম. এস. স্বামীনাথন পদত্যাগ করেন। এবং দেশকে দাগা দিয়ে ফিলিপিন্সের লস বানো-স্থিত আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা কেন্দ্রের (ইন্টারন্যাশনাল রাইস রিসার্চ ইনস্টিটিউট বা সংক্ষেপে আইআরআরআই) director general হিসাবে যোগ দেন। ‘দাগা দিয়ে’ শব্দবন্ধটি এখানে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবেই ব্যবহৃত হয়ছে। এর আগে তিনি কৃষি মন্ত্রকের সভাপতিও ছিলেন। কৌশলগতভাবে এরকম গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন বিজ্ঞানীকে, যিনি কিনা দেশের বিজ্ঞান-বিষয়ক গোপন খুঁটিনাটি, বিশেষত যেগুলি খাদ্য-সম্পর্কিত তা নিয়ে ওয়াকিবহাল, দেশ-ছেড়ে বিশ্বের অন্য কোনও দেশে রাতারাতি এরকম কোনও বিদেশি প্রতিষ্ঠানে যোগদানের অনুমতি দেওয়া হয় না। আইআরআরআই প্রতিষ্ঠানটি আবার নিয়ন্ত্রিত হয় মার্কিন পুঁজিবাদ ও তার বিদেশনীতির স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট দুটি ব্যক্তি-মালিকানাধীন সংস্থা দ্বারা।
এশিয়ার ধান গবেষণাকে নিয়ন্ত্রণ করতে উদ্যত মার্কিন প্রয়াসেরই অংশ ছিল ১৯৬০ সালে আইআরআরআই গড়ে তোলা, যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে খাদ্য হিসাবে চালের ব্যবহার তেমন নেই। এক বিখ্যাত বীজ-উৎপাদনসংস্থার মালিক একবার বলেছিলেন “যে চালের যোগান নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে সেই হবে সমগ্র এশীয় কক্ষের ভাগ্য-নিয়ন্তা। এশিয়ার বেশিরভাগ অংশেই পুঁজিবাদ, বা সমাজতন্ত্র বা অন্য কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শ গুরুত্বপূর্ণ নয়, যেটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা হলো খাদ্য যা প্রকারান্তরে জীবন, এবং এশিয়ার বেশিরভাগ জায়গার খাদ্য হলো ভাত।”
প্রাক্তন মার্কিন কৃষি অধিকর্তা ইয়ার্ল বাজ তাঁর ঘটনাবিহীন কর্মজীবনে শুধু একটিমাত্র বাক্য উচ্চারণের জন্য কুখ্যাত। তিনি বলেছিলেন, “যদি খাদ্যকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা যায়, আমরা তা স্বচ্ছন্দে ব্যবহার করব।”
আজ একুশ শতকের দ্বারপ্রান্তে এসে আমাদের স্বীকার করতেই হবে যে ধান ও গম, যে দুটি খাদ্যশস্যের উপর আমাদের জীবন সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে, তাদের নিয়ে যাবতীয় গবেষণা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের তৈরি প্রতিষ্ঠানের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয়।
আইআরআরআই তে ডঃ স্বামীনাথনের যোগ দেওয়াকে অনেক দিক দিয়েই তাঁর পদাবনতি বলে মনে হয়। ভারতে তিনি একটি বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠানের ওপর কর্তৃত্ব করতেন যেখানে হাজার হাজার বিজ্ঞানী সংযুক্ত ছিলেন। সেখানে ফিলিপিন্সে তাঁর নিয়ন্ত্রণে ছিলেন ২০০র কম বিজ্ঞানী। কিন্তু, তাঁর আসল প্রাপ্তিটা ছিল বিরাট অংকের মাইনে যা কিনা আবার আয়করমুক্ত।
সেই সময়েই মার্কিন নির্দেশকদের পরিচালিত এই আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের উচ্চ ফলনশীল বীজ চাষের কৌশল মার খাচ্ছিল, কারণ তাদের তৈরি একটার পর একটা বীজ পোকা ও জীবাণুর সংক্রমণে জেরবার হচ্ছিল। এর জন্য আইআরআরআই এর তখন প্রয়োজন ছিল তার জার্মপ্লাজমের ব্যাপক বিস্তার ঘটানোর। জার্মপ্লাজম অর্থে বোঝানো হয় জিন-সম্পদ অর্থাৎ বীজ, কোষ-কলা ইত্যাদিকে, যেগুলির সাহায্যে প্রাণী বা উদ্ভিদ তার বংশবৃদ্ধি, আত্মরক্ষা ও প্রতিষেধক ক্ষমতা গড়ে তোলে। জার্মপ্লাজমের ভাণ্ডার গড়ে তুলতে পারলে তা থেকে প্রতিরোধক জিন বেছে নিয়ে নিয়ে উচ্চ ফলনশীল জাতগুলিতে ঢোকানো যায় এবং সেগুলিকে কীটসংক্রমণ থেকে বাঁচানো সম্ভব। চালের সব চেয়ে বেশি বৈচিত্র্য তথা জার্মপ্লাজম ছিল ভারতীয় উপ-মহাদেশে। তাই উক্ত উদ্দেশ্য সাধনে স্বামীনাথনের নিয়োগ ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
আইআরআরআই বিজ্ঞানের কোনো অগ্রণী প্রতিষ্ঠান ছিল না। এটি ছিল একটি ব্যক্তি-মালিকানাধীন কৃষি গবেষণা কেন্দ্র। তা সত্ত্বেও এটা ভাবা শক্ত যে স্বামীনাথনের মতো একজন এর সাধারণ নির্দেশক বনে যাবেন। যদি না সেই ব্যক্তি তাঁর বৈজ্ঞানিক সাফল্য অপেক্ষা কার্যনির্বাহক (এক্সিকিউটিভ) হিসেবে দক্ষ প্রতিভাত হন। সমতুল্য বৈজ্ঞানিক সাফল্য নিয়ে কোনো বৈজ্ঞানিকের পক্ষেই ম্যাক্স প্লাঙ্ক ইনস্টিটিউট, ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি বা টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ এর মতো প্রতিষ্ঠানের নির্দেশক হওয়া সম্ভব হত না। আমি ফিলিপিন্সের জ্ঞানী-গুনী লোকেদেরকেও জিজ্ঞেস করেছিলাম যে কী করে স্বামীনাথনের মতো একজন প্রথাগত বিজ্ঞানী আইআরআরআই এর নির্দেশক হয়ে যান। সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য উত্তরটি ছিল সবচেয়ে মজার। ঐ পদটির জন্য তিনটি আবেদনপত্র জমা পড়েছিল বলে জানা যায়। প্রথমটি ছিল রকফেলার ফাউন্ডেশন এর উপ-প্রধানের যিনি পীড়াপীড়ি করছিলেন এই প্রতিষ্ঠানে চাকরিটি পেয়ে তাঁর স্ত্রী ও রক্ষিতাকে নিয়ে চলে আসার জন্য। দ্বিতীয় আবেদনকারী ছিলেন পশ্চিম জার্মানির, খোঁজখবর করে দেখা যায় তিনি যে ডিগ্রির অধিকারী বলে দাবী করেছিলেন তা তাঁর নেই। সেই তুলনায় ডঃ এম. এস. স্বামীনাথন, যাঁর ওপর কিনা ১৯৭৯ সালে এন্সায়ক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা কর্তৃক প্রকাশিত ‘ইয়ারবুক অফ সায়েন্স এন্ড দি ফিউচার’ এ প্রবন্ধ বেরিয়েছে, অবশ্যই এই পদটির দাবিদার হিসেবে বাকি দুজনের তুলনায় যোগ্য ছিলেন।
ভারত ভাতের ওপর নির্ভরশীল দেশ। চাল একটি জটিল বাস্তুতন্ত্রের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ, এর সাথে নানা কিংবদন্তী জড়িয়ে, নানা ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও আচারের সময় একে প্রতীক ও সাক্ষী হিসাবে ব্যবহার করা হয়। যাকে নিয়ে এত মাতামাতি সে যে তার উৎপাদনের জন্য বিশেষ বিশেষ দক্ষতার উদ্ভব ঘটাবে সেটাই প্রত্যাশিত। এজন্যই আমরা তাক লাগানোর মতো বহুবিধ চাষের কৌশল দেখতে পাই, যেগুলির কয়েকটি এমনকি আজকের দিনেও ভারতীয় চাষীদের এবং কিছু আদিবাসীদের আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানের চেয়ে অনেক উচ্চ শ্রেণিতে স্থাপন করে।
ওড়িশার পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে দেবতাকে প্রতিদিন নতুন চালের ভাত উৎসর্গ করা হয় এবং বিভিন্ন জাতের চাল বিভিন্ন হাঁড়িতে রেখে একটার ওপর আরেকটাকে চাপিয়ে তলার হাঁড়ির নিচে থেকে আঁচ দেওয়া হয় অথচ প্রত্যেকটি হাঁড়িতে একসাথে রান্না হয়ে যায়। ছত্তিসগড় অঞ্চলে ‘বোরা’ নামের এক জাতের ধান পাওয়া যায় যাকে সরাসরি পিষে আটা বানানো যায় রুটি তৈরি করার জন্য। অন্যান্য জাতগুলিরও অদ্ভুত সব নাম যেমন গোয়ালিয়রের ‘কালিমুচ’, ‘মতিচুর’ এবং ‘খোয়া’; শেষেরটির নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে যে তার স্বাদ ক্ষীরের মত। ‘ঢোকরাঢোকরি’র দানা ১৪ মিলিমিটার লম্বা, এটি পৃথিবীর দীর্ঘতম চাল। ‘ভীমসেন’ জাতের চালের প্রস্থ সবচেয়ে চওড়া। ‘উড়ান পাখেরু’ জাতর ধানের নামকরণ হয়েছে তার লম্বা, পালকের মতো গঠনের জন্য।
এদেশে প্রায় ১,২০,০০০ এর মতো ভিন্ন জাতের ধান ছিল, যেগুলি ছিল আলাদা আলাদা পরিবেশে অভিযোজিত এবং চাষীরা যাদের অভিব্যক্তি ঘটিয়েছিল আলাদা আলাদা প্রয়োজন মাথায় রেখেই। এই জাতগুলির সৃষ্টি হয়েছিল বৈচিত্র্যের প্রতি প্রকৃতির ঝোঁক এবং সহজাত বিজ্ঞানের যোগসূত্রে। বলাবাহুল্য আনুষ্ঠানিক অ্যাকাডেমিক বিজ্ঞানচর্চার কোনও অবদান সেগুলিতে ছিল না।
১৯৫০ সালের শেষের দিকে প্রতিষ্ঠিত কটকের সেন্ট্রাল রাইস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (সংক্ষেপে সিআরআরআই) তার শুরুর দিন থেকেই ধান চাষের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে কাজ করে আসছিল। ১৯৫৯ সালে ডঃ আর. এইচ. রিচারিয়া এর নির্দেশক হলেন এবং একদল যোগ্য বিজ্ঞানী তাঁদের গুরুত্বপূর্ণ কাজ নিয়ে এগিয়ে এলেন, যেগুলি অনতিবিলম্বে সম্মিলিত হয়ে জন্ম দিতে চলেছিল বেশি ধান উৎপাদনের কৌশলের। উদাহরণস্বরূপ ইতিমধ্যে ১৯৬৩ সালে, সিআরআরআই এর এক বিজ্ঞানী সি. গঙ্গাধরণ পরিব্যক্তি দ্বারা পরিবর্তিত (mutant) স্বল্প দৈর্ঘ্যের ধানের একটি জাত তৈরি করে ফেলেছিলেন যেটি ছিল উচ্চফলনশীল। প্রতিষ্ঠানটি ভারতীয় ধানের পাশাপাশি তাইওয়ান ও জাপানের ধানের জাত নিয়েও কাজ করছিল। কাজটি ধীরে ধীরে এগোচ্ছিল কারণ কোনকোন জাতগুলি রোগ-পোকার আক্রমণ প্রতিরোধে সক্ষম এবং স্থিতিশীল তা খুঁজে বের করা সময়সাপেক্ষ।
গঙ্গাধরণ ভারতের ধান গবেষণার ইতিহাসকে তিনটি মূলপর্বে ভাগ করেছেন। ১৯১২ থেকে ১৯৫০ পর্যন্ত ছিল প্রথম পর্ব যাতে মূলত জোর দেওয়া হয়েছিল পিওর লাইন সিলেকশনের ওপর। এই পদ্ধতিতে স্বপরাগী ফসলের একাধিক চারাগাছকে আলাদা আলাদা করে চাষ করে পাওয়া অপত্য চারাগুলির মূল্যায়ন করা হয় এবং সেরা গাছটিকে পিওর লাইন জাত হিসাবে নির্বাচন করা হয়। এই পর্বের শেষে মোট ৪৪৫ প্রকার উন্নত জাতের ধান চাষ হত, যেগুলির বেশিরভাগই পাওয়া গিয়েছিল পিওর লাইন প্রক্রিয়ার।
এ প্রসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ, যে এর পরবর্তীকালে সহজাত বিজ্ঞান ও ‘আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান’ এর মধ্যে মূল বিভেদ হিসাবে যেটা ক্রমশ দেখা যাচ্ছে তা হলো গবেষণার মূল লক্ষ্যগুলির পালটে যাওয়া। গঙ্গাধরণ ন’টি লক্ষ্য উল্লেখ করেছেন - ধান তাড়াতাড়ি পেকে ওঠা, বন্যা ও জমা জল প্রতিরোধ ক্ষমতা, ঢলে পড়ার প্রবণতা প্রতিরোধ, ধানের দানা ঝরা আটকানো, বীজের সুপ্তদশা কাটানো, ‘ওয়াইল্ড রাইস’ (চার প্রজাতির ঘাস, যা অনেক জায়গায় খাদ্য হিসাবেও ব্যবহৃত হয়) নিয়ন্ত্রণ, রোগ প্রতিরোধ এবং বেশি সারের প্রতি সংবেদনশীলতা। যেহেতু পিওর লাইন সিলেকশন বা পিওর লাইন নির্বাচন শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলে আসা প্রাকৃতিক নির্বাচনের ওপর নির্ভরশীল তাই এতে করে জিনগত কাঠামো ও বাহ্যিক পরিবেশের মধ্যে কোনো সমন্বয়ের অভাব হয়নি এবং ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ বা পেস্টের সমস্যাও হয়নি।
দ্বিতীয় পর্বটি ছিল কম আশাপ্রদ। এতে প্রাথমিকভাবে ব্যর্থ হওয়া জ্যাপনিকা ও ইন্ডিকা জাতের সংকরায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। গঙ্গাধরণ লিখেছেন, এর লক্ষ্য ছিল জ্যাপনিকা জাতের উচ্চ ফলন ক্ষমতা ও সারের প্রতি সংবেদনশীলতাকে স্থানীয় ইন্ডিকা জাতের ধানগুলি, যারা স্থানীয় চাষপদ্ধতি ও রোগ-পোকা প্রতিরোধে সক্ষম তাদের মধ্যে সঞ্চারিত করা। জাপান বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই রাসায়নিক সার ব্যবহার করে আসছিল এবং জ্যাপনিকা জাতের ধানগুলি সেখানে এই প্রক্রিয়ায় সাড়া দিয়েছিল, যেখানে ইন্ডিকা জাতের ধানগুলিকে কখনই উচ্চ ফলনদায়ী অবস্থায় চাষ করা হয়নি।
এই কার্যক্রমে মাত্র চারটি সাফল্য আসে। সমস্যাটা ছিল জ্যাপনিকা জাতের ধানগুলি আলোর স্থায়িত্বকাল এবং তাপমাত্রা দুই-এর প্রতিই সংবেদনশীল ছিল, তার ওপর আবার বীজগুলি আনা হয়েছিল জাপানের শীতলতম কিছু অঞ্চল থেকে। যখন এই জাতের ধানগুলিকে উষ্ণ নিরক্ষীয় অঞ্চলে রোপণ করা হলো তখন তার ফল ঋণাত্মক হয়ে দাঁড়ালো। ফিলিপিন্সের অর্ধবামন জাতের ধানগুলি আনার পরই এই ধারার গবেষণার আকস্মিক ইতি ঘটল। পরে সিআরআরআই জাপানের মৃদু-উষ্ণ অঞ্চলের বীজ আমদানি করে সাফল্য পায় কিন্তু ধান গবেষণায় আইআরআরআই এর কর্তৃত্বের ফলে এই গবেষণার ফলাফল বিজ্ঞানের আলো ও প্রচারের বাইরেই থেকে যায়। এরপর আসে আইআরআরআই কর্তৃক উদঘাটিত তৃতীয় পর্ব যার বিষয়ে এবার সন্ধান চালানো হবে।
রকফেলার ফাউন্ডেশনের এক আধিকারিকের ১৯৫৯ সালে লেখা নোটের ভিত্তিতে স্থাপিত হয় আইআরআরআই। ফোর্ড ও রকফেলার ফাউন্ডেশন উভয়েই এই প্রতিষ্ঠানটি খুলতে অর্থ বিনিয়োগ করে। এটি ১৯৬০ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে স্থাপিত হলেও ১৯৬২ সালে কাজ শুরু করে। শুরু থেকে শেষ অবধি কখনই সিআরআরআই, আইআরআরআই এর সাথে অসম প্রতিযোগিতায় পেরে ওঠেনি। আইআরআরআই আধিকারিকরা এশিয়ার বিভিন্ন জায়গার বিজ্ঞানীদের রীতিমত কিনে নিত এবং তারা যে শুধু ডলারে মাইনে দিত তা-ই নয়, নিজ নিজ দেশে ঐ বিজ্ঞানীরা যা পেতেন তার তুলনায় তাদের অস্বাভাবিক রকমের বেশি মাইনে দিত। সঙ্গে থাকত থাকার বন্দোবস্ত এবং পৃথিবীর যেকোনো জায়গায় ছেলেমেয়েদের পড়ানোর সুযোগ।
১৯৬৬ সাল নাগাদ আইআরআরআই তার প্রথম সাফল্য নিয়ে হাজির হলো। এটা ভালোভাবে লক্ষ্য করার বিষয়, যেখানে সিআরআরআই এর গবেষণার ন'টি লক্ষ্য ছিল, আইআরআরআই এর ছিল একটিমাত্র লক্ষ্য। ‘আইআর ৮’ ছিল একটি অর্ধ বামন ধানের জাত যা ইন্দোনেশীয় লম্বা ধানের চারা ও তাইওয়ানের বামন জাতের মধ্যে সংকরায়নের ফলে উৎপন্ন হয়। এই গাছের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো প্রচুর সার সহ্য করা এবং অধিক নাইট্রোজেন প্রয়োগে ঢলে না পড়ে উচ্চ ফলন দেওয়া (এর দ্বারা এশিয়ার প্রায় সর্বত্র মার্কিন সারের বাজার তৈরী হলো)। জল, সার ও কীটনাশক ছাড়া আইআর ৮ পুরনো ধান গুলির তুলনায় খুব একটা ভালো ফল করতে পারেনা। পুরনো ধানগুলির সমস্যা ছিল যে অতিরিক্ত পোষক উপাদান তারা ঢলে পড়ত এবং আর্থিক ক্ষতির কারণ হত।
আগেই যা বলা হয়েছে, সিআরআরআই একই রকম কাজ করছিল এবং বস্তুতপক্ষে সেই সব তাইওয়ানের জাতগুলিকে আলাদা করে চিহ্নিত করে ফেলেছিল যেগুলি ভাইরাস আক্রমণ থেকে মুক্ত। যখন খবর এলো যে ভারত সরকার আইআরআরআই বিশেষজ্ঞদের প্রভাবে এসে ব্যাপক পরিমানে আইআরআরআই-এর বীজ ভারতে আমদানি করার পরিকল্পনা করছে তখন ডঃ রিচারিয়া এর বিরোধিতা করলেন।
সরকারের বোধ হয় ডঃ রিচারিয়ার উপদেশ স্ববিরোধী মনে হয়েছিল, এর আগে সিআরআরআই জানিয়েছিল যে তাইচুং জাতগুলি ধান উৎপাদনে নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারে আর এখন রিচারিয়া এগুলির আমদানির বিরোধিতা করছেন। রাজনীতিবিদ ও আমলাদের জেনেটিক্স নিয়ে খুব সামান্যই ধারণা ছিল, তাই সম্ভবত তাঁরা বুঝতে পারলেন না যে যেসব বীজ বহু ঋতু ধরে অনেক অভিযোজন-পরীক্ষার পর নির্বাচন করে সংখ্যায় বাড়ানো হয়েছে তারা বিদেশ থেকে ব্যাপক পরিমাণে কেনা বীজের থেকে আলাদা। বিদেশি বীজগুলি বিভিন্ন চারার সাথে মিশ্রিত থাকার ফলে তাতে এমন রোগগ্রস্ত জিন থাকার সম্ভাবনা রয়েছে যা পেস্টের কবলে পড়বে। আইআরআরআই সেসময় খুব দ্রুত হারে তাদের বীজগুলি ব্যাপক হারে চাষ করাতে চাইছিল। যাতে সরকার সিদ্ধান্ত পাল্টানোর আগেই বীজগুলি ছড়িয়ে পড়ে।
ভারতের বিজ্ঞান নিয়ামকসংস্থায় মার্কিনদের স্বার্থপূরণের লোক থাকায় আইআরআরআই ভারতীয় বিজ্ঞানীদের প্রতিবাদ-জনিত বাধা বন্ধন কাটিয়ে ওঠে। যদিও রাজনৈতিকভাবে এদেশ ধনতান্ত্রিক বা সমাজতান্ত্রিক কোনো ক্যাম্পেই ছিলনা, তবু এদেশের বিজ্ঞান ও অর্থনীতি সংক্রান্ত বেশিরভাগ নীতিই মার্কিন নিয়ন্ত্রনাধীন ছিল। এর জন্যই আলবার্ট মেয়ার্সকে দিয়ে সমষ্টি উন্নয়ন কার্যক্রম শুরু হলো। ফোর্ড ফাউন্ডেশনের ডগলাস এমসুইঙ্গার একবার গর্ব করে বলেছিলেন যে পন্ডিত নেহেরুর মন্ত্রিসভার যেকোনো সদস্যের তুলনায় তাঁর নেহেরুর কাছে যাওয়া-আসার সুযোগ বেশি ছিল। ডঃ রিচারিয়া নাকি সিআরআরআইতে নির্দেশক হিসাবে তাঁর নিয়োগের কথা প্রথম জানতে পারেন এক মার্কিনের কাছ থেকে। আইআরআরআই-এর নির্দেশক ডঃ রবার্ট চ্যান্ডলার সরাসরি কৃষিমন্ত্রী সি. সুব্রামানিয়ানের সাথে কথাবার্তা বলতেন।
আইআরআরআই সম্পর্কে তাঁর সাম্প্রতিক বর্ণনা ‘অ্যান অ্যাডভেঞ্চার ইন অ্যাপ্লায়েড সায়েন্স’-এ চ্যান্ডলার স্বীকার করেছেন যে আইআরআরআই-তে যোগ দেওয়ার আগে তিনি একটিও ধানের চারা দেখেন নি। অথচ তাঁরই প্ররোচনায় সরকার ডঃ রিচারিয়াকে অপসৃত করার সিদ্ধান্ত নেয় কোয়ারান্টাইন শংসাপত্র ছাড়া বীজ আমদানি করে দেশের আইন ভাঙার অভিযোগে। উল্লেখ্য ডঃ রিচারিয়া ছিলেন সেসময় ধানের বিষয়ে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিশেষজ্ঞ। এবং চ্যান্ডলার এর আগে একবার ডঃ রিচারিয়ার দ্বারা শাস্তি পেয়েছিলেন।
এবার আইআর ৮ এবং টি এন ১ ভারতে প্রচলিত হয়ে গেল এবং এদের পূর্বসুরী হিসাবে ব্যবহার করে অর্ধ-বামন জাত তৈরী করার উদ্দেশ্যেই সমস্ত গবেষণা চালিত হতে লাগল। ব্যাপক রাজনৈতিক ক্ষমতা ও বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা ঢেকে আইআরআরআই স্বভাবতই শীর্ষস্থান বজায় রাখতে পারলো। এরপর থেকে এশিয়ার বিজ্ঞানীদের কর্মজীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে গেলে আইআরআরআই-এর গবেষণার ধারাকে সমর্থন করতেই হত।
অন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সরকারকে প্রভাবিত করেছিল, সেটি হলো ১৯৬৫ ও ১৯৬৬ সালের অত্যন্ত খারাপ ফলন। যে বিষয়টি তৎকালীন ভারত সরকার (এবং ফিলিপিন্সের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি মার্কোস)-কে গভীরভাবে বিচার-বিবেচনা না করেই আইআরআরআই এর প্রযুক্তি কার্যকর করতে ঝুঁকিয়েছিল তা হলো এই প্রযুক্তি প্রথমবার খাদ্য উৎপাদন বাড়াবার একটি প্রায় স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি এনেছিল যা খাদ্য উৎপাদন বাড়াবার বিষয়টি কৃষকের হাত থেকে বের করে প্রশাসনের কর্তৃত্বে এনে দেবে। যদি সরকার তার যাবতীয় সংস্থান এই উচ্চ ফলনের প্যাকেজ ব্যবহার করে কয়েকটি সমৃদ্ধ অঞ্চলে কেন্দ্রীভূত করে তাহলেই বর্ষার খামখেয়ালিপনার ওপর নির্ভর না করে যথেষ্ট পরিমাণে ফসল উৎপাদন করা যাবে। আবার, এই চাষের পদ্ধতি ব্যয়বহুল হওয়ায় একে কার্যকরী করতে কৃষককে আর্থিক ঋণ নিতে হবে। এই ব্যাপারটা সরকারকে আশ্বস্ত করেছিল যে উৎপন্ন ফসলের একটা বড় অংশ বাজারে এবং সরকারি খরিদারি সংস্থার হাতে আসবে, যা আবার শহরে জিনিসপত্রের দাম স্থিতিশীল রাখতে কাজে লাগবে।
দুটো বড় ঘটনা জমিকে ধান ও মধুতে ভরিয়ে তোলার প্রতিশ্রুতির ভবিষ্যৎ ছারখার করে দিল। প্রথমটি অর্থনীতি-সংক্রান্ত; ১৯৭৩ সালে তেলের দাম বাড়ল যার ফলে সার-নির্ভর কৃষিনীতি ধাক্কা খেল। এতে সবুজ বিপ্লবের প্রাথমিক যোগানের দাম এতটাই বেড়ে গেল যে এরপর থেকে এগুলোতে সরকারি ভর্তুকি দিতে হয় যাতে কৃষকেরা এই চাষ-পদ্ধতি চিরতরে না ছেড়ে দেয়। দ্বিতীয় সমস্যাটিও ছিল এমন যা আর পূর্বের অবস্থায় ফেরার মতো নয়, এটি ছিল রোগপোকার আক্রমণ। খুব অল্প জিন-সমৃদ্ধ ধানের জাতগুলির চাষ (প্রত্যেকটিতে ছিল গাছ বেঁটে করার জিন ডিজিওগেন) পতঙ্গ-নির্ভর বাস্তুতন্ত্রকে ভয়ানক ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল এবং প্রচুর ক্ষতিকর পেস্ট-এর উদ্ভব ঘটিয়েছিল। ডঃ স্বামীনাথন নিজেই আইআরআরআই-এর জাতগুলির পরিণতির বেশ নির্লজ্জ একটি সারাংশ করেছেন ‘মাজিনগিরা’ (Mazingira) র একটি সাম্প্রতিক সংখ্যায়। তিনি লিখেছেনঃ
“এমনিতে নিরক্ষীয় জলবায়ুতে এমন কোনো জাতের উদ্ভব ঘটানো কঠিন যার ব্যবহারিক জীবন ৫-৬ বছরের বেশি হবে যদি না অধিকতর স্থায়ী প্রতিরোধক জিনগুলি খুঁজে বের করে সেগুলি ঢোকানো হয়। সারা বছর ধরে ধানচাষের ফলে রোগের জন্য দায়ী জীবাণু ও পোকামাকড়গুলির একাধিক প্রজন্মের সহ-অস্তিত্ব গড়ে তুলে নতুন প্রজাতি বা বায়োটাইপদের উদ্ভব ঘটার সম্ভাবনা বেড়ে যায় এবং তার থেকে নতুন নতুন পেস্ট সমস্যার জন্ম হয়। ১৯৬৬ সালে বের হওয়া আইআর-৮ ১৯৬৮ ও ১৯৬৯ সালে ব্যাকটিরিয়াল ব্লাইট (সংক্ষেপে, বিবি)-এর সাংঘাতিক আক্রমনে পড়ে। ১৯৭০ এবং ১৯৭১ সালে রাইস টুনগ্রো ভাইরাসের (সংক্ষেপে, আরটিভি) আবির্ভাব সমগ্র ফিলিপিন্সে আইআর ৮ এর উৎপাদন ধ্বংস করে। ১৯৬৯ সালে বের হওয়া আইআর ২০ জাতটির বিবি ও আরটিভি সহ্য করার ক্ষমতা ছিল এবং এটি ১৯৭১ ও ১৯৭২ সালে আইআর ৮ কে প্রতিস্থাপিত করে। কিন্তু, ১৯৭৩ এ ব্রাউন প্ল্যান্ট হপার (সংক্ষেপে বিপিএইচ) এবং গ্রাসি স্টান্ট ভাইরাস (জিএসভি) এর আক্রমণ ফিলিপিন্সের বেশিরভাগ প্রদেশে আইআর ২০ কে নষ্ট করে। ১৯৭৩ সালে বিপিএইচ প্রতিরোধে সক্ষম আইআর ৩৬ বের হয় এবং ১৯৭৪ ও ১৯৭৫ সালে এটি ছিল ফিলিপিন্সের প্রধান জাতের ধান। ১৯৭৬ সালে একটি নতুন বিপিএইচ বায়োটাইপের আক্রমণ হয় এবং আইআর ৩৬ বের হয়। এতে একটি আলাদা রকমের জিন ছিল নতুন বিপিএইচ বায়োটাইপ প্রতিরোধ করার জন্য এবং এটি এক বছরের মধ্যে আইআর ২৬ এর জায়গা নেয়। এটা ছিল এখন ফিলিপিন্সের প্রধান জাতের ধান। এর বিপিএইচ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা কিছুদিন আগে অবধি বজায় ছিল, কিন্তু এখন আবার শঙ্কার কারণ হয়ে দেখা দিচ্ছে রাজেড স্টান্ট ও উইল্টেড স্টান্ট (দুইই নতুন রোগ) এবং বিপিএইচ এর নতুন বায়োটাইপ ।”
ভারতেও অবস্থাটা ছিল একই রকমের ভয়ঙ্কর। ডঃ রিচারিয়ার প্রতিটি ভবিষ্যদ্বাণী ফলে গেল। বিশিষ্ট ধান উৎপাদনকারীদের একটি টাস্ক ফোর্স লক্ষ্য করেন যে “উচ্চ ফলনশীল জাতের প্রচলন গাল মিজ, বাদামি শোষক পোকা, পাতা মারা পোকা, হোর ম্যাগট প্রভৃতি ক্ষতিকর পোকার চরিত্রে পরিবর্তন আনে। বেশিরভাগ বাজারে আসা উচ্চ ফলনশীল জাতের মেজর পেস্ট দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা রয়েছে যাতে করে ৩০ থেকে ১০০ শতাংশ অবধি ফসলের ক্ষতি হতে পারে।” বেশিরভাগ উচ্চ ফলনশীল জাত তৈরী হয়েছে টি এন ১ ও আইআর ৮ থেকে এবং সেজন্যই বেঁটে করার জিন ডিজিওগেন বহন করে। এই ক্ষুদ্র জিন ভাণ্ডার বিপজ্জনক রকমের সমরূপতা সৃষ্টি করে পেস্ট ও রোগে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বাড়িয়েছিল। বাজারে আসা বেশিরভাগ জাতই উঁচু-নিচু ঢেউ খেলানো জমি, যেগুলি একত্রে দেশের মোট ধান জমির প্রায় ৭৫ শতাংশ, সেই ধরনের জমির পক্ষে উপযুক্ত নয়।
পেস্টদের বিরুদ্ধে আইআরআরআই এর পাল্টা কৌশল ছিল ধানের ওয়াইল্ড রিলেটিভ (যে নিকটবর্তী প্রজাতি থেকে এই জাতের ধানের উদ্ভব) বা প্রথাগত কাল্টিভার (এক বা একদল গাছ যাদের নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যের জন্য নির্বাচন ও রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় নতুন চারাগাছ তৈরি করার জন্য) থেকে সেই সব পেস্টের প্রতিরোধক জিন সংগ্রহ করে ঢোকানো। হঠাৎ করে আই আরআরআই প্রতিরোধী জিনের গুরুত্বপূর্ণ দাতা পুরনো জাতের ধান সংগ্রহের জন্য উঠে পড়ে লাগলো যার বেশিরভাগই ছিল সনাতন ইন্ডিকা। অন্যভাবে বলতে গেলে, জিন একত্রীকরণের কৌশলের জন্য প্রয়োজন ছিল ব্যাপক জার্মপ্লাজম বা জিনসম্পদের যার বেশিরভাগটাই পওয়ার ছিল ভারত থেকে। ডঃ এম. এস. স্বামীনাথনের নিয়োগ এই সংগ্রহের কাজের চালিকাশক্তি।
ভারতবর্ষে আবার ডঃ রিচারিয়া এর বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন।
চ্যান্ডলারের প্ররোচনায় তাঁকে সরানোর পর তিনি ওড়িশা হাই কোর্টে যান, সেখানে তিনি তিন বছর ধরে আইনি লড়াই লড়েন, যার ফলে তাঁর পরিবার গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ছেলেমেয়েদের শিক্ষা বিঘ্নিত হয়, তাঁর স্ত্রীর ব্যাপক স্বাস্থ্যহানি ঘটে। ১৯৭০ সালে তাঁর এই আইনি লড়াই সফল হয়, কোর্ট সিআরআরআই এর নির্দেশক পদে তাঁকে পুনর্বহাল করে। তিনি তাঁর হারানো মর্যাদা ফিরে পান।
ইতিমধ্যে মধ্যপ্রদেশ সরকার ডঃ রিচারিয়াকে কৃষি উপদেষ্টা নিযুক্ত করে এবং ধান বিষয়ে বিশেষজ্ঞ মানুষটি তাঁর সহজাত উদ্যমে আবার তাঁর থেমে যাওয়া কাজ শুরু করেন। ছ বছরের মধ্যেই তিনি রায়পুরে একটি নতুন ধান গবেষণাকেন্দ্র গড়ে তোলার পরিকাঠামো তৈরি করেন। এখানে এই অনন্য-সাধারণ, প্রতিভাবান, চিন্তাশক্তিসম্পন্ন মানুষটি তাঁর অফিস তথা গবেষণাগারে এমনকি একটা অনুবীক্ষণ যন্ত্র অবধি না থাকা সত্ত্বেও বছরে মাত্র ২০,০০০ টাকা ব্যয়ে ১৯,০০০ এরও বেশি জাতের ধান স্ব-স্থানেই (in-situ) সংরক্ষণ করেছিলেন। তাঁর অফিস তথা গবেষণাগারটি ছিল একটি সমবায় পরিচালিত চালকলের লাগোয়া। তাঁর সহকারী বলতে ছিল দুজন কৃষির স্নাতক এবং ছ-জন গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষ। শেষ ছ-জনের মাইনে ছিল মাসে ২৫০ টাকা। রিচারিয়া প্রকৃতপক্ষে শূন্য থেকে শুরু করে গড়ে তুলেছিলেন পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ অত্যাশ্চর্য সজীব জিন-ব্যাঙ্ক এবং তিনি দেখিয়ে দিয়েছিলেন পর্যাপ্ত উৎসাহ পেলে ভারতীয় বিজ্ঞানীরা কী করার ক্ষমতা রাখেন।
১৯৭০ সালে আমেরিকায় লিফ ব্লাইট-এর আক্রমনে ভুট্টা চাষ ধ্বংস হলো, যার মূলে ছিল ব্যাপক হারে সংকরজাতের গাছ রোপণ যাদের সাইটোপ্লাজমের উৎস ছিল এক। একই সাথে চলছিল আইআরআরআই এর জাতগুলির একনাগাড়ে পেস্টে আক্রান্ত হওয়া। এইসব ঘটনা আইআরআরআই-কে তাড়িত করেছিল ১৯৭৭ সালে ‘রাইস জেনেটিক কনজারভেশন ওয়ার্কশপ’ আয়োজন করতে। স্বামীনাথন এতে ‘পর্যবেক্ষক’ হিসাবে যোগ দেন। ঐ ওয়ার্কশপের রিপোর্টটি শুরু হয় এই বাক্য দিয়ে - “আইআরআরআই এর প্রতিষ্ঠাতারা ১৯৬০-৬১ সালে একটি জার্মপ্লাজম ব্যাঙ্ক তৈরির পরিকল্পনা করে এক বিরাট দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেলেন।” ডাহা বাজে কথা। প্রতিষ্ঠানটির ঘোষিত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে কেবলমাত্র ধান চাষ নিয়ে পৃথিবীতে যাবতীয় যা বর্ণনা আছে সেগুলি সংগ্রহ করার কথা বলা ছিল। আইআরআরআই প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ১৭ বছর পর এই ওয়ার্কশপ হওয়া এটাই দেখায় যে জার্মপ্লাজম সমস্যাটি কেবল এখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
ওয়ার্কশপের পর আইআরআরআই এর লোলুপ দৃষ্টি পড়ল রিচারিয়ার মধ্যপ্রদেশ রাইস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এমপিআরআরআই) ১৯,০০০ জাতের ধানের ওপর। রিচারিয়া শুধুমাত্র ঐতিহ্যমণ্ডিত ধানগুলির একটি তাক লাগানো জগৎই গড়ে তোলেননি যেখানে কিছু ধান ৮৯ টন প্রতি হেক্টর ফলন দিত – যা আইআরআরআই এর জাত গুলির চেয়ে বেশি; তিনি আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন অন্য এক প্রজাতির বেঁটে চারাগাছ যাতে আইআরআরআই-এর জাতগুলির মধ্যে থাকা সমস্যাসৃষ্টিকারী বেঁটে করার জিনটি ছিলনা। কৃষকদের মধ্যে তার সম্প্রসারণের কাজ সরাসরি আইআরআরআইকে চ্যালেঞ্জ জানায়।
আইআরআরআই এর কর্মীরা রায়পুর যান এবং তাঁর (রিচারিয়ার) উপাদানগুলি দিতে বলেন। তিনি প্রত্যাখ্যান করেন কারণ পুরনো বৈজ্ঞানিক ধাঁচে গড়া উপাদানগুলি তখনও অবধি তিনি নিজেই পুরোটা খুঁটিয়ে দেখে উঠতে পারেননি। এর পাশাপাশি তিনি এই ধরনের যেকোনো প্রকার ‘বিনিময়’ এর চূড়ান্ত বিরোধী ছিলেন কারণ এর বিনিময়ের অর্থ ছিল তাঁর সংরক্ষিত বিশুদ্ধ জাতগুলিকে দিয়ে আইআরআরআই এর তৈরি সমস্যায় পড়া জাতগুলি পাওয়া।
সুতরাং আইআরআরআই পরবর্তী সেরা বিকল্পটি বেছে নিলো, এমপিআরআরআই বন্ধ করিয়ে দিল!
আই. সি. এ. আর. (ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ এগ্রিকালচারাল রিসার্চ) মধ্যপ্রদেশের কৃষির বিশেষত ধান চাষের উন্নতির জন্য একটি স্কিম ঘোষণা করে। বিশ্ব ব্যাঙ্ক ৪ কোটি টাকা দান করে। শর্ত ছিল এমপিআরআরআই বন্ধ করে দিতে হবে যেহেতু এতে ‘একই কাজ দুবার করে হবে’। এমপিআরআরআই এর একটি বিশেষ মিটিং এ মধ্যপ্রদেশের মুখ্যসচিব উপস্থিত ছিলেন যিনি কিন্তু এমপিআরআরআই এর ট্রাস্টি ছিলেন না। এর আগে তিনি ফোর্ড ফাউন্ডেশনের সাথে যুক্ত ছিলেন। সিদ্ধান্ত হয় প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ করা হবে এবং সমস্ত জার্মপ্লাজম জহরলাল নেহেরু কৃষি বিশ্ব বিদ্যালয়ে (জেএনকেভিভি) স্থানান্তরিত করা হবে, যার উপাচার্য সুকদেব সিং-ও আইআরআরআই র বোর্ড অফ ট্রাস্টিতে যোগ দেন। বিজ্ঞানীদের আইআরআরআই তে জার্মপ্লাজম ট্রান্সফার এ ট্রেনিং নিতে পাঠানো হলো, রিচারিয়ার দলটিকে বাদ দিয়ে।
এবারেও তারা ডঃ রিচারিয়ার অফিসঘর বন্ধ করে দেয় এবং তাঁর সমস্ত গবেষণাপত্র নিয়ে চলে যায়।
১৯৮২ সালের ৪ঠা জুন জেএনকেভিভি-র ধানপ্রজননবিদ ডঃ এম. এন. শ্রীবাস্তব আইআরআরআই-এর মধ্যস্থতাকারী আধিকারিক (liaison officer) পি. এন. শ্রীনিবাসনকে ‘প্রযত্নে ফোর্ড ফাউন্ডেশন, নতুন দিল্লি’ ঠিকানায় চিঠি পাঠালেন। সঙ্গে পাঠালেন আইআরআরআই এর টি. টি. চাং প্রার্থিত প্রথম সেট- ২৬৪ টি অ্যাকসেশন (অ্যাকসেশন হল প্রজাতির তালিকাভুক্তির সংখ্যা সূচক, একই সংখ্যা সূচকের আওতায় একই প্রজাতির একাধিক নমুনা থাকতে পারে)) যা এমপিআরআরআই-এর প্রথম দিককার সংগ্রহ থেকে নেওয়া এবং, দ্বিতীয় সেট (১৭০ টি নমুনা), যেটি ছিল সেই জাতগুলি থেকে নেওয়া যে জাতগুলি মধ্যপ্রদেশের চাষীদের মধ্যে জনপ্রিয় ছিল এবং এমপিআরআরআই এর প্রাক্তন নির্দেশক ডঃ আর. এইচ. রিচারিয়া যেগুলির বিশুদ্ধিকরণ ঘটিয়ে মূল জাতগুলির জায়গায় এগুলি ব্যবহারের সুপারিশ করেছিলেন।
ডঃ রিচারিয়ার অপসারণ হয়ে গেছিল, কিন্তু এবার প্রকৃতি স্বয়ং ময়দানে নামলেন। আইআরআরআই-এর চারাগুলির মধ্যে মিউটেশন দেখা দিল, যার ফলে এগুলোর কীটনাশক বিরোধী জিনের প্রভাব কমে এল এবং জিন ঢোকানোর যে স্ট্র্যাটেজি নেওয়া হয়েছিল দেখা গেল তা নেহাৎই সাময়িক।
উচ্চ ফলনশীল জাতগুলির স্বতন্ত্র সাফল্য নিহিত রয়েছে পুরনো জাতগুলির তুলনায় তাদের স্বল্প দৈর্ঘ্যের কাণ্ড এবং ঢলে না পড়ে প্রচুর নাইট্রোজেন প্রয়োগ সহ্য করার ক্ষমতার মধ্যে। প্রথাগতভাবে প্রচলিত কাল্টিভার থেকে বেশি বেশি জিন ঢোকানোর ফলে শুধু রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাই সঞ্চারিত হয় না, ঢলে পড়ার প্রবণতাও ঢোকে। এর ফলে আধুনিক জাতগুলি তাদের ঢলে না পড়ার বৈশিষ্ট্য হারাতে থাকে যেটা ছিল পুরনো কাল্টিভারদের তুলনায় তাদের মূল সুবিধাজনক গুণ। আইআরআরআই প্রকাশিত ‘রিসার্চ হাইলাইটস ফর ১৯৮৩’ লেখায় বলা হয়ঃ
“আধুনিক ধানগুলি বেশি পরিমাণ নাইট্রোজেন প্রয়োগে প্রচুর দানা উৎপন্ন করে। কিন্তু, অতিরিক্ত প্রয়োগ ঢলে পড়ার প্রবণতা বাড়ায়, যেটা আবার উৎপাদন কমিয়ে দেয়। আরও বলা যায়, আধুনিক অর্ধ-বামন জাতগুলিতে যেমন যেমন ক্ষতিকর পোকা ও রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, ঢলে পড়া আটকানোর ক্ষমতা কমে এসেছে।”
ধানের সবুজ বিপ্লব জট পাকাতে শুরু করেছিল।
তাহলে আর অকপটভাবে রাজনৈতিক এই বিজ্ঞানের ‘কৃতিত্ব’ কী পড়ে রইলো? (আইআরআরআই এর এক-সেট জার্মপ্লাজম আমেরিকার সবচেয়ে সুরক্ষিত স্থান ফোর্ট কলিন্সে পাঠানো হয় ভারত সরকারের অনুমতি ছাড়াই)। এই বিজ্ঞান কি তার ঘোষিত লক্ষ্যের একটিও পূরণ করতে পেরেছে? ভরত ডোগরা এর সারাংশ করেছেন নিম্নরূপঃ
“১৯৭০-৭১ সালে মাত্র পাঁচ মিলিয়ন হেক্টর থেকে শুরু করে ১৯৮২-৮৩ সাল নাগাদ ১৮ মিলিয়ন হেক্টরেরও বেশি অর্থাৎ মোট ধান চাষের জমির প্রায় অর্ধেক জমি উচ্চ ফলনশীল জাত চাষের আওতায় আনা হয়েছিল...সুতরাং এই শস্য বর্ধিত সেচ এবং বাড়তি এনপিকে (এনঃ নাইট্রোজেন, পিঃ ফসফরাস, কেঃ পটাশিয়াম) সারের একটা ব্যাপক অংশের সুবিধা পেয়েছিল। কিন্তু, উচ্চফলনশীল জাতের আওতায় আসা বাড়তি এলাকার তুলনায়, এবং বাড়তি সার ও সেচের তুলনায় ধান উৎপাদন বেড়েছে কম। উল্লিখিত সময়কালে (১৯৭০-৭১ থেকে ১৯৮২-৮৩) ধান উৎপাদন ৪২.২৩ মিলিয়ন টন থেকে বেড়ে হয়েছে ৪৬.৪৮ মিলিয়ন টন। এটা যদি ধরেও নেওয়া হয় যে উচ্চফলনশীল জাত ছাড়া অন্য জাতের ধানের উৎপাদনে কোনো বৃদ্ধি হয় নি এবং যাবতীয় উৎপাদন বৃদ্ধি হয়েছে কেবল মাত্র উচ্চফলনশীল জাতের জমিতে, তাহলেও আমরা দেখছি ১৩ মিলিয়ন হেক্টর জমি জুড়ে উচ্চ ফলনশীল জাতের চাষ প্রসারিত করে প্রায় ৪ মিলিয়ন টন বাড়তি ফলন পাওয়া গেল। অন্য ভাবে বললে, উচ্চ ফলনশীল জাত ব্যবহার করে প্রতি হেক্টরে ০.৩১ টন বৃদ্ধি হলো। এটা তুলনামূলকভাবে ক্ষুদ্র প্রাপ্তি যেটা এমনকী ব্যায়বহুল উচ্চ ফলনশীল জাত চাষের কার্যক্রম এবং তার পরিকাঠামো ছাড়াই সহজেই গ্রামীণ সম্পদকে আরো ভালোভাবে ব্যবহার করেই পাওয়া যেত।”
কৃষি মন্ত্রকের অতিরিক্ত সচিব কে. সি. এস. আচার্যের নেতৃত্বে একটি ৩৩ সদস্যের সরকারি দল সমীক্ষায় লক্ষ্য করেন যে সবুজ বিপ্লবের পরে ধানের উৎপাদন বৃদ্ধির হার সবুজ বিপ্লবের পূর্ববর্তী সময়ের চাইতে কমে গেছে।
মিলিয়নের পর মিলিয়ন জমির ধান এখন নিয়মিতভাবে ধ্বংস হয় বিপিএইচ ও অন্যন্য পেস্টের আক্রমণে এবং কৃষকদের জন্য ক্ষতিপূরণ থাকে না। কিন্তু সরকার থেকে তাঁদের পরামর্শ দিয়ে প্রবৃত্ত করা হয় এই ‘আধুনিক’ কৃষিপদ্ধতি গ্রহণ করতে। এই ধরনের পেস্ট সংক্রমণ ভারতের পরিবেশে আমদানি করা হয়েছে। আইআরআরআই আধিকারিকরা কিন্তু জানতেন তাঁরা কী ঘটাতে চলেছেন এবং তা সত্ত্বেও তাঁরা এটা করলেন নিজেদের প্রাধান্য জাহির করার নীচ আকাঙ্খার জন্য।
যথেষ্ট পর্যবেক্ষণ ছাড়াই তাড়াহুড়ো করে উচ্চ ফলনশীল জাতের বীজের প্রচলন জিন-সম্পদের প্রভূত ক্ষতিসাধন করে, শত শত অমূল্য ঐতিহ্যমণ্ডিত ধান মানব সমাজ থেকে চিরতরে হারিয়ে যায়। আশির দশকে এসে আইআরআরআই পুরনো জাতগুলির প্রকৃত মূল্য স্বীকার করে। কী অদ্ভুত ঘটনাচক্র!
আইআরআরআই ধান চাষে বিপ্লবের দ্বারোদ্ঘাটন করেছিল প্রথাগত কৃষিপদ্ধতিকে উপহাসের পাত্র করে। চাষীদের দ্বারা দশকের পর দশক জুড়ে নিবিড় পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলে যে প্রথাগত কাল্টিভার তৈরি হয়েছিল আইআরআরআই সেই সব কাল্টিভার নিজেদের তৈরি পণ্য, উচ্চফলনশীল জাত দিয়ে প্রতিস্থাপিত করতে চেয়েছিল। কিন্তু, যেহেতু উচ্চফলনশীল জাতকে কোনো নির্দিষ্ট আবহাওয়ায় ভালোভাবে অভিযোজিত করা হয় নি, ব্যাপক হারে পেস্ট সংক্রমণের দরুন একে বহুধরণের ঠেকা দিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে হত। পরিহাসের বিষয় উচ্চফলনশীল জাতের বিস্তারের সময় যাদের বিদ্রূপ করা হয়েছিল সেই প্রথাগত কাল্টিভার থেকেই এদের পেস্টের হাত থেকে প্রতিরক্ষা এলো ।
এর থেকে কি কোনো নিষ্কৃতি নেই? কীভাবে স্বাধীনতার ৪০ বছর পরেও বিজ্ঞানের এরকম দশা থাকে? কেন সিআরআরআই এর নির্দেশক আইআরআরআই এর ট্রাস্টি থাকবেন, যেমনটা হয়ে আসছে ১৯৭৯ সাল থেকে? এটা কি নির্ভরশীলতা বজায় রাখা এবং তাকে বাড়িয়ে তোলার জন্য? আইআরআরআই এর কোনো ভবিষ্যৎ নেই, রাজনৈতিক ভাবে এবং যদি গবেষণার কথা বলা হয় সেদিক থেকেও। রাজনৈতিকভাবে এর ভবিষ্যৎ বাঁধা ছিল রাষ্ট্রপতি মার্কোসের শাসনের সাথে, এবং ফিলিপিন চাষী ও বিজ্ঞানীরা ইতিমধ্যেই একে বন্ধ করার দাবি তুলেছেন। গবেষণার কথা বলতে, আইআরআরআই এর কাছে নতুন কোনো ধারণা নেই, এখন এর লোকজন মহা আগ্রহে চীনে যাতায়াত করেছে সংকর ধান উৎপাদনের চীনা পদ্ধতি শেখার জন্য, যেটা ধান উৎপাদন বাড়ানোর পরবর্তী দিগন্ত।
সিআরআরআই এর কাছে চীনা বিজ্ঞানের সাথে পাল্লা দেওয়ার মতো যথেষ্ট প্রতিভা আছে। এর হাতে এখনো শত শত মূল্যবান খাঁটি কাল্টিভার রয়েছে (ধান সংগ্রহ কেন্দ্রের একটি সাম্প্রতিক গণনায় দেখা যায় সেখানে ৪৪,০০০ জাত রয়েছে যেখানে আইআরআরআই এর কাছে আছে ৭০,০০০)। তাহলে কী করা উচিৎ?
প্রথমত, সিআরআরআই কে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করতে হবে, কারণ তাহলেই একমাত্র প্রয়োজনীয় অর্থ-বিনিয়োগ নিশ্চিত হবে, যেটা থেকে একে বঞ্চিত রাখা হয়েছে, যবে থেকে ভারতীয় রাজনীতিকরা আইআরআরআই এর বিজ্ঞানকে মদত দিতে শুরু করেছেন। আজকে, সিআরআরআই জার্মপ্লাজম ইউনিট এর ধানের কাল্টিভার সংগ্রহ পরিচালনার জন্য একটা জিপ পর্যন্ত নেই।
দ্বিতীয়ত, আইআরআরআই তে ধানের জার্মপ্লাজম রপ্তানি পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা উচিত, যেহেতু জার্মপ্লাজম আমাদের জাতীয় উত্তরাধিকার এবং একে সংরক্ষণ করার কথা সংবিধানে মৌলিক কর্তব্য অধ্যায়ে বলা আছে। তৃতীয়ত, ক্ষেতে ধীরে ধীরে ফলনদায়ী খাঁটি জাত দিয়ে আইআরআরআই এর জাতগুলিকে এবং যেসব সংকর জাত এই জাতগুলি থেকে উদ্ভুত সেগুলিকে প্রতিস্থাপিত করতে হবে। এটা ইতিমধ্যে ফিলিপিন্সে শুরু হয়ে গেছেঃ সেখানে চাষীরা নিজেদের মধ্যে পুরনো জাতগুলির বিনিময় করছেন আইআরআরআই বীজগুলি ছেড়ে যেগুলিকে যথার্থভাবেই ‘সাম্রাজ্যবাদের বীজ’ এবং ‘অন্তর্ঘাতের বীজ’ বলে বর্ণনা করা হচ্ছে।
পরিবেশগত ও আর্থিক কারণে সরকারি স্তরেও কিছু সচেতনতা দেখা যাচ্ছে যে ধান বিপ্লব ভূপতিত হয়েছে। প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী গান্ধী ডঃ রিচারিয়াকে ধান উৎপাদন বাড়াবার পরিকল্পনা জমা দিতে বলেন। তিনি এটা জমা দেওয়ার পরে আমরা এর সম্বন্ধে আর কিছু জানতে পারলাম না। রিচারিয়ার ওপর ডোম মোরেসের একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হওয়ার পর মধ্যপ্রদেশ সরকার তড়িঘড়ি করে কিছু টাকাপয়সা যোগাড় করার চেষ্টা করলো যাতে তিনি তাঁর কাজটি পুনরায় শুরু করতে পারেন। এখন আবার সেই একই আন্তর্জাতিক শক্তি প্রস্তাবটি বাতিল করিয়েছে যা একদা এমপিআরআরআই বন্ধ করিয়েছিল।
২৫ বছরেরও বেশি অতিক্রান্ত হলো এক্সোজিন নিয়ে এই ব্যয়বহুল, অপচয়পূর্ণ, পরিবেশের পক্ষে অস্বাস্থ্যকর ছিনালির। এর দুঃখজনক ও খারাপ ফল একটা মূলসত্যই তুলে ধরে - পাশ্চাত্য বিজ্ঞান দ্বারা আমরা যতই মোহাবিষ্ট হই না কেন - সত্যিকারের কোনো প্রকৃত উন্নয়নের জন্য ইণ্ডি জিন এখনো সেরা জিন।
(ডঃ ক্লদ আলভারেসের অনুমতিক্রমে অনূদিত)
অনুবাদকঃ সীতাংশু চক্রবর্তী ও সোমনাথ রায়