ছবি দেখার কি আদৌ কোনো প্রয়োজন আছে? (অথবা, রাগসঙ্গীত শোনার? সাহিত্যপাঠের? কিম্বা, ভালো সিনেমা দেখার? এককথায়, শিল্পবিষয়ে সচেতন চর্চার কি আদপেই কোনো যুক্তি আছে?) ভেবেছিলাম, এই প্রশ্নের অতি স্বাভাবিক উত্তরটি অস্তিবাচক। কিন্তু, কিছু আলাপ-আলোচনার শেষে বুঝলাম, এই প্রশ্নের সর্বজনগ্রাহ্য উত্তর পাওয়া মুশকিল।
যেমন, আমার মনে হয়, এই অভ্যেস জরুরি। এই প্রসঙ্গেই, আগের একটি লেখায় বলেছিলাম, নান্দনিকতার বোধ গড়ে তুলতে এই অভ্যেস অবশ্যপ্রয়োজনীয়। পশ্চিমী দেশে, স্কুলের বাচ্চাদের নিয়মিত আর্ট গ্যালারী বা চিত্রপ্রদর্শনীতে নিয়ে যাওয়ার চল রয়েছে। এবং, শুধু দেখাই নয়, ছবি দেখে কেমন লাগলো, সেই অনুভব নিয়ে তাদের দস্তুরমতো লিখতেও হয়। এইভাবেই নান্দনিকতার বোধ তৈরী হয়, আর সাথে সাথে নিজের ভালো লাগাটিকে বিচার বা বিশ্লেষণ করার বোধটিও তৈরী হয়। সুকুমার হৃদয়বৃত্তির গঠনে এমন চর্চা বা পাঠ জরুরি, এমনই আমার ধারণা।
সকলে যে এই ধারণার সাথে সহমত হবেন, এমন আশা করিনি। কিন্তু, কয়েকজন এইমতের প্রতিবাদে যে যুক্তিটি তুলে ধরলেন, সেইটা বিশেষ করে ভাবিয়ে তুললো। তাঁদের মুখ্য প্রতিপাদ্য, সাধারণভাবে ছবি দেখার প্রয়োজন বা নান্দনিকতার বোধ তৈরীর জন্যে ছবি দেখার প্রয়োজন, এইটা নিতান্ত এলিটিস্ট ভাবনা।
ছবি দেখা কি একটি এলিটিস্ট আঁতলামো?
এমনধারা কথা শুনে, দুশ্চিন্তায় পড়লাম। হ্যাঁ, চারুশিল্পচর্চা চালু রাখতে, যুগে যুগেই, রাজানুগ্রহের প্রয়োজন পড়েছে। চারুশিল্পের মুখ্য পৃষ্ঠপোষক যাঁরা, তাঁরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রাজরাজড়া, বা তথাকথিত এলিট। কিন্তু, চারুশিল্পের চর্চা যাঁরা করেন, তাঁরা? বা, শিল্পীরা?
সেই প্রাচীন কালে, বা তারপরেও, দক্ষিণ ভারতের মন্দিরে, কোনারক বা খাজুরাহের গাত্রে, যাঁরা অনন্য শিল্পসুষমার বিস্তার ঘটিয়েছেন, তাঁরা সকলেই কি এলিট? কোন এলিট গ্রুপ দুর্গম পাহাড়ের গুহার দেওয়ালে মাসের পর মাস ধরে গড়ে তুললেন অজন্তা গুহাচিত্র?
এদেশে, একেবারে হালের শিল্পীদের অধিকাংশই, খুব উচ্চমধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে একেবারে রুপোর চামচ মুখে ছবি আঁকতে এসেছেন, এমন তো শুনিনি। বরং, অনেকেই বেশ নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। দারিদ্র্যের মধ্যে থেকেই তাঁদের শিল্পচর্চা জারি থাকে। পরবর্তীতে আর্থিক সাফল্য বা স্বাচ্ছন্দ্যের মুখ দেখেন যতোজন, অস্বাচ্ছল্যের গল্প তার বহুগুণ। যথার্থ কারণেই ভ্যান গঘের গল্প সবার জানা, কিন্তু জীবদ্দশায় না খেতে পেয়েও অনর্গল ছবি এঁকেছেন আর মৃত্যুর পরে সেই ছবির দাম আকাশ ছুঁয়েছে, এমন নজির সব দেশে সব কালেই ভুরি ভুরি। আমাদের আশেপাশে যে শিল্পীরা ছবি আঁকেন, বা যাঁরা আজ যশশ্বী চিত্রকর, তাঁদের অধিকাংশের গ্রাসাচ্ছাদন জুটেছে সামান্য চাকরি করেই। এলিট সমাজের অংশ হওয়ার সৌভাগ্য, জীবিত শিল্পীর, প্রায়শই হয় না। অন্তত, শিল্পীজীবনের শুরুতে তো নয়ই।
ছবির বিষয়ের কথাও যদি বলি, আধুনিক চিত্রশিল্পের প্রায় কোনো ধারাতেই, উচ্চবিত্তের মার্সিডিজ-চড়া হাই-ফ্লাইং জীবনযাত্রা ধরা নেই। কয়েক কোটি টাকায় বিক্রি হওয়া ছবির বিষয়ও কিন্তু আটপৌরে সাধারণ জীবনযাপন বা আমাদের একঘেয়ে পারিপার্শ্বিক। তাহলে, শিল্পী বা তাঁর সৃষ্টি যদি এলিট ভাবনাজাত না হয়, চারুশিল্প দেখার ভাবনাটা খামোখা এলিটিস্ট হবে কেন?
সত্যি বলতে কি, মহৎ শিল্পের চর্চা শুধু এলিটদের জন্যে, আর সমাজের বাকি অংশের মানুষের রোটি-কাপড়া-মকানের বাইরে প্রয়োজন যদি কিছু থেকে থাকে, সেইটা ওই চটুল বিনোদন, এই এলিট-বাহিত ভাবনার বাইরে এসে ভাবাটা জরুরী।
ছবি নিয়ে কিছু কথা - উপলক্ষ্য সুনীল দাস
আজকের এই লেখার উপলক্ষ যিনি, সেই শিল্পী সুনীল দাস যখন বাবার ছোটো ব্যবসা ছেড়ে আর্ট কলেজে পড়তে যাওয়ার কথা বলেন, বাবা আগেভাগেই আপ্তবাক্য স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন, আর্ট পড়ার অর্থ অনাহারে থাকা।
কিন্তু, সুনীল ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তিনি ছবি আঁকা বাদ দিয়ে কোনো কিছু ভাবতেই পারেন নি। আর্থিক নিরাপত্তা কোন পথে, এমন চিন্তা, একবারের জন্যেও, তাঁর মাথায় আসেনি। এখন, তাঁর ছবি দেখতে বসার অর্থ এলিটিজমকে প্রশ্রয় দেওয়া, এমন দাবিটা নেহাতই বেয়াড়া বলে বোধ হয়।
ঠিক কোন তাড়নায়, পরিবারে শিল্পচর্চার কোনো ঐতিহ্য ছাড়া, একজন মানুষ, ছবি আঁকা ছাড়া অন্য কোনো পথে জীবন কাটানোর কথা অকল্পনীয় বোধ করেন, এবং ছবি আঁকার মতো অনিশ্চিত নেশা তথা পেশা বেছে নেন, তার কোনো হাইপোথিসিস এই লেখা থেকে পাওয়া যাবে না। আমার উদ্দেশ্য, আধুনিক ভারতীয় চিত্রশিল্পের এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র, শিল্পী সুনীল দাসের ছবি, আমাকে কেমন করে আক্রমণ করে, ভাবতে বাধ্য করে, সেইটুকু ভাগ করে নেওয়া। আর, তার সাথে, ছবি দেখার কিছু টেকনিক্যাল দিক নিয়েও অগভীর আড্ডা দেওয়া।
ছবি যদি দেখিই, দেখবো কীভাবে?
তাহলে, আবারও প্রশ্ন। ছবি দেখার প্রয়োজন রয়েছে একথা যদি মেনে নিই-ও, প্রশ্ন, ছবি কীভাবে দেখবো?
ছবির বিষয়বস্তু - একটা পথ, ছবির বিষয় নিয়ে আকৃষ্ট হয়ে ছবি দেখা। কিন্তু, একই বিষয় নিয়ে বিভিন্ন শিল্পী যখন ছবি আঁকেন, তার মধ্যে কয়েকটি ছবি হিসেবে উতরোয়, মাত্র সীমিত কয়েকটিই মহৎ শিল্প হিসেবে কালজয়ী হয়। ফুলের ছবি অল্পবিস্তর সকলেই এঁকেছেন, কিন্তু ভ্যান গঘের সূর্যমুখী তো অনির্বচনীয়। কোনটা নেহাতই ছবি, আর কোনটা অসামান্য শিল্পকর্ম, আমরা চিনবো কীভাবে? ছবির বিষয়, প্রাথমিক আকর্ষণ সৃষ্টির ক্ষেত্রে কাজে এলেও, ছবি দেখার ক্ষেত্রে, বিষয়বস্তু কোনোভাবেই একমাত্র মানদন্ড হতে পারে না।
শিল্পীর দক্ষতা - দ্বিতীয় পথ, শিল্পীর দক্ষতা বিষয়ে একটা আন্দাজ পাওয়া। এইখানে দক্ষতা বলতে অনেকেই বোঝেন, ছবি কতোখানি বাস্তবানুগ হয়েছে, মানুষটি কতোখানি জীবন্ত, আপেলটি কতোখানি আসল আপেলের মতো এইধরনের ব্যাপার। কিন্তু, ফটোগ্রাফির এই ছড়াছড়ির বাজারে, এমন দক্ষতার দাম কতোখানি?
শিল্পীর দক্ষতার বিচারের জন্যে প্রয়োজন, শিল্পী নিজের দেখাটিকে আমাদের সামনে সম্পূর্ণ প্রকাশ করতে পারছেন কিনা, এইটুকু। তার জন্যে প্রয়োজন, শিল্পীর দেখাটাকে অনুভব করা, তাঁর শিল্পমানসের খানিকটা আন্দাজ পাওয়া।
তদুপরি, আমরা আমাদের অদীক্ষিত চোখে আশেপাশে রোজ যা দেখি, যেমনভাবে দেখি, নিদেনপক্ষে ক্যামেরার চোখ যে দৃশ্যাবলি যেমন করে ধরে রাখে এবং আমরা পুনরাবৃত্ত দর্শনের সুযোগ পাই, শিল্পীর কাজ থেকে তার চাইতে বেশী কিছু যদি না পাই, তাহলে তো ছবি দেখার কোনোই মানে হয় না। তাই না? ছবি আঁকার ক্ষেত্রে টেকনিক্যাল দিকটি, শিল্পীর কুশলতা বা কারিগরি দক্ষতার প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ নিঃসন্দেহে, কিন্তু শুধুমাত্র সেই ভাবনাতেই আটকে থাকলে, দক্ষ কারিগর আর শিল্পীর ফারাক বোঝা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়।
যেমন ধরুন, সুনীল দাসের কারিগরি দক্ষতা অসামান্য। আর্ট কলেজে ভর্তির পরীক্ষায় এমন চমৎকার দক্ষতার পরিচয় পেয়েই তাঁকে সরাসরি সেকেন্ড ইয়ারে ভর্তি করা হয়।
এই দক্ষতার স্বীকৃতিতেই, আর্ট কলেজের ছাত্র থাকাকালীন তিনি পান জাতীয় পুরস্কার। ছাত্রাবস্থায় জাতীয় পুরস্কারে ভূষিত হওয়ার নজির এপর্যন্ত আর দ্বিতীয়টি নেই।
সুনীল দাস, অনিবার্য প্রসঙ্গক্রম - ঘোড়া
যে ঘোড়া আঁকার আশ্চর্য দক্ষতার জন্যে, ছাত্রাবস্থায় হর্সি সুনীল এবং পরবর্তীতে ঘোড়া দাস নামে পরিচিত হয়েছিলেন তিনি, সেই ঘোড়ার ছবিগুলো ফিরে দেখুন।
ভারতীয় চিত্রশিল্পে এমন করে, এতো বেশী সংখ্যায়, ঘোড়া আঁকার নজির রয়েছে সুনীল দাস বাদে, হুসেনের। রঙের ঔজ্জ্বল্যে হুসেনের ঘোড়া যদি চোখ টানে, সুনীল দাসের যাত্রা সম্পূর্ণ বিপ্রতীপে। রঙহীন, প্রায় ড্রয়িং-ভিত্তিক। শুধু রেখার টানে, এমন করে প্রাণ আর গতি ফুটিয়ে তোলা বিস্ময়কর। প্রশ্ন এই, তাঁর আঁকা ঘোড়ার সাথে ঘোড়ার ফটোগ্রাফের পার্থক্য কী? বা, তেমন কোনো ফারাক রয়েছে কি? উত্তরের জন্যে, একবার ঘোড়ার কিছু ছবি দেখুন।
না, এর কোনোটিই ঘোড়ার ফটোগ্রাফ নয়। কিন্তু, একপাল ঘোড়ার স্থিরচিত্রের তুলনায়, নিশ্চিতভাবেই, সুনীল দাসের ঘোড়া অনেক বেশী জীবন্ত। ঘোড়ার প্রাণবন্ত গতির পরিচয় সুনীল দাস চারকোলের কয়েকটি রেখায় যেমন করে ধরতে পেরেছেন, তেমন করে ফটোগ্রাফে আসে কি?
বৃত্তি ভিন্ন পড়াশোনার খরচ চালানো মুশকিল। আর, বৃত্তি নির্ভর করবে, ভালো ড্রয়িং বা স্কেচিং দক্ষতার উপরে। ছাত্রাবস্থায় নাকি পড়েছিলেন, “উট, মুট, ঘুট এই তিনটে যে যত ভালো আঁকতে পারবে, সে ততো বড়ো শিল্পী হতে পারবে।“ মুট অর্থাৎ হাতের মুঠো। ঘুট অর্থাৎ ঘোড়া। সেই থেকে ক্যালকাটা মাউন্টেড পুলিশের ঘোড়ার আস্তাবলে দিনের পর দিন, ঘণ্টার পর ঘন্টা পর্যবেক্ষণ। ছাত্রজীবন থেকে শুরু করে শুধু ঘোড়াই এঁকেছেন কয়েক হাজার। জাতীয় পুরস্কারও এই ঘোড়ার সুবাদেই। ছাত্রাবস্থাতেই কলেজের বার্ষিক এক্সিবিশনে, ভিনদেশী সাহেব কিনে নিচ্ছেন তাঁর ঘোড়ার ছবি, চড়া দামে, এমন অবিশ্বাস্য ঘটনাও ঘটেছে। ছাত্রজীবন শেষ করার সাথে সাথেই ছবি বিক্রির একটা মোটামুটি বাজার এবং তজ্জনিত নিয়মিত উপার্জনের ব্যবস্থা থাকার মূলেও এই ঘোড়া।
ছাত্রজীবন থেকে শুরু করলেও, ঘোড়া এঁকেছেন আজীবন। তাঁর ঘোড়ার ক্রমবিবর্তনের মধ্যেই, হয়তো, শিল্পী হিসেবে সুনীল দাসের পরিণতির গতিপথটি ধরা আছে। রঙহীন, ড্রয়িংধর্মী থেকে সামান্য রঙের ব্যবহার এবং লোকশিল্পধর্মী। বাস্তবানুগ থেকে বিমূর্ত হওয়ার যাত্রা। সুনীল দাসের ঘোড়া, সবসময়েই, আশ্চর্য প্রাণবন্ত।
আর্ট কলেজের শিক্ষা শেষ করার পরের বছর, ১৯৬০ সালে, সরকারী বৃত্তি নিয়ে তিনি প্যারিস যান উচ্চতর শিক্ষালাভ তথা শিক্ষানবিশির জন্যে। সেইখানেও, ঘোড়ার ছবি বিক্রি করেই তাঁর খরচের একটা বড়ো অংশ উঠে এসেছে, আর সরকারী বৃত্তি তো ছিলোই। এমনকি, প্যারিসের গ্যালারি তাঁকে কনসাইনমেন্ট দিয়ে রেসের মাঠে নিয়ে গিয়েছে ঘোড়ার ছবি আঁকার জন্যে।
ঘোড়া এবং, পরবর্তী, ষাঁড়
ঘোড়ার পাশাপাশি, তাঁর আরেক বিস্ময়কর সৃষ্টি, ষাঁড়। ইউরোপে শিক্ষার্থী থাকাকালীনই একবার স্পেনে যাওয়ার সুবাদে, বুলফাইটের জনপ্রিয়তায় আকৃষ্ট হয়ে ষাঁড় আঁকা শুরু করেন তিনি।
ঘোড়ার মতো, ষাঁড় আঁকার ক্ষেত্রেও, শিল্পী সুনীল দাসের বিবর্তন লক্ষণীয়। প্রথমদিকে চারকোলের রেখাভিত্তিক ড্রয়িং, পরবর্তীতে তুলি-কালি।
আবার, কখনো এসেছে সামান্য রঙের অনুষঙ্গও। বুলফাইট বলেই কি এমন রক্তের লাল? ষাঁড়ের চিত্রবিবর্তনটিও লক্ষ্যণীয়।
সুনীল দাসের ষাঁড়ও, ফটোগ্রাফের মতো না হয়েও, ফটোগ্রাফের চাইতে অনেক বেশী বাস্তব। এই অফুরান জীবনীশক্তি, পৌরুষ (পলিটিক্যালি ইনকারেক্ট হলেও শব্দটি এক্ষেত্রে খুব প্রযোজ্য নিশ্চিত) নিয়ে তাঁর ষাঁড় আমাদের খুব চেনা। নাকি, চেনা হওয়া সত্ত্বেও নতুন করে চেনা?
বিষয়বস্তু বা দক্ষ কারিগরী শেষ কথা নয়। তাহলে?
তাহলে, এতোক্ষণ আলোচনার পরে, দুটো ব্যাপার, আশা করি, স্পষ্ট।
এক, শিল্পবিচারের ক্ষেত্রে ছবির বিষয় একমাত্র বিচার্য হতে পারে না। বিষয়বস্তুর গুরুত্ব থাকলেও, ছবিতে বিষয়টি কেমন করে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, সেইটাই বেশী গুরুত্বপূর্ণ।
দুই, বিষয়বস্তুকে বাস্তবের হুবহু প্রতিরূপ হিসেবে ফুটিয়ে তোলার ক্ষমতা দিয়ে শিল্পীর দক্ষতার বিচার করা চলে না। তার জন্যে ফটোগ্রাফ রয়েছে, চিত্রশিল্পের কারিগরেরাও রয়েছেন। বিষয়ের অন্তঃস্থ প্রাণটিকে দেখার চোখ সবার থাকে না। শিল্পী সেই দুর্লভ ক্ষমতার অধিকারী। আর, শিল্পীর সেই দেখাকে ছবির মাধ্যমে আমাদের দেখাতে পারার মধ্যেই লুকিয়ে আছে শিল্পীর দক্ষতা। ঘোড়া আর ষাঁড়ের অন্তঃস্থিত গতি, জীবনীশক্তি বা নিছক শক্তির প্রকাশ সুনীল দাস যেমন করে আনতে পেরেছেন, তা আম ফটোগ্রাফারের সাধ্যের বাইরে। তাহলে, ছবি দেখার ক্ষেত্রে কি এইটাই শেষ কথা?
ছবি এবং সৌন্দর্যের বোধ-অনুভূতি - এইবার, ছবি দেখার ক্ষেত্রে আমাদের তৃতীয় ভাবনাটিতে আসি। ছবি দেখার সাথে নান্দনিক বোধের ওতপ্রোত সম্বন্ধের সম্ভাবনার কথা প্রথমেই বলেছি। অধিকাংশ মানুষই, অন্তত যারা ছবি দেখতে যান, তাঁদের অধিকাংশই শিল্পের সাথে সুন্দরকে এক করে দেখেন। আমাদের দেশজ চিন্তাপদ্ধতিতে সত্য এবং সুন্দরের নিবিড় যোগের কথা স্বীকৃত। কিন্তু, এই আধুনিক সভ্যতায়, অসুন্দরও কি সত্য নয়? সুন্দরের চাইতেও আরো সাধারণ সত্য নয়? তাহলে, শিল্প কেমন করে শুধুমাত্র সুন্দর হয়ে থাকবে?
পশ্চিমে রেনেসাঁ বা ক্লাসিকাল পর্যায়ের ছবিই বলুন, বা প্রাচীন ভারতীয় শিল্প কিম্বা মিনিয়েচার, দেখলে সুন্দরের অনুভূতিই সর্বাগ্রে মনে আসে। ক্রুসিফিকশনের মতো করুণ বিষয়ের চিত্রও, অন্যান্য শোক-দুঃখ ইত্যকার অনুভবের শেষে, সেই সুন্দরই। কিন্তু, আধুনিক চারুশিল্পের ক্ষেত্রে, শিল্প মাত্রেই সুন্দরের অনুভব অবশ্যগ্রাহ্য, এই ধারণা আর গ্রাহ্য নয়। হ্যাঁ, পাশ্চাত্য আধুনিক চিত্রকলার অন্যতম পুরোধা মাতিস বলেছিলেন বটে, "What I dream of is an art of balance, of purity and serenity devoid of troubling or depressing subject matter, an art which might be for every mental worker, be he businessman or writer, like an appeasing influence, like a mental soother, something like a good armchair in which to rest from physical fatigue." কিন্তু, এই ভাবনা তো সর্বজনমান্য নয়। শিল্পক্ষেত্রে ভাঙচুরের পুরোধা ডাডাইস্ট-দের কাজই শুধু নয়, আধুনিক চিত্রশিল্পীদের অধিকাংশের ছবিই, প্রাণের আরাম মনের আনন্দ হওয়া দূরে থাক, রীতিমতো ডিস্টার্বিং। পিকাসো যেমন বলেছিলেন, বাইরের দুনিয়া আর তাঁর একান্ত মনোজগতের মধ্যে যে অহর্নিশ দ্বন্দ্ব চলে, চলতে থাকে, তাকে ক্যানভাসে ফুটিয়ে তোলাই তাঁর অভীষ্ট। আর, এই দ্বন্দ্বকে দর্শকের সামনে তুলে ধরার জন্যে চিত্রশিল্পের প্রথাগত ভাবনাকে সম্পূর্ণ অস্বীকার, এমনকি ধ্বংস করতেও তাঁর আপত্তি নেই।
আসুন, পশ্চিম ছেড়ে সুনীল দাসে ফিরি। ঘোড়া আর ষাঁড় ছেড়ে তাঁর অন্যান্য শিল্পকর্মের দিকে চেয়ে দেখি। বিভিন্ন মাধ্যম এবং বিভিন্ন পর্যায়ে বিবিধ বিষয় নিয়ে কাজ করেছেন তিনি। প্রায় প্রতিটিতেই উৎকর্ষের স্বাক্ষর রেখেছেন। সারাজীবন ধরেই ছবি নিয়ে বিচিত্র সব পরীক্ষানিরীক্ষা জারি রেখেছিলেন। সমস্ত মাধ্যমে এমন অনায়াস দক্ষতা বা বিভিন্ন পর্যায়ে কৃত শিল্পকর্মের মধ্যে এমন বৈচিত্র্য, নিজেকে এমনভাবে ক্রমাগত ভেঙেচুরে দেখা, এদেশের চিত্রশিল্পে, সুলভ নয়। তাঁর শিল্পজীবন নিয়ে আলোচনার ক্ষেত্রে, ঘোড়া বা ষাঁড়ের অনন্য জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও, বাকি শিল্পকৃতির প্রসঙ্গও সমধিক গুরুত্বপূর্ণ।
সুনীল দাসের ছবিতে তথাকথিত অসুন্দর, পশ্চিমপানে মুখ
আধুনিক ভারতীয় চিত্রধারার অন্যতম পুরোধা ফ্রান্সিস নিউটন সুজা তাঁর সমসাময়িক শিল্পী সুনীল দাসের শিল্পচরিত্র প্রসঙ্গে বলেছিলেন, 'His paintings are often about death and horror… [He is] a master of the horrific in art.' কাজেই, সুনীল দাসের ছবির মধ্যে একনজরে সুন্দর বা নান্দনিকের সন্ধান করতে গেলে হতাশ হওয়ারই সম্ভাবনা।
সহযাত্রী হিসেবে সুজার এই মন্তব্য বিশেষভাবে প্রনিধানযোগ্য একারণেই যে, সুজার মতো, সুনীল দাসের ছবিও, আপাতসুন্দর এবং স্বস্তিদায়ক নয়। দ্বিতীয়ত, সুজার মতো, সুনীল দাসের ছবিও, মুখ্যত, পাশ্চাত্য শিল্পধর্মে জারিত। দেশজ শিল্পের বিবিধ উপাদান নিয়ে বিস্তর পরীক্ষানিরীক্ষা থাকলেও, দুজনের ছবির মূল সুর পাশ্চাত্য অনুসারী। এমনকি, দেশজ বিষয় নিয়ে ছবি আঁকলেও, তাঁদের ছবিটি শেষে, অনেকাংশে, পশ্চিমমুখী হয়ে দাঁড়িয়েছে বলেই আমার মনে হয়।
সুনীল দাসের শিল্পকৃতিতে পশ্চিমের প্রভাব বোঝার জন্যে সমকালীন শিল্পশিক্ষার ইতিহাসটিও একটু বোঝার প্রয়োজন রয়েছে। দুশো বছরের ঔপনিবেশিক শাসনের অন্যতম অঙ্গ হিসেবে, দেশের মানুষকে নিজস্ব অতীত ইতিহাস বা ঐতিহ্য বিষয়ে শ্রদ্ধাহীন করে গড়ে তোলা ছিলো একান্ত প্রয়োজনীয়। তথাকথিত ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষের অধিকাংশ যা কিছু ইউরোপীয় তা-ই মহৎ, এমন ধারণায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। কয়েক হাজার বছরের যে শিল্প ঐতিহ্য আমাদের সম্পদ, সেই অতীত বিষয়ে এদেশের শিক্ষিত মানুষ হয়ে উঠেছিলেন সম্পূর্ণ নিস্পৃহ। এরই বিপরীতে গিয়ে, হ্যাভেল সাহেবের নেতৃত্বে ভারতীয় শিল্পধারাকে পুনরুজ্জীবিত করার জরুরী কাজটি শুরু হয়েছিলো, যার পুরোধা হিসেবে ছিলেন অবনীন্দ্রনাথ। শুধুমাত্র ভারতীয় শিল্পরীতিই নয়, প্রাচ্যের বিভিন্ন শিল্পধারার পুনরাবিষ্কারে তৈরী হলো এক দেশীয় শিল্পরীতি। স্বাধীনতা আন্দোলনের অনুসারী তথা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ধারা হিসেবে এই বেঙ্গল স্কুল অফ আর্টের শিল্প-আন্দোলনকে ধরা হলেও অত্যুক্তি হবে না। অবনীন্দ্রনাথের পথ ধরেই এই শিল্পধারাকে এগিয়ে নিয়ে গেলেন নন্দলাল বসু। কিন্তু, ধীরে ধীরে এই শিল্পধারাচর্চার প্রাণবিন্দুটি সরে গেলো কলকাতা থেকে শান্তিনিকেতনের কলাভবনে।
স্বাধীনতা লাভের সময়ে পরিবর্তিত জাতীয় বাস্তবতাকে ধরতে দেশের শিল্পীরা মুখ ফেরালেন পশ্চিম পানে। মুম্বাইয়ের (তৎকালীন বোম্বে) প্রগ্রেসিভ আর্ট গ্রুপ এই সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিল্প-আন্দোলনের সূচনা করেন। হুসেন, সুজা, রাজা, তায়েব মেহতা, গাইতোন্ডে, কৃষেণ খান্না, পদমসি, রামকুমার সকলেই এই প্রগ্রেসিভ গ্রুপের সদস্য।
কলকাতার আর্ট কলেজেও, একই সময়ে, অবনীন্দ্রনাথ-নন্দলালের দেশজ শিল্পরীতির বিপরীতে হেঁটে নতুন শিল্পভাষা আবিষ্কারের প্রয়াসটি শুরু হয়েছিলো। সুনীল দাস এই সময়টারই ফসল। ছাত্রাবস্থায় আঁকা ঘোড়ার স্কেচের মধ্যেও, বিশেষত রেখা এবং পার্সপেক্টিভের ব্যবহারের ক্ষেত্রে, দেশীয় ঘরানার চাইতে ইউরোপীয় মাস্টারদের (বিশেষত দ্য ভিঞ্চি প্রমুখ) অনুসরণের প্রবণতা ছিলো স্পষ্ট। এমনকি, ছাত্রাবস্থায় জলরঙে অঙ্কিত একটি সিটিস্কেপে যে আলোছায়া বা রঙের ব্যবহার, তাঁর মধ্যেও বেঙ্গল স্কুলের সুবিখ্যাত ওয়াশ টেকনিকের প্রভাব বিশেষ নেই, এবং ছবির চলনে পাশ্চাত্য প্রভাবই বেশী।
সুনীল দাসের ছবিতে তন্ত্রের অনুষঙ্গ
অবশ্য, প্যারিসে থাকাকালীন এক ভারতীয় পন্ডিতের তন্ত্রবিষয়ক বক্তৃতা তাঁকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে এবং তারপর কিছুদিন তিনি তন্ত্র এবং ভারতীয় দেবদেবীদের বিষয় করে কিছু ছবি আঁকেন। কিন্তু এই প্রভাব তেমনভাবে দীর্ঘস্থায়ী হয় নি এবং সুনীল দাসের শিল্পীজীবনের ধারা অনুসরণ করার ক্ষেত্রে এই ছবিগুলোর গুরুত্ব থাকলেও, কালের বিচারে এই ছবিগুলি, তাঁর গুরুত্বপূর্ণ কাজের মধ্যে থাকবে কিনা, সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে। (প্যারিস এবং ভারতীয় শিল্পীদের তন্ত্র বিষয়ে ছবি আঁকার প্রবণতাকে বিষয় করে কোনো শিল্পতাত্ত্বিক-শিল্পগবেষক ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই একখানা যুতসই প্রবন্ধ লিখবেন, কেননা ভারতীয় শিল্পীদের তান্ত্রিক শিল্পচর্চার পীঠস্থান, কোনো এক অজানা কারণে, প্যারিস। সেই নীরদ মজুমদার থেকে শুরু করে হালের সৈয়দ হায়দার রাজা পর্যন্ত)।
সুনীল দাসের নারী - বাস্তববাদ, অসুন্দর নাকি ভিন্ন দৃষ্টিকোণ?
আগেই বলেছি, আধুনিক পাশ্চাত্য শিল্পধারার অনুসারী সুনীল দাসের ছবি। আপাতসুন্দর উপাদান তাতে খুব বেশী নেই। জন্ম থেকে কালিঘাট অঞ্চলে থাকার সুবাদে কাছ থেকে দেখেছিলেন রাস্তার মোড়ে খরিদ্দারের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থেকে দেহপশারিনীদের। তাঁর ক্যানভাসে নারী হিসেবে, প্রায়শই উঠে এসেছেন তাঁরা। আলোর পাশে ছায়াতেই তাঁদের জীবন। সুনীলের ক্যানভাসে তাঁদের মুখে গাঢ় অন্ধকার। প্রায় মোনা লিসার ধাঁচে আঁকা সুনীল দাসের নারী সমান রহস্যময়ী, ডার্ক, কিন্তু পটভূমিতে সুন্দর প্রকৃতির আরাম শিল্পী কেড়ে নেন। এই ক্যানভাসের সামনে দাঁড়িয়ে আরাম বা স্বস্তি নেই। অথচ, না দাঁড়িয়েও কি পারা যায়?
অন্ধকারের পথে যাত্রা থেমে থাকে না তাঁর। গাঢ় থেকে গাঢ়তর অন্ধকারের গভীর থেকে তিনি কি তুলে আনেন কোনো আলোকবর্তিকা? কী সেই সন্ধান?
তাহলে, সত্যিই, ছবিটা দেখবো কীভাবে?
আবারও শুরুতে ফিরি। সুনীল দাসের ছবি কীভাবে দেখবো? বা, বৃহত্তরে অর্থে, ছবি কেমন করে দেখা যেতে পারে? কোনো একটি বিশেষ পথ দিয়ে, বোধ হয়, লক্ষ্যে পৌঁছানো যাবে না।
অধিকাংশ ছবিই বিষয়গতভাবে তেমন অসামান্য নয়। আমাদের আশেপাশের রোজকার বেঁচে থাকা বিষয় নিয়ে যে ছবি, তার মধ্যেই কয়েকটির উত্তরণ ঘটে মহৎ শিল্পকৃতিতে। এই ম্যাজিক শিল্পীর করায়ত্ত। আমাদের তা না দেখলেও চলে যায়, কিন্তু জীবনের একটা বিস্ময়, সেক্ষেত্রে, আমাদের অধরা রয়ে যায়।
তাহলে, শিল্পীর করায়ত্ত সেই ম্যাজিক কী? না, বাস্তবের হুবহু চিত্রায়ণ শিল্পীর দায়িত্ব নয়। কাঙ্ক্ষিতও নয়, সম্ভবত। শিল্পীর আসল অসাধারণত্ব তাঁর দেখার চোখে। পিকাসো বারবার বলেছেন, দ্যাখো, দেখতেই থাকো, বাস্তব বড়ো ফাঁকি দেয়, নজরকে ভুলিয়ে দেয়, দেখা বা দেখতে পাওয়ার মধ্যেই শিল্পসৃষ্টির রহস্য। কাজেই, শিল্পীর দক্ষতা দেখতে পাওয়া আর সেই দেখাকে আমাদের দেখাতে পারা, এই দুইয়ের মধ্যেই লুকিয়ে। সুনীল দাসের নারী আর হেমেন মজুমদারের নারী একই নন। নিছক কারিগরি দক্ষতার বিচারে সুনীল দাস হেমেন মজুমদারের চাইতে কম, এমনও নন। দুজনের দেখার চোখ আলাদা, দৃষ্টিভঙ্গী পৃথক আর দুজনের দেখাতে চাওয়ার অভিপ্রায়ও ভিন্ন, ছবির ফারাকও এইখানেই।
মহৎ শিল্পকৃতিমাত্রেই সুন্দর হতে হবে, তার সামনে দাড়ালেই মনে শান্তি বা সুন্দরের অনুভূতি জাগবে, এমন দায় আর শিল্পের নেই। আপনি রোজ যা দেখছেন, ছবির সামনে দাঁড়িয়ে তাকে নতুনভাবে আবিষ্কার করছেন কিনা, আপনার দেখার চোখে নতুন কোনো মাত্রা আসছে কিনা, এইটা বোধ হয় একটা গুরুত্বপূর্ণ সূচক বিন্দু হতে পারে। সুনীল দাসের ছবি দেখার ক্ষেত্রে একথা বিশেষভাবে উল্লেখের দাবি রাখে।
শিল্পভাবনার জগতে, সর্বজনমান্য না হলেও, অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চিন্তাধারা, আমাদের সমাজের চারপাশে যে পূতিগন্ধময় আবর্জনা রয়েছে, যে অন্ধকার রয়েছে, শিল্পে যদি তা অপ্রকাশিত রয়ে যায়, সেই শিল্প সমাজবিমুখ, এবং বিপজ্জনকও বটে। বিপজ্জনক একারণেই, কেননা, সেই শিল্প মনোরঞ্জনের শিল্প, বিনোদনের উপকরণ আর সেই শিল্প সমাজের এই স্থিতাবস্থা জিইয়ে রাখতে সাহায্য করে। মাতিসের মাপের শিল্পীকেও তাঁর শিল্পের বিষয়ে কলাকৈবল্যবাদী অবস্থানের (মাতিসের মন্তব্য পূর্বে উদ্ধৃত) প্রসঙ্গে শুনতে হয়েছিলো, ন্যান্সি স্পেরোর কলমে, "Art that claims to be about pleasure is often about power"।
শিল্পী আর পাঁচটা মানুষের চাইতে সংবেদনশীল, এমনটাই ধরা হয়ে থাকে। সমাজের অন্ধকার যদি তাঁকে আহত না করতে পারে, সেই সংবেদনশীলতা নিয়েই সন্দেহ রয়ে যায়। অন্ধকারের ছবি আঁকা মানেই অন্ধকারকে বাস্তব, অতএব ভবিতব্য এই হিসেবে স্বীকার করা নয়। অন্ধকারের স্বরূপটি পরিষ্কার করে সবার সামনে তুলে ধরা গেলে, তবেই না আসবে উত্তরণের পথ।
তাহলে কি বিষয়বস্তু বা উদ্দেশ্যই শিল্পসৃষ্টির শেষ কথা? প্রথমেই বলে নিয়েছি, না, তা নয়। আমাদের দেখার চোখকে প্রসারিত করতে পারা মহৎ শিল্পকৃতির অন্যতম গুণ। সামাজিক বাস্তবতা হোক, বা নিছক প্রকৃতির দৃশ্য, বড়ো শিল্পীর আঁকা ছবির সামনে দাঁড়িয়ে, নিবিষ্ট পর্যবেক্ষণ আপনার সামনে খুলে দেয় এক নতুন অনুভবের দুয়ার। কেমন করে?
সুনীল দাসের মা ও ছেলে - নিখাদ জৈবিক দৃষ্টিকোণ?
এই প্রসঙ্গে, সুনীল দাসের মাদার অ্যান্ড চাইল্ড সিরিজের ছবিগুলির কথা বলা যেতে পারে। অত্যন্ত সনাতন থীম। প্রায় যুগে যুগে শিল্পীদের সবচেয়ে পছন্দের বিষয়বস্তুর অন্যতম। এর মধ্যে নতুন কিছু বাঁক বদল আনা দুরূহই নয়, প্রায় অসম্ভব বোধ হয়। কিন্তু, সুনীল দাস এই বহুব্যবহৃত বিষয়বস্তুকে দেখলেন সম্পূর্ণ নতুন চোখে। এই সিরিজের দুটো ছবি দেখুন। কতো সহজেই, এক চিরন্তন সম্পর্ককে নতুন চোখে দেখতে পেরেছেন শিল্পী।
ক্লান্তিকর পুনর্কথন হয়ে যাচ্ছে, মেনে নিয়েও বলি, অনেক ছবির মধ্যে থেকে অসামান্য শিল্পকর্মকে আলাদা করতে গেলে, ছবির বিষয়বস্তু বা শিল্পীর দক্ষতা অথবা আপনার সুন্দরের বোধ কিম্বা সামাজিক বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি, এসবের কোনোটিই এককভাবে, বা সম্মিলিতভাবেও যথেষ্ঠ নয়।
বিষয়বস্তু, দক্ষতা, নান্দনিকবোধ - সবার উপরে ফর্ম-ই সত্য?
তাহলে, শিল্প কী? ছবি কী? অনেক ছবির মধ্যে একটা ছবি শিল্পকৃতি হয়ে ওঠার রহস্য কী? এককথায় এর উত্তর, ছবির ছবিত্ব। মাতিস নিয়ে জন এলডারফিল্ড বলেছিলেন, "If Matisse were indeed solely devoted to luxury and pleasure, he would be disqualified from truly major importance." হ্যাঁ, মাতিস সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পী একারণেই, যে, বিষয়বস্তুগত চমক বা সামাজিক ঘটনাসমূহের তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ না থাকা সত্ত্বেও, শিল্পগুণের বিচারে তাঁর ছবি অসামান্য। শুধুমাত্র চোখজুড়োনো বা মন শান্ত করা ছবিই যদি তিনি এঁকে যেতেন, তাহলে মাতিস কালজয়ী হতে পারতেন না।
ভালো ছবি কাকে বলে, এই প্রশ্নের উত্তরে সুনীল দাস জানিয়েছিলেন, “আ গুড পেইন্টিং ইজ আ গুড ডিজাইন”। এইখানে ডিজাইন শব্দটিকে একটু বিশদে ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন।
একটি ছবির কয়েকটি উপাদান থাকে। রেখা বা লাইন, আকার বা আকৃতি বা শেপ, ফর্ম, স্পেস, টেক্সচার এবং রঙ। (প্রসঙ্গত, একটি ফটোগ্রাফের শিল্পগুণ যাচাইয়ের ক্ষেত্রেও এই উপাদানগুলিই মুখ্যত বিচার্য)। প্রতিটি ছবিতে এর মধ্যে অন্তত দুটি বা তাঁর বেশী উপাদান উপস্থিত। আর, কোনো একটি ছবিতে, এই উপাদানগুলি পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত। একটি ছবিতে, এই উপাদানগুলি বিভিন্নভাবে সাজানো যেতে পারে, প্রায় পারমুটেশন-কম্বিনেশনের নিয়ম মেনে। সর্বোত্তম কম্বিনেশনটি বেছে নেওয়ার মধ্যেই শিল্পীর কুশলতা। উপাদানগুলির এমন অনিবার্য আন্তঃসম্পর্কই হলো ছবির ক্ষেত্রে ডিজাইন। একই বিষয় নিয়ে সমান কারিগরি দক্ষতার দুই চিত্রকরের একই উপাদানযুক্ত দুটি ছবির মধ্যে একটির যথার্থ শিল্পকর্ম হয়ে ওঠার পেছনে এই কুশলী ডিজাইন।
বিগত শতকের শুরু থেকেই, বিশেষত সেজান তাঁর অবিশ্বাস্য চিত্রধারার মাধ্যমে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গীতে একটা বড়োসড়ো ঝাঁকুনি দেওয়ার পরে, চিত্রবিচারের ভাবনার জগতে একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। ছবির গুণগত বিচারের জন্যে ছবির উপাদান, বিশেষ করে ফর্ম এবং কম্পোজিশনের গুরুত্ব সর্বাগ্রে, এমনটাই মেনে নেওয়া হয়েছে। ফর্মকে এমন প্রাধান্যের কারণে এবম্বিধ বিচারপদ্ধতি ফর্ম্যালিজম বলে স্বীকৃত। আধুনিক চিত্রধারা, বিশেষত বিমূর্ত চিত্রধারার আধিপত্যের যুগে, অবশ্য, রঙের ব্যবহার, ফর্মের সমান গুরুত্বপূর্ণ হিসেবেই ধরা হয়ে থাকে।
চিত্রবিচার - সুনীল দাসের বুলফাইট - ফর্ম্যালিস্ট উদাহরণ
এখন, সহজ করে ফর্মের বিষয়টা একটু বোঝার চেষ্টা করি। আর, বিষয়টি একটু স্পষ্ট করার জন্যে, সুনীল দাসের আঁকা, উপরের,বুলফাইটের ছবিটি বিশ্লেষণ করে দেখি।
ছবির উপাদান হিসেবে, প্রথমেই রেখা বা লাইন। এক প্রখ্যাত শিল্পীর ভাষায়, রেখা হলো একটি বিন্দু যে মর্নিং ওয়াকে বেরিয়েছে। লাইন বিষয়ে বিশদ ব্যাখ্যার প্রয়োজন, বোধ হয়, নেই। উপরের ছবিটিতে লাইনের ব্যবহার লক্ষ্য করুন। সাধারণত, অনুভূম বা উল্লম্ব (হরাইজন্টাল এবং ভার্টিকাল) রেখা দিয়ে ছবিতে শান্তি এবং স্থিরতার আভাস আনা সম্ভব হয়। অপরদিকে, তেরছা এবং বাঁকা রেখা দিয়ে আনা যায় গতির অনুভব। এই ছবিটির ক্ষেত্রে, স্বভাবতই, সরলরেখার সংখ্যা কম। মানুষটি বা ষাঁড়ের আউটলাইন বাদ দিলেও বেশ কিছু আপাত-অবিন্যস্ত বাঁকাচোরা রেখার মাধ্যমে ছবিটি হয়ে উঠেছে আশ্চর্য প্রাণবন্ত ও গতিময়।
পরবর্তী উপাদান, আকার বা শেপ। কয়েকটি রেখা মিলিয়ে ছবিতে যেটা ফুটে ওঠে, সেইটা আকার। এই দ্বিমাত্রিক আকার যখন সমতল ছবিতে ত্রিমাত্রিকতার আভাস আনতে সক্ষম হয়, তা-ই ফর্ম। আরেকটু বিশদে বলবো? ছবি মাত্রেই সমতলে অঙ্কিত, সে কাগজ বা ক্যানভাস বা অন্য যে কোনো সারফেস হোক না কেন। আমদের চোখের সামনে দুনিয়াটা ত্রিমাত্রিক। একটি সমতল ক্যানভাসে ত্রিমাত্রিকতার আভাস আনার জন্যে প্রয়োজন কিছু কৌশলের। যেমন, পার্সপেক্টিভের নিপুণ ব্যবহার। কাছের জিনিস বড়ো, দূরেরটি ছোটো। অথবা, আলোছায়ার চতুর প্রয়োগ। অপেক্ষাকৃত আলোকিত অংশ কাছের এবং অনুজ্জ্বল অংশ দূরের মনে হবে। রঙের কন্ট্রাস্ট দিয়েও, ছবিতে গভীরতার দ্যোতনা আনা সম্ভবপর।
অতএব, ফর্মের প্রশ্নটি, ভাস্কর্যের ক্ষেত্রে একেবারে প্রাথমিক বিচার্য, কেননা ভাস্কর্য স্বভাবতই ত্রিমাত্রিক। ছবির ক্ষেত্রে, বেশ কয়েকটি বিষয়ের মধ্যে ফর্ম অন্যতম। বরং, রঙ-স্পেস-ফর্মের আন্তঃসম্পর্কের বিষয়টি, অর্থাৎ ডিজাইন ঢের বেশী গুরুত্বপূর্ণ। আবার, ত্রিমাত্রিকতা আনার প্রচেষ্টা হয় যেখানে, সেই ছবির তুলনায়, দ্বিমাত্রিক ছবির বিচারে ফর্মের বিষয়টি অপেক্ষাকৃত গৌণ। যেমন, ভারতীয় মিনিয়েচার ছবি, সে রাজপুত বা পাহাড়ি বা মুঘল যে ঘরাণারই হোক না কেন, মুখ্যত দ্বিমাত্রিক। কেবলমাত্র ফর্ম দিয়ে সেই ছবির বিচার চলে না।
এক্সপ্রেসানিস্ট এবং, বিশেষ করে বিমূর্ত ছবির পরে, ফর্মের ধারণায় প্রায় মৌলিক একটা পরিবর্তন এসেছে। রেখা থেকে আকার, সেই আকারকে ত্রিমাত্রিক গড়ন দেওয়ার চেষ্টা যে ফর্ম, সেই ফর্মের ভাবনাতেও বদল এসেছে। বাস্তব একটি কাঠামো, মানুষ বা গাছ বা পশুপাখি যা-ই হোক না কেন, কয়েকটি রেখার আঁচড়ে যদি তাকে ছবিতে স্পষ্ট করে তোলা যায়, সে-ও ফর্ম। সম্পূর্ণ বাস্তবানুগ না হয়ে বাস্তবকে ধরতে পারাও ফর্মের সাফল্য। উপরের ছবিতে, ষাঁড়ের সামনের মানুষটিকে দেখুন। তাঁর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বা পোষাক কোনোকিছুই তেমন করে স্পষ্ট করে ধরা নেই। কিন্তু, মানুষটির অবস্থান, লড়াই, গতি সবকিছুই অত্যন্ত স্পষ্ট। ষাঁড়ের ক্ষেত্রেও, বাড়তি কিছু গাঢ় লাইনের ব্যবহারে ষাঁড়ের আউটলাইন কিছুটা অস্পষ্ট ঠেকলেও, ফর্মটি ত্রিমাত্রিক, স্পষ্ট ও প্রাণবন্ত।
ছবির ডিজাইনের ক্ষেত্রে, অন্তত দুটি উপাদান এই ছবিতে খুব স্পষ্ট। ছন্দ ও ভারসাম্য। ষাঁড় এবং মানুষের বিভঙ্গের মধ্যে সম্পর্কটি লক্ষ্য করুন। ঠিক কেমন করে দুটি ফিগারের দেহভঙ্গী একে অপরের পরিপূরক হয়ে ছবিটাতে ভারসাম্য আনতে পারছে, খেয়াল করুন।
ফর্ম! ফর্ম! তোমার মন নাই…….?
প্রশ্ন হচ্ছে এটাই, যে, ছবির এমন করে ব্যবচ্ছেদ করতে পারলে, তবেই কি ছবির আসল রূপটি স্পষ্ট হবে? নচেৎ নয়?
এই প্রশ্নের উত্তর, আমার কাছে নেই। গানের ব্যাকরণ না জেনেও মার্গসঙ্গীতের সুরে বিভোর হওয়া যায়। কিন্তু, অন্তত রাগরূপটির চরিত্র জানা থাকলে, উস্তাদ আমির খান কেন জিনিয়াস, সেইটা বুঝতে সুবিধে হয়। ছবি দেখা একটা অভ্যেস। প্রাথমিক পর্যায়ে, দেখার টেকনিক্যাল দিকগুলি একটু খেয়াল রাখলে, বুঝতে সুবিধে হয়। কিন্তু, একটু ধরে ধরে ছবি দেখতে থাকলে, বিশ্বাস করুন, এ কিছু রকেট সায়েন্স নয়।
দেখুন, একটা ছবি যখন আপনি দেখতে বসছেন, তখন নিজস্ব কিছু পদ্ধতির আশ্রয় তো আপনি নিচ্ছেনই। হয়তো সেই পদ্ধতি অসচেতন। কিন্তু, নিশ্চিতভাবেই, আপনার শিক্ষা, রুচি, বইপত্র পড়া বা সিনেমা দেখা বা গান শোনা এইসব নিয়েই তৈরি হয়েছে আপনার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গী, বা আপনার শিল্পবোধ। ছবি দেখে আপনার ভালো লাগা বা না লাগা, আপনার বিচারপদ্ধতির মধ্যে সেই শিল্পবোধই প্রতিফলিত। ক্রমাগত ছবি দেখে চলার মধ্যে দিয়ে, এবং একটু টেকনিক্যাল দিকগুলো মাথায় রেখে ছবি দেখার মধ্যে দিয়েই খুলে যায় চারুশিল্পের উজ্জ্বল দুনিয়াটির প্রবেশদ্বার। সেইটুকু মানসিক শ্রম, বোধ হয়, করাই যায়। বিশেষ করে, যখন সেই শ্রমের পুরস্কারটি সত্যিই চমকপ্রদ। এক নতুন জগতের চাবিকাঠি।
না হলে, যেমনটি ইদানিং দস্তুর, বই বা সিনেমার ক্ষেত্রে রীতিমতো আভাঁ গার্দ হওয়ার পরেও, ছবির ব্যাপারে, মডার্ন আর্টের আমি কিছু বুঝিনে, এইটা অগৌরবের না হয়ে বেশ আঁতলেমোরও বিষয় হয়ে যায়। আর, ছবি দেখার অভ্যেস করতে না চাইলে, আধুনিক চিত্রকলার মাস্টারপিস দেখেও, অনায়াসে বলা যায়, আরে, আমার ক্লাস সিক্সে পড়া ছেলেটাও তো এর চাইতে বেটার ছবি আঁকে।
কিন্তু, আমার অনুরোধ, ছবি দেখুন। আশেপাশের জগতটা দেখার চোখই বদলে যাবে। একবার অভ্যেস করে দেখুন।
ছবির সামনে দাঁড়ান। স্বপ্নের ভেতরে সুনীল দাসের ঘোড়ারা দৌড়াতে থাকুক।