ও মশাই জানি খুব ই ব্যস্ততা আপনার, তবুও কয়েকটা কথা শুনে যান। কোন এক দলে তো পড়বেনই যাদের সম্বোধন করে এই খোলা চিঠি। বিশ্বকাপ দেখার মাঝে যদি এক দুবার খবরের চ্যানেলে চোখ পড়ে গিয়ে থাকে বা খবরের কাগজের ভেতরের পাতায় যদি চোখ পড়ে থাকে তাহলে নিশ্চয়ই অন্তত এটুকু জেনেছেন যে মেডিক্যাল কলেজ কোলকাতায় তৃতীয়, দ্বিতীয় ও চতুর্থ বর্ষের প্রায় শ'খানেক ছেলে-মেয়ে ৯ দিন ধরে কলেজের কমন রুমে থাকছে হোস্টেল না পেয়ে। ৫ ই জুলাই হোস্টেলের দাবি নিয়ে প্রিন্সিপাল এর কাছে গেলে তিনি শান্তিপূর্ন অবস্থানের ওপর ২০০ জন পুলিশ ও তৃণমূল গুন্ডা বাহিনীকে লেলিয়ে দেন। তার ফলে বেশ কিছু ছাত্র গুরুতর আহত হয়। তার পরেও ছাত্ররা দমে থাকে নি। তারা এখনো কলেজের কমন রুমে থাকছে। ৯ ই জুলাই সোমবার অন্যান্য বন্ধু চিকিৎসক-চিকিৎসাকর্মী সংগঠন ও ছাত্র সংগঠন মিলে প্রায় ৪৫০ জন কলকাতার রাজপথে মিছিল করে পাল্টা বুঝিয়ে দিয়েছে যে তারা আরো দৃঢ় ভাবে তৈরি। পুলিশ গুন্ডাদের সঙ্গে মিলে অনশন মঞ্চ ভেঙ্গে দিয়েছে। অন্যায়ভাবে নতুন হোস্টেলে কোন কাউন্সিলিং ও অফিশিয়াল নোটিশ ছাড়া রাতারাতি স্নাতকোত্তর মেয়েদের ঢুকিয়ে দিয়েছেন। এই স্নাতকোত্তর মেয়েদের কোন অফিশিয়াল থাকার জায়গা না দিয়ে তাদেরকে ব্যবহার করা হচ্ছে ছাত্রদের মধ্যেকার(স্নাতকোত্তর এর সাথে প্রাক-স্নাতক) সংহতি নষ্ট করার কাজে। সারা ক্যাম্পাস জুড়ে অঘোষিত কার্ফু জারি হয়েছে। ছাত্র-ছাত্রীরা এর পরেও কিন্ত হার মানেনি। ১০ তারিখ দুপুর থেকে তারা প্রশাসনিক ভবনে অনির্দিষ্টকালীন অনশনে বসেছে। স্বচ্ছ হোস্টেল কাউন্সিলিং এর দাবীতে ও কলেজ ক্যাম্পাসের গণতন্ত্র বজায় রাখতে তারা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে।
এসব শুনতে বলছি কেন? কোন মেডিক্যাল কলেজের ঝামেলা বা কে মার খেল বা কে হোস্টেল না পেল তাতে আপনার আমার দিন গুজরানে সরাসরি কিছু যায় আসে না তো ঠিকই, কিন্তু আসতেও তো পারে কখোনো। হঠাৎ করে আপনার নিজের বা কাছের কারোর শরীর খারাপ তো হতেই পারে। এমনই অবস্থা, যে মেডিক্যাল কলেজের ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিট এ (CCU) তে ভর্তি করতে হল। জানেন এই CCU এর ডেপুটি ইনচার্জ কে? এমন একজন ডাক্তার, যিনি ২০১৬ সালে এমবিবিএস পাশ করেন। CCU এর কাজ, অর্থাৎ ক্রিটিকাল কেয়ারে কাজের জন্য প্রথামত কোনো বিশেষ প্রশিক্ষণ ও ডিগ্রী তার নেই। উপরন্তু তিনি পাশ করার পর বড়জোর দুবছর রোগী দেখেছেন (যদিও এই দুবছরে কতদিন ডিউটি দিয়েছেন তার খবর যদি আপনি সঠিক ভাবে নেন তাহলে আপনি বাকরুদ্ধ হবেন এ নিশ্চিত) ।
মেডিকেল কলেজে CCU এ বা ক্রিটিকাল কেয়ারে যথেষ্ট অভিজ্ঞ ডাক্তার আছেন। তাঁদের অনেকের অ্যানাস্থেশিয়োলজি বা মেডিসিন-এ পোস্ট গ্রাজুয়েট ডিগ্রী আছে। তাঁরা ক্রিটিকাল কেয়ার (CCU / ITU) তে কাজও করছেন। তাঁদের মাথার ওপর বসিয়ে দেওয়া হল এরকম অভিজ্ঞতাহীন ও বিশেষ প্রশিক্ষণ বিহীন এক ডাক্তারকে, যিনি সাধারণ সমস্ত মাপকাঠিতেই ডাক্তারি ছাত্র হিসেবে বা ডাক্তার হিসেবেও যথেষ্ট যোগ্যতার পরিচয় কোনদিনই দেন নি। যোগ্যতা একটা অবশ্য আছে, শাসক দলের ঘনিষ্ঠ হওয়া। ভাবুন একবার, মেডিক্যাল কলেজের CCU এর ডেপুটি ইনচার্জ এর anesthesiology তে স্নাতকোত্তর বা এমডি ডিগ্রী নেই। ভাবুন আপনার চিকিৎসা হবে কার হাতে। আর সেই স্বাস্থ্য ব্যবস্থার তদারকি করেন আমাদের মুখ্যমন্ত্রী। ধরেই নিলাম এই কারচুপি তাঁর কাছে অজানা। ভাবতেই ইপারেন, আমি কি আর সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হব? সে না হয় কিছু সাধারণ মানুষ মরবে। সমস্যা হল এই ভদ্রলোক আপ্যোলো হাসপাতালেও যুক্ত। কী এবার। কোথায় যাবেন? ভয় করছে না? তা এই ভদ্রলোকই হলেন মেডিক্যাল কলেজের নতুন হোস্টেলের সুপার। যার অধীনে প্রিন্সিপাল মহাশয় প্রথম বর্ষের ছাত্রদের রাখবেন বলে ঠিক করেছেন। মেডিক্যাল এর ছাত্ররা হোস্টেলের দাবীর পাশাপাশি লড়ছে এটার জন্য যে এই রকম এক জনকে তারা হোস্টেলের সুপার হিসেবে মেনে নিতে নারাজ। আর এর প্রধান মদতদাতা হলেন 'কুকুরের ডায়ালিসিস' করানো (কু)খ্যাত আরেকজন 'চিকিৎসক'। ছবিটা ভাবুন, আপনি মেডিক্যাল কলেজের CCU তে ভর্তি আপনার চিকিৎসক হলেন ইনি। হয়ত আপনার পাশের বেডে কুকুরের ডায়ালিসিস চলছে। এর পর ভয় করছে না! ভাবুন ছেলেমেয়েগুলো আপনার জন্যও কিন্ত পরোক্ষ ভাবে ৯ দিন ধরে লড়ছে।
শুধু চিকিৎসাপ্রার্থী কেন? আপনি যদি সেই সমস্ত বাবা - মা ও আত্মীয়দের একজন হন, যাদের ছেলে-মেয়েরা হয়তো ভবিষ্যতে মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হবে, তাহলে ভেবে দেখুন, কার দায়িত্বে ছেলেকে রাখতে চলেছেন? এতো স্বপ্ন করে মেয়ে বা ছেলেকে ডাক্তারি পড়তে পাঠাবেন পশ্চিমবঙ্গ এর সেরা মেডিক্যাল কলেজে, রাখবেন কার অধীনে? কী পরিবেশে সে থাকবে? কী শিক্ষা পাবে?
আপনি যদি চিকিৎসক বন্ধুদের একজন হন তো, শেষ দুই বছর ধরে ডাক্তারদের যে গণশত্রু হিসেবে দেখান হল তার সাথে মিলিয়ে দেখুন। ভাবুন এমন লোক যদি CCU এর ডেপুটি ইনচার্জ হয় তবে রোগী গাফিলতি তো হবেই। আর এরকম কিছু ডাক্তারের জন্য সারা ডাক্তার সমাজ কে গণশত্রু তে দেখান হবে আর সাধারণ মানুষ ও এটাই ভাবতে বাধ্য হবেন। এর পর ও চুপ থাকবেন? আপনি প্রাইভেট চেম্বার করলেও এই কিছু ডাক্তারের জন্য আপনার রোগী আপনার পেশার জাতি কে অসুর বানাবে। চুপ থাকবেন নাকি ভাই বা ছেলের বয়সি এই ছাত্রদের পাশে দাঁড়াবেন। লড়াইটা ময়দানে ওরা লড়লেও এটা কিন্তু পুরো ডাক্তার সমাজের লড়াই।
পুলিশ আর প্রিন্সিপাল এর জন্য অবশ্য শব্দ খরচ করাও পাপ। একজন নিজে ছাত্রাবস্থায় থাকতেন হোস্টেল জবরদখল করে। আর আজ ছাত্র পিটিয়ে কুকুরের ডায়ালিসিসকারী ও তার কোম্পানির কাছে পুষ্পস্তবক নিয়ে হাসি বদনে ছবি তুলছেন বুক ফুলিয়ে। নিজে তিনি কলেজের আনাটমি বিভাগের ওপরের হোস্টেল জবরদখল করে থাকতেন প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রদের সাথে পাশ করার পরেও হাউসস্টাফশিপের সময়। আর এখন তিনি মেডিক্যাল কলেজের ১৮৪ বছরের ঐতিহ্য কে নষ্ট করে প্রথম বর্ষের ছাত্রদের আলাদা করে দাললদের অধীনে রাখতে তৎপর। যিনি একসময় মালদা মেডিক্যাল কলেজে তৃণমূল এর হাতে মার খেয়েছিলেন আজ তিনি সেই তৃণমূলের হাতের পুতুল।
পুলিশ কিছুদিন আগে একটি পোস্টার দিয়েছিল যে 'ডাক্তারেরা সমাজবন্ধু বিপদে-আপদে আমাদের সহায়। ওদের গায়ে হাত তোলা দণ্ডনীয়। জেল হতে পারে ১০ বছর পর্যন্ত।' ঘটনা এই, যে আজ তারাই ১০০ জন মিলে শাসক গুন্ডাদের সাথে হাত মিলিয়ে ডাক্তারি ছাত্রদের পেটাচ্ছে।
হায় সেলুকাস কি বিচিত্র এ দেশ!