সারা পৃথিবীর নানা জায়গায় যখন ছুটির নারীদিবস তখন এ পোড়া দেশে রাস্তায় পড়ে থাকা বিবস্ত্রের দেহের বাইরে বেরিয়ে আসা ক্ষুদ্রান্ত্রের কত ফুট দেহ থেকে বেরিয়ে তা নিয়ে বিতর্ক। নির্যাতিতের সাহস ও শ্বাস টিকিয়ে রাখার লড়াই কে হাজার স্যালুট। কিন্তু এরকম কত অপরাধে অপরাধীর হদিস নেই, শুধু নির্যাতিতকে নিয়ে আছে নানাধরণের সাবধানবাণী, নিষেধাজ্ঞা। রাষ্ট্র যখন নির্যাতিতার পক্ষে রুখে না দাঁড়িয়ে আখেরে অপরাধীকেই প্রশ্রয় দেয় তখন কোনো বাদ বা ইজম বোধহয় খানিকটা নিরস্ত্র হয়। রাষ্ট্রীয় পুজিবাদ যখন স্থির করে দেয় শ্রমের দাম আসলে নারীর কম, তখন একটি কমিউনিটি, একটি পক্ষ, একটি প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানো একদল মানুষ খুব অসহায় হয়ে পড়ে। জীবিকার লড়াই ও জীবনের নানা লড়াই এর মাঝে এই দম টিকিয়ে রাখার লড়াই বুঝি সবচেয়ে কঠিন। সে লড়াই নিরন্তর মেয়েদের একথা কোন বিতর্কের অবকাশ রাখে না। তথ্যানুযায়ী প্রতিদিন গড়ে ৫৭ র বেশী ও প্রতি ২৯ মিনিটে একটি করে ধর্ষণ ভারতে। ২৮ টি রাজ্যে ২ লক্ষ বাহাত্তর হাজার আটশো চুয়াল্লিশ টি কেস নথিভুক্ত। সোনাল শশীধরনের ‘সেক্সি দুর্গা’ দেখতে বসে বন্ধ প্রেক্ষাগৃহে চলিশোর্দ্ধ নারীদের ঘামে ভিজে যেতে দেখেছি। শরীরের নিরাপত্তাহীনতার এই রকম চেহারা দেখেই বড় হয়েছি আমরা সবাই।
মেয়েদের মর্য্যাদা মানে পোশাকের ডিজাইন ও বাড়তি চেস্ট কভার ব্যবহারকেই প্রতিষ্ঠা দেওয়া, আর মেয়েদের আত্মসম্মান হল নিজের শরীর ও চরিত্র রক্ষার নিয়মকানুনে আটকে থাকা, এই তো বাস্তব। মানুষ হোক বা না হোক, অসতী যেন না হয়। ওদিকে রাত দশটায় বেরোলে আজও অনেক এলাকায় এক চিত্র। জরুরি কোনো কাজে গেলেও রাস্তায় গুটিকতক মদ্যপ, অলিখিত যৌনপল্লী হিসেবে চিহ্নিত এলাকা অভিমুখী কিছু মানুষ মেলে। রাস্তা জুড়ে কোথাও কোনো পুলিশ নেই। সত্যিই তাদের কোনো দায় হয়ত নেই।ধীরে ধীরে মেয়েরা শিখে নেয় রাতে তাদের বাইরে যেতে নেই। কিছু পুরুষ তাদের জন্য ক্ষতিকর যাদের তারা পরিবারে বাবা –কাকা-ভাই বলে থাকে। তাদের আসলে প্রাণখোলা হাসিতে গড়িয়ে পড়তে নেই, মনখুলে বিশ্বাস করতে নেই। কখন কার মধ্যে পশুত্ব জেগে উঠবে তাই নিজেদের সাবধানে রাখার জিম্মা তাঁর নিজেরই। কিন্তু সবশেষে যে নিরাপত্তার অঙ্গীকার করে এক সামাজিক সম্পর্কে আবদ্ধ হবে তাঁর কাছেও সে নিরাপদ নয় মোটে। অচিরেই সে জানতে পারে তার শরীর পিষে ফেলার এক অঘোষিত অধিকার আছে সেই পুরুষটির। কিন্তু শরীরের ভয় জয় করার কোনো প্রশিক্ষণ নেই। সেটা বাড়িয়ে তোলার হাজার উপাদানের ছড়াছড়ি।
মেয়েদের উপর অত্যাচারের কাহিনী তার পরিবার নিরপেক্ষ নয়। এক মেয়ে ভোগে, ভোগে তার পরিবারের সকলে। অন্যদিকে যে অত্যাচার করে সমর্থন পায় তার পরিবারের। আইন আদালত শেষে মেয়েটি না ঘর কা না ঘাট কা! সম্পদ বলতে তার সন্তান। যার বিষয়ে সে একদম ঢাল নেই,তরোয়াল নেই নিধিরাম সর্দার। কেননা তার হাতে না থাকে পয়সা, না মেইটেইন্যান্স পাওয়ার ধারাবাহিক নিশ্চয়তা। মূল প্রশ্ন তবে কী? একজন মা তার নিজের ও তার উত্তরাধিকার নিয়ে অসহায়। আইন, আদালত অমাবস্যার রাতে সার সার কলা গাছের মত দাঁড়িয়ে। কর্তৃত্ব ও অনুশাসনের অধিকার নিয়ে সবাই সামনে। মুর্শিদাবাদের ঝর্ণা দাস নিজের মেয়ে নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে আসেন। তাকে স্বামী বিতাড়িত করে। দেবলীনা চৌধুরী শিকার হন ভুয়ো ডিগ্রীর স্বামীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে। পুলিশ সেখানে দর্শকের ভূমিকায়।আইন ও পরাস্ত।
জীবনভোর পাহারাদারের হানার মাঝে বেড়ে ওঠা এক জীবন বঞ্চনার স্বাদ জানে।একসময় ঘুরে জবাব দিতে শেখে কিন্তু প্রতিপক্ষ চিহ্নিতকরণে তার ভুল হয়ে যায়।প্রমাণ হয়ে আসলে মেয়েরাই মেয়েদের প্রতিপক্ষ।তারাই চায় না মেয়েদের উন্নতি হোক। এইটি এক নিঃসাড় যুক্তি প্রবঞ্চকের, তাতে কোনো ভুল নেই।তারপর আসে সফল নারীর কথা।যার সব অর্জন ই তার শরীর ও তার ফ্লেক্সিবিল আচরণের ফসল।এই এক সুপরিচিত সুপারফিসিয়াল স্টেট্মেন্ট যা থেকে রেহাই নেই মেয়েদের।জেনারালাইজ করেই বলি পুরুষের অর্জন তার নিজস্ব আর নারীর অর্জন তার শরীর ও মুখশ্রীর কায়দার ফল।প্রকারান্তরে সে বারবণিতা।পদে পদে অভিযোগকারিণী,প্রতিরোধকারী আসলে মানসিক ভাবে অসুস্থ মানে সাইকো।সে পুরুষশাসিত ও পরিচালিত সমাজের ব্যাখ্যা বুঝতে ও তার যথার্থতা নির্ধারনে অক্ষম।মুর্শিদাবাদের এক বিখ্যাত গাইনোকলজিস্ট তার স্বামীকে অন্য সম্পর্কের অভিযোগে বাড়ী থেকে বিতাড়িত করলে তার বিরুদ্ধে ওথেলো সিন্ড্রুম এই মানসিক রোগে আক্রান্ত বলে স্বামী অভিযোগ করেন।প্রতিবাদ করলেই সেই মহিলার মানসিক সুস্থতা নিয়ে কথা এসেই যায়।সমাজে এ এক চিরাচরিত বিশ্বাসের বীজ।
এতকিছুর মাঝে কি তবে নারীদিবস প্রাসঙ্গিক নয় ? কী বলে প্রান্তিক , অভিজাত ও এই দুই এর মাঝে ঝুলে থাকা মধ্যবিত্ত নারী সমাজ? শুরু হোক তবে মাঠ থেকে। কৃষক মৌসুমী বিশ্বাস জানান নারী দিবস তাঁর কাছে একটি গুরুত্বহীন বিষয়। শ্রমের মর্য্যাদা আজ ও অবহেলিত।নিজেদের কম মজুরির বিরুদ্ধে মেয়েরা সংগঠিত হয়ে উঠতে পারেনি। মুর্শিদাবাদের চামেলী বিবি ১৩ বছর বিড়ি বাঁধছেন। তাঁকে নারী দিবসের কথা বললে অবাক হন! তাঁর কাছে জীবনের মানে একটি গজাল, কুলো ও প্রতিদিনের সরবরাহ পাতা ও মশলা ,সুতো।এর বাইরে তার আলাদা কোনো জীবন নেই। সকাল হলেই কত বান্ডিল বিড়ি তাকে শেষ করতে হবে বেঁধে এই তাঁর টার্গেট। রাজমিস্ত্রীর কাজ করতে যাওয়া কামাল শেখের স্ত্রী জানতে চান, নারী দিবস কী? ওই দিন কি ছেলের স্কুল ছুটি থাকবে? বহরুল গ্রামের জাগরী মান্ডি বলেন, তিনি জানেন না নারী দিবস কী। জানার পরে আরো অবাক হয়ে বললেন, মেয়েদের মুখের কথায় কি আর দুনিয়া চলবে? স্বঘোষিত ব্যাচেলর অদিতি বিশ্বাস জানান সকালের ব্রাশ থেকে রাতের তৈরি বিছানায় মেয়েদের হাতের ছোঁয়ায় বেড়ে ওঠা ছেলে শুধু মেয়েদের মর্য্যাদা দেওয়ার শিক্ষাটা রপ্ত করে না জীবনভোর। নারী দিবস তাঁদের কাছে এক হাসির দিবস। ব্যঙ্গের দিবস।
ওদিকে মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবি নারী একদম মুখস্থ কথা বলে ফেললেন। তাঁদের কাছে নাকি সব দিবস নারী দিবস। আলাদা কোনো দিবসে তাদের বিশ্বাস নেই। প্রতিদিন রান্না ক’রে একশো কিলোমিটার দূরে কলেজ যান, ফিরে রান্না করেন, এটির নাম তিনি সংসার মানেন এবং শ্রমবিভাজনের চেয়ে সে তার বাড়তি দায়িত্বে গর্বিত।নির্জলা হাসিতে বলেন, সব কি আর সমান হিসেবে চলে? মানিয়ে নেওয়াটাই তো আসল! নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের মালকিন জানালেন তাঁরা একটি ইভেন্ট করবেন ওই দিন, সাথে থাকছে ককটেল পার্টি। ইভেন্টে থাকছে ক্যাটওয়াক ও লকার জুয়েলারি শো।
শেষ কথা বললেন এক সেক্স ওয়ার্কার। ঠিক ঢিলছোঁড়া দূরত্বে প্রশাসনিক আধিকারিকদের বাংলো, পাশেই গজিয়ে ওঠা দলীয় অফিস।ওই চত্বরে তাদের রাত ৮.৩০ পর থেকে আনাগোনা। কাস্টমার নিয়ে তাদের বড় চিন্তা। নারী দিবসে তার একটিই দাবি, একজন নেশাহীন, শিক্ষিত কাস্টমার। কেননা তাঁর বিশ্বাস মদ্যপ,অশিক্ষিত কাস্টমার বেয়াদপি বেশি করে। নারীদিবসের মানে তিনি এই স্বস্তিটুকু বোঝেন!
নারীদিবস পালনের প্রাসঙ্গিকতা যার কাছে যতটাই থাক সেলিব্রেশনের মেজাজটা খুব ভিন্ন মনে হয়। এখানেও এক বিভাজনের ছায়া, বোধের ফারাকের কথা এসেই গেছে। নারীর প্রতি সাধারণ শ্রদ্ধা ও সম্মান যখন বাস্তবের চেয়ে তাত্ত্বিক বেশি, তখন আর্থিক, রাজনৈতিক, সামাজিক প্রতিষ্ঠায় মেয়েদের উপস্থিতির করুণ পরিসংখ্যান বয়ান করে বিশ বাঁও জলে নারীর শ্রম, মজুরি,মানবিক পরিবেশের অধিকারের দাবি। শুধু বলতে হয় স্যালুট ক্লারা জেটকিন। আপনার শুরু করা যুদ্ধের পরিণতি আমরা টানতে পারিনি। এক অসীম আলস্য ও রাস্তায় নামার সাহসের অভাব আমাদের আজ ও হাজার অপরাধ ও অন্যায়ের সাথে সমঝোতা করতে শেখায়। যে ব্যাটন নিয়ে আমাদের আজ হাজার দাবি পূরণ করার কথা ছিল তাতে ডাহা ফেল করে ও আমাদের আস্থা একদিন সব বদলে যাবে।আমরা মরছি কিন্তু নিজেদের ওয়েল ইক্যুইপড করতে শিখছিনা কেননা আমরা বিলাসী। কখনো দুঃখের কখনো স্বপ্নের। আমরা আমাদের কবর খুড়ছি। বিকল্প কিছু ভাবনার জোর আমাদের মেরুদণ্ডে নেই। তাই আবার বছর জুড়ে সেই বধূহত্যা ও ধর্ষণের সিরিয়াল জারি।