এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ইস্পেশাল  ঈদের কড়চা

  • ফিদায়ে চাঁদ রাত

    জিনাত রেহেনা ইসলাম লেখকের গ্রাহক হোন
    ইস্পেশাল | ঈদের কড়চা | ২৩ জুন ২০১৮ | ১৩৭৭ বার পঠিত
  • ৩০ দিন কঠিন সাধনার পর একফালি চাঁদ দেখা হয়ে ওঠেনি আজও।মায়ের সেই কানে শোনা ‘চাঁদ দেখার’ চোখ আমার ।শেষ রোজার আগের রাতে মেহেন্দির মেহেফিলে বসিনি কখনো ।আসসালাম ওলাইকুমের পর ফিরিয়ে কি দিতে হয় আজও পড়া হয়ে ওঠেনি ।আরবী অক্ষর জ্ঞান নেই আমার তবু উৎসব আমার কাছ এক ছন্দবহপ্রবাহের মত।দুর্গা পুজো আমাদের উৎসব বলে জেনে এসেছি তিন বছর বয়স থেকে।ঈদ ও ও আমাদের কিনতু সাজানো মেহেফিলের পরিবেশ পাইনি।তাই অতীতের পেরিয়ে যাওয়া ৪০ বছর এই ঈদ উৎসবের দিনে একদম হাউস আরেষ্ট থেকে এসেছি। দুর্গাপুজোর সময় জামাকাপড় কেনাকাটা, প্যান্ডেল ঘোরা কোয়ার্টারে সবাই হাত ধরেছে আমাদের।আমরা পূর্ণ হয়েছি আনন্দে, অভিজ্ঞতায়।কিন্তু ঈদে এক বিষণ্ণতা একাকীত্ব কাজ করেছে।হাত ধরার মানুষ পাইনি।

    হাতে গুনে কয়েকবার ঈদ কাটিয়েছিলাম মামার বাড়িতে।সেখানেই জেনেছিলাম ঈদ আরবী শব্দ আউদ থেকে।যার অর্থ উৎসব।আর উৎসব মানেই খুশি আর আনন্দের প্রবল উচ্ছ্বাস। ফিতর শব্দের অর্থ ভেঙে দেওয়া।আরেক অর্থে বিজয়।রোজা ভঙ্গার পর আনন্দের জোয়াড়।ঈদ পালনের আগের রাত পুরস্কারের রাত।একেই লাইলাতুন জায়জা বলে । এক মাস সিয়াম সাধনা ও ইবাদত-বন্দেগীর পর রোজা ভঙ্গ করে আল্লাহর বিশেষ নিয়ামতের শুকরিয়াস্বরূপ সম্প্রীতি ও ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হয় বিশ্ব মুসলিম উম্মাহ।নানী মা বলেছিলেন হজরত ইউনুস আল্লাহর অসন্তুষ্টির কারণে চল্লিশ বছর মাছের পেটে কাটিয়ে তবেই মুক্তি পেয়েছিলেন সেদিন উম্মতরা পালন করেছিল ঈদ উৎসব। ইতিহাসে পড়েছিলাম মোঘল যুগেও খুব উৎসাহের সাথে পালিত হত ঈদ। ঈদ্গাহের ধ্বংসাবশেষ তাই প্রমান দেয়।যদিও সেখানে দরবারী ও উচ্চমধ্যবিত্ত ছাড়া সাধারণের যোগদান কম ছিল।কাতার,আরব,ইন্দোনেশিয়া,ইরান নানা জায়গার মানুষদের জিজ্ঞাসা করে একটিই সিদ্ধান্তে এসেছি পরিবারে মহিলাদের একটিই কাজ।সারামাস ধরে সেহেরীর ব্যবস্থা করা,ইফতারের আয়োজন করা ও পরিবারের সবাইকে উৎসবের ইতিহাস বর্ণনা করা,মেহেন্দি ও পোশাক কেনাকটায় অংশগ্রহণ করা।

    যখন বালুরঘাট,মালদহ ছিলাম তখন এভাবে বক্স বাজিয়ে মাইকের আওয়াজ পেতাম না।সাজানো হবে বলে একদল ছেলে চাঁদা নিতে আসত।যদিও সেটা মুসলিমদের বাড়িগুলো থেকেই নেওয়া হত।ঘুম ভেঙে যেত রাত তিনটের সময়।অমুসলিম এলাকায় যখন আমরা ভাড়া পেতাম না তখন ছিল অন্য অভিজ্ঞতা। রোজদারদের ঘুম থেকে জাগানোর জন্য একদল যুবক প্রতিদিন গানের সম্ভার নিয়ে আসত।আমাদের বাড়িতে কেউ রোজা রাখত না।বাবা চেইন স্মোকার ছিলেন।মা খুব বেশি ধর্মবিশ্বাসী নয়।তাই লাইট জ্বালিয়ে রাখা হত রাতে যাতে কেউ আমাদের প্রশ্ন না করে বাড়িতে কেউ রোজা করছে কিনা! মসজিদে নিয়মিত খাবার পাঠানো হত নিয়মানুসারে। তারপর বহরমপুরে আসার পর দেখেছি ঈদ উপলক্ষ্যে ফাংশন বা জলসার আয়োজন করা হবে সেই উদ্দেশ্যে চাঁদা।বিভিন্ন এলাকায় থাকতে গিয়ে দেখেছি ঈদের চাঁদা শুনলেই অমুসলিম পরিবার প্রশ্ন করেছে ,’তোরা আবার কী সাজাবি?তোদের আবার কি আছে? অপরপক্ষ নিরুত্তর।ঈদে নিজের বাড়িতে বিভিন্ন রান্না করা,খাওয়া ও প্রতিবেশীদের বাড়ি ঘোরা ছাড়া কী আছে?প্রতিবেশীরা অনেকেই কালীপূজোর মত করে বাড়ি সাজাত রঙিন ল্যাম্প দিয়ে ঈদের দিন।কিজানি আমার খুব ভালো লাগত,এই দুই পক্ষের মানুষের এই মিলে যাওয়া ব্যাপারটা আমায় খুব টানত।

    রোজার মাসে ফিতরা দান,জাকাত দান, ঈদের নামাজের পর শুভেচ্ছা বিনিময়, সালামি গ্রহণ,কবর জিয়ারত ,এই বিষয়গুলোর যে এক মানবিক ও নৈতিক মূল্য আছে তা আমার ঐ ভিন্ন মহল্লার প্রতিবেশীদের মত জানা ছিল না।সামুই,পায়েস,খুরমা একসময় খুব আভিজাত্যের সাথে উচ্চারিত হতে দেখিনি।এই উৎসবের সার্বজনীনতার এক ঘাটতি চোখে পড়েছে সবসময়।বাণিজ্যিকিকরণ হয়েছে এই উৎসবের নানাভাবে।ঈদের সময় কেনাকাটার উপর বিশেষ ছাড় বা লটারি বা বোরখার উপর বিশেষ ছাড় ঘোষণা করা হয়েছে।রাজনীতিকরণও দিনে দিনে বাড়ছে।ইফতার পার্টির আয়োজন করা হচ্ছে।মোনাজতের ভংগিতে প্রার্থনাও চলছে।ঈদ মোবারক বিনিময় হচ্ছে কিন্তু একে অপরের উৎসবকে আপন করার প্রয়াস খুব কম সেট ধরা পড়ে যাচ্ছে।কিছু ক্ষেত্রে কৃত্রিম আবার কোথাও আন্তরিকতার এক ভান লক্ষ্য করা গেছে। আমাদের এই দেশের ইমারত এক গভীর আবেগের উপর দাঁড়িয়ে তাই যে মানুষদের মুসলিম বাড়িতে বাচ্চাদের খাওয়া নিষেধ বলে অকাট্য সিদ্ধান্ত আছে জানি তাদেরও ঈদ মোবারক বলতে বা সোস্যাল সাইটে শুধু মুসলিম বন্ধুদের ট্যাগ করে আনন্দের শরিক বলে আত্মপ্রকাশ করতে দেখেছি।এই আবেগ মিথ্যার,সমন্বয়ের আস্ফালনের।গভীরে ক্ষতটা আমরা দেখি, যারা দুই সম্প্রদায়ের মানুষদের অন্দরমহলের বাইরে থেকে গেছি। পূজা ও ঈদের মাঝে আমরা কোথাও খুঁজে পাইনি নিজেদের।যে একফালি চাঁদ এত আনন্দের তাকে ছুঁতে পারিনি আবার বিসর্জনের সময় দুর্গামাকেও সাথ দেওয়া হয়নি একবার।উৎসবে অবগাহন অধরা থেকে গেছে।মানুষ হওয়ার বোধহয় এটাই ট্রাজেডি।তাকে হিন্দু নয় মুসলিম হতেই হয়।মুসলিম জন্মায় না।মুসলিম হয় বিশ্বাসে।সে বিশ্বাসের আবার ৫ স্তম্ভ।তা চর্চার বাইরে আমি।তাই চাঁদ রাত আমার কাছে এক গল্পমাত্র ।আর আমি যদি বলি সিন্ধুর তীরের হিন্দু আমি, কে দেবে আমায় দুর্গা ঠাকুর পছন্দ করে মণ্ডপে আনতে? বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে সেই সরস্বতীদেবীকে তো হোষ্টেল সুপার আনতে দিতে বাদ সেধেছিলেন।জানিয়ে দিয়েছিলেন এক অহিন্দুর কখনো ঠাকুর চয়েস করার কাজ করতে পারে না!আমার মত অনেকের উৎসবের চেনা পথ তাই নির্জন,ব্যতিক্রমী।তবু আনন্দ জাগে...


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ইস্পেশাল | ২৩ জুন ২০১৮ | ১৩৭৭ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • স্বাতী রায় | unkwn.***.*** | ২৩ জুন ২০১৮ ০৩:১২84311
  • "কাতার,,আরব,ইন্দোনেশিয়া,ইরান নানা জায়গার মানুষদের জিজ্ঞাসা করে একটিই সিদ্ধান্তে এসেছি পরিবারে মহিলাদের একটিই কাজ।সারামাস ধরে সেহেরীর ব্যাবস্থা করা,ইফতারের আয়োজন করা ও পরিবারের সবাইকে উৎসবের ইতিহাস বর্ননা করা,মেহেন্দি ও পোশাক কেনাকটায় অংশগ্রহন করা।" - এইখানে এসে সব উৎসব এক হয়ে গেল।

    ভাল লাগল.
  • prativa | unkwn.***.*** | ২৩ জুন ২০১৮ ০৮:২১84309
  • গভীর অভিমানের লেখা !
  • বিপ্লব রহমান | unkwn.***.*** | ২৩ জুন ২০১৮ ১২:৪৫84310
  • রোজা এখন আর সিয়াম বা কৃচ্ছ্রসাধন নয়, কেবলই যেন দেখনদারী আর খাওয়াদাওয়ার বিকট উৎসব!

    আগে ছিল ইফতার পার্টির নামে এলাহি ভোজ। সম্প্রতি যোগ হয়েছে ভোররাতে নামিদামী রেঁস্তোরা সপরিবারে না বন্ধু-বান্ধবে দলেবলে সেহরি পার্টিতে যোগদান। এই নিয়ে স্যোশাল মিডিয়ায় চলে সেলফি মচ্ছব।...

    বিস্মৃত রোজা ও ঈদোৎসবের অনেক কথাই এ লেখায় মনে পড়লো! এমনকি হারানো কাসিদার দল, চানরাতে পটকাবাজি, ঈদের সালামী, পাড়ার মাঠে নাগরদোলা।...

    যে যায়, সে একেবারে যায়!
  • শক্তি | unkwn.***.*** | ২৫ জুন ২০১৮ ০৯:৫৪84312
  • অভিমান আছে, ক্ষোভ বোঝা যায় তবুও উৎসবের দিন গুলো উৎসবেই ভরপুর
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আদরবাসামূলক মতামত দিন