৩০ দিন কঠিন সাধনার পর একফালি চাঁদ দেখা হয়ে ওঠেনি আজও।মায়ের সেই কানে শোনা ‘চাঁদ দেখার’ চোখ আমার ।শেষ রোজার আগের রাতে মেহেন্দির মেহেফিলে বসিনি কখনো ।আসসালাম ওলাইকুমের পর ফিরিয়ে কি দিতে হয় আজও পড়া হয়ে ওঠেনি ।আরবী অক্ষর জ্ঞান নেই আমার তবু উৎসব আমার কাছ এক ছন্দবহপ্রবাহের মত।দুর্গা পুজো আমাদের উৎসব বলে জেনে এসেছি তিন বছর বয়স থেকে।ঈদ ও ও আমাদের কিনতু সাজানো মেহেফিলের পরিবেশ পাইনি।তাই অতীতের পেরিয়ে যাওয়া ৪০ বছর এই ঈদ উৎসবের দিনে একদম হাউস আরেষ্ট থেকে এসেছি। দুর্গাপুজোর সময় জামাকাপড় কেনাকাটা, প্যান্ডেল ঘোরা কোয়ার্টারে সবাই হাত ধরেছে আমাদের।আমরা পূর্ণ হয়েছি আনন্দে, অভিজ্ঞতায়।কিন্তু ঈদে এক বিষণ্ণতা একাকীত্ব কাজ করেছে।হাত ধরার মানুষ পাইনি।
হাতে গুনে কয়েকবার ঈদ কাটিয়েছিলাম মামার বাড়িতে।সেখানেই জেনেছিলাম ঈদ আরবী শব্দ আউদ থেকে।যার অর্থ উৎসব।আর উৎসব মানেই খুশি আর আনন্দের প্রবল উচ্ছ্বাস। ফিতর শব্দের অর্থ ভেঙে দেওয়া।আরেক অর্থে বিজয়।রোজা ভঙ্গার পর আনন্দের জোয়াড়।ঈদ পালনের আগের রাত পুরস্কারের রাত।একেই লাইলাতুন জায়জা বলে । এক মাস সিয়াম সাধনা ও ইবাদত-বন্দেগীর পর রোজা ভঙ্গ করে আল্লাহর বিশেষ নিয়ামতের শুকরিয়াস্বরূপ সম্প্রীতি ও ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হয় বিশ্ব মুসলিম উম্মাহ।নানী মা বলেছিলেন হজরত ইউনুস আল্লাহর অসন্তুষ্টির কারণে চল্লিশ বছর মাছের পেটে কাটিয়ে তবেই মুক্তি পেয়েছিলেন সেদিন উম্মতরা পালন করেছিল ঈদ উৎসব। ইতিহাসে পড়েছিলাম মোঘল যুগেও খুব উৎসাহের সাথে পালিত হত ঈদ। ঈদ্গাহের ধ্বংসাবশেষ তাই প্রমান দেয়।যদিও সেখানে দরবারী ও উচ্চমধ্যবিত্ত ছাড়া সাধারণের যোগদান কম ছিল।কাতার,আরব,ইন্দোনেশিয়া,ইরান নানা জায়গার মানুষদের জিজ্ঞাসা করে একটিই সিদ্ধান্তে এসেছি পরিবারে মহিলাদের একটিই কাজ।সারামাস ধরে সেহেরীর ব্যবস্থা করা,ইফতারের আয়োজন করা ও পরিবারের সবাইকে উৎসবের ইতিহাস বর্ণনা করা,মেহেন্দি ও পোশাক কেনাকটায় অংশগ্রহণ করা।
যখন বালুরঘাট,মালদহ ছিলাম তখন এভাবে বক্স বাজিয়ে মাইকের আওয়াজ পেতাম না।সাজানো হবে বলে একদল ছেলে চাঁদা নিতে আসত।যদিও সেটা মুসলিমদের বাড়িগুলো থেকেই নেওয়া হত।ঘুম ভেঙে যেত রাত তিনটের সময়।অমুসলিম এলাকায় যখন আমরা ভাড়া পেতাম না তখন ছিল অন্য অভিজ্ঞতা। রোজদারদের ঘুম থেকে জাগানোর জন্য একদল যুবক প্রতিদিন গানের সম্ভার নিয়ে আসত।আমাদের বাড়িতে কেউ রোজা রাখত না।বাবা চেইন স্মোকার ছিলেন।মা খুব বেশি ধর্মবিশ্বাসী নয়।তাই লাইট জ্বালিয়ে রাখা হত রাতে যাতে কেউ আমাদের প্রশ্ন না করে বাড়িতে কেউ রোজা করছে কিনা! মসজিদে নিয়মিত খাবার পাঠানো হত নিয়মানুসারে। তারপর বহরমপুরে আসার পর দেখেছি ঈদ উপলক্ষ্যে ফাংশন বা জলসার আয়োজন করা হবে সেই উদ্দেশ্যে চাঁদা।বিভিন্ন এলাকায় থাকতে গিয়ে দেখেছি ঈদের চাঁদা শুনলেই অমুসলিম পরিবার প্রশ্ন করেছে ,’তোরা আবার কী সাজাবি?তোদের আবার কি আছে? অপরপক্ষ নিরুত্তর।ঈদে নিজের বাড়িতে বিভিন্ন রান্না করা,খাওয়া ও প্রতিবেশীদের বাড়ি ঘোরা ছাড়া কী আছে?প্রতিবেশীরা অনেকেই কালীপূজোর মত করে বাড়ি সাজাত রঙিন ল্যাম্প দিয়ে ঈদের দিন।কিজানি আমার খুব ভালো লাগত,এই দুই পক্ষের মানুষের এই মিলে যাওয়া ব্যাপারটা আমায় খুব টানত।
রোজার মাসে ফিতরা দান,জাকাত দান, ঈদের নামাজের পর শুভেচ্ছা বিনিময়, সালামি গ্রহণ,কবর জিয়ারত ,এই বিষয়গুলোর যে এক মানবিক ও নৈতিক মূল্য আছে তা আমার ঐ ভিন্ন মহল্লার প্রতিবেশীদের মত জানা ছিল না।সামুই,পায়েস,খুরমা একসময় খুব আভিজাত্যের সাথে উচ্চারিত হতে দেখিনি।এই উৎসবের সার্বজনীনতার এক ঘাটতি চোখে পড়েছে সবসময়।বাণিজ্যিকিকরণ হয়েছে এই উৎসবের নানাভাবে।ঈদের সময় কেনাকাটার উপর বিশেষ ছাড় বা লটারি বা বোরখার উপর বিশেষ ছাড় ঘোষণা করা হয়েছে।রাজনীতিকরণও দিনে দিনে বাড়ছে।ইফতার পার্টির আয়োজন করা হচ্ছে।মোনাজতের ভংগিতে প্রার্থনাও চলছে।ঈদ মোবারক বিনিময় হচ্ছে কিন্তু একে অপরের উৎসবকে আপন করার প্রয়াস খুব কম সেট ধরা পড়ে যাচ্ছে।কিছু ক্ষেত্রে কৃত্রিম আবার কোথাও আন্তরিকতার এক ভান লক্ষ্য করা গেছে। আমাদের এই দেশের ইমারত এক গভীর আবেগের উপর দাঁড়িয়ে তাই যে মানুষদের মুসলিম বাড়িতে বাচ্চাদের খাওয়া নিষেধ বলে অকাট্য সিদ্ধান্ত আছে জানি তাদেরও ঈদ মোবারক বলতে বা সোস্যাল সাইটে শুধু মুসলিম বন্ধুদের ট্যাগ করে আনন্দের শরিক বলে আত্মপ্রকাশ করতে দেখেছি।এই আবেগ মিথ্যার,সমন্বয়ের আস্ফালনের।গভীরে ক্ষতটা আমরা দেখি, যারা দুই সম্প্রদায়ের মানুষদের অন্দরমহলের বাইরে থেকে গেছি। পূজা ও ঈদের মাঝে আমরা কোথাও খুঁজে পাইনি নিজেদের।যে একফালি চাঁদ এত আনন্দের তাকে ছুঁতে পারিনি আবার বিসর্জনের সময় দুর্গামাকেও সাথ দেওয়া হয়নি একবার।উৎসবে অবগাহন অধরা থেকে গেছে।মানুষ হওয়ার বোধহয় এটাই ট্রাজেডি।তাকে হিন্দু নয় মুসলিম হতেই হয়।মুসলিম জন্মায় না।মুসলিম হয় বিশ্বাসে।সে বিশ্বাসের আবার ৫ স্তম্ভ।তা চর্চার বাইরে আমি।তাই চাঁদ রাত আমার কাছে এক গল্পমাত্র ।আর আমি যদি বলি সিন্ধুর তীরের হিন্দু আমি, কে দেবে আমায় দুর্গা ঠাকুর পছন্দ করে মণ্ডপে আনতে? বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে সেই সরস্বতীদেবীকে তো হোষ্টেল সুপার আনতে দিতে বাদ সেধেছিলেন।জানিয়ে দিয়েছিলেন এক অহিন্দুর কখনো ঠাকুর চয়েস করার কাজ করতে পারে না!আমার মত অনেকের উৎসবের চেনা পথ তাই নির্জন,ব্যতিক্রমী।তবু আনন্দ জাগে...