এক হত্যা। এক নৃশংসতা। এক অবিশ্বাস। প্রেম ও প্রবৃত্তির ভিন্ন অভিঘাত। মালদার বাসিন্দা, বহরমপুরে পাঠরতা ছাত্রীর হত্যাকাণ্ড এক বিষাদের ছায়ায় ঢাকল শহরটাকে। হতবাক ও শোকস্তব্ধ বাসিন্দাদের একটিই প্রশ্ন কুরে কুরে খেল- এভাবে কেন? এই পাশবিকতা তো মনুষ্যত্বের লজ্জা! এই আক্রোশ, এই জিঘাংসা সম্পর্ক বিষয়ক নয়। এ তো অন্য ঘৃণা। অন্য অসম্মান। অন্য মোড়কে থাকা প্রতিশোধ ও প্রতিরোধ। এর কোনও দিক নেই। মানও না। যতদূর সীমানা শুধুই মানবিকতার হার। পুরুষ-তন্ত্র ও মহিলা বিদ্বেষের চেনা পুরানের বুনোটে ধ্বংসলীলার উল্লাস।
প্রেমিক সুশান্ত ও হত্যাকারী সুশান্ত অসুস্থ। আর এই অসুখ সমাজের এক কোনে লালিত আগুন। তাতে এক সুতপা নয়,হাজারও মেয়ে অনিরাপদ। এক সামগ্রিক এজেন্সির সারভাইভাল ঝুঁকির মুখে। কেন সুশান্ত খুনি সে পর্যালোচনার আগে প্রয়োজন কেন একদা প্রেমিকের হাতে মরতে হবে সুতপাদের! এবং খুনির পাশে আর এক মহিলাকে অপরাধী সাব্যস্ত করা ও তাকে জনতার দরবারে টার্গেট করে তোলার জন্য মিডিয়ার নির্লজ্জ ও অবিবেচনাপ্রসূত গল্প বড় মারাত্মক ভূমিকায়। অভিযুক্তের পাশাপাশি এক প্যারালাল মহিলা চরিত্রের আবির্ভাব ও অভিযুক্ত করার ঘটনা পীড়াদায়ক। আর সেই পড়ে-শুনে অভিযুক্তের 'সোর্স' মেয়েটির শাস্তি দাবী করা সমাজ মানসিকতার সেই ঘুণকেই চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়। মেয়ের প্রতি অন্যায়ে সেই মেয়েকেই হাতিয়ার। আসলে অভিযুক্তের যাবতীয় খোঁজের রসদ সাপ্লায়ার হিসেবে সুতপার বন্ধু কাম মেস-মেট মেয়েটিই দায়ী। এক আততায়ীর কাঠগড়ায় এক মহিলা চরিত্রের হঠাৎ চিত্রায়ন। এ এক অন্য অবদমন। সর্বনাশের রাশ মূল অভিযুক্তর পাশাপাশি অন্য এক শত্রুর হাতে। আখেরে 'মেয়েরাই মেয়েদের শত্রু' তত্ত্বে বাজার চঞ্চল।
ঘটনা ঘিরে যে উক্তি ও পাল্টা উক্তি সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে সেই দৃষ্টিকোণ আরও ভয়াবহ। সমাজ-মনন আসলে শূন্য এক দিশায় ধেয়ে যাচ্ছে। পাল্টা যুক্তি ও পারস্পরিক মতবিরোধ এক সিদ্ধান্ত হীন দিকে মেয়েদের নিরাপত্তা ও আত্মসম্মানবোধকে ঠেলে দিচ্ছে। সমাজ ও পরিবারে মেয়েদের ভূমিকার বদলে পুরুষের ক্রোধ ও হিংসার সমর্থনে যুক্তি সেজেই উঠছে। অপরাধীর অপরাধের কারণ কী হতে পারে? সে নিয়েই ডিফেন্সের বলয় নির্মাণ চলছে। ভিক্টিম ব্লেমের সেই পুনরাবৃত্তি। সুতপা সেখানে নিরীহ-নিপীড়িত নয়। ঘাতকের যথার্থ মোটিভ। রাগের সমুচিত কারণ। লিঙ্গ হিংসার এ এক পরিচিত আসপেক্ট। সচেতনতা ও চর্চার প্রয়োজন এখানেই।
অভিযুক্তের পরিবার সরাসরি একবারও বলেনি
ছেলেটি 'খুব খারাপ' করেছে মেয়েটির সঙ্গে। স্পষ্ট করে সেটা একবারের জন্যও উঠে আসেনি। সেটা দুর্ভাগ্যজনক। মেয়েদের বাঁচাতে এই চিহ্নিত অভিযুক্তের বিষয়ে রাখ-ঢাক চলেনা। পক্ষ - বিপক্ষ চলে না। অন্যায়কারীর সমাজ নেই। পরিবার ভাবনা নেই- তাই সে বিকৃত। সে ছন্নছাড়া। আত্মপক্ষ সমর্থনে সে যাই বলুক সমাজ পক্ষপাতিত্বের বোঝা বইবে না সেটাই কাম্য। কেননা পরিবারে ভিত নির্মাণ করে সেই নারীরাই। তারপর তারাই নিরাপত্তা-হীনতায় কেন ভুগবে?
খুশীর ইদ। সকলের। শুধু তৃতীয় বর্ষের মেয়েটি হারিয়ে গেল। পড়ার জন্য জেলা বদল। প্রতিষ্ঠান বদল। এবার বদলে গেল পৃথিবীর ঠিকানাও। ঘটনা ভয়াবহ ও মর্মান্তিক। মেয়ের অকালে মৃত্যু। এবং অপঘাতে। হত্যায়। যারা মোবাইলে ভিডিও করেছেন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা। নইলে অপরাধীকে এত দ্রুত সনাক্তকরণ ও ধরে ফেলা হয়তো সহজ হত না। যারা বাঁশ নিয়ে এগিয়ে গেছেন অপরাধীর দিকে, কিন্তু বন্দুকের নলের ভয়ে থমকেছেন সেই প্রতিবেশীরাই মেয়েদের বিপদের মুহূর্তে প্রকৃত রক্ষক। পাড়ার দাদা-ভাই। মেয়েদের বিপদে পাড়ার ছেলেদের সর্বাগ্রে এগিয়ে আসা বহরমপুর শহরের সংস্কৃতি এটাই।
নিউজ ফিডে বহুল শেয়ার হওয়া এই হত্যার ঘটনায় হাজারো কমেন্ট। হত্যাকারীর শাস্তি সকলের কাম্য কিন্তু 'একপেশে স্বাধীনতা' দায়ী কিনা প্রশ্ন তুলেছেন দেখলাম কয়েকজন। মেয়েরা প্রাণ হারাচ্ছে প্রেমিক -পরিবারের হাতে। দায়ী হবে পাওয়ার ডাইনামিকস, মিসোজিনিস্ট ভাবনার আদিম শিকড়। কিন্তু উঠে আসছে পৃথিবীর স্বাধীনতার কতটা ভাগ মেয়েদের প্রাপ্য সেই গল্প। এক অন্ধ বিশ্বাস। এক মিথ্যা ধারণা। 'ভাল মেয়েদের' কেউ মারে না। 'ভাল' মেয়েদের সন্ধানে শতাব্দী ফুরিয়ে এলো। আসলে 'ভাল' মেয়ের সংজ্ঞা স্থির হল না।
ফোন করে বাইরে ডেকে এনে ছুরি দিয়ে কুপিয়ে দিল প্রেমিক সেই ছাত্রীকে। কোনও মেয়েই তার প্রেমিকের হাতে এরকম যন্ত্রণার মৃত্যু ডিজার্ভ করে না। শরীরের কোথাও একটু কেটে গেলে ছটপট করি আমরা। সেখানে এতবার ছুরিকাঘাত। মেয়েটির জন্য বুক ভাঙে কষ্টে। অভিযুক্ত খেলনা বন্দুক দিয়ে ভয় দেখিয়ে স্থান ছাড়ল। ধরা পড়ল। এবার বিচার চলবে। কিন্তু মেয়েটি ফিরবে না। ওর সেই ছুরিকাহত হওয়ার বেদনা চাইলেও কেউ অনুভব করতে পারবে না হয়তো। অভিযুক্তর ফেসবুক আকাউন্ট যা গতকাল ভাইরাল হয় সেখানে সে রীতিমত হুমকি দিয়ে রেখেছিল। সেটা পুলিশ-প্রশাসনের নজরে আনা খুব দরকার ছিল। এরকম এক বয়ান যে প্রকাশ্যে সোশ্যাল সাইটে রাখে তার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ জরুরি ছিল। মেয়ের বাবা বলেছেন যে, উনি এলাকার কাউন্সিলরকে জানিয়েছিলেন ছেলেটির হুমকির কথা। প্রশ্ন এখানেই। মেয়েদের নিরাপত্তার জন্য মহিলা থানা থেকে উইনার্স স্কোয়াড। তবে কেন কাউন্সিলর?
আজকের দিনে রিলেশনশিপ ম্যানেজমেন্ট খুব দরকার। সম্পর্কের এখন মাল্টিডাইমেনশন। সম্পর্কে সততা না থাকলে তা বর্জনীয়। আবার সেটা উভয়পক্ষ মেনে নিয়ে চললে একটা পারস্পরিক বোঝাপাড়ার জন্ম। প্রেমের সম্পর্ক পরিবর্তনশীল। আজকের পছন্দ কাল বদলাতেই পারে। একজন একশো শতাংশ ইনভেস্টেড বলে অন্যজন ততটাই থাকবে এমনটা ডেলিবারেট নয়। দুই ইন্ডিভিজুয়াল। দুই রকমভাবে বেড়ে ওঠা। তাই 'মুভ অন'খুব স্বাভাবিক বিষয়। প্রেম কোনও যুদ্ধক্ষেত্র নয়। জীবন নষ্টের মাঠও নয়। পছন্দের মানুষটি হঠাৎ অপছন্দের হয়ে উঠলে অপশন খোলা আছে। প্রেমে ব্যর্থ হওয়ার যে কষ্ট বা ফেইলড রিলেশনের যে বার্ডেন তা অত্যন্ত ভারবাহী। কিন্তু তার বিকল্প আক্রোশে বা প্রতিশোধে নেই এটাই বড় কথা। প্রেমে পড়া মানেই কারও প্রাইভেট প্রপার্টি হয়ে যাওয়া নয়। তাই কাউকে মেরে ফেলার যুক্তি এটা নয় যে, "মেয়েটি নিশ্চয়ই কিছু করেছিল। এমনি কি কেউ কাউকে মারে?" ক্ষমতার দম্ভ থেকে মারে। ভাবনার বিকৃতি থেকে মারে।
মেয়েদের বাঁচা-মরা সবটাই অভিভাবক নিয়ন্ত্রিত এই বিশ্বাস থেকে মারে। আসলে প্রতিষ্ঠা করতে চায় যে, মেয়েদের সাহস বা পছন্দ অর্জন নয়, তদ্বির ও ভিক্ষার বিষয়। সেটি এক পুরুষের মর্জি দেবে কী ফেরাবে!
হত্যাকারী জন্মায় না। ভাবনা, দৃষ্টিভঙ্গি,সাহস-স্পর্ধা সব এই সমাজ লালন করার ভূমিকায় থাকে। এক অপরাধীর শাস্তি আগামীর অঘটন আটকাবে কি? 'দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি' আসলে কী তা আজও অজানা। তাই ভাবনার প্রাঙ্গণে আরও অনেক বিষয়ের সংযুক্তি দরকার। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা পুরুষের নারী ভাবনা ও অধিকার বোধের জায়গা নিয়ে বিশ্লেষণ দরকার। নইলে মেয়েদের উপর নেমে আসা লাগাতার আক্রমণের শেষ হবে না। প্রেমিকা - বৌ - মেয়েকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার অভিভাবক একমাত্র পুরুষই - সেই ভুল বাক্যের সামাজিক পরম্পরায় ইতি টানা দরকার। মেয়েরা নিজেরাই নিজের অভিভাবক। নিজের সিদ্ধান্ত নিজের অধিকার। এই আধুনিকতাটুকু কে প্রশ্রয় দেওয়া কি খুবই কষ্টের!