উনিশ শতকের শেষদিক ভারতের নারী-শিক্ষার ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক সময়। এইসময় একগুচ্ছ ভারতীয় মহিলাকে আমরা ইতিহাসের পাতায় দেখতে পাই, যারা উচ্চশিক্ষার আঙিনায় ঢুকে পড়েন, যে আঙিনাটা এতদিন পুরোপুরি পুরুষদের দখলে ছিল। কামিনী রায়, অবলা বোস, কাদম্বিনী গাঙ্গুলি, চন্দ্রমুখী বোস, আনন্দিবাই যোশী, আনি জগন্নাথন—এইরকমই কয়েকজন মহিলা। এ ছাড়াও আরও বেশ কয়েকজন রয়েছেন। এই আলোচনার সুবিধার জন্য এই ক-জনেরই নাম নেওয়া হল। যে ক-জনের নাম নেওয়া হল তাদের মধ্যে কাদম্বিনী গাঙ্গুলি বেশ কিছু বিষয় ‘প্রথম’ ছিলেন। আনন্দিবাই যোশী, আনি জগন্নাথন, অবলা বোস, কাদম্বিনী গাঙ্গুলী—চারজনই কম-বেশি একই সময় ডাক্তারি পাস করেছিলেন। কিন্তু এঁদের মধ্যে কাদম্বিনীই প্রথম ভারতীয় মহিলা যিনি ভারতীয় একটি প্রতিষ্ঠান থেকে পশ্চিমি চিকিৎসাশাস্ত্র নিয়ে পড়াশোনা করেন এবং জীবনের শেষদিন পর্যন্ত এই পেশার সঙ্গে যুক্ত থাকেন। এই কৃতিত্ব গোটা ব্রিটিশ উপনিবেশেই প্রথম। কাদম্বিনী গাঙ্গুলি, চন্দ্রমুখী বসু—এই দুজন ব্রিটিশ উপনিবেশগুলির মধ্যে প্রথম মহিলা স্নাতক। বেথুন কলেজ শুরু হয় এঁদের দুজনকে নিয়ে। কামিনী রায় কাদম্বিনীর কিছু ছোটো, বেথুন কলেজেরই ছাত্রী। আমরা এঁকে চিনি মূলত ‘পাছে লোকে কিছু বলে’ এই বিখ্যাত পঙ্ক্তির রচয়িতা-কবি হিসেবে। কামিনী রায় কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত তো ছিলেন বটেই, একজন সমাজসংস্কারক ছিলেন, ভারতের নারী-অধিকার আন্দোলনের এক্কেবারে শুরুর দিককার কর্মী ছিলেন।
ঘরে আটকে থাকা নারীদের সামাজিকভাবে দৃশ্যমান হয়ে ওঠার এক্কেবারে শুরুর দিক ছিল সেই সময়টা। আর বাংলায়, শুরুর দিকের সময়কার এই নড়াচড়ার একদম পুরোভাগে ছিল ব্রাহ্মসমাজ ও তার নেতৃত্বদায়ী মানুষরা। দ্বারকানাথ গাঙ্গুলি তাঁদের মধ্যে অন্যতম। দ্বারকানাথ গাঙ্গুলি, কাদম্বিনীর স্বামী ছিলেন। বেথুন কলেজে স্নাতক হওয়ার পর কাদম্বিনী কলকাতা মেডিকাল কলেজে ভরতি হতে চান। তখনও কাদম্বিনীর বিয়ে হয়নি। কিন্তু সেই সময় কলকাতা মেডিকাল কলেজে মেয়েদের প্রবেশাধিকার ছিল না। দ্বারকানাথ গাঙ্গুলির নেতৃত্বে বেশ কিছু লোকজন মেডিকাল কলেজের সামনে, কলেজে মেয়েদের প্রবেশাধিকারের দাবিতে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন। দাবি মেনে নেওয়া হয়। কাদম্বিনী মেডিকাল কলেজে পড়াশোনা শুরু করেন। কলেজে পড়াশোনা শুরু করার ঠিক আগ দিয়েই কাদম্বিনীর সঙ্গে দ্বারকানাথের বিয়ে হয়ে যায়। দ্বারকানাথের এটি দ্বিতীয় বিয়ে। আগের বউ আগেই মারা গিয়েছিলেন। এই বিয়ে নিয়েও বিভিন্ন মহলে যথেষ্ট পরিমাণ ঢিঢি পড়ে যায়। দ্বারকানাথ বা কাদম্বিনী কেউই সেসবকে পাত্তা দেওয়ার চরিত্র ছিলেন না। কাদম্বিনী চিকিৎসাকে পেশা হিসেবে বেছে নেওয়ার কিছু পরপরই ‘বঙ্গবাসী’ নামে একটি পত্রিকায় কাদম্বিনীকে ঘুরিয়ে ‘বেশ্যা’ বলা হয়। দ্বারকানাথ, শিবনাথ শাস্ত্রী, নীলরতন সরকার ওই পত্রিকার সম্পাদকের বিরুদ্ধে কেস করেন ও কেসে জেতেন। সম্পাদকের ১০০ টাকা জরিমানা ও ছয় মাসের কারাবাস হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য কাদম্বিনী ডিগ্রি বাড়াবার জন্য বিলেত যান এবং তিনটি ডিপ্লোমা করে ফেরেন।
এ হেন কাদম্বিনীকে নিয়ে সম্ভবত দুটি বাংলা সিরিয়াল হচ্ছে, যার কোনো একটির বিজ্ঞাপনের জন্য সানরাইজ গুঁড়ো মশলা এই কথাটি লেখে—‘এক গৃহিণীর অসাধ্যসাধনের কাহিনি’। মেয়েরা যতই বাইরে বেরোক, তাদের আসল জায়গা ঘরে আর ছেলেদের আসল জায়গা বাইরে—এই চরাচরিত শ্রম-বিভাজনকেই আবারও প্রতিষ্ঠিত করছে এই বিজ্ঞাপন। অথচ কাদম্বিনী সারাজীবন ঠিক এর উলটোদিকে হেঁটেছিলেন। হতেই পারে তাঁর ঘরে আটটি সন্তান ছিল, হতেই পারে তিনি গৃহকর্মনিপুণা ছিলেন, কিন্তু তাঁর প্রধান পরিচয় ‘গৃহিণী’ ছিল না। কোনোদিনই ছিল না। তখন যদিও মেয়েদের সেই পরিচয়টাই প্রধান থাকে তবুও ওনার এই পরিচয়টা প্রধান ছিল না। তার প্রমাণ আমরা ওনার কাছের লোকেদের স্মৃতিচারণে দেখতে পাই। পুণ্যলতা চক্রবর্তীর ‘ছেলেবেলার দিনগুলি’ বইটির বিভিন্ন জায়গায় কাদম্বিনীর কথা রয়েছে। কাদম্বিনী গাঙ্গুলি পুণ্যলতার দিদিমা ছিলেন। প্রথমেই দিদিমার বিলেত থেকে ফেরার দিনের স্মৃতি রয়েছে। কাদম্বিনী বিলেত যাওয়ার আগে তাঁর সবচাইতে ছোটোছেলে, পুণ্যলতার ‘জংলুমামা’-কে রেখে গিয়েছিলেন নিজের মার কাছে। কাদম্বিনী যেদিন ফেরত আসেন সেদিন ‘জংলু’ তাঁকে চিনতে পারেনি। পুণ্যলতার স্মৃতিতে দেখা যায় যে, কাদম্বিনীর পড়াশোনার জন্য একটি আলাদা ঘর ছিল। ঘরটিকে বাচ্চারা ‘কঙ্কালের ঘর’ নামে চিনত। বাড়ির বউ-এর পড়াশোনার জন্য আলাদা ঘর থাকাটা শুধু সেই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে প্রথাবিরুদ্ধ ছিল তাই নয়, আজকের যুগেও খুব চালু একটি পদ্ধতি নয়। কাদম্বিনী সারাজীবন চিকিৎসা করে গিয়েছেন। নেপালেও বেশ কিছুদিন ছিলেন চিকিৎসার সুবাদে। কলকাতাতেও ঘরে ঘরে গিয়ে মেয়েদের চিকিৎসা করেছেন। পুণ্যলতার স্মৃতিচারণেই দেখা যাবে যে, ডাক্তার-দিদিমার সঙ্গে তাদের একটি সশ্রদ্ধ দূরত্ব ছিল। এগুলোর কোনোটাই সাবেক গৃহিণীর লক্ষণ নয়। লীলা মজুমদারের ‘পাকদণ্ডী’-তেও কাদম্বিনীর স্মৃতিচারণ আছে। সেখানে বলা হয়েছে যে, বিলেত থেকে ফেরার পর ছোটো ছেলে তাঁকে চিনতে না পারায় কাদম্বিনী কেঁদে ফেলেন। কাদম্বিনীকে গৃহিণী বলে অভিহিত করা হলে বস্তুত শুধু কাদম্বিনীকে নয় কাদম্বিনী আর দ্বারকানাথের যৌথ লড়াইকেও লঘু করা হয়, তার মর্যাদাহানি হয়।
একটি চালু প্রবাদ হল ‘যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে’। যখন মেয়েদের একটু টাইট দেওয়ার, একটু কড়কে দেওয়ার দরকার পড়ে তখনই এই প্রবাদের আবিল ব্যবহার নজরে আসে। অথচ ইতিহাস দেখিয়েছে যে বা যারা ভালো ভাবে ‘রেঁধেছে’ তাঁরা কেউই ভালো ভাবে ‘চুল’ বেঁধে উঠতে পারেননি। এবং এটি ছেলেদের ক্ষেত্রেও আংশিক সত্য। ভাস্কর মীরা মুখোপাধ্যার-এর একটি সাক্ষাৎকারে তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয় যে কেন তিনি বিয়ে ভাঙেন, কেন তিনি সংসার ভাঙেন। উত্তরে তিনি ঠিক কী বলেছিলেন আমার মনে নেই, কিন্তু যেটা বলেছিলেন তার সারমর্ম হল সংসার তিনি ছাড়তে চাননি, তাঁর ভাস্কর্য-প্রীতির জন্য সংসার তাঁকে ছেড়ে গিয়েছে। মেরি কুরি-পিয়ের কুরির দিকে যদি তাকানো হয় একই জিনিস দেখা যাবে। ছত্রে ছত্রে ছড়িয়ে আছে স্রোতের বিপরীতে হাঁটার লড়াই। রোজা লুক্সেমবার্গের ব্যক্তিগত চিঠিগুলোতে ছড়িয়ে আছে নানা রোমান্টিক আকাঙ্ক্ষা। একটি যৌথ ঘর, একটি সন্তান, তাকে নিয়ে সান্ধ্য-ভ্রমণ—এইসব আকাশ-কুসুম স্বপ্নে চিঠিগুলো রঙিন। বাস্তবে এসব কিছুই হয়নি। যারা, বিশেষ করে যেসব মহিলারা অন্যরকম ভেবেছেন এবং সেই লক্ষ্যে এগিয়ে গিয়েছেন দুর্মর গতিতে তাঁদের জীবনে ‘যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে’ জাতীয় কোনো ব্যালেন্স প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এই ব্যালেন্স প্রতিষ্ঠা করার কোনো সময়ই তাঁরা পাননি। তাঁদের চরিত্র তুলে ধরার সময় তাই যথাসম্ভব সত্যাশ্রয়ী হয়ে ওঠাটাই বাঞ্ছনীয়। না হলে তাদের বহিরাঙ্গের ও অন্তরঙ্গের লড়াই উঠে আসবে না।
অবলা বসু ডাক্তারি পাস করেছিলেন নাকি? আমি তো জানতাম করেন নি। কাদম্বিনীর গুছিয়ে সংসার করার খ্যাতি ছিল বলেই তো শুনেছিলাম। তিনি ঘোড়ার গাড়িতে কুরুশ বুনতে বুনতে যেতেন। গুছিয়ে ভাঁড়ার বার করে দিতেন। ওঁর কন্যা জ্যোতির্ময়ীর স্মৃতিচারণে পড়েছি। এবং এঁরা সেই যুগের সুত্রপাত করেছিলেন যার থেকে পরে 'ডাবল বার্ডেন' এর ধারণার শুরু হবে। আমার তো মনে হয় কাদম্বিনী ‘যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে’ প্রথাকেই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। উল্টোটা নয়।
@হুচি কাদম্বিনী কে নিয়ে কুমুদি লিখেছিলেন । আর হ্যাঁ রাঁধা, চুল বাঁধা কিছু নিয়েই চাপ নিতে নেই। একটাই জীবন। নিজের মত থাক। লেখাটা সুন্দর সেটা আগের বার বলা হয় নি। এইবার বললাম।
রাঁধা ও চুল বাঁধার যৌথ চাপ নিতে গিয়ে অনেক মেয়ে হারিয়ে যায়। ভাল রাঁধতে না পারলে,চুল বাঁধতে না পারলে গার্হস্থ হিংসা ধেয়ে আসে। নারীমুক্তি নিয়ে অনেক আন্দোলনেও বিশেষ ফললাভ হয় না। সাধারণ নির্যাতিতার মতো নেত্রীরাও বলি হন। কাদম্বরী দেবীর সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে।
কাদম্বরী, কাদম্বিনী নয় কিন্তু।
লেখার মূল বক্তব্যের সাথে একমত। ঘরে বাইরে সব কাজ সমানভাবে সমান দক্ষতায় সামলাতে পারেন আজকের নারী, এই জাতীয় গ্যাস খাওয়ানো কথায় ভুলে নিজেকে দশভূজা দুর্গা প্রমাণ করতে গিয়ে যেটা অনেক সময়ই হারিয়ে যায় জীবন থেকে সেটা হল নিজের ভাল লাগা, ভালবাসার জায়গাগুলোকে লালন করা, নিজেকে সময় দেওয়া, নিজেকে ভাল রাখা! কত মেয়েদের যে নিজের শারীরিক মানসিক যত্ন নেবার সময় হয় না এই চক্করে