আমার জীবনে কোনো উৎসব নেই।
বিয়েটাও মৌলালিতে রেজেষ্ট্রি করেছিলাম। 'বেজাতে' বিয়ে বলে নিজ মহল্লায় দামামা বেজেছিল। পাত্র ডাক্তার এই কথাটা কর্পূর হয়ে 'হিন্দু ছেলে' এটাই প্রচার হয়েছিল। তো, এই কালী পুজো নিয়ে আমার এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা। কালীমা আমার প্রতিদিনের। ছাত্রজীবন থেকে কলেজ টানা সময় জুড়ে আমায় 'মা কালী' বলে পথে ঘাটে ডেকে দিত কেউ। অবশ্যই পুরুষকণ্ঠ। কখনো পেছন ফিরে দেখিনি। দেখতে নেই এটাই ছিল পারিবারিক ও সামাজিক শিক্ষা। তখন অবশ্য আমি খুব ভয় পেতাম এই ডাকে। লজ্জা হত খুব। কী এমন আছে এই চেহারায়? নিজের মাও মাঝে মাঝে কেঁদে ফেলতেন, আমার পেটের মেয়ে এমন কালো কীকরে?বুঝতাম না এই সমাজে মেয়েদের কেন কালোরঙ হওয়া বারণ ? কেন এত নেগেটিভ? তারপর মাথায় সিঁদুর চড়ানোর পর আমায় কেউ কোনদিন 'মা কালী' বলে ডাকেনি। সিঁদুর ছাড়ার পরও। জানিনা, বিবাহিত মেয়েদের বুঝি সব মাফ। ধীরে ধীরে নিজের গায়ের রং ও চেহারার সঙ্গে কম্ফর্টেবল হয়ে গেলাম। নিজেকেই ভালবেসে ফেললাম।
বিয়ের আগেই জানতাম আমার স্বামী কালীভক্ত। বিয়ে রেজেষ্ট্রির আগের দিনই সে নিয়ে যায় আমায় দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ি পুজো দিতে। সেখানেই লাইনে দাঁড়িয়ে সে জানায় আমার কাছে তার একটিই দাবি। মন্দিরে তার পাশে দাঁড়িয়ে পুজো দিতে হবে ও প্রসাদ খেতে হবে। তার এই ভক্তি একইভাবে সন্তানের মধ্যে জন্ম নিল । প্রতিদিনই ড্রাইভার অভিযোগ করত মেয়ে স্কুলের পথে যেখানেই মন্দির দেখছে গাড়ীর কাচ নামাতে বলছে। নেমে পড়ে প্রণাম করছে। এরপর আমার নিজের বাড়িতে মেয়ের পছন্দের কালী মায়ের ওয়াল হ্যাঙ্গিং লাগানো হল। তার নিজের পূজা করার জায়গা ক'রে দেওয়া হল। আনা হল লাল কাপড়,ঘণ্টা,কর্পূর, সিদুর,গঙ্গাজল,ধূপকাঠি। কাছের মন্দিরের পুরোহিতের কাছে গিয়ে লিখে আনা হল মন্ত্র। আমার মা এখানেই কখনো কখনো কোরান পাঠ করতেন, নামাজ পড়তেন। আমার বাবা কালীপুজোর জন্য চারটে করে জবাফুল এনে দিতেন বাজার থেকে প্রতিদিন।
প্রতিবছর কালীপুজোর দিনে আমার মেয়ে উপোস করে পুজো দিতে যায় বিষ্ণুপুর কালীবাড়ি। মা জানতেন, আগের দিনের রাত বারোটার আগে থেকে । সকালেই কুককে জানিয়ে দেওয়া হত যে মেয়ের জন্য খাবার বানাতে হবে না। প্রতিবার আমি তার সঙ্গে যাই পুজো দিতে। অসম্ভব ভিড় ঠেলে পূজার থালি সংগ্রহ করে ভেতরে যাওয়া। আমি ঠিক জানিনা কোনটা আমাদের নেওয়া উচিত। ১৫১ টাকার থালি, যেটার স্রেফ দাম বেশি তাই সেটাই উপযুক্ত ভেবে হয়ত মেয়ে পছন্দ করত। আমি তার কথামত সেটাই নিতাম। মন্দিরের ভেতরে গিয়ে সেখানে নিজের নাম বলার পরই পুজো দেওয়া শুরু। মেয়ে সেখানে বসার পর বার বার পেছন ফিরে আমায় খুঁজত। তাই আমি নিজে সবার সঙ্গে পুজোয় বসে পড়তাম। পরে দেখতাম আমার অকারণ জায়গা দখলের জন্য অনেক ভক্তদের দরজার বাইরে দাঁড়াতে হচ্ছে। শেষে আমি সরে যেতাম। আমি তো ঠিক ভক্ত নই। ভক্তদের সম্মান করি। একজন সাধারণ মানুষ। আমি কোনও নিয়ম জানিনা, হয়ত সেও জানেনা। তবে সবাই যা করতো দেখে দেখে মেয়েও শিখে গিয়েছিল । পুজো শেষে মাথায় লাল রঙের তিলক কেটে দিতেন ঠাকুরমশাই । আমি দেখতাম এক অদ্ভুত পরিবেশ। ধূপের গন্ধ,মোমাবাতির আলো আর ঘণ্টার শব্দে আমি কিছুক্ষণের জন্য আমার নিজের মধ্যে থেকে চলে যেতাম অন্য কোথাও। আরাধনার সত্যি কোনো ভাষা হয় না।
আমি অবাক হয়ে দেখতাম, মেয়ে প্রার্থনার সঙ্গে সঙ্গে তার চোখ আমার থেকে লুকোতে থাকে। হয়ত ভক্তির একটা পর্যায় এটা। তখন আরাধনার সাথে কান্নাও আসে। কিজানি, দূরে দাঁড়িয়ে থেকে আমার তখন সবকিছু কেমন জানি খুব ফাঁকা লাগত। মনে হত আমায় ধরার মত যদি এমন কেউ এই ত্রিভুবনে থাকত ! সন্ধ্যেবেলায় পুজো দিয়ে ফেরার পথে মেয়ের কপালের লাল তিলক আমার চোখে বার বার আটকে যেত। আমি ঈশ্বরে বিশ্বাসী নই। কিন্তু মেয়ের কারণে কোথাও যেন কয়েক্মুহূর্তের মধ্যে অন্য এক জগত ঘুরে ফিরতাম। পথে সে আবার মিষ্টি,ফল কিনে নিত । রাত্রিবেলায় একটা নিদির্ষ্ট সময়ে আবার পুজো করত। স্রেফ মিষ্টির লোভে আমিও অপেক্ষা করতাম। মেয়ে বলত মায়ের প্রসাদ। আমি আর মা বলতাম খুব ভাল মিষ্টি খেলাম। কিন্তু আমার মাকে লক্ষ্য করতাম আমাদের বাড়ির ল্যব্রাডর জোজো অন্যান্য খাবারের মত প্রসাদের জন্য লাফালে মা তাকে কিছুতেই দিত না। মেয়েকেও খুব ভালো করে নিষেধ করতেন মায়ের প্রসাদে যেন জোজো মুখ না দেয়। আমার মায়ের এই ভাবনাকে স্যালুট করতে ইচ্ছা হত। মানুষ তো এইজন্যই মহান।
ধর্মের যাবতীয় আচার,নিয়মকানুন নিয়ে যারা পাকামি করে, ফতোয়া দেয় তাদের আমার ওই তুবড়িবাজির মত ওড়াতে ইচ্ছে হয়। এই ধর্মের কারণেই আমি আমার পছন্দের জায়গায় ফ্ল্যাট পাইনি,শ্বশুরবাড়ি কখনো দেখা হয়নি আমার, কিন্তু আমার কোথাও কোনো খেদ নেই। সকলকেই ক্ষমা করতে ইচ্ছা করেছে। কারণ ধর্মের শেষ কথা দেখেছি নিজের বাড়িতে। এখানেই মন্দির,এখানেই মসজিদ,এখানেই সব। শুধু মানিয়ে আর মেনে নেওয়ার সমস্যা। সেটা একান্তই আমাদের। বাড়ি এক ঘর জুড়ে মাকালী,গণেশের ছবি। মেয়ের ঠাকুরঘর সবার কাছেই খুব পবিত্র জায়গা। কতবার মেয়ের সাথে আমারও দুই হাত প্রণামের মত করেই মাথায় ঠেকেছে। ঝেড়ে আনতে হয়েছে লাল শালু। কখনো মনে হয়নি আমি কিছু হারালাম। বরং পেয়েছি অনেক । ভক্তির এক অসাধারণ পাঠ নিজের চোখের সামনে দিনে দিনে উপলব্ধি করেছি। মন ভরে গেছে সাধনার মহিমায়। শিখেছি প্রতি মুহূর্তে। জয় মা কালী বলার পরও আমি সেই মানুষ ছিলাম, যা আছি বা যা থাকবো। এ নিয়ে আমার মনে কোথাও এককণা দ্বিধা নেই। বিশ্বাসকে সম্মান করা মানুষের ধর্ম। আমি তা মাথা নত করে পালন করি।
নাহ, কোথাও কারো কাছে আমার এ কথা বলতে লজ্জা হয় না।