অদিতি হালকা গুণগুণ করতে করতে কাজ করছিল। আজ ফ্রীজে জায়গা হচ্ছে না। প্রবাল আর বুবকা দুজনেই না খেয়ে উঠে গেল। কোনো মানে হয় না। আলোচনা যখন হচ্ছিল, তখন এত উত্তেজিত হওয়ার কি মানে হয়? মাঝখান থেকে এখন সব খাবার গুছিয়ে তোলা!
বুবকা বাড়ি ফিরে যেমন ঘরে ঢুকে যায় তেমনই গেছিল। আর প্রবাল বসে বসে হোয়্যাটস্যাপ দেখছিল। রান্নাঘরে কাজ করতে করতে টুকটাক কথা বলছিল অদিতি আর প্রবাল। সারাদিন ফরোয়ার্ড হয়ে আসা গুচ্ছ ঠাট্টা তামাশা শুনিয়েই যাচ্ছিল প্রবাল। অফিসে অতসীর সামনে একদিন সবাই মিলে এরকম জোক পড়ে শুনিয়ে প্রবাল আর ওর বন্ধুরা বাজে চাপে পড়েছিল। অতসী অ্যাকাউন্টস অফিসারকে নালিশ করে যে এই অফিসের পরিবেশে সে স্বচ্ছন্দ বোধ করছে না। তারপর একটু অশান্তি হয় আর প্রবালরা নিজেরাই এসব জোক টোক ব্ন্ধ করে দেয়। সব মধ্যবিত্ত মানুষজন, কে আর অশান্তি চায়। তাই দিনের শেষে আপাততঃ অদিতির সাথে বসে বসে ফরোয়ার্ড পড়ে। অদিতি আধখানা শোনে, বাকিটা শোনার ভান করে। দিন শেষে তার তর্ক ভাল্লাগে না। নইলে প্রতি দু-নম্বর জোকে তার বিবমিষা জাগে। আজও এ রুটিনের ব্যতিক্রম হয়নি।
বুবকা বাইরে এল একটু উত্তেজিত হয়ে। ফোনে কথা বলতে বলতে বাইরের বারান্দায় চলে গেল। দু একটা শব্দ কানে যেতে অদিতির ভুরু কুঁচকে গেলেও কিছু বলেনি ও। একটু পরে এসে বাপ ব্যাটায় টিভি চালালো। তখনো সব স্বাভাবিক। অদিতি সে হিসেবেই এতোগুলো রুটি করেছিল। নাহ, কি যে হল তারপর।
খাবার টেবিলে এসে বসে দুজনে কথা বলছিল। মনে হল বেশ গুরুগম্ভীর কিছু । সে জানতে চাওয়ায় প্রবালই বলল, "আরে , দেখছো না, কি এক আমিও না তুমিও আন্দোলন হচ্ছে। যে যেখানে আছে, সবাই নাকি অত্যাচারিত। কোনো না কোনো একদিন। তাই বুবকাকে বলছিলাম, বাবা সামলে চোলো। তোমাদের তো মেয়ে বন্ধুর শেষ নেই। কবে কোন মেয়ে ট্প করতে পারবে না, অমনি বলবে সুযোগ নিয়েছো। ব্যস গেল তোমার কেরিয়ার। আজকাল প্রেম ভলোবাসাও হবে না এরপর। বুঝলে। হয়ত কেউ জানতে চাইল, বিয়ে করবে কিনা। হয়ে যাবে হাতে হ্যারিকেন।"
বুবকা হাসিমুখে প্লেট টানতে টানতে বলল, "হ্যাঁ বাবা, আমরাও বলছিলাম। এই দ্যাখো শ্বেতা সব ক্লাসটেস্টে হায়েস্ট পাচ্ছে। পিবি র ক্লাসে ফ্রন্ট বেন্চ। সুবিধে কি নিচ্ছে না। এরপর উনিশ বিশ হলে পিবি গেলেন।এই আমিও আর তুমিও করে করে ভাল ছেলেগুলোও চাপে। আমি বলে দিয়েছি, ফেস্টে এ একসাথে ব্যান্ডে আমি নেই। কোথায় কি বলে ফেলবো, তারপর অবসীন বলে আমার ছবিতে মালা।"
এই অবধিও সব ঠিকঠাক।
প্লেটে রুটি দিয়ে চেয়ার টেনে বসতে বসতে অদিতি বলল, "সত্যি কথা! এরকম হবে আমি ভাবিনি, কি করে করছে বলো তো মেয়েগুলো ? এরকম তো আকছারই হয়ে এসেছে। এত বাড়াবাড়ির সাহস পাচ্ছে কি করে এরা?" "এটাই তো ! দ্যাখো, কাউকে ভাল লাগলে তো আমরাও অ্যাপ্রিশিয়েট করি টরি। তোমাকে বলে না কেউ? বৌদি কি দারুণ লাগছেন। ছেলেপুলে একটু আধটু কবে ফ্লার্ট করেছে, তাতেও তুমিও তুমিও করে লাফাচ্ছে।" প্রবাল একটা চামচ তুলে নেয়।
"হ্যাঁ। আমিও এটাই ভাবছিলাম জানো। " অদিতি মুখ খোলে। " তোমার শিপ্রাকে মনে আছে? সেই যে আমার মণিপিসির মেয়ে। ঝুনুর বিয়েতে তোমরা দেখেছিলে। অনেক বছর আগে। ভোলোনি হয়ত। অমন চটকদার চেহারা আমাদের কারো ছিল না। বিয়ের দিন , তুমি আর জামাইবাবু খুব অ্যাপ্রিশিয়েট করেছিলে ওকে। চওড়া পিঠের ব্লাউজ পরেছিল আর টপনট। ঘন্টাখানেক পরে দেখলাম চুল খুলে পিঠে ছড়ানো। তোমাদের টানা অ্যাপ্রিশিয়েশানে বেচারির একটু সমস্যাই হয়েছিল। কেঁদে অস্থির হয়ে গেছিল। ছেলেমানুষ তো, মানে লেগে্ছিল ওর। কিন্তু দ্যাখো , কেউ কিছু জানতে পেরেছে? পিসি বলল, উঠতি বয়সের ছেলেদের অমন হয়। হৈচৈ করতে না। ব্যপারটা থেমে গেল। আজ হলে হয়্ত কি বাড়াবাড়িই না হত!"
অদিতি মুখ তুলে দেখল, প্রবালের মুখ থমথম করছে। বুবকা তাকিয়ে তার দিকে।
অদিতি আবার বলে যায়, "তবে হ্যাঁ, তুমি বুবকা কে ডাক দিয়ে ভাল করেছো। সেদিন দেখলাম বাড়িতে এসে তোমার ছেলেকে সেমেস্টারের পড়ায় হেল্প করছে শ্বেতা। কি সুন্দর করে বোঝাচ্ছিল। সাবজেক্টে কি দখল। পরীক্ষার আগে নিজের পড়া ছেড়ে এসে সে তার বন্ধুকে হেল্প করল। এদিকে তোমার পুত্র মনে করছে যে সেই মেয়েটা সুযোগ নেয়। এভাবেই কোনোদিন বাইরেও বলে আসবে। তাতে শ্বেতা খারাপ পেলে, রুখে দাঁড়ালে তখন আবার তোমাদেরই তো খারাপ লাগবে।"
হতভম্ব বুবকার দিকে তাকিয়ে অদিতি আবার জানতে চায়, "হ্যাঁ রে, স্মিতা কদিন আসছে না কেন?মিস্টি মেয়েটা। "
বুবকা কেমন খিঁচিয়ে ওঠে, "আমি কি করে জানব? আমি জানি না।"
গম্ভীর প্রবালের দিকে তকিয়ে অদিতি আবার বলে ," সব কিছুতে তো সবাই ইগোনোর করে না। এই যে পরশু স্মিতা ঘর থেকে চোখ মুছে বেরিয়ে গেল, আমি দেখলাম। ছোটো একটা মেয়ে তার পছন্দের মানুষের সাথে দেখা করে অপমানিত হয়ে ফিরে গেল দেখলাম। তোমার ছেলে কি ভাবছে জানি না, কিন্তু তুমি যে বাবা হয়ে ভাবছো , ওকে বারণ করছো, ঠিক ভাবে চলতে শেখাচ্ছো আমি এতেই খুশি।"
অদিতি থামে।আর দেখে বাড়ির দুই পুরুষমানুষ খাবার থালা ফেলে উঠে দাঁড়াচ্ছে, জানাচ্ছে যে তারা আজ খাবে না। হঠাৎই তাদের ক্ষিধে নেই হয়ে গেছে। অবাক অদিতি কে টেবিলে রেখে তারা ঘরে ঢুকে যায়।
তখন থেকেই অদিতি বোঝার চেষ্টা করে যাচ্ছে ,সমস্যাটা ঠিক কি হল! সে তো না জানা কিছু বলে নি।