মালতীর ছোটবেলায় একটি পাড়াতুতো দিদি ছিল। ফিজিক্সে মাস্টার্স ডিগ্রি হোল্ডার, অসম্ভব সুন্দরী আর পারসোনালিটি-ওলা চেহারা – যখন শিরদাঁড়া টান টান করে সোজা হয়ে বসে ছাড়া গলায় গান ধরত, লক্ষ্মী যখন আসবে তখন কোথায় তাঁরে দিবি রে ঠাঁই, নেহাত বেরসিকেরও মনে হত সত্যিই বোধহয় মা লক্ষ্মী, মা সরস্বতী এক অঙ্গে নেমে এসেছেন। তার একদিন বিয়ে হল। অষ্টমঙ্গলায় বাপের বাড়ি এল এক মাথা সিঁদুর নিয়ে। পাড়ার অন্য মেয়েরা খুব হাসাহসি করল। ওর শ্বশুরবাড়ির নাকি নিয়ম ফুলশয্যার রাতে বরের পা ধুইয়ে মাথার চুল দিয়ে মুছিয়ে দিতে হয়। ছোট ছোট করে কাটা চুল নিয়ে পরম ব্যক্তিত্বশালিনী দিদিটিকে নাকি খুব নাস্তানাবুদ হতে হয়েছে তখন। বেশ হয়েছে, যেমন ফ্যাশন করে ছোট করে চুল ছাঁটা! মালতীরই শুধু ভারী অবাক লেগেছিল! মাথার চুল দিয়ে পা মুছিয়ে দিতে হবে কেন? ওদের বাড়ীতে গামছা- তোয়ালে কিচ্ছু নেই?
এতো সবে শুরু। কিছুদিন পরে মালতীর বাড়ীতে এক তুতো দিদির বিয়ে। বিয়ে বাড়ীর লাখো কথা, হট্টগোল, খাওয়া-দাওয়া, আত্মীয়-কুটুম সে এক এলাহি ব্যাপার! কিন্তু সব ছেড়ে মালতীর চোখ পড়ল দুটো জিনিসে। প্রথমতঃ বিয়ের সব দায়িত্ব দিদির বাবা-মা’র অথচ বিয়ের কার্ডটি বাড়ীর এক অনুপস্থিত দাদুর ( বাবার জ্যাঠামশায়ের ) নামে। আশ্চর্য এই কারণে যে যৌথ পরিবার হলেও নাহয় কথা ছিল – কিন্তু সেসবের পাট চুকেছে বহুদিন আগে। এখন সব যার যার নিজের সংসার। তাই দিদির রোজকার খাওয়া-ঘুম-পড়াশোনার দুনিয়ায় তিনি কোথায়? অথচ এটাই নাকি নিয়ম! আর সেই প্রসঙ্গে শোনা গেল, দিদিকে সম্প্রদান করবেন দিদিরই আরেক প্রবাসী জ্যেঠু। এ তো আরও বড় অনুপপত্তি! একটা অত বড় ধেড়ে মেয়ে, আইনতঃ সাবালিকা, পাঁচ-ছয় বছর ধরে প্রেম করে তারপর বিয়ে করছে, আর আবার সম্প্রদান কি? এ তো আদতে গন্ধর্ব বিবাহ, মানে এসব অনুষ্ঠান-টনুষ্ঠানেরই কোন মানে হয় না! তা তোমাদের যদি পয়সা বেশী হয়ে থাকে, লোক খাওয়াতে ইচ্ছে করে সে খাওয়াও, কিন্তু সম্প্রদান আবার কি? আর যাঁর সঙ্গে পাঁচ-ছ বছর পরপর একবার দেখা হয় কিনা সন্দেহ, তিনি কেন সম্প্রদান করবেন? এক যদি ধরো, ছোটবেলা থেকে খাইয়ে-পড়িয়ে আদর দিয়ে বাঁদর করে তোলার দৌলতে কারোর সম্প্রদান করার কিছু মাত্র অধিকার জন্মে থাকে, সে তো বাবা-মায়ের। এর মধ্যে এসব থার্ডপার্টি সিঙ্গুলার-নাম্বার আসে কোত্থেকে? ... শোনা গেল এও নাকি নিয়ম! বাড়ীর অর্থাৎ পিতৃবংশের সব থেকে বড় যিনি তিনি নাকি সম্প্রদান করবেন! এতো কথাতেও দমে না গিয়ে মালতী সোজা পুরোহিতকে ধরেছিল, সম্প্রদান কেন হবে? পুরোহিত এক উচ্চাঙ্গের হাসি হেসে বলেছিলেন, সম্প্রদান ছাড়া বিয়া হয় না, এইটাই zানো না , বো-কা মাইয়া!
বাড়ীতে অনেকগুলো এমন এমন সব বিয়ে দেখে বোকা মালতীও ভারী অভিজ্ঞ হয়ে উঠেছিল। নিজের বেলায় এ ঘাটে মাথা মুড়োন’র ইচ্ছে ছিল না মোটেই। ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময়, বইএর বোঝায় কাঁধ বেঁকে যাওয়া ঘাড় নিয়ে ল্যাগবেগিয়ে রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে প্রেমিকপ্রবরকে বলত, “আমরা কিন্তু শুধু রেজিস্ট্রি করে বিয়ে করব বুঝলি! শুধু গোটা কয়েক বন্ধু ডেকে নিয়ে রেজিস্ট্রারের কাছে চলে যাব। ব্যস বিয়ে করে ফেলব। যে পয়সাটা বাঁচবে, তাই দিয়ে মজাসে বই কেনা যাবে।“ কিন্তু ওই যে, woman proposes, man disposes। বিধাতাপুরুষ সবার অলক্ষ্যে এমন এক কিস্তিমাতের চাল চাললেন যে মালতী সব প্ল্যান ভেস্তে গেল – সামাজিক ভাবে বিয়ে করাটা নেহাতই বাধ্যতামুলক রকমের দরকার হয়ে পড়ল। অগত্যা। নতুন চাকরীতে ঢুকে একটা বিশাল বই-এর লিস্টি তৈরি হয়েছিল। শেষবারের মত সেটা দেখে নিয়ে বঙ্কিম রচনাবলীর পাতার ফাঁকে ঢুকিয়ে আলমারিতে চাবি দিয়ে দিল। যা সব খরচের বহর – এ লিস্টি আগামী অনেক বছরে আর বার করা যাবে না। হ্যাঁ, বাপের পয়সায় বিয়ে করা যাবে না – এদিকে পকেটের চেহারা দেখলে মেঠো ইঁদুরও দুটো ধান ফেলে যায়। তাই ডিল হল, হিজ হিজ, হুজ হুজ। মালতীর শাড়ী-গয়না, বন্ধুবান্ধবের দায় মালতীর আর বাবা-মার যা ইচ্ছে, তার খরচ বাবা-মার। বেগতিক দেখে সেটাই বাড়ির লোক মেনে নিল।
এবার মাঠে নামল হবু শ্বশুরবাড়ীর লোকজন। হবু শাশুড়ী খবর পাঠালেন, বর-কনের গোত্র এক – তাই মেয়েকে আগে একবার গাছের সঙ্গে বিয়ে দিতে হবে। মালতী পড়ল মহা সমস্যায় – কি করে জানা যাবে গাছের গোত্র কি? এঁরা কি তবে গাছের ভাষা বুঝতে পারে? বাপরে কি ইনটেলিজেন্ট শ্বশুরবাড়ী! কিন্তু পরের সমস্যাটা আরো মারাত্মক! গাছকে বিয়ে করে তারপর তাকে ডিভোর্স না করে তো আর আরেকটা বিয়ে করা যায় না। এক সঙ্গে দুটো বর, বাপরে! তাই গভীর রাতে ফোন করে বলে দিল, বিয়েটা হবে- কিন্তু তোকে যে কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে – এ যাত্রায় গাছের সঙ্গে বিয়ে হোক, তারপর কিছুদিন সংসার না করে কি আর বলা যায় ডিভোর্সের কথা! আর বলা যায় না, অবশ্য গাছকেই যদি ভালো লেগে যায় তাহলে তো আবার অন্য কথা! বেগতিক দেখে ফোনধারী বেচারী তাড়াতাড়ি নিজ দায়িত্বে বলে দিল, আরে না না গাছ এলো কোথা থেকে এর মধ্যে! দরকার হলে আমি চাট্টি ডালপালা মাথায় বেঁধে গাছ সেজে নেব।
ইতিমধ্যে মালতী জোর গলায় সবাইকে জানিয়ে দিয়েছে যে সালংকারা কন্যা সম্প্রদান করতে হয়, খুব ভালো কথা। এতকাল দাদা-দিদিদের বিয়েতে তো গয়নাগাঁটি পরেই সেজে-গুজে ঘুরে বেরিয়েছে, না হয় হলই ইমিটেশনের গয়না। তা বলে কি ফেলনা নাকি! নিজের বিয়ে বলে তার ব্যতিক্রম করা যায় না! তবে সব গয়নার গভীর পর্যালোচনা করে খুবই দুঃখের সঙ্গে ঠিক করা গেছে যে নেহাতই সাধের অক্সিডাইজড ঝুমকোগুলো বেনারসীর সঙ্গে ম্যাচ করবে না, তাই একটা অন্য গয়নার সেট পছন্দ করতে হয়েছে।
হ্যাঁ বেনারসী একটা কেনা হয়েছে। সেটাও ওই যে কারণে ধর্ম মেনে বিয়ে করতে বাধ্য হওয়া, সেই কারণে। দোকানে দাঁড়িয়ে মালতী একবার মিনমিন করে দোকানদারকে জিজ্ঞেস করতে চেষ্টা করেছিল যে বিদেশে যেমন টাক্সেডো ভাড়ায় মেলে, ওঁদের তেমন কোন বেনারসী ভাড়া দেওয়ার স্কীম আছে কিনা! নেহাতই বাড়ির লোকে ধাতানি দিয়ে চুপ করিয়ে দিল।
ব্যস বিয়ের শাড়ী-গয়না রেডী যখন, বিয়ে করে ফেললেই হয়! দিনক্ষণও মিলে গেছে। একটা ছোট্ট সমস্যা দেখা গেল। বিয়ের পুরোহিতকে নিয়ে! হবি তো হ, ছেলেটি মালতীর বাবার স্কুলের ছাত্র। “ও বাবা, এ তো নিউটনের ল ভুল লিখত!” বাবা কিছু বলার আগেই মা বলে ওঠেন, “নিউটনের ল দিয়ে তো আর তোমার বিয়ে দেবে না মা, ও মন্ত্র তন্ত্র ঠিক জানে , আমি দেখে নিয়েছি। ” এবার নিশ্চিন্ত হয় মালতী। মা সংস্কৃতের ছাত্রী। মা যদি বলে, তাহলে ঠিক হ্যায়।
যথাদিনে যথাক্ষণে মালতী সেজেগুজে রেডি। এদিকে বর বাবাজীও কোন রিস্ক না নিয়ে যথাসময়ের আগেই এসে হাজির। বিয়ে শুরু হয়ে গেল। শুভদৃষ্টি কমপ্লিট। এমনকি মায় মালতী বরের দিকে লাজুক লাজুক ভাবে তাকাচ্ছে তারও ছবি উঠে গেল চারদিক থেকে খচাৎ খচাৎ করে। এই বার বিয়ে করতে বসল। খানিক পরেই ভুল বুঝল নিজের। বিয়ে করতে বসল না। তাকে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বাবা যখন বরের হাঁটু ধরে কিসব বিড়বিড় করে বলছেন, আর বরও নির্বিকার মুখে বসে রয়েছে, তখন মালতীর অহং-এর এক একটা পাক খুলতে লাগল। তারপর মালতীদের দুজনকে মুখোমুখি বসিয়ে পুরোহিত কিসব দুর্বোধ্য বক্তব্য বলে যেতে থাকলেন। মালতী একবার ভাবল, সবাইকে গোল করতে মানা করবে – যাতে ফুল কনসেন্ট্রেশনে মন্ত্র শুনতে পারে। তখনই মনে পড়ল একবার লোন নেওয়ার জন্য লোনের ফর্ম খুঁটিয়ে পড়ছিল। তখন লোনের এজেন্টটি বলেছিল, ম্যাডাম এই ফর্ম পড়লে আর ঠান্ডা মাথায় সই করতে পারবেন না। তার থেকে না পড়েই সই করুন। আপনার মানসিক শান্তি বজায় থাকবে। কি জানি বিয়ের মন্ত্র শুনে ফেললে যদি আর বিয়ে করতে ইচ্ছে না করে! তাই মালতী মনে মনে ভারী ভক্তিভরে যত প্রেম পর্বের গান মনে আসে তাই মনে আওড়াতে লাগল।
এই বার সিঁদুরদান পর্ব। বর বাবাজী এতক্ষণ এদিক ওদিক চাইছিলেন আর হাই তুলছিলেন। এবার তিনি বেশ নড়ে চড়ে বসলেন। ভারী উৎসাহ নিয়ে তিন বার সিঁদুর পরিয়ে দিলেন। তারপর লজ্জাবস্ত্র দিয়ে ঢেকে দেওয়ার মুহুর্তে মালতীর নজরে পড়ল বরের মুখে যুদ্ধজয়ের হাসি। হাসিটা কোথায় যেন ঘা দিল! মনে পড়ল জন্ম থেকে শুনে আসতে থাকা যাবতীয় উপদেশাবলী!
…. মেয়েমানুষের জন্মই বিয়ের জন্য। (ঠাকুমা)
…. বলি পড়াশোনা তো শিখছ, রান্নাবান্না ঘরের কাজকর্ম কিছু শিখছ, নাকি পরে শ্বশুরবাড়ী থেকে বলবে বাপ-মায় কিছুই শেখায় নাই ? (ঠাকুর্দা)
….. পড়াশোনা করেছ ভালো কথা, কিন্তু তোমার চাকরী করার কি দরকার? তুমি চাকরী করলে আমার ছেলের দেখভাল কে করবে ? (হবু শাশুড়ী)
… জানো তো আজকাল আর কেউ হাউস-ওয়াইফ বলে না, এখন হাউস-ম্যানেজার বলে। (হবু শ্বশুরমশাই )
… মানিয়ে চলতে শেখ মা, বিয়ে হলে মানিয়ে চলতে লাগে। (দিদিমা)
শুধু একটা ভারী চেনা গলা সেখানে এতদিন অনুপস্থিত ছিল। আজকের হাসিটা কি সেই শূন্যস্থান পূরণ করে দিল?
মালতীর অহং এর শেষপাকটাও খুলে গেল। এরপর মালতী ভারী ফুর্তিতে সাতপাক ঘুরতে লাগল। এক এক পাক ঘোরে আর নিজের মনেই বিড়বিড় করে বলে এই পুড়ে গেল আমার মাধ্যমিকের মার্কশীট; ওঁ স্বাহাঃ এই পুড়ে গেল আমার সঙ্গীত প্রভাকর ডিগ্রি ওঁ স্বাহাঃ এই পুড়ে গেল আমার হায়ার সেকেন্ডারীর মার্কশীট, ওঁ স্বাহাঃ এই পুড়ে গেল আমার ছবির খাতাগুলো ওঁ স্বাহাঃ এই পুড়ে গেল আমার গ্র্যাজুয়েশনের সার্টিফিকেট ওঁ স্বাহাঃ এই পুড়ে গেল আমার মাস্টার্সের সার্টিফিকেট ওঁ স্বাহাঃ এই পুড়ে গেল আমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার ওঁ স্বাহাঃ । যজ্ঞের বেদীর থেকে খপ করে লাফিয়ে উঠে আগুন মালতীর সবটুকু আমিকে খপ করে গিলে নিল।
সেদিন গভীর রাতে বাসরঘরে সবাই ঘুমিয়ে পড়ার পরে মালতী চুপি চুপি বরবাবাজীকে খুঁচিয়ে ঘুম থেকে তুলে বলল, একটাকার কয়েন আছে? সে বেচারী অবাক হয়ে বলল, কেন? মালতী মধুর হেসে বলল, নিয়ম। জানিস না, বিয়ের রাতে বরের থেকে টাকা নিয়ে লক্ষ্মীর ঝাঁপিতে ফেলতে হয়। বর আর কথা না বাড়িয়ে অ্যাটাচি কেস খুলে পার্স বার করে একটা টাকা বার করে দিয়ে পাশ ফিরে নাক ডাকাতে শুরু করল। খানিক শ্যেন দৃষ্টিতে সে দিকে তাকিয়ে থেকে মালতী যখন নিশ্চিত হল যে তার কাছে এখন চরাচর লুপ্ত, তখন খাটের একটা কোণার চাদর হাত দিয়ে অনেকবার টান টান করে মালতী একটা এক্সপেরিমেন্টে ব্যস্ত হল, কাল সকালে যে ঘুম থেকে উঠবে সে আসলে কে? হেড হলে আজ রাতে নবজন্ম হওয়া, “ওয়াইফ অফ অমুক” মালতী আর টেল হলে এই সব কিছুকে ছাপিয়ে, কিছুতেই দাবিয়ে রাখতে না-পারা, বেড়ালের মত নটা প্রাণ-ওলা, আদি ও অকৃত্রিম মানবী মালতী। অনেকবার ঝঁকিয়ে টাকিয়ে টাকাটাকে আকাশে ছুঁড়ে দিয়ে প্রবল উৎকণ্ঠায় তার দিকে তাকিয়ে রইল মালতী।
গরাদের বাইরের আধ- খাওয়া চাঁদটাও হুমড়ি খেয়ে পড়ল টাকাটা দেখতে।