কলকাতা টেলিফোন ভবন। ডালহৌসি স্কোয়ার, যাকে এখন বিবাদী বাগ বলা হয় সেইখানে লালদীঘির পাড়ে সুউচ্চ অট্টালিকা। তার সাত তলায় ট্রাঙ্ক এক্সচেঞ্জ। যে সময়ের কথা বলছি তখন কলকাতা থেকে দুবরাজপুর কথা বলতে হলেও ট্রাঙ্ক কল বুক করে অপেক্ষা করতে হত কখন টিলিফোনের ঘন্টি বাজবে। আবার কানেকশন লাগলেও শান্তি ছিল না, কেন না যান্ত্রিক গোলযোগে প্রায়ই লাইন কেটে যেত। সেইসব দূরবর্তী ফোন ও মনের কানেকশন জোড়ার কাজ যারা দিনে রাতে ২৪ ঘন্টা করতেন তাঁদের পোষাকি নাম ছিল টেলিফোন অপারেটরস। কোনো এক অজ্ঞাতকারণবশত: তাঁরা সবাই ছিলেন মহিলা। যার মধ্যে আমার মা ছিলেন একজন। তাই সেইসব অপারেটররা সবাই ছিলেন আমার অমুক মাসি, তমুক মাসি। সংখ্যায় প্রায় তিনশো ছুঁই ছুঁই। অজস্র নাম আর তাঁদের জীবনের অজস্র গল্প। হাসি-কান্না-লড়াই। জয়ের গল্প। হারেরও। সেই সব গল্পই মায়ের মুখে শোনা। মায়ের তেত্তিরিশ বছরের চাকরি জীবনে, অর্থাৎ বিংশ শতকের শেষ তৃতীয়াংশে টেলিফোন ভবনের ট্রাঙ্ক এক্সচেঞ্জে কাজ করা মানুষীদের জীবনের সেই সব সিনেমাকে হার মানানো টুকরো-টাকরা সত্যি গল্প নিয়ে এই সিরিজঃ "এক ট্রাঙ্ক গল্প"। পাত্রপাত্রীদের নাম পরিবর্তিত।
*************
এক ট্রাঙ্ক গল্প (১)
সাদা শাড়ীর আঁচলটা মাথার ওপর আরেকবার টেনে নিয়ে ধীরে ধীরে কাঠগড়ায় উঠলেন অনুভা। এই শেষ বয়সে এসে কাছারী-আদালত করতে হবে ভাবেন নি। মিত্রবাড়ীর বউ তিনি। কখনো বিশেষ দরকার না পড়লে বাড়ির বাইরে বের হন নি, আপিস-আদালত তো দূরস্থান। গীতার ওপর হাত রেখে শপথবাক্য পড়তে পড়তে একবার ঘরের ভেতর চোখ বোলালেন। একদিকে বসে রয়েছে তাঁর বৌমা, জয়া। রোগা পাতলা, কালো চেহারা। মুখে এককালে হয়তো শ্রী ছিল, এখন ক্লান্তির প্রলেপ। তার আঁচল ধরে পাশে দাঁড়িয়ে নাতনি রুমকি। অন্যদিকে বসে ছেলে তপন। গাঁট্টাগোট্টা চেহারা। যেমন লম্বা, তেমন চওড়া। টকটক করছে গায়ের রঙ। দেখলেই বোঝা যায় বড় বংশের ছেলে। কি যে দেখেছিল মেয়েটার মধ্যে, কে জানে। চাকরি করতে গিয়ে আলাপ। দুজনেরই আপিস ডালহৌসি পাড়ায়। মেয়েটা কাজ করত টেলিফোন ভবনে, তাঁর ছেলে জিপিও তে। রাস্তার বেঞ্চিতে বসে চা খেতে খেতে প্রেম। অনেক বুঝিয়েছিলেন অনুভা। কিন্তু কে শোনে কার কথা। শুনেছেন, মেয়ের মায়েরও না কি এই বিয়েতে আপত্তি ছিল। মেয়েকে বুঝিয়েছিলেন তিনিও। বামন হয়ে চাঁদে হাত দিতে নেই। কিন্তু ওই বয়সে আর কে শোনে বাবা মায়েদের বারণ? দুই বাড়ির অমতে রেজিস্ট্রী করে বিয়ে করেছিল তপন আর জয়া। তারপর আর আপত্তি করেন নি অনুভা। কথায় বলে, জন্ম, মৃত্যু আর বিবাহ না কি মানুষের হাতে নেই। কে জানে, হয়তো বা।
-মহামান্য আদালতকে বলুন অনুভাদেবী, জয়াদেবী প্রায়ই তপনবাবুকে মারধোর করতেন, কথাটা সত্যি?
গত কয়েকমাস ধরে তপন পইপই করে বুঝিয়ে চলেছে কি বলতে হবে। এই ডিভোর্সটা ওর চাইই চাই। নয়তো রীতাকে ও বিয়ে করতে পারছে না। গত এক বছর ধরে রীতার সঙ্গেই থাকছে তপন। ঢাকুরিয়াতে। প্রথমে ভেবেছিল ধমকে ধামকে জয়াকে ডিভোর্সে রাজী করানো যাবে। কিন্তু ওই ছোট্টখাট্টো মেয়েটা যে এত ঠ্যাঁঠা হবে কে জানত? খুব শান্ত স্বরে বলেছিল, "তুমি সারা জীবন ওর সঙ্গে থাকবে থাকো, কিন্তু তোমাকে আমি ডিভোর্স দেব না।"
উকিল আবার জানতে চাইলেন, "বলুন অনুভাদেবী, আদালত আপনার উত্তরের অপেক্ষা করছে।"
-ওই ফড়িঙের মত মেয়েটা ওই জোয়ান ছেলেটার গায়ে হাত দেবে? একবার তাকিয়ে দেখুন তো দুজনের দিকে।
অনুভা জানেন, গায়ে হাত তুলত তপনই। জয়া শুধু চিৎকার করত। তার বেশি কিছু করার ক্ষমতা ওর ছিল না। কিন্তু সে কথা এখানে বলা যাবে না। তাই বলে মিত্রবাড়ীর ছেলে বউয়ের হাতে মার খেত, একথাই বা বলেন কি করে? শুধু কি গায়ে হাত তোলা, তপন জয়াকে খুনের হুমকিও দিয়েছিল। বলেছিল, অফিসের রাস্তায় লোক দিয়ে তুলে রেপ করিয়ে দেবে। কিছু বলে নি জয়া। শুধু অফিস যাওয়ার রাস্তায় যে কটা থানা পড়ে সবকটাতে রিপোর্ট করে রেখেছিল। ধন্যি সাহস মেয়ের। মনে মনে জয়াকে তারিফই করেছিলেন।
-ঠিক করে বলুন। আপনার বৌমা কি আপনার ছেলের ওপর শারীরিক মানসিক অত্যাচার করত?
-আমার কোনও বউমা নেই।
-দেখুন, আমি বুঝতে পারছি আপনি অত্যন্ত ক্ষুব্ধ। সেটা যে কোনও মায়েরই হবে। কিন্তু আদালতের তো জানা দরকার আপনার ছেলের ওপর কি অত্যাচারটা হত।
-আমার কোনও ছেলে নেই।
-ওই যে ভদ্রলোক বসে আছেন, উনি কে হন আপনার? আর এই মহিলা?
-মেয়েটি আমার মেয়ে। পেটে ধরি নি যদিও। ধরলে খুশিই হতাম। অত পুন্যি হয়তো করি নি আগ জন্মে। আর ওইটা? ওটা কিছু না। একটা জানোয়ার পুষেছিলাম অনেক বছর। বছর খানেক হল এখন অন্যত্র গিয়ে ঘর বেঁধেছে।
ঝানু উকিল বুঝলেন, সাক্ষী হোস্টাইল হয়ে গেছেন। তাই জজের দিকে ফিরে বললেন, "ইওর অনার, সাক্ষী প্রাচীনপন্থী। তাঁর কাছে বিবাহের চেয়ে পবিত্র কিছু নেই। তাই তিনি যেন তেন প্রকারেণ একটা প্রেমহীন বিয়ে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন। তাঁর প্রাপ্তবয়স্ক ছেলের শূন্য জীবনে যে নতুন ভালোবাসা এসেছে, তা তিনি মেনে নিতে পারছেন না।"
অনুভা হাতজোড় করে জজের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললেন, "তাকিয়ে দেখুন স্যার ছেলেটি কেমন মাথা নীচু করে বসে আছে। সত্যিকারের প্রেম করলে কারোর অমন মাথা নীচু হয় বুঝি?"
*****
এক ট্রাঙ্ক গল্প (২)
"তখন তোমার একুশ বছর বোধহ্য়.. আমি তখন অষ্টাদশের ছোঁওয়ায়.."
অষ্টাদশী লজ্জায় কাঁপছে পঞ্চাশোর্ধ অঞ্জলিমাসির গলা। মাথাটা একটু হেলানো আর ঠোঁঠে একটা মৃদু হাসি। চোখ বুজে গাইছেন অঞ্জলি সাহা, সিনিয়র সুপারভাইসার। সুরের ছোঁওয়া ঘুরে ঘুরে খেলা করছে টেলিফোন ভবনের সাত তলার কমন রুমে। একদিকে চলছে সরস্বতীপুজোর খিচুড়ি খাওয়া, অন্যদিকে আল্পনা কম্পিটিশন, আর তার মাঝখানে গোল হয়ে বসে ট্রাঙ্ক এক্সচেঞ্জের গানের আসর। আমি মায়ের পাশ দিয়ে বসে অবাক হয়ে শুনছি এঁদের গান। আটপৌরে এইসব মানুষগুলো সুরের ছোঁওয়ায় কেমন যেন বদলে যাচ্ছে প্রতি মুহূর্তে।
অঞ্জলিমাসির গান শেষ হতেই ঘরের মধ্যে কয়েক সেকেন্ডের নীরবতা আর তারপর অনেকগুলো গলা একসাথে কলকল করে উঠল। "অঞ্জলিদি, তুমি এখনও কি সুন্দর গাও গো", "আমাদের অঞ্জলির গলা আরতিকেও হার মানায়", "ইশশ্, ছেড়ে দিলে", "তুমি তো রেডিওতে গাইতে না?"
অঞ্জলিমাসি একটু হাসল। তারপর বলল, "জানিসই তো। বিয়ের পর শ্বশুর, শাশুড়ি, দেওর, ননদ এইসব সামলিয়ে কি আর গান হয়। নেহাৎ আমার কত্তাটি চাকরি ছাড়তে দেন নি, তাই এটা চলছে।"
-"রেওয়াজ করার সময় পেতে না, তাই না?"
-"শুধু কি রেওয়াজ? গান শুনতে হয়, বুঝতে হয়, ভাবতে হয়। সবথেকে বড় কথা, ভালবাসতে হয়। সংসারে থেকে তার গন্ডীর বাইরে অন্য কোনও ভালবাসাকে বাঁচিয়ে রাখা খুব মুশকিল।"
-"গান ছাড়তে কষ্ট হয় নি?"
-"তা না হলে সংসার ছাড়তে হত। তাতে বেশি কষ্ট হত। সবাই কি আর মালবিকা হতে পারে?"
অঞ্জলিমাসির গলায় কি একটু ঈর্ষা খেলা করে গেল? কে জানে। কিন্তু সবার নজর ঘুরে গেল মালবিকার দিকে। আমিও তাকিয়ে দেখলাম। এই মাসিটা নতুন। আগে দেখি নি। অল্প বয়স। তন্বী, কালো। কানে, গলায়, হাতে কোনও অলঙ্কার নেই। কিন্তু একটা অদ্ভূত শান্তশ্রী মুখ জুড়ে ছড়ানো। কোথাও কোনও আনন্দ-বিষাদের ছায়া নেই।
-হ্যাঁ রে, মালবিকা, তাহলে তুই শেষ পর্যন্ত গানের জন্য ডিভোর্সই করলি? তোদের তো প্রেম করে বিয়ে। কষ্ট হল না?
-তা না হলে যে গান ছাড়তে হত। তাতে বেশী কষ্ট হত।
ঘরে আবার নৈঃশব্দ্য। তবে এবার অস্বস্তির। একটু বাদে সেইটা কাটানোর ভার আবার অঞ্জলিমাসিই নিলেন।
-আজকের দিনে বাদ দে তো ওইসব। আমি লক্ষ্মীকে বেছে ভালো বউ, বউমা, বউদি হয়ে ঘরে বসেছি, মালবিকা মা সরস্বতীকে বেছেছে। অথবা বলতে পারিস মা সরস্বতীই ওকে বেছেছেন। তা না হলে, এমন কন্ঠ হয়? হ্যাঁ রে, আজ একটা গান শোনাবি না?
মালবিকা শান্ত স্বরে বলল, "গানকে তো আমি কখনও না বলি না গো।"
-শোনা তাহলে।
মালবিকামাসি গান ধরল। পা মুড়ে পদ্মাসনে বসা, মেরুদন্ড ঋজু, এক হাত কোলের ওপর রাখা, অন্য হাতের মুদ্রায় সুরের ওঠাপড়া। চোখ বন্ধ। শান্ত মুখে কোথাও কোনও বেদনার ছায়া নেই। বরং এক অনির্বচনীয় প্রশান্তি। শুধু কন্ঠে খেলা করছে হৃদয় নিঙড়ানো সুর-
"আমার স্বপন কিনতে পারে
এমন আমীর কই ?
আমার জলছবিতে রঙ মিলাবে
এমন আবীর কই ?
আমি দুখের সিংহাসনে বসে সুখের বিচার করি
আমি ভাবের ঘরের অভাবটুকু আখর দিয়ে ভরি।।
আমার পরম বন্ধু হবে এমন অধীর কই
আমার জলছবিতে রঙ মিলাবে
এমন আবীর কই ?"
**********
এক ট্রাঙ্ক গপ্পো (৩)
"এই শুনেছো, সুরমাদি না কি মেটার্নিটি লীভের জন্য অ্যাপ্লাই করেছে?" চম্পা প্রায় হাঁফাতে হাঁফাতে কথাটা বলল বিভাকে। বিভা কমনরুমের সোফায় আধশোয়া হয়ে একটু ঘুমিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিল। শ্যামনগর থেকে রোজ ডালহৌসি এসে সকাল ছটার মর্ণিং ডিউটি করা কি চাট্টিখানি কথা? তার জন্য আলো ফোটার আগে ঘুম থেকে উঠে রান্নাবান্না শেষ করে আসতে হয়। সারাদিন শুধু ঘুম পায়। তবে এ শুধু একা বিভার গল্প নয়। এক অবস্থা আরও অনেকের। তাই টেলিফোন ভবনের সাততলার এই কমন রুমে এলে সবসময়ই দেখা যায় কেউ না কেউ, কোথাও না কোথাও একটু মাথা কাত করে ঘুমিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। এই হইচইয়ের মধ্যে যতটা পারা যায় আর কি।
কমনরুমের আরেকটা পরিচিত দৃশ্য হল পুশ সেলিং। অপারেটরদের মধ্যেই অনেকে বিভিন্ন জিনিসপত্র পাইকারি হারে কিনে এনে এখানে সহকর্মীদের মধ্যে কমবেশি লাভে বিক্রি করেন। সব মিলিয়ে আয় মন্দ হয় না। তাই দিয়ে সংসারের এটা ওটা অতিরিক্ত খরচ, সাধ-আহ্লাদ, ছেলের পেন্সিল বক্স, মেয়ের নাচের ক্লাসের ফি এইসব হয়ে যায়। আবার যারা কিনছে তাদেরও লাভ। তাদের বাঁচছে সময়। এখানেই কেনা হয়ে যাচ্ছে ভাগ্নীর মেয়ের জন্মদিনের ফ্রক, পিসিশাশুড়ির জন্য পুজোর সরু পাড় সাদা শাড়ি। এর বাইরে নিজের জন্য শখের বোমকাই কি মণিপুরী সিল্ক তো আছেই। যেহেতু পয়সা মাসে মাসে দিলেও চলে, তাই গায়ে লাগে না।
তবে এর মধ্যে সুরমার কথা আলাদা। যেখানে অন্য সবার নিজস্ব পশরার স্পেশালাইজেশন রয়েছে, সেখানে সুরমার যেন মণিহারী দোকান। শাড়ি তো আছেই, তার সাথে আছে সায়া, ব্লাউজ, ব্রা,ঝুটো গয়না, খেলনা, বিছানার চাদর, বালিশের ওয়াড়, পর্দা, শীতের মাফলার, সেফটিপিন, টিপের পাতা আরও টুকিটাকি কত কি। সকালে এসে কমনরুমে নিজের বোঁচকা আর খাতা রেখে দিয়ে সুরমা কাজে ঢুকে পড়ে। তারপর সারাদিন ধরে যে যার মত জিনিষ সেই পশরা থেকে নিয়ে পাশে রাখা খাতায় লিখে রাখে। কেউ যদি বলে, "সুরমাদি, তুমি যে এত বিশ্বাস করে সব জিনিষপত্র রেখে দিয়ে চলে যাও, যদি আমি একটা শাড়ি নিয়ে না লিখি, তখন? লস হয়ে যাবে তো?" সুরমা পান খাওয়া দাঁত বার করে হেসে বলে, "ওমা, মাইয়াডা কয় কি? বুইনেরে একখান শাড়িজামা দিলে কহনো লস হয়? তরা তো সব আমার বইন, না কি?"
তো এই "বইন"দের কাছে জিনিষপত্র বেচে রানাঘাটে একটা বাড়ি তুলেছে সুরমা। ছোট দোতলা বাড়ি। ইচ্ছে আছে দুটো তলা দুই ছেলেকে দেবে। দুজনকে দুটো দোকানও খুলে দিয়েছে রানাঘাট স্টেশনের কাছে। এবার বিয়ে-থা দিয়ে ওদের সংসারী করে দিতে পারলেই ব্যস্, ঝাড়া হাত পা। তারই মধ্যে এই খবর।
ঠিকই তো, সুরমা অফিসে আসছে না বেশ কয়েকদিন। বাড়িতে ফোনও নেই যে কেউ ফোন করে খবর নেবে। এরই মধ্যে আবার চারতলার অ্যাকাউন্ট ডিপার্টমেন্টের একজন যার রাণাঘাটে বাড়ি সে খবর দিল, সুরমার বাড়ির বারান্দায় না কি কাঁথা শুকোচ্ছে। তার সাথে সুরমার চেনা-পরিচয় নেই, নয় তো বাড়ি ঢুকে পাকা খবরই নিয়ে আসত সে।
অফিস জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল চাপা গুঞ্জন। অবিশ্বাস, ফিসফাস। এই বয়সে? না, না, তা কি করে হয়? "সুরমাদির তো কবেই শরীর খারাপ হওয়া বন্ধ হয়ে গেছে", "না রে, তুই জানিস না", "এ মা, এখন তো ছেলের বিয়ে দিয়ে ঠাকুমা হওয়ার কথা যে রে?", "কি যে বলো, দেখলে কিছু বুঝতাম না আমরা? সুরমাদিকে একদিনের জন্যও প্রেগনান্ট হলে মনে হয়েছে?"
যখন আর কৌতূহল সহ্য হচ্ছে না তখন কয়েকজন মিলে ঠিক হল শেষ পর্যন্ত সুরমার বাড়ি যাওয়া হবে।
-"কি বলবে গিয়ে?"
-"কি আবার বলব? বলব, এতদিন অফিসে আসছো না, কিছু বিপদ আপদ হল কি নি দেখতে এলাম।"
-"বিশ্বাস করবে সুরমাদি?"
-"না করলে বলব, তোর নাতির বয়সী ছেলেকে দেখতে এলাম লো।"
বয়স্ক ঝর্ণাদির কথা বলার ধরনে অল্পবয়স্ক মেয়েরা হাসিতে ফেটে পড়ে।
কিন্তু এত কিছু করার আগেই একদিন অফিসে চলে এল সুরমা। পান খাওয়া দাঁত বার করে একগাল হেসে বলল, "দুইখান পোলার পর এইবার মাইয়ার মা হইসি রে। বইনগুলারে খবরডা দেওন লাগে তো, না কি? তাই আইয়া পইড়লাম। আমি কিন্তু অহন স্যুডিতে (ছুটিতে) আসি। কাম দিবি না।"
সবাই থতমত। বলেটা কি? শেষে সুরমার থেকেও বড় ঝর্ণাদি হাল ধরলেন। "এই যে বাঙাল বেটি, ঝেড়ে কাশ দেখি ব্যপারটা কি? কি ঘটিয়েছিস খুলে বল দেখি।"
সুরমার পান চিবানো বাঙালভাষা ভেদ করে যা বের হল তা হল এই যে মর্ণিং ওয়াক করতে গিয়ে পার্কের কোণের ডাস্টবিনের পাশে একটি ফুটফুটে সদ্যোজাত মেয়ে কুড়িয়ে পেয়েছে সরমা। থানায় নিয়ে গিয়েছিল। তারপর সেখান থেকে এসে রীতিমত লেখাপড়া করে মেযেটিকে ঘরে নিয়ে এসেছে। এখন দত্তক নেওয়ার প্রসেস চলছে। ম্যাটার্নিটি লিভের খবরটা নিতান্তই রঙচড়ানো গুজব। তবে বাচ্চাটার দেখাশোনার জন্য ও সত্যি সত্যিই লম্বা "স্যুডি" নিয়েছে।
কেউ কেউ খবরটা শুনে নিজেদের আশঙ্কা প্রকাশ করল।
-"সুরমাদি, এরম অজানা অচেনা বাচ্চা ঘরে তুললে? কেমন রক্ত, কোন বংশ কিছুই তো জান না।"
সুরমা একটু ভাবল। তারপর বলল, "মনে তো লাগে, রক্ত লালই হইব।" তারপর থেমে বলল, "আসলে কি জানস তো, দ্যাশভাগের পর যখন এই দ্যাশে আসি তখন মাথার উপর কুনও ছাদ আছিল্ না। বাপ-মায়ের লগে দরজায় দরজায় ঘুইরা বেড়াইসি। হেইখান থেইক্যা শুরু কইরা, আইজ আমার এই দুই তলা বাড়ি। কিন্তু, ঘর না থাকলে কেমন লাগে, মানষের জীবনডাই কেমন দুচ্ছাই হইয়া যায়, নিজেরে দিয়াই তা বুইঝসি। তাই এইডারে ভগবানের ভরসায় ফালাইয়া আইতে মন দিল না।"
********
এক ট্রাঙ্ক গপ্পো (৪)
"এই ছবিদি, এই মেটার্নিটি লিভের ফর্মটা একটু ফিল্ আপ করে দেবে গো? তুমি তো তিন তিনবার করেছো।" কথাগুলো বলতে বলতে ছবির সামনে চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসল কবিতা। ভারী, গিন্নীবান্নি শরীর। দুর্গাপ্রতিমার মত টানাটানা চোখ আর পানপাতা মুখটা যেন মায়ায় মাখানো।
ছবি তখন ভাত ডাল তরকারি সব একসাথে মেখে কোনওরকমে গলায় ঢোকাতে ব্যস্ত। যদি তাড়াতাড়ি খাওয়াটা শেষ করে কাজে ফিরতে পারে তাহলে মিনিট পনেরো আগে অফিস থেকে বেরোতে পারবে। সেক্ষেত্রে সাড়ে ছটার ব্যারাকপুর লোকালটা ধরে বাড়ি ফিরে ছেলেটাকে নিয়ে একটু বসতে পারবে। কালকে ইতিহাস পরীক্ষা। মাধ্যমিকের টেস্ট। বাকিগুলো নিজে ম্যানেজ করে নিলেও এই একটা সাবজেক্ট কিছুতেই বাগে আনতে পারে না। ছবির মনে হয়, কত তাড়াতাড়ি ও খাওয়াটা শেষ করতে পারবে তার ওপর ওর ছেলের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে।
তবুও কবিতার প্রশ্ন শুনে ছবির খাওয়া থেমে গেল। অবাক হয়ে ওর শান্ত মুখের দিকে তাকাল ছবি। কোথাও কোনও ভাঙাচোরার চিহ্নমাত্র নেই। এই মেয়েটা কি রক্ত-মাংসের মানুষ? না কি পাথর?
আজ থেকে দেড় বছর আগের কথা। বিয়ের দিন সম্পূর্ণ শান্ত কবিতাকে দেখে অফিসের কলিগরা ভয় পেয়ে গিয়েছিল। এই মেয়ে যেরকম শান্তভাবে সব মেনে নিয়ে হাসিমুখে নিয়ম কাজ করছে, শেষমেশ বৌভাতের পরে আত্মহত্যা করবে না তো? গল্পে মোচড় না এলে যেন জমে না। কিন্তু জীবনটা তো আর বাংলা সিনেমা নয়। তাই বিয়ের পরও কোনও অঘটন ঘটল না। জীবন চলতে লাগল আগের মতন, তার নিজের নিয়মে। শুধু ডিউটির টাইমটা পাল্টে নিয়েছিল কবিতা। আগে মর্ণিং ডিউটি করত, এখন একটা দশের করে। তাতে করে সকালের রান্নাবান্না করে সবাইকে অফিসে পাঠিয়ে, শ্বশুরের খাওয়ার দাওয়ার গুছিয়ে দিয়ে আসতে সুবিধে হয়।
কবিতার জন্ম যশোরে। তখন আসন্ন মুক্তিযুদ্ধের দিন গুনছে বাংলাদেশ। চারিদিকে খানসেনার ভারী বুটের শব্দ। অবস্থা ভাল নয় দেখে তেরো বছরের কবিতাকে কলকাতায় তার মামার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিল ওর বাবা-মা। অন্তত: আব্রু আর প্রাণ বাঁচবে। তবে কলকাতায় মামাবাড়িতে যত্নের অভাব হয় নি কবিতার। মামাই ওকে পড়াশুনো করিয়ে স্কুল ফাইনাল পাস করিয়েছেন। তারপর আই এ পড়তে কলেজে ভর্তি হওয়া। সেই কলেজে যাওয়ার পথেই একদিন কবিতা নজরে পড়ে যায় ওর ভাবী শ্বশুরমশাইয়ের। সুন্দরী কবিতাকে ঘরের বউ করে নিয়ে আসেন উনি। বিয়েতে কবিতার বাবা-মা আসতে পারেন নি। কিন্তু তাতে কিছু আটকায় নি। শ্বশুরমশাই ওনার পরলোকগত পত্নীর যাবতীয় গয়না দিয়ে সাজিয়ে নিয়ে গেছেন তাঁর একমাত্র পুত্রবধূকে। কোথাও কোনও কিছুর খামতি হতে দেন নি।
বিয়ের পর আই এ পাশ করে চাকরিতে ঢুকল কবিতা। তারপর টাকা জমিয়ে, লোন নিয়ে বাড়ি করে কলকাতায় নিয়ে এল বাবা-মাকে। সঙ্গে বছর দশেকের ছোট বোন। ততদিনে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেছে।
এদিকে বিয়ের পাঁচ বছর পরেও নাতির মুখ না দেখে অস্থির হয়ে পড়লেন শ্বশুরমশাই অবনী রায়। তারপর নিয়মমত ডাক্তার-বদ্যি-পীর-থান করে কেটে গেল আরও কিছু বছর। ডাক্তারিমতে সব কিছু ঠিক থাকলেও মা হতে পারল না কবিতা। তারপর একদিন বয়স কাঁটাতারের গন্ডী পার হল। বছর বিয়াল্লিশেই ঋতুচক্র বিদায় নিল। সে খবর শুনে প্রায় পাগল পাগল অস্থির হয়ে উঠলেন অবনীবাবু। তিনি ছেলের আবার বিয়ে দেবেন। কিন্তু তাতে কবিতা বা তার স্বামী কেউই রাজি ছিল না। শুরু হল বাড়িতে নিত্য অশান্তি।
এদিকে বোনের বিয়ের বয়স পেরিয়ে যাচ্ছে। অবস্থা দেখে একদিন কথাটা পাড়লেন কবিতার মা।
-বেয়াইমশাই, বলছিলাম কি, মেয়ে খুঁজতে বাইরে যাওয়ার কি দরকার, মেয়ে যখন ঘরেই আছে? এখনো দুই বোন একসাথে আছে, তখনো থাকবে। কিছুই পাল্টাবে না।"
কবিতা আশা করছিল বোন আপত্তি করবে কিন্তু দেখা গেল সে হঠাৎই ভীষন বাবা-মায়ের বাধ্য হয়ে গেল। অদ্ভুতভাবে কবিতার স্বামীও কেমন চুপ করে গেল। সবার আচরণে মনে হল যেন এমনটাই হয়ে থাকে, এমনই হওয়ার কথা ছিল। কবিতাই বুঝি অকারণে অশান্তি করছে। ওর মনে হল যেন এর সবটাই পূর্বপরিকল্পিত, সাজানো। এমনকি ওর বরের দ্বিতীয় বিয়েতে আপত্তিটাও। একটা ঝটকায় সম্পর্কের সব সুতো যেন ছিঁড়ে গেল। মনে মনে বর, বোন, বাবা, মা সবাইকে নিজের মোহবন্ধন থেকে মুক্তি দিল ও।
তারপরের গল্প তো আগেই বলেছি। সবাইকে অবাক করে দিয়ে বিয়ের সব দায়িত্ব শান্তমুখে পালন করল কবিতা। ছুটোছুটি করে বরের গায়ে হলুদ, বোনের বিয়ে তত্ত্ব সাজানো কিছুই বাকি রাখল না। যেন কোনও দূর সম্পর্কের আত্মীয়র বিয়েতে এসেছে। এখানকার কোনও কিছুতেই ওর কিছু যায় আসে না।
বন্ধুদের ভয়কে মিথ্যা প্রমাণ করে আত্মহত্যার মত কোনও কান্ড ঘটাল না কবিতা। এমনকি কারও কাছে কোথাও কোনও অনুযোগ পর্যন্ত করল না কবিতা। কোনও আলোচনাও নয়। বন্ধুরা প্রবল কৌতূহলে কয়েকবার খোঁচানোর চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিল। জীবন চলতে থাকল জীবনের মত।
তবে সংসারের মায়া কি অত সহজে ছাড়া যায়? তাই মায়ার বাঁধনে আবার বাঁধা পড়ল ও। এইবার বোনের যমজ ছেলেমেয়েদের সাথে। সন্তানস্নেহে বড় করে তুলল ওদের। এরাও কবিতাতেই মা বলে ডাকত। আর ওর বোনকে বলত মামণি।
তারপর বহুবছর কেটে গেছে। আমার মা অবসর নিয়েছে চাকরি থেকে। কবিতামাসি কেমন আছে, কোথায় আছে কোনও খবর ছিল না। কয়েকবছর আগে টেলিফোন ভবনে পেনশন সংক্রান্ত একটা কাজে গিয়ে আবার দেখা হয়ে গেল মায়ের সাথে। মাকে দেখে একগাল হেসে এগিয়ে এল কবিতা। মুখে বয়সের আঁকিবুঁকি। মা জিজ্ঞেস করল, "কেমন আছিস?"
একই রকম শান্তভাবে উত্তর দিল কবিতা, "খুব ভালো আছি গো। ছেলেমেয়েরা খুব যত্নে রেখেছে। আজ এটা নিয়ে আসছে, কাল সেটা। এই দেখো না এই শাড়িটা গত পুজোয় দিয়েছে।"
এই বলে মায়ের সামনে সাদা চুলের দুর্গাপ্রতিমা মেলে ধরল ওর শতছিন্ন রিফু করা শাড়ির আঁচল।
******
এক ট্রাঙ্ক গপ্পো (৫)
সকাল সাতটা। কার্জন পার্কের ভেতর দিয়ে শর্টকাটে ফিরছে ছবি। ক্লান্তিতে শরীর যেন ভেঙে আসছে। আগের দিন দুপুর একটা দশে অফিসে জয়েন করে সারা দিন কাজ। তারপর সন্ধ্যেবেলা দু ঘন্টার ব্রেক। তারপর আবার সারা রাত ধরে ফোন ঘোরানো। পা যেন আর চলছে না। অনেকেই সকালে ছুটির পর অফিসেই ঘুমিয়ে নিচ্ছে। কিন্তু ছবির সে উপায় নেই। বাড়িতে মা-এর শরীর খারাপ। বোন কলেজে বের হওয়ার আগে পৌঁছতে হবে। সকালের রান্নাটা যদিও বোনই করে রাখবে কিন্তু মাকে স্নান করানো, খাওয়ানো সব ওকেই সারতে হবে। তারপর যদি দুপুরে সময় পায় তো একটু ঘুম।
ছবি পা চালায়। স্প্ল্যানেড থেকে বাস ধরলে বসার জায়গা পাবে। তা হলে ঘন্টা দুয়েক বাসেই ঘুমিয়ে নিতে পারবে। ঘুমটা খুব দরকার। পরপর এই দিনে-রাতের কাজ আর শরীর নিচ্ছে না। গত পনেরো দিন ধরে এই চলছে। টানা প্রায় আঠারো ঘন্টার অফিস আর তারপর একদিনের ছুটি। আবার আঠারো ঘন্টার ডিউটি। যবে থেকে ভারত-চীন যুদ্ধ শুরু হয়েছে তবে থেকেই চলছে এই এক রুটিন। বড় ক্লান্তির। কিন্তু কিছু করার নেই। সন্ধ্যার পর সব ব্ল্যাক আউট হয়ে যায়। তাই রাতের ডিউটিতে কেউ জয়েন করতে পারে না। অবস্থা সামলাতে দুপুরের ডিউটির মেয়েদেরই রাত্রেও কাজ করে দিতে হয়। বিনিময়ে একদিন ছুটি পাওয়া যায়। কিন্তু মেয়ে মাত্রই জানে, বাড়তি ছুটিতে তাদের কোনও লাভ হয় না। সংসার ছুটি তো দেয়ই না বরং বাড়তি কাজের ভার চাপিয়ে দেয়।
অনেকে যে গাঁইগুই করে নি এমন নয়। এমন আঠারো ঘন্টা টানা কাজ কি আর দিনের পর দিন করা যায়? কয়েকজন মিলে গিয়েওছিল সুপারভাইজার মিস্টার পুরকায়স্থর কাছে। গিয়ে বলেছিল নিজেদের অপারগতার কথা। কিন্তু কোনও কাজ হয় নি। উল্টে উনি বলেছেন, "আমাদের যে সব জওয়ানরা সীমান্তে লড়ছে, তাদের কথা ভাবুন। ওনারা দেশের জন্য জীবন দিয়ে লড়ছেন, আর আপনারা এটুকু কষ্ট করতে পারবেন না? আপনারা জানেন না, ট্রাঙ্ক এক্সচেঞ্জ চালু রাখা দেশের স্বার্থে কতটা দরকার? যান, সবাই কাজে যান। আর কোনো জানলা যেন খোলা না থাকে। এতটুকু আলো যেন বাইরে না যায়। তাহলে আমাদের সবার বিপদ। জানেনই তো, যোগাযোগ ব্যবস্থা কিন্তু শত্রুদের পছন্দের টার্গেট।" আর কিছু বলে নি মেয়েরা। শুধু নিজেদের প্রশ্ন করেছিল, দেশের জন্য আমাদের এই অমানুষিক পরিশ্রমের কথা কি লেখা থাকবে কোথাও? না কি শুধুই পয়সার বিনিময়ে চাকরি বলেই ধরা হবে এই যুদ্ধকালীন কষ্টস্বীকার?
পা চালায় ছবি। সকালের কার্জন পার্কে ধীরে ধীরে প্রাতঃভ্রমণকারীদের ভীড় বাড়ছে। আগেরদিন বিকেলে বৃষ্টি হয়ে যাওয়ায় হাওয়া ঠান্ডা। রাস্তা ভিজে। হয়তো সে কারনেই ভীড় অন্যদিনের তুলনায় কম। তাড়াতাড়ি পৌঁছতে পারলে বাসে একটা ভালো সীট পাওয়া যাবে।
হঠাৎ পেছনে একটা হাতের ছোঁওয়ায় চিন্তার সুতো ছিঁড়ে গেল। একজন মধ্যবয়স্ক লোক ছবির পাছায় হাত দিয়ে একটা চিমটি কেটে এগিয়ে গেছে। রাগে গা টা জ্বলে উঠল ছবির। থু:! এর নাম দেশবাসী? এদের জন্য এই পরিশ্রম? ইচ্ছে করল লোকটার গলা টিপে ধরতে। ততক্ষণে সেই লোক হাঁটতে হাঁটতে আরও খানিক এগিয়ে গেছে।
এতক্ষণের ক্লান্তি ভুলে পা চালাল ছবি। ওই তো এসে গেছে কাছে। আর একটু। ছাতাটাকে শক্ত মুঠোয় ধরে শরীরের সমস্ত শক্তি জড়ো করে হাত চালাল ও। একদম লোকটির পাছা লক্ষ্য করে। আচমকা আঘাতে কোঁক করে উঠল সেই অভদ্রলোক। ছবি তার হাঁটার গতি কমাল না। যেন কিছুই হয় নি এমনভাবে হনহন করে হাঁটতে লাগল ওর বাসের দিকে। বসার জন্য একটা ভালো সীট যে করেই হোক পেতে হবে। একটু ঘুমিয়ে না নিতে পারলে কালকে আবার কাজে আসতে পারবে না। যতই হোক, সেনারা সীমান্তে লড়ছে। দেশের ভেতর এটুকু যুদ্ধ তো করতেই হবে ছবি এবং ওর মত আরও অনেককে।
*********
এক ট্রাঙ্ক গপ্পো (৬)
রোগাসোগা বেঁটেবুঁটে চেহারা। কালো রং, চাপা নাক। মুখের মধ্যে শুধু নজরে পড়ে চোখ দুটো। আর ঝকঝকে হাসি। তবে রোগা হলে কি হবে, মহিলা কাজ করতে পারেন কিছু। কি অসীম এনার্জি। তবে সে কথা বললে একটু লাজুক হেসে বলেন, "ও কিছু না। অভ্যেস।"
তা অভ্যেস হবে নাই বা কেন? পাঁচ ভাইবোনের সংসার টানছে ছোটবেলা থেকে। বাপ দশরথ হাঁসদা যখন তিনদিনের জ্বরে মারা গেল তখন ফুলমনির বয়স আট। তখন থেকেই শুরু এবাড়ি ও বাড়ি কাজ করে খাওয়া। জঙ্গলে গিয়ে কাঠকুটো কুড়োনো থেকে শুরু করে গেঁড়ি-গুগলি ধরে আনা-কোন কাজটা করে নি ওই বয়সে? না করেই বা উপায় কি? মা-টা তো বিছানা থেকেই উঠতে পারে না। সবথেকে ছোট ভাইটাকে বিয়োতে গিয়ে সেই যে বিছানায় পড়ল, তারপর বাপ মাস কতক কত ওঝা বদ্যি ঝাড়ফুঁক করল, হল না কিছুই। সদরের হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলেছিল কেউ কেউ, বাপ ভয়েই যায় নি। হাসপাতালে গেলে কি আর কেউ ফেরত আসে? বাঁচালে ভগবান বোঙ্গাই বাঁচাবে, নয় তো নয়। মারাংবুরুর কাছে জোড়া মুরগী মানতও করেছিল বাপ। বড় ভালবাসত বউকে। তারপর তো নিজেই চলে গেল।
ফুলমনির বয়স যখন এগারো তখন হঠাৎই একদিন ও নজরে পড়ল চার্চের। ফাদার ওদের বাড়ি এসে ওর মাকে বোঝাল। তারপর একদিন ধর্ম বদল করে খ্রিস্টান হয়ে গেল ফুলমনি আর ওর ভাইবোনেরা। বদলে জুটল খাওয়া, ইস্কুল আর ছোটখাটো চিকিৎসার বন্দোবস্ত। তবু অভাব নিত্যসঙ্গী। সেই সব যুদ্ধকে পার করেই অবশেষে আই এ পাশ করল ফুলমনি ডেইজি হাঁসদা। বছর ঘুরতে চাকরি কলকাতা টেলিফোনে। তারপর আর ফিরে তাকাতে হয় নি। ভাইবোনকে নিয়ে এসেছে কলকাতায়। পড়াশুনো শিখিয়েছে। মা অবশ্য ততদিনে চলে গেছে বাপের কাছে সগ্যে।
সহকর্মীরা অনেক সময় জিজ্ঞেস করত, "নিজের ধর্মকে ছেড়ে দিলে ফুলমনিদি?"
-ছাড়লাম কই রে? খ্রিস্টান হলেও আমার ধর্ম তো আমার সঙ্গেই ছিল। তার নাম কি জানিস? খিদে। গরীব লোকের ওই একটাই ধর্ম। কখনো বাড়িতে না খেয়ে উপোস দিয়ে দেখিস তো দিন তিনেক পর চোখ বুজলে কোন দেবতার ছবি চোখে আসে? একটাই দেবতা আসবে রে, সে হল একথালা ভাত। ধোঁওয়া ওঠা গরম হওয়ার দরকার নেই। পান্তা হলেই হবে।"
ফুলমনিদির সবই হয়েছিল একে একে। জমি, বাড়ি, টিভি, ফ্রিজ। শুধু বিয়েটা আর হয় নি। কিছু বললে বলত, "পড়াশুনো শিখে চাকরি করে বাবু হয়ে গেলাম যে। দাঁড়কাকের গল্প শুনিস নি? ময়ূরের পালক লাগানোর পর নিজের জাত আর যাকে ছুঁয়ে দেখে নি? আমি সেই দাঁড়কাক। আর কলকাতা শহরের বাবুরা? তারা সব পেখম মেলা ময়ূর। নিজেদের ময়ূরীদের ফেলে এই দাঁড়কাকের দিকে কেন তাকাবে বল?"
***********
এক ট্রাঙ্ক গপ্পো (৭)
আজকের গপ্পো একজনকে নিয়ে নয় বরং তিনজনকে নিয়ে। তারা আসলে তিন নন, তাঁরা হয়তো এক বা তিনশো। এদের প্রত্যেকের গল্পগুলোই আদতে খুব কাছাকাছি। হয়তো পরিণতিগুলো আলাদা কিন্তু সে তো শুধু প্রবাবিলিটির জন্য। সেই প্রবাবিলিটি বা এক্স ফ্যাক্টর যাকে কেউ বলেন ভাগ্য, কেউ বলেন ভগবান, কেউ বা অন্য কিছু।
এক মুহূর্তের এদিক ওদিকে এর গল্প তার হয়ে যেতে পারত। পারতই। হয় নি, সে অন্য কথা। সুতরাং কি হতে পারত তা না ভেবে কি হয়েছিল তাই বলি।
ধরা যাক তিনজনের নাম অনিতা, মনিতা আর রনিতা।
অনিতা যখন প্রথমবার সন্তানসম্ভবা হল তখন ওর বয়স আঠাশ। বিয়ের চার বছর পর সন্তান, তখনকার হিসেবে অনেকটাই গ্যাপ। তাই আসন্ন সন্তানকে নিয়ে বাড়িতে উৎসাহের শেষ নেই। প্রায় উৎসবের মেজাজ। শাশুড়ি বলেছিলেন বটে, "বৌমা, এই শেষ কদিন আর অফিস গিয়ে কাজ নেই। বরং বাড়িতে বসে একটু আমার নাতিটার যত্ন কর।" অনিতা ওর স্বভাবসুলভ মিষ্টি হেসে বলেছিল, "কি করে জানলে নাতি আসছে? যদি নাতনি হয়?" শাশুড়ি পরম স্নেহে মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিলেন, "যা হবে হোক, ভগবান যাকে পাঠাবেন, সেই ঘর আলো করে রাখবে। কিন্তু তুই যেরকম শুকিয়ে গেছিস, এ ছেলেই হবে দেখিস।"
তা একটু শুকিয়েছিল বটে সাধারনত গোলগাল অনিতা। কিন্তু কি আর করা? সব মিলিয়ে তো সাকুল্যে পাওয়া যাবে নব্বই দিনের ছুটি। যখনই নাও। তাই অনিতা চেষ্টা করছে এদিকে যতটা সম্ভব টেনে দেওয়ার। তাহলে দুষ্টুটা হয়ে যাওয়ার পর অন্ততঃ মাস তিনেক ওর সঙ্গে সর্বক্ষণ কাটাতে পারবে। ইশ্ ওই তিনমাসের গুবলুটাকে ছেড়ে অফিসে যেতে হবে ভাবলে এখন থেকেই কষ্ট হচ্ছে।
আজকে সকাল থেকেই শরীরটা একটু খারাপ লাগছিল অনিতার। তাই সুপারভাইজার ঝর্ণাদিকে বলে মিনিট পনেরো আগেই বেরিয়ে এল অনিতা। একটু আগে হলে সোদপুরেপ ট্রেনে উঠতে সুবিধে হয়। নয়তো লেডিস কম্পার্টমেন্টেও যা ভীড় হয় এই ভরা মাসে বড় কষ্ট হয়।
রাস্তায় নেমেই দেখতে পেল একটা শিয়ালদার বাস আসছে। তাড়াতাড়ি করে রাস্তা পার হতে গেল অনিতা। আর তখনই কোথা থেকে চলে এল আরও দুটো বাস। দুটো বাসের মাঝখানে....
মনিতার গল্পের শেষটা এত করুণ ছিল না। ওই যে বললাম, হতেই পারত কিন্তু ভাগ্য বা ভগবানের কৃপায় তা হয় নি। অফিসেই জল ভেঙে গেছিল ওর। সহকর্মীরা অতি তৎপরতায় হাসপাতালে নিয়েও গিয়েছিল। ভাগ্যিস। ডাক্তার ওটি থেকে বেরিয়ে বলেছিলেন, "মা বেঁচে গেছেন। এর থেকে বেশি দেরি হলে মাকেও বাঁচানো যেত না।"
মনিতার ভাগ্য অনিতার থেকে একটু, ওই একটু সামান্য ভাল ছিল।...
শেষ গল্পটা রণিতার। রণিতা একটু জ্বর গায়েই অফিস গিয়েছিল সেদিন। শুধু আজ নয় গত কয়েকদিন ধরেই জ্বর আসছে বারবার। ডাক্তারের কাছে যাওয়াটাও দরকার। কিন্তু ঘরে বাইরে সবদিক সামলিয়ে আর হয়ে উঠছে না। এই সপ্তাহের ছুটি শুক্রবার। তখনও জ্বর না কমলে একবার ডাক্তার দাশকে দেখিয়ে নিতে হবে।
বোর্ডে বসে সকাল থেকে একটার পর একটা কল লাগিয়ে চলেছে রণিতা। গৌহাটি বোর্ডে আজ যেন অন্য দিনের থেকে তিনগুন বেশী ট্র্যাফিক। কলকাতার লোকেদের আজই এত কি দরকার পড়ল গৌহাটির লোকেদের সাথে কথা বলবার কে জানে? মনে মনে একটু বিরক্ত হল রণিতা। কখন থেকে বাথরুম যাওয়ার দরকার মনে হচ্ছে। কিন্তু আশেপাশে কেউ খালি নেই যার হাতে বোর্ড ছেড়ে যাওয়া যায়। এদিকে একের পর এক কল রিকোয়েস্ট ঢুকেই চলেছে অবিরাম।
অবশেষে সাড়ে এগারোটার সময় একটু ফুরসত পেল ও। শিখাকে বোর্ডে বসিয়ে বাথরুমে গেল রনিতা। কিন্তু শুরু হতেই যেন হাত পা যেন ঠান্ডা হয়ে এল। সাদা কমোডে জল কোথায়, এতো শুধু রক্ত। আর তার মধ্যে শুকনো কালচে ছোট ছোট রক্তের ডেলা। মাথা ঘুরে উঠল রণিতার। কোনও রকমে দেওয়াল ধরে বেরিয়ে রেস্টরুমে এসে শুয়ে পড়ল ও। পা আর চলছে না। পেটেরটা আছে না গেছে কে জানে?
নাহ্ সে যাত্রায় পেটেরটা বেঁচে গেছিল। ডাক্তার সব দেখে বলেছিলেন, "ভগবানকে ধন্যবাদ দিন যে এমন অবস্থাতেও বেবি বেঁচে গেছে। সাধারণতঃ থাকার কথা নয়"।
ইশশ্, বেবি গেলেই হল না? তাহলে আপনাদের এই এক ট্রাঙ্ক গপ্পো কে শোনাত, শুনি?
পুনশ্চঃ আজকাল যখন শুনি যে লোকজন বলে কেন এই ইক্যুয়াল রাইটসের যুগেও বাসে, ট্রামে, ট্রেনে লেডিস সীট, লেডিস কম্পার্টমেন্ট আছে, তখন হাসি পায়। অনিতা, মণিতা, রণিতারা এখনও আছে। আপনার আমার চারপাশেই।
***********
এক ট্রাঙ্ক গপ্পো (৮)
"কে শাশুড়ি আর কে বৌ সে তো দেখে বোঝার উপায় নেই"। কাবেরীদি তার ছেলে আর বৌমাকে নিয়ে অফিসে ঢুকতেই কলকলিয়ে উঠল অল্পবয়স্ক সহকর্মীরা।
তা কিছু ভুল বলে নি তারা। কাবেরীদির বিয়ে পনেরো বছর বয়সে, ছেলে আঠেরোয়। ছেলেরও বয়স পঁচিশ হতেই ওর জন্য মেয়ে খোঁজা শুরু, সাতাশে বিয়ে। ফলে বৌমার সঙ্গে বয়সের পার্থক্য মাত্র কুড়ি বছরের। সেই পার্থক্যও কাবেরীদি ঘুচিয়ে ফেলেছেন নিয়মিত রূপচর্চায় আর সাজগোজে। মেয়েরা কুড়িতে বুড়ি এই আদ্যিকালের প্রবাদ তুড়িতে উড়িয়ে কাবেরীদি পঁয়তাল্লিশেও রীতিমত তরুণী। শুধু কি তাই? কাবেরীদির সাজও অন্যদের থেকে আলাদা। কালো মেয়েদের লাল পরতে নেই একথা যারা বলেন তাঁরা নিশ্চই কাবেরীদিকে দেখেন নি। টকটকে লাল শাড়ি, যথোপযুক্ত লিপস্টিক ও টিপ, খোঁপায় গোলাপ, কৃষ্ণচূড়া, রঙ্গন বা পলাশ, এ কাবেরীদির যখন তখনের সাজ। উজ্জ্বল রঙে নিজেকে কি করে সাজাতে হয়, তা কাবেরীদিকে দেখে শিখতে হয়। সহকর্মীরা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, "এত সময় কোথায় পাও কাবেরীদি?" গর্বিত পায়রার মত ঘাড় উঁচু করে কাবেরীদি জবাব দেয়, "ঘরের যতটা কাজ আমি করি, ততটাই তোদের রজতদাও করে। আমি তো বলেই দিয়েছি, টাকা রোজগার যখন দুজনে করতে পারি, ঘরের কাজই বা দুজনে করব না কেন?"
মেয়েরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঈর্ষামিশ্রিত গলায় বলে, "তুমি সত্যিই লাকি গো।"
"লাকি বটেই, তবে স্বামী সৌভাগ্যে নয়। শাশুড়ি ভাগ্যে।" মুচকি হেসে বলল কাবেরীদি।
সেটা ঠিকই কথা। পনেরোতে বিয়ে করে আসার পর শ্বশুরমশাই বলেছিলেন পড়াশুনো বন্ধ করে দিতে। তখন যদি শাশুড়ি মা কোমর বেঁধে পাশে না দাঁড়াতেন, তাহলে আজ হয়তো কাবেরীদি সংসার নিয়েই থাকত। সেই '৫০ '৬০ সালেই ছেলেকে ঘরের সব কাজ শিখিয়েছিলেন। নাতি হওয়ার পর বউমাকে বলেছিলেন, "তুমি তোমার মত অফিস কর। ওকে আমি সামলে নেব।" নিয়েওছিলেন তাই। কোথা দিয়ে যে ছেলে বড় হয়ে গেল, কাবেরীদি টেরও পায় নি।
সেই ছেলে আর তার সদ্যবিবাহিত বৌয়ের সাথে কলিগদের দেখা করানোর জন্যই আজ অফিসে আসা। নয়তো এমনিতে ছেলের বিয়ে উপলক্ষ্যে লম্বা ছুটি নিয়েছে কাবেরীদি। বলেছে, "দ্যাখো বাপু, এই একটিমাত্র সন্তান, আশা করি বিয়েও করবে এই একবারই। একটু চুটিয়ে আনন্দ করে নেই।"
কাল বাদে পরশু এরা ফিরে যাবে ব্যাঙ্গালুরু, নিজের নিজের কাজের জায়গায়। তার আগে এই একটু ঘুরে নেওয়া। অফিসের বন্ধুরা জানতে চায়, "এখন কোথায় যাবে গো? আত্মীয়-টাত্মীয়দের বাড়ি?"
কাবেরীদি উত্তর দিল, "ধ্যুস। এখন আমি আর অপর্না যাব শপিং করতে। দেখছিস তো একে, কিচ্ছু সাজে না। ও এরকম সাদামাটা থাকলে আমি কি আর পটের বিবি সাজতে পারি বল? তাই ঠিক করেছি আজ আমরা দুজনে মিলে চুটিয়ে কেনাকাটা করব।"
কাবেরীদির বন্ধুরা ওর ছেলের সাথে ঠাট্টা করে, "আজ মা আর বউ একসাথে তোমার অনেক খসাবে।"
ওদের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে কাবেরীদি উত্তর দেয়, "কেন, ওর খসাবো কেন? আমি আর আমার বউ আমরা দুজনেই চাকরি করি। নিজেদের পয়সায় যা কেনার কিনব। বুবুনকে তো আমরা সঙ্গেই রাখব না। এই সব বর-ছেলের সঙ্গে আবার শপিং হয় না কি? ও এখন বাড়ি গিয়ে আমাদের সবার জন্য ডিনার তৈরী করবে। সকালে কুচো মাছ এনেছি। রসুন পেঁয়াজ দিয়ে রগরগে করে ওটা ও যা ভাল রান্না করে না, কি বলব?"
(শেষ)