(১)
হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরে জানলাটা হাট করে খুলে দিল শতদ্রু। এসিটা চালাতে পারলে ভাল হত, কিন্তু গতরাত্রে ওটা থেকে অল্প অল্প ধোঁওয়া বের হচ্ছিল। আজ ভেবেছিল মেকানিক ডাকবে, তারপর সারাদিনের এই অপ্রত্যাশিত দৌড়ঝাঁপে কখন যে ব্যাপারটা মাথা থেকে বেরিয়ে গেছে নিজেও জানে না। নভেম্বর পড়ে গেল, তবু গুমোট গরমটা কমল না। তারপর ফ্যানটা চালিয়ে বিছানায় দেহটা এলিয়ে দিল শতদ্রু। শরীরের ক্লান্তি যতটা না, মনের ক্লান্তি তার থেকে অনেক বেশি। চন্দ্রিকাদিকে কখনো এই অবস্থায় দেখতে হবে কোনওদিন ভাবে নি ও। দীঘল চোখ, ঘন ভুরু, চাপা রঙ আর ভারি ঠোঁটের সেই চন্দ্রিকাদি, যাকে ওদের পাড়ার শ্রীলেখা মিত্র বলা হত।
সরকারি হাসপাতালের চাতালে পড়েছিল দেহটা। পিচুটি দিয়ে বোজা চোখ, মাথা ভর্তি জটা, আর পুঁজ ভরা ঘায়ের ওপর ভনভন করা মাছি দেখে বোঝা কঠিন ছিল যে মানুষটা বেঁচে আছে না মরে গেছে। শতদ্রুও বাকি সবার মত পাশ কাটিয়ে চলেই যাচ্ছিল। হাসপাতালের চত্বরে পড়ে থাকা এরকম বেওয়ারিশ মড়া তো কম দেখল না জীবনে। আগে ধাক্কা খেত। এখন বুঝে গেছে ওসব ঝামেলায় না জড়ানোই ভাল।
শরীরটাতে শায়া ব্লাউজের কোনও বালাই ছিল না। শুধু কোনওমতে জড়ানো ছিল একটা ছেঁড়াখোঁড়া কাপড়। তাতে যা না ঢাকা পড়ছিল, দেখা যাচ্ছিল তার বেশি। কয়েকটা ছেলে একপাশে দাঁড়িয়ে শকুনের মত চোখে তাই গিলছিল। "মালটাকে দেখেছিস? সময়কালে খাসা ছিল"।
ওদের কথা কানে যেতেই স্বয়ংক্রিয় কৌতূহলে চোখটা চলে গেছিল দেহটার দিকে। আর তাতেই নজরে পড়ে গেল পেটের ওপর করা সেই ট্যাটুটা। একটা বাদামী-কালো কাঁকড়াবিছে। যার দেহটা নেমে হারিয়ে গেছে উরুসন্ধির খাতে। আর সামনের দাঁড়াদুটো বেরিয়ে রয়েছে নাভীর দুপাশে। যেন ওই গভীর গর্ত থেকে উঠে আসা কোনও শিকার ধরার আশায়। নিশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে ওঠানামা করত বিছেটা। যেন তারও আলাদা করে প্রাণ আছে।
বিছেটাকে দেখেই হাত পা অসাড় হয়ে গেছিল শতদ্রুর। হ্যাঁ, এই দাঁড়াদুটোর কবলেই তো আটকা পড়েছিল ও। তখন কত আর বয়স হবে? চোদ্দ পার করে পনেরো। নাচের ক্লাসে চোখদুটো আটকে থাকত শাড়ির কুঁচি থেকে বার হয়ে আসা ওই দাঁড়াদুটোর ওপর। নাভির অনেকটা নিচে শাড়ি পড়ত চন্দ্রিকাদি। তা সত্ত্বেও বিছেটার বাকি দেহটা লুকিয়ে থাকত শাড়ির তলায়। সম্ভবত হাতদুটো অনেকটা লম্বা ছিল বিছেটার। চন্দ্রিকাদির মতই। সুঠাম আর দীর্ঘ। সেই না দেখা বিছেটা শতদ্রুকে একটা অমোঘ আকর্ষণে নিজের দিকে টানত। ফিসফিস করে কথা বলত ওর সাথে। হাতছানি দিয়ে বলত, আয়, আয়। মনে মনে শতদ্রু বিছেটার বাকি শরীরটা কল্পনা করে নিত। একদিন স্বপ্নে দেখেছিল একটা কালো কাঁকড়াবিছে ওর বাঁদিকের উরু বেয়ে একটু একটু করে ওপরে উঠে আসছে। শিরশিরে খরখরে পায়ে। শতদ্রু হাত দিয়ে সরাতে যেতেই বিছেটা এক ঝটকায় হুল বিঁধিয়ে দিল ওর অণ্ডকোষে। আর কী আশ্চর্য, যন্ত্রণা হওয়ার বদলে একটা তীক্ষ্ণ আনন্দ ওর শরীরের ভেতর দিয়ে বয়ে গেছিল। ঘুম ভেঙে বুঝেছিল প্যান্টের ভেতরটা চ্যাটচ্যাটে হয়ে আছে। সেই ছিল ওর প্রথম স্বপ্নস্খলন। বড় হয়ে ওঠার প্রথম ধাপ।
পরের দিন নাচের ক্লাসে চন্দ্রিকাদির মুখের দিকে তাকাতে পারে নি ও। মনে হচ্ছিল চোখের দিকে তাকালেই চন্দ্রিকাদি ওর মনের কথা সব জেনে যাবে। একটা অস্বস্তি আর লজ্জায় বারবার স্টেপে ভুল হয়ে যাচ্ছিল শতদ্রুর। বুঝতে পারছিল, চন্দ্রিকাদি খুব বিরক্ত হচ্ছে।
-"আহ্ কি হচ্ছে দ্রু? কনুইটা আরও উঠবে। ওটা কাঁধের সাথে সমানে থাকবে। না, না কাঁধ উঠছে কেন? কত্থকে শিল্পীর গ্রেসটাই আসল। ইশ, কাঁধটা ওরম উঁচু করে রাখলে পুরো ভিস্যুয়ালটাই বাজে দেখতে লাগছে।"
বলতে বলতে চন্দ্রিকাদি এসে কাঁধে হাত রাখতেই থরথর করে কেঁপে উঠল শতদ্রু। চন্দ্রিকাদি ধীরে ধীরে হাত নামিয়ে নিল। তারপর তিরিশ সেকেন্ড পর আস্তে আস্তে প্রায় ফিসফিসে গলায় বলল, "আজ বাড়ি যা, দ্রু। মন চঞ্চল হলে সাধনা হয় না। শনিবার দুপুরে আসিস। তোকে একা শেখাব। আজ যা।"
কি সমাপতন। আজকেও শনিবার। শুধু মাঝে কেটে গেছে আঠেরোটা বছর।
শতদ্রু হঠাৎ টের পেল একটা মিষ্টি গন্ধে ঘরটা ভরে উঠছে । এই পারফিউমটাই তো লাগাত চন্দ্রিকাদি ওর নাভির চারপাশে। কী যেন নাম ছিল পারফিউমটার? কোথা থেকে আসছে গন্ধটা?
(২)
-"কী দেখছিস অমন হাঁ করে? এর আগে কখনও ট্যাটু দেখিসনি বুঝি?"
চন্দ্রিকাদির কথায় হুঁশ ফিরল শতদ্রুর। সত্যিই ও অবাক হয়ে ট্যাটুটাকে দেখছিল। কলকাতা থেকে দূরের এই মফস্বলে মেয়ে তো দূরে থাক, কোনও ছেলেরও উল্কি করা পেট আগে কখনো দেখে নি ও। যেটুকু ট্যাটু দেখেছে তা টিভিতে, বছর কয়েক আগে কেবল লাইন আসার পর। আস্তে আস্তে মোহাচ্ছন্নের মত ঘাড় নেড়ে না বলল শতদ্রু।
-"নে তবে ভাল করে দেখে নে।" বলে কোমরের কাছ থেকে শাড়িটা আরও কয়েক ইঞ্চি নামিয়ে দিল চন্দ্রিকাদি। প্রায় পুরো বিছেটাই দেখা যাচ্ছে এখন, শুধু লেজের শেষ প্রান্তের হুলটুকু ছাড়া। সেই অংশটা লুকিয়ে আছে একটা সরু কালো বনপথের ভেতর। যেন গোপনে অপেক্ষা করছে তার শেষ ছোবল মারার জন্য।
-নাচ হচ্ছে শরীরের শিল্প। তোর শরীরটাই তুলি, শরীরটাই ক্যানভাস। তোর মনের আর্তিকে আঁকতে হবে সেই তুলি দিয়ে। কোন তুলি তুই কখন ইউস করবি সেটা তোর ওপর, তোর শিল্পের ওপর। আমরা শিল্পীরা কখনো ব্যবহার করি ভুরু, কখনো চোখ, কখনো বুক, কখনো পা, এমনকি কখনো পেট। তাহলে বাকি তুলিগুলো বাদ যাবে কেন? তুলিকে শিকল পরিয়ে কি আর ছবি আঁকা যায়? নিজের তুলিকে চেন দ্রু। ক্যানভাসকে চেন। তুলি-ক্যানভাস না চিনলে যেমন ছবি আঁকা যায় না, শরীরকেও তেমনি পুরোপুরি না চিনলে নাচ অসম্পূর্ণ থেকে যায়। আয়, আমি তোকে ক্যানভাস দিচ্ছি, তুই ছবি আঁক। ছুঁয়ে দেখ, ছেনে দেখ সবকিছু যা তোর অজানা, যা তুই জানতে চাস।
বলতে বলতে শতদ্রুর হাত নিজের টানটান শ্যামলা পেটের ওপর ছোঁওয়াল চন্দ্রিকা। শতদ্রু কারেন্ট লাগার মত ছিটকে উঠল। হাত সরিয়ে নিতে চাইল। পারল না। চন্দ্রিকা শক্ত করে ধরে আছে ওর হাত। শতদ্রুর ছোঁওয়ায় ও নিজেও কাঁপছে তিরতির করে। আর ওই কাঁপতে থাকা শরীরটাকে দেখে শতদ্রুর মনে হচ্ছে বিছেটা যেন ধীরে ধীরে জেগে উঠছে।
আস্তে আস্তে চন্দ্রিকার সামনে হাঁটু গেড়ে বিছেটার মুখোমুখি বসল শতদ্রু। আর তখনই নাকে এল সুগন্ধটা।
আহ্ ইয়ার্ডলি। নামটা মনে পড়ে গেল শতদ্রুর। এটাই চন্দ্রিকাদি লাগাত নাভির চারপাশে। এতদিন বাদে গন্ধটা নাকে যেতেই শরীরটা আনচান করে উঠল ওর। বালিশে মুখ গুঁজল শতদ্রু। কোথা থেকে আসছে এই গন্ধটা? নাকি ওর মনের ভুল? আরেকবার জোরে জোরে নিশ্বাস নিল ও। আর তখনই বুঝতে পারল, গন্ধটা একা নয়। তার সঙ্গে মিশে রয়েছে হাসপাতালের ডেটল আর ফিনাইলের গন্ধ। আজ হসপিটাল থেকে ফিরে জামাকাপড়গুলো ছাড়া হয় নি। এরকম কখনও করে না ও। শতদ্রু ক্লান্ত শরীরটাকে বিছানা থেকে টেনে তুলল। জামাকাপড় ছেড়ে একটু স্নান করে নেওয়া দরকার।
গীজারটা অন করতেই একটা বিকট শব্দ হয়ে ঘরের সব আলো নিভে গেল। ফিউসটা গেল বোধহ্য়। মোবাইলটা হাতে নিয়ে টর্চটা জ্বালাতে গিয়ে শতদ্রু লক্ষ্য করল তার মোবাইল স্ক্রীণে জ্বলজ্বল করছে চন্দ্রিকাদির ছবি। একি মণিকর্নিকা ঘাটে পনেরো বছর আগে তোলা এই ছবিটা এখানে এল কীকরে? ও তো সেট করে নি। এমনকি ছবিটাও ওর কাছে নেই পর্যন্ত। তবে?
ছবিটা শতদ্রু তুলেছিল ওর প্রথম ক্যামেরায়। সামনে বসে আছে চন্দ্রিকাদি। আর ব্যাকগ্রাউন্ডে দূর থেকে হেঁটে আসছে রাজীবদা। চন্দ্রিকাদির হবু বর। অনেকটা নিয়তির মত।
(৩)
বেনারসের নাচের অনুষ্ঠান থেকে ফিরে শতদ্রুর কাছে রজতের সাথে ওর বিয়ের কথাটা ভেঙেছিল চন্দ্রিকা। প্রবোধ দেওয়ার গলায় বলেছিল, "ধুর বোকা, মন খারাপ করছিস কেন? আমি তো বাড়িতে আসবই। তোর বিছুয়া তোরই থাকবে। ইচ্ছেমত খেলিস। কেউ কিছু জানতেও পারবে না।"
শতদ্রু যেন ভেতর থেকে বুঝতে পারছিল এগুলো কথার কথা। ওকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য বলছে। ভেতর থেকে একটা চাপা রাগ, একটা অপমান উঠে আসছিল গলার কাছে। এর থেকে যদি চন্দ্রিকাদি ওকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিত, তাহলেও বোধ হয় ওর এতটা খারাপ লাগত না। সবথেকে কানে বিঁধছিল চন্দ্রিকাদির শেষ কথাগুলো, "কেউ কিছু জানতেও পারবে না।" অর্থাৎ এত বড় পৃথিবীর কোথাও কেউ শতদ্রুর এই অসহ্য জ্বালাপোড়ার সাক্ষী থাকবে না। একা একা গুমরে গুমরে মরতে হবে ওকে।
শতদ্রুর ধারণা ভুল ছিল না। আর কখনও ওই বিছেটাকে দেখতে দেয় নি চন্দ্রিকাদি। শুধু একবার ছাড়া। বিয়ের প্রায় বছরখানেক বাদে একটা দুপুরবেলা আবার চন্দ্রিকাদিদের বাড়ি গেছিল শতদ্রু। হেঁচকি তুলে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, "আমাকে শুধু কয়েকটা ছবি তুলতে দাও চন্দ্রিকাদি। ওই বিছেটাকে না দেখে আমি থাকতে পারছি না। তোমার মুখ শরীর কিচ্ছু থাকবে না। শুধু ওই বিছেটা।" রজত তখন অন্য ঘরে ঘুমিয়েছিল। সম্ভবত শতদ্রুর কান্নার শব্দে ওর ঘুম ভেঙে যেতে পারে এই ভয়েই রাজি হয়ে গিয়েছিল চন্দ্রিকা। অঝোরধারায় কাঁদতে কাঁদতে একের পর এক শাটার টিপে গেছিল শতদ্রু। হুঁশ ফিরেছিল রিল শেষ হয়ে যাওয়ার পর।
সেই নেগেটিভ সাহস করে প্রিন্ট করাতে পারে নি ও বহুদিন। তারও বেশ কয়েক বছর পর লন্ডনে পড়তে গিয়ে ছবিগুলো ওয়াশ করিয়েছিল শতদ্রু। ছবিগুলো দেখ শরীর জুড়ে জেগে উঠেছিল সেই পুরোনো অসহ্য যন্ত্রণা।
তারপরের কয়েক বছর শুধু এক শরীর থেকে অন্য শরীর খুঁজে বেড়িয়েছে ও। খাবলা খাবলা দিয়ে খেয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে একের পর এক অর্দ্ধভুক্ত শরীর। অন্য কিছু চাই, আরও অন্য কিছু। কখনও হিংস্রভাবে সঙ্গম করতে গিয়ে রক্তাক্ত করেছে ওর প্রেমিকাদের দেহ, কখনও বা নিজেকে মারার জন্য চাবুক তুলে দিয়েছে পেশাদার বেশ্যাদের হাতে। এমনকি ওর প্রেমিকা মালবিকাকে দিয়ে জোর করে নাভির নীচে কাঁকড়াবিছের ট্যাটুও করিয়েছে ও। কিন্তু সেই বিছেকে চুমু খেতে গিয়ে তীব্র অনীহায় গা গুলিয়ে উঠেছে। কী নেই, কী যেন নেই।
আজ অনেকদিন পরে মোবাইলের ছবিটার দিকে তাকিয়ে শতদ্রু বুঝতে পারল, ও কী মিস করেছে এতদিন। না, বিছেটাকে নয়। বিছেটার গায়ে লেগে থাকা ইয়ার্ডলের গন্ধটা। যেটা ওর সাততলার ঘরে ক্রমশ: দমবন্ধ করা তীব্র হয়ে উঠছে। জানালা খোলা, তবুও।
যেদিন শতদ্রু প্রথমবার জানতে পেরেছিল যে ও এইচ আই ভি পজিটিভ, সেদিনও এমনই দমবন্ধ লেগেছিল ওর।
(৪)
ব্লাড রিপোর্টটা হাতে নিয়ে অনেকক্ষণ জড়পদার্থের মত বসে ছিল শতদ্রু। চারপাশের কোনও শব্দ, কোনও কথা কানে যাচ্ছিল না। খালি মনে হচ্ছিল, "আমিই কেন? হোয়াই মি?" আর তার সাথে উঠে আসছিল একটা নিষ্ফল চাপা আক্রোশ, রাগ। কার প্রতি শতদ্রু নিজেই জানে না। যেন কোনও একটা নামহীন মুখহীন ছায়া অবয়ব ওর এই অবস্থার জন্য দায়ী। সেই অবয়বটাকে পা দিয়ে মাড়িয়ে, পিষে, থেঁৎলে দেওয়া অব্দি ওর শান্তি নেই। কিন্তু কে সে?
ডক্টর হ্যারিসের ক্লিনিক থেকে বাড়ি ফিরেই যন্ত্রের মত চন্দ্রিকাদিকে আই এস ডি করেছিল ও। মনে হচ্ছিল, চন্দ্রিকাদির কাছেই লুকোনো রয়েছে ওর জীয়নকাঠি। একমাত্র চন্দ্রিকাদিই পারে টাইম মেশিনে করে ওকে অতীতে নিয়ে গিয়ে সবকিছু আবার আগের মত ঠিকঠাক করে দিতে।
বহুবার কেটে দেওয়ার পর অবশেষে ফোন তুলল চন্দ্রিকা। ফিশফিশে গলায় বলল, "আমি আর রাজীব এখন বাইরে বেড়াতে এসেছি। প্লীজ ডিস্টার্ব করিস না, দ্রু। আমি তোকে পরে সময়মত কল করে নেব।"
প্রায় এক সপ্তাহ সেই ফোনের অপেক্ষা করেছিল শতদ্রু। আসে নি।
আর এই এক সপ্তাহে ধীরে ধীরে ওই অজানা অবয়বটা আকৃতি নিয়েছিল ওর মাথায়। সেই অবয়বটার দেহ সুগঠিত ও পিচ্ছিল, দুটো বাড়ানো সরু হাতের শেষে আঁকশির মত দাঁড়া, ঘন ভুরুর নীচে দীঘল চোখে মায়া ও মোহ, আর শ্রীলেখা মিত্রর মত ভারী ঠোঁঠের তলায় তীক্ষ্ণ মাদকভরা একটা লুকোনো হুল।
শতদ্রু এরপর আর দেরি করে নি। বহুদিন ধরে লুকিয়ে রাখা সেই বিছের ছবিগুলো এয়ারমেলে পাঠিয়ে দিয়েছিল কলকাতায় রাজীব ঘোষের অফিসের ঠিকানায়। এক ঝটকায় বিছেটার সমস্ত চিহ্ন মুছে দিয়েছিল নিজের জীবন থেকে।
তখন কে জানত, আবার ন বছর বাদে এভাবে বিছেটা ওর সামনে এসে দাঁড়াবে? এই রকম করুণ, থ্যাঁৎলানো, মৃতপ্রায় অবস্থায়?
এইচ আই ভি নিয়ে কাজের সুবাদে যথেষ্ট চেনাজানা ছিল শতদ্রুর। নয়তো সরকারি হাসপাতালে এত সহজে ভর্তি করা যেত না। একবার ভেবেছিল মুখ ঘুরিয়ে যায়। কিন্তু পারল না। কেন, কে জানে? প্রেম না কি প্রতিহংসা? দাক্ষিণ্যের চেয়ে বড় প্রতিশোধ বোধহ্য় আর কিছু হয় না। চন্দ্রিকাদিকে ধরে স্ট্রেচারে তোলার সময় শতদ্রুর হাসি পাচ্ছিল। কোথায় সেই ইয়ার্ডলের অহংকারী সুগন্ধ আর কোথায় এই গা গুলোনো পুঁজের গন্ধভরা নোংরা শরীর। একটা তৃপ্তির স্বাদ ভরে দিচ্ছিল ওর মুখ। চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিল জুতোর তলায় থ্যাঁৎলানো, দলা পাকানো একটা দেহ। শুধু তার দাঁড়াদুটো এখনও থরথর করে কাঁপছে।
ইয়ার্ডলের গন্ধটা ক্রমে বাড়ছে। আস্তে আস্তে যেন নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। মাথা ঝিমঝিম করছে। কিন্তু জানলাটা বন্ধ কেন? ওর তো স্পষ্ট মনে আছে যে ও জানলাটা ফিরে এসেই খুলে দিয়েছিল। তবে কি হাওয়াতে বন্ধ হয়ে গেল? জানলা খোলার জন্য এগোল শতদ্রু কিন্তু পারল না। তার আগেই ওর অবশ হাত থেকে ফোনটা পড়ে গেল। শতদ্রু দেখতে পেল ফোনটা থেকে দলে দলে বেরিয়ে আসছে অজস্র বিছে। তাদের গায়ের রঙ শুকনো রক্তের মত গাঢ় খয়েরি। চোখগুলো কামনায় লাল। ওরা ঘিরে ধরছে শতদ্রুর দেহ। খরখরে পা দিয়ে উঠে ওর দেহের ওপর। ওদের বরফঠা্ণডা নিশ্বাস লাগছে ওর গায়ে। আতঙ্কে জ্ঞান হারানোর আগে শতদ্রু শুনতে পেল কোথায় একটা ঘুঙুর বাজছে। কত্থকের বোলে ঘুরে ঘুরে চক্কর লাগাচ্ছে কোনও এক সুদক্ষ নর্তকী। পায়ের তুলির টানে এক অদৃশ্য ছবি আঁকা হয়ে চলেছে এক অজানা ক্যানভাসের ওপর।
"কি মরণ ঘুম রে বাবা। আধঘন্টা ধরে পেশেন্টের এক্সপায়ার হওয়ার খবর দেওয়ার চেষ্টা করছি, ফোনই তোলে না। অমাবস্যার মড়া। থাক পড়ে, আমার কি?" অত্যন্ত বিরক্ত গলায় তার সহকর্মীকে কথাটা বলল কোনও এক সরকারি হাসপাতালের এক রাতজাগা নার্স।
(শেষ)