অমর্ত্য সেন বলেছেন "monumental blunder", আমাদের দেশের স্বাস্থ্য-ব্যবস্থা নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে হতাশ নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদের এই দীর্ঘশ্বাসে আমরা শঙ্কিত হয়ে উঠি। হাসপাতালের সামনে মুমূর্ষু রোগীর অন্তহীন প্রতীক্ষা, জরুরি বিভাগে মৃতপ্রায় মানুষের শয্যার জন্য হাহাকার, সম্ভ্রমহীন চিকিৎসা পরিষেবা ও সর্বোপরি রোগী-চিকিৎসক সম্পর্কের পারস্পরিক আস্থাহীনতা - এই নিয়ে আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা। পীড়িত মানুষ হাসপাতালের কাছে একটি সংখ্যামাত্র, যা ভিক্টর হুগোর কয়েদী চরিত্রটি মনে করিয়ে দেয় "I am not a man. I am a number"। চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে ক্ষোভ তাই সর্বত্র। চিকিৎসকের তথাকথিত অমানবিকতার কাহিনিও তাই যে মানুষের মুখে মুখে ফিরবে তা কোন অত্যাশ্চর্য রূপকথা নয়, এ চূড়ান্ত বাস্তব। এই "অমানবিকতা ও স্বার্থপরতা" কি চিকিৎসাব্যবস্থার ত্রুটি নাকি স্বাস্থ্যকর্মীদের এ সহজাত অভ্যাস ? তারা কি মানবিক মূল্যবোধের উচ্চতর আদর্শ থেকে পতিত হয়েছে, তারা কি উচ্চবর্গের প্রাণী? নাকী তারা এক অলীক স্বপ্নরাজ্যের অধিবাসী, যেখানে মূল্যবোধের অভাবই শাশ্বত সত্য!! সংবাদপত্র চিকিৎসার ময়না তদন্ত করে - কী করলে একটি মানুষ বাঁচতে পারতেন কিন্তু হৃদয়হীন চিকিৎসকের নিষ্ঠুরতার বলি হয়ে অকালে চলে গেলেন, তার মর্মস্পর্শী উপাখ্যানে নিজের অজান্তে চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। বিচারক-মন ন্যায় প্রতিষ্ঠায় ব্যাকুল হয়ে ওঠে। প্রয়োজনীয় কিন্তু ব্রতচ্যুত এই ক্রুর চিকিৎসক-নামক প্রাণীটিকে একাঘ্নী বাণে বিদ্ধ করবার জন্য নিজেকেই অর্জুন বলে ভাবতে ইচ্ছে করে! তাৎক্ষণিক বিচারে দোষী সাব্যস্ত এই পাপীদের শাস্তি মনে আনে অদ্ভুত প্রশান্তি, বিপন্নতাবোধও কি একটু কমে! দেশে চিকিৎসা ব্যবস্থা আদতে একটি ব্যবসা, ধনী আর দরিদ্রের ব্যবধান সেখানে দৃষ্টিকটুভাবে প্রকট। চিকিৎসকরাও সেই ব্যবস্থার অঙ্গ। যে দেশে সংবাদপত্র ভরে কোন স্বাস্থ্যকর বাণী শোনা যায় না, যেখানে লুটপাট, ধর্ষণ, উচ্চপদাধিকারীদের নৈতিক পতনের রসালো বর্ণনায় আমরা অভ্যস্ত, সেখানে চিকিৎসককুল কী করে নিষ্কলঙ্ক থাকবেন তা ভাবা দুষ্কর। তবু যখন প্রিয়জন বিয়োগ-ব্যথা মেনে নিতে পারি না, ব্যবস্থার ত্রুটির চেয়ে চিকিৎসকের ব্যক্তিগত বিচ্যুতি বড় হয়ে দেখা দেয়। মনে মনে ভাবি, চিকিৎসা-ব্যবস্থায় যেন এই বৈশ্য মনোভাব না থাকলেই সব নিখুঁত হত - নিষ্কলঙ্ক আয়েশার ভ্রুযুগলের একতিল খামতি হল এই ভণ্ড চিকিৎসকের উপস্থিতি।
অথচ, চিকিৎসকরা মানুষ- এই সমাজ থেকে রসগ্রহণ করে তারা বেড়ে উঠেছে, তার মূল্যবোধ তারা নিজের অজান্তে শুষে নিয়েছে, এই সমাজের আচরণেই তারা ধীরে ধীরে ঋদ্ধ হয়েছে। শৈশব-কৈশোরের চিকিৎসক বিদ্যায় প্রবেশিকা পরীক্ষার প্রস্তুতির কঠিন লড়াই কি তাহলে তার মনুষ্যত্বকেই নিংডে নিয়েছে? পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে মেডিকেল স্কুলের চৌকাঠ অতিক্রম করার আগেই কি সে নিজেকে ক্রুর, হৃদয়হীন, অর্থঘৃধ্নু, পিশাচে পরিণত করেছে? নাকি ঐ চৌকাঠের পারাপারে বিশেষ কোন যন্ত্রের সাহায্যে তার মূল্যবোধকে পিষে বার করে তাকে অমানবিক পিণ্ডে পরিণত করেছে?এমনও কি হতে পারে আমাদের দৃষ্টিক্ষীণতায় মুদ্রার অপর পিঠ দর্শন করতে পারছি না? অথবা আমাদের ক্রোধ ও ক্ষোভ বিচারক্ষমতাকে এমন পঙ্গু করে রেখেছে যে না-পাওয়ার বেদনার দগদগে ক্ষতচিহ্ন চিকিৎসকের সামান্য স্খলনে ও বিষাক্ত হয়ে ওঠে!
===================================================
ভলতেয়ার বলেছিলেন: সেবিকারা রোগ নিরাময়ের কাণ্ডারী, চিকিৎসক শুধু রোগীর মনোরঞ্জক। পুরনো সিনেমার চিকিৎসকরা যেমন হতেন আর কি! রাগী, ধন্বন্তরী, বেখায়ালী, দানে মুক্তহস্ত, গানে মানবেন্দ্র, গ্রহণে সঙ্কুচিত সেইসব মহাপ্রাণ রূপালী নায়কনায়িকারা স্মৃতির মণিকোঠায় কতই না আবেগের জন্ম দেয়! বর্তমান সমাজে তারা অনুপস্থিত- এ এক নিষ্ঠুর সত্য । তা কি আকস্মিক না অন্যতর কোন গূঢতায় তার মর্মমূল ঢাকা পড়ে আছে? বিশ্লেষণী মন নিয়ে তার অন্তর্নিহিত কারণ নির্ণয় করতে হবে। দু দুটি বিশ্বযুদ্ধের পরে কি মানবিক মূল্যবোধ সারা পৃথিবী জুড়েই ক্ষয়িষ্ণু হয়ে ওঠে নি? আমরা কি মধ্যবিত্ত মূল্যবোধ অকাতরে বিসর্জন দিই নি, সরস্বতীর আবাহনের সংকল্পে কী আমাদের উপমনে লক্ষ্মীর মুখ ভেসে ওঠে না, আমরা কী ঋজু দৃঢ়তায় সারস্বত সাধনার একই রকম একাগ্র? তাই কি সেই শান্ত, সৌম্য, মানবিকতাবোধে দীক্ষিত সমাজের পরিচালকরা সর্বস্তরে দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠেছেন? সে ক্ষয়িষ্ণু মূল্যবোধ চিকিৎসার উদার অঙ্গনকেও রেহাই দেয় নি! যে সমাজে সিদ্ধ পুরুষের ছড়াছড়ি ছিল, সেখানে অর্ধসিদ্ধ কূপমণ্ডুকতার মৈনাক পর্বত। আজকের যুগে বিধাতা পুরুষ যেন প্রতিমার নিঁখুত রূপে দৃষ্টি দিচ্ছেন বেশি করে, তার প্রাণ প্রতিষ্ঠায় তার তেমন আগ্রহ নেই।
প্রয়াত সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় মহাশয়কে অনেকে নিন্দা করেন, নানা বর্ণময় বিশেষণে তাঁকে বামপন্থীরা ভূষিত করেন। আকস্মিকভাবে তাঁর সাথে একবার সাক্ষাতের সুযোগ হয়েছিল। তাঁর সেই প্রহরব্যাপি স্মৃতিচারণ আমার স্বাভাবিক নির্বুদ্ধিতায় লিপিবদ্ধ করি নি কিন্তু জনপ্রতিনিধিদের সম্পর্কে তাঁর দাদামশায়ের যে উক্তিটি তিনি শুনিয়েছিলেন, তা এখনো অমলিন হয়ে আছে। এক প্রায়ান্ধকার সন্ধ্যায় চিত্তরঞ্জন দাশ মহাশয়ের কাছে কোন কৃপাভিক্ষু তাঁর নাতির জন্য এক বাক্স চকোলেট নিয়ে এসেছিলেন, ভদ্র সভ্য মানুষটি ক্রোধে ক্ষিপ্ত হয়ে বাক্সটি আস্তাকুঁডে বিসর্জন দিয়েই ক্ষান্ত হননি, সেই ভিক্ষুকের জন্য চিরতরে তাঁর গৃহদ্বার বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তিনি বলেছিলেন - রাজনীতি করতে এসেছি, সিজার-পত্নীর মত নিষ্পাপ থাকতে হবে। আজকে যাদের আমরা নির্বাচিত করি তাঁরা সকলেই না হলেও বেশির ভাগই সিজারের পত্নীর চেয়ে ম্যাকবেথ-পত্নীর আদলে তৈরি - তাঁদের দুহাতে রক্ত, যা ধুলেও পরিষ্কার হয় না, তাদের উচ্চাশার রথচক্রে সাধারণ মানুষরা আহত, রক্তাক্ত হন। কিম্বা মনে করুন সেই দরিদ্র শিক্ষককে- শিক্ষাদান যাঁর আদর্শ, কাঞ্চনমূল্যেও যা ক্রয় করা যায় না, সেই বিদ্যা দান করেই তার অপার সুখ। গৃহিণীর শিবের সংসারে সব বাড়ন্ত, শুধু হৃদয় দিয়ে ক্ষুধাতৃষ্ণা জয়ী সেই মহাপ্রাণ শিক্ষককূল যেন পৃথিবী থেকে চিরতরে বিদায় নিয়েছেন। অথবা ধরা যাক, কচের মত সঞ্জীবনী বিদ্যালিপ্সু চিকিৎসককূল যাঁরা একদিন ধান্যমুষ্ঠি লাভে করেও খুশি মনে আর্তের সেবা করতেন, তাঁরাও চিরতরে বিদায় নিয়েছেন। তাঁদের জায়গা নিয়েছে সাদা-কুর্তা পেশাদার। মাপা হাসি, পেশাদারি ক্ষিপ্রতা আর চাপা ঠোঁটের ত্র্যহস্পর্শে রোগ নিরাময় হয় কিন্তু রোগীর অটল বিশ্বাস আর আস্থা যেন চিড় খায়। বেশির ভাগ রোগ নিরাময় হয়, বেশির ভাগ মানুষ ফিরে যান নিজ নিকেতনে, আবার তাঁরা বাঁধাঘাটে তরী ভিড়িয়ে প্রাত্যহিকতায় মগ্ন হন, কিন্তু কিছু একটা না পাওয়ার বেদনা আর সুক্ষ্ম অপমানবোধে তাঁদের কুরে কুরে খায়, দিনে দিনে যা পল্লবিত হয়ে ঘৃণার পাহাড়ে তৈরি করে। চিকিৎসকের স্নেহের স্পর্শ যা একসঙ্গে সমীহ ও ভরসা জোগাত তা কবে যেন সবার অলক্ষ্যে বিদায় নিয়েছে। ডা: বিধানচন্দ্র রায়ের চিকিৎসায় সেরে ওঠা এক প্রবীণ মানুষের সাথে আমার সাক্ষাত হয়েছিল তিনদশক আগে। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের অভুতপূর্ব উন্নতির যুগেও তিনি অর্জুন বৃক্ষের ছালের রস খেতেন। তিনি সেই মহাপ্রাণ মানুষটিকে ভুলতে পারেন নি, যাঁর স্পর্শে তাঁর নিরাময় হয়েছিল। সব খাদ্যেই ক্ষুন্নিবৃত্তি হয়, কিন্তু তুষ্টি? সে মায়াবী মারিচের মত জগত থেকে বিদায় নিয়েছে।
সমাজের সর্বস্তরে চিরায়ত মূল্যবোধের এই ক্রমানবতি ও অবক্ষয় কি কোন আকস্মিক সমাপতন নাকি আমরা ধূমায়মান পর্বত নিয়ে চিন্তিত কিন্তু প্রকৃত অগ্নিকে অস্বীকার করতে চাইছি? সমাজ বিবর্তন অন্যতর মূল্যবোধের জন্ম দেয় কিন্তু এ কেমন সমাজ যার যূপকাষ্ঠে জীর্ণবস্ত্রের মত আমাদের যা কিছু মহান, যা মানবিক গুণে সমৃদ্ধ, যা অপরকে কাছে টেনে নেয় তাকে বিসর্জন দিচ্ছি!! এইরকম সমাজে একজন চিকিৎসকের কাছে মানুষের প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির তুল্যমূল্য আলোচনা খুবই প্রয়োজনীয়। রোগীর প্রত্যাশা শুধু নিরাময় নয়, তাঁর দরকার নির্ভরতা, আস্থা, মানবিকতা, সম্ভ্রমপূর্ণ সদ্ব্যবহার। বর্তমান চিকিৎসা পরিকাঠামোতে কি সেটা আদৌ সম্ভবপর? এদেশে চিকিৎসা খাতে ব্যয় অপ্রতুল (মাথাপিছু ৩৯ ডলার) যা এমনকি অনেক অনুন্নত দেশের থেকেও কম। প্রতি হাজারে শয্যা সংখ্যা ০.৮ যা প্রতিবেশী শ্রীলঙ্কার (৩/১০০০) থেকে কম। স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দ জিডিপির মাত্র ১.২ শতাংশ। জনস্বাস্থ্যে খরচের হার মাত্র ৩৩শতাংশ (প্রয়োজন ৭০%), স্বাস্থ্যে ব্যক্তিগত বিনিয়োগ শতকরা ৮০ যার ৭৪% ব্যয় হয় ওষুধ ও সরঞ্জামের জন্য। সরকারি পরিকাঠামোর রোগী-চিকিৎসক সাক্ষাতের গড় সময় ১ মিনিট মাত্র। স্বাস্থ্যের মানোন্নয়নের জন্য যে উপযুক্ত পরিকাঠামো প্রয়োজন তার অভাবের কথা চিন্তা করে সরকার শ্রীনাথ রেড্ডি কমিশন গঠন করেন, যা সাম্প্রতিককালে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ব্যবস্থা বলে বিবেচিত হয়। শ্রীনাথ রেড্ডি কমিশনের সুপারিশ সরকার গ্রহণ করেন নি। সে রিপোর্টে বলা হয়েছিল ২০২২ সালের মধ্যে স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি করে ৩ শতাংশ করতে হবে, ব্যক্তিগত খরচ কমিয়ে ৩৫% করতে হবে ও জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে হবে। দেশে এখন যেখানে স্বাস্থ্য ব্যয়ের বেশিরভাগই বেসরকারি বিনিয়োগ, স্বল্প বিনিয়োগকারী সরকারের পক্ষে বেসরকারী ক্ষেত্রকে নিয়ন্ত্রণ করা প্রায় অসম্ভব ও অবাস্তব। এ দেশে চিকিৎসা ব্যবস্থার আর একটি বড় সমস্যা হল অসম বিন্যাস। চিকিৎসক , হাসপাতাল ও শয্যা সংখ্যার নিরিখে গ্রাম-শহর বিভাজন স্পষ্ট - গ্রামীণ চিকিৎসা ব্যবস্থা সঙ্কটজনক বললেও অত্যুক্তি হয় না। বস্তুত চিকিৎসা নিয়ে মানুষের বাস্তব অভিজ্ঞতা অতীব করুণ ও ভয়াবহ কিন্তু তার মূল দায়ভার কার সেটা নিয়ে খুব জরুরি আলোচনার প্রয়োজন আছে।
==================================================
পৃথিবীর সবদেশের মত এদেশেও চিকিৎসা নিয়ে মানুষের চাহিদা সীমাহীন। পৃথিবীর অন্যতম ধনী ব্যক্তি একজন ভারতীয় হতে পারেন কিন্তু পিঁপড়ের ডিম খেয়ে বেঁচে থাকা মানুষটিও ভারতীয়। চাহিদার নিরিখটিও তাই আলাদা। একই কেন্দ্রে একজন রমণী মা হওয়ার আকাঙ্খা নিয়ে চিকিৎসকের কাছে মাথা ঠুকছেন, সেই কেন্দ্রে অবাঞ্ছিত শিশুকে পৃথিবীর আলো দেখতে না দেওয়ার জন্য অন্য মায়ের আকুতি। একজন খেতে না পেয়ে অসুস্থ, অন্যজন মেদ কমানোর জন্য প্রাণপণে দৌড়াচ্ছে। কিন্তু পরিকাঠামোর অসম বিন্যাস ও অপ্রতুল স্বাস্থ্য পরিকাঠামো এই বহুমুখী চাহিদা পুরণে অক্ষম। চিকিৎসা শিক্ষা-ব্যবস্থাটি ও অন্যতর ব্যাধিতে আক্রান্ত। যে অল্পবয়সী ছাত্রটি মেডিকেল স্কুলের পেষণযন্ত্রে পিষ্ট হয়ে অবশেষে চিকিৎসক হয়ে বেরোচ্ছে, সে এই সমাজ ব্যবস্থার কতটুকু খবর রাখে? যে দারিদ্র পীডিত আর্ত মানুষের সেবায় সে আত্মনিবেদন করতে চায় সে কি তাদের একজন হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়, নাকি সে সমাজের বাইরে উচ্চবর্গের কোন ছদ্মসম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত হতে চায়? সমাজবিজ্ঞান, ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিমুখতা চিকিৎসকের নিজস্ব পছন্দে নয়, বস্তুত চিকিৎসা বিদ্যা এক অন্যতর কলা যা তার অখণ্ড মনোযোগ দাবি করে। অন্য সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সে নিজেকে যোগ্য চিকিৎসক হিসেবে গড়ে তুলতে চায় কিন্তু লড়াই বোধহয় তাকে খানিকটা সমাজচ্যুত করে ফেলে। উত্তর-আধুনিক অণু-পরিবারে শিশুরা বেড়ে ওঠে অসমবয়সী দুটি তিনটি বয়স্ক পরিণত মানুষের মধ্যে। বড় বয়সের সব স্খলন-পতন সে মাতৃদুগ্ধের মত অনায়াসে লাভ করছে। তার কচি অপরিণত মন কোন প্রশ্ন ছাডাই তা আত্মস্থ করছে। একাকী স্বার্থপর আবহাওয়াই বেড়ে ওঠা সেদিনের সেই শিশুই এই সমাজে তার সব প্রাপ্তি সবৃদ্ধিমূলে সমাজকে ফিরিয়ে দিচ্ছে। পেশা হিসেবে শুধু চিকিৎসক নয়, সমাজের সর্বত্র আমাদের ব্যক্তিগত সঙ্কট সমষ্টির রূপ ধরে গোটা সমাজকেই ব্যাথিত করে তুলছে। চিকিৎসকদের ক্ষেত্রে সমস্যাটি যে আরো প্রকট কারণ তার যমের বিরুদ্ধে অসম সংগ্রাম। সে লড়াইয়ে হারজিতের সমান সম্ভাবনা। সে সম্ভাবনা অনেকসময়ই সাধারণ সূত্র মেনে চলে না। সে যুদ্ধে হারলে তার সমস্যাটি আরো ঘন হয়ে ওঠে কারণ অধীত কেতাবী বিদ্যার বাইরে তার দক্ষতা কম, সে অন্য কোন বিষয়ে সহজ সরল আলোচনার বদলে তার বিশেষ পারঙ্গমতা নিয়ে বেশি চিন্তিত। দক্ষ নাবিক সে কিন্তু সমুদ্রের আবহাওয়া বিদ্যা তার করায়ত্ব নয়। সে সহজেই উচ্চমানের চিকিৎসা দেয় কিন্তু রোগীর সাথে ভাব বিনিময়ে তার স্পষ্ট অনীহা। "আপনি বুঝতে পারবেন না" তখনই বলতে হয় যখন যিনি বুঝতে চান আর যিনি বোঝাতে চান তাঁদের বিপরীতমুখী মনোভাব ও উদ্দেশ্য থাকে। রোগী-চিকিৎসক সম্পর্ক মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে মনে হয় দাতা ও গ্রহীতার সম্পর্ক অহেতুক জটিল হয়ে রয়েছে। ভাবের অভাবই সবচেয়ে বড় সমস্যা। রোগীর সীমাহীন ও কখনো কখনো অবাস্তব প্রত্যাশার সাথে চিকিৎসকের নিরাসক্ত অতি পেশাদারিত্ব রোগী-চিকিৎসক মধুর সম্পর্ককে দুষিত করে ফেলে। চিকিৎসকের চুড়ান্ত পেশাদারিত্ব হয়ত এখনো মন থেকে মেনে নেওয়া এই সমাজের পক্ষে এখনো অত সহজ নয়। তারা যদি আরো বেশি সময় দিয়ে আরো ভাব বিনিময় করেন, তাহলে জটিলতা কমতে পারে।
চিকিৎসক যে রোগীর সাথে স্পষ্ট ও অবাধ আলোচনা করেন না, তা বহুলাংশে সত্য। এদেশের বেশির ভাগ রোগী ইওরোপের মত নন- তাঁরা তাঁদের রোগের একটি নিজস্ব ব্যাখ্যাও চটজলদি দিয়ে দেন, তা যত অবৈজ্ঞানিকই হোক না কেন এবং তা চিকিৎসকের ধারণার সাথে না মিললে এক ধরণের সংঘাত তৈরি হয়, খুব লঘু হলেও তা রোগী-চিকিৎসক সম্পর্কে সুক্ষ্মতর প্রভাব ফেলে। জঁ দ্রেজ "an uncertain glory" বইটিতে লিখেছেন যে আমাদের দেশে বিদ্বৎসমাজ স্বাস্থ্য নিয়ে আলোচনা করতে তেমন উৎসাহী নয়। তিনি ২০০০ ও ২০১২ সালে নামকরা সংবাদপত্রের স্বাস্থ্য বিষয়ক আলোচনার একটি হিসাব দিয়েছেন যেখানে দেখা যায় যে সংবাদপত্রের উত্তর সম্পাদকীয়র মাত্র ১ শতাংশ স্বাস্থ্য বিষয়ক আলোচনাই ব্যয় হয়। দেশের পার্লামেন্টেও স্বাস্থ্য বিষয়ে আলোচনা তেমন গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করতে ব্যর্থ হয়। অথচ, চিকিৎসা ত্রুটির অনুপুঙ্খ মাঝে মাঝে সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। চুলচেরা বিশ্লেষণে চিকিৎসকের ভুলের ফিরিস্তি লেখা হয়। অম্লানবদনে লেখা হয়ে যায়, প্রসব করাতে গিয়ে রোগীর মাথা ছিঁড়লেন ডাক্তার, বা মৃত মানুষকে যান্ত্রিক শ্বাসযন্ত্রে রেখে অর্থপিশাচ ডাক্তার হাসপাতালের বিল বাড়াচ্ছেন- ইত্যাকার কাহিনির রোমহর্ষক বিবরণ পড়ে চিকিৎসকের সামাজিক সম্মানহানি করে তাকে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয় কোন দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছাড়াই! "চিকিৎসায় ত্রুটি" সংবাদপত্রের পাতায় আলোচ্য হতে পারে না, তা মেডিকেল স্কুলের চৌহদ্দির মধ্যে আলোচনা করা দরকার- সে ভুল হয়ত কোন প্রাণ অকালে কেড়ে নিয়েছে কিন্তু তা ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত খুন হতে পারে না- চিকিৎসক মানুষ মারার প্রশিক্ষণ নেন নি, মানুষকে বাঁচানোই কার ব্রত। ভুল ভ্রান্তি সব পেশার আছে, মহামান্য আদালতেরও ভুল হয়, সে error of judgement, খবরের কাগজের আলোচ্য হওয়ার বদলে আইনী জার্নালের আলোচ্য হওয়া উচিত। চিকিৎসকের ভুলও নিছক ভুল - সংবাদপত্র তার সঠিক স্থান নয়, মেডিকেল জার্নালে তার চুলচেরা বিশ্লেষণ হওয়া দরকার।
রেজাউল করিম
সাম্মানিক সভাপতি
ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টর্স ফোরাম
কলকাতা