এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  আলোচনা  বিবিধ

  • অলীক

    মো. রেজাউল করিম লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বিবিধ | ২০ জুন ২০২০ | ১৯৫৬ বার পঠিত
  • আরিফ আহমেদ- কর্মক্ষেত্রে আরিফ সাহেব নামেই পরিচিত। এনজিওপ্লাস্টি সার্জারি শুরুর আগে অপারেশন টেবিলে খুব কম সময়ই সজাগ ছিলেন তিনি। সে সময়টুকু ছিল ভিন্ন এক অনুভূতি।
    জীবন তাঁর একরকম বৈচিত্র্যহীনই বলা যেতে পারে। ত্রিশ বছর বয়সে বিয়ে করেছেন। এখন পঞ্চাশ। ছাত্রজীবনে স্কুলে ‘আমার জীবনের লক্ষ্য’ রচনা লিখতে দেয়ায় তিনি লিখেছিলেন শিক্ষকতা করা তাঁর জীবনের লক্ষ্য। শিক্ষকতা পেশাতেই নিজেকে নিয়োজিত করতে পেরেছেন। বেসরকারি কলেজে চাকরি নিয়েছিলেন। পরে কলেজটি সরকারি হয়েছে। স্ত্রী ও দুই ছেলে নিয়ে সংসার। ছেলে দুটোও তাঁর মতোই, অনেকটা সাদাসিধে প্রকৃতির।
    অপারেশন টেবিলে শুয়ে যেটুকু সময় পেয়েছিলেন, সে সময়টুকুতে সামান্য কিছু ভাবার সুযোগ পেয়েছিলেন। অদ্ভুত এক ভাবনা তাঁর মনকে আচ্ছন্ন করেছিল সে সময়। সুস্থ হয়ে উঠলে, দেখা হয় না এমন মানুষগুলোর সাথে দেখা করবেন তিনি।
    সুস্থ হয়েছেন। দীর্ঘ ছুটিতে শুয়ে-বসে তিনি চিন্তা করেন পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠলে তিনি দেখা করবেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ক্লাস-বন্ধু টিপু ও হোসেনের সাথে। দেখা করবেন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ক্লাস-বন্ধু বাবু, টেংকু ও মোহনের সাথে। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে যাদের সাথে ঘনিষ্ঠতা ছিল তাদের সাথে মোটামুটি যোগাযোগ আছে। ব্যাচেলর জীবনে রহিমা খালা রান্নাবান্না করে দিতেন। তাঁকে খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। তবে শাহাদাত নামে ছেলেটি সপ্তাহে দুদিন এসে ধোয়া কাপড়গুলো ইস্ত্রী করে, জুতোজোড়া পালিশ করে, ঘরের আসবাবগুলো গোছগাছ করে রেখে যেত- তাকেও দেখতে মন চায়। ওর বাড়ি কুমিল্লার লাকসামে। ঠিকানা ছিল- হারিয়ে গেছে। গ্রামের নামও মনে নেই। সে আমলে তো মোবাইল ফোনও ছিল না। তাকে বোধ হয় খুঁজে পাওয়া সম্ভব না। বিয়ের পরে বাসায় অনেক গৃহকর্মী ছিল। আরিফ সাহেবের স্ত্রীর সাথে কেমন করে যেন তাদের বেশ মানিয়ে যেত। তাদের প্রায় সকলেই দুই থেকে পাঁচ বছর ছিল। তাদেরও কাউকে কাউকে দেখতে মন চায়। স্ত্রীকে পুরো বিষয়টা বলেন তিনি। স্ত্রী আশ্বাস দেন, কয়েকজনের সাথে মোবাইল ফোনে কথা বলিয়ে দিবেন। আরও একজনের সাথে দেখা করতে মন চায়। তার নাম স্ত্রীকে বলতে পারেন না। বলা সম্ভবও না।

    তখন আরিফ সাহেবের বাবা কুষ্টিয়ার আলমডাঙ্গা রেলস্টেশনের মাস্টার ছিলেন। স্টেশন-সংলগ্ন ছোট্ট কোয়ার্টারেই তারা থাকত। আরিফ আহমেদ তখন দশম শ্রেণির ছাত্র। কোয়ার্টারের পেছনে গ্রাম। সেখানকার ছেলেদের সাথে মিশতে বারণ করতেন বাবা। বাবার ধারণা গ্রামের বেশিরভাগ পরিবারের সংস্কৃতি, আচার-আচরণ শহুরে সংস্কৃতির সাথে মেলে না। পদোন্নতি হওয়ায় অনিচ্ছা নিয়েই কুষ্টিয়া কোর্ট স্টেশন থেকে এখানে চাকরি করতে এসেছেন। বদলির জন্য চেষ্টাও করেছেন। কিন্তু হয়নি। তিন বছরের আগে হবেও না। তাদের বাসার সামনে দিয়ে সারি বেঁধে মেয়েরা স্কুলে যেত। দলের একটি মেয়ে চোখগুলো বড়ো বড়ো করে আরিফের দিকে তাকাতো। শ্যামলা রঙের সুশ্রী মেয়েটির চোখেই ছিল জগতের সব সৌন্দর্য। আর সেই চোখে আরিফের দিকে বারবার তাকানোতে তার কিশোর মনেও দোলা লাগত। ঐ বয়সে সেটাই ছিল স্বাভাবিক।
    আরিফ সুলেখার যোগাযোগ রাস্তায় স্বল্প সময়ের জন্য কথা আর চিঠি পর্যন্ত গড়িয়েছে, তার বেশি না। রেলস্টেশন আর সুলেখার গ্রাম পদুয়ার মধ্যবর্তী স্থানে পথের ধারে তমাল গাছতলায় আরিফ সামনে বিস্তৃত জলাভূমি বা বিলের ধারে পানির দিকে তাকিয়ে বসে থাকত। সেখানেই সুলেখার আর তার বোন সুনেত্রার সাথে দেখা হতো। হাঁটু অবধি পানিতে ছেলেমেয়েরা ডাঁটাশুদ্ধ শাপলা ফুল পানি থেকে তুলে মাটির রাস্তায় এনে রাখছে। ফুলগুলো ছিঁড়ে ডাঁটাগুলো দলা পাকিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। পানির মধ্যে দুটো কোষা নৌকায় দুজন লোক মাথায় গামছা দিয়ে ছিপ ফেলে সুতোর সাথে বাঁধা ভাসমান কলের দিকে ঠাঁয় তাকিয়ে আছে। একটু নড়লেই চিলের মতো ছোঁ মেরে সপাং করে সুতোয় টান দিচ্ছে। ঐ একজন মাছ-সমেত সুতো তুলেছে। সুতোর আগায় বড়শিতে বাঁধা শামুকের শরীরের খণ্ডিতাংশ খেতে গিয়ে বড়শি মাছটার ঠোঁটে আটকে গেছে। একটা পুঁটিমাছ তিরবির করে লাফাচ্ছে। লোকটা পরম যত্নে বড়শি থেকে মাছটাকে খুলে পাশে রাখা অ্যালুমিনিয়ামের বদনায় পানির মধ্যে রেখে দিল। বাড়ি ফিরে মায়ের সাথে কথা বলে জানতে পারল, শাপলা ফুলের ডাঁটা কেন ছেলেমেয়েরা নিয়ে যায়? ওগুলো ওদের বাড়িতে রান্না করে খায়। খুব স্বাদের না, তাই বাবা ওগুলো বাজার থেকে আনেন না। ওরা গরিব মানুষ, বিনে পয়সায় পায়, তাই খায়। ওরা পানির তলা থেকে পেয়ারার মতো কী যেন তুলে ভেঙে ওর ভেতরকার কালো রঙের সরিষার মতো দানাগুলো ওরা খায়। ওগুলো সম্পর্কেও মায়ের কাছ থেকে জানতে পারে। গ্রামের লোক ওগুলোকে ঢ্যাঁপ বলে। সেই বয়সেই আরিফের কাছে ধনী, মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র মানুষের মাঝে পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সে বুঝতে পারে গ্রামের ছেলেপুলের সাথে বাবার নিষেধ করার পেছনে যে চিন্তা রয়েছে তা হচ্ছে, সমাজে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের মধ্যকার আন্তঃসম্পর্কের ভিন্নতা।
    এইচএসসিতে আরিফ প্রথম বিভাগে পাস করলে আরিফের বাবা বললেন, ‘বাবার জমি বিক্রি করে হলেও ওকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াব।’ আরিফ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষায় টিকে গেল। ততদিনে আবারও কুষ্টিয়াতে তার বাবার বদলির খবর চলে এল। শেষ দেখা হয়েছিল কলেজে। অশ্রুসজল সুলেখার চোখে অবিরত পানি। সুলেখার বোন সুনেত্রাও কাঁদছে। অনির্ণীত-অনিশ্চিত ভবিষ্যতের চিন্তায় আরিফও যেন কথা বলার শক্তি হারিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে দুমাস যেতেই আরিফ চিঠি পেল। সেই একই কাগজে পরিচিত লেখা কাগজের ওপরে ছাপানো লেখা- ‘মনে রেখ, ভুলো না আমায়’। কাগজের মধ্যে দুটো কামিনী পাতা, আর পাতার মাঝে লোহিত বর্ণের গোলাপ পাপড়ি। সংক্ষিপ্ত চিঠি, ‘যত দ্রুত পার আস, বাবা বিয়ে ঠিক করছেন। আমি তোমারই অপেক্ষায়।’
    আরিফের কক্ষে তখন কেউ নেই। চিঠিটি পড়ে আকাশ-পাতাল অনেক কিছুই চিন্তা করল। কোনো সমাধান খুঁজে পেল না। ঘর থেকে বের হয়ে হলের সামনে পুকুরপাড়ে বকুল গাছতলায় কিছুক্ষণ বসে থাকল। সামনে বেশ বড়ো পুকুরটা। সুলেখার অপেক্ষায় একসময় রেলস্টেশনের পেছনে জলাভূমির পাশে তমাল গাছতলায় বসে থাকত সে। তবে সে সময় ছিল অপেক্ষার যন্ত্রণা। আর এখন হতাশায় আকীর্র্ণ অন্ধকার। মনের গহনে সুলেখার অস্তিত্ব। বাস্তবতায় দিশাহীন রুদ্ধদ্বার। দু’বছর আগে মা বলেছিলেন, সে কথাটাই কানে বাজছে, “তোর বিয়ের বয়স হতে এখনও ঢের বাকি। ওরা গ্রামের মানুষ। ঐ মেয়ের বাবা ওর বিয়ে দিল বলে। আর সমাজের কথা ভেবেছিস একবারও? খামাখা মনের মধ্যে ক্ষত সৃষ্টি করে কী হবে রে?” বিকেল গড়িয়ে সাঁঝের আঁধার গোটা পৃথিবীকে যেন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরছে। বেশ খানিকটা দূরে হলের বিভিন্ন ঘরে বাতিগুলো জ্বলে উঠছে। বকুলতলায় আর বসে থাকা হলো না। দলছুট পরাজিত অস্ত্রবিহীন সৈনিক অন্ধকার খোঁজে লুকিয়ে থাকার জন্য। তানভীরের সে সুযোগও নেই। নিজেকে পরাজিত অস্ত্রবিহীন সৈনিকই মনে হচ্ছে। কিন্তু ফিরে যেতে হচ্ছে একদঙ্গল সঙ্গী-সাথির মাঝে। ক্লাসে তো দূরের কথা রুমমেটকেও সে সুলেখার কথা বলেনি।
    ঘরে ঢুকতেই রুমমেট শফি একসাথে অনেক প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল, ‘কী-রে এতক্ষণ কই ছিলি? তোর চেহারা এমন হয়েছে কেন? বাড়ি থেকে কোনো খারাপ খবর এসেছে নাকি?’
    ‘না।’
    তো! তোর চেহারা এমন দেখাচ্ছে কেন?’
    আরিফ ধীরে সুস্থে কাপড়-চোপড় খুলে বাথরুমে গেল। দ্বিতীয়বারের মতো গোসল করল। গোসলের পর রাজ্যের ক্লান্তি যেন শরীরে ভর করল। সন্ধ্যেবেলাতে সে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নেবে ভেবেছিল। কিন্তু বিছানায় শুয়ে থাকলেও অশান্ত মন তাকে ঘুমাতে দিল না। তার অস্থিরতা দেখে শফি বলল, ‘দোস্ত, সত্যি করে বলত, কী হয়েছে তোর?’ চাপা স্বভাবের আরিফ অস্থির-অশান্ত মন নিয়েও নিজের জীবনের একান্ত গোপন ঘটনা বন্ধুর কাছে চেপে গেল। সে জানে, সুলেখাকে চিঠি দেয়ার কোনো উপায় নেই। দেখা করা? কী লাভ? সুলেখাকে নিয়ে পালিয়ে বিয়ে করার সাহস আরিফের নেই। উনিশ বছরের একটা ছেলে কিভাবে বাবাকে বলবে যে সে বিয়ে করবে? ধর্মীয় বাধাতো আছেই।
    আরিফের জীবন থেকে সুলেখাপর্ব সেখানেই শেষ হয়ে গেল।
    অপারেশন টেবিলে ক্ষণিকের জন্য আরিফ সাহেব ভেবেছিলেন, সুস্থ হলে দেখা হয় না এমন মানুষগুলোর সাথে দেখা করবেন। সার্জারির পরে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে মনে মনে তালিকাও তৈরি করেছেন কার কার সাথে দেখা করবেন। সেই তালিকায় এক নম্বরে রয়েছে সুলেখা। মনের তালিকায় এক নম্বরে থাকলেও সুলেখার সাথে দেখা করা হয়ে ওঠে না। সার্জারির পরে গত এক বছরে একে ওকে ফোন করে পুরনো দিনের বেশ কিছু বন্ধুর সাথে কথা বলেছেন, দেখাও করেছেন। স্ত্রীর সহায়তায় দুজন গৃহকর্মীর সাথেও ফোনে কথা হয়েছে। একজন দেখাও করে গেছে। কিন্তু মনে আছে সুলেখাকে দেখার ইচ্ছে। কুষ্টিয়ার পৈত্রিক বাড়িতে ছোটো ভাই আছে।
    এভাবেই বছর পার হয়েছে। আরিফ সাহেব অবশেষে কুষ্টিয়া হয়ে আলমডাঙ্গা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। পৈত্রিক বাড়িতে ছোটো ভাইয়ের সাথে দেখা করতে যাওয়ার কথা বলেই ঢাকা থেকে বের হলেন। সাথে স্ত্রী রানু ও ছেলেরাও আছে। স্ত্রীর অনিচ্ছ্বাসত্বেও একাকীই একদিন আলমডাঙ্গার পথ ধরলেন। ত্রিশ বছর আগে এ পথে কালো রঙের কয়লার স্টিম-ইঞ্জিনচালিত রেল ঘন ধোঁয়া উদগীরণ করে হুশহুশ শব্দ করে চলত। এখন আর ওগুলো নেই। কুষ্টিয়া থেকে অটোরিকশায় করে পোড়াদহ। ইন্টারসিটি ট্রেন যখন চালু হলো তখন আলমডাঙ্গায় থামত না। এখন সব উপজেলাতেই ধরে। পোড়াদহ থেকে খুলনাগামী ইন্টারসিটি ট্রেনে উঠে আলমডাঙ্গা নামলেন। মাত্রই এক ঘণ্টার পথ।
    স্টেশনটা ঘুরে ঘুরে দেখলেন। ত্রিশ-বত্রিশ বছরের ব্যবধানে সেই পুরনো দিনের স্টেশনটি আরও জীর্র্ণ হয়েছে। বরং আরও নোংরা হয়েছে। বয়সের ভারে ন্যুজপ্রায়। ভাঙাচোরা প্লাটফরম, লাল রঙা ঢেউ খেলানো টিনের ছাউনি, প্লাটফরমে যাত্রী না থাকলেও অসংখ্য হকার। প্লাটফরমের একদিকে গাছ-গাছড়ার ঔষধ বিক্রেতা মজমা জমিয়েছে। অপরদিকে বন্ধ টং-ঘরের সামনে জনা কয়েক দরিদ্র মানুষ বেলা এগারোটায় ঘুমোচ্ছে। রাতের বেলায় ওরা কী করেছে কে জানে। তবে স্টেশন মাস্টারের ঘরের দেয়ালে টাইলস লাগিয়ে নোনা ঠেকানো কিংবা সৌন্দর্য বর্ধনের চেষ্টা করা হয়েছে। স্টেশন মাস্টারের কোয়ার্টার পোড়ো বাড়ির রূপ নিয়েছে। ত্রিশ বছর আগে স্টেশনে একটা বুকশপ আর একটা রকমারি দোকান ছিল। বুকশপে খবরের কাগজও পাওয়া যেত। এখন বুকশপটি নেই। টেলিভিশন আর ইন্টারনেটের যুগে বইয়ের চাহিদা হয়ত আর নেই। রকমারি দোকান একটি ছিল, এখন হয়েছে দুটি। চা-সিঙ্গারার দোকান প্লাটফরমের বাইরে থেকে ভেতরে চলে এসেছে।

    স্টেশনটি বেশ উঁচুতে। প্লাটফরম থেকে কয়েক ধাপের সিঁড়ি দিয়ে পেছনের গ্রামে যাওয়া যায়। সিঁড়ি দিয়ে ধীরে ধীরে নেমে পদুয়া গ্রামের রাস্তা ধরলেন আরিফ সাহেব। বত্রিশ বছরের ব্যবধানে সেই সরু মাটির রাস্তাটি আর নেই। পিচের রাস্তায় রিকশা চলছে। রিকশা মিটিয়ে নিলেন ঘণ্টা তিনেকের জন্য। রাস্তার ডান পাশের বিস্তীর্র্ণ জলাভূমি তার চেহারা পাল্টেছে। দিগন্ত বিস্তৃত জলাভূমি আর নেই। এখানে সেখানে মাটি উঁচু করে ঘর তোলা হয়েছে। জলাভূমির যেটুকু অবশিষ্ট আছে সেখানেও এই ভরা বর্ষাতে হাঁটু পানি। পানিতে কচুরীপানা দেখা যায়, কিন্তু পদ্ম কিংবা শাপলার অস্তিত্ব নেই। মাছ আছে কিনা কে জানে? রিকশা এগিয়ে যাচ্ছে। তিনি খুব সতর্ক দৃষ্টি রেখেছেন। পোড়ো শিব মন্দিরটি এখনও তার অস্তিত্ব ধরে রেখেছে, কিন্তু তমাল গাছটি নেই। রাস্তা নির্মাণের প্রয়োজনেই হয়ত গাছটি কেটে ফেলা হয়েছে, কিংবা মরেও যেতে পারে- কে জানে?
    পদুয়া গ্রামের প্রবেশমুখে বেশ কতক রকমারি দোকান হয়েছে, আগে এগুলো ছিল না। রিকশা থেকে নেমে একটি দোকানে বসলেন। প্রায় প্রতিটি দোকানেই চায়ের ব্যবস্থা আছে। থার্মাল ফ্লাস্ক থেকে গরম পানিতে টি-ব্যাগ দিয়ে চা বানিয়ে দিল ছেলেটি। চা খেতে খেতে দোকানদার ছেলেটিকে সুলেখার বাবা শ্যামল সাহার হদিস জানতে চাইলেন আরিফ সাহেব। ছেলেটি জানাল সে চেনে না। ছেলেটি প্রায়বৃদ্ধ এক মানুষকে ডেকে আরিফ সাহেবের সাথে কথা বলতে বলল।
    আরিফ সাহেব বললেন, ‘ভাইজান, পদুয়া গ্রামের শ্যামল সাহাকে চেনেন?’
    বৃদ্ধ অবলীলায় জিগ্যেস করলেন, ‘পরিচয়?’
    ‘আমার বাবা ত্রিশ বছর আগে আলমডাঙ্গা রেলস্টেশনের মাস্টার ছিলেন। তখন শ্যামল বাবুর সাথে আমাদের জানাশোনা ছিল।’
    ‘বাজারে পানের আড়তদার শ্যামল সাহা?’
    ‘জ্বি, জ্বি।’
    ‘তা তাইনেকে দিয়ে আপনার এহন কী কাম?’
    আরিফ সাহেব এই বয়সেও মিথ্যে বলতে বাধ্য হলেন। বললেন, ‘আমি একটা এনজিওতে চাকরি করি। এই অঞ্চলে আমরা কাজ শুরু করব। ভাবছিলাম একজন পরিচিত মানুষ থাকলে তার সাথে যোগাযোগ রেখে কাজকর্ম শুরু করলে সুবিধা হবে।’
    ‘তাইনে তো মরছে দুই যুগ আগে। হের ইসতিরি কয়েক বছর বাদেই মরছে। তয় মাইয়াগো বিয়া দিয়া মরছে।’
    ‘মেয়েরা এখন কোথায়, জানেন নাকি ভাইজান?’
    ‘ছোটোডারে বিয়া দিছে কুষ্টিয়া। তারে তো বছর দশেক দেহি না। আর বড়োডার অবস্থা বিশেষ ভালা না। বড়োডার বাচ্চা হওনের বছরই হের স্বামী মইরা যায়। বাপে তো মাইয়াগোর জন্য কিছু রাইহা যায় নাই। শ্বশুরবাড়িতেও জায়গা হয় নাই। অহন গ্রামেই বাপের ভিটায় থাহে সে। স্বামী নাই। একটা পোলা। সেলাই ফোরাই কইরা কিছু কামাই-রোজগার করে। ভিটাত শাকসবজি হয়। কোনো রহমে বাঁইচা আছে আর কী।’
    মনের গহনে এক বছর সঞ্চিত আরিফ সাহেবের সব উদ্যম মুহূর্তেই উবে গেল। চিন্তার অন্তর্জালে সুতাগুলো যেন জট পাকিয়ে গেল। ভাবলেন, সুলেখার সাথে দেখা করার ইচ্ছাটা কি সঠিক ছিল? তিন বছর মন দেয়া-নেয়া করে হাত ধরাধরি কিংবা ছাড়াছাড়ির সময়ে তার চিঠির উত্তরটি পর্যন্ত দেয়া হয়নি। একবার এসে দেখা করে বলেও তো যেতে পারত এ হবার নয়। কৈশোরের অপরিণত চিন্তাজাত সম্পর্ক পূর্ণাঙ্গতা পায় খুব কম ক্ষেত্রেই। পরিবার ও সমাজের বাধাও ছিল দুর্লঙ্ঘনীয়। আজ যদি সুলেখার স্বামী বেঁচে থাকতেন, তাহলেও কী তাদের বাসায় যাওয়া শোভন হতো? এখন যদি যায়ও কেন যাবে? সুলেখাও হয়ত বাল্যপ্রেমের কথা ভোলেনি। তো? ক্ষণিকের দেখা কেন? তিনি জীবনের এক ক্রান্তিকালে, বিশেষ এক মুহূর্তে চিন্তাটা করেছিলেন। সেটা কি সঠিক ছিল নাকি অলীক ছিল? সুলেখার কাছে সেই চিন্তা কি আদৌ মূল্যায়িত হবে? তার বাসায় গেলে পড়শিরা কী বলবে, কোন চোখে দেখবে? সুলেখার জীবনে নতুন বিড়ম্বনা এনে কী ফায়দা হবে? গিয়ে যদি দেখে সকালে খেলেও মা-ছেলের দুপুরের অন্নের ব্যবস্থা নেই- তাহলে? কিশোরী সুলেখার সেই চঞ্চলতা-চপলতার লেশমাত্র নিশ্চয় তার মধ্যে নেই, বরং দেখতে হবে জীবনযুদ্ধে ক্লান্ত-বিপর্যস্ত মধ্যবয়স্কা এক রমণীকে । শারীরিকভাবে আরিফ সাহেব খারাপ বোধ করলেন। দোকানদার ছেলেটার কাছ থেকে চেয়ে এক গ্লাস পানি খেলেন। কিন্তু মনে হলো বুকের বাম পাশটা চেপে ধরছে যেন কেউ। মাথাটা ছিঁড়ে যাচ্ছে। ছেলেটাকে বলে দোকানের সামনে চারটা বাঁশের খুঁটির ওপরে কাঠের একটা তক্তা দিয়ে বানানো বেঞ্চে শুয়ে পড়লেন ।
    বুড়া মিয়া ও দোকানদার ছেলেটা দুজনেই উঠে আসল তাঁর কাছে। আরিফ সাহেব তখন অচেতন। মুখে, মাথায় পানি ছিটিয়ে দিল ছেলেটা। ততক্ষণে দোকানের সামনে ভিড় তৈরি হয়েছে। কে একজন এগিয়ে এসে হাতের কব্জিতে পালস দেখে বলল, ‘বাঁইচি আছে। শীগগিরি হাসপাতালে নিয়া লাগবি।’
    একটা রিকশাভ্যান থামিয়ে কয়েকজন ধরাধরি করে আরিফ সাহেবকে তুলে নিয়ে ভ্যান হাসপাতালের দিকে ছুটে চলল। বেলা তখন একটা। হাসপাতালে তখনও চিকিৎসকরা আছেন। তাঁদের একজন পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে প্রথমদিকে যে কল নাম্বারগুলো আছে, সেগুলোর মধ্য থেকে সুবিধাজনক মনে করে একটাতে ফোন দিলেন তিনি। ফোন ধরলেন রফিক সাহেবের ছোট ভাই। সে তো আশ্চর্য। বড়ো ভাই স্টেশনে যেতে চেয়েছিলেন। গ্রামে কেন গেলেন? তিনি চিকিৎসককে বললেন, ‘ডাক্তার সাহেব, আপনাদের কী মনে হচ্ছে?’
    ‘আমাদের মনে হচ্ছে, হার্ট অ্যাটাক করেছে। তার রেসপিরেশনের চেষ্টা চলছে।’
    ‘আপনি কী পরামর্শ দেন? কী করতে পারি? আপনাদের অ্যাম্বুলেন্স আছে?
    ‘আছে, কিন্তু নষ্ট। কুষ্টিয়া যেতে পারবে না।’
    ‘আমরা এখানে থেকে গাড়ি নিয়ে গিয়ে আনতে তো অনেক সময় লাগবে। যত টাকাই লাগুক আমি বিকাশ করে টাকা পাঠিয়ে দিচ্ছি। ওনার সাথে একজন ব্রাদার বা গ্রামের কোনো ছেলেকে দিয়ে কি পাঠিয়ে দেয়া যাবে কুষ্টিয়াতে?’
    ‘আপাতত অক্সিজেন ছাড়া তাকে স্থানান্তর করা যাবে না। আমাদের সাধ্যমতো যতটুকু করা যায় করব। লাইফ সাপোর্ট সরঞ্জাম আছে এমন কোনো অ্যাম্বুলেন্স আলমডাঙ্গাতে পাওয়া যাবে না। কুষ্টিয়াতে বেসরকারি হাসপাতালে পাবেন। অমন একটি অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে আপনারাই দ্রুত চলে আসেন।’
    তখন বিকেল। সাঁঝের আলো ম্রিয়মাণ। কিছুক্ষণের মধ্যেই আঁধারের চাদর জেঁকে বসবে। আরিফ সাহেবের স্ত্রী অ্যাম্বুলেন্সের মাঝের সিটে উঠে বসলেন, পাশে দেবর। পেছনে রইল সাদা কাপড়ে মোড়ানো অলীক স্বপ্নের ফেরিওয়ালা আরিফ আহমেদ এর ডেডবডি। অ্যাম্বুলেন্স ছুটে চলল গড়াই নদীর তীরে কুষ্টিয়া অভিমুখে- আরিফ সাহেবের জন্মস্থান।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • আলোচনা | ২০ জুন ২০২০ | ১৯৫৬ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • বিভু তলাপাত্র | 45.9.***.*** | ২১ জুন ২০২০ ০৫:৩৯94503
  • দেবদাস এর ছোঁয়া পেলাম যেন 

  • মো. রেজাউল করিম | ১৮ জুলাই ২০২০ ২১:৪০95302
  • তাই? তবে লেখার সময়ে দেবদাসের থিম মাথায় ছির না। যেটি ছিল, তা হচ্ছে, মানুষ জটিল রোগাক্রান্ত হয়ে অপারেশনে যাওয়ার আগে, কিংবা বৃদ্ধ বয়সে ফেলে আসা দিনগুলো নিয়ে ভাবে।

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। হাত মক্সো করতে প্রতিক্রিয়া দিন