পঁচিশে নভেম্বরের সন্ধ্যা, প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটি। হাঁ করে তাকিয়ে ছিলাম এক হিম্মতওয়ালীর দিকে। তাঁর পাশে বেবী হালদার। আলপনা মন্ডলের পূর্বজা। ২০০২ সালেই ওরই "আলো আঁধারি" গিলেছিলাম গোগ্রাসে। সত্যিকারের সাবল্টার্ণ সাহিত্য। সম্মানজনক দূরত্বে দাঁড়িয়ে পিঠ চাপড়ানো নয়। সেই বইয়ের অনুবাদ হয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায়। আরো দুটি বই লিখেছেন বেবি। সেগুলোও সমান আদৃত।
নিজের জীবন সংগ্রামের কথা নিজের অনুভূতি জড়িয়ে পেশ করার মতো আর কিছু হয় না। কিন্তু সেরকম সংগ্রাম অনেক মানুষের থাকে, জীবনের গাঁদ চিনিয়ে দেওয়ার কাজ করে তাদের লেখা আর সেই সুবাদে তাদের মানসিক উত্তরণ। কিন্তু রাষ্ট্রের দাঁত আর নখের সামনে নিজের সাহস বজায় রেখে লড়া, চূড়ান্ত শারীরিক অত্যাচার আর ধর্ষণের ট্রমা কাটিয়ে সমাজ বদলানোর লড়াই লড়া, সে একেবারে অন্য স্তরীয় ব্যাপার। আমি তো জানি এক শ্রদ্ধেয় ইলা মিত্রকে আর এই হিম্মতওয়ালী ছত্তিসগড়ের সোনি সোরিকে।
কলকাতায় এসেছিলেন সোনি এনজিও আপনে আপ ওয়ার্ল্ড ওয়াইডের সেমিনারে যোগ দিতে। প্রফেসর ক্যাথরিন ম্যাককিনন, মালিনী ভট্টাচার্য, শমিতা সেন, বাংলাদেশের এডভোকেট সালমা আলি, এক্টিভিস্ট মালেকা বেগম রুচিরা গুপ্তারাও ছিলেন। শেষের জন উদ্যোক্তা। বিষয় ছিল শিশু শ্রম, নারী পাচার আর "দ্য লাস্ট গার্ল।" এই লাস্ট গার্ল বা সবশেষের মেয়েটি কে? সে হচ্ছে সেই হতভাগ্য টিন এজ মেয়ে যে হতদরিদ্র ঘরের সন্তান, নীচকুলোদ্ভব আর তার ফলে ট্রাফিকারদের কাঙ্ক্ষিত শিকার।
দ্বিতীয় দিনের দ্বিতীয়ার্ধে দেখি প্রথম সারিতে রুচিরা গুপ্তার পাশে এসে বসল এক রোগা, কালো, পোড়খাওয়া মাঝবয়েসী মেয়ে। অত্যন্ত সাধারণ চেহারা, কোথাও কোন অসাধারণত্ব নেই।
মাঝে এতো লেখা হত বস্তারে রাষ্ট্রের নিপীড়ন নিয়ে, বার বার উচ্চারিত হত সোনি সোরির নাম, কিভাবে পুলিশ লক আপে তার ওপর জঘন্য নির্যাতন চলেছে, যৌনাঙ্গে ভরে দেওয়া হয়েছে ছোট বড় পাথরের টুকরো, বাঁচার কথাই ছিল না, সেই অসহ্য যন্ত্রণার সমুদ্র পার করে তাকে বাঁচিয়েছিল কলকাতার চিকিৎসকেরা --সবই জানতাম, কিন্তু সোনির ছবি আমি দেখিনি কখনো। তাই নাম ঘোষণার পর আমি নড়েচড়ে বসি, এইই তা হলে সোনি সোরি! তারপরেরটুকু এক অভিজ্ঞতা! মাইকে উগড়ে দিতে থাকা বস্তারে ক্রমাগত লাগু থাকা কালা কানুনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ, জল জঙ্গল জমিনের লড়াই আর ব্যক্তিগত লাঞ্ছনার কাহিনী। কোন রাজনৈতিক দল তেমন ভাবে পাশে দাঁড়ায়নি সোনির, কারণ ঐ মাওবাদী তকমা।
অথচ নিজের একটি স্কুল আর হোস্টেল গড়ে তোলা এই শিক্ষকের একমাত্র অপরাধ ছিল মাওবাদী ফতোয়া মান্য করে জন- আদালতে যাওয়া, সেখানে স্কোয়াডের লোকেদের বোঝানো কেন তার স্কুল টিঁকিয়ে রাখাটা বস্তারের বাচ্চাদের জন্যই জরুরী। মাওবাদী হুমকি ছিল জন- আদালতে না এলে স্কুলঘর পুড়িয়ে দেবার। ডাঙ্গায় বাঘ আর জলে কুমির, ভয়াবহ সরকারি প্রতিশোধের ভয়ে আর কোন শিক্ষক না গেলেও একা অকুতোভয় সোনি মাওবাদীদের সঙ্গে তর্কবিতর্কে নিজের স্কুলটি বাঁচাতে সক্ষম হয়েছিলেন, কিন্তু নিজেকে নয়। মাওবাদী যোগসাজশের অভিযোগে পরদিনই তাকে তুলে নিয়ে যায় পুলিশ, দুবছর বিনাবিচারে জেলে অকথ্য নির্যাতনের পর, মোটে পাঁঁচবছর হয়েছে তার নানা আদালতে চক্কর কাটা।
সেই সোনি সোরি তুলে ধরছেন নতুন নতুন অত্যাচারের লাগামহীন ছবি, একবারও গলা ধরে আসছে না নিজের স্বামী, সন্তান, আত্মীয়দের ওপর নির্যাতনের বিবরণ দিতে গিয়েও কেবলই বলে চলেছেন, ও সব তো হ্যায়ই, মগর বস্তারকো বচাইয়ে।
গত জুলাই মাসে আদিবাসী মেয়েদের হোস্টেলে রক্ষাবন্ধনের দিন ঢুকে পড়ে উপোসী জওয়ানরা, সঙ্গে মাসতুতো ভাই রাজ্য পুলিশ। টয়লেট থেকে বেরোনো ছোট ছোট মেয়েদেরও দেহ সার্চে বড় উৎসাহ তাদের, একসময় অপেক্ষাকৃত বড়দের পেছন পেছন টয়লেটে ঢুকে পড়ে তারা, অসহায় কিশোরীদের আর্ত চিৎকারে মহা সমারোহে পালিত হয় ভ্রাতৃত্বের উৎসব।
বস্তারের যেখানে অত্যাচার, সেখানেই অদম্য সোনি সোরি। স্কুল কর্তৃপক্ষ চূড়ান্ত অসহযোগিতা করলেও নির্যাতিতা মেয়েদের হয়ে মামলা রুজু করেছেন সোনি। পরিষ্কার বললেন, তার গুপ্তাঙ্গে পাথর ঢোকানো পুলিশ অফিসারটি এবার রাষ্ট্রপতি পুরষ্কার পেয়েছে, ওর সদম্ভ চলাফেরা দেখলে বুকের ভেতরটা জ্বলেপুড়ে যায়, মগর ক্যা করু, দেশ কা সংবিধানমে বহোত বিশোয়াস রখতি হুঁ।
না, বন্দুক হাতে তুলে নেবার কথা একবারও ভাবেননি সোনি। বরং একবারই গলা ধরে এলো বাবাসাহেবের এই সত্যিকারের সন্তানের, যখন বললেন তার ভেঙে দেওয়া স্কুলহোস্টেলে পঞ্চাশটি অনাথ বাচ্চা থাকতো যাদের বাবা মায়েরা খুন হয়েছে রাষ্ট্রের পোষা আতঙ্কবাদী সালোয়া জুড়ুমের সদস্যদের হাতে। তাদের কি হল তিনি জেলে যাবার পর জানা নেই, শুধু এই সেদিন গহন বনের ছায়ায় এক গ্রামে ধর্ষণের ঘটনা শুনে সোনি যখন ছুটে যাচ্ছিলেন দুটি মাওবাদী তার পথ আটকায়। যাবার হুকুম নেই। কথা কাটাকাটি শুরু হতেই বন্দুক হাতে ছুটে আসে আর এক তরুণ, প্রাক্তন শিক্ষিকার পা ছুঁয়ে মাফি মাঙে। এ সেই অনাথদের একজন।
এইভাবেই অস্ত্র তুলে নিতে বাধ্য করছে রাষ্ট্র, শুশ্রূষার বদলে রক্তের স্বাদ দিচ্ছে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে।
নারী তো দলিতেরও দলিত। ফলে বস্তারের আদিবাসী রমণী ভোগ্যা ছাড়া আর কি! অবিবাহিতারাও মঙগলসূত্র পরে লাঞ্ছনা এড়াবার জন্য। তখন জওয়ানরা কাপড় সরিয়ে তার বুক দেখে। শুকনো বুক হলে স্বামী লা-মরদ কিনা জিজ্ঞাসা করে, তাদের সেবা নিতে পীড়াপীড়ি করে ভীতসন্ত্রস্ত মেয়েগুলিকে।
তবু বস্তারের 'লা-মরদ' আদিবাসী তার মানবিকতা ভোলে না, ধর্ষণের সন্তানরা বৈধ সন্তানের মতো একই আদরে মানুষ হচ্ছে বস্তারের অনেক ঘরে, জানালেন সোনি।
বেশির ভাগ সময় নিজের আইনি লড়াই লড়তে চলে যায়, তবু একাই একশ সোনি বস্তারের সর্বত্র। বাইরেও যেখানেই ডাক পান ছুটে যান এইসব সকলকে জানাবার জন্য। জল জঙ্গল জমিনের এই লড়াই, খনির ওপর পুঁজির কায়েমি দখলের বিরুদ্ধে ভূমিকন্যার এই লড়াই, জনজাতির মর্যাদাপূর্ণ জীবনের জন্য এই লড়াইয়ের স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে যাবে সর্বত্র এই আশা জাগালেন সোনি সোরি, সাধারণ নির্যাতিত এক মেয়ে, কিন্ত এক অসাধারণ মানুষ, সাহসী আর প্রত্যয়ে দৃঢ়।