নোম চমস্কির একটি লেখা “দ্য রেসপন্সিবিলিটি অফ দ্য ইন্টেলেকচুয়ালস”-এ তিনি ডুইট ম্যাকডোনাল্ডের একটি নিবন্ধের সিরিজের বিষয়ে উল্লেখ করেছিলেন। সিরিজটি ১৯৪৫ সালে পলিটিক্স পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল, যেখানে তিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন জনতার দায়, বিশেষত বুদ্ধিজীবি সম্প্রদায়ের দায়িত্বের বিষয়েঃ জার্মানি বা জাপানের মানুষ তাদের সরকারের ঔদ্ধত্যের জন্য কতটা দায়ী? এবং, একই ভাবে, ব্রিটিশ বা আমেরিকান সরকার যেভাবে সাধারণ মানুষের ওপর বোম ফেলে চলেছে, দিনের পর দিন ধরে তাদের যুদ্ধপ্রক্রিয়াকে আরও নিখুঁত করে চলেছে যতক্ষণ না হিরোশিমা বা নাগাসাকির মত ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যা সংঘটিত না হচ্ছে, এই যুদ্ধবাজ মানসিকতার জন্য এইসব দেশের নাগরিকরা কতটা দায়ী?
চমস্কি লিখেছেন, “বুদ্ধিজীবিদের দায়িত্বকে মাথায় রেখেই বলছি, প্রশ্ন আরও আছে, যেগুলো আরও বেশি অস্বস্তিকর। বুদ্ধিজীবিদের এমন একটা অবস্থান থাকে যেখান থেকে তাঁরা রাষ্ট্রের মিথ্যেগুলোকে এক্সপোজ করে দেবার ক্ষমতা রাখেন, বিভিন্ন কার্যকলাপের পেছনে রাষ্ট্রের যে সমস্ত গোপন অ্যাজেন্ডা থাকে সেগুলো তাঁরা অ্যানালাইজ করতে পারেন কার্যকারণ বিচার করে উচিত-অনুচিতের বিচার করতে পারেন। … খুব অল্পসংখ্যক কিছু ব্যক্তিকে পশ্চিমী গণতন্ত্র এই সুবিধে, এই ক্ষমতা, এই ট্রেনিং দেয় যাতে তাঁরা আদর্শ বা ইতিহাসের বিকৃত এবং বিচ্যুত ইন্টারপ্রিটেশনের আড়াল থেকে সত্যিটাকে খুঁজে বের করতে পারেন। ইন্টেলেকচুয়ালদের এটা দায়িত্ব, (যা সাধারণভাবে আমজনতার দায়িত্বের থেকে অনেক বেশি – যে সুবিধে তাঁরা পান তার বদলে) সত্যের সপক্ষে বলা এবং মিথ্যার আবরণ হটিয়ে দেওয়া।”
এই সত্য এবং মিথ্যার উন্মোচন হয় তো কাউকে কাউকে আঘাত করতে পারে, যাদের ধ্যানধারণাই বিভিন্ন তথাকথিত জাতীয়তাবাদী প্রোপাগান্ডার ওপর নির্ভর করে গঠিত। কিন্তু সত্যকে স্বীকার করা এবং তার দায়িত্বের মুখোমুখি হওয়ার মধ্যে যে সম্মান আছে, সে সম্মান আর কিছুতে নেই।
শুরুতে আমি এই বিষয়ে বক্তব্য রাখতে একটু ইতস্তত করছিলাম, ভাবছিলাম সেই সব অন্ধকার, বেদনাদায়ক ভাগ বাঁটোয়ারার দিনগুলোকে মনে করা টিক হবে কিনা, যদিও জানি কিছু বন্ধু সেই সব সময়ের ঘটনাবলীর একটা নিজেদের মত মানে বানিয়ে রেখেছে তাদের মনে। কিন্তু চমস্কির এই বক্তব্য আমাকে উৎসাহিত করল সেই দিনগুলোর কথা বলতে, উপমহাদেশের বাঁটোয়ারার সেই দিনগুলোয় জম্মুতে আমার নিজের অভিজ্ঞতার কাহিনি বলতে।
আমি এটুকু ভেবে খুশি যে, জম্মু সেদিনকার ধ্বংস আর মৃত্যুর তাণ্ডবের মধ্যে দিয়ে শিক্ষা নিয়েছিল এবং হিংসা-হানাহানির মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি আর সৌহার্দ্যের এক উজ্জ্বল উদাহরণ হিসেবে নিজেকে তুলে ধরেছিল।
শুরুতেই স্বীকার করে নেওয়া ভালো যে সেই অন্ধকার হিংসা, রক্তপাত আর সাম্প্রদায়িক হানাহানির দিনগুলোর কোনও লিখিত এবং স্বীকৃত রেকর্ড রাখা নেই, আর তাই জোর দিয়ে কালানুক্রমিকভাবে সেই দিনগুলোর কাহিনি বলা আমার পক্ষে খুব কঠিন। এ বিষয়ে যতটুকু যা লেখা হয়েছে, সীমান্তের এপারে বা ওপারে, তার সমস্তটাই নিতান্ত একপেশে এবং রঙ চড়িয়ে লেখা যাতে একপক্ষ অন্যপক্ষের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে গেছে, বা অন্যপক্ষের হিংসা দিয়ে নিজের “মানবিক” হিংসাকে জাস্টিফাই করে গেছে। আজ সন্ধ্যেয় আমি আপনাদের যেটুকু শোনাব, তা একান্তই আমার স্মৃতিনির্ভর। আমি আজ আপনাদের আমার স্মৃতি থেকে শোনাব ১৯৪৭ সালের জম্মুর কথা, যখন আমি ছিলাম ১৭ বছরের এক কিশোর, এবং শান্তির পক্ষপাতী। এই স্মৃতিচারণায় আমি আরও কয়েকজন জ্ঞানী বন্ধুদের থেকে তথ্য আহরণ করেছি যাঁরা সেদিনের ঘটনাবলী সাম্প্রদায়িকতার চশমা পরে দেখেন নি।
প্রথমে সংক্ষেপে বলি সেই সময়ের রাজনৈতিক অবস্থার কথা, যখন এই উপমহাদেশ স্বাধীনতা পেতে চলেছে, ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসক আর কদিন পরেই ভারত এবং পাকিস্তানের ক্ষমতা হস্তান্তর করে দেবে কংগ্রেস আর মুসলিম লীগের হাতে।
সেই সময়ে, ১৯৪৬ সালে ক্যাবিনেট মিশন একটি বয়ান প্রকাশ করে, যার ১৪ নম্বর স্তবকে লেখা ছিল “সম্পূর্ণ ক্ষমতা ব্রিটিশ ক্রাউনের কাছে রাখা সম্ভব নয়, নতুন গঠিত সরকারের কাছেও অর্পণ করা সম্ভব নয়।” শেষ পর্যন্ত এই “সম্পুর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের” টানাপোড়েন শেষ হয় ১৯৪৭ সালের ইন্ডিপেন্ডেন্স অ্যাক্টের মাধ্যমে যার আর্টিকল ৭-এ লেখা ছিল “দ্য সুজেরেইন্টি অফ হিজ ম্যাজেস্টি ওভার দ্য ইন্ডিয়ান স্টেটস ল্যাপসেস।” এর মানে দাঁড়াল ঔপনিবেশিক শাসক চলে যাবার পরে ভারতীয় উপমহাদেশের ছোট ছোট রাজ্যগুলি স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে স্বাধীন এবং সর্বভৌম হয়ে যাবে, যাদের সম্পূর্ণ নিজেদের ইচ্ছা থাকবে তাদের ভবিষ্যত বেছে নেবার এবং আইনত কোনও চাপ থাকবে না নবগঠিত ভারত বা পাকিস্তান রাষ্ট্রে যোগদান করার।
মাউন্টব্যাটেনের প্ল্যান ঘোষিত হল তেসরা জুন ১৯৪৭ সালে, লন্ডনের ভাইসরয় লন্ডন থেকে ফিরে আসার পর এবং এর পর ভারত আর পাকিস্তান, ১৫ই আর ১৪ই আগস্ট দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করল। সমগ্র উপমহাদেশ সাম্প্রদায়িক উসকানি আর দাঙ্গায় ছেয়ে গেল, বাংলা, বিহার আর পঞ্জাবে ঘটতে থাকল বড় বড় হত্যাকাণ্ড, গণধর্ষণ জাতীয় ঘটনা। ইতিহাস প্রত্যক্ষ করল বিশ্বের বৃহত্তম মাইগ্রেশনের প্রক্রিয়া, পাকিস্তানের অধিকৃত এলাকা থেকে হিন্দুদের এবং ভারতের অধিকৃত এলাকা থেকে মুসলিমদের স্থানান্তরণ, হিংসা, হানাহানি আর রক্তের বন্যার তাদের স্বপ্নের দেশের দিকে।
জম্মুর অবস্থা ছিল সংকটপূর্ণ, ভয় এবং অনিশ্চয়তার আবহে ঘেরা। সঠিক খবরের অভাবে দাবানলের মত গুজব ছড়াতে লাগল এবং ধর্মান্ধ নেতারা তাদের মত করে ধর্মের জিগির তুলে দুই সম্প্রদায়কেই একে অপরের বিরুদ্ধে তাতিয়ে তোলার চেষ্টা করে যেতে থাকল। জম্মুর স্থানীয় মিডিয়া “হিন্দু প্রেস” আর “মুসলিম প্রেস” নামে দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেল এবং দুই পক্ষই তাদের নিজেদের মত করে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে সমস্ত খবর প্রকাশ করতে লাগল। এই পরিস্থিতিতে যা হয়ে থাকে, সবার প্রথমে নিহত হয় সত্য এবং সঠিক তথ্য। লাহোরের কিছু সংবাদপত্র – ইংরেজিতে ট্রিবিউন এবং সিভিল মিলিটারি গেজেট আর উর্দুতে মিলাপ, প্রতাপ এবং জমিনদার হয়ে উঠল খবরের মূল সোর্স। বিশেষ করে উর্দু খবরের কাগজগুলো সমানে প্রতিবেশি দেশের এবং বাকি দেশের বিভিন্ন ঘটনার একতরফা এবং রঙ চড়ানো খবর ছেপে যেতে লাগল। লেখার প্যাটার্ন হত আগুন লাগাবার পক্ষে যথেষ্ট। কিন্তু ক্রমাগত হিংসায় রাস্তা এবং রেলপথের ক্ষতি হবার কারণে এই কাগজগুলোও লোকের হাতে এসে পৌঁছতে পারত না নিয়মিতভাবে।
জম্মুর রাজনৈতিক পরিমণ্ডলেরও সাম্প্রদায়িকভাবে মেরুকরণ ঘটে গেছিল, মূল চক্রী হিসেবে উঠে আসছিল মুসলিম কনফারেন্স, হিন্দু মহাসভা বা রাজ্য হিন্দু মহাসভার নাম। এই অঞ্চলের দুই ধর্মের পুরুষপ্রধান এলাকাগুলো একবাক্যে মহারাজার পতাকার তলায় নিজেদের আনুগত্য একত্রিত করেছিল। কংগ্রেস বা ন্যাশনাল কনফারেন্সের মত ধর্মনিরপেক্ষ পার্টিগুলোর এই অঞ্চলে তেমন উপস্থিতি ছিল না – মিরপুর বাদে, এখানে রাজা মহম্মদ আকবরের নেতৃত্বে ন্যাশনাল কনফারেন্সের শক্ত ঘাঁটি ছিল। এমনকি ছাত্রদের সংগঠনও ধর্মীয় সংস্থাগুলোর হাত ধরেই গড়ে উঠেছিল – আরএসএস এবং হিন্দু মহাসভার তরফে হিন্দু স্টুডেন্টস ইউনিয়ন এবং মুসলিম কনফারেন্সের পৃষ্ঠপোষকতায় মুসলিম স্টুডেন্টস ফেডারেশন – এরা তাদের নিজের নিজের মত করে সাম্প্রদায়িকতার তাস খেলে চলছিল যেগুলো ছাত্রদের উসকে দেবার কাজ করত। আমরা যুক্ত ছিলাম জম্মু স্টুডেন্টস ইউনিয়নের সঙ্গে, যেটা ছিল ধর্মনিরপেক্ষতার ধ্বজা ধরে থাকা একমাত্র যুব-সংগঠন। যদিও এরা ন্যাশনাল কনফারেন্সের সাথে গভীরভাবে যুক্ত ছিল, তবে এরা স্বাধীনভাবেই কাজ করত এবং এলাকায় শান্তি বজায় রাখবার জন্য সবরকমভাবে চেষ্টা চালিয়ে যেত। ১৯৪৬-৪৭ সাল নাগাদ আমি ছিলাম এই সংগঠনের জেনারেল সেক্রেটারি, আর আমার সঙ্গে সেই সময়ে ছিলেন আবদুল খাদিক আনসারি, বলরাজ পুরি, নীলাম্বর দেবশর্মা, বেদ পাল দীপ, রাম নাথ মেঙ্গী, ভূপিন্দর সিং, ইন্দরজিৎ জলি, গুরচরণ সিং ভাটিয়া এবং আরও অনেকে – এদের বেশির ভাগই ছিলেন এই সংগঠনের ফাউন্ডার মেম্বার।
মাউন্টব্যাটেনের ঘোষণা রাজ্যে একটা বিশাল পরিবর্তনের ঢেউ বয়ে এনেছিল। উপমহাদেশ যখন দুটো নতুন দেশের স্বাধীনতার জন্য তৈরি হচ্ছিল, তখন জম্মু-কাশ্মীরে ঘনিয়ে আসছিল সংকট, এক এলোমেলো অবস্থা। মহারাজা হরি সিং কোনও সিদ্ধান্তে আসতে পারছিলেন না, শোনা যাচ্ছিল তিনি জম্মু-কাশ্মীরকে আলাদা একটি স্বতন্ত্র দেশ হিসেবে ঘোষণা করতে চলেছেন। গুজব চলছিল, তাঁর ধর্মীয় গুরু স্বামী সন্ত দেব, যাঁর কথা মহারাজা খুব মেনে চলতেন, তিনি নাকি ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে জম্মু কাশ্মীর এক বিশাল স্বতন্ত্র হিন্দু রাষ্ট্রের অংশ হবে। অন্যদিকে রাম চাঁদ কাক, জম্মু কাশ্মীরের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী কাশ্মীরের ভারতীয় ইউনিয়নে যোগদানের বিরোধী ছিলেন এবং তাঁর ব্যক্তিগত মনোবাসনা ছিল এক স্বাধীন স্বতন্ত্র জম্মু-কাশ্মীর রাষ্ট্রের।
কাক ন্যাশনাল কনফারেন্সকে খুব সহযোগিতা করতেন না, এ কথা সবাই জানত এবং তিনি আর মহারাজা – কেউই রাজতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে জনতার হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের পক্ষপাতি ছিলেন না। শেখ আবদুল্লা তখন জেলবন্দী, তাঁর তৈরি করা ন্যাশনাল কনফারেন্সও স্বাধীন কাশ্মীরের আইডিয়ার খুব একটা বিরোধী ছিল না সেই সময়ে। কিন্তু মহারাজা আর শেখ আবদুল্লার মতানৈক্যের জন্যই তাঁরা একসাথে সেই কমন-স্বপ্নকে সফল করবার কাজে নিযুক্ত হতে পারেন নি।
জুন মাসের তিন তারিখের প্ল্যানের পর থেকেই মহারাজার ওপরে কংগ্রেস আর মুসলীম লীগ লাগাতার চাপ দিতে থাকে ভারত এবং পাকিস্তান রাষ্ট্রে কাশ্মীরের যোগদানের জন্য। কিন্তু মহারাজা কোনওদিকেই সমর্থন না জানিয়ে কাশ্মীরের স্বাধীনতার পক্ষেই তাঁর মত ব্যক্ত করেন। শোনা যায়, কাক, মহারাজাকে বারণ করেন কনস্টিট্যুট অ্যাসেমব্লিতে যোগদান করতে – তাতে তাঁর মুসলিম প্রজারা অসন্তুষ্ট হত। ক্রমবর্ধমান চাপের মধ্যেই গান্ধিজী পয়লা আগস্ট শ্রীনগরে আসেন মহারাজার সঙ্গে দেখা করতে। যদিও গান্ধিজী বলেছিলেন এই যাত্রা কোনওভাবেই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নয়, তিনি শুধুমাত্র মহারাজাকে কথা দিয়েছিলেন শ্রীনগর বেড়াতে আসবেন, তাই এসেছেন, তবু এটা বুঝতে কোনও অসুবিধেই ছিল না যে তিনি এসেছিলেন মহারাজাকে ভারত রাষ্ট্রে যোগদানের সুবুদ্ধি জোগাতে। গান্ধিজী ফিরে গেলেন জম্মু হয়ে, যেখানে তিনি তেসরা জুনের তারিখটিতেও এসেছিলেন। স্থানীয় ন্যাশনাল কনফারেন্স তাঁর জন্য জম্মুতে একটি ছোটখাটো সম্বর্ধনা সভার আয়োজন করেছিল, তাঁকে একটি প্রাইভেট বাড়িতে রাখা হয়, কারণ ন্যাশনাল কনফারেন্স স্থানীয় পুলিশকে গান্ধিজীর নিরাপত্তার দায়িত্ব দিতে চায় নি। সেই দায়িত্ব পেয়েছিলাম আমি, জনা-পঞ্চাশ বিশ্বস্ত যুবক যুবতীর দ্বারা তৈরি একটি সুরক্ষা বলয় আমি তৈরি করে দিয়েছিলাম গান্ধিজীকে রক্ষা করার জন্য। তারা সেই বাড়িতে, এবং সন্ধ্যেবেলায় কাছেই একটা চকে তাঁর প্রার্থনাসভাতে তাঁর নিরাপত্তার কাজে নিযুক্ত ছিল। সেখান থেকে গান্ধিজী সিয়ালকোট চলে যাবার কথা ছিল। কোথাও কোনও ঘোষণা করা হয় নি এই প্রার্থনাসভার ব্যাপারে, লাউডস্পিকার ব্যবহার করা বা প্রকাশ্য জনসভা করাও তখন নিষিদ্ধ ছিল, তবুও কী করে যেন খবর পেয়ে কয়েক হাজার লোক জড়ো হয়েছিল তাঁর সভায়। সেই সময়ে ঐ এলাকায় আরএসএসের কর্মীরা গান্ধিজীর বিরুদ্ধে হেট-ক্যাম্পেন চালাচ্ছিল। তাঁর নিরাপত্তার ব্যাপারে আমরা তাই খুব চিন্তিত ছিলাম, আমরা সবাই মিলে পুরো জনসভাটাকে বৃত্তাকারে ঘিরে ছিলাম। গান্ধিজী মূলত শান্তি এবং সৌহার্দ্যের ওপরেই তাঁর বক্তব্য পেশ করেন।
কাশ্মীর কীভাবে ভারতের ‘অন্তর্ভূক্ত’ হল, সে বিষয়ের বিস্তারিত আলোচনায় আমি যাচ্ছি না; কারণ সে ইতিহাস খুব ভালোভাবে লিখিত হয়ে রয়েছে, প্রায় সকলেই সে ইতিহাস জানেন। গান্ধিজীর শ্রীনগর আসার পরে পরেই ঘটনাপ্রবাহ দ্রুত এগোতে থাকে এবং ধারণা করা হয় অনিচ্ছুক মহারাজা ক্রমশ ভারতে অন্তর্ভূক্তির পক্ষে সায় দেন। রাম চাঁদ কাককে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে অপসারণ করা হয়, এবং কয়েক দিন পরে তাঁর বিরুদ্ধে একটি কেস দায়ের করা হয়। মেজর জেনারেল জনক সিং নামে মহারাজার জনৈক বিশ্বাসভাজন নতুন প্রধানমন্ত্রীর পদে শপথ নেন। তাঁর পদগ্রহণের সাথে সাথেই জমু-কাশ্মীরের ভবিষ্যৎ ঘিরে অনিশ্চয়তা শেষ হতে থাকে এবং এটা পরিষ্কার হতে থাকে যে মহারাজা, ন্যাশনাল কনফারেন্স (এনসি) আর কংগ্রেস মিলে রাজ্যটির ভবিষ্যৎ সুনিশ্চিত করতে চলেছেন। কাকের অপসারণে এনসি অত্যন্ত খুশি হয়েছিল, তারা এটাকে তাদের জয় হিসেবে দেখেছিল। এগারোই আগস্ট তারিখে কয়েকশো এনসি সমর্থক শ্রীনগরের সেক্রেটারিয়েট কম্পাউন্ডে জড়ো হয়ে জনক সিংকে সম্বর্ধনা জানান, শ্লোগান ওঠে ‘মহারাজা বাহাদুর কি জয়’, ‘জনক সিং জিন্দাবাদ’ এবং ‘শেখ আবদুল্লা জিন্দাবাদ’। শেখ আবদুল্লা জেল থেকে ছাড়া পেলেন ২৯শে সেপ্টেম্বর, প্রায় দু লাখ কাশ্মীরি মহাসমারোহে তাঁকে রাজকীয় সম্বর্ধনা জানিয়েছিল। তিনি তাদের অনুরোধ করলেন শান্তি আর সম্প্রীতি বজায় রাখতে, আর মহারাজার প্রতি নিজের আনুগত্য ব্যক্ত করলেন। মহারাজার সঙ্গে দেখা করতে যাবার আগে তিনি মহারাজার প্রতি নিজের আনুগত্য জানিয়ে একটি চিঠি লিখেছিলেন –
“মহারাজাধিরাজের জয় হোক।
এ দেশের সমস্ত শুভার্থীর কাছে এটা এখন স্পষ্ট যে অতীতে যে সমস্ত দুঃখজনক ঘটনা এখানে ঘটে গিয়েছে, সেগুলো ইচ্ছাকৃতভাবে কিছু ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর দ্বারা তৈরি করা, তাদের নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য … আমি মহারাজাধিরাজকে আশ্বস্ত করতে চাই এই বলে যে, অতীতে যা-ই ঘটে থাকুক, আমি এবং আমার পার্টি কখনওই মহারাজাধিরাজের বিরুদ্ধে, তাঁর বংশের বিরুদ্ধে বা তাঁর সিংহাসনের বিরুদ্ধে কোনওরকমের চিন্তাধারায় যুক্ত ছিলাম না। এই সুন্দর দেশের উন্নতি এবং এই দেশের মানুষদের সুখ সাচ্ছন্দ্য আমাদের সাধারণ লক্ষ্য এবং এই লক্ষ্যপূরণে আমি এবং আমার পার্টি সদাসর্বদা আপনার সমর্থনে থাকবে। শুধু তাই নয়, আমি মহারাজাধিরাজকে আশ্বস্ত করতে চাই এই বলে যে, দেশে এবং দেশের বাইরে কোনো পার্টি যদি আমাদের এই লক্ষ্যপূরণে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়, তারা আমাদের শত্রু হিসেবে পরিগণিত হবে।
… এই চিঠি শেষ করার আগে আমি আবার মহারাজাধিরাজকে বিনীতভাবে আমার আনুগত্য নিবেদন করতে চাই এবং প্রার্থনা করি, ঈশ্বর মহারাজাধিরাজের রাজত্বে শান্তি, সুখ, সমৃদ্ধি এবং সুশাসন বলবৎ রাখুক যেন এই রাজ্য জগতের সেরা হিসেবে পরিগণিত হয়।
মহারাজাধিরাজের একান্ত অনুগত
এস এম আবদুল্লা”
মেহর চাঁদ মহাজন শ্রীনগরে এসে মহারাজার সাথে দেখা করলেন, চারদিকে তখন গুজব চলছে, ইনিই জনক সিং-এর জায়গায় প্রধানমন্ত্রী হতে চলেছেন। অবশেষে সত্যিই প্রধানমন্ত্রী হবার পরে মহাজন ১৬ই অক্টোবর ঘোষণা করলেন, তিনি কাশ্মীরকে প্রাচ্যের সুইটজারল্যান্ড বানাবেন। শাসনব্যবস্থা তিনি ওপর থেকে ঢেলে সাজালেন। রাম নাথ শর্মা নামে এক সেশনস জাজ চৌধরি নিয়াজ আহমেদকে সরিয়ে মুখ্যসচিব হলেন। এর পর মহাজন দিল্লি গেলেন নেহরুর সঙ্গে দেখা করতে, তার ঠিক পরে পরেই ২৬শে অক্টোবর মহারাজা চলে গেলেন জম্মুতে, ভি পি মেননের সঙ্গে দেখা করে তিনি ভারত অন্তর্ভূক্তির চুক্তিতে স্বাক্ষর করলেন। শেখ আবদুল্লা শাসনব্যবস্থার শীর্ষ ব্যক্তি হিসেবে সম্মানিত হলেন। এক ঐতিহাসিক মিছিল তাঁকে নিয়ে চলল শ্রীনগরের লাল চকে, যেখানে শেখ আবদুল্লা ভারত এবং নেহরুর প্রতি তাঁর আনুগত্য ঘোষণা করলেন এই প্রতিশ্রুতির সঙ্গে – যে খুব শিগগিরই গণভোটের মাধ্যমে জেনে নেওয়া হবে কাশ্মীরের ভবিষ্যতের বিষয়ে জনতার মতামত, ততক্ষণ পর্যন্ত কাশ্মীরের ভারতের অংশ হয়ে থাকা এক অস্থায়ী স্থিতি মাত্র। কিন্তু ততদিনে পাকিস্তান থেকে লুটেরার দল ঢুকে পড়েছে জম্মু আর কাশ্মীরে, লুণ্ঠন, খুন, ধর্ষণ – দুই সম্প্রদায়ের পুরুষ আর মহিলাদের ওপরেই, অরাজকতা এসে পৌঁছেছিল শ্রীনগরের খুব কাছে। এ ইতিহাসও খুব ভালোভাবে লিখিত, এর বিস্তারিত বিবরণে যাবার প্রয়োজন নেই।
আগেও বলেছি, জম্মুর রাজনীতি সাম্প্রদায়িক চরিত্রের ছিল। শুধু একবারই, ১৯৪৩ সালের রোটি আন্দোলনের সময়ে হিন্দু আর মুসলমানরা হাতে হাত মিলিয়ে প্রতিবাদ করেছিল আসন্ন দুর্ভিক্ষের কালে, একটিমাত্র ব্যানারের তলায়, এবং পুলিশের গুলিতে প্রায় ডজনখানেক লোক মারা যান, যাঁদের বেশির ভাগই ছিলেন মুসলিম। এটুকু বাদ দিলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এই শহরের নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা ছিল।
ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যান ঘোষিত হবার পরে সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একটা চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হল। হিন্দু সভা দুটো ভাগে ভাগ হয়ে গেল, একদল মহারাজা-সমর্থক পণ্ডিত প্রেম নাথ ডোগরার সমর্থনে নাম নিল রাজ্য হিন্দু সভা। এদের দাবি হল কাশ্মীর রাজ্যের ভবিষ্যত মহারাজাই নির্ধারণ করবেন, আর তাঁর সমস্ত সিদ্ধান্তে সহমত জানাবে মূলত উচ্চবর্ণের হিন্দু এবং সামন্ততান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন সদস্যদের দ্বারা গঠিত এই দল, যাদের সত্যিকারের মনোগত বাসনা ছিল কাশ্মীর স্বতন্ত্র স্বাধীন একটা দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে। অন্য অংশটি গোপাল দত্ত মেঙ্গির নেতৃত্বে সিদ্ধান্ত নিল যে তারা সম্মিলিতভাবে মহারাজাকে অনুরোধ করবে কাশ্মীরকে ভারত ইউনিয়নের মধ্যে পাকাপাকি অন্তর্ভূক্ত করতে। মুসলিম লীগের ছায়ায় প্রতিপালিত মুসলিম কনফারেন্স কোনও সিদ্ধান্তেই আসতে পারে নি এই সময়ে।
২৮শে মে, ১৯৪৭, একটি প্রেস কনফারেন্সে মুসলিম কনফারেন্সের কার্যকারী সভাপতি চৌধরী হাবিবুল্লাহ্ বললেনঃ
“কাশ্মীরের পাকিস্তানে অন্তর্ভূক্তি হিন্দুদের সমস্যায় ফেলবে, আর ভারতে অন্তর্ভূক্তি মুসলমানদের সমস্যায় ফেলবে। সুতরাং, আমরা ভারত আর পাকিস্তানের মধ্যে কোনওরকমের বিবাদের কারণ হয়ে দাঁড়াতে চাই না। তা ছাড়াও আমরা এই রাজ্যটির সম্পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য চেষ্টা করব। এখন আমাদের সামনে প্রশ্ন এই, এ বিষয়ে মহারাজার অবস্থান কী? আমরা তাঁকে যথাযথ আনুগত্য এবং সম্মান প্রদর্শনে কখনও বিচ্যুত হই নি এবং এই কারণেই আমরা কখনও কুইট কাশ্মীর আন্দোলনকে সমর্থন জানাই নি, যদিও সেটা এক দিক থেকে একটা স্বতস্ফূর্ত আন্দোলন ছিল। অতএব আমরা এমন একটা অবস্থান নিতে চাই, যেটা মহারাজাকেও তাঁর অবস্থান বজায় রাখতে সাহায্য করবে, একই সাথে তাঁর প্রজাদেরও সন্তুষ্ট রাখবে। সেরা সমাধান, আমাদের মতে, মহারাজাকে সাংবিধানিকভাবে রাজা বলে স্বীকার করা হোক, বিভিন্ন দেশে যে রকম নিয়ম আছে, … এর সাথে আমরা আমাদের একটা সাংবিধানিক সংসদ বানাব যার মাধ্যমে আমরা আমাদের সংবিধান তৈরি করব …
আমার সাথে মুসলিম কনফারেন্সের সমস্ত নেতা এবং চৌধরি গুলাম আব্বাস খানের পূর্ণ সমর্থন আছে এই বিষয়ে। মুসলিম কনফারেন্সের তরফে একটি রিপ্রেজেন্টেটিভ কনভেনশন আহ্বান করা হবে এক মাসের মধ্যে যেখানে এই প্রোপোজালটি সর্বসম্মতভাবে স্বীকৃত হবে। অতএব, এই প্রোপোজালটিকে মুসলিম কনফারেন্সের তরফ থেকে অফিশিয়াল হিসেবে মেনে নেওয়া যেতে পারে। এটি মুসলিম লীগের মস্তিষ্কপ্রসূতও নয়, আমরা এটিকে ব্যবহার করে হিন্দুদের ধোঁকা দেবারও চেষ্টা করব না। আমরা বর্তমান পরিস্থিতির পূর্ণ বিবেচনা করে সততার সঙ্গে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি। মুসলিম লীগের সাথে আমাদের একমাত্র সম্পর্ক এই যে, ভারতের দখলদারির বিরুদ্ধে মুসলীম লীগের প্রাক্তন ও বর্তমান নীতি আমাদের বলীয়ান করেছে। সম্পূর্ণ সততার সাথে আমি জানাচ্ছি যে এই বিষয়ে আমাদের সাথে মুসলিম লীগের কোনও নেতা বা কর্মীর সাথে কোনও আলোচনা হয় নি। মুসলিম লীগের থেকে আমরা এই ব্যাপারে কোনও নির্দেশ চাই না, এবং হিন্দুরাও কংগ্রেসের মাধ্যমে আমাদের যেন কোনও উপদেশ দিতে না আসে। সবচেয়ে ভালো হয় যদি কংগ্রেস আর মুসলিম লীগ আমাদের সংশ্রব ত্যাগ করে; আমরাও ওদের সাথে কোনও রকম সম্পর্ক রাখতে ইচ্ছুক নই। আমরা যে বলছি আমরা হিন্দুস্তান আর পাকিস্তান, দুইয়ের থেকেই আলাদা হতে চাই, এর সত্যিকারের মানে হচ্ছে, আমরা দুজনের সাথেই বন্ধুত্ব বজায় রাখতে চাই। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সম্পর্ক থাকবে আমাদের সাথে পাকিস্তানের এবং একজন হিন্দু মহারাজার নেতৃত্বে ভারতের সঙ্গেও আমাদের সুসম্পর্ক বজায় থাকবে।”
মুসলিম কনফারেন্সের কার্যকরী কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হল ১৮ জুলাই, ১৯৪৭ সালে। কার্যকরী কমিটি, সবদিক বিবেচনা করে চৌধরী হামিদুল্লাহ্র বয়ানকে সর্বসম্মতিক্রমে সমর্থন জানাল, এবং সর্বসম্মতিক্রমে মহারাজার ওপরে কাশ্মীরের স্বাধীনতা ঘোষণা করার দায়িত্ব ন্যস্ত করল এবং জানাল এ বিষয়ে পার্টি সবরকমভাবে সাহায্য এবং সমর্থন জানাবে।
অবশ্য, খুব তাড়াতাড়িই তারা ডিগবাজি খেল, পেছন থেকে মুসলিম লীগ মেন্টরদের কলকাঠি নাড়াবার ফলে অচিরেই আরেকটি জমায়েতে তারা জানাল যে তারা “পাকিস্তানের অংশ হিসেবে নিজেদের পরিগণিত করে ধন্য মনে করছে এবং কায়েদ-এ-আজমকে অভিনন্দন জানাচ্ছে”।
কাশ্মীরের পাকিস্তানে অন্তর্ভূক্তিকে সমর্থন জানিয়ে সেই জনসভায় বলা হলঃ
“…অতএব, এই রাজ্যের পাকিস্তানে অন্তর্ভূক্তি খুবই প্রয়োজনীয়।
এই সভা মহারাজার কাছে দাবি পেশ করছে যে, কাশ্মীরের জনতা পূর্ণ আভ্যন্তরীণ স্বরাজ পাক, মহারাজা তাদের সাংবিধানিক নেতা হোন এবং একটি সংসদীয় দল গঠন করা হোক, প্রতিরক্ষা, বিদেশনীতি এবং যোগাযোগের মন্ত্রকগুলি পাকিস্তানের সংসদের হাতে তুলে দেওয়া হোক।
এই সভা ঘোষণা করছে যে, যদি কাশ্মীরের সরকার আভ্যন্তরীণ বা বাইরের কোনও চাপের মুখে পড়ে মুসলিম কনফারেন্সের দাবি মেনে না নেয় বা এর প্রস্তাবনা-মাফিক কাজ না করে, এবং এই রাজ্যকে ভারত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সংযুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়, কাশ্মীরের সমস্ত মানুষ একত্রিত হয়ে সেই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে এবং সমস্ত শক্তি দিয়ে এর বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করবে।”
জম্মুতে, ন্যাশনাল কনফারেন্সও এই প্রশ্নে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে ছিল। এনসির নন-কমিউনিস্ট সদস্যরা একটি মিটিং-এ প্রস্তাবনা আনল যে মহারাজার কাছে শেখ আবদুল্লার মুক্তির দাবি জানানো হোক, জনমত নিয়ে সরকার গঠিত হোক এবং কাশ্মীর ভারতে সংযুক্ত হোক। অন্যদিকে প্রো-কমিউনিস্ট অংশটি মোতি রাম বাইগ্রার নেতৃত্বে প্রস্তাবনা আনল, শেখ আবদুল্লার মুক্তির দাবি জানানো হোক এবং জনতাকে সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা দেওয়া হোক ভারত বা পাকিস্তানে সংযুক্তিকরণের ব্যাপারে। এই অংশের বেশির ভাগই অবশ্য স্বতন্ত্র জম্মু-কাশ্মীর গঠনের পক্ষপাতি ছিলেন।
ভারতের স্বাধীনতাপ্রাপ্তির দিন জম্মুর আবহাওয়া থমথমে ছিল। সারা ভারতে যে উল্লাস উদ্দীপনার মাধ্যমে স্বাধীনতাকে অভ্যর্থনা জানানো হচ্ছিল, সেই উল্লাস জম্মুতে অনুপস্থিত ছিল। স্থানীয় কংগ্রেস এবং ভারতপন্থী এনসি সদস্যরা এক রুদ্ধদ্বার বৈঠকে ভারতের স্বাধীনতাকে স্বাগত জানান এবং তিরঙ্গা পতাকা উত্তোলন করেন।
জম্মুর রাস্তায় রাস্তায় মহারাজার পতাকার সঙ্গে অসংখ্য ব্যানার লাগানো হয়েছিল হিন্দু রাজ্য সভা এবং আরএসএসের তরফে, “মহারাজাধিরাজ স্বাধীন জম্মু, কাশ্মীর, লাদাখ, তিব্বতের একচ্ছত্র অধিপতি”, স্পষ্টতই তাদের দাবি বোঝা যাচ্ছিল। (অবশ্য পরে জনাদেশের মাধ্যমে সরকার গঠিত হবার পরে যখন স্টুডেন্টস ইউনিয়ন তখনকার প্রিন্স অফ ওয়েলস কলেজের মাথায় ভারতের জাতীয় পতাকা এবং লাঙলের ছবি-ওলা লাল রঙের এনসি পতাকা উত্তোলন করে, তখন আরএসএস সমর্থকেরা এই ব্যানার পোস্টারগুলো ছিঁড়ে ফেলে, এবং এর পরে পরেই ইউনিয়নের কর্মীদের ওপর আক্রমণ করে)
মাউন্টব্যাটেন প্ল্যান ঘোষিত হবার পরে পরেই জম্মুতে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার পারদ ক্রমশ চড়ছিল, হিন্দু সভা-আরএসএস এবং মুসলিম কনফারেন্স প্রত্যেকেই নিজেদের সাধ্যমত সাম্প্রদায়িকতার আগুন ছড়িয়ে দেবার চেষ্টা করছিল। উত্তেজনা আরও বাড়ে যখন এক বিপুল সংখ্যক হিন্দু এবং শিখ পঞ্জাব এবং NWFP (নর্থ ওয়েস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার প্রভিন্স) থেকে, এমনকি বর্তমান পাকিস্তানের অধীনে থাকা বিভিন্ন এলাকা থেকেও জম্মুতে আসতে শুরু করে। পুঞ্ছ সেক্টরেও উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে যখন মহারাজার প্রশাসন সেখানকার একটি জায়গীর নিজের রাজ্যের অন্তর্গত করে নেন ও সেখানে কিছু কর বসান, ফলে একটা অসাম্প্রদায়িক চরিত্রের আন্দোলন সেখানে দানা বাঁধে। এই আন্দোলনকে দমন করতে গিয়ে মহারাজার প্রশাসন শুরুতেই কঠিন দমন-পীড়নের আশ্রয় নেয়, ফলে এই অসাম্প্রদায়িক আন্দোলন অচিরেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার রূপ নেয়।
মহারাজার প্রশাসন তাঁর অধীনস্থ সমস্ত মুসলিমদের অস্ত্র সমর্পণ করতে আদেশ দেয়, শুধু তাই নয়, ডোগরা আর্মি এবং পুলিশ বিভাগেও যে সমস্ত মুসলিম ছিলেন, তাঁদেরও আত্মসমর্পণ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়, কারণ তাদের আনুগত্যে সন্দেহ করা হয়েছিল। মহারাজার ভীম্বার যাত্রার পরে সেখানে বড় মাত্রায় হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়। এর ফলে পুঞ্ছ, পুলান্দরি, বাগ এবং সুধনোতি এলাকার এক বিশাল সংখ্যক জনতা, যারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ইংরেজ সৈন্যদলের হয়ে লড়াই করেছিল, তারা সরাসরি মহারাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করল।
এই সব দিনের কোনও সঠিকভাবে লিখিত ইতিহাস কোথাও রাখা হয় নি, ফলে আজকের দিনে দাঁড়িয়ে বলা খুব মুশকিল আসলে কী ঘটেছিল। ডোগরা আর্মির ট্রুপ পুঞ্ছ, বাগ, রাওয়ালকোট এবং অন্যান্য এলাকায় মোতায়েন করা ছিল। হিন্দু সৈন্য আর মুসলমান প্রাক্তন-সৈন্যদের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধল। পুঞ্ছ এলাকা থেকে মুসলমানরা বেশির ভাগই পালিয়ে গেল অন্যদিকে, আবার বাগ, পুলান্দরি, রাওয়ালকোট এবং অন্যান্য এলাকা থেকে হিন্দু আর শিখরা দলে দলে পুঞ্ছের দিকে চলে আসতে লাগল।
২১শে অক্টোবর তারিখে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস অফ ইন্ডিয়ার নিউ দিল্লির একটি রিপোর্টে শেখ আবদুল্লাকে উদ্ধৃত করা হয়েছে এই সময়ের ওপরেঃ
“পুঞ্ছের আজকের এই সমস্যা, এই সামন্ততান্ত্রিক অশান্তির মূল কারণ হচ্ছে কাশ্মীর রাজ্যের গৃহীত নীতি। পুঞ্ছের মানুষদের এই যে নির্যাতন, একবার স্থানীয় শাসকের হাতে, একবার সেই শাসকের শাসক কাশ্মীর দরবারের হাতে, এই নিরন্তর নির্যাতন এক আন্দোলনের জন্ম দিয়েছে, জনতার আন্দোলন, এই নির্যাতনের অভিযোগের বিরুদ্ধে। এই আন্দোলন সাম্প্রদায়িক নয়। কাশ্মীর রাজ্য তার সৈন্য দিয়ে দমন-পীড়ন চালিয়েছে, পুঞ্ছের মানুষ আতঙ্কিত। পুঞ্ছের বেশির ভাগ প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষই ভারতীয় সেনাবাহিনির প্রাক্তন সেনা, যারা ঝিলম আর রাওয়ালপিণ্ডির মানুষদের সাথে খুব গভীরভাবে যুক্ত ছিল। ঘরের নারী আর বাচ্চাদের ফেলে তাদের পালাতে হয়েছে, সীমা পেরিয়ে তারা অন্যপারের লোকেদের থেকে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আবার ফিরে এসেছে। তাদের প্রতিরোধের মুখে পড়ে কাশ্মীরের সেনাকে কয়েক জায়গায় পিছু হঠতে বাধ্য হতে হয়েছে।”
খবর পাওয়া গেল যে, সংলগ্ন মিরপুর এলাকাতেও এক্স-সার্ভিসম্যানদের প্রতিরোধের মুখে পড়তে হয়েছে কাশ্মীরের সেনাবাহিনিকে। অভিযোগ এল যে, মুখোমুখি লড়াইতে নামতে গিয়ে সেনা প্রচুর নিরপরাধ মানুষকে মেরে ফেলেছে, তাদের গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে এবং তারপরে দাবি করেছে যে তারা বিদ্রোহীদের প্রতিহত করেছে। কাশ্মীরের প্রশাসন সরাসরি এই অভিযোগ অস্বীকার করে এবং দাবি করে যে বিদ্রোহীদের সম্পূর্ণরূপে পরাস্ত করা হয়েছে, এবং বিদ্রোহীরাই হিন্দু আর শিখদের ওপরে আক্রমণ চালিয়েছে।
জম্মুতে ঘটল নৃশংসতম গণহত্যা। গুজবের পর গুজব ছড়ালো যে মুসলমানরা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হিন্দুদের আক্রমণ করছে, এবং তার ফলে যা হবার তাই হল – সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা।
১৯৪১-এর জনগণনা অনুযায়ী জম্মু প্রভিন্সের জনসংখ্যা ছিল মোটামুটি ২০ লাখ, যার মধ্যে মুসলমান জনসংখ্যা ছিল ১২ লাখ। জম্মু জেলার জনসংখ্যা ছিল সাড়ে চার লাখ, এর মধ্যে মুসলমান ছিল এক লাখ সত্তর হাজার। জম্মু শহরের জনসংখ্যা ছিল মাত্র পঞ্চাশ হাজার, এর মধ্যে মুসলমান ছিল মাত্র ষোল হাজার। সেপ্টেম্বরের শেষাশেষি সীমান্ত এলাকার বিষ্ণাহ, আর এস পুরা, আখনূর এলাকা থেকে এক বিপুল সংখ্যক মুসলমান পাকিস্তানের সিয়ালকোটের দিকে পালায়। পঞ্জাবে তখন পুরোদস্তুর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়ে গেছে, ফলে জম্মুর সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলতে খুব তাড়াতাড়ি আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছিল। ফলে, আর এস পুরা আর কাথুয়া থেকে মুসলমানরা সিয়ালকোটের দিকে যখন চলে যাচ্ছিল, তখন অন্যদিক থেকে হিন্দু আর শিখরা শরণার্থী হয়ে চলে আসছিল জম্মুতে। সিয়ালকোট থেকেও এক বিশাল সংখ্যক হিন্দু আর শিখ জম্মু শহরের দিকে চলে আসে, স্থানীয় প্রশাসনের কাছে তাদের আশ্রয় বা শরণ দেবার মত কোনও সংস্থানই ছিল না। বেসরকারি লেভেলে কিছু রিলিফ ক্যাম্পের আয়োজন করা হয়েছিল, কিন্তু তা যথেষ্ট ছিল না। কিছু শরণার্থী তাদের পরিচিতজনের বাড়িতে আশ্রয় পেল, বাকিদের আশ্রয় হল প্যারেড গ্রাউন্ডে এবং অন্যান্য এলাকায়, খোলা আকাশের নিচে। সিয়ালকোট থেকে শেষ ট্রেন নিয়ে এল আরও অসংখ্য হিন্দু আর শিখ শরণার্থী।
উধমপুর জেলায় দলে দলে মুসলমানদের খুন হবার খবর আসছিল; উধমপুর শহর, চেনানি, রামনগর এবং রেয়াসি এলাকা থেকে বিশেষত। ভাদেরওয়াতেও মুসলমানদের দলে দলে খুন করা হচ্ছিল। এই হত্যাকাণ্ডে মূল ভূমিকা ছিল আরএসএসের, তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল একদল অস্ত্রধারী শিখ শরণার্থী, যারা এমনকি জম্মুর রাস্তায় খোলা তলোয়ার হাতে প্যারেডও করেছিল। এই দাঙ্গা আর গণহত্যা সুচারুভাবে পরিকল্পনা এবং পরিচালনা করছিল আরএসএস, এবং উধমপুর-ভাদেরওয়াতে যারা এই দাঙ্গার মূল হোতা ছিল, পরিহাসের বিষয়, তাদের কয়েকজন পরে এনসি-তে যোগ দেয়, এবং পরে মন্ত্রীও হয়। ছাম্ব, দেবা বাতালা, মানাওসার এবং আখনূরের বিভিন্ন এলাকা থেকে হত্যাকাণ্ডের খবর আসছিল, লোকজন প্রাণ বাঁচাবার তাগিদে হয় অন্যদিকে চলে যাচ্ছিল, অথবা জম্মু শহরে চলে আসছিল। কাথুয়া জেলাতেও বড় মাপে হত্যাকাণ্ড ঘটছিল, মুসলমানদের কচুকাটা করা হচ্ছিল, মেয়েদের হয় ধর্ষণ কিংবা অপহরণ করা হচ্ছিল। বিলাওয়ার এলাকায় হিন্দু সাম্প্রদায়িক গুণ্ডারা যথেচ্ছভাবে মুসলমান পুরুষদের খুন করছিল আর মেয়েদের ধর্ষণ অপহরণ করছিল। মাচেদি এবং আশপাশের এলাকা থেকে এক বিশাল সংখ্যক মুসলমান ডোডা এলাকার দিকে পালায়। গুজব ছড়ায় – যারা প্রাণ বাঁচাতে ডোডা পালিয়ে গেছে, তারা ডোডার জঙ্গলের মধ্যে একটা “মিনি-পাকিস্তান” বানিয়ে ফেলেছে।
পরে, যখন শেখ আবদুল্লা সরকারিভাবে এমার্জেন্সি অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের প্রধান হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণ করবার পরে জম্মু শহরে আসেন, তখন একটি গুডউইল ডেলিগেশন টিম বানানো হয় – যাতে ছিলেন কাথুয়ার তৎকালীন এমার্জেন্সি অফিসার গিরধারী লাল ডোগরা, হিন্দু সভার গোপাল দত্ত মেঙ্গি, আঞ্চলিক ন্যাশনাল কনফারেন্সের সম্পাদক সৈয়দ নাজির হুসেন সামনানি, এবং আটা মহম্মদ নামে একজন ফরেস্ট অফিসার। এই টিম বিলাওয়ারে গিয়ে সেই জঙ্গলে লুকিয়ে থাকা মুসলমানদের উদ্ধার করে ফিরিয়ে আনেন। তারা প্রায় কিচ্ছু খেতে পায় নি ততদিন।এই উদ্ধারকার্যে আমি এবং স্টুডেন্টস ইউনিয়নের কিছু সদস্য যুক্ত ছিলাম। কাশ্মীর থেকে একদল সশস্ত্র শান্তিবাহিনি আমাদের সঙ্গে ছিল। মাচেদি ফেরার পথে, আমাদের সেই মুসলমানেরা তাদের দুঃখ আর আতঙ্কের কাহিনি শোনাচ্ছিল। আমরা হিন্দু সাম্প্রদায়িক গুণ্ডাদের কবল থেকে অনেক মুসলমান মেয়েদেরও উদ্ধার করেছিলাম এবং তাদের জম্মু এনেছিলাম পুনর্বাসনের জন্য।
এই হত্যাকাণ্ড থামানো বা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ফিরিয়ে আনার কোনও চেষ্টা তো মহারাজার প্রশাসন করেই নি, উলটে তারা পরিকল্পিতভাবে সাম্প্রদায়িক গুণ্ডাদের হাতে অস্ত্র তুলে তাদের আরও হিংসায় উদ্বুদ্ধ করেছিল। স্পষ্টতই, এটা আরএসএস পরিচালিত সম্পূর্ণ পরিকল্পিত একটা গণহত্যা ছিল, যাদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসা কিছু সশস্ত্র শিখ শরণার্থী, এবং তারা স্থানীয় প্রশাসনের তরফ থেকে সম্পূর্ণ সুরক্ষা আর সহযোগিতা পেয়েছিল। জম্মুতে নামকরা উকিল লালা দীননাথ মহাজনের নেতৃত্বে হিন্দু-শিখ ডিফেন্স কমিটি তৈরি হয়, সরকারি সমর্থনপুষ্ট হয়ে। মহাজন পরে বকশি গুলাম মহম্মদের মন্ত্রীসভায় অর্থ-রাজস্ব মন্ত্রীর পদ অলঙ্কৃত করেছিলেন।
নৃশংসতম ঘটনা ঘটে জম্মু শহরের তালাব খটিকান এবং মোহল্লা উস্তাদ এলাকার মুসলিম বসতিতে। তাদের ঘিরে ফেলে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়, একটি দানা খাদ্য, এক ফোঁটা জলও সেখানে ঢুকতে দেওয়া হয় না। শহরের অন্যদিকে লাখদাতা বাজার এবং পীর মিঠা বাজার ছিল হিন্দু আর মুসলমান বসতির মধ্যেকার সীমারেখা। মুসলিমপ্রধান এলাকার বাইরে অন্যান্য এলাকার মুসলিমদের নৃশংসভাবে খুন করা হয়েছিল, খুন করেছিল দাঙ্গাবাজেরা, যারা শহরে কার্ফু চলার সময়েও খোলা অস্ত্রশস্ত্র হাতে করে গাড়িতে চেপে শহর দাপিয়ে বেড়াত। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিল যে, কার্ফু চলাকালীন শুধু মুসলমানদের গতিবিধিই নিয়ন্ত্রণ করা হত। মোহল্লা উস্তাদ এলাকার বিচ্ছিন্ন মুসলমান বন্ধুদের জন্য আমাদের কয়েকজন বন্ধু কিছু খাদ্যশস্যের জোগাড় করে পৌঁছে দিয়ে আসতে পেরেছিল। কর্নেল পীর মহম্মদ এবং আরও কিছু রাজসভার লোক যদিও তাঁদের বাড়ির সামনে শান্তির প্রতীক হিসেবে সাদা পতাকা ঝুলিয়ে রেখেছিলেন, তবুও দাঙ্গাকারীরা তাঁদের বাড়িতেও আক্রমণ করার চেষ্টা করেছিল। লাখদাতা বাজার আর পীর মিঠা বাজারের সীমারেখার কাছাকাছি হিন্দু বাড়িগুলোতে হিন্দুরা পজিশন নিয়ে বসে ছিল। পরে তাদের সাথে যোগ দেয় পাটিয়ালা থেকে আসা একদল দাঙ্গাকারী। তালাব খটিকান এলাকার মুসলিমরাও প্রাণরক্ষার তাগিদে হাতের কাছে যা অস্ত্র পেয়েছিল তাই নিয়ে একত্র হয়েছিল। পরে মুসলিম কনফারেন্স তাদের কিছু সাহায্য করে।
জম্মুতে এবং জম্মুর চারদিক থেকে অবিশ্রান্ত মুসলিম হত্যাকাণ্ডের খবর আসছিল। গুজ্জর সম্প্রদায়ের নারীপুরুষ, যারা মূলত আশপাশের গ্রাম থেকে শহরে দুধের জোগান দিত, তাদের দলে দলে কচুকাটা করা হয়েছিল। রামনগর রাখ ভর্তি হয়ে গেছিল গুজ্জর পুরুষ, নারী আর শিশুদের মৃতদেহে। আমার এক সহকর্মী এক সকালে রামনগর এলাকায় প্রাতর্ভ্রমণ করতে গিয়ে এক বাচ্চার চীৎকার শুনে দৌড়ে যায় এবং আবিষ্কার করে একটা আট-ন বছরের বাচ্চা মেয়ে তার নিহত বাবা-মায়ের মৃতদেহের সামনে বসে তারস্বরে কাঁদছে। সে মেয়েটিকে নিয়ে আসে এবং ১৬ই নভেম্বর, ১৯৪৭, যখন শেখ আবদুল্লা জম্মুতে আসেন এবং মোহল্লা উস্তাদে একটা রিলিফ ক্যাম্প স্থাপন করেন, সেই ক্যাম্পে গিয়ে মেয়েটিকে রেখে আসে।
তালাব খটিকান এলাকার মুসলিমদের আত্মসমর্পন করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। অসহায় অবস্থায় তাদের নিয়ে আসা হয় জোগি গেট পুলিশ লাইনে, আজ যেখানে দিল্লি পাবলিক স্কুল অবস্থিত। নিরাপত্তা দেবার পরিবর্তে সেখানে প্রশাসন তাদের বলে পাকিস্তানে গিয়ে নিজেদের নিরাপত্তা খুঁজে নিতে। প্রায় ষাটটি লরিতে প্রথম দফার মুসলিমদের বোঝাই করা হয়, তাদের সিয়ালকোট নিয়ে যাবার জন্য। তারা জানত না তাদের ভাগ্যে কী ঘটতে চলেছে। গাড়িগুলোকে প্রশাসনের বাহিনি এসকর্ট করে নিয়ে চলে, কিন্তু যখন তারা শহরের বাইরে জম্মু-সিয়ালকোট রোডের চত্থা এলাকায় পৌঁছয়, বিশাল সংখ্যক সশস্ত্র আরএসএসের গুণ্ডা এবং শিখ শরণার্থীরা সেখানে তাদের ঘিরে ধরে। প্রতিটা গাড়ি থেকে মুসলমানদের টেনে নামানো হয় এবং প্রত্যেককে কুপিয়ে কুপিয়ে মারা হয়। এসকর্ট করা সৈন্যরা কেউ কেউ হত্যাকাণ্ডে অংশ নিয়েছিল, বাকিরা চুপ করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এই হত্যাকাণ্ড দেখেছিল। কাউকে জানতে দেওয়া হয় নি এই হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে, পুরোপুরি চেপে যাওয়া হয়েছিল। পরের দিন আর এক দফা মুসলমান পরিবারকে লরিতে করে নিয়ে আসা হয় এবং তাদেরও একই পরিণতি হয়। শুধুমাত্র কয়েকজন যারা বেঁচে পৌঁছতে পেরেছিল সিয়ালকোট, তাদের কাছ থেকে শোনা গেছিল সেই ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের কাহিনি।
কোনও রেকর্ড রাখা হয় নি, তাই বলা সম্ভব নয় ঠিক কতজন মারা গেছিলেন, ধর্ষিত হয়েছিলেন বা অপহৃত হয়েছিলেন। তবে সংখ্যাটা যে কয়েক হাজারের থেকে কম নয়, সেটুকু নিশ্চিতভাবে বলা যায়।
রাজ্য প্রশাসন যথারীতি এই হত্যালীলায় তাদের অংশগ্রহণের তত্ত্ব অস্বীকার করে। আমি, এখানে শুধু দুটো ঘটনার কথা উল্লেখ করব প্রশাসনের এই হত্যালীলায় যুক্ত থাকার প্রমাণ হিসেবে, যা জম্মুর জনঘনত্বের চরিত্র পালটে দিয়েছিল। আমি স্টুডেন্ট ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে “ইনসানিয়ত কে নাম পর” শীর্ষকে একটি আপীল করেছিলাম সাধারণ মানুষের কাছে, শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখবার জন্য, এবং দাঙ্গাবিধ্বস্ত হিন্দু, শিখ ও মুসলমান শরণার্থীদের কাছে সাহায্য পৌঁছে দেবার প্রচেষ্টায় সবাইকে সামিল হতে আহ্বান জানিয়েছিলাম। আমরা একটা ছাত্রদের শান্তিকমিটিও গঠন করেছিলাম। আমাকে শমন পাঠান জম্মুর তৎকালীন রাজ্যপাল লালা চেত রাম চোপড়া, কাচি ছাওনিতে তাঁর সরকারি বাসভবনে। অত্যন্ত বিনীতভাবে তিনি আমাকে হুমকি দেন, “তোমার এই ছ্যাঁচড়ামোর জন্য আমি চাইলেই তোমাকে এক্ষুনি গরাদের পেছনে পাঠাতে পারি। কিন্তু তুমি কিনা আমার মতই খত্রি (ক্ষত্রিয়) এবং কোনও না কোনওভাবে আমার দূর সম্পর্কের বেরাদর, আমি তাই তোমাকে আপাতত উপদেশ দিচ্ছি। এটা শান্তি কমিটি গঠন করা বা শান্তির জন্যে কাজ করার সময় নয়, এখন সময় হচ্ছে সাম্প্রদায়িক মুসলিমদের হাত থেকে হিন্দু আর শিখদের রক্ষা করার, যারা হিন্দু আর শিখদের খুন করার চক্রান্ত করছে এবং পরিস্থিতি বিগড়ে দিচ্ছে। আমরা ইতিমধ্যেই একটা হিন্দু-শিখ ডিফেন্স কমিটি গঠন করেছি। তুমি আর তোমার বন্ধুরা যদি একে সমর্থন করো তো ভালো।” অতঃপর তিনি বলেন, “আমরা হিন্দু আর শিখ যুবকদের অস্ত্রচালনার ট্রেনিং দিচ্ছি রেহারি এলাকায়। তুমি আর তোমার বন্ধুরা যেন অতি অবশ্যই সেই ট্রেনিংয়ে যোগ দেয়”। আমি যখন পরের দিন আমার এক সহকর্মীকে সেই ট্রেনিং ক্যাম্পে পাঠাই, সেখানে সে দ্যাখে কিছু আরএসএসের লোককে আর কিছু যুবককে থ্রি নট থ্রি রাইফেল চালানোর প্রশিক্ষণ দিচ্ছে সেনার লোকেরা।
আরেকটা ঘটনা যেটা আমার মনে পড়ছে, সেটা মেহর চাঁদ মহাজনকে নিয়ে। তিনি জম্মু এসে পৌঁছনোর পরে হিন্দুদের একটি ডেলিগেশনের সাথে দেখা করেন, এবং বলেন যে ক্ষমতা যখন হস্তান্তর হচ্ছেই, তখন তাদের উচিত সাম্যের দাবি করা। এনসির এক সদস্য তখন তাঁকে প্রশ্ন করেন সাম্য কীভাবে সম্ভব যেখানে জম্মুর জনসংখ্যায় এতখানি বৈচিত্র্য আছে? কাছেই রামনগর রাখ, যেখানে তখনও কিছু মুসলমানের লাশ পড়ে রয়েছিল, সেইটা দেখিয়ে মহাজন বলেছিলেন, “জনসংখ্যার অনুপাতও তো বদলানো যায়”।
জম্মুর সাম্প্রদায়িক হানাহানি অবশ্যই একতরফা ছিল না। এক বড় সংখ্যক হিন্দু আর শিখও নির্মমভাবে নিহত হয়েছিল মুসলমান ঘাতকদের হাতে, রাজৌরি, মিরপুর, এবং কিছু এলাকায় যেগুলো এখন পাকিস্তানের অধীনে পড়ে। রাজৌরিতে যেখানে মুসলমান-প্রধান এলাকা থেকে হিন্দুরা সরে আসছিল, সেই সময়েই অন্য এলাকা থেকে মুসলমানেরাও সরে আসছিল মুসলমান-প্রধান এলাকায় – একই পথে। মুসলমানদের দল হিন্দুদের গ্রাম ঘিরে ফেলে এবং গণহত্যা, ধর্ষণ আর লুটতরাজ চালায়। মিরপুর জেলাতেও এক বড় সংখ্যক হিন্দু খুন হয়েছিল। মুসলমানেরা যখন মিরপুরের জেলাসদর থেকে কাছাকাছি গ্রামে এবং ঝিলমে চলে আসছিল, হিন্দুরা তখন সদরে ফিরে আসছিল নিরাপত্তার খোঁজে।
আসলে এই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়েছিল, আরএসএসের গুন্ডারা যখন রাজা ইকবাল খান আর শেখ ইমাম দিন নামে দুই মুসলমান পুলিশ অফিসারকে খুন করে, তখন থেকে। কিছু এনসি সমর্থককেও আক্রমণ করা হয়েছিল। হিন্দুরা সব চেয়ে বেশি মাত্রায় খুন হয়েছিল কাসগুমাতে, যেখানে মুসলমান দাঙ্গাবাজদের সঙ্গে যুক্ত হয় কিছু প্রাক্তন আইএনএ-র সদস্য, যারা জম্মু ফিরছিল। এক বিশাল সংখ্যক হিন্দু শরণার্থী, যারা গরুর গাড়িতে আর পায়ে হেঁটে চলছিল সদরের দিকে, বিনা খাবারে, বিনা জলে, তাদের সবাইকে নৃশংসভাবে খুন, ধর্ষণ আর অপহরণ করেছিল মুসলিম সাম্প্রদায়িক গুণ্ডারা। কেউ কেউ পালিয়ে বেঁচেছিল, তারা পৌঁছেছিল চৌকি চৌরা গ্রামে, যেখান থেকে তাদের জম্মুতে নিয়ে আসা হয়। একই রকম ভাবে আলিবেগ এলাকাতেও হিন্দু আর শিখ শরণার্থীদের দলে দলে হত্যা করা হয়।
… … …
সাম্প্রদায়িক উন্মাদনার সেই দিনগুলোকে স্মরণ করার পেছনে আমার একটাই উদ্দেশ্য, এটা বোঝানো যে সাম্প্রদায়িকের কোনও ধর্ম হয় না। সাম্প্রদায়িক হানাহানিতে প্রথম মৃত্যু ঘটে মনুষ্যত্বের, মানবিকতার। বিশেষ কাউকে এই দেশভাগের হত্যালীলার কারণে দোষ দেবার বদলে আমাদের উচিত এই ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়া, যাতে কখনও কোনও সাম্প্রদায়িক দল বা শক্তি আমাদের শান্তি সম্প্রীতিকে নষ্ট করতে না পারে। ১৯৪৭এর সেই উন্মাদনার জন্য একদিকে যেমন আমার মাথা লজ্জায় হেঁট হয়ে যায়, অন্যদিকে গর্বে আমার মাথা উঁচু হয়ে যায় এই মনে করে যে, জম্মুর আলোকপ্রাপ্ত এবং রাজনৈতিকভাবে ম্যাচিওরড লোকজন সেই সময়ে সেই অন্ধকার দিনগুলোর শেষে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে পেরেছিলেন, যা উপমহাদেশের অনেক সাম্প্রদায়িক হানাহানির ঘটনার বিপরীতে একটা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।
মূল ইংরেজি পেপার থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন শমীক মুখার্জি ।