১.
‘জুলে ভার্ন’ ছাড়িয়ে ‘এলেকতিক’ অফিসকে ডাইনে রেখে আর কিছুদূর এগুতেই বনঝাড় সরে এল। একটা চমৎকার ‘ভিলা’ পড়ল। ভিলা তো নয়, শহরের অদূরে ফাঁকা জায়গায় অবস্থিত সুরম্য বাড়ি।
শুধুই বাড়ি তো নয়, সুশোভিত বাগানবাড়ি। তাও নয়, যেন দূর্গভবন। চতুর্পার্শ্বে সুবৃহৎ বৃক্ষাদি। লতাগুল্ম। কোনটাই বা ওক, চেস্টনাট, বীচ, বার্চ, ম্যাপল কোনো কিছুই তো চিনি না, জানিও না।
ভিলা সংলগ্ন খেতিবাড়ির প্রান্ত বরাবর ‘রেকত্র স্মিত্’ বাস স্টপ ও ট্রামস্টপের দিকে হাঁটতে গিয়ে কিন্তু মনে হ’ল – আনাজ খেতিটা কেমন চেনা চেনা।
নালা করে সার সার বাঁধাকপি ফুলকপির চাষ। ‘ত্যাঁড়ায়’ ভরে পাল জমিনে জল দেওয়ার সাজ সরঞ্জাম। কেয়ারটেকারের ঘর থেকে তক্ষুণি লুঙ্গির কশিতে গিঁট দিতে দিতে যেন বেরিয়ে আসবে নদীধারের পাল জমিনের পাহারাদার চাঁদপুরের নীলধ্বজ দন্ডপাট।
ছবির মতো সাজানো ভিলা, খেতিবাড়ি সব। অথচ আশ পাশে লোক দেখিনা। খালি তো এদিক ওদিক থেকে দুরন্ত বেগে ছুটে আসা গাড়ি আর গাড়ি। কার্যত কেয়ারটেকারের ঘর থেকে কোনো নীলধ্বজ দন্ডপাট কী দারোয়ান মিশেল বেরিয়ে এলো না।
‘রেকত্র স্মিত্’-এর মোড়ে পৌঁছে ডাইনে ‘র্যু দ্য লা বুর্জেনীয়ের’-এর দিকে কয়েক পা হাঁটলেই চোখে পড়ল মরা শামুক গেঁড়ি-গুগলি শুকা-শুঁটকির দোকান। তারমানে আজ নির্ঘাত ‘দিমশঁ’। অর্থাৎ রোববার।
হপ্তার ছুটির দিন। যখন মল, বাজার বন্ধ। তখন এ বুলভার সে বুলভারের মোড়ে, এ র্যু সে র্যুয়ের মুখে তাদের দোকান খোলা।
আমাদের হাওড়ার কালীবাবুর বাজার, বোসবাবুর বাজার কী বোষ্টমপাড়ার বাজারের শাকউলী শামুকউলীদের মতো নয়। অনাহূত রবাহূতের মতো কোনক্রমে বাজারের একপাশে যৎসামান্য ঠাঁই করে নিয়ে হাজা হাতে গেঁড়ি ভাঙছে।
রীতিমতো ভারী দোকানদার। অনেকটা কলকাতার নিউমার্কেটের ফল দোকানীদের মতো। ওই যারা স্টিকারআঁটা আম-আপেল-বেদানা বেচে। মাঝে মাঝে স্প্রে মেশিন দিয়ে ফলের উপর খুশবুর জল ছড়ায়।
ঈষৎ হেলানো আলমারি। চৌকো চৌকো খোপের ভিতর মরা শামুক জ্যান্ত শামুক। শামুকের শুঁটকি। জীবন্ত ও মৃত গেঁড়ি গুগলি। প্রত্যেকটা খোপেই দামের ফর্দ আঁটা – ‘ল্য কিলো’ ২ ইউরো থেকে ৪-৫ ইউরো পর্যন্ত।
বইয়েই পড়েছি ‘মোলাস্কা’ অর্থাৎ কোমল পর্বভুক্ত প্রাণী হ’ল শামুক। তার আবার কত রকমফের। জল শামুক, স্থল শামুক। ঝিনুক, শঙ্খ। গেঁড়ি, গুগলি। সেপিয়া, ললিগো, অক্টোপাসও এই গ্রুপের। নাকি ভুমধ্যসাগরীয় দেশের মানুষের কাছে অক্টোপাস শামুক গেঁড়ি গুগলি সেপিয়া ললিগো খুবই সুস্বাদু। তদুপরি ভারি প্রোটিন সমৃদ্ধ।
হাঙর, অক্টোপাস, জেলিফিস আমরা খাই বা না খাই, শামুক ঝিনুক গেঁড়ি গুগলি তো হামেশাই খাই। অধিকন্তু আমাদের গ্রামের মলিনাবুড়ী ও তার মেয়ে শীতের গোটা মরসুমটায় ‘কুমহারডুবি’ জলা থেকে কাঁড়ি কাঁড়ি ঝিনুক তুলে হাড় মাংস আলাদা করে খোল পুড়িয়ে কলিচুন বানায়। বেলা গড়ায়। অপরাহ্নের রাঙা ভাঙা ঝিলঝিলে রৌদ্রও একসময় টুঙ্ করে খসে যায়। তবু মলিনা ও তার মেয়ে আঙুরবালার ঝিনুক পুড়িয়ে কলিচুন বানাবার চুল্লী নেভে না। তার অনর্গল ধোঁয়ায় মাঠঘাট গ্রাম গ্রামান্তর আচ্ছন্ন থাকে সায়াহ্নেও।
শামুক বিক্রেতার গুমটির কাছে দাঁড়াতেই—
-- ‘বঁজুর!’
আমিও বললাম—
-- ‘বঁজুর!’
তারপর সামান্য হাসি। আমিও হাসলাম। ‘লা সঁস’, ‘রূত দ্য শ্যাপেল্’ এর ওদিকে বিগত হপ্তাগুলোর দু একটা রোববারেই শামুক বিক্রেতাদের দেখেছি। ‘র্যু দ্য লা বুর্জেনীয়ের’ এর গেঁড়ি গুগলিওয়ালাকে এই প্রথম।
‘শ্যের মঁসীও’ বলে ফরাসীতেই কীসব বলতে লাগল সে! ‘ভু-জেত দু কেল পেই’ না ‘পারলে ভু ফ্রঁসে’, কী যেন!
আমি পরিষ্কার বাংলাতেই জিজ্ঞাসা করলাম—
-- এসব গেঁড়ি গুগলি তোমরা পেলে কোত্থেকে। সেই ১৭৩১ না ৩৫ এ তোমাদের দ্যুপ্লেক্সেসের আমলে চন্দননগর-চুচঁড়া-হুগলির খালবিল ঘেঁটে এনেছিলে বুঝি?
ও যেন কত বুঝল! গড় গড় করে বলে চলল
-- ‘মেরসি বীয়াঁ, ম্যসিও, ভুজ এত্ বিয়াঁন্ এমাব্ল্। ল্য কিলো দ্যো ইউরো।’ বলেই দুটো আঙুল দেখাল।
মাথামুন্ডু কিছু বুঝি আর না বুঝি, দুটো আঙুল আর ‘কিলো’ শুনেই বিলক্ষণ বুঝলাম—ব্যবসায়ী হিসেবে সে অত্যন্ত ঝানু। বেশি কথায় কাজ কী, কিনতে হয় কেনো, নচেৎ।
তৎক্ষণাৎ একটা গেঁড়ি আমি হাতের তালুতে তুললাম। আশ্চর্য, যেন আমাদের দখিনসোলের সোঁতার জ্ঞানকাকার হেঁতুবিলের কাদামাটি লেগে আছে তার গায়ে। আমাকে আরো আশ্চর্য করে কিয়ৎকালের মধ্যেই গেঁড়িটা তালুর মাঝখান থেকে বিবর্তিত হয়ে গড়াতে গড়াতে চলল আঙুলের দিকে। একটাই আঙুল তুললাম।
তারমানে ‘ল্য কিলো’। সঙ্গে সঙ্গে এক কিলো গেঁড়ি গুগলি ইলেকট্রনিক বাটখারায় মেপে প্যাকেটে পুরে সে আমাকে দিল।
মূল্য বুঝে নিয়ে ঘাড় ঈষৎ নত করে স্মিতহাস্যে শামুক ব্যবসায়ী বলল —
-- ‘মের্সি ব্যকু, ম্যসিও!’
আমিও
-- ‘ধন্যবাদ! ভালো থাকুন।’
২.
একটা বই, বই তো নয় মহাগ্রন্থ, পাঠ করেছিলাম। বইটির নাম ‘নয়াবাঙ্গঁলার গোড়াপত্তন’। লেখক, শ্রী বিনয়কুমার সরকার। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ধনবিজ্ঞানাধ্যাপক। গ্রন্থটির প্রকাশকাল ১৯৩২। তার উৎসর্গে—‘ ১৯৩২ সালে বাঙ্গালীর ঘরে ঘরে যেসকল শিশুর জন্ম তাহারা যখন আঠার বৎসর বয়সে পদার্পণ করিবে সেই সময়কার যুবক বাঙ্গালার হাত-পা’র জোর আর মাথার জোরকে উদ্দেশ্য করিয়া এই গ্রন্থ উৎসর্গ করিলাম’।
বলা বাহুল্য আমার জন্ম তৎপরবর্ত্তীকালে। তবুও সে গ্রন্থ পাঠে মনোনিবেশ করিচি। সেখানেই পড়ছি—‘ফ্রান্স এমন একটি দেশ যেখানে অনেক বিষয়ে কতকগুলি ঐক্য আছে। ফ্রান্সকে অনেক বিষয়ে আমরা ঐক্যবিশিষ্ট লোকসমষ্টির সুবিস্তৃত জনপদ বলিয়া বিবেচনা করিতে পারি। করিলে বেশী ভুল হইবে না। কিন্তু তবুও বাস্তবিকপক্ষে, ফ্রান্সের ‘জাতিগত’ ঐক্য বা সামঞ্জস্য নাই বলা উচিত। আছে ‘জাতিগত’ বৈচিত্র্য । এখানকার লোকসংখ্যা ৪০,৭৫০,০০০। এই কিঞ্চিদুর্দ্ধ চারকোটি নরনারীর ভিতর ১,৭০০,০০০ জার্ম্মান, ১,০০০,০০০ কেল্ট, ৬০০,০০০ ইতালিয়ান, ২৫০,০০০ স্প্যানিশ। তাহা ছাড়া অন্যান্য কুচোকাচা প্রায় ৬০০,০০০। অধিকন্তু ফ্রান্সে যাহারা আসলে ‘ফরাসী’ তাহাদের ভিতরও অসংখ্য জাতি উপজাতি রহিয়াছে।’
বিনয়কুমার সরকারের মতে এহেন ইউরোপিয়ান অনৈক্যই চাই ভারতের উন্নয়নের ক্ষেত্রেও। এতে ভারতবাসীর লজ্জিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। কেননা, ইউরোপের ছোট ছোট ত্রিশ-বত্রিশটা স্বাধীন দেশের মধ্যে কোনও জাতিগত ঐক্য কি ভাষাগত ঐক্য নেই। সর্বত্রই বিরাজ করছে মিশ্র বা দোঁআসলা জাতি আর বহুবিধ ভাষা।
শ্রীসরকারের ধারণা – ইউরোপের দেখাদেখি ভারতকেও যদি গোটা ত্রিশ-বত্রিশ স্ব স্ব প্রধান রাষ্ট্রে ভাগ করা যায়, তবে মহাভারত এমন কিছু অশুদ্ধ হয়ে যাবে না। ইউরোপ সুলভ অনৈক্যই চাই আজ ভারতে। নয়া বাঙলার গোড়াপত্তনের জন্য সর্বপ্রথম দরকার এই ‘নবীন বস্তুনিষ্ট রাষ্ট্রদর্শন।’
তাঁর আরও ইচ্ছা, - ‘চাই বিদেশে ভারতীয় মোসাফির’। ‘চাই ভারতে বিদেশী ভাষা শিক্ষার ব্যবস্থা’। তিনি নিজেই মুসাফিরের মতো ঘুরে বেড়িয়েছেন জার্মানী জাপান, বিলাত, আমেরিকা, ইতালি, ফ্রান্স। চার সপ্তাহে ইতালিয়ান, পাঁচ সপ্তাহে জার্মানী আর তিন সপ্তাহে ফরাসী ভাষা আয়ত্বে এনেছিলেন। দুনিয়ার কত না পর্যটন সাহিত্য পাঠ করেছেন স্ব স্ব ভাষায়। পড়েছেন ফ্রান্সের ‘প্যের ল্যতি’ – ‘প্যের ল্যতি’র ভ্রমণমূলক উপন্যাসে পিরেনীজ পাহাড়ের পল্লীজীবন, ব্রিটানি প্রদেশের চাষী জীবন, আফ্রিকার জনপদ ও জনজীবন বিধৃত আছে।
নাকি প্যারিসে থাকার সময় একজন ফরাসী পন্ডিত শ্রী সরকারকে আরেকজন ফরাসী পন্ডিতের সাথে আলাপ করিয়ে দেওয়ার সময় বলেছিলেন, “এ এসেছে ভারত থেকে কলম্বাসের চোখ নিয়ে। চায় আমাদের ফ্রান্স আর পশ্চিম মুল্লুক আবিষ্কার করতে।”
আহা আমারও যদি শ্রী সরকারের মত চোখ থাকত! আমিও যদি তিনসপ্তাহের মধ্যে ফরাসীটা আয়ত্বে আনতে পারতাম।
আরেকজনের কথাও জানি। রাহুল সাংকৃত্যায়ন। যিনি বিশ্ব ভবঘুরে। যাঁর কাছে ‘পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ বস্তু হ’ল ভবঘুরেমি।’ যেদিকে মন চায় বেড়িয়ে পড়। ‘যদহরেব বিরজেৎ তদহরেব প্রবজেৎ’।
৩.
রেকতোর স্মিথ এবং বোয়াসিয়ের ট্রাম স্টপের মাঝবরাবর বুর্জেনীয়ের ট্রামস্টপ। সুবিস্তৃত অঞ্চল, র্যু দ্য লা বুর্জেনীয়ের। যেখানে প্রায় গায়ে গায়ে অবস্থিত একোল পাবলিক, ছোটদের স্কুল, উ এক্সপ্রেস মল, ‘এগলিজ সেঁ ফ্রঁসে দাজি গির্জা আর খেলার মাঠ।
ঈষৎ কুয়াশাছন্ন প্রাতঃকাল। তদুপরি ছুটির দিন। তবু সারাদিনমান ব্যস্তসমস্ত থাকা বুর্জেনীয়ের অঞ্চলে এক্ষণে লোকের তেমন বাহুল্য নেই। ওই বড়জোর সম্মুখস্থ সিতে য়্যুনিভেরসিতে র আবাস স্থল থেকে ফুড়ুৎ ফাড়ুৎ করে এক দুজন ছাত্র কি ছাত্রী নিষ্ক্রান্ত হয়ে এদিক সেদিক হেঁটে যাচ্ছে।
একটি দুটি করে লোক জড়ো হচ্ছে বুর্জেনীয়ের ট্রামস্টপেও। তবে যেমন জড়ো হচ্ছে তেমন চলেও যাচ্ছে। গার দ্য পঁ রুশো কী অরভলত গ্রাঁ ভ্যাল এর দিকে।
এগলিজ সেঁ ফ্রঁসে দ্যাজি গির্জা আর বোধহয় কয়েক গজের ভিতর। হ্যাট কোট পরা এক ফরাসী প্রৌঢ়ের সাথে মুখোমুখি দেখা-
- বঁজ্যুর।
- বঁজ্যুর।
তৎক্ষণাৎ হাস্যমুখ। যেন কতকালের চেনা।
- শ্যের মঁসিও, কঁ মঁতালে ভ্যু? মিল ফোয়া মের্সি ভতরএ মাবল আক্যই-
ফ্রেঞ্চম্যানই বটে। মৃদুমন্দ কাঁধ ঝাঁকিয়ে সেই চিবিয়ে চিবিয়ে বলা। কিন্তু আমি তো এর বিন্দু বিসর্গ কিছুই বুঝছি না। সেকথা বললামও।
- আই অ্যাম ইন্ডিয়ান। আই ডোন্ট নো ফ্রঁসে।
ল্য ফ্রঁসে যে ফরাসী ভাষা- অ্যাতদিনে এইটুকু অন্ততঃ বুঝেছি।
শোনাইস্তক লোকটা উচ্ছসিত হয়ে হাত ধরল। করমর্দন করল। হাত না ছেড়ে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে অনর্গল বলে চলল-
- ভ্যু জোত তো এ মাব্ল, জুভু ফেলিসিত। যে ত্রে ফাঁ, জ্যু নে পা আ সে দাঁগজ সু মোয়া-
অসহ্য, বিরক্তিকর। কোনো কিছুই যে বুঝছি না। লোকটা ইংরেজী জানে না। অগত্যা হাত ছাড়িয়ে এগুতে গেলাম। লোকটা সজোরে তার বাঁ হাত দিয়ে আমার হাত ফের আঁকড়ে ধরে তার ডানহাতের গুচ্ছ আঙুল জড়ো করে মুখের কাছে বার বার তুলে খাবার খাওয়ার সনাতন ভঙ্গি করে দেখাচ্ছে।
আমি হতচকিত। কিংকর্তব্যবিমূঢ়। মুহূর্তেই হাত চলে গিয়েছিল পকেটে। মুহূর্মুহু আঙুলের ঘষাও লাগছিল বর্তুলাকার দু ইউরো এক ইউরোর কয়েনে। মনে মনে হিসেবও চলছিল এক ইউরো হচ্ছে আশি টাকা, দু ইউরো-
ভিক্ষাঞ্চ ভিক্ষবে দদ্যাৎ অথবা গ্রাসমাত্রা ভবেদ্ ভিক্ষা। তাহলে আমাদের দেশের ভিখারীদের সাথে এদেশের ভিখারীদের তফাৎ কি? না তফাত সফিস্টিকেশনে।
এদেশে কেউ কেউ শীতের পোষাকে কানমাথা মুড়ে সঙ্গের কুকুর নিয়ে মল কি মেট্রো স্টেশনের মুখে বসে থাকে। কথাও বলে না। খালি পোস্টারে লিখে রাখে – ‘হোমলেস + হাংরি’।
কেউ কেউ স্যুটেড ব্যুটেড হয়ে বাসে ট্রামে ট্রেনে ছড়িয়ে যায় লিফলেট। কথা বলতেও হয় না। চিরকুটেই লেখা থাকে ভিখারী বৃত্তান্ত ও সবিনয় প্রার্থনা এক কি দু ইউরোর। নিদেনপক্ষে রেস্তোরার একটা টিকিট।
দু ইউরো নয়, দু ইউরোর কয়েনটা বের করেও ফের ঢুকিয়ে রাখলাম। বেছে বেছে একটা এক ইউরোর কয়েনই তার হাতে দিলাম। তৎক্ষণাৎ ফেরত দিয়ে সহাস্যে সে দুটো আঙুল দেখাল। অগত্যা দু ইউরোই গেল।
কুয়াশা কি অধিকতর গাঢ় হ’ল? এগলিজ সে ফ্রঁসে দাজি গির্জার মাঠ এত সাদাটে লাগছে কেন! পুঞ্জীভূত সাদা সাদা। কোথাও গাঢ় কোথাও হালকা।
কুয়াশা নয়, তারমানে এই সকাল সকাল তাঁবু পড়েছে গির্জার মাঠে। নাঁত শহরের জোন থার্টিতে অ্যাতদিন আছি, কত দিঁমশ অর্থাৎ রোববারই তো প্রত্যূষে হেঁটে বেড়িয়েছি। গির্জার মাঠ তো মাঠ, নাঁত স্পোর্তিক কমপ্লেক্স, সিমতিয়ের শোভেনিয়ের, ই তোয়ালে দ্যু সঁস ফুটবল খেলার মাঠ, পার্ক দে লা গূদেনিয়ের, পার্ক দ্যু পাতি পর্ত, লা ক্লসে, হিপ্পোড্রোম তথা রেসকোর্সের মাঠ –
কই কোথাও তো এমন তাঁবু পড়তে দেখিনি। ঢাকনাওয়ালা বৃহৎ ক্যারাভান কী গড়গড়িয়ে ঢুকে এল এগলিজ সে ফ্রঁস্যে গর্জার মাঠে? তার সামনে কি ওটা, ঘোড়া না গাধা—
এরাই কি তবে ইজিপশিয়ান তথা জিপসী? হোমলেস? ভবঘুরে? চুরুমাহো- যারা জুতোর তলায় শুকতলা পরায়? পাতলারো- যারা যেখানে সেখানে কামারশালা বসিয়ে গ্ল্যামিংগো গান শোনায়? ক্যাসকারবেরো- যারা সুন্দর সুন্দর মাটির পাত্র বানায়? কাহিরিনানো- যারা রংবেরঙ্গের ঝুড়ি তৈরী করে?
ইহুদী? কারাকিস? রাঁবোয়া? বিউরদিনদি? ক্যাম্প ভোলান্ত? নাকি উঠল বাই তো কটক যাই, দেশে দেশে ঘুরে বেড়ানো বোহেমিয়ান?
না না, তাদের পোশাক পরিচ্ছেদ দেখে তো তা মনে হয় না। অবশ্য স্যুটেড ব্যুটেড দেখেও কী আর এদেশে ভিক্ষাকারী বলে মনে হয়? এইতো একটু আগে গচ্চা গেল দু ইউরো।
কম করেও দশ বারোটি মোটরকার। একটা ক্যারাভান, একটা চতুস্পদ ঘোড়া। গাধা বা খচ্চর নয়, ঘোড়াই। এক গোষ্ঠীর লোক বলেও তো মনে হয় না।
ঐ যে প্রৌঢ়া, হলদে মুখমন্ডলে, কুঁচকানো মুচকানো অজস্র বলীরেখা-দেখে তো ভ্রম হয় বুঝি বা চীনা কি জাপানী। নিদেনপক্ষে তিব্বতী, পোশাক আশাকও পরেছে তেমন। লুংগী আর মেখলা।
ফুল্লরা বেসাতি করে নগর বাহিরে। হাঁড়িয়া চামার বেচে চারি পাই দরে। গলায় গুচ্ছ পুঁতির মালা ঝুলিয়ে প্রৌঢ়া তার পসরা সাজ্জিয়েছে। কতক কবেকার প্রাচীন মুদ্রা ও চিত্রকলা দিয়ে। কাগজে এক ইউরোর ছাপ্পা সাঁটা। অর্থাৎ কি না যা লিবে সব এক ইউরো।
আসল না নকল? যদি চীনা উম্যানই ধরি, তবে এসব কি চৈনিক মুদ্রা ও ছবি? চীনে ঐতিহাসিক যুগের শুরু তো শাঙ বংশের রাজা টি আংএর আমলে। শাঙ চৌ। চৌ বংশের শ্রেষ্ট রাজা শি হুয়াংতির শ্রেষ্ঠ কীর্তি তো চীনের মহাপ্রাচীর।
শাঙ চৌ আমলের মুদ্রা? কু খাই চির ছবি থাং সুং আমলের চিত্রকলা? আসল কি আর, সব নকল নকল।
মহিলা কি জাপানী? এসব কি জাপানের মাকিমোনো, কাকেমোনো, কানো , উকিওয়া গোত্রের ছবি? আসুকা ফুজিয়ারা, কামাকুরা, আসিকাগা, যুগের মুদ্রা?
আর তিব্বত, প্রৌঢ়া যদি তিব্বতীয় হয়, তবে তো আমাদের হিমালয়ের ওপারের দেশের মেয়ে! কুবলাই খাঁ নাকি তারও আগে শ্রোঙ বতসং সগম পোয়ের আমলের মুদ্রা বিছিয়ে গ্যাঁট হয়ে টুলের ওপর বসে আছে সে।
শুধু কী সে, অনতিদূরেই এক শ্বেতাঙ্গিনী। চোখের তারায় বেগুনী ফোঁটা। দোকান খুলেছে যতসব পুরাতন ফুলকারি হাতঘড়ি ও হাতব্যাগের। বিশেষতঃ মেয়েদের।
ভাষা তো বুঝি না, শ্রের ক্লিয়ে বলে সে কী হেঁকে চলেছে – মাদাম রঁলার ভ্যানিটি ব্যাগ, মাদমোয়াজেল অঁরির হাতঘড়ি, নাপোলেঁয় বোনাপার্তের ঘোড়ার নাল?
সব জিনিসেরই একদর। এক ইউরো। একটা নীল ফিতেওয়ালা ফুলকারি হাতঘড়ি দেখে তো মনে হল নতুনই- কিনে ফেললাম। চারধারে সোনার বরণ আর তারার মালা, মাঝখানে রুপোলী আভা, এক ইউরোর কয়েনটা হাতে দিতেই সুন্দরী রমণী স্মিতহাস্যে—
মেরসী বক্যু! ম্যসীও—
আমিও বললাম,
মেরসি বক্যু মাদাম!
মাদাম রঁলার ভ্যানিটি ব্যাগটিও কম লোভনীয় ছিল না। সেটাও ফুলকারি, নানাবিধ নক্সা আঁকা। ওসব রঁলা-টঁলা বাজে কথা। হয়তো কোনো ফরাসী রমণীরই ব্যবহৃত সেকেন্ড হ্যান্ড।
সখেদে হাত কামড়াচ্ছি, একটু আগে দু ইউরো জলে গেল। কীই না পাওয়া যাচ্ছে- শীতবস্ত্রাদি, পশমের টুপি মোজা, পুরাতন খেলনা, এয়ারগান। পিয়ানো গীটার। বনেদী আয়না। সাইকেল পেরাম্বুলেটর। কাষ্ঠনির্মিত নক্সাদার পাত্র, পুরাতন মানচিত্র। বিবিধ সাম্রাজ্যের পতাকা। বাইনোকুলার, ইলেকট্রিক ইস্তিরি। ছুরি অস্ত্রাদি। হিটার ইনডাকশন কুকার। চুম্বক, চাক ভাঙা হানি, ওয়াইন। বৃহদাকার বাইবেল, অভিধান ও আধুনিক নভেল। দিগদর্শন যন্ত্র, তিমি শিকারের তুরপুন। আরো কত কী যে!
হঠাৎ জমে ওঠা গির্জার মাঠের বেচাকেনার, ভেবেছিলাম আমিই আবিষ্কারক আর প্রথম খদ্দের। তা সে আদপে ভুল, টের পেলাম খানিকটা থিতু হয়েই। আমার আসার আগে, এমনকী গাড়ি ঘোড়া ক্যারাভান ঢোকারও আগে এগলিজ স্যে ফ্রঁসের মাঠে লোক জড়ো হচ্ছিল দস্তুরমতো।
মাত্র এক দুইউরোর ব্যাপার। ওই তো মাথায় ফেট্টি বাঁধা কালো মহিলা এর মধ্যেই ব্যাগ ভর্ত্তি করে ফেলেছে। উঁকি দিচ্ছে সসপ্যানের কানাচ হাতা খুন্তি। একটা রুমওয়াশের যন্ত্র নিয়ে দরাদরি করছে। তারা বুঝি জানতই।
আমি নাড়ানাড়ি করছি একটা দূরবীন নিয়ে। দূরবস্তুর দর্শন সাধন যন্ত্রবিশেষ, টেলিস্কোপ। যার কাজই হ্ল দূরস্থিত বস্তুকে দৃশ্যতঃ নিকটস্থ বা বর্ধিত করা। গালিলেওর দূরবীন বলে চালানোর চেষ্টা করছে নাকি বিক্রেতা?
না না, তা নয়। আমি যন্ত্রটির গুণাগুণ পরীক্ষার ছলে প্রথমেই বিক্রেতা যুবকের মুখের ওপর ফোকাস নিবন্ধ রাখলাম। সে আমার সামনে অনেক বড় হয়ে প্রতিভাত হ’ল।
ঈষৎ লালচে দাড়ি। দাড়ির লোমকূপগুলি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। বাঁ ঠোটের কোণে হসন্তের মত সামান্য কাটা দাগ। কোথকার মানুষ সে? ফ্রান্স? জার্মানী? স্পেন? পর্তুগাল? বুলগেরিয়া? রোমানিয়া? হাঙ্গেরি না কিরঘিজস্থানের?
নাকি সিরিয়া ইরাক ইরান তুরষ্ক আফগানিস্থান মিশরের? ভারতীয়ও তো হতে পারে। কেননা আজ যারা ইউরোপের ভবঘুরে, জিপসী, রোমানী, এককালে তারা ছিল ভারতীয়ই।
ভারতীয় সিরকীওয়ালা। সম্ভবতঃ একাদশ কি দ্বাদশ শতাব্দীতে তারা ভারতবর্ষ থেকে চিরতরে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। যা তাঁবু তাই সিরকী। বানজারা বাদিয়া বিরহোড়রা, তো এখনও গ্রাম বা ঘরবাড়ি অর্থাৎ সিরকী কাঁধে ঘুরে বেড়ায় দেশ থেকে দেশান্তরে।
ক্রমে বিক্রেতা যুবকের মুখ থেকে দূরবীন সরিয়ে চোখ রাখলাম যাযাবর যাযাবরীদের মেলার ওধারে মাঠের দিকে। মাঠের ঘাসগুলোর ডগাও যেন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। আর রঙ। সব জ্যান্ত ঘাস না প্লাস্টিকের?
দূরবীন চলছে। চলছে চলছে। অতঃপর দেখা গেল প্রায় তিনফুট উঁচু একটা পাঁচিল। পাঁচিল টপকাচ্ছে একটা ষোল সতের বছরের যুবতী। সোনালী চুল গায়ে একটা সাদা গেঞ্জি আর শর্টস। পায়েও সাদা রঙের শ্যু।
একটা পাঁচিল টপকাল। দুটো। প্রায় সম উচ্চতার আরেকটা পাঁচিল টপকে সে একটা বাড়ির কাছে গেল। চিমনিওয়ালা দোতলা বাড়ি। বাড়িটার পেছন দিকে দাঁড়িয়ে মেয়েটি দুহাতের আঙুল মুখে পুরে শিস দিল।
গল্পটা তৈরী হয়েও হ’ল না। কেননা বাইনোকুলারটা আচমকা কেড়ে নিয়ে বিক্রেতা লোকটা এক আঙুল দেখাল। তার মানে মূল্য এক ইউরো। নেবে তো নাও।
সহসা মনে হ’ল বিক্রেতা যুবক নির্ঘাৎ কিরঘিজস্থানের। নচেৎ যেমন করে ছোঁ মারল। কিরঘিজস্থান- সোনালী ঈগলের দেশ, যেখানে তাদের শিকার উৎসবে, দড়িতে বাঁধা নেকড়ের সাথে শিকারী ঈগলের যুদ্ধ হয়।
হতচকিত আমি খানিক বিমূঢ় হয়ে বিক্রেতার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। ফের যখন মাঠবরাবর দূরবীন হীন চোখে তাকাই শিস দেওয়া যুবতীকে আর দেখা গেল না। গল্পটাও পুরো হ’ল না।
কেমন যেন মনে হ’ল গল্পটা দূরবীনেই আছে। খালি চোখে তা দেখা যাবে না। তখন এক ইউরো দিয়ে কিনেই ফেললাম দূরবীনটা। বিক্রেতা কিরঘিজস্থানী যুবক আমার সঙ্গে হাত মেলাতে মেলাতে তার ভাষায় কি যেন বলে চলল। তবে তা কখনই বঁজুর বা মেরসি বক্যু নয়।
৪.
ক্যারাভান তো নয়, ঢাকনাওয়ালা একটা গাড়ি, ঘোড়ায় টানা। ওই করেই কেউ কেউ তাদের জিনিসপত্র বেচতে এনেছে। ক্যারাভান বা কাফেলাতো নিরাপত্তার জন্য একত্র ভ্রমণকারী মরুযাত্রীদল। তাদের সঙ্গে থাকে কতক পশু উট ঘোড়া আর খচ্চর।
তাদের কাছ থেকেই জামাকাপড় ইস্তিরি করার একটা যন্ত্র কিনলাম। মাত্র দু ইউরো। ছুরি কাঁটা চামচ, পুরোনো তরবারি কম্পাসযন্ত্র ময়ুর আর খেজুর গাছের নক্সা খোদাই করা বাক্স এক ফরাসী ছোকরা তো খাপে ঢাকা একটা ছোরা নিয়ে দরদাম করছে।
ছোরাটা কার? অষ্টাদশ শতাব্দীর সমরবিদ সাকসে, গিবের, বুর্সে না নাপোলিঁয় বোনাপার্তের? ছোকরাকে জবরদস্ত বিক্রেতা কি বলে টুপি দিচ্ছে?
টুপি কি আর, অস্ট্রিয়া, গ্রেট ব্রিটেন, স্পেন, জার্মানী, ইতালি, মিশর, সিরিয়া, আলজিরিয়া, তিউনিশিয়ার বিরুদ্ধে অভিযানকারী যুদ্ধবাজ ফ্রান্সের বংশধর বোধকরি ছোরার ধার দেখাচ্ছে।
টুলের ওপর বসা প্রায় মোনালিসার মতো দেখতে এক পসারিনী তখন থেকে আমার নজর কাড়ছে। বা বলা চলে যা দেখছি তাই কিনছি দেখে সে বুঝি আমাকে ইশারা করছে। গেলাম—
--বঁজুর মাদাম!
--বঁজুর ম্যসীও!
ডাঁই করা কতক নতুন পুরাতন ডিকশনারী। দিকসিওনের – ফ্রঁসে অঁগলেজ, অঁগলেজ ফ্রঁসে। অর্থাৎ ফরাসী থেকে ইংরিজি কী ইংলিশ থেকে ফরাসী। মাকসি পশ। বৃহত্তম পকেট ডিকশনারী।
একটা ডিকসিওনের দরকার অবশ্যই। এতদিন থাকলে অন্ততঃ উ এক্সপ্রেস মলে আর যাইহোক মাছের মাথাটা খোয়া যেত না।
উলটে পালটে দেখছি। ভাষা ফরাসী হলে কি হবে, প্রায় সবই তো ইংরেজী হরফে। ফরাসী শব্দ, তর্জমা ইংরেজীতে করা। আবার অর্দ্ধেক বই জুড়ে ইংরাজি, অর্থ ফরাসীতে করা। পাবলিশার্স ফ্রাঁসোয়াজ অরল্যান্দো।
যাযাবরী কিসব বলতে বলতে একটা ভাবের আবহ তৈরী করে ফেলাতে কিনেই ফেললাম। দাম মাত্র চল্লিশ সেন্ট। খুচরো পয়সাটা হাতে নিয়ে গুণেও দেখল না। মোনালিসার হাসি হেসে বলল-
-- মেরসী ব্যকু ম্যসীও!
মাথা নেড়ে ধন্যবাদ জানালাম আমিও। খেয়াল করলাম যাযাবর যাযাবরীদের মেলা খুব জমে উঠেছে। যাযাবর যাযাবরীই তো। কোত্থেকে ভুঁইফোঁড়ের মত উঠে এসেছে। কোথাও একটাও লোক ছিল না। তারপর কেমন করে মেলা বসে গেল।
বুর্জেনীয়ের হয়ে গার দ্য পঁ রুশোর দিকে ট্রাম চলে যাচ্ছে। ট্রামের জানালায় যাত্রী। রাস্তার ওধারে একটা বৃহদাকার হোর্ডীং, ক্যাবারে এস্প্যানিওল লা বোদেগা —মনে হয় ঘোড়ায় চড়ে নৃত্য পরিবেশন।
ডিকসিনেওর ঘেঁটে দেখলাম এস্প্যানিওল শব্দটির অর্থ স্প্যানিস। তার মানে স্পেন দেশীয়। তবে কি স্পেনিয়ার্ড নৃত্য? স্পেনের জিপসী সংস্কৃতির কেন্দ্র গ্রানাদা থেকে আসছে এরা?
হবেও বা। একটা কালো মেয়েকে দেখলাম এঁগলিজ সে ফ্রঁসে দাজি গির্জার দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে গেল বোধহয় প্রার্থনা শুরু হবে। আমি আবার যাযাবরদের মেলায় মন দিলাম।
এবারে বইয়ের দোকান। যেন নতুন ও পুরাতন বইয়ের প্রদর্শনশালা। সমগ্র কলেজ স্ট্রীট না হোক ভবানীদত্ত লেনের মুখটা বড়জোর। কি বই চাই, কি বই চাই বলে হাঁকাহাঁকি নেই, হাত ধরে টানাটানি নেই। বিক্রেতা দুজন নিজেদের ভিতর নীচু স্বরে কথা বলছে।
কম আন শ্যভাল সোভাজ...। হাতের কাছেই ডিকশনরি। খুঁজে খুঁজে মানে বের করলাম। যেন বুড়ো ঘোড়া। লেখক ব্রেন্দা মত। প্রচ্ছদে বন্য জলাশয়, ধাবমান তিনটি অশ্ব, উপরে আলুলায়িত কুন্তলা এক রমনী। চুলের গোছ এসে পড়েছে দুই ঠোঁটের উপর। চোখের তারায় বেগুনী ফোঁটা। কভারের রঙ গৈরিক।
উপন্যাসই বটে। মূল্য আধ ইউরো। প্রকাশক আর্লকাঁ। প্রথমে প্রস্তাবনা, তারপর উপন্যাসের শুরু শাপিতর ওয়ান অ্যনসেত জুর্নি উ এতেত সঁসি ক্ষেতেত জোয়াইসেমেঁ সোঁ আনিভেরসের কাতলিন ক্রাসের...
কে জানে কি মানে! বাসায় ফিরে ডিকশনরী ঘেঁটে তর্জমা করব। তবে এটুকু ধরে নিতেই পারি বেগুনীফোঁটাওয়ালা চোখের মালকিন কাতলিন ক্রাসের। এক নম্বর পরিচ্ছেদে তার বিবাহবার্ষিকী উৎসব উদযাপনে একটা কিছু অঘটন ঘটে গিয়েছে।
যা হোক বইটা আধ ইউরোর বিনিময়ে হস্তগত করলাম। একটা হাতঘড়ি একটা দূরবীন, একটা ইস্তিরি, একটা ডিকসনরী, একটা আধুনিক নভেল কেনা হ’ল।
আর আর ক্রেতারা হাঁড়ি ডেকচি হাতা খুন্তি পেরাম্বুলেটর একপায়ের সাইকেল ছোট ছোট খোকাখুকুদের পোশাক পায়ের মোজা রকমারি আয়না সুদৃশ্য ফ্রেঞ্চ উইন্ডো কত কি কিনে চলেছে। মাদাম রঁলার ভ্যানিটি ব্যাগটাও লোভে পড়ে কিনে ফেললাম।
কেনা জিনিসগুলো সঙ্গের দুদুটো বাজারী থলের মধ্যে ঠেসেঠুসে রেকতর স্মিথ হয়ে জুলেভার্ণ মূজের পাশ দিয়ে পাশ দিয়ে প্রায় দৌড়ুতে দৌড়ুতে য়্যুনিভ্যেরা ল্য সঁসিভ্ এ ফিরেছি। ঘোরতর ইচ্ছা আরো কিছু খুচরো সেন্ট ও ইউরোতে নিয়ে এসে আরও কিছু সওদা করি।
দ্বিগুণ তিনগুণ উৎসাহে বুলভার মার্টিন লুথার কিং ধরে দু দুটো থলে নিয়ে আমি ফের দৌড়ুতে লাগলাম। জুলে ভার্ণ, এলেকতিক অফিস, রেকতর স্মিথ ট্রাম স্টপ পেরিয়ে গেল...আমি দৌড়ুতে লাগলাম
গলি তক তেরী লায়া হমেঁ শওক
কঁহা তাকত কে অব ফির জায়ে ঘরতক?
আমার ইচ্ছেই আমাকে তোমার গলিতে টেনে এনেছে। এখন আমার সাধ্য কি ঘরে ফিরে যাই।
মরা শামুক গেঁড়ি গুগলীর দোকানদার এখনো দোকান খোলা রেখেছে। দুচারজন খরিদ্দার শুকা শুঁটকি কেনাকাটা করছে। ট্রাম ট্রাম রাস্তায় চলেছে, বাস বাস রাস্তায়।
ছুটির দিন হলেও রাস্তায় লোক চলাচল বেড়েছে। বেলাও কম হ’ল না। তবে ঘড়িতে প্রায় বারোটা বাজলেও দ্বিপ্রহর বলা চলে না। রোদের তাত সে তো বাড়বে বেলা দুটোয়।
আর ক’ গজ দূরেই এগলিজ সে ফ্রঁসে দাজি গির্জ্জার মাঠ। মাঠে যাযাবর যাযাবরীদের এতক্ষণে হয়তো লোক জড়ো হয়েছে প্রচুর। হয়তো বেচাকেনাও বেড়েছে পুরোদস্তুর। সমসতই বুঝি ফুরিয়ে গেল। দৌড়লাম,
দৌড় দৌড়—
কোথায় কী! একটা লোক নেই। একটা গাড়ীও নেই। ঘোড়ায় টানা ক্যারাভান চলে গিয়েছে। কখনও যে এখানে একটা মেলা বসেছিল তার কোনো চিহ্ন নেই।
ধূসর একটা ঘুঘু এক পা এক পা করে নেচে নেচে গির্জ্জার মাঠে কী যেন খুঁটে খাচ্ছে।