এক
জঙ্গলের ধারে ধারে গ্রাম, গ্রামের ধারে ধারে জঙ্গল। কখনো বা জঙ্গলের মাঝে মাঝে গ্রাম, গ্রামের মাঝে মাঝে জঙ্গল। জঙ্গলে গ্রামে মেশামেশি। মেশামেশি মেশামেশি। জ্যোৎস্না পুলকিত যামিনীতে। যখন চাঁদের আলোর খই ফুঁটে, প্রস্ফুটিত খইয়ের জ্যোৎস্না ঠিকরে এসে রদবদিয়ে মাটির বাড়ির "পশুমাটি" অর্থাৎ বিলমাটি চর্চিত দেয়ালে "কহবর" লেখে, 'কহবর লেখা' তারমানে চাঁল গুঁড়ি গোলা জল, আলতা, সিঁদুর, পুঁই-মেচড়ি আর সিমপাতার রস দিয়ে বিবাহ বাসরের পাল্কি সোয়ারি কাঁজল লতা জাতি, মাথার কাঁটা কাঁকই আঁকে, জ্যোৎস্না কী আর আঁকে, মেহা-মাদাল, চল্লা আঁইশা গাছে ডালপালার ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে ঢুকে পড়া চাঁদের আলোয় আগে থেকেই আঁকা দেওয়ালের চালচিত্র উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়, পিড়িং পিড়িং করে আলো জ্বালতে জ্বালতে পাশ দিয়ে চলে যায় "বাঘ ফুগনী" বা জোনাকি পোকা, অলস অপারন্থের মতো ভারি হতে থাকে জ্যোৎস্না, ছায়ায় ঢাকা পাতায় মোড়া, অনুস্বার বিসর্গ চন্দ্রবিন্দু খণ্ড ত (ৎ) এর মতো ছোট ছোট গ্রামগুলি। দোরখুলি, সবুজ রুখনীমারা, ভালিয়াঘাটা, মুঢ়াকাটা, টটাসাহি, নুয়াসাহি, থুড়িয়া, বড়োডাঙা, ডাঙাসাহি, কিয়াঝরিয়া, বিবিবাড়িয়া, টিয়াকাটি, সব এই এক ঘুমিয়ে পড়ে। কটকটি, ব্যাঙ কিংবা রিঁ-রিঁয়া পোকা, থেকে থেকে "কট রিঁ-ইই রিঁ-ইইই করে কেবলই ডাকতে থাকে তখন, ঠিক তখন মনে হতেই পারে চরাচর খুব সুখেই আছে। তাবৎ মানুষের কোন দুঃখ নেই। তার আগে বড়োডাঙা গ্রামের অধিবাসী শশাঙ্ক বেহেরার অবশ্য তাই মনে হত। সে রাত ভিত জ্যোৎস্নার ছায়ান্ধকারে ঢোল-কলমির বনের ভিতর দিয়ে গড় নেমে যেত। সামান্য হেঁটে হাত বাড়ালেই সুবর্ণারেখা নদী, নদীজল। হাতে বড় থাকতো একটা টর্চের আলো। যতনা পথঘাট দেখার জন্য, তারও বেশি নদীতে মৎস্য শিকার, অন্ধকারে নদীজলে টর্চের আলো ফেলে মাছ ধরার সে এক অদ্ভুত কৌশল। টর্চের নীলাভ আলো মাছের চোখে পড়লে জলেও খালবিলে মাছ স্থির হয়ে যায়। নড়তে চড়তেও পারে না আর। তখন ঝোপ বুঝে কোপ মারলেই হলো। কেউ কেউ তো তলোয়ারের কোপ মেরেই মাছটাকে করে ফেলে দু'টুকরা, নদীজলে রক্তারক্তি কাণ্ড। শশাঙ্ক বেহেরা অতোটা আবার নিষ্ঠুর নয়। টর্চের ফোকাস মাছের উপর ফেলে রেখে অন্য হাতে মাছটাকে খপ করে তুলে নেয় সে। তার যে জীবন্ত ধরাতেই আনন্দ। এই কিছুদিন পূর্বেও সুবর্ণারেখা নদীতে ইলিশ উঠত। খান্দারপাড়া গ্রামের ঝড়েশ্বর পানী আর মাধব পানী দুই ভাই, নদীবুকে পাটায় দাঁড়িয়ে দিবারাত্রি অষ্টপ্রহর জাল ফেলত। দিনে তাদের গড়ে বত্রিশটা ইলিশেরও রেকর্ড আছে। এখন সে দিনকাল আর নাই। জিজ্ঞাসা করলে তারাও তেরচা করে বলে "আঘু তভু অনেক ইলশা উঠতায় সুবনরেখায়। অখন সে ইলশা কুবে আছে জানু?কলকাতায়!" অর্থাৎ আগে তবু অনেক ইলিশ উঠত সুবর্ণরেখায় এখন কোথায় উঠে জানিস? কলকাতায়।
শশাঙ্ক ভাবে সে "কহবর"ও কী আর এখন বিবাহ বাসরে মাটির দেয়ালে লেখা হয়? সেই আরশি কাঁকই, জাঁতি, কড়ির চুবিড়ি, মৌড়, কাজললতা। হয় না, হয় না। আগে আগে পাতি না তালডাংকা মলতাবনি দেউলবাড়, বাছুর খোঁয়াড়, নিজের গ্রাম বড়োডাঙা তো আছেই। আরো দূর দূর গ্রাম নারদা নিঘুই চাঁদাবিলা থেকেও তার ডাক আসত কহবর লেখার। বাঁধাপনীর আসরে অর্থাৎ বিদায় বেলায় বরকনে যখন জোড়ের কাপড় জোড়া লাগিয়ে পাশাপাশি বসে থাকে ঘর সুদ্ধ লোক, গ্রাম সুদ্ধ লোক, বাবা-মা, কাকা-কাকী, জেঠা-জেঠী, আত্মীয়পরিজন হুমড়ি খেয়ে একের পর এক জ্বলন্ত প্রদীপের শিখায় হাত সেঁকে মাথার উপর ধানদূর্বা ছড়িয়ে উলু দিয়ে চুমু খায়, আশির্বাদ করে, ঝকঝকে কাঁসা কী পিতলের ঠং করে অথবা নীরবে আশীর্বাদীর অর্থ পড়ে সম্পর্কে শালাশালীদের কেউ একজন অধীর আগ্রহে লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, কখন শেষ হবে বাঁধাপনী, কখন থালার সমুদয় অর্থ সরিয়ে জল ঢেলে পা ধোয়ানো হবে বরকনের। থালার পা ধোয়া জলে কাঁকড়া ধরতে কখন তার ডাক পড়বে। কাঁকড়া ধরার নামকরে সে ধরবে বরকনের পায়ের যে কোন একটা বুড়ো আঙুল। উপযুক্ত বখশিশ না পেলে কিছুতেই সে আঙুল ছাড়বে না। তখন, ঠিক তখনও বরকনের বাঁধাপনীর আসরের পিছনের দেয়ালে শশাঙ্ক বেহেরার মধুবনী আর্টের আদলে আঁকা কহবর লেখা জ্বলজ্বল করে, জ্বলজ্বল করে। একবার হলেও লোকের চোখ চলে যাবে সে দিকে, যাবেই। আসলে চালগুঁড়ি , পুঁইমেচড়ি গিরমাটি, আলতা সহযোগে বিলমাটি দিয়ে ছঁস দেয়া দেয়ালে কতক আঁকাজোকা, তবুও তো লোকে বলে "কহবর" লেখা। বিবাহ বাসরে যেন বরকণের অনাগত ভবিষ্যৎ জীবনের আলেখ্যই লিখে দিতো শশাঙ্ক বেহারার ললাট লেখা।
সেদিন আর নেই। তার রমরমা আজ প্রায় অতীত। তবুও এই তো কিছুদিন আগেও নদী যখন শুকনো চার ধারে বালির বাঁধ দিয়ে খাবলা খাবলা জলটুকু ঘিরে জলে হাজারটা গুড়মন গাছের রস মিশিয়ে সতীবাঁধা সামান্য চুনোপুঁটি, ব্যাঙ টুনিও পাওয়া যাচ্ছিলো না আর, তখন যে শুরু করেছিলো বাণিজ্য মহুল আর বাবুই দড়ি কেনাবেচা জঙ্গলের ভিতরে ভিতরে অবস্থিত মাহাত করনদের গ্রামে গ্রামে গিয়ে মহুল অর্থাৎ মহুয়ার বস্তা আর বাবুই দড়ির বাণ্ডিল গোস্ত করে বড়খাঁকড়ির হাঁটে কিংবা আরো দূর দূর বারিপদা ময়ূরভঞ্জের বাজারে বেচে আসত।
ফিরতি পথে বনের ভিতর চালিয়ে আসতে গিয়ে মস্ত চাঁদ উঠত। চন্দ্রালোকিত বনের সুঁড়িপথের দুধারে অতঃপর মাহাত তাঁতি-সাঁওতাল-কুমহার-কামহারদের গ্রাম, তাদের মাটির বাড়ির ছঁস দেয়া অর্থাৎ সাদা বিলমাটির ন্যাতা বুলান দেয়ালে সাঁওতাল মাহাত বিটিছানাদের হাতের কতরকম কাজ, ফুলপাখি, লতাপাতা -তার কহবর লেখার থেকেও যে সরেস সরেস আঁকাজোকা সব, শশাঙ্ক বেহেরা ক্রিং ক্রিং বেল বাজিয়ে যেন শিল্পীদের সংবর্ধনা জ্ঞাপন করেই সরসরিয়ে সাইকেল ছোটাত-"আমি মানি জানি না"
সেদিনটাও আর নেই। চাপা পড়ে গেছে। চাপা পড়ে গিয়েছিল দেয়ালগুলোও। রাজনীতি বাবুদের হাতে লেখা, ছাওয়া ছবি ও পোস্টারে কুলহি রাস্তার দুধারের মাটির বাড়ির দেয়ালে ঢাকা পড়ে যেত। চাপা পড়ে থাকত মাহাত, সাঁওতাল, ভূঁইয়া, ভুমিজ, বাউরি, বিটিছানা বহুছাদের অত্যাশ্চর্য সব হাতের কাজ। একদিন দুদিনের জন্য তো নয়। বছরের পর বছর, দেয়ালের স্বত্ব দখল করে নিত পার্টি বাবুরা।
মকর বাঁদনা সারুল সহরায় এবিল থেকে পশুমাটি তুলে এনে মেয়েরা দেয়াল গাবিয়ে শুকনো করতে না করতেই তারা এসে ইংরেজিতে কী সব লিখে দাগা মেরে দিত। তাদের দাগা দেখলে সেখানে আর কেউ দাগা মারতে সাহস পেত না। অঙুলশিল্পী বউড়ী-ঝিউড়ীদের আঁকার জন্য হাত নিসপিস করলেও হাত গুটিয়ে বসে থাকা ছাড়া উপায় কী?
কহবর বাদ, গিরগিটি -পুঁইমেচড়ি, সিমপাতার দিনও শেষ, পার্টিবাবুদের লেখাজোকা পোস্টার সাঁটাও আপাতত বন্ধ, এখন তো প্রতিদিন দেয়ালে দেয়ালে, বিশেষত যাতায়াতের রাস্তার পাশের দেয়ালে সূর্যাস্তের আগে ভাগে বেলা থাকতে থাকতেই আঁকতে হচ্ছে গোবরের লাদি দিয়ে তিন, তিনটে বেটে বাটকুল মানুষের প্রতিমূর্তি মাঝের জলভার কাঁধে পিছে আর দু'জন খালি হাতে।
নিজের বাড়ির দেয়ালে যেমন-তেমন আশ পাশের প্রতিবেশীর সবাইকে বাঁচার তাগিদে মরিয়া হয়ে খবর হাতে এখন গোবর নাদি থাপছে দেয়ালে। বাঁচতে তো হবে বাঁচা চাই।
দুই
‘মহুল’ আর ‘বাবুই দড়ির’ ব্যবসা ছেড়ে শসাঙু ক'দিন ‘কাজু বাদাম’ আর ‘জারা ডালের’ কারবার ধরল। এই গ্রামের মেয়ে জঙ্গল মহালের উপান্তে কালচে সবুজ কাজু বাদামের প্রাণ টেশান। ফাল্গুন চৈত্রে ময়না হলুদ ফুল আসে। ওই ফুল দেখে কাজুর লিজ নিতে হয়। জঙ্গল বাহাদুরের কাছ থেকে ফল ভালো হলে ভালো। নচেৎ লাভতো লাভ। হাতের পাঁচটুকুও উঠে আসে না। বছর দু'য়েক ভালোই লাভ করেছিলো শশাঙ্ক। লোভে পড়ে পরের বছরগুলো মার খেল। অতপর কাজ ছেড়ে আড়া ধরা। আড়া হলো জঙ্গলের ভিতরে গাছের ডাল কেটে সীমানা চৌহদ্দি চিহ্নিত করে, অনেকটা যায়গা হয়ে তসরগুটির চাষ করা, দানের চাষ না পারলেও এ চাষ লোধা শবররা। তাহোক শশাঙ্ক বেহারার আড়ার প্রতি তেমন লোভ ছিলো না। তার চোখ ছিলো জারার দিকে। জারা হলো এক প্রকার বনজ বরবটি। বন কুদরী বন কাকরোলের ন্যায় অবিকল গাঢ় সবুজ রঙের বরবটি। আড়ার শুকনো জালের মাচান বেয়ে আদিবাসী সৌন্দর্যে ও সতেজতায় ফনফনিয়ে বেড়ে ওঠে। তার পুরুষ্টু পুরুষ্টু বীজ অর্থাৎ জারা ডাল খেতে সুস্বাদু , বিকোয়ও খুব চড়া দামে। দুটো বেশি পয়সার মুখ দেখেছিলো শশাঙ্ক তাও তো 'ফেল' মারলো। এমন জঙ্গলের ঢোকাই দুঃসাধ্য, বিপদজনক।
জঙ্গল ছেড়ে নদীর মাছ নয়, নদীধারের পাল জমিনের খেড়ী-তরমুজ, বাঁধাকপি, ফুলকপি, আলুটা, মূলটা, চাষীদের কাছ থেকে অপেক্ষাকৃত কম দামে কিনে নদী সেপারে রোহিনী, কুলটিকরী কী কেশিয়াড়ীর হাটে একটু চড়া দামে বেচে দিয়ে আসে শশাঙ্ক। দামের তফাৎ খুব যে আকাশ-পাতাল হয়ে যায় এমনটা না হলেও মোটের উপর লাভ থাকে ভালোই। আনাজের পাইকার হিসেবে যৎকিঞ্চিত নামডাক হলেও শশাঙ্ক কিন্তু ফড়ে নয়। ফড়ে নয়, ফড়ে নয়। গরুর গাড়ি করে আনাজ পাতির চাঙারি নিয়ে সে যখন কুস্তুড়িয়ার বেগুনা - শ্বেতভেরেণ্ডার ছায়াঘন পথ ধরে, পথের অদূরে ছোট নদী ডুলুঙের জল যখন রৌদ্রে পড়ে ঝিলিক দেয়, বাতাসে তিরতির করে কাঁপে, চিল ডেকে উঠে চি-ল কু-ড়-র-র-র..
তখন হঠাৎ কী মনে করে গাড়ি ঘুরিয়ে দেয় শশাঙ্ক, নাহ এবার হাতিবান্ধির ভিতর দিয়ে যাওয়া যাক। হাতিবান্ধি গ্রামের ভিতর দিয়ে কিছুদূর গেলেই রোহিণী গড়ের বাবুঘর, বাবুঘর অর্থাৎ জমিদার বাড়ি, গাড়ি থামিয়ে জমিদার বাড়ির ঠাকুর দালানে একটা আস্ত 'বৈতাল', দুটো ফুলকপি কী বাঁধাকপি নামিয়ে রেখে ঢিব করে সে প্রনাম করে, হয়তো তখনও দুর্গা মেড়ের কাঠামোও মাটিই পড়েনি। সবে খড় বাঁধার কাজ হয়েছে। লেজুড় মুচড়ে আনাজ গাড়ির গরুগুলিকে ছুটিয়ে দিয়ে শশাঙ্ক তারপর গান ধরে -"উইড়া গেলে রাজা নতুন পঙ্খী বান্ধে। আর দুঃখীর পঙ্খী উইড়া গেলে দুঃখী শূণ্য খাঁচায় কান্দেরে-"।
তিন
রোহিনীর হাটে এসেছিলো শশাঙ্ক। 'কাঁকুড়ে'র গাড়ি নিয়ে, 'কাঁকুড়'- তারমানে বৃহদাকার শশা। তরকারি করার নিমিত্ত রোহিণী সি এর ভি হাইস্কুল হোস্টেলের ম্যানেজারই কিনে নিয়েছেন সিংহভাগ। বাকিটাও আধঘণ্টার মধ্যে শেষ। দুচাট্টা 'বুড়ো' বেরিয়েছিলো, তাই এখন চিবিয়ে চিবিয়ে খাচ্ছে গরুগুলো, খাক! হাট 'বুলতে' বেরুল শশাঙ্ক। মঁঙ্গল আর শুক্র সপ্তাহে দুদিন এখানে হাট বসে।
হাটের পরিধি বাড়তে বাড়তে এখন ছাড়িয়ে গেছে 'ভ্রমড়গড়'। রোহিণী গ্রামের উত্তর প্রান্তে অবস্থিত 'ভ্রমড়গড়'। সে এক আলাদা আখ্যান। সে দিকে গেল না শশাঙ্ক। তার আগেই তাকে হঠাৎ করে টেনে নিল নদী সেপারের থুরিয়া গ্রামের মনা পাতর। বলল, "খবর শুনিছ র্যা শশাঙ্ক?" শশাঙ্ক বলল, "হঁ, টিকে টিকে। " অর্থাৎ একটু একটু। তারপর তাদের দুজনের ভিতর সুবর্ণরেখা নদীতীরবর্তী 'হাটুয়া' ভাষায় ফিস্ ফিস্ করে কথা হল। একটু একটু নয়, খবরটা চাউর হয়ে গেছে বেশ গভীরভাবেই, এখন দাবানলের মতোই ছড়িয়ে পড়ছে হু হু করে! 'হাটুয়া' তার মানে বাংলা-ওড়িয়া মেশামেশি এক চলিত ভাষা– রাজু, খন্ডায়েৎ, সদ্গোপ, তেলি-তাম্বুলী, করণ, উৎকল-ব্রাহ্মণদের ভাষা।
খবরটা এই, – দিনের বেলা যেমন-তেমন, রাতের বেলা, বিশেষত রাত যত বাড়ে, শুন্শান হয়, কট্কটি ব্যাং কিংবা 'রিঁ-রিঁয়া পোকা'র ডাক যত মুখর হয়, নিকটবর্তী জঙ্গলমহালে দু-চাট্টা ভুঁড়াশিয়াল অথবা বনমোরগের ডাক প্রহর গোনে, কর্মক্লান্ত অবসন্ন মানুষ যখন গভীর ঘুমে ঢলে পড়ে, আচ্ছন্ন হয়, যখন তার আর কোনো 'সাড়' থাকে না, তখন, তখনই তারা আসে, সুবর্ণরেখা নদীর দক্ষিণতীরবর্তী তেঘরি-পায়রাকুলি-আসনবনী-হাতিমারা-ধানসোলা-জামসোলা-পাতিনা-বাবুইচাটি-খুদ্মরাই, কোনো-না-কোনো গ্রামের 'কুল্হি-রাস্তা'য় যেতে যেতে আচমকা কারোর-না-কারোর ঘরের 'ছামু'-তে দাঁড়িয়ে পড়ে নাম ধরে হাঁক দিচ্ছে, সে-হাঁকডাকে ঘুমের ঘোর ভেঙে সাড়া দিলেই 'মরণ'! ভোর হতে-না-হতেই তার মৃতদেহ পড়ে থাকছে পাঁচকাহিনা বড়খাঁকড়ি ঘোড়াটাপুর কমলাসোল নারদানিঘুইয়ের জঙ্গলে, চাঁদাবিলা- খড়িকামাথানী-গোপীবল্লভপুরের 'পিচ্' রাস্তায়, নচেৎ মহলী-সীতানালা-মুরলী খালধারে, সুবর্ণরেখা নদীপাড়ে। শ্বাসহীন, ধড়-মাথা বিচ্ছিন্ন হয়ে। রটনা– সংখ্যায় 'তারা' তিনজন, গ্রামের 'কুল্হি-রাস্তা'-য় টায়ারের চটি-পায়ে রাতভিত বালি ছিটিয়ে মস্ মস্ করে হেঁটে যায়, মাঝের জন 'ভার-কাঁধে', আগে-পিছে দুজন, খালিহাতে–। উচ্চতায় তারা খাটো– যাকে বলে বেঁটে-বাঁটকুল। কেউ কেউ বলছে, "না, সংখ্যায় তারা ন'জন, তেরজনও হতে পারে। জোড়ে জোড়ে নয়, তারা আসে সবসময় বিজোড়ে।
মনা পাতরকে ছেড়ে শশাঙ্ক গেল চঁদরপুরের চারু হাটুইয়ের কাছে। চারু হাটুই হাটে এনেছে ক্ষেতের পুঁই, 'পাল'-য়ের বেগুন, গাছের পেঁপে-পেয়ারা। 'নদী-এপারে'র মানুষ ফলমূল খুব খাচ্ছে, তাদের তো ডর-ভয় নেই, তাদের তো রাতভিত কেউ এসে 'নাম ধরে' ডাকছে না, তারা নাকে সর্ষে তেল দিয়ে ঘুমোচ্ছে, যত আতঙ্ক 'নদী-সেপারে'। 'নদী-সেপার' 'নদী-এপার'। চারু হাটুইয়ের বুক ধ্বক্ ধ্বক্ করছে– কে জানে আজ, হয়তো আজ রাতেই 'তিনমূর্তি' এসে দাঁড়াবে তারই ঘরের 'নাচদুয়ারে', 'তুলসী চউরা'র কাছে দাঁড়িয়ে হাঁক পাড়বে যমদূতের গলায়, "চারু! চারু হাটুই!! চারু-আ-আ-আ! খোল্ দরজা!!" হয়তো সেও ঘুমের 'তাড়সে' দরজার পাল্লা খুলে মুখ ফস্কে "কে" "কে" বলে সাড়া দিয়ে ফেলবে। আর দিলেই তো–
"চারু ভাই! শুনোট?"
"কে? কে?" ঘোর ভেঙে চমকে উঠে একহাট লোকের মধ্যে প্রায় কেঁদে ফেলে সম্বিত ফিরে পেয়ে চারু হাটুই বলল, "অঃ শশাঙ্ক!"
চার
গ্রামাঞ্চলে মেলা বা হাটবাজারের গুরুত্ব অপরিসীম । এখানে তো আর শহরে মতো দৈনিক ‘বাজার’ বসে না, কালীবাবুর বাজার বোসবাবুর বাজার বা বোষ্টমপাড়ার বাজারের মতো বস্তুত তার কোনো ‘বাবুবাজার’ নেই, আছে বড়জোর ‘বাবুঘর’ । সেই ‘বাবুঘরের’ তত্ত্বাবধানেই রোহিনীগ্রামে মঙ্গলবার আর শুক্রবার হাট বসে প্রতি সপ্তাহেই । কারণে-অকারণে কত লোক যে হাটে আসে ! কেউ আসে কিনতে, কেউ আসে বেচতে । যার ক্ষেত আছে যে বেচতে আসে ক্ষেতের আলুটা মুলাটা, যার ক্ষেত নেই সে কিনতে আসে ক্ষেতের জিনিস, মুদিখানার জিনিস, তেলটা নুনটা । যার ক্ষেত নেই, ক্ষেতের জিনিস কিনতেও আসে না, মুদিখানার জিনিস সে তো গ্রামের হীরালাল মুদীর দোকানে গোস্ত করলেই হয়, বাস্তবিক পক্ষে সে কিছু কিনতেই আসে না, সে আসে দেখতে! দেখতে ‘খুকড়া-লড়াই’ ‘সার্কাস-বাজি’ । হা-ঘরে বাজিকররা টিকিট কেটে ‘সার্কাস’ দেখায় – ‘বাঁশবাজি’ ‘দড়িবাজি’ ‘চিটিংবাজির’ খেল । খেল খতম পয়সা হজম । রোহিনীহাটের পশ্চিমে ডুলুংয়ের ধারে ইস্কুলের মাঠে সার্কাসের তাঁবু পড়েছে । তার ধারে কাছেই ‘ফ্রী’-তে হচ্ছে ‘খুকড়া-লড়াই’ অর্থাৎ মোরগ-লড়াই । এসব দেখে-শুনে কে বুঝবে – অনতিদূরে ‘নদী-সেপারে’র মানুষ সন্ধ্যা উত্তীর্ন হতে না হতেই ঘনায়মান অন্ধকারে রাতের গভীরে ভ্রাম্যমান ‘ত্রিমূর্তি’র হিমশীতল ডাকের অপেক্ষায় প্রহর গুনছে ! প্রহর গুনছে, প্রহর গুনছে । কে জানে আজ কার পালা ! বলা মুস্কিল !
‘নদী-সেপারের’ শশাঙ্ক একফাঁকে সার্কাসও দেখল, দেখল ‘খুকড়া-লড়াই’ও । ‘নদী-সেপারের’ মুঢ়াকাটি থেকে এসেছে ঝানু ‘কাতকার’ কমলেশ্বর মাহাত । লড়াইয়ের মোরগটা কোঁচড়ে চেপে সে বসে আছে ‘উধাস’ হয়ে চুপটি করে । খেলায় আজ তার আগ্রহ নেই ।
ঘুরতে ঘুরতে তার কাছে উপস্থিত হয়ে কমলেশ্বরের মোরগটার গায়ে হাত বুলোতে বুলোতে শশাঙ্ক জিজ্ঞাসা করল, “আজ কী খালি-হাতেই ফিরবে কাৎকার?”
কোঁচড়ে এতক্ষণ চেপে রাখা লড়াইয়ের মোরগটার ঠোঁট ফাঁক করে একদলা থুতু গিলিয়ে কমলেশ্বর মাহাত যেন স্বগতোক্তি করল, “কার কপালে কী আছে বলা মুস্কিল !” বলে পরক্ষণেই মাটিতে থাপ্পড় মেরে বলল, “কিন্তু বাঁচতে তো হবে ! বাঁচা চাই !”
“এটাই কথা কাৎকার, বাঁচতে তো হবে ! বাঁচা চাই !”
আসলে গাড়ির গরুগুলোকে বিশ্রাম দিয়ে হাটময় ঘুরে ঘুরে মায় সার্কাস দেখে ‘খুকড়া-লড়াই’-য়ের ময়দানে উপস্থিত হয়ে শশাঙ্ক বেহেরাও বেঁচে থাকার কৌশল আবিষ্কারের চেষ্টায় রত ছিল । চারু হাটুইয়ের মতো তার বুকও যে ধ্বক ধ্বক করছে – ‘মাঝের জন ভার-কাঁধে, আগে-পিছে দুজন খালি হাতে’, বেঁটে-বাঁটকুল ওই তিনসঙ্গী আজ যদি তার দরজায় এসে কড়া নেড়ে ডাক দেয় – “শশাঙ্ক হে ! ওহে শশাঙ্ক হে-এ-এ-এ” – তখন? তার বেলা? তার উপর কমলেশ্বর মাহাতর মুখ থেকে যখন শুনল গতরাতে ডাক দিয়ে নিয়ে গেছে জামসোলার ভূধরকে, আজ তার লাশ পাওয়া গেছে সিংধুইয়ের জঙ্গলে – তখন তার বুকের ধুকপুকানি উত্তরোত্তর বাড়তে লাগল । বাড়তে লাগল, বাড়তে লাগল ।
গ্রাম্য হাট যেমন ‘পিঁয়ো চেঁড়ে’র মতো বিপদের খবর বহন করে নিয়ে এসে মুখ থেকে মুখে ছড়িয়ে দেয়, মুহুর্তে ‘গুজব’ হাট থেকে তল্লাটময় ছড়িয়ে পড়ে, তেমনি হাটই আবার পরিত্রাণের উপায়ও বাৎলে দেয় । ‘পিঁয়ো চেঁড়ে’ হল ‘নিশান পাখি’, যে কীনা ‘শিকার দিশমে’ যাওয়া সাঁওতাল ছেলের জঙ্গলে আক্রান্ত হওয়ার দুঃসংবাদ বহন করে নিয়ে এসে তার মায়ের চুল ধরে টেনে জানান দেয় । আজকের হাটও ‘পিঁয়ো চেঁড়ে’র ন্যায় সঙ্কটমোচনের ‘নিশান’ দিল ।
হাটের পশ্চিমে ‘সার্কাসের তাঁবু’ আর ‘খুকড়া-লড়াই’য়ের মাঠ থেকে দিশাহীনভাবে শশাঙ্ক যখন হাটের মাঝখানে এল তখন হাটের রকম-সকম তুঙ্গে উঠেছে । মোহিনীমোহন সাউয়ের দোকানে ভিড় উপছে পড়েছে । সামনে ‘পরব’ – তাই বিক্রি হচ্ছে ‘মোহিনী মিলের’ ধুতি, মুদীখানার তৈজস । গুড়-পাটালি ।
ক্ষ্যাপা শ্রীমন্তই হাত ধরে টানল, “এই য্যা শশাঙ্ক, শুনিছ?”
“কী?”
“আর কারেও বলার দরকার নাই – ”
বলেই শ্রীমন্ত যা বলল তা এইরকম – সূর্যাস্তের আগে দিনের আলো থাকতে থাকতেই রাস্তার দিকে বাড়ির দেয়ালে গোবর দিয়ে আঁকতে হবে তিনটি ‘বেঁটে-বাঁটকুল’ মানুষের ছবি – মাঝের জন ভার কাঁধে, আগ-পিছে দুজন, খালি হাতে । পরিক্রমায় বেরিয়ে ‘তারা’ যখন রাতের আলো-আঁধারিতে গৃহস্থের দেয়ালে আঁকা ওই ছবি দেখবে তখন উদ্দিষ্টের নাম ধরে আর ‘তারা’ ডাকবে না, ‘ধর্মের রাস্তা’ ছেড়ে আর ‘তারা’ গৃহস্থের উঠোনেও পা রাখবে না । সমূহ বিপদের সম্ভাবনাও আর থাকবে না । তবে যা করার প্রতিদিনই করতে হবে দিনের আলো নিভে যাওয়ার আগে আগে, সায়াহ্নে নয়, অপরাহ্নে ।
অপরাহ্নে, অপরাহ্নে ।
পাঁচ
আর বিন্দুমাত্র দেরি করেনি শশাঙ্ক, গাড়ি ‘জুতে’ ফেলল । ‘শর্টকাট’ করতে আর রোহিনীগড়ের ‘বাবুঘরের’ ওদিকে গেল না, কুস্তুডিয়ার পথ ধরল । ডুলুং নদীর ধার দিয়ে বট-অশ্বত্থের ছায়ায় ছায়ায় তার গাড়ি চলল । ‘বেলা’ এখনও ঝিরিঝিরি হয়নি, রৌদ্র যথেষ্টই আছে । একটু শীত শীত ভাব হাওয়ায় । গরু বাগালরা নদী-ধারে গরু ছেড়ে রেখে ডাংগুলি খেলছে, খেলছে ‘কাতি’ ‘দাঁড়িয়াবান্ধি’ । মাঠঘাট ছেড়ে কাক-গুয়েবনি-চটা-চড়ুই এখনও গাছে ঝোপেঝাড়ে উঠে যায়নি । তারমানে ‘বেলা’ আছে অনেকটাই । তারমানে সূর্যাস্তের আগেই সে বাড়ি পৌঁছে যাবে – ওই তো দুটো নদীর হাঁটুজল, মাঝখানে ‘কদোপালের’ চর, ওধারে মুগ-চনার ক্ষেত, কুমোরদের ‘মাটিখানা’, তারপরেই গ্রাম, বাড়ি – তারপর তো ‘কহবর’ লেখা হাত মাটির দেয়াল সাফ-সুতরো করে অবলীলায় গোবরের নাদি থেপে থেপে এঁকে ফেলবে তিন-তিনটে মানুষের প্রতিমূর্তি – ‘মাঝের জন ভার কাঁধে, আগে-পিছে দুজন, খালি হাতে’ । ল্যাজুর মুচড়ে গরুগুলোকে ছুটিয়ে দিল শশাঙ্ক, তার উপর তার গরুগুলোও সরেস – এইটুকু পথ ‘হুঁকরে’ চলে যাবে !
‘বাজে-শিমুল’ অর্থাৎ বাজে-পড়া শিমুলগাছের তলা দিয়ে গাড়ি যাচ্ছে এখন । যেতে যেতে শশাঙ্কর মনে পড়ছে মহাভারতে পড়া অর্জুনের জয়দ্রথ বধের কথা । গ্রামে-ঘরে কাশীরাম দাসের মহাভারত কার না পড়া একটু-আধটু – দু-এক ছাঁদ তো শশাঙ্কেরও কন্ঠস্থ ! অভিমন্যুর মৃত্যুতে শোকাহত অর্জুনের প্রতিজ্ঞা – “বিনা জয়দ্রথ-বধে সূর্য্য অস্ত হয়। অগ্নিতে শরীরত্যাগ করিব নিশ্চয়।। ” যুদ্ধক্ষেত্রে যখন অর্জুন-জয়দ্রথের তুমুল ‘রণ’ চলছে, তখন আচম্বিতে সূর্য অস্তমিত হয়ে গেল । উল্লসিত জয়দ্রথ অর্জুনকে তার প্রতিজ্ঞার কথা স্মরণ করিয়ে দিল, কৌরবদলও আনন্দে নৃত্য করল । এমনসময় শ্রীকৃষ্ণের সুদর্শন চক্রে ঢাকা সূর্যের প্রকাশ ঘটল – “দুই দন্ড বেলা আছে গগন মন্ডলে । দেখিয়া হইল ত্রাস কৌরবের দলে । । ” ‘বেলা’র দিকে তাকিয়ে শশাঙ্কেরও মনে হল – দু’দন্ড বেলা তো আছে, এখনও রৌদ্রের তেজ কী ! এর মধ্যে বাড়ি পৌঁছে যা কিছু করার করে ফেলতেই হবে, নচেৎ ‘ডাক’ আসবে ‘শেষ ডাক’ । - কিন্তু বাঁচতে তো হবে ! বাঁচা চাই ।
ডুলুং নদীর হাঁটুজল পেড়িয়ে গাড়ি উঠল কদোপালের চরে । সূর্যের দিকে চোখ রেখে গাড়ি ছোটাচ্ছে সে । চরে আকন্দ কাঁটাকুল আর ‘পিটনা-সিজে’র সমাহার, মাঝে মাঝে বালির স্তুপ, গাড়ির ‘লিকে’ ধুলো উড়ছে, ধুলো উড়ছে । ওই দেখা যাচ্ছে গ্রাম – খান্দারপাড়া বড়োডাঙা থুরিয়া দেউলবাড়, রামেশ্বর জীউর মন্দির, মন্দিরের সাদা পলেস্তরা করা চূড়া, পিতলের ঘট – রৌদ্রে জ্বলজ্বল করছে, বাতাসে খলখল করছে । নাহ, বেলা এখনও যথেষ্টই আছে, চিন্তার কিছু নেই । শশাঙ্ক নিশ্চিন্তে ক্লাস ‘ফাইভ’ কী ‘সিক্স’-এ পড়া কবিতা আউরালো গুনগুন করে – “ঐ যে গাঁ-টি যাচ্ছে দেখা আইরি ক্ষেতের ধারে, প্রান্তটি যার আঁধার করা সবুজ কেয়াঝাড়ে – ”
সবুজ কেয়াঝাড় আর কোথায় ! গ্রামগুলোর পশ্চাদ্ভাগ আঁধার করে রেখেছে তপোবন জঙ্গলমহাল, পাঁচকাহিনা-বড়খাঁকড়ি-নারদা-নিধুই-বনশিরষির বিস্তৃত বনভূমি, যার ভিতরে ভিতরে ‘অনুস্বার’ ‘বিসর্গ’ ‘চন্দ্রবিন্দু’ ‘খন্ড ত (ৎ)’-এর মতো গ্রামগুলি – দোরখুলি, সুখজুড়ি, রুখনীমারা, ডালিয়াঘাটী, মূঢ়াকাটি-যার অনতিদূরে দূরে তিনরাস্তার মোড়ে, শালগাছের তলায়, বাবুইঘাসের জঙ্গলে গলা-কাটা মাথা-থ্যাঁতলানো উপুর-করা চিৎ-করা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে থাকা ‘নিশিতে-পাওয়া’ মানুষের মৃতদেহ ! আঁতকে উঠে গাড়ি ছোটাতে গিয়েই শশাঙ্ক দেখল – গাড়ির ‘ধুরি’টা ভেঙে গেল মচ করে!
গাড়ি থেকে নামতেই হল শশাঙ্ককে, আর নেমেই দেখল – নদী-বালিতে সে শুধু একা নয়, হাটফেরত গাদাগুচ্ছের মানুষ ঘরের দিকে বালি ছিটিয়ে মস মস করে দ্রুতগতিতে হেঁটে চলেছে, ‘বেলা’র দিকে দেখছে আর দৌড়ুচ্ছে – ওই তো গাড়ি নিয়ে থুরিয়ার মনা পাতর, চাঁদপুরের চারু হাটুই, খান্দারপাড়ার রজনী বেহেরা – কে নেই ? যেন ‘কমপিটিশন’ চলছে ঘরে ফেরার । ঘরে ফেরার, ঘরে ফেরার । তবে কী সবাই জেনে গেছে ‘বাঁচার উপায়’? বাঁচতে তো হবে সবাইকেই! বাঁচা চাই! আর এসময়ই কী না শশাঙ্কর গাড়িটা করল ‘বেগেড়বাঁই’, আচমকা ধুরিটা ভেঙে গেল মাঝবরাবর !
‘ঠেকনো’ খুঁজে এখন ধুরিটা জুড়তে হবে, ধূ ধূ বালিয়াড়িতে এক মড়াকাঠ ছাড়া আর কাঠ কোথায় ? তাই খুঁজে পেতে জুড়ে ফেলল শশাঙ্ক । ততক্ষণে তাকে ‘কমপিটিশনে’ হারিয়ে একে একে চলে গেছে সবাই - থুরিয়ার মনা পাতর, চাঁদপুরের চারু হাটুই, মূঢ়াকাটির কমলেশ্বর – কেউই, কেউই আর নদীবালিতে পড়ে নেই ।
‘ঝিল ঝিল’ করতে করতে এতক্ষণে বেলাও পড়ে গেল । তবু, দ্রুত হাত লাগিয়ে গাড়ি জুততে গিয়ে শশাঙ্ক দেখল – দড়ি খুলে জোয়ালের ‘বাঁয়া’ গরুটা উধাও !
অবিকল মহাভারতের ‘কর্ণের রথচক্রগ্রাসের’ ছবির মতো গাড়ির চাকা আঁকড়ে অসহায় ও ভয়ার্ত শশাঙ্ক নদীবালিতে বসে থাকল । তার আর গরু খোঁজার আগ্রহটুকুও নেই । সায়াহ্নের অন্ধকার গাঢ় হয়ে নেমে আসছে । যেকোনো সময় ‘তিনমূর্তি’ও নামতে পারে ।
এই প্রথমদিন ‘ডিসকোয়ালিফাই’ করা ছাড়া গোবরের নাদি দিয়ে দেয়ালে দেয়ালে ‘তিনমূর্ত্তি’র ছবি আঁকায় শশাঙ্কের আজ পর্যন্ত কোনো কামাই নেই । - বাঁচতে তো হবেই ! বাঁচা চাই !