এক।
দু বছর আগের বর্ষায় নবারুণের মৃত্যুর পর কতগুলো অজানা জিনিশ জানা গেল। জানা গেল নবারুণ একজন অতি জনপ্রিয় লেখক, এবং সর্বপূজ্য একজন আইকন। পিলপিল করে তাঁর কোটি কোটি অনুগামী গজাল, তাঁর বিদায়ের বেদনায় ফেসবুকচাপড়ানিতে কান পাতা দায় হল। তাঁর লেখা পড়ুক না পড়ুক, অন্যের লেখায় তাঁর নাম বসিয়ে বা তাঁরই দু একটি অতি পরিচিত পুরনো কবিতা জেপেগ করে, রাশি রাশি ভাইরাল করা হল। সবচেয়ে যেটা হল, সেটা হচ্ছে খিস্তিখাস্তা করে বাংলা লেখার একটা চেষ্টা হঠাৎ যেন ভীষণ ফ্যাশনদুরস্ত হয়ে গেল। সবাই লিখতে লাগলেন ‘নবারুণীয়’ ভাষায়, বাল, বাঁড়া, শালা, বাঞ্চোৎ ইত্যাদি সমাকুল এক একটি স্ট্যাটাস পোস্ট।
নবারুণ কবির চেয়েও বেশি আইকন, একজন গড়পড়তা গদ্যলেখকের চেয়ে অনেকগুণ বেশি বৈপ্লবিক ভূমিকা তাঁর... এবং সাহিত্যিকের চেয়েও বেশি বড় সংগঠক। ভাষাবন্ধন একটা আন্দোলন নিশ্চয়তই। কিন্তু ভাবছি একটাই কথা। নবারুণের জীবিত কালে তিনি যদি দেখতেন তাঁর লেখার এত “ফলোয়ার” আছে তাদের প্রতি তাঁর সুভাষিতানি কী হত কে বা জানে। তাঁর সুপ্রাচীন কবিতা নিয়ে টানাটানি হচ্ছে দেখলেও কী যে বলতেন? যাহোক, আপাতত তিনি নেই, তাই কারুর কিছু বলার নেই। যে কেউ যা খুশি লিখতেই পারে।
তবে নবারুণ যে “অননুকরণীয়” (যাকে উচ্চারণ করতে গেলেই বাঙালির জিভ জড়িয়ে আসে, এবং ‘ননু’ হয়ে যায় অন্য কিছু, কাছাকাছি কিছু, অসভ্য কিছু) অর্থাৎ সাদা বাংলায় ইনিমিটেবল, এই কথাটি মনে রাখা ভাল। যে কেউ ত্যাঁদড়ামি করতে চাইলেই ভাষা সেটা গ্রহণ নাও করতে পারে।
দুই।
আমার নিজের পাঠে নবারুণ। উপভোগ করেছি তাঁর লেখা। একটা অত্যন্ত দ্রুতগামী জ্বলন্ত ছুঁচোবাজির মত গদ্যটা। এই গদ্যের ভেতর কী আছে কী নেই, আমার সীমিত বুদ্ধিতে তার একটা লিস্টি পাকাতে চাইলে তা হবে এই রকম :
ক। উত্তর কলকাতার মেজাজ। রকের আড্ডা।
খ। বিদ্যুত ঝলকের মত একটা উইট ও মেধা। যেটা নিচু মেধার লোক হওয়ার ফলে সব সময় ধরতে পারিনা, ফসকে বেরিয়েও যায়।
গ। সব কিছুকে তুশ্চু করে দেওয়ার অদ্ভুত একটা অ্যারোগেন্স, যেটা সত্যিই অননুকরণীয়। এটা খুব বড় একটা গ্রুমিং, গজানো। পারিবারিক প্রাপ্তি, সামাজিক প্রাপ্তি, বড় হবার প্রক্রিয়া সব মিলিয়েই, নবারুণের যে শিকড় বাকড়, সবকিছুকে দেখা, বোঝা ও তুলোধোনা করা ঔদ্ধত্যের মেজাজটা তাঁকে দান করেছে বলে মনে হয়।
ঘ। একটা স্ববিরোধ। যেটা ডিকোড করে সঠিক পারিনা, (ওই নিচু মেধার লোক হবার ফলেই)। এই যে কোন “অ্যান্টি এস্টাবলিশমেন্ট” এর যেটা থাকেই। ওনার লেখায় উনি যে সবাইকে নিয়ে হাসছেন, এবং হাসতে হাসতে নিজেকে নিয়েও হাসছেন, কিন্তু আসলে হাসছেন কি? এই ধাঁধাটা আমার থেকেই যায়। ফ্যাতাড়ুর মূল প্রণোদনাই, ইতিহাস মোছা, শ্রদ্ধাভক্তি মোছা, আইকন ভাঙা একটা ইচ্ছাকৃত পতনশীলতা। সমাজের শ্রেণী ভেঙে ভেঙে গিয়ে উত্তর কলকাতার ভাঙাচোরা বাড়ির ততোধিক মূল্যবোধ হারানো রোথো লাথখোর পাবলিক হয়ে যাবার ইচ্ছে।
এ ইচ্ছেটা যতটাই তীব্র, ততটাই কি আসলে তীব্র হয়ে ওঠে না, সেই মূল্যবোধগুলোকে কোথাও খুব খুব পাত্তা দেবার একটা অন্তরতম স্থান?
তিন।
নারী-পাঠে নবারুণ / মেয়েলি ডিকোডিং : শেষ মেশ এখানেই এসে পৌঁছতে চাইছি আসলে। নারীবাদী হিসেবে, নারী বয়ানের একনিষ্ঠ সাপোর্টার হিসেবে, নবারুণকে কীভাবে দেখছি আমি?
সেই নবারুণ, যার লেখা থেকে অসংখ্য উদাহরণ টেনে আনা যায় মিসোজিনি বা নারীবিরোধিতার, মূলগতভাবে সামাজিক নির্মাণে নবারুণের কলম যেভাবে ‘মাগি’ অথবা ‘খানকি’ শব্দ দুটিকে ব্যবহার করে তার, ডি এস-এর (ফ্যাতাড়ুর অন্যতম) বউ বাচ্চা-র যে ভূমিকা (যা আমাকে পরশুরামের উদো চরিত্রের ‘বউ’ কে মনে করায় বাধ্যতামূলকভাবে) যেভাবে বর্ণিত হয় তার। যে কোন নারী সংক্রান্ত বিষয় যেভাবে উচ্চারিত হয় তার। যেভাবে বর্ণিত হয় প্রতিটি যৌন অনুষঙ্গবাহী শব্দগুচ্ছ, তার।
নবারুণ কে যদি নারীবাদীরা পাঠ করতেন, যেভাবে হেনরি মিলারের, নরম্যান মেইলারের, ডি এইচ লরেন্সের নারী-দর্শনের পুঙ্ক্ষাণুপুঙ্ক্ষ ডিকোডিং পড়েছিলাম, রবিন মরগ্যান অথবা কেট মিলেট এর কলমে, সেইভাবে? হয়ত “সে অনেক শতাব্দীর মনীষীর কাজ”।
কিন্তু একইসঙ্গে আমি যখন নবারুণ পড়ছি, অসম্ভব রকমের আনন্দ পাচ্ছি, সে আনন্দের ‘ইন্টেলেকচুয়াল’ তরঙ্গভঙ্গিমা আমাকে তূরীয় এক উন্নয়নের দিকে ঠেলে দিতেই পারে। কারণ আমার পাঠক সত্তাও একটি নির্মিত সত্তা, তার অনেকটাই পুরুষকলম পড়ে পড়ে তৈরি। তার ভেতরের আস্বাদনের মুকুলগুলোকে দান করেছে বহুযুগের মনীষীদেরই লেখা, যাদের অধিকাংশ পুরুষ।
যে কারণে আমি পরশুরাম পড়ে উদবেলিত, মেনস্ট্রিমের মেনস্ট্রিম শরদিন্দু পড়েও। যে কারণে আমি সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় পড়েও উদবেলিত। এই সব লেখকদের তুমুল তুমুল পুরুষতান্ত্রিক কলম, নারীকে, বা নারীর কিছু কিছু স্টিরিওটাইপ রচনা করে সামাজিক কার্টুনের চিহ্নিত করণের অসম্ভব সক্ষমতা, অবলীলাক্রমে ভাঁড়-টাইপগুলোকে চেনা লাগা জনিত আমাদের পাঠক উল্লাস (দু একটা উদাহরণ : পরশুরামের চিকিৎসা সংকটের ডক্টর বিপুলা, দ্বান্দ্বিক কবিতার সেই শঙ্করী দেবী যাঁর কবিতায় উদ্দাম লিবিডো লক্ষ্য করা গেছিল) ... অথবা অনায়াসে নারীকে শুধুমাত্রই ভোগ্য বলে চিহ্নিত করা (শরদিন্দু), বা যৌন সম্পর্কের ডিসব্যালান্সে এক পেশে এবং মনস্তাত্ত্বিক অত্যাচারী বলে (সন্দীপন) ... আমাদের আইডেন্টিফিকেশন, আমার পাঠক আইডেন্টিফিকেশন, থাকে আমার পরিচিত পুরুষ লেখনীটির সঙ্গেই, পুরুষ প্রোটাগোনিস্টের সঙ্গেই।
এই সমস্ত ব্যাপারটাতেই আমি প্রথম পাঠে খেয়াল করিনা, ঐ ঐ তথ্যগুলি। নারীকে স্টিরিওটাইপ করার ওই ওই লক্ষণগুলি এড়িয়ে গিয়েই আমার রসাস্বাদন হয়।
কিন্তু দ্বিতীয় ও সচেতন পাঠে আমি দেখতে পাই এই সব ক্রিয়াকর্ম। ঠিক যেভাবে ছোটবেলায় আস্বাদন করে, প্রায় চেখে চেখে চেটে চেটে পড়া উপেন্দ্রকিশোরের টুনটুনির গল্প-এর বাঘের বাচ্চাদের মেরে কেটে ঝুলিয়ে রেখে তেলের মধ্যে টপ টপ রক্ত পড়ার ছ্যাঁক ছোঁক আওয়াজ ও বাইরে বসে বাঘ বাবাজির সে আওয়াজে পিঠে ভাজা হচ্ছে ভাবার ঘটনা, আজকের আমার সচেতন দৃষ্টিতে, পরিবেশপ্রীতি ও পশুপ্রীতির দৃষ্টিতে বিষম, অসহ্য, পলিটিকালি ইনকারেক্ট, গ্রহণীয় নয়। ঠিক যেভাবে প্রায় অধিকাংশ রসালো প্রাচীন কাহিনি আজ হয় পাগল, নয় শারীরিকভাবে অক্ষম, নয় কোন না কোন ভাবে শোষিত মানুষের অ-সংবেদনশীল বিবরণের কারণে পরিত্যাজ্য হয়ে যাচ্ছে।
আমাদের এই সময়ের চোখ, এই সময়ের পাঠক সত্তাও পরিবর্তিত হচ্ছে ক্রমাগত। আর তাই ক্রমাগত আমরা অসন্তুষ্ট হচ্ছি।
অসন্তুষ্ট হবার মত এই সবই আছে নবারুণের লেখায়।
কিন্তু একই সঙ্গে, নবারুণ তো এটাই চান। তিনি তো পলিটিকালি ইনকারেক্ট হতে বদ্ধপরিকর। তিনি তো সব নির্মিতি, প্রগতি, ও বিশুদ্ধতার পরিপন্থীই হতে চান। তিনি কি চান না, পুরুষকেও এক একটি সামাজিক ভাঁড়, স্টিরিওটাইপে বিসর্জিত করতে, যেরকম মেয়েদেরও?
সুতরাং তাঁর রচনায় ঘুরে ফিরে আসছে মিস পিউ মিস ঝিনুকের মত “সেলিব্রিটি–অভিনেত্রী”, যাদের বগলদাবা করে স্টেজে উঠছে নবনী ধর নামের বিশাল বপু মাল্লু টেনে টাইট বহুপ্রজ লেখক সেলিব্রিটি। তাঁর রচনায় আসছে রাস্তাঘাটের মেয়েরা, যারা দেখতে খানকি না হলেও আসলে খানকি। সকাল সকাল তারা রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে পুরুষ ধরতে। ডি এস বা পুরন্দর দাঁড়িয়ে যাচ্ছে “দর কত?” জিগ্যেস করতে।
আসলে হেনরি মিলারের লেখা নিয়ে যেমন এক পোস্ট ফেমিনিস্ট বলেই ফেলেন, রাজনৈতিক সঠিকতাকে এক পাশে সরিয়ে রেখে তবেই পড়তে হবে এই নব্য ক্লাসিক, এবং ব্যক্তি জীবনে আমরা যে যে ধরণের সভ্য ভদ্র শাণিত এবং “ভাল” পুরুষদের সঙ্গে মিলব মিশব বলে আশা করি, তা থেকে ভিন্ন হলেও কলমের সঙ্গে কথোপকথনের ক্ষেত্রে আমাদের সরিয়ে রাখতেই হবে শুচিবায়ুগ্রস্ততাকে, পাঠক চোখকে রাখতেই হবে নিজের সামাজিক ভূমিকা থেকে বিচ্ছিন্ন, একইভাবে পড়তে হবে হারবার্টকে, তার মা –জ্যাঠাইমা – বছর এগারোর বুকি–কে। পড়তে হবে খেলনা নগরের ভবিষ্যৎ ডিসটোপিয়া অথবা যুদ্ধ পরিস্থিতি-র আয়ুর্বেদ গ্রন্থের রমণ-রতি-বীর্য্য স্তম্ভ-র বিবরণকেও।
চার।
নবারুণের লেখায় আরো যা পাচ্ছি তা শৈশবের ইস্কুলে অভিনীত নাটকের মত, নারী চরিত্র বর্জিত তকমা লাগানোর মত আদিগন্ত পৌরুষ। ভিন্ন কনটেক্সটে, ভিন্ন অর্থে এই একই পৌরুষ সত্যজিৎ লীলা মজুমদারের কিশোর সাহিত্যেরও একটা দুর্বলতা ছিল। পৌরুষ এখন ঘেঁটে গেছে, তাই রকের বা বারোয়ারি পুজো মন্ডপের বা চকমেলানো পুরনো যৌথ পরিবারের বাবা জ্যাঠা কাকাদের কর্কশ, পরুষ, প্রচন্ড বীরত্বগুলো সব স্মৃতি। সেরকমই, নবারুণের এই অল-পুরুষ নৈর্ব্যক্তিকতা, শিব-সুলভ অনন্যতা, এক ধরণের আনন্দময় স্মৃতি দেয় আমাদের, মুক্তি দেয়, নস্টালজিয়াও দেয়।
এও কাঙ্ক্ষিত রচিত অথবা নিজের অজানিতেই প্রবেশ করতে দেওয়া অন্ধত্ব তাঁর?
আমি শুধুই আমার কিছু চিন্তার সুতো রেখে যাচ্ছি এখানে। তাবড় বিশ্লেষকরা এগুলো নিয়ে আর একটু খুঁড়ুন। আরো অনেকটা সময় দিন। হয়ত কিছু বেরোতেও পারে।