
সাগরবালার চোখের জলে ‘নিজে শেখো’ বই-এর মলাট ভিজে গেলেও কাগজ নরম হচ্ছিল না। আজকাল এসব বই-এর মলাট বেশ পুরু হয়, ল্যামিনেটেড এবং পৃষ্ঠাগুলোও শক্ত হয়। ছোটদের বই তো, সহজেই ছিঁড়ে যাওয়ার একটা প্রবণতা থাকে। মলাট এবং পাতাগুলো যাতে টেকসই হয়, সেদিকে লক্ষ রেখেই আজকাল এ রকম বই বিক্রি হয়। শুধু অ আ ক খ নয়, জীবজন্তুর ছবিওয়ালা বইগুলোও এমন শক্তপোক্ত হয় যে, টেনে ছেঁড়া বেশ কঠিন। অজগর, ঐরাবত, ঢাকি ইত্যাদি বিবিধ আক্রমণ থেকে রক্ষা পায়। এ কথা আজকাল সবাই জেনে গেছে যে, বই-এর ভেতরে ছাপা বিভিন্ন চিত্র ও অক্ষরের ওপর বহুবিধ প্রকাশ্য ও গোপন পদ্ধতিতে আক্রমণ হয়ে থাকে। ছবি পালটে দিয়ে কোমলমতি ভারতীয়দের ইতিহাস সম্পর্কে নতুন জ্ঞান ও অক্ষর পালটে দিয়ে ভারতবর্ষের নয়া-ইতিহাস রচনার গোপন কৌশল আমাদের খুফিয়া কিছু বুদ্ধিজীবী ধরে ফেলেছেন। এ ছাড়াও আপনারা জানেন যে, প্রাচীন কাল থেকেই ‘গ্রন্থাগার পোড়াও’ নামক এক উৎসব সভ্যতার অঙ্গ হিসেবে কিছু রাজা-মহারাজা পালন করতেন। এ ভাবে আলেজান্দ্রিয়ায়, চীনে, ভারতবর্ষে, সাম্প্রতিক ইরাকে এই উৎসব পালিত হয়েছে। আসলে বই খুবই উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন দাহ্য পদার্থ হওয়ায় দহনশীলতায় বিশ্বাসী কিছু মানুষ এ কাজটি করে থাকে। কিন্তু হতভাগারা জানে না যে, একটা বই পোড়ালে সেই ভস্ম থেকে অন্তত দশটি বই ছাপা হয়। বিশেষত এখন মুদ্রণ-ব্যবস্থার অভূতপূর্ব উন্নতি হওয়ায় এবং পূর্ব বৈরাগিটোলা থেকে ফ্র্যাঙ্কফুর্ট পর্যন্ত বইমেলা যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হওয়ার ফলে পাওভাজির দোকান থেকে বই-এর দোকানে আগুন লাগলেও মুহূর্তে ফিনিক্স পাখি আবার বেঁচে ওঠে। সেই পাখি বইমেলার উঠোনজুড়ে সপ্তবর্ণ বাহারে উড্ডীন হয়। এবং শিস দেয়। মনোযোগী অনুভবী পাঠক শোনে – বই কথা কও।
সাগরবালা বর্মনের স্বামীর নাম ফরেন বর্মন। যে বছর তার জন্ম, সে বছর তার জন্মের মাস দুয়েক আগে তাদের গ্রামে পঞ্চায়েত প্রধান মোজাম্মেল হকের হাতে সবাই একটা অদ্ভুত জিনিস দেখতে পায়। একটা ঝকঝকে রুপোর সরু দন্ড। শোনা গেল সেটার আগত দিয়া লিখে, বাত্তিও জ্বলে। সেই টর্চযুক্ত পেন বা পেনযুক্ত টর্চ দিয়ে প্রধান রাতে দিস ইজ টু ছাট্টিফাই লেখা শুরু করলে বেশ জমায়েত হয়। তখনই সবাই জানতে পারে যে, এই দু’মুখো যন্ত্রটি আদতে ফরেনের মাল। সাগরবালার শ্বশুর অর্থাৎ অজাত ফরেনের বাবা ফরেন শব্দটির ধ্বনিমাধুর্যে বিমোহিত হয়ে পড়ে। খেতে নিড়ানি দিতে দিতে, পিঠের দাদ চুলকোতে গিয়ে, এমন কী রাতে বিছানায় তার বউ মালতীকে সোহাগ করার সময় ফলুই বর্মন ‘ফরেন’ শব্দের মায়ায় আচ্ছন্ন হয়। শব্দটি নিয়ে সে মুখের ভেতরে এধার ওধার করে। তখন ধানের গোছ, দাদনিসৃত রস ও মালতীর শরীরের উষ্ণতা পার হয়ে সে নতুন এক রকম সুখ টের পাচ্ছিল। মালতী সন্তানসম্ভবা সে ঠিক করে ব্যাটাছুয়া যদি জন্মায়, তবে তার নাম হবে ফরেন বর্মন। বিশেষত তার নিজের নাম ফলুই হওয়ায় ‘ফ’-এর বংশানুক্রমিক ধারাবাহিকতা বজায় থাকে। এ-ও ঠাকুরের এক লীলা।
এক সুন্দর সকালে মেখলিগঞ্জের সীমান্তঘেঁষা এক গ্রামে ফলুই ও মালতীর পুত্রসন্তান জন্মায়। পূর্ব-নির্ধারিত সূচী অনুযায়ী তার নাম হয় ফরেন বর্মন। বয়সকালে ভোটপট্টির সাগরবালার সঙ্গে তার শুভ বিবাহ সম্পন্ন হয়। কিছুকাল তারা সুখে বাস করে বটে, কিন্তু বাপের বাড়ি থেকে লুকিয়ে-আনা ‘নিজে শেখো’ বইটি সহসা একদিন টিনের বাক্সের অন্ধকার থেকে উদ্ঘাটিত হলে ফরেন স্তম্ভিত হয়ে পড়ল। তার এক রকম আতঙ্ক হয়। সে নিরাপত্তার অভাব বোধ করতে থাকে। মাগি হয়তো নিজের নামও সই করতে পারে – এই আশঙ্কায় তার বায়ু কুপিত, পিত্ত ঊর্ধমুখী ও কফ সবজেটে হয়ে পড়ে। স্মরণ থাকে যে, ফরেন টিপসই পার্টি।
সাগরবালা নিজের নাম লিখতে পারে। যুক্তাক্ষরবর্জিত বাক্য সহজেই এবং যুক্তাক্ষরসহ বাক্য কুঁথে কুঁথে পড়তে পারে। এ বাড়িতে কাগজের কোনও কারবার না থাকায় এবং প্লাস্টিকের ব্যবহার বহুল-প্রচলিত হওয়ায় কালেভদ্রে ঠোঙা পেলে সে জানতে পারে যে, সৌরভ জাতীয় নির্বাচক, মাসে হিরো হোন্ডার বিক্রি পাঁচ লক্ষাধিক, ওড়িশায় মৎস্যজীবীদের পরিচয়পত্র দেওয়া হবে, নির্বাচন কমিশন এবার কড়া হবে এবং উড়ালপুল ভেঙে পড়ার দায় বামফ্রন্টের। সে পরবর্তীকালে আরও জানতে পারে যে, কাটোয়ায় ধর্ষক শ্বশুর গ্রেপ্তার ও শকুনদের রক্ষায় শপথ গ্রহণ করা হয়েছে।
এসব বাক্য তার বোধে কোনও অর্থ তৈরি করে না। চিন্তনপ্রক্রিয়া কাজ করে না। কিন্তু যখন সে উনুনের সামনে বসে চুলায় লাকড়ি দিতে ভুলে যায়, তখন তার হাতে ঠোঙা দেখা যায়। তখন তাকে কেমন যেন অন্য রকম দেখায়। তখন সে দৈনন্দিন ফরেন বর্মণের বউ সাগরবালা নয়। তখন ফম-এ* থাকে না গোয়ালঘরে সাঁজাল দেওয়া হয়নি।
ফরেন তার টিনের বাক্স খুলে ছিল। কালীপুজোর রাতে আসরে বসার জন্য তার কিছু টাকাকড়ি কম পড়েছিল। শেষ পর্যন্ত সে ভাবল – এইঠে কিছু হোবা পারে। সে তার বউ-এর তোয়াক্কা না করে তার টিনের বাক্স ছানবিন করে। উপরন্তু মস্তিতে থাকায় সে সাগরকে বিন্দুবৎ দেখছিল। তার চলাফেরায় এক্সট্রা মাইলেজ ছিল।
বইটা বেরোলো দু’টো শাড়ির মাঝের ভাঁজ থেকে। অ আ-গুলো ছিল হলুদ, ক খ নীল। প্রথমে ফরেন অতটা পাত্তা দেয়নি। সে টাকা খুঁজছিল। শেষ পর্যন্ত টাকাপয়সা না পেয়ে তার বউকে বলে নিকড়িয়ায় বেটি, পরে খেপে গিয়ে শ্বশুর, শাশুড়ি – দু’জনের সঙ্গেই শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের ইচ্ছা প্রকাশ করে। হঠাৎ সেই বইটির দিকে নজর পড়লে প্রথমে সেটিকে ঠাহরই করে উঠতে পারেনি। মাথায় নেশায় ঘোর, বুকে টাকার জন্য দুঃখ ছিল। চোখে রাগ ছিল। তা ছাড়া, অল্প আলোয় মেঝেয় ছড়িয়ে থাকা শাড়িব্লাউজ, কাঁথাচাদরের মাঝে ‘নিজে শেখো’ প্রকৃতই এক অলীক দৃশ্য মনে হয়।
নিচু হয়ে বইটা কুড়িয়ে নিল ফরেন। শক্ত পিচবোর্ডের মত মলাট। পৃষ্ঠা খুলে মৃদু আলোয় ফরেন শুধু ছবি বুঝতে পারে। রেখার যে ঋজু বা বঙ্কিম ইশারায় মানুষের জিভ নড়েচড়ে, অজগর ও ঋষিমশাই ধ্বনিত হয়, সেই ইশারাময় রেখাচিত্র ফরেনের কাছে রহস্যময় কিছু দাগমাত্র। তবু সে রেখার দাপট জানে। জমি বেহাত হয়ে যায়, সুদের ওপর সুদ – ঋণ কোনও দিন শোধ হয় না। বিন্দুবৎ ওই নারীর কাছে পরাজয়ের লজ্জা থেকে ক্রমে ক্রোধ জন্মায়।
কিন্তু কাগজটা ঠিক কাগজ ছিল না। বেশ মোটা, বেশ শক্ত। মনে হয় ওয়াশেবল। তাছাড়া, ফরেন টাল খাচ্ছিল। সে বই-এর কিছুই ছিঁড়তে পারেনি।
প্লাস্টিকের কোটিং থাকায় সাগরবালার চোখের জল মলাটের ওপর দিয়ে পিছলে যাচ্ছিল। পরে সে চুলা থেকে আধপোড়া সিনজাকাঠি( পাটকাঠি) বের করে আগুনের লাল আভায় মাটির ওপরে লিখতে চেয়েছিল – মা, নববর্ষের প্রণাম নিও, কিন্তু লিখেছিল – মাও রে, আমি ভালো আছি। যুক্তাক্ষর না থাকায় তার অসুবিধা হয় না।
* রাজবংশী ভাষায় অর্থ, মনে থাকে না
Tim | unkwn.***.*** | ০৬ মে ২০১৬ ০২:৩৯80690
d | unkwn.***.*** | ০৬ মে ২০১৬ ১১:৩৯80689
de | unkwn.***.*** | ০৭ মে ২০১৬ ০৬:৩০80691
সে | unkwn.***.*** | ০৭ মে ২০১৬ ০৭:০১80692
san | unkwn.***.*** | ০৭ মে ২০১৬ ০৭:০৫80693
Robu | unkwn.***.*** | ০৮ মে ২০১৬ ০৬:৫৫80697
প্রতিভা সরকার | unkwn.***.*** | ০৮ মে ২০১৬ ০৭:৩৯80694
cm | unkwn.***.*** | ০৮ মে ২০১৬ ০৮:৩৮80695
Kaushik Ghosh | unkwn.***.*** | ০৮ মে ২০১৬ ১০:৪৮80696
Paallin | unkwn.***.*** | ০৯ মে ২০১৬ ০২:২৬80699
sinfaut | unkwn.***.*** | ০৯ মে ২০১৬ ০৩:২১80698
i | unkwn.***.*** | ০৯ মে ২০১৬ ১১:৪১80700
Ekak | unkwn.***.*** | ১০ মে ২০১৬ ০২:২৫80701
aka | unkwn.***.*** | ১০ মে ২০১৬ ০২:৫৩80702
Sahana | unkwn.***.*** | ১০ মে ২০১৬ ০৫:১৬80703
দ্রিঘাংচু | unkwn.***.*** | ১৩ মে ২০১৬ ০৭:৪৯80704
Swati | unkwn.***.*** | ৩০ মে ২০১৬ ০৩:৪৫80705
বাবু বনিক | unkwn.***.*** | ২২ জুন ২০১৬ ০৩:২১80706
দ | unkwn.***.*** | ২২ জুন ২০১৬ ০৩:৪৬80707
Ela | unkwn.***.*** | ২২ জুন ২০১৬ ০৩:৪৯80708
দ | unkwn.***.*** | ২২ জুন ২০১৬ ০৩:৫০80709
pi | unkwn.***.*** | ২২ জুন ২০১৬ ০৩:৫৮80710
শ্রী সদা | unkwn.***.*** | ২২ জুন ২০১৬ ০৪:৩১80711
বনেদি বনিক | unkwn.***.*** | ২২ জুন ২০১৬ ০৫:০৩80712
Paramita | unkwn.***.*** | ২২ জুন ২০১৬ ০৬:৪১80713
ranjan roy | unkwn.***.*** | ২২ জুন ২০১৬ ০৬:৫৯80714
pi | unkwn.***.*** | ২৩ জুন ২০১৬ ০৫:০৬80715
Ranjan Roy | unkwn.***.*** | ২৩ জুন ২০১৬ ০৫:৫৩80716