সকাল দশটা নাগাদ সোমনাথের বেরোনোর কথা ছিলো। বাড়ির পাশেই, ফুটপাথে বিড়ির দোকান থেকে সিগারেট ধরিয়ে একটু এগিয়েই আচমকা ফিরে বললো, সোমনাথই কেন? কোন সাল? চশমা আছে? কী পরে আছি?
এত প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। কলকাতা শহরে গরমের দিনে দশটা বাজলেই মনে হয় দুপুর নেমে এসেছে। লোকারণ্য।
- সাল সত্তরের শুরুও হতে পারে, আবার ওয়াইটুকেও হতে পারে। তুমি কোনটা চাও? তুমি পরে আছো খুব হালকা নীলচে জামা, ছাই রঙের ট্রাউজার। ফুলশার্ট, পাড়ার দর্জি হারুদা বানিয়েছে। সন দুহাজার হলে জামাটা গোঁজা। চশমা সত্তর হলে নেই, নয়ত আছে। তোমার হাইট পাঁচ ফুট আট, গায়ের রং প্রায় ফরসা, গাল একটু বসা।
কথা না বাড়িয়ে সোমনাথ হাঁটছিলো। গরম হাওয়া বইছে রাশবিহারী অ্যাভেনিউ বরাবর, ট্রামলাইন পেরিয়ে সে হাওয়া ঘুপচি দোকানগুলোয় ঝাপটা মারছিলো।
- ক্যালিফোর্নিয়া গ্যাছেন? ওখানে এমনি হাওয়া দেয় গরমে
স্বীকার করতে হলো, যাইনি। ও নিজেও যায়নি, এসব বইতে পড়েছে। ফুটপাথে গজিয়ে ওঠা গাছে, বা গাছ ঘিরে গজিয়ে ওঠা ফুটপাথে একটা অস্থায়ী দোকান। বিশাল অক্ষরে হর এক মাল পাঁচ টাকা লেখা একটা পিচবোর্ড - দু ফুট বাই দু ফুট। প্লাস্টিকের মগ, খেলনা ইত্যাদি। একটা ছাউনি মতন করা হয়েছে যাতে বাচ্চাটার গায়ে তাত না লাগে। মায়ের বয়স বছর তিরিশ। সে এতক্ষণ আমাদের দিকে তাকিয়েছিলো, অল্প আশান্বিত। বাচ্চাটা কাঁদছে কর্কশ স্বরে, হয়্ত ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়বে এই ভরসায় মেয়েটি পাত্তা দিচ্ছেনা।
রাস্তার ডানদিকের ভ্যাটটা উপচে পড়ছে দেখে সোমনাথ দাঁড়িয়ে পড়লো। তারপর গাড়ির ভিড় দেখে হতাশ হয়ে আবার এগোলো। সামনেই একটা লোক জঞ্জালের গাড়ি এনে উপুড় করে দিলো। আরেকটু এগোলেই হাজরা মোড়। কচুরি ভাজা হচ্ছে।
-আমাকে এখন কী করতে হবে? কলেজ?
-সেও তোমার ইচ্ছে।
-প্রেম?
উত্তরে আমি হাসলাম। নানা রঙিন ও রঙহীন পোষাকে ছেলে মেয়েরা ঐ বাড়িটায় ঢুকছে। ওদের মধ্যে কেউ হয়ত সোমনাথের প্রেমিকা হতে পারে। দেখেশুনে একটা সবুজ সালোয়ার কামিজ পরা মেয়ের সাথে গিয়ে সোমনাথ কথা বলতে শুরু করলো। মেয়েটির নাম শ্রুতি। রোগা, গায়ের রং কালোর দিকেই, চোখ তীক্ষ্ণ।
-কী হলো?
-পাত্তা দিলোনা। চা খাবো
রাস্তাতেই চা পাওয়া যায়, কিন্তু এই গরমে কলেজের সিঁড়িতে বসা কঠিন। একটা সময় পড়ে আসা ক্যান্টিনে কয়েকজন বসে তাস খেলছে। সিনেমা হল কর্মী ওরা, কথাবার্তায় বোঝা গেল। হলে স্ট্রাইক চলছে, বকেয়া মাইনে। চা খেতে খেতে সোমনাথ একটাও কথা বললো না। আমি জানি ও শ্রুতির কথা ভাবছে।
-আমি তো এখনও ঠিকই করিনি কোন সাল। সেই অনুযায়ী নাম পাল্টাবে না?
- হতে পারে। খুবই সম্ভব
-আর ঐ মেয়েটা?
-কে?
-দোকানে বসে বাচ্চাটাকে ঘুম পাড়াচ্ছিলো
-হুম। ওটা ভাবতে হবে। পরে বলছি
চা শেষ। তাস এখনও চলছে। টোয়েন্টি নাইন খেলা হচ্ছে। একজনের লাল খুলে গেছে, দু ঘর। অন্যদিকের ঝাঁপ বন্ধ। উঠলাম। একটা দমকলের গাড়ি গেল নিঃশব্দে।
- ক্লাস করে এসো। আমি হরিশ মুখার্জ্জি ধরে হাঁটবো, ওখানেই ছায়াটায়া দেখে বসবো।
সোমনাথ ক্লাসে চলে গেল। আমি ওকে মিথ্যে কথা বলে আবার ফিরে চললাম রাশবিহারীর দিকে। পথে একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ পড়লো। এখন কি এত ফুল ফোটার সময়? কী মাস মনে পড়লো না।
হরেক মালের দোকানের কাছেই একটা চায়ের দোকানের বেঞ্চে বসলাম। বাচ্চাটা এখনও ঘুমোয়নি। এখন গনগনে দুপুর, মেয়েটি আমায় খেয়াল করেনি। রোগাসোগা মেয়ে, বসে আছে বলে হাইট বোঝা যায়না। বাচ্চাটা কেঁদে কেঁদে গলা ভেঙে ফেলেছে।
-আমার নাম কী?
-এখনও ঠিক করিনি। আপাতত মিনা ডাকছি
মুখ দেখে মনে হলো পছন্দ হয়নি। কিন্তু উপায় নেই, এখন অত নাম ভাবার সময় নেই। সবকিছু ছাপিয়ে বাচ্চাটার কান্না কান ঝালাপালা করে দিচ্ছে। মিনা গুনগুন করে গান করে, ঘুমপাড়ানিয়া। দোলের মতন দেয়। দুপুর গড়ায়, সামান্য মেঘ করে। আকাশে তাকিয়ে দেখি, বৃষ্টির মেঘ নয়।
-তোমার বাড়ি কোথায়?
জিগ্যেস করেই বুঝি ভুল। মিনা অবাক তাকায়। আমি জলদি ঠিক করে দিই, ঝাঁঝা থেকে এসেছে। কোনদিন যাইনি, তবে নামটা ভারি ভালো লাগে। ঝিমধরা দুপুরের মতই যেন মনে হয় জায়গাটা। শুনলেই মনে হয় একটা শুনশান নিকোনো রেলস্টেশন, বেরোলেই শালবন, ধোঁয়া ওঠা পাহাড়। বাচ্চাটা চেঁচিয়েই চলেছে, অবিরাম। তার চোখে জলের শুকনো দাগ, মুখের কষ বেয়ে লালা। এইবার মিনা তাকে বুকে করে ছাউনির মধ্যে ঢুকে যায়। কান্নার শব্দ কমে আসে, দূরত্বের জন্য, না স্নেহে ওর মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বলে বোঝা যায়না। আরেক গ্লাস চা নিয়ে আসি এই সুযোগে। ভাবতে থাকি ঝাঁঝা থেকে ওরা অনেকদিন এসেছে, বাংলায় কোন টান নেই।
এই করে করে বিকেলের মত হয়। রোদ কমে আসার ভ্রম, কান্না থেমে আসার ভ্রমের মতন। মিনা আবার এসে বসেছে অনেকক্ষণ। কান্না থামেনি, মাতৃদুগ্ধ মাতৃভাষার মত হতে পারে, তবে অসন্তোষ দূর করার ব্যাপারে তার ভূমিকা খুব ইতিবাচক নয় দেখা যাচ্ছে। মিনা দৃশ্যতই বিরক্ত।
-ঐ কলটা থেকে আসছি। দেখবেন । আর ঝাঝায় চন্দ্রবিন্দু নেই।
বলে সে একটা দু লিটারের স্প্রাইটের বোতল নিয়ে জল আনতে গেল। বাচ্চাটা কেঁদেই চলেছে, এক একটা তোড়ে গলার শির ফুলে উঠছে। মিনা এসে বসলো, নির্বিকারে একটা ছোট টিফিন কৌটো বের করে খেলো।
দূর থেকে সোমনাথকে দেখা গেল। কাছে আসতে দেখলাম জামা ঘামে ভেজা, কপালেও ঘামের ফোঁটা।
-বেকার এতটা হাঁটালেন
-কী করে জানলে এখানে আছি?
গজগজ করতে করতে সোমনাথ চা আনতে গেল। বিকেল একবার পড়তে শুরু করলে তাকে ধরে রাখা ভার। এখন হাওয়া ক্রমশ শীতল হচ্ছে। আরো পরে একসময় ঘামের বাষ্পায়নহেতু শীতের বিভ্রম হবে। মেঘের রং, মানুষের মুখের আভাস অনেক সহনীয় হবে। এমনকি কোথাও কোথাও প্রেমের অনুকূল পরিবেশও গজিয়ে উঠতে পারে।
মিনা সকৌতুকে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখে বিদ্যুৎ। সোমনাথ এসে বসায় সে দৃষ্টি সেদিকে গেল। এটাই চাইছিলাম। বাচ্চাটা খুবই কাঁদছে, এখনও। মানুষের বাচ্চা টানা কতক্ষণ কাঁদতে পারে, এ কৌতূহল এই সময় অমূলক নয়।
- ওর কি শরীর খারাপ?
-না ওরম কাঁদে। অন্যদিন এতক্ষণে থেমে যায়
-রোজ কাঁদে?
-একদিন ছাড়া ছাড়া
-নিয়ম করে?
অবাক লাগে। যদিও অবাক হওয়ার কিছু নেই। এই যে আমি টের পাচ্ছি সোমনাথ একটা ম্যাগাজিন পড়ার ফাঁকে মিনাকে দেখছে, এতেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। বিকেল পড়ে আসছে, গলন্ত মোমের মত অতবড়ো দিনটা এক ঝলক দমকা হাওয়ায় এবার উড়ে ময়দানের দিকে চলে যাবে। হয়ত ঝড়ের মত হবে, কিংবা আস্ত গোটা ঝড়ই। হতেও পারে, হতেই পারে।
উঠে হাঁটতে থাকি, কান্নার শব্দ পিছনে পড়ে থাকে, তাই একসময় হারিয়ে যায়। একটা ট্রাম যায়, জানলায় আবছা মুখের সারি। এতক্ষণে খেয়াল হয় চশমায় ঘামের আবছা আস্তরণ পড়েছে। সোমনাথ এতক্ষণে নির্ঘাৎ একটা দুটো কথা বলছে। ঝাঁঝায় কি এখন এরকমই ঠান্ডা বাতাস? মাটির অবস্থা, চাষের হাল কেমন ভাবতে ইচ্ছে হয়। বাচ্চাটা কি এখনও কাঁদছে? একটা কিছু করা উচিত ছিলো। হয়্ত ইন্ফ্যান্টাইল কলিক আছে। কে বলতে পারে? সন্ধ্যেবেলাও যদি কাঁদে, প্রেমের অনুকূল পরিবেশের দফারফা।
আরেকটা ট্রাম যায়। আরেকটা কিনা অব্শ্য বলা মুশকিল। সেই জানলায় সারি সারি মুখ। যদি এমন হতো, যে সব ট্রামেই অন্তত একটা জানলায় একজন করে চেনা মুখের ছবি, তাহলে বোঝা যেত এটা অন্য ট্রাম কিনা। কিংবা হয়ত তাও নয়, লোকে কি ট্রাম পাল্টায় না?
সন্ধ্যে নামে, একটা পার্ক দেখা যায়। এই রাস্তায় অনেক পার্ক, ছোট বড়ো। খেলাধুলো হচ্ছে, আড্ডা। গাছের ছায়ায় পাতা একটা বেঞ্চে বসেই জায়গাটা চেনা লাগলো।
-হাঁটা হয়ে গেল?
-কই আর হলো, একটু জিরিয়ে নিচ্ছি
সোমনাথ আর মিনা এখন বেশ জমিয়ে ফেলেছে। আড্ডা হচ্ছে। একটা মগ বিক্রি হলো । বাচ্চাটা কেঁদে যাচ্ছে যদিও।
একটু পরেই একটা একটা করে আলো জ্বলে উঠবে। অল্প পাওয়ারের হলদেটে বাল্ব। তেলেভাজা এগরোলের দোকান খুলবে এদিক সেদিক। সোমনাথ সেসব কিনে আনতে পারে, সম্ভবত। ততক্ষণে পসরা গুটিয়ে ফেলে মিনাও ফ্রি হয়ে যেতে পারে, বিশেষ বিক্রিবাটা যখন এমনিতেও হচ্ছেনা। সবই সম্ভব।
হাওয়া কমে এসেছে। একটা গুমোট ভাব, দরদর করে ঘাম হয়। ঐ জায়গা, ঐ সন্ধ্যে, কোথাও সামান্য ভেসে আসা সুগন্ধ যা বিভ্রম হতে পারে, ভালো লাগেনা। উঠে রাস্তা পেরিয়ে দাঁড়াই। একটা ট্রাম আসে।
ভোরের ট্রাম, ডিপো থেকে ছেড়ে বেশ চমৎকার স্পিডে চলছে। বেশি লোক নেই। সামনে থেকে তিননম্বর সিটে সোমনাথ বসে আছে, পাশে শাড়ি পরা একটি মেয়ে, যার নাম, আমি জানি শঙ্করী। জানলার বাইরে তাকাতেই দেখি দোতলা বাস যাচ্ছে, দেখেই বোঝা যায় ছ'নম্বর। ভোরেও গরম কম না, তবে সারাদিনের তুলনায় অনেক কম। ফুরফুরে হাওয়া দেয় ট্রাম গোঁ গোঁ শব্দে স্পিড নিলে। ঘন্টা বাজে। শব্দ শব্দ ডেকে আনে। বাচ্চাটা কি কাঁদছে? ভাবনা বড়ো নির্মম। টেনে হিঁচড়ে নামিয়ে আনে ট্রাম থেকে। কোন স্টপেজ জানিনা, পুরু ঘাসে পা ডুবে যায়। ট্রাম চলে যাওয়ার শব্দ মিলিয়ে যায়। এ কোন স্টপেজ বুঝিনা, দেখি এখানেও ফুটপাথে মিনার ছাউনি। কান্নার শব্দ পাইনা।
কাছে যেতেই মিনা চেপে ধরে।
-কী হয়েছে ওর?
-কেন, কাঁদছে না তো আর
-একদিন ছেড়ে ছেড়েই তো কাঁদে। কী অসুখ এটা?
-জানিনা, অত ভাবিনি। তবে ইনফ্যান্টাইল কলিক বলে একরকম ----
বলতে বলতেই মিনা অন্য কথায় চলে যায়। সোমনাথের সাথে আজ সিনেমার টিকিট কাটা আছে। চারপাশ থেকে তখন মৃদু স্নিগ্ধ রাত ঘনায়। নাইট শোয়ের টিকিট, যেমনটি হওয়ার কথা ছিলো। যাই হোক, বাচ্চাটা শান্ত আছে, যে কাজে আসা। তাই ফিরে যাই।
সোমনাথ আর শঙ্করী ততক্ষণে ময়দানের দিকে চলে গেছে। হু হু করে হাওয়া দিচ্ছে। এই ক্লাসটা পরপর অনেকদিনই করা হলোনা। সকালে ঘাম ঝরিয়ে ফুটবল খেলে ছেলেরা। পেশী ওঠে নামে, তাতে ঘাম জমে চিকচিক করে।
বাচ্চাটা পরেরদিনও কাঁদেনা। মিনার খুব সুবিধে হয় এতে। সোমনাথকে অনেক কথা বলে। ঝাঝার গল্প। আমার জানা হয়না সেসব, এদিকে যাইওনি কোনদিন। হতাশ হয়ে দেখি সোমনাথ শঙ্করীর সাথে পড়া বুঝে নিতে গেছে, অর্থনীতি। সময়টা গোলমাল হয়ে যাচ্ছে সোমনাথ। এটা কোন সাল? দূর থেকে কথা ভেসে আসে। উত্তর দেওয়ার সময় পাইনা। আলো চলে যায় আর বৃষ্টি নামে, অঝোরে। সেই বৃষ্টিতে, শঙ্করীদের বারো বাই দশ ফুটের ঘরে ওরা চুমু খায়। তেলেভাজা ঠান্ডা হয়ে আসে, আশ্লেষে। আমি ভাবি মিনার তো খিদে পাওয়ার কথা, সেই দুপুরে একফোঁটা রুটি তরকারি। বলতে বলতেই বাচ্চাটা কেঁদে ওঠে। পাশবিক, কর্কশ চিৎকারে নানারকম তারে বসা অযুত পাখির দল উড়ে যেতে থাকে। কাক শালিখ। ম্যাগপাই। কলকাতায় ম্যাগপাই? বলে সোমনাথ আর শঙ্করী পাগলের মত হাসতে থাকে। নাইট শো। সিনেমার নাম পড়তে পারিনা, হিমে।
বাচ্চাটা সেই যে কাঁদতে শুরু করে, থামেনা। দুঘন্টা পরেও, না সিনেমা শেষ হয়, না কান্না। বিরক্ত হয়ে অন্যদিকে চলে যাই। রাত নেমেছে গাঢ় হয়ে। হাঁটতে হাঁটতে পেরিয়ে যাই অগভীর নালা, তার সাঁকো নড়বড় করে। একের পর এক দোকান, সব বন্ধ। ফ্যাক্টরির মাঠটা আবছা কুয়াশার মত পড়ে আছে। ঘাসে পা পড়লে শিউড়ে ওঠার মত হয়। দেখি সোমনাথ ।
-এখানে? একা?
সোমনাথ উত্তর দেয়না। আমি বসি ঐ ভেজা ঘাসেই। বৃষ্টিতে ভেজা না শিশিরে, কি এসে যায়? একটা ঝিঁঝির মত কিছু ডাকতে থাকে কাছেই। গাঢ় অন্ধকারে একে একে তারা ফুটে ওঠে, দেখি। কলকাতার আকাশে তারা দেখা ভাগ্যের ব্যাপার।রাত হলেই শহরের আকাশ ময়লা চটের বস্তার মত হয়ে যায়। অথচ শহরতলি বলেই হয়ত এখানে অন্ধকার এত গাঢ়।
-একটা গোলমাল হয়েছে। তোমার সাথে কিছু কথা ছিলো।
বলে চুপ করে রইলাম উত্তরের অপেক্ষায়।
সোমনাথ কথা বলতে চাইছে না। মিনার মন ভালো নেই, মা'র কথা মনে পড়ছে। সেই যেবার দু'সন পর পর অনাবৃষ্টি হলো, ওর বাপটা দাওয়ায় ছটফটিয়ে মরে গেল, সেই বছরের কথা মনে পড়ছে। মহাজনের কাছে কেঁদেকেটেও হাকিমের পয়সা পাওয়া যায়নি। পাওয়ার কথাও ছিলোনা, ঠান্ডা মাথায় ভাবলে।
এত গরমের সময় যদি একই সঙ্গে লোডশেডিং আর হাওয়া বন্ধ হয়ে যায় তো সবদিক থেকেই মুশকিল। শঙ্করীর ঠাকুমা বলে, সরকারি বিদ্যুতের সাথে বাইরের আলো হাওয়ার সাঁট আছে। একটা গেলে অন্যটা যাবেই। শঙ্করী ভোরের ট্রামে আমার সামনে বসে আছে। একটা হাওয়ার সূক্ষ্ম ছেঁড়া ছেঁড়া অদৃশ্য কুন্ডলী মাঝে মাঝে একগাছি চুল উল্টে দিচ্ছে। আমি জানি শঙ্করী সোমনাথের কথা ভাবছে। গত কদিন নানাকাজে দেখা হয়নি। এমন সময় আমি বাচ্চাটার কান্নার শব্দ পেলাম। পরিত্রাহী চিৎকার। নেমে দেখি আকাশের মুখ ভার, মিনারও।
-এ কী হলো এর? আগে তিনঘন্টার বেশি কানতো না। এখন থামেনা। রোজ এরম করছে
মিনার চোয়াল শক্ত আর চাউনি খারাপ। বাধ্য হয়ে হাঁটতে হয়, এটা কত সাল মনে পড়েনা বলে বুঝিনা এখন কোনদিকে গেলে মেট্রো পাবো। পাবো কী?
শঙ্করীর হাতে অবশেষে সোমনাথের চিঠি আসে। প্রেমের কথা, দুটি কবিতার ছত্র। বুক ভরে ওঠা ভালোবাসার শ্বাস নিয়ে শঙ্করী বইয়ের তাক হাতড়ায়।কয়েকটি মাত্র শব্দ,কিন্তু কত কথা জমে আছে ওতে! বইয়ের তাকে এত মেঘ কেন থাকে সে জানেনা। ধূলো হবে। সোমনাথ দেখা করতে লিখেছে, সন্ধ্যেয়।
বাচ্চাটা যে সত্যিই অবিশ্রান্ত কাঁদছে সেটা মিথ্যে নয়। মিনার মেজাজ দেখে কাছে যাওয়ার সাহস করিনা, যদিও ওকে দেখে মনে হয়না আমি আছি। দোকান আজ খোলেনি, ছাউনির মধ্যেই ওরা, আমি উল্টো ফুটপাথে একটা রকে বসে আছি। এখান থেকেও আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। সারাদিন গুমোট গরমে বসে অসুস্থ লাগে। সোমনাথের দেখা পাইনা। ট্রামগুলো আসে যায়, খুঁজে দেখি। জানলায় সারিসারি মুখ, একটাও চেনা না। মিনা মাঝে একবার দুবার বেরোয়, চোখে চোখ পড়লে ঘুরিয়ে নেয়। বাচ্চাটা কাঁদছে, কিছুই বলার নেই।
অবশেষে সন্ধ্যে নামে। শঙ্করী একটা বই ফেরত দেওয়ার অছিলায় বেরিয়েছে। যে ট্রামে সে দক্ষিণের শহরতলির দিকে গেল সেটা দেখতে পাই। কন্ডাক্টরের সাথে সামান্য খোশগল্প করে সে, স্বভাববিরুদ্ধ। একেবারে সব গন্তব্য পেরিয়ে, পুরোনো ভাঙাচোরা লোহালক্কর যা কিনা মরে যাওয়া ট্রামেদের কঙ্কাল, সেসব পার হয়ে একেবারে ডিপোতে গিয়ে ট্রাম থামে। অন্ধকার থেকে আলোয়। বাইরে ফুলের দোকান বসেছে, শঙ্করী একটা জুঁইফুলের পুঁটুলি নেয়। হাঁটার সাথে অন্ধকার গাঢ় হয়, তারপর সেই মাঠটা আসে। এখানেই সেদিন ঝিঁঝিটা ডাকছিলো। ভিজে ঘাসের ওপর শঙ্করীর চলন বোঝা যায়না। অনেক দূরে, আবছায়া কুয়াশার মত শঙ্করীর অবয়ব জেগে থাকে। ফুলের গন্ধে বাতাস ভারি হয়ে আসে। ফিরি।
বাচ্চাটা কাঁদছে যদিও, মিনার মুখ আর ভার নেই। আজও নাইট শো। সোমনাথ এসেছে। দুটো একটা কথা ভেসে আসে।
-এটাই কী ঠিক ছিলো?
-কোনটা?
ওরা পাত্তা দিলোনা। না দেখার ভান করে ওরা শশব্যস্ত গোছগাছ করছিলো। আমি বুঝতে পারিনা কি হচ্ছে। ঝাঁঝায় তো এখন খরা, দাওয়ায় মিনার বাপের কঙ্কাল ভেঙেচুরে পড়ে আছে। মিনার মা কে খুঁজে পাওয়া যায়নি, লোকে বলে মহাজনের কাজ। আমি বুঝিনা ওরা কি করতে চলেছে। বাচ্চাটা এর মধ্যেই চেল্লায়। তার গলা দিয়ে জান্তব ধ্বণি বেরোয়। রাগের, হুমকির মত লাগে সেসব আমার।
ধীরে ধীরে নাইট শোয়ের সময় এগিয়ে আসে, আমি রকে বসে ঝিমোই। মাথার কাছে লঘুসপ্তর্ষিমন্ডল ভিড় করে আসে, শিশিরের ওপর হাঁটতে হাঁটতে আচমকা জুঁইফুলের দমকা গন্ধ ভেসে আসে। এমন সময় একটা ট্রাম আসে, ঢিমেতালে। তার ঘন্টাধ্বণিতেই সম্ভবত, চটকা ভেঙে যায়। অতদূর থেকেও পরিষ্কার দেখতে পাই মিনা আর সোমনাথকে। দুটো বাক্সো ভরে জিনিস গোছানো হয়েছে। মিনা খুব হাসছে, ছাউনিতে আলো নেই। বাচ্চাটা আর কাঁদছেনা, কাঁথার নিচে ঘুমে অচেতন। আরেকটা ট্রাম আসার শব্দ ভেসে আসে, দূরাগত। ওরা ওঠে, ধীরে বেরোয়। আমি দেখি ট্রামের জানলায় সারিসারি মুখ, অচেনা। মিনা নিস্পন্দ কাঁথার বান্ডিলটা ময়লার ভ্যাটে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ট্রামে উঠে পড়ে।
ট্রাম চলে গেলে দেখি সোমনাথ পড়ে আছে, নিরাবরণ। চারপাশে গভীর ঘাস, শিশিরে সোমনাথের শরীর টুপটুপে, চিকচিক করছে, হাতে কবজির কাছে আর পায়ের গোড়ালিতে কালশিটে। পায়ে আর পিঠে বুলেটের গর্ত। ঝিঁঝি ডাকে, যেন কার্সার।