অজ্ঞানতিমির
কাঁধের ব্যাগ বুকের কাছে টেনে এনে, দ্রুত পায়ে হাঁটতে শুরু করেছিল অলক্তিকা। হাঁটার পথটুকু অতিক্রম করতে পারলে বাঁচা যায়। অলক্তিকার পরনে খাটো প্যান্টস, যেটাকে বলে হটপ্যান্টস। প্রায় শর্টসের মত ছোট সবুজ খাকি প্যান্টসের তলে ওর স্পোর্টস করা দুটো পেশল অনাবৃত উরু অনেকটা একটা কিশোরের কথা মনে করায়। অবশ্য রোমহীন। কারণ নিয়মিত রোম তোলার সরঞ্জাম ব্যবহার করে ও। ছোট প্রিন্টের লাল কালো ডট দেওয়া ঈষৎ ঝলঝলে টিশার্ট পরে আছে ও।
গলিতে ঢোকার আগেই ও একবার ব্যাগ থেকে ফোন বার করে টাইমটা দেখে নেয়। ঘড়ি ও কোনকালেই পরেনা। ফোন থেকেই সময় দেখে। একটা মেসেজ চেকও করে নেয় তাড়াতাড়ি। কাল একটা মিটিং আছে ওদের।
গলিতে ঢুকেই চোখে ধাক্কা দেয় অন্ধকার। আজ আবার কোন আলোটা ফুটে গেল! এই আলোগুলো এক একদিন জ্বলে এক একদিন জ্বলে না। নির্জন রাস্তা, একদুটো বাঁদিক ডানদিকে বাঁক নিয়ে নিয়ে এগিয়েছে, সারি সারি বাড়ির সবার দরজা জানালা বন্ধ। এই রাস্তায় বড় গাড়ি ঢোকে না বিশেষ। এখন নটা চল্লিশ। আরো শুনশান। বাইক বা স্কুটারও যাচ্ছে না। লোক না থাকাটা বিপদের নয়, লোকজনই বিপদের, অলক্তিকা জানে। তবু, কিন্তু নির্জনতা তো নির্জনতাই হয়, না?
ইউনিভার্সিটিতে যাবার বছর থেকে একটু বেশি যেন রাস্তাঘাটের ভয়। স্কুল থেকে অবশ্য তাড়াতাড়ি আসত, তবু বাস থেকে নেমে এই পথ দিয়েই আসত, বছর কয়েক আগেও। মাথা না ঘামিয়ে বড় বড় পায়ে ফিরে আসত ।
এই তিন চার বছরে সব পালটে গেল নাকি? অবশ্য মায়ের বক্তব্য, মায়েদের ছোটবেলায় কলকাতা ছিল এক স্বর্গ, মেয়েদের রাস্তাঘাটে হাঁটার জন্য। এখন ভয় আর ভয়। বাস থেকে নেমেই খানিক দূর অব্দি দোকানগুলো আছে বলে ওখানটা জমজমাট। গলিতে ঢুকলেই কেউ কারো নয়। বড় জোর একজন দুজন পেরিয়ে যাচ্ছে ওকে।
ও কোনদিন ভয় পেতই না। অলক্তিকা জানত, ভয় একটা মেন্টাল ব্যাপার। ভয়কে জল মাটি দিয়ে যারা পেলেপুষে বড় করে, তাদের একদল হল মাতৃস্থানীয় মহিলারা, অন্যদল, মিডিয়া। সদ্য সদ্য ঘটে যাওয়া কয়েকটা ধর্ষণের ঘটনায়, চারিদিকে তোলপাড় হয়েছে। সম্প্রতি এক মেমসাহেবকে তাদের পাড়ার থেকে দু পা দূরে, যোধপুর পার্কে রাত দশটায় আক্রমণ করা হয়েছে, বাইক আরোহী একদল যুবক এই কান্ডটি ঘটায়। ফ্রান্সের মহিলাটি কোনমতে পালিয়ে একটা বাড়ির গেটের ভেতর ঢুকে লুকিয়ে বাঁচেন ।
এই সব মিলিয়ে কেমন একটা তলপেটে খিঁচ ধরা অনুভূতি, যখনই এইরকম শুনশান রাস্তায় ও। বা ওর মত আরো কেউ কেউ। জীবনে একবার দুবার কোন অসভ্যতার শিকার হয়নি এমন তো কোন মেয়ে নেই। সেটা আলাদা। সেবার পাশ দিয়ে যেতে যেতে বাইক থেকে হাত বাড়িয়ে ওকে ছুঁয়ে গেছিল দুটো লোভী হাত। ছ্যাঁক করে উঠেছিল গা। খুব বিশ্রি একটা শিরশিরে অসহ্য লাগা নেমে গেছিল গা দিয়ে।
তবে এখন অনেকটাই গা সওয়া। বিশেষত বাজারের ভেতর দিয়ে হেঁটে আসার সময় সার সার চোখ। রাস্তার ছেলেদের। “রাস্তার ছেলে” এই শব্দবন্ধ আবিষ্কার করেছিল কোন উচ্চবর্গীয় ভদ্দরলোক কে জানে। বাবা বা মায়ের ক্লাসের লোকেরা, যতই কম্যুনিজম কপচাক , অন্যমনস্কভাবে ওই শব্দ ব্যবহার করেই ফেলে। সেখানে থেকেই অলক্তিকার মাথাতেও ঢুকেছে। আসলে বাজারে, দোকানে, সাইকেল চালিয়ে, রিকশা চালিয়ে, যেসব হাড় বের করা, ডিগডিগে চেহারার পুরুষেরা ওর দিকে জ্বলন্ত চোখে তাকায়, তাদের সবাইকে লেচার ভাবার, রেপিস্ট ভাবার কোন হক নেই ওর। তবু এভাবেই ভাবতে শেখাচ্ছে সমাজ।
আজো, ওর হটপ্যান্টস পরা পায়ের দুমদাড়াক্কা হেঁটে যাওয়া একটু আগেই রকে বসা দুটো ছেলের উঃ আঃ আওয়াজের সঙ্গে কোইনসাইড করে গেছে।
হঠাৎ সমস্ত ইন্দ্রিয় সজাগ হয়ে ওঠে অলক্তিকার। এই নির্জন গলিতেই, ওর ঠিক কয়েক কদম পেছনে, একটা কেউ হেঁটে আসছে না? কনটিন্যুয়াসলি, একই পেসে হাঁটছে। বোঝাই যাচ্ছে ওকে ফলো করছে।
ভয়গুলো সত্যি হয়ে যাবে আজ। কোন বদমাশ লোক ইচ্ছে করে ওকে বিরক্ত করবে বলে ওর পেছনে পেছনে আসছে। ওর গতির তালে তাল রেখে। ভেতরটা কাঁটা কাঁটা হয়ে উঠতেই সেটাকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করার একটা তীব্র রাগ ওর ভেতর দিয়ে খেলে যায়।
অলক্তিকা বাঁই করে একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে গিয়ে লোকটার দিকে ভীষণ আচমকা এগিয়ে যায়। ওর মুখের ডগায়, এ্যাই বাঞ্চোত! টাইপের একটা গালাগাল এলেও সেটাকে ও খসতে দেয়না, যদি সত্যি খুব ভয়ংকর কোন খারাপ লোক হয় , অতটা খাপ খোলা ঠিক হবে না বোধ হয়।
লোকটা, থুড়ি, ছেলেটা , সত্যি ওর ওই হঠাৎ ঘুরে দাঁড়ানোয় হকচকিয়ে যায়, থমকে দাঁড়ায়। আধো অন্ধকারে ও ছেলেটার মুখ দেখতে পায়না।
একবার ওইভাবে র্যালা নিয়ে ঘুরে দাঁড়াবার পর আর থেমে থাকা যায়না, ও সটান এগিয়ে যেতে থাকে। দু পা এগোতেই , ওর মাথায় ধাক্কা দেয় একটা তথ্য। এটা আর কেউ নয়। ওর হাড়বজ্জাত বি এফ। টুবান। একটু আগেই এস এম এস করেছে, আজ আসতে পারছি না। মাথা ধরেছে। শুয়ে আছি।
টুবান! পাজি , ছুঁচো, আজ এক থাপ্পড়ে তোর থোবড়টা যদি না পাল্টেছি!
প্রায় সিংহ বিক্রমে টুবানের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে অলক্তিকা। রোগা ডিগডিগে টুবান খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসে। কেমন সারপ্রাইজ দিলাম, বল্? আচ্ছা, তুই কি সত্যি ভয় পেয়েছিলি?
বাড়ির ছোট লোহার গেট খুলে ঢুকতে ঢুকতে টের পেল অলক্তিকা, দু তিনতলার জানালায় অন্য ফ্ল্যাটের কাকিমা আন্টিদের চোখ তার ওপর। রাত দশটায় রোজ ফেরা এই ঝাঁকড়া চুল, ছোট প্যান্টস পরা, সঙ্গে এক বা একাধিক ছেলে লটকে নিয়ে ফেরা মেয়েটাকে নজরে রেখেই চলেছে গোটা পাড়া। ওই সব কাকি আন্টিদের সঙ্গে মা যতই প্র্যাক্টিকাল সখ্য রেখে চলেছে, অলক্তিকা কাউকে পাত্তাই দেয়না।
একটা হু হু হাওয়া বয়ে যায়, নীরব , অথচ বিপজ্জনক আড়ি পাতার। গসিপের। অলক্তিকা নিজের কাছে রাখা চাবি দিয়ে নিচের দরজার ইয়েল লক খুলে, আস্তে আস্তে উঠে যায় ওপরে। পেছনে ক্লিক শব্দে বন্ধ হয়ে যায় ঘরের দরজা। নিরাপত্তার ঘেরাটোপে ঢুকতে ঢুকতে, একটু অন্যমনস্ক হয়ে হাঁপ ছেড়ে বাঁচে।
চল, চল, টুবানকে তাড়া দেয় ও। হাসে এবার। এতক্ষণ সব কটা স্নায়ু টানটান হয়ে ছিল।
মা দরজা খোলে, টুবান আর ওকে দেখে একটুও অবাক হয়না। বাথরুমে ঢুকে যায় অলক্তিকা। মা-কে বলে, মা, খিদে পেয়েছে। টুবান স্ট্রেট ওদের বসার ঘরে গিয়ে বসে।
বাবা অন্য ঘর থেকে বলে, বিবি এসেছে? এবার খেতে দাও।
মা খুব আলগোছে বাবাকে – খাবার টেবিলেই আছে, খেতে চলে এসো। বিবি , টুবান, খেতে আয়।
ওরা চুপচাপ রুটি তরকারি খায়। বাবা ফ্রিজ খুলে মিষ্টির কৌটো বার করে। অন্যরা খায় না, বাবা খাবার পর একটা মিষ্টি খায়। টুবানের দিকে তাকিয়ে অলক্তিকার মা বলে, আজ বাড়ি ফিরতে হবে না। এখানেই থেকে যা।
পাড়ার কাকিমাদের সঙ্গে মায়ের জেল করে কী করে? ভাবে অলক্তিকা। যাকগে, একটা সি পি এম মা থাকা অনেক দিক থেকে ভাল। যদিও সবকিছুর শেষে লাল টুকটুকে সূর্য দেখতে চায় মা।
অর্চির মুষ্টিযোগ
তৃতীয় ফোনটার পর খুব ক্লান্ত বোধ করছিল সোমদত্ত। এইভাবে প্রতি মুহুর্তের মনিটরিং আর কতকাল সম্ভব?
তিন হাজার তিপ্পান্ন বার ফোন করলেও শুধরোবে না ওই ছেলে। যা করার করে নাও!
অর্চি বুঝেই নিয়েছে। নিজের বাবা মাকেই মানে না , কাকাকে মানবে। হতে পারে কাকা তোমার ছোট্টবেলায় পার্কে নিয়ে ঘুরিয়েছে দোলনা চাপিয়েছে। তারপর ?
আসল সোর্স অফ মধু কোথায় সবাই জেনে যায়, বয়স ১০-১১ হবার আগেই । ওসব ভালবাসাটাসা কিচ্ছু না।
সোমদত্ত সজোরে দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
অর্চি জানে, বাবা মাকে একটু চাপ দিলে যা চাও পাবে। একটু ব্ল্যাকমেল করলে, মাথা গরম করে একটু চেঁচামেচি করলেই সুড়সুড় করে টাকাপয়সা আসবে। নিজের ইচ্ছেগুলো দিব্যি মিটিয়ে নেওয়া যাবে।
বাবা মা ছাড়া পৃথিবীর আর বাকি সব লোক, ফোটো, ফুটে যাও! ক্লোজেস্ট অ্যালাই বাবা মা, ইন দ্য সেন্স, যে, ওরা সার্ভিস প্রোভাইডার। বাকিরা বিনে পয়সায় জ্ঞান বিতরণ করবে। একটু স্পেস দিলেই কনট্রোল করতে আসবে। সুতরাং প্রথম থেকেই তফাত রাখো। চেপে দাও। ...নো এন্ট্রি।
অর্চির কাছে, কাকাফাকা ফাঁকা। কে কাকা, কে মামা! তা ছাড়া গার্ল ফ্রেন্ড পাশে থাকলে , এইসব ওল্ড ফ্যাশনড কনট্রোল করা লোকগুলোকে একদম নো পাত্তা করে রাখতে হয়। নইলে প্রেস্টিজ যায় ভাঁড় মে!
এইসব জানা সত্ত্বেও , সোমদত্তকে মনিটরিং করতে হচ্ছে। বাধ্য হয়ে। কেন যে এরকম ঘোর অভাগার দশা সোমদত্তর। প্রেশার বেড়ে যায়। মধ্য পয়ঁতাল্লিশের সোমদত্তর নেয়াপাতি ভুঁড়িও কেমন টেনশনে থরথর করে।
অথচ সোমদত্তর দাদা আর বউদি দিব্যি অর্চিকে ওর ওপর ফেলে দিয়ে চলে গেল। একজন কিটি পার্টি গ্রুপের সঙ্গে বেরু বেরু করতে গেছে দু হাজার কিলোমিটার দূরে। অন্যজন কাজে অকাজে সমানে বাইরেই থাকে। ব্যাঙ্ক অফিসার হোনে কে নাতে।
একটা সতেরো আঠেরো বছর বয়সী ছেলে। সারাদিন সারাক্ষণ যার হায়ার সেকেন্ডারির পড়া নিয়ে থাকার কথা , সে আছে ভিডিও গেম আর কম্পিউটার নিয়ে। মোবাইল ফোন আর চ্যাটিং নিয়ে।
তাও এমনি চ্যাটিং হলে হত। এ একেবারে মোক্ষম ব্যাপার। গার্ল ফ্রেন্ড। কোথা থেকে আজকালকার বাচ্চাগুলো এইসব রোগ পায়? বীজাণুর মত একেবারে গিজগিজ করছে রোগটা বাতাসে যেন। তেরো উর্ধ বাচ্চাগুলো পটাপট পড়ছে এ রোগে। লাভেরিয়া। যখন তখন তৈরি হচ্ছে বয়ফ্রেন্ড গার্লফ্রেন্ড। অ্যাফেয়ার হচ্ছে। আবার দ্রুত ভেঙেও যাচ্ছে তা। ব্রেক আপ না কি বলে। এক ব্রেকাপ থেকে আর এক ব্রেকাপে যাওয়া, না কী যেন বলে।
অর্চির গার্লফ্রেন্ড থাকে ব্যাঙ্গালোরে। আলাপ হয়েছে বছর দুই আগে। কলকাতায় । তার পর থেকে সবটাই ফেসবুকে আর ফোনের চ্যাটে , ওয়াটস অ্যাপে। একদিন মাত্র সাক্ষাৎ হয়েছিল ওদের। সেটাও সোমদত্তদেরই দৌলতে। সোমদত্তর স্ত্রী স্বস্তিকার বান্ধবী প্রথমার মেয়ে সুনন্দনা। ক্লাস টেনে পড়ে। সোমদত্তর ছেলে টিন্টোর জন্মদিনে এসেছিল প্রথমা আর সুনন্দনা। সেই কাল হল।
শুরুতে অর্চি খুব নাক শিঁটকে বলেছিল, এ্যাঃ টিন্টো তোর জন্মদিনে একপাল বাচ্চা আসছে। এদের হোস্ট করতে কিন্তু আগেই বলে দিলাম, আমার কোন ইন্টারেস্ট নেই। ও বাবা , তোর মায়ের বন্ধুর মেয়েও আসছে? ন্যাকা হবে একটা। টেনে পড়ে? আমি তো ওদের সঙ্গে বসে গল্প করতে পারবই না। যা তা বোরিং সব।
সেই অর্চিই সারা সন্ধে সুনন্দনার সঙ্গে লটকে গেল। চিপকে গেল যেন চুইং গাম। তারপর, সমস্ত বছরটা ওদের হু হু প্রেমের সাক্ষী হয়ে রইল। পড়াশুনো মোটামুটি লাটে।
এখন সুনীতা যখন বার বার আউট অফ রিচ, মানালি না কোথায় একটা গেছে, অর্চিও ফোন তুলছে না, সোমদত্ত ঘামছে, স্বস্তিকা বলে, সুনন্দনার সঙ্গে গেছে তো কি হয়েছে। আমার বান্ধবীর মেয়ে বলে, আমি জবাবদিহি করতে যাব কেন? নিজের ছেলেকে কনট্রোল করতে পারো না নিজে, আমাদের ওপর ছেলের দায়িত্ব ফেলে গেছো কেন? অর্চির আঠারো হয়ে গেছে না? ওর রেসপন্সিবিলিটি আমাদের নাকি?
স্বস্তিকা রেগে গেলে খুব মারাত্মক। বিষ। তেতো। সোমদত্ত জানে। তাই কিছু বলতে পারেনা। চুপ করে গিলে নেয়।
সত্যিই দাদারা এটা কী যে করছে। নিজেদের কেরিয়ার গোছাতে ছেলেটাকে কলকাতায় ফেলে দিয়ে চলে গেল সব। দাদা পুরোটা যায় নি অবিশ্যি, কিন্তু বাবাকে আর কবে সেভাবে মানত অর্চি। পারলেই ধমকায়, আমাকে ডিস্টার্ব করবে না বাবা। নিজের প্রফেশনাল স্ফিয়ারে দিব্যি মান্যগণ্য বিশাখদত্ত বাড়িতে ছেলের কাছে কেঁচো।
বাবার ক্রেডিট কার্ড একটা অর্চির কাছে থাকে। সেটা দিয়ে রোজ আমাজন আর ফ্লিপকার্ট থেকে জিনিস কিনছে, নতুন নতুন মডেলের ফোন, হেডসেট , এটা ওটা সেটা । ব্রাউন পেপারের মোটা সরু ছোট বড় বাক্স ঢুকছে বাড়িতে। এখন, প্রেম শুরু হবার পর, একটা বাই উঠেছে, সুনন্দনার সঙ্গে হ্যাং আউট করতে ব্যাঙ্গালোর যেতে হবে। কার্ডে ফটাফট যাত্রা ডট কম থেকে টিকেটিং করা হয়ে যাচ্ছে। এই নিয়ে দ্বিতীয়বার। গতবার বিশাখদত্ত-সুনীতা কলকাতায় ছিল। এবার নেই। কাজেই মনিটরিং এর দায়িত্ব সোমদত্ত।
সুনন্দনা মাঝে মাঝে মায়ের সঙ্গে কলকাতা আসে, তখন তো প্রথমার বাড়িতেই সারাদিন অর্চি। লটকে থাকে পুরো ওদের সঙ্গে।
একটার পর একটা দিন, লেখা নেই পড়া নেই, এই ক্যাফে নয় ওই রেস্তোরাঁয়। দিন কয়েকের জন্য অর্চি প্রথমাদের বাড়িতেই গ্যারেজ হয়ে যায়। আর খিটমিট করে। এখানে প্রাইভেসি নেই। এ বাড়িতে হাটবাজার। কাকু কাকিমা দাদু ঠাকুমা। যত্তোসব।
সুতরাং মাঝে মাঝে ব্যাঙ্গালোরও যেতে হবে। ব্যাঙ্গালোর নয়। বেঙ্গালুরু। পালটানো নামটা সরোগরো করে নিতে হবে। এও একটা কাজ বটে। সোমদত্ত যাবার সময়ে একবার ফোন করে জেনেছে অর্চি এয়ারপোর্ট পৌঁছল কিনা।
না, কেউ অর্চিকে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দেবে না। ও কন্ডিশন দিয়েছে। আতুপুতু খোকা ভোলানো পছন্দ করেনা। টুয়েল্ভে পড়ে তো কী হয়েছে। ওকে ছেড়ে দিতে হবে, নিজে ট্যাক্সি নিয়ে যাবে।
তবু ফোন করতেই হয় সোমদত্তকে। “থ্যাংকলেস জব” দাঁতের তলায় চাপা হিস হিস শব্দ করে স্বস্তিকা টিপ্পনি মেরেছে। তোমার দাদা বৌদিও তো ফোন করছে ওদিক থেকে দেখো। সব খবরই রাখছে ওরা।
দমদম এয়ার পোর্ট থেকে ফোন তুলে কোনমতে বলে দিয়েছে , জোর করে ভারিক্কি ভাব এনে, ভারি গলায়, অর্চি। “পৌঁছে গেছি”।
ঘড়ির কাঁটার দিকে চোখ রেখে আবার বেঙ্গালুরুতে ল্যান্ডিং টাইমে ফোন করেছে সোমদত্ত। এবার প্রথমে একবার সুইচড অফ বলেছে। তার মানে ল্যান্ড করেনি ফ্লাইট। পরের বার বেজেছে ফোন। কেউ তোলেনি ওপারে। তারপর বার বার ফোন করে গেছে, তোলেনি অর্চি। টেনশন হয়েছে সোমদত্তর।
রবিবার, ওরা বাড়িতেই । স্বস্তিকা ওর দিকে আড়চোখে দেখেছে, তারপর বলেছে, চাপ নিচ্ছ কেন অযথা? ও সুনন্দনার সঙ্গে গাড়ি ফাড়িতে আছে। পকেটে ফোন থাকলে শুনতে পায় নি হয়ত। বাইরে আওয়াজ টাওয়াজ থাকলে না-ই শুনতে পারে।
দাদাকে ফোন করেছে সোমদত্ত। ভুবনেশ্বরে কনফারেন্সে গেছে বিশাখদত্ত । নিজের ব্যাঙ্কিং সেক্টরের কাজ। তার সঙ্গে এই সব টেকনিকাল কনফারেন্স। খাওয়াদাওয়া আরামের ঢালাও ব্যবস্থার সঙ্গে একটু ঘোরাঘুরিও। আজ সাইট সিইং এ বাইরে ঘুরছে । আউট অফ রেঞ্জ বলেছে।
বৌদিকেও ফোন করেছে। সুনীতা খুব টেনসড। সত্যি বেঙ্গালুরু পৌঁছে অর্চি কেন ফোন ধরল না?
একটু পরেই পিং করে সোমদত্তর মোবাইলে একটা মেসেজ এসেছে। অর্চির মেসেজ। খুলে তো সে থ। এই উত্তর পাঠিয়েছে অর্চি, প্লেন থেকে নেমে , ফোন না ধরে?
“ হু দ্য হেল আর ইউ?”
হু দ্য হেল আর ইউ? তুমি কোথাকার কে হে , আমাকে ম্যালা ফ্যাচফ্যাচ করতে এয়েচ? এইরকম মুডে অর্চির মেসেজ ।
তার মানে সোমদত্তর নাম্বার সেভ করা নেই অর্চির ফোনে! বা কোন কারণে দেখাচ্ছে না নম্বরটা।
ও চিনতেই পারছে না কাকার নাম্বার। কী করে হয়। সোমদত্ত সেটা তবু যদি বা বিশ্বাস করতে পারে, যদিও অর্চির কাছে কাকার নাম্বার সেভ করা নেই এটা হতেই পারে না... কিন্তু কোন অচেনা লোক অর্চিকে ফোন করেছে, মিসড কল দেখে অর্চির তার প্রতি এই সম্ভাষণ? হু দ্য হেল আর ইউ? অতীব খচড়া ছেলে হয়ে গেছে তো অর্চিটা। নিজের আঠারো বছরের ভাইপো সম্বন্ধে বেশ তির্যক হয়ে উঠল কাকা।
সোমদত্ত খিটকেল মুডে স্বস্তিকাকে বলল, দেখেছ, ওই মেয়েটাকে সঙ্গে পেয়েই কেমন ভোল পালটে গেল ছেলের? কী মেয়ে গো তোমার ঐ সুনন্দনা? সেদিনই প্রথমাদের দেখে বুঝেছিলাম, বড়লোক, আপস্টার্ট, পয়সার গরম শুধু।
স্বস্তিকা তিরিক্ষি হল মুহূর্তে। অথবা মুহূর্তও লাগল না। বলল, প্রথমাদের টাকা আছে সেটা খুব গায়ে লেগে গেল না? অমনি দোষ হয়ে গেল সুনন্দনার। ওর সঙ্গদোষে অর্চি অসভ্যতা করছে? আরে, তুমি তো লাকি, যে ওই মেসেজটা অন্তত করেছে। তাহলে বুঝলে যে অর্চি পৌঁছেছে সেফলি। কনফার্মেশন তো পেলে? বাকিটা ইম্যাজিন করে নাও। এখন সে বিজি, গার্লফ্রেন্ড ছাড়া পৃথিবীতে কারুর সঙ্গে আর দরকার নেই। দোষটা দয়া করে অন্যদের ঘাড়ে চাপিও না। যেভাবে ভাইপোকে তোমরা মানুষ করেছ, সেইটা দেখ! আহ্লাদ দিয়ে দিয়ে তো মাথায় তুলে দিয়েছ সবাই মিলে। এবার বোঝ।
আহা , তোমার ছেলে কিছু কম আহ্লাদে মানুষ? কিন্তু টিন্টো এরকম ভাষায় কাউকে এস এম এস করছে, আমি তো ভাবতেই পারি না।
ওই ছেলে তোমাদের হাঁড়ির হাল করবে জেনে রাখো। প্রথম দিন সুনন্দনার সঙ্গে আলাপ হবার পরই অর্চি তো আমাকে বলেছিল, ওরা খুব রিচ, না কাকিমা? ছুটিতে ইউ কে বেড়াতে টেড়াতে গেছিল, বাড়িতে এক্স বক্স আছে, ল্যাপটফ ফ্যাপটপ সব। টাকা দেখেই তো সুনন্দনার দিকে যত অ্যাট্রাকশন অর্চির। একটা হাংলাবাংলা ঘরের সাধারণ ছেলে, তার এত লোভ কেন। চোখ নাচিয়ে বলেছিল, আমাকে ভাল ভাল গিফট দেবে, ভাল ভাল রেস্টুরেন্টে ট্রিট দেবে, ওকে গার্লফ্রেন্ড করি?
আমরা হাংলাবাংলা ঘরের তো কী হয়েছে। নেক্সট জেনারেশনের কাছে তো ওসব পুরনো মধ্যবিত্ততার হ্যাং ওভার নেই। বাঙালি আর কিছু না পারুক, মধ্যবিত্ত থাকার আর কিপ্টেমি করে সারাটা জীবন ময়লা লুঙ্গি আর ছেঁড়া হাফশার্ট পরে কাটিয়ে দেবার সেন্টিমেন্ট ছেড়ে তো বেরিয়ে এসেছে। দাদা বৌদি দুজনেই জীবনে সফল, ছেলে যখন যা চেয়েছে দিয়েছে। ও লোভী কেন হতে যাবে। নর্মাল যে কোন বাচ্চাই আজকাল এগুলো চায়। সোমদত্ত খ্যাঁক খ্যাঁক করে উঠেছিল।
চিপসের প্যাকেটের মত গাল ফুলিয়ে স্বস্তিকা উঠে গিয়েছিল। জানি না বাপু, সব সময়ে নিজেদের দীনতার অভিমান আর হোলিয়ার দ্যান দাউ অ্যাটিচ্যূড যে তোমাদের কবে যাবে। এখুনি বললে প্রথমারা আপ স্টার্ট। এখন এটা বলছ। ডাবল স্ট্যান্ডার্ড দেখে বাঁচিনা।
প্রিয়নাথের ব্যাকরণ
এ পাড়ায় একজ্যাক্টলি সকাল সাতটার সময় একটা গরম তাজা হাওয়ার ঢেউ খেলে যায়। পুরনো বাংলা গানের গমকী প্যাঁচপয়জার ও শোনা যায়। আর হুলুস্থুল কথা।
প্রিয়নাথবাবু। বেঁটে, চৌকো। মশলাঠাশা তুবড়ির মত। হাফ হাতা শার্ট। ওপরে হাতকাটা সোয়েটার। ধূসর প্যান্ট, একটূ ঝুলে ছোট। পায়ে রাবারের স্যান্ডাল। একটা হালকা সবুজ স্কুটার, আদ্যিকালের, সেইটে চেপে আসেন। মাথার চুল ছোট করে ছাঁটা। দেখলেই সত্যিই মনে হয় খেলার মাঠে পিঁ পিঁ করে হুইসেল বাজিয়ে ছেলেদের ডনবৈঠক করাচ্ছেন, অথবা ফুটবল খেলাচ্ছেন। বাস্তবে ঐ ঐ গুলোই করতেন তিনি। ছোটখাট, সলিড চেহারা। শরীরচর্চা করে করে ওয়েল বিল্ট। বেশ গাট্টাগোঁট্টা যাকে বলে।
ফ্ল্যাটে আট ঘর। সবাই মাঝারি , বয়স্ক। ওঠার আগেই চত্বরে দেখা হল একজনের সঙ্গে। দোতলার তিন নম্বরের শ্যামলবাবু। কানে মাঙ্কিক্যাপ। বয়সের আগেই বুড়িয়ে গেছে।
-কী খবর? কেমন আছেন প্রিয়নাথদা?
ফার্স্ট ক্লাস ভায়া , ফার্স্ট ক্লাস, তোমরা সব কেমন?
হেঁ হেঁ, ঠিক...
কোথায় চললে, মর্নিং ওয়াক? করো , করো , ঐটির মত ওষুধ আর নেই।
হেঁ, আজ্ঞে, আমার আবার বাতের ব্যথাটা...
আরে আমার বয়স তিয়াত্তর আর তোমার তো ষাটও হয়নি হে। কোথায় বাত, দাঁড়াও ধরছি তোমাকে এবার... বাত বাছাধন পালাতে পথ পাবে না... একেবারে এমন মালিশ দিয়ে দেব না।
শ্যামল মর্নিং ওয়াকের স্পিড বাড়ালেন। কথা না বাড়ানোর একটাই পন্থা। বাঁই করে ঘুরে, ওর দিকে দৃকপাত না করে, মায়ামোহহীন প্রিয়নাথ গলা ছেড়ে গান ধরলেন।
শ্যামা মা কি আমার কালো রে! ...
গিটকিরি, গমকে মোটা ভারি গলাটা গানের তান ফেঁদে উঠতেই, পাড়ার ঘুমভাব উধাও। বাড়িতে লোকজনের কান খাড়া। কোন ফ্ল্যাটে এলেন উনি? বেশ মানুষটি। তিনতলার ছ নম্বরের তন্বী ধবধবে ফর্সা নাতনিটি লাফিয়ে লাফিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামছে। স্কুলবাস ধরবে।
ও মা! আজ আমার কী সৌভাগ্য, একেবারে মিঠি দিদিমণির সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। ওয়াহ ওয়াহ, খুব সুন্দর লম্বা হচ্ছ দিদি।
মাথায় গায়ে পিঠে সুগোল নিটোল বেঁটেখাটো পুরুষ্টু হাতটি একবার বুলিয়ে নিলেন। মেয়েটা তিড়িক করে টিকটিকির মত পিছলে নেমে গেল। উনি উঠতে থাকলেন।
নামেই ফিজিওথেরাপিস্ট। আসলে সাইকোথেরাপিও করেন। আসতে যেতে গান করেন গলা খুলে। পুরনো বাংলা গানের দারুণ কালেকশন। আর, কথার মার প্যাঁচে মন খারাপকে হাওয়া করে দিতে পারেন। দারুণ জমাতে পারেন আড্ডা। লোককে কুশল জিগ্যেস করার আর্ট জানেন।
দোতলার চার নম্বরের বাসুবাবু নামছেন বাজারের থলি হাতে। সত্তরের ওপোর বয়স। দরকার না থাকলেও ডাক্তার বলেছেন, রোজ একবার করে বাজার যাওয়ার নাম করে বেরোবেন। নইলে কলকব্জাগুলো জং ধরে যাবে যে। ... কথা শোনেন ডাক্তারের, নামেন।
মুখোমুখি হলেন প্রিয়নাথের।
কী, সব ভাল তো? প্রিয়নাথ এক গাল হেসে বল্লেন।
চলছে। এই আর কী। আপনি?
বাসুবাবু করুণ একটা ভঙ্গি করলেন। ভাল আছি বললেন না। চলছে বললেন। বুদ্ধিমানের মত। এ দেশের বুদ্ধিমানরা ‘ভাল আছি’ বলতে ভুলে গেছেন বহুদিন। উল্টোদিকে প্রিয়নাথ উৎসাহে টগবগ করে বললেন, আমার তো সবসময়েই দা-রুণ, দাদা...
হুম, এখন কোথায় চললেন, বোসদার বাড়ি?
হ্যাঁ, বোসদার শরীর তো খুব খারাপ।
তাই বুঝি? আবার কি কিছু হয়েছে? সেই স্ট্রোকের পর থেকেই অবশ্য ভাল নেই। ভাবছি একদিন দেখে আসব গিয়ে...
হ্যাঁ দেখলে চোখে বিশ্বাস করা যায়না এমন হাল হয়েছে আমাদের জাঁদরেল হেডস্যারের। বৌদির জন্য দুঃখ হয় খুব। রাতের ঘুম উড়ে গেছে...
ইয়ে, বাজারে যাই, ছোট বেলা...আবার অফিস আছে...
যান গিয়ে , এগোন। আমি নরেনদার বাড়িটা একবার ঢুঁ মেরে যাই।
হ্যাঁ হ্যাঁ...কেমন কুয়াশা করেছে দেখুন।
হবে না, আজ যা ঠান্ডাটা পড়েচে। আজ তো নলেন গুড় খাওয়ার দিন বাসুদা।
বাসুবাবুর মন ভাল হল।
রোজই প্রিয়নাথের উপস্থিতি শ্যামলবাবু, বাসুবাবু, বোসবাবু, নরেনবাবুদের ফ্ল্যাটটার ঠান্ডা মিইয়ে থাকা অবস্থাটা পালটে দেয়। সকাল সকাল জমজমাট একটা গলার উত্তাপ পাড়ার নিস্তব্ধতাকে খান খান করে। গরম চায়ের গন্ধের মত চাঙ্গা করে তোলে ম্রিয়মান সিনিয়র সিটিজেনদের।
মন ভাল হল সনাতন প্রধানের। সাত নম্বর ফ্ল্যাটের সিনিয়র সিটিজেন। প্রাংশু হাজরা আট নম্বরের, বেরিয়ে বারান্দার গ্রিলে জং লেগেছে কিনা পর্যবেক্ষণ করছিলেন। উনিও খুশি খুশি মুখে ঘরে ঢোকেন। গিন্নিকে শুধোন, প্রিয়নাথবাবুর আজ আসার দিন নাকি?
প্রাংশু হাজরার ছোট ছেলে ছেলের বউ নাতি অবশ্য ওঁদের সঙ্গেই থাকে। সেদিন প্রাংশু রসিয়ে গিন্নিকে বলেছিলেন। আমাকে আগে খোঁটা দিতে তো, দুই ছেলেকেই ইঞ্জিনিয়ার করিনি কেন ? বাসুবাবুর ছেলে অ্যামেরিকা চলে গেল। বোসদার দুই মেয়ে ক্যানাডা আর ব্যাঙ্গালোরে সেটল্ড। বোঝ এবার। বুড়ো হয়ে কী দুর্দশা।
প্রাংশুর ছেলে , ছোট ছেলে, সোমদত্তর বউ স্বস্তিকাটা বেশ। এমনিতে মোটাসোটা, চাপা গায়ের রং হয়ে কী হবে। মুখে বেশ লাবণ্য । পড়াশুনো করেছে, ভাল চাকরিও পেয়েছে সরকারি।
রোজ যখন আসেন প্রিয়নাথ, ডাইনিং কাম ড্রইং রুমেই বসেন। প্রাংশুবাবুকে মালিশ করতে শুধু নয়, প্রাংশুবাবুর স্ত্রী, যাকে বউদি বলে ডাকেন প্রিয়নাথ, তাঁরও হাত পায়ের কিছুটা দলাইমলাই, খানিক ব্যায়ামের ব্যবস্থা করাতে হয়। তখন মুখ চলে। গান গাইতে গাইতে কথা। কথা বলতে বলতে গান। বেশ মজার ব্যাপার। সিনে ঢুকে আসে সোমদত্ত। স্বস্তিকা ছেলের ব্রেকফাস্ট বানায়, টিফিন বানায়।
স্বস্তিকা প্রিয়নাথকে চা করে দেয়। আগে গল্প করত, এখন একটু এড়িয়ে যায়। অতটা উষ্ণতা নেই। পুরনো হয়ে গেছে প্রিয়নাথ। বোঝেন।
তবে তাও। প্রিয়নাথ দুর্দমনীয়। কথা বলতে থাকেন। গান গাইতে থাকেন। নিজের চোখের কোণ দিয়ে প্রিয়নাথ দেখতেও থাকেন। স্বস্তিকার ছেলেকে দুদ্দাড় বেগে ইস্কুলের জন্য তৈরি করা, দিয়ে আসা ইস্কুলে। সব কিছুর মধ্যে চোরাটানের মত স্বস্তিকার আঁটোসাঁটো শরীরটা উঠছে পড়ছে নিচু হচ্ছে লাফিয়ে উঠছে, দৌড়ে যাচ্ছে, সিঁড়ি দিয়ে নামছে।
আজকালকার মেয়েগুলোকে সত্যি, দেখলেও মনে আনন্দ। শাড়ির বালাই নেই। আঁট সালোয়ার কামিজ পরে সর্বক্ষণ আছে। বুকে ওড়নাও থাকে না সবসময়। সমস্ত শরীর থেকে ফুটে বেরোচ্ছে কনফিডেন্স।
এক এক বাড়ির বসবার ঘরে এক এক রকমের বিষয় ওঠে আড্ডায়। প্রাংশুবাবুর বাড়িতে, লক্ষ্য করেছেন প্রিয়নাথ , এই সময়ে সোমদত্ত বসে কাগজ পড়ে। অন্তত চার পাঁচটা কাগজ রাখে এরা। এই কাগজ ছড়াছড়ি করা টেবিলে , একটা কুড়িয়ে নেওয়া কাগজ নিয়ে প্রিয়নাথ একটা হেডলাইন পড়েন, তোলেন একটা প্রশ্ন। কী দাঁড়াল ব্যাপারটা, তাহলে , দাদা?
হাসি হাসি মুখে বলেন প্রিয়নাথ।
এই যে, কাগজে লিখল, নতুন সরকার সবার গ্যাসের কানেকশনগুলো ব্যাঙ্কের সঙ্গে লিংক করে দেবে, কী দারুণ ব্যাপারটা বুঝতে পারছেন? সবার সব কিছু ওদের হাতের মুঠোয় নিয়ে নেবে।
আরে না না , সাবসিডির জন্য করছে তো। গলা খাদে নামিয়ে বলল সোমদত্ত। বাংলা কাগজ স্ক্যানিং সেরে তখন সে ইংরিজির মধ্যে ঢুকেছে।
না সেটা তো জানি, আমি তো নিজেই পেয়ে গেছি সাবসিডি। ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের খাতাটা ভাল করে দেখবেন বৌদি। আপনারা পেয়েছেন?
বৌদি বাতের ব্যথায় কাতর। স্বামী প্রাংশুর সুগার আর হার্টের ওপরে ওঠাতে পারেন না নিজের চিন্তাকে। চুপ করে থাকেন। ঘোলাটে চোখে। প্রসঙ্গ পালটান প্রিয়নাথ।
মাধবপুরের ব্যাপারটা দেখেছ তো সোমদত্ত? ছ্যা ছ্যা ছ্যা।
প্রিয়নাথ মাথা দুলিয়ে হাসেন। চোখের কোণদুটো ঝিকিয়ে ওঠে বাচ্চা দুষ্টু ছেলেদের মত।
কোন ব্যাপারটা?
সোমদত্ত খুব নিরুত্তাপ গলায় বলে।
ওই যে, হোক...
হোক ঝঞ্ঝা তো? হ্যাঁ খুব ক্লোজলি ফলো করছি আমি ওটা।
আরে ওটা তো শুরু। কীভাবে পথভ্রষ্ট করা হল দেখলে তারপর ছেলেমেয়েগুলোকে? বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়ে তো সব। ওদের বুদ্ধি আর কতটুকু। দিদিমণির বিরোধিতা ওরা করতে পারে, কিন্তু এটা কি! প্রকাশ্য দিবালোকে চুম্বন!
চুম্বন শব্দটা চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, লজ্জা পেলেন না প্রিয়নাথ। কেননা তিনি সত্তরোর্ধ। তাঁর লাইসেন্স আছে।
বলে, নিজস্ব বক্তব্যের রসে বশে বিগলিত হয়ে, মুখ টেপা হাসিতে গোল মুখ টুলটুলে করে, একবার রান্নাঘরের দিকটায় চোখ বুলিয়ে আনেন।
----------------------------
এক দু মুহূর্ত পরেই, রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে, স্বস্তিকা ঠকাস করে চায়ের কাপ নামিয়ে রাখে দুটো বিস্কুট সহ। টেবিলের কাগজগুলো একটু সরিয়ে।
পাশে, রুটি ডিম, সোমদত্তের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে, নাও, নাও, আমার তাড়া আছে।
এই যে এসে গেছেন স্বস্তিকা মা আমার। শ্যামা মা কী আমার কালো রে!
গমগমে গলায় গেয়ে ওঠেন প্রিয়নাথ। স্বস্তিকার সঙ্গে চোখে চোখে চারিচক্ষের মিলন হয়না। বরং, ওর চেষ্টা করেই, ওনার চোখ এড়িয়ে যাওয়াটা প্রিয়নাথকে সুড়সুড়ি দেয় আরো। “আমায় বলে বলুক লোকে মন্দ” মাথা দুলিয়ে গাইছেন এখন প্রিয়নাথ।
হঠাৎ ভেতরের বেডরুমটা থেকে বেরিয়ে আসে ঢ্যাঙা অর্চি। ঝলঝলে বার্মুডা, হাতকাটা গেঞ্জি। এই মিঠেকড়া শীতে, যখন সবাই একটা আধটা করে সোয়েটার চাপাচ্ছে গায়ে, তখন ছেলেটা এই পরে আছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে এই ঘুম থেকে উঠল। অলস মন্থর হেঁটে ফ্রিজ খুলে একটা বোতল বার করে ঢকঢক করে কোকাকোলা গলায় ঢালল।
অর্চি প্রাংশু হাজরার বড় ছেলের একমাত্র সন্তান।
স্বস্তিকা দাঁড়িয়ে গেল। কী রে অর্চি, তোর এখন কোক খাওয়ার সময়?
অর্চি কাকিমাকে পাত্তা দিল না। উলটে কটমট করে একবার প্রিয়নাথের দিকে তাকাল।
প্রিয়নাথ গদগদ স্বরে বলল, এই তো, এসে গেছে। আহা , ওর ভারি গরম লেগেছে। যা গরম পড়েছে , হ্যা হ্যা হ্যা।
অর্চি প্রিয়নাথের কথা শুনে হাসা দূরস্থান , একটা অসম্ভব তাচ্ছিল্যের লুক দিল। এই বুডঢাটা কে? এমন একটা মুখ।
আমারো গরম লাগছে, সোয়েটারটা খুলেই ফেলি । বেলা বাড়লে আর গায়ে রাখা যায় না।
অর্চির তাচ্ছিল্য পেয়ে নড়ে চড়ে বসেন। কটা বাজে? ও বাবা, এতটা বেজে গেছে। যাই। আবার বাজার যেতে হয় ।
অর্চি রান্নাঘরে একবার ঢুকে, ব্রেকফাস্টে কী রান্না হয়েছে দেখে নিয়ে বেরিয়ে, আবার বেডরুমের দিকে পা বাড়াল। অপাঙ্গে প্রিয়নাথের দিকে তাকিয়ে বলে গেল, হোক চুম্বনের ব্যাপারটা আপনার মাথার ওপর দিয়ে যাবে তো, ওটা বোঝার চেষ্টা করবেন না দাদু। আমাদের জিনিশ আমাদের বুঝতে দিন।
প্রিয়নাথ নিজের যাবতীয় বক্তব্য গপ করে গিলে নিলেন। একটু পরেই দেখা যাবে, উনি ছোট্ট হালকা সবুজ স্কুটারটায় স্টার্ট দিচ্ছেন।
সুনন্দনার রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস
প্রেম হল সব চেয়ে স্বাভাবিক অস্বাভাবিক অবস্থা।
কেননা প্রাণ নিজের থেকে বেরিয়ে অন্যের মধ্যে গিয়ে বসে।
প্রেম পারে আমাদের নিজেদের থেকে বেরিয়ে যেতে দিতে।
সাময়িকভাবে।
তারপর আবার আমরা নিজের মধ্যে ফিরে আসি।
স্পেল কেটে যায়।
মন প্রেম থেকে উঠে গেলে প্রেম আর মনেই পড়ে না।
মনেই পড়ে না, কীভাবে মন বেরিয়ে গিয়েছিল এবং ঢুকে গেছিল অন্য লোকের মধ্যে বা ঘুরঘুর করছিল তার চারপাশটিতে।
হায়।
প্রেম , স্বাভাবিকভাবেই, অস্বাভাবিক।
ইংরিজিতে লেখাটা লিখেছিল সুনন্দনা। অর্চিকে পড়িয়ে একটু লজ্জা পেল সে।
কিন্তু অর্চি পেল না। অর্চি পড়ে বলল, বাব্বাঃ খুব ভাল কিন্তু ভীষণ বেশি ডিপ হয়ে যাচ্ছে না?
ডিপ, হ্যাঁ, তো কী?
মানে আমার মাথার ওপোর দিয়ে না বেরোলেও অন্যদের যাবে।
ধ্যাত তেরি কা। তুই না!
খুব রেগে গেল ও।
না, মানে আমি তোকে ডিসকারেজ করতে চাইছি না। আমি জাস্ট বুঝতে পারছি যে তোর আগের ব্রেকাপের ব্যথাটা এখনো যায়নি। পুরনো ক্রাশকে দেখেছিস এর মধ্যে কোথাও? তাই এইসব রিয়ালাইজেশন?
আমি খেলব না তোর সঙ্গে যা!
রেগে ও উঠে যেতে চায়। ওর হটপ্যান্টস পরা পাতলা সুন্দর পা, হাঁটু, থাইয়ের ওপর অর্চির আঙুল খেলা করছিল এতক্ষণ অন্যমনে। ও খপ করে হাত ধরে।
তারপর ওকে টেনে এনে ডিপ কিস করে।
ওরা খানিকক্ষণের জন্য ডিপ কিসে ডুবে থাকে।
তারপর অর্চি বলে, একটা মজার কথা শোন। আমাদের বাড়িতে একটা বুড়ো আসে, দাদু ঠাম্মাকে মালিশ ফিজিও থেরাপি করাতে। সেটা একটা যা বুড়ো না। সেদিন যা দিয়েছি না। বসে বসে হোক চুম্বন আন্দোলন নিয়ে ব্যাঁকা ব্যাঁকা কমেন্ট মারছে। নিজেদের কম বয়সে তো কোনো মেয়ের সঙ্গে মিশতে পারেনি। এক্কেবারে রিপ্রেসড সব। এদিক ওদিক মেয়ে দেখে বেড়ায়। ওর কথাটা শুনেই আই পুট মাই ফুট ডাউন। বলেছি এসব বুঝবেন না দাদু, চেপে যান।
হি হি। যাঃ তুই না ভীষণ মীন হয়ে যাস মাঝে মাঝে।
শোন। চাপ তো। এইসব লোকেদের একদম স্পেস দিতে নেই। স্পেস দিয়েছ, কি এসে দুটো জ্ঞান মেরে চলে যাবে।
তুই আমাকে স্পেস দিস? হঠাত সুনন্দনার গলাটা কেমন হয়ে গেল, কথাটা । যেন উড়ে গেল আদ্ধেক, হাওয়ায়। অর্চিও যেন শুনতে পায়নি।
কী? ফিরে তাকালো ও। আজকাল জিমে যায় অর্চি। রোজ ওয়ার্ক আউট করার ফলে ওর বাইসেপস চেয়ে চেয়ে থাকে। ও সালমানের মত রঙিন স্যান্ডো গেঞ্জি পরে থাকে বাড়িতে। সেই বাইসেপসের ওপার থেকে একটু আন্দাজ করার চেষ্টা করল সুনন্দনার মুডটা। মাপল। কেস কী রে তোর? মুড অফ?
নাঃ , কিচ্ছু না।
সুনন্দনা মুখ ফেরাল।
কী হয়েছে? ঘন হয়ে এসে আবার ওকে ছুঁতে চাইল, দু হাতে জড়িয়ে নিচ্ছিল।
সুনন্দনা বলল, অর্চি তোর রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস, এখনো সিঙ্গল।
ফেসবুকে। ওদের আলাপের দিন থেকে , আজ অব্দি। অর্চিকে বার বার বলা সত্ত্বেও করেনি চেঞ্জ। সিঙ্গল রেখেছে। কত না ইজিলি ইন এ রিলেশনশিপ উইথ বলে সুনন্দনার ফেসবুক আইডেন্টিটিটাকে জুড়ে দিতে পারত।
সুনন্দনা দিয়েছে সেটা। আজকাল সবাই দেয়। সবাই তো জানাতে চায় অন্যদের। আমি সম্পর্কে আছি। কেউ যাতে ভুল না ভাবে। জাস্ট ফ্রেন্ডস থেকে বয়ফ্রেন্ড গার্লফ্রেন্ড ওঠা তো একটা পদোন্নতি বইকি। তাহলে অর্চি দেবে না কেন?
যেদিন প্রথম ওদের আলাপ তার পর তো দু চারমাসেই সুনন্দনা অর্চির কেস একদম মাখো মাখো হয়ে গেছিল। কত যে ইট আউটে এ রেস্তোরাঁ ও রেস্তোরাঁ, সুনন্দনার বাবা মাকে জকিয়ে কলকাতা আসা, অর্চির সঙ্গেই শুধু টাইম স্পেন্ড করার জন্য, কত যে সেলফি তুলে ফেলা স্যামসুং ফোনে, আর সঙ্গে সঙ্গে আপলোড করে দেওয়া, কিউট কিউট, অসাম বন্ধুদের মেসেজ।
এমনকি , গত মাসে সুনন্দনা ওদের রিলেশনশিপের এক বছরও পালন করেছে। অ্যানিভার্সারি প্রেজেন্ট দিয়ছে অর্চিকে, একটা দুর্দান্ত ফ্যাশনেবল হাতঘড়ি...। অর্চি অ্যানিভার্সারির ব্যাপারটা ভুলেই যেত, কিন্তু সুনন্দনার প্ল্যানিং এবং শেষ মেশ বেঙ্গালুরু যাওয়ার টিকিট নিজে নেট থেকে কেটে দেবার প্রস্তাব, এগুলো আসায় , অর্চিও তেড়েফুঁড়ে গিয়ে মা বাবাকে প্রায় আলটিমেটাম দিয়ে টিকিট কেটে ফেলেছে, চলে গেছে বেঙ্গালুরু।
বেঙ্গালুরুর নাইট আউটিংগুলো দুর্দান্ত ছিল। যদিও সুনন্দনার বাবা মা দিনে একবার ডাল ভাত খেতে বলেছে ওদের। সেটা গিয়ে দাঁড়িয়েছে আন্টির বাড়িতে বানানো দারুণ পাস্তা আর নুডলসের ওপর। ওগুলো বাড়িতেই আন্টি দারুণ বানাতো।
সন্ধেবেলাগুলো ওরা বাইরে খেত।
এবার অ্যানিভার্সারি গিফট দিয়েছে অর্চিও। প্রেস্টো থেকে নিজের মুখের ছবি প্রিন্ট করা মাগ ।
কিন্তু রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস আপডেট করে “ইন এ রিলেশনশিপ উইথ” করতে এত কেন দেরি?
মানসীর ঘরতোলা
মানসী রোজ পাঁচটায় বেরোয়। গোবরডাঙা থেকে লোকাল ট্রেনে তিনঘন্টা জার্নি করে কলকাতা পৌঁছয় আটটায়। বিধাননগরে নেমে সল্ট লেকে ঢুকতে ঢুকতে সাড়ে আটটা পার। রোজ স্বস্তিকা বৌদি আড় চোখে দেখে আর বলে, আজও আধঘন্টা পরে ঢুকলে মানসী। নাকি এটাই সিস্টেম করে নিলে?
তবে বৌদি লোক খারাপ নয়। না, শুধু মাঝে মাঝেই পুরনো শাড়ি দেয় তার জন্য নয়। মানসীর কথা জানতেও চায়।
মানসীর একটাই ছেলে। বর অনেকদিন বাড়ি বসা। আগে যে চাকরিটা করত, সেটা পাকা ছিল না কখনো কিন্তু কেউ জানত না। একটা দোকানের চাকরি। সেটা চলে গেল নিজেরই দোষে। চাকরির পাশাপাশি ব্যবসা করতে শুরু করেছিল বিধান, কিন্তু সেরকম বৈষয়িক বুদ্ধি টুদ্ধি ছিল না লোকটার। খুব ভাল রান্না করে বলে এখনো গৌড়ীয় কীর্তন সংঘ থেকে ওকে ডাকে, উৎসবের সময় খিচুড়ি আলুরদম বোঁদে রেঁধে দিয়ে আসে। বছরে পুজোটা আসটায় রান্নার কাজ করে, পরদিনের জন্য অনেকটা খাবার নিয়ে পোঁটলায় বেঁধে আসে বিধান। কিন্তু পাকাপাকি রান্নার কেটারিং খুলতে গিয়ে পয়সা জলে দিয়ে হেরে বসে থাকল।
মানসী, বাবার খাবারটা দিয়েছ?
সকালে ইনসুলিন নেন প্রাংশু হাজরা। সঙ্গে সঙ্গে খাবারটা দিতে হয়। দেরি হলে সুগার ফল করে যাবে। আটটা থেকে সাড়ে আটটা মালিশ। নটায় ইনসুলিন, সোয়া নটার মধ্যে একটা মাখন ছাড়া পাউঁরুটির স্লাইস আর ডিমের সাদাটা কায়দা করে খোলা থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে পোচ। ডিমের হলুদ থেকে যাবে খোলাতেই। সেই হলুদ পরে পেয়াঁজ দিয়ে ভেজে খাবে মানসী। পাঁউরুটির পিঠের স্লাইস দিয়ে। শক্ত কড়কড়ে করে ভেজে নেয় পিঠটা। বিস্কুটের মত লাগে। একটু তেল ছিটে দিয়ে ঐরকম। ভাজাভাজা, দিব্যি।
ছেলের জন্য মন খারাপ করে মানসীর। এরই মধ্যে হাত পুড়িয়ে রেঁধে খায় ছেলে। বাবাটা বাউন্ডুলে আদ্ধেক দিন ঘরে থাকে না। ছেলে বি এ পাস পড়ছে। তিনটে টিউশন করে এরই মধ্যে।
রাত করে ঘরে ফিরে দুটো সুখদুঃখের কথা বলবে ছেলের সঙ্গে ভাবে। ভাবতে ভাবতেই ঘুম এসে যায়। সারাদিনের খাটুনি।
সারাদিনে অবিশ্যি মোবাইলে কথা বলে। ছেলেকে দুপুরে বলে, কী রাঁধলি বাবু?
বৌদিরা বলে সেলোফোন। ওদের সব যন্ত্রে হয়। ঘরে গড়াগড়ি খায় সেলোফোন, কম্পুটার। মাঝে মাঝেই মাসিমা ওয়াশিং মেশিং চালায়। বেশি কাপড় পড়লে, কাচাকাচির মেয়েটা না এলে। আবার বৌদি খাবার গরম করে মাইকোভেব মেশিং এ। কী সব খায়, একটু গরম করে খানিকটা সস ঢেলে নিয়ে। খুব কম একটু আধটু রাঁধে বৌদি। তবে একদিন চাউ করেছিল বেশ ভাল খেতে হয়েছিল সেটা।
মানসী ছেলের খবর নিতে নিতে ভাবে, ওর একটা নতুন ফোন কিনতে হবে। অনেকদিন ধরে বলছে ছেলে । মা, স্মাটফোন চাই। আঙুলে ছুঁইয়ে বাঁদিক থেকে ডানদিকে হুশ হুশ করে পাখি তাড়ানোর মত করে ছবি দেখে সবাই। ট্রেনে দেখে। ওই ফোন।
এই তেরো বছর আয়ার কাজ করে অনেকটা সংসার গুছিয়ে এনেছে মানসী। দেড় লাখ টাকায় ঘর পাকা করেছে। প্রথমে মেঝে ঢেলেছে। অনেক ঘেঁষ কম দামে পেয়ে গেছিল স্টেশনের ওপারের একটা ট্রাক ড্রাইভারের কাছ থেকে। কাদের বাড়ি ভাঙা হচ্ছিল সেই রাবিশ তুলছিল স্বপন। ওর সঙ্গে স্টেশনেই আলাপ।
মেঝে পাকা করেছে কত কষ্টে। ঘেঁষ ঢেলেছে। তার ওপর ইঁট পেতেছে এক থাক। সিমেন্ট দিয়ে জমিয়েছে। তারপর দেওয়াল দিয়েছে। একটার পর একটা ধাপ পেরোতে ধার নিতে হয়েছে। অনেকটা রাস্তা । কষ্ট হয়েছে। নিজের শখ আহ্লাদ ছেড়ে দাঁতে দাঁত চেপে ও টাকা জমিয়েছে। মাসে তখন আড়াইহাজার পেত। এখন প্রায় সাড়ে ছ হাজার।
খরচও তো বেড়ে যাচ্ছে। অটো বাস কিছু একটা নিতেই হয় বিধাননগরে নেমে। স্টেশন চত্বরে খিদে পেলেও খিদে চেপে থাকে মানসী। চা খাওয়ার জন্যও থামে না। অন্যেরা অনেকেই চা লেড়ো বিস্কুট খেয়ে নেয়, চাঙা হবার জন্য। একটা জিলিপি খেতে সন্ধেবেলা ট্রেন লেট থাকলে ইচ্ছে করে। যদিও বেরোবার আগে মাসিমাদের জন্য চা করে, চা করার পর ঢেলে নেয় এক কাপ নিজের জন্য। মাসিমাই বিস্কুট দেয়, অনেক সময় পড়ে থাকা তলানি চানাচুর বা ছোলাভাজা ঢেলে দেয়। সেসব খেয়েই বেরোয়।
আজ বৌদি বেশ মজা করেছে। হঠাৎ ওর মোবাইলটার দিকে তাকিয়ে বলে কি, আচ্ছা মানসী , আমরা যে শুনি, মোবাইলে অনেকরকমের ফোন আসে, কত মেয়েরা খারাপ লোকের পাল্লায় পড়ে যায় মোবাইলে কথা বলতে বলতে অচেনা লোকের সঙ্গে, তোমার কখনো সেরকম হয়েছে?
মানসী ফিক করে হেসে ফেলেছে। বলেছে, না না বৌদি ওসবে আমি খুব ভয় পাই। হ্যাঁ, মিথ্যে বলব না, অনেকে এসব করে । আমার ট্রেনেই আসে আর একটা মেয়ে রত্না, আয়ার কাজ করে , ওকে একবার একটা ছেলে ধরেছিল। ছেলেটা ওর বরের ভাই হয় দূর সম্পর্কের। কিন্তু পরে বোঝা গেল খুব খারাপ ছেলে, একদম সকাল থেকে রাত্তির ফোণ করে করে বিরক্ত করত। ভালবাসার কথা বলত...
মুখ টিপে হেসে চুপ করে গেল মানসী।
তারপর কথা ঘুরিয়ে নিল। বলল, আমি এসব খুব ভয় পাই। আসলে গোবরড্যাঙায় আমার শ্বশুরবাড়ির লোক ভর্তি। দুতিন পাড়া জুড়ে আমার স্বামীর আত্মীয়রা থাকে। অনেক ভাশুর দেওর জা আমার। কে কোতায় দেকে নেবে। আমার খুব ভয়। আমার স্বামী যত খুশি জ্বালাক আমায়, সংসারে টাকা না ঢালুক, অন্য মেয়ে টেয়ে নিয়ে থাকে না তো। আমিই বা কেন অন্যদিকে মন দেব।
বৌদি চুপ করে শুনেছিল। তারপর নিজের কাজ নিয়ে বসে গেছিল। এক কাপ চা করে দেবে মানসী?
ল্যাপটপ খুলে বসেছিল স্বস্তিকা। ভাবছিল। একটু আগেই ফেসবুকে বাছা বাছা সামাজিক বক্তব্য দিয়ে স্ট্যাটাস পেশ করেছিল প্রথমা। সেইটা পড়ে কিছু একটা জুতসই লোকদেখানো কমেন্ট লিখতে হবে তাকে।
কত তো নারিবাদী পেপার লেখে প্রথমারা। ফেমিনিস্ট প্রবন্ধ লেখে কাগজে। হিন্দু অথবা ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে ওর সারগর্ভ বক্তব্য বেরোয়। প্রথমার মত বান্ধবীরা, যারা সর্বক্ষণ এ সি ঘরে বসে মেয়েদের অবস্থা ও অবস্থান নিয়ে লড়ে যাচ্ছে, তাদের কাছে মানসীর মত পিসরা একটা করে অবজেক্ট । অবজার্ভেশনের ল্যাব। তার বেশি কিছু না।
স্বস্তিকা ভাবছিল, প্রথমাকে বলবে, সমাজ পরিবর্তন ভাগ্যিস হল না রে। হলে, বাড়িতে কাজ করার লোক পেতাম ? পেতাম না। সব কাজ নিজেদের করতে হত।
মানসী চা করল, তারপর খাবার গরম করে প্রাংশুকে সেবার দীর্ঘ কর্মপ্রক্রিয়ায় জড়িয়ে গেল। তেল মাখানো চান করানো খাওয়ানো। ধরে ধরে তোলা, বসানো , শোয়ানো । প্রাংশুর ঠিক দু থেকে তিনদিন লেগেছিল, মানসীর স্পর্শ চিনে নিতে । মানসী যখন কাজে আসে, তার আগের আয়া সুমতির চলে যাওয়ার ঠিক দু তিনদিন পর, সে সময়ে খুব ভায়োলেন্ট হয়ে গিয়েছিলেন প্রাংশু। অ্যালজাইমারের পেশেন্ট।
অপরিচিত হাত তাঁকে সেবা করতে চাইছে, নাকি আঘাত করতে, শরীরের প্রতিটি অণুপরমাণু দিয়ে বুঝতে চাইছিলেন প্রাংশু। মগজ দিয়ে নয়। কারণ মগজে অনেকটাই অসাড়তা ভর করেছে।
মানসীর নারীসুলভ নরম, যত্নশীল হাতদুটিকে বিশ্বাস করতে সময় লাগেনি, অশীতিপর প্রাংশুর প্রতিটি দেহকোষের।
অলক্তিকার সাহিত্যচেতনা
বিবর পড়েছিস?
না।
যাও পাখি?
না।
ম্যারেজ অ্যান্ড মরালস?
না।
সুনীল গাঙ্গুলিও পড়িসনি নিশ্চয়ি? সেই সময় বা পূর্ব পশ্চিম?
না।
কী পড়েছিস তাহলে? খালি খালি কতগুলো ওই হ্যারি পটার পড়ে তুই হিউম্যানিটিজ –এ টুয়েল্ভ পাস করে যাবি? জানিস মাধবপুর ইউনিভার্সিটির ইংরিজি অনার্স পড়তে গেলে সতীনাথ ভাদুড়ির ওপর নোটস লিখতে দেয়? জাগরী পড়। বা ঢোঁড়াই চরিত মানস। শিক্ষিত হ, বুঝলি , শিক্ষিত হ।
এই হচ্ছে তৃষা আন্টির দোষ। অলক্তিকার বাবার বন্ধু। হিস্ট্রি পড়ার আইডিয়াটা তৃষা আন্টিরই। কথাবার্তা এই রকমই। খালি জ্ঞান দেবে।
ইলেভেনে পড়তে পড়তে আন্টি ওর মাথায় হিউম্যানিটিজ নিয়ে দারুণ একটা লেকচার দেয়।
I am a teacher of the humanities. Humanities teachers are like personal trainers in the gym of the mind.
বলেছেন গায়ত্রী স্পিভাক।
এই আন্টিই সে অর্থে ওর সাহিত্য আর হিউম্যানিটিস পড়ার গোড়া। আন্টির কথা শুনে, পড়াগুলো প্রথমে শুরু করেছিল অলক্তিকা মায়ের কবিতার কালেকশন দিয়ে। তারপর বাংলা উপন্যাস পড়েছে। মতি নন্দী, রমাপদ চৌধুরী। পাশাপাশি ইংরিজি বইপত্তর। অনেকগুলো ফেমিনিস্ট বইও পড়িয়ে দিয়েছে , সিমোন দ্য বভোয়া অথবা ফে ওয়েলডন, জার্মেন গ্রিয়ার শুধু নয়। যতদিনে অলক্তিকা মাধবপুরের ইংরিজি ফার্স্ট ইয়ার, অনেকটাই পড়া হয়ে গেছে।
অ্যাডমিশন টেস্টে প্রশ্ন এসেছিল অদ্ভুত। ইংরিজি অনার্স পড়তে সতীনাথ ভাদুড়ির ওপর শর্ট নোট লিখতে হবে। খাইসে। বন্ধুরা ঠোঁট কামড়াল। বাইরে বেরিয়ে অনেকেই বলল, যাঃব্বাব্বাঃ এসব কি , মাথার ওপর দিয়ে বেরিয়ে গেল বস।
অলক্তিকা মুখ টিপে হেসেছিল। ওর মজা লেগেছিল। ভাগ্যিস তৃষা আন্টি ছিল। ওকে ঢোঁড়াই চরিত মানস পড়িয়েছিল। তাই এ যাত্রা উতরে গেল।
কিন্তু ঝামেলা তো তার পর শুরু। যত পড়ে তত মনে প্রশ্ন জাগে। মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। মনে হয়, সব এক পেশে । সব কিছু ভীষণ নিজের কোলে ঝোল টানা টাইপ। আর ঝোল টানছে কে? হিরো। প্রোটাগনিস্ট। পুরুষ লেখকের পুরুষ প্রোটাগনিস্ট। সমরেশ বসুর বিবর দ্যাখো। অথবা সন্দীপনের বিজনের রক্তমাংস।
পরশু তৃষা আন্টি বলল তোকে একটা কুইজ দিচ্ছি। তোর বন্ধুদের। ফেসবুকে। পোস্ট করল। একটা কবিতা। এইভাবে।
আমি তারে ভালবাসি অস্থিমাংস সহ
অমৃত সকলি তার – মিলন বিরহ !
বুঝি না আধ্যাত্মিকতা,
দেহ ছাড়া প্রেম-কথা,
কামুক লম্পট ভাই যা কহ তা কহ।
আমি তারে ভালবাসি অস্থিমাংস সহ!
আমি ও নারীর রূপে
আমি ও মাংসের স্তূপে,
কামনার কমনীয় কেলী-কালীদহ –
ও কর্দমে – অই পঙ্কে,
অই ক্লেদে – ও কলঙ্কে,
কালীয় নাগের মত সুখী অহরহ!
আমি তারে ভালবাসি অস্থিমাংস সহ !
বলুন তো এ কবিতা কার লেখা? হিন্ট : কবির জন্ম ১৮৫৪।
হিন্ট থেকে পায়নি অলক্তিকা, পেয়েছে তৃষা আন্টির ইনবক্স থেকে।
যাই বল এই মেল ফ্যান্টাসি আমার জঘন্য লেগেছে। এসব পুরুষতান্ত্রিক কবিতা-গপ্পো উপন্যাস আমাকে আর শুনিয়ো না আন্টি। যত্তসব। কে কী লিখল তাতে আমার ভারি ছেঁড়া পড়ল।
ছিঃ কী সব ভাষা বলছিস । তৃষা আন্টি খ্যাঁক খ্যাঁক হাসির ইমোটিকন দিল ওকে। বলল, রবি ঠাকুরের কবিতা পড় তাহলে গিয়ে। উফ, এমন সাবলিমেশন করেছে বুড়ো, যে পরবর্তী এক্কেবারে ষাট থেকে আশি বছরের জন্য নাকাবন্দী করিয়ে দিয়েছিল বাংলা কবিতাকে। পঞ্চাশের দশকের আগে আর কেউ লিখতে পেরেছে সেক্স নিয়ে, শরীরী কামনা নিয়ে, নিজের লিবিডোকে প্রকাশ করতে পেরেছে নির্দ্বিধায় লেখার ভেতর? সব স্যানিটাইজড, ভদ্র, ভিক্টোরিয়ান ভ্যালুজ এর ডেটল জলে চোবানো। কেউ আর মেয়েদের বুকের নিচে নামতে পারেনি।
হুম, তাই তুমি বলতে চাইছ, রবি ঠাকুরের থেকে বয়সে কয়েক বছরের বড়, এই গোবিন্দ চন্দ্র দাস , এসবের তোয়াক্কা না করে তখনই লিখে গেছে কবিতাটা।
হ্যাঁ, তারপর ওই লম্বা গ্যাপটা পড়ল।
হ্যাঁ , সেই গ্যাপের পর উনিশশো পঞ্চাশের দশকে কৃত্তিবাসের “স্বীকারোক্তিমূলক” এসে গেল, আর লেখা হল, সুনীল গাঙ্গুলির দিস্তে দিস্তে লেখায় চুমু আর সঙ্গমের বর্ণনা শুরু হয়ে গেল। কিন্তু একশো বছর আগেও মেয়েদের যৌনতা একটা ট্যাবু জিনিশ ছিল, নিষিদ্ধ জিনিশ । একশো বছর পরেও রইল। এভরিথিং ইজ সো মেল সেন্ট্রিক, আন্টি।
হ্যাঁ ।তুই হেনরি মিলার পড়, দ্য ট্রপিক অফ ক্যান্সার বা দ্য পিঙ্ক সেক্সটাস। দারুণ সাহিত্য কিন্তু পুরোটাই একটা পুরুষকে পৃথিবীর কেন্দ্রে রেখে লিখে যাওয়া। সেক্সুয়াল প্রাওয়েস দেখানো। কতটা সে বিছানায় ক্ষমতাবান, কতরকম ভাবে সঙ্গম করতে পারে, কত সহজে মেয়েদের পটাতে পারে, মেয়েদের তুলতে পারে। এই পৌরুষ কপচানোর সাহিত্যেরই কিন্তু এদেশি ভার্শন লিখেছেন বেলাল চৌধুরী সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় সুরঞ্জন মিশ্ররা। অবশ্যই এদেশি ঘরানায়। এই শোন , তোকে এসব লিখছি আবার তোর বাবা মা জানতে পারলে কিন্তু যা তা ভাববে আমাকে।
আন্টির সঙ্গে নির্বিবাদে এইসব নিয়ে কথা হয়। কয়েকটা বন্ধুবান্ধবের সঙ্গেও হয়। মানে যারা একটু আধটু সাহিত্য ভালবাসে, সত্যিই পড়ে, তাদের সঙ্গে এই নিয়ে কথা বলে, অলক্তিকা। এই এত্ত এত্ত বছরের সাহিত্য মাহিত্য সব আসলে পুরুষদের লেখা। তা হোক না গিয়ে। পুরুষরা বড় সাহিত্য যা লিখেছে, নোবেল উইনারগুলো থেকে শুরু করে ক্লাসিক মাসিক সব, প্রত্যেকটা আত্মজীবনী টাইপ। অথচ মেয়েদের কোন লেখা নিয়ে কথা বলতে গেলেই ওরা বলে, এগুলোর মধ্যে সাহিত্য আবার কী আছে, এগুলো তো সব আত্মজীবনী। মেয়েরা নিজেদের গন্ডীর বাইরে আবার বেরোতে পারে নাকি? সেই অবজেক্টিভিটি কোথায়? সেই ম্যাক্রোস্কোপিক ভিশন কোথায়?
হ্যাঁ, ছেলেরা নাকি মেয়েদের থেকে বেটার অ্যাবস্ট্র্যাক্ট থিংকিং পারে। পড়িস্ নি, ছেলেদের ব্রেনের লেফট হেমিস্ফিয়ার বেশি কাজের আর মেয়েদের রাইট? ছেলেদের রিজনিং পাওয়ার , ডিসিশন মেকিং পাওয়ার বেশি। মেয়েদের ইনটুইটিভ পাওয়ার বেশি ।
তুই যেটা বললি , সেটা বেদবাক্য বলে মেনে এসেছে এতদিন ধরে সব পন্ডিত, কারণ ওটা বলেছে সমস্ত ওয়েস্টার্ন থিংকারদের দাদু, বিজ্ঞ অ্যারিস্টটল। সেই কবে ! তাও , ওটাই চলছে। বলে গেছে, মেয়েদের মেয়েরা দেখতে নরম সরম কিন্তু আসলে বেশি বদমাইশ, তাদের সারল্য নেই, তাদের আবেগপ্রধান চরিত্র, শিশুদের লালন পালন করতে পারে, ওটাই তাদের একমাত্র গুণ। পুরুষেরা অনেক সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং পরিপূর্ণ। কান্ট এবং পরবর্তী মার্কিন অনেক সাইকলজিস্ট ও একই কথা বলে গেছে।
হ্যাঁ কিন্তু পরে বিহেভরিয়াল স্টাডি অনেক হয়েছে। ২০০১ এ বার্বার আর ওডিন এর স্টাডিতে বেরিয়েছিল নাকি, ছেলেরা একা থাকলে অতিরিক্ত আত্মপ্রত্যয়ে ভুলভাল ইনভেস্টমেন্ট করে শেয়ার বাজারে। বিবাহিত পুরুষরা বেশি ধীরস্থির ভাবে সিদ্ধান্ত নেয়। আর সিঙ্গল মহিলারা অনেক বেশি বুঝেশুনে টাকা শেয়ার বাজারে খাটান, বিবাহিত পুরুষদের থেকে কম সংখ্যায় হলেও, যারা করেন, তাঁদের ট্রেন্ড এটাই।
আরে ছাড়। আর বেশি সাইকোলজি মাড়াস না। এসব স্টাডি ওখানে রোজ তিন চারটে করে বেরোচ্ছে। ফলাফলও এত রকমের, যে ও থেকে কিছু প্রমাণ হয়না। রাইয়ের বাবা মা দুজনেই সাইকোলজির ছাত্র। দুজনেই পড়ায়।
দিশা আবার একটু বেশিই লেখার ব্যাপারটা নিয়ে থাকতে চায়। ও বলে, ঐ আত্মজীবনী লেখার ব্যাপারটা আমাকে এখনো ইনট্রিগ করছে। জানিস, আমার কীরকম মনে হয়, এই এত এত বছর ধরে নভেলে পুরুষরা পুরুষদের নিয়েই উপন্যাস লিখেছে কিন্তু ওপরে খোলশটা দিয়েছে অবজেক্টিভিটির।
হ্যাঁ , সেটা একটা দিক। অন্য দিকটা আমার আরো অবজেকশনেবল লাগে জানিস তো। এদের সব লেখায় বড্ড আমি আমি। পুরুষগুলো নিজেদের হাগু, হিশু, বীর্যপাত, প্রেম , যেগুলো আবার বেশির ভাগ সময়েই বিবাহ বহির্ভূত প্রেম, তা নিয়ে লিখে যায় পাতার পর পাতা। যেন সেগুলোর থেকে বেশি ইম্পর্টেন্ট কোন ঘটনা আর নেই। মেয়েদের নিয়ে যে লেখাগুলো, মেয়েদের যেভাবে ওরা দেখায়, ডেপিক্ট করে, তার মধ্যে ত অ্যাঞ্জেল হোর ডিকটমি। হয় উর্বশী নয় সতীসাবিত্রী। হয় ভীষণ গুডি গুডি নায়িকা নয়ত ভ্যাম্প। ছেলেদের মাথা চিবিয়ে খাচ্ছে। উর্বশীদের সঙ্গে দেহগত প্রেম করে তারপর পুরুষ নায়করা ফিরে যাচ্ছে বউয়ের আঁচলের তলায়। শেষ মেশ জয় হচ্ছে বউয়ের। কারণ না হলে সোশ্যাল ইনস্টিটিউশনটাকে জিতিয়ে দেওয়া হয়না। দাগিয়ে দিতে হবে বউয়ের সীতার মত আত্মত্যাগ করে সংসার টিঁকিয়ে রাখার গল্পটা। নইলে মেয়েরা সব বখে যাবে।
এই কথাটা বলল অয়নী। ও খুব স্মোক করে , জানালার ধারের খোপ কাটা অংশটায় পা তুলে উঠে বসে আছে।
অলক্তিকা বলে, মুশকিল হল, এরা সবকিছু লিখেছে এদের নিজেদের রুলস সেট করে। যেখানে মেয়েদের ঢুকতে গেলে ওই ঐ রুলসগুলো মেনে লিখে দেখাতে হয়েছে। কোন অলটারনেটিভ ডিসকোর্স মানে বয়ান কিন্তু উঠে আসেনি।
কিন্তু জেন অস্টেন বা শার্লট ব্রন্টি তো নিজেরা সেই রুলের ভেতরে থেকেই অসম্ভব ঠিকঠাক সব জিনিশ লিখতে পেরেছে রে। ওদের প্রথম প্রকাশের সময় নাকি পাঠক ভেবেছিল, আসলে ওই পেন নেমের আড়ালে কোন পুরুষ আছে। এতটাই বাঁধুনি আর অবজেক্টিভিটি। আমাদের এখানে সুচিত্রা ভট্টাচার্যের লেখা পড়েও তাই বলেছিল কেউ কেউ, এটা ছদ্মনামে কোন পুরুষ নয়ত?
আসলে লেখার স্ট্রেংথ বা লেখার জোর যাই বল, দেখলেই পুরুষ ভাবার একটা রেওয়াজ রয়েছে। মেয়েরা একই ভাষায় যদি নিজেদের সমস্যাগুলো লেখে... যেমন ধর পিরিওডস।
পিরিওডস কে সমস্যা বলতে আমি রাজি নয়। রাই আবার দ্বিমত হয়। আবার বেঁকে বসে। একটা ন্যাচারাল বায়োলজিকাল জিনিশ। সেটাকে সমস্যা কেন বলব। মাসের তিনদিন চারদিন একটু পেট ব্যথা হয় বলে ? সমাজ এই জিনিশটাকে নিষিদ্ধ করে দিয়েছে, সমাজ বলেছে তুমি ওই সময় অশুদ্ধ, অপবিত্র, তাই? সেটা যদি ইনিশিয়ালি হাইজিন থেকে এসেও থাকে, এখন স্যানিটারি প্যাড ইত্যাদি এসে গিয়ে তো আর সেই কন্সার্ন গুলোই থাকার কথা নয় , তাই না? এখন তাহলে কেন সমস্যা কথাটা বলা হবে। কেন একটা ন্যাচারাল প্রসেসকে ন্যাচারালি উচ্চারণ করতে পারা যাবে না। মাসিক না বলে পিরিওডস বলতে হবে?
অয়নী, দিশা, রাই আর অলক্তিকা এই নিয়ে ডিসকাস করতে করতেই একদিন এই কথাটা ভেবে ফেলে। “আচ্ছা, মেয়েরা যদি এইরকম ভাবে পিরিওডসের কথা লিখত? কেউ মেনে নিত? যেভাবে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় মাস্টার্বেশনের কথা লেখে? বা হেনরি মিলার নিজের মেয়েবাজির গল্পগুলো?”
তারপর হঠাৎ ওদের ভেতরে সব রকমের মতভেদ উড়ে যায়। ওরা ভাবতে শুরু করে, নিজেদের মাত্রই কয়েক বছর আগেকার ঘটে যাওয়া এই জৈবিক পরিবর্তনগুলো নিয়ে নীরবতার দিন গিয়েছে। এই নীরবতা ভাঙতে হবে।
অয়নী বলে, জানিস, আমার যে পিরিওডস নামক একটা বস্তু কখনো হতে পারে, এই যুগের মহিলা হয়ে, একটা মাল্টিন্যাশনালে চাকরি করেও আমার মা কোনদিন সেটা আমাকে বলেনি? আমি বারো বছর বয়সে একদিন আবিষ্কার করলাম আমার প্যান্টিতে রক্ত। আমার ভয় হল। মা বাবা বাড়িতে থাকে না, সারাদিন। আমি কাউকে বললাম না। মায়ের ফার্স্ট এইড বক্স থেকে তুলো নিয়ে নিয়ে রক্ত আটকানোর চেষ্টা করে যাচ্ছি। ঘরের কোনায় গুম মেরে বসে থাকছি। ওরাও দিনের পর দিন কেউ জিগ্যেস করছে না আমার কী হয়েছে। কী ইনসেন্সিটিভ ছিল রে মা!
হঠাত জ্বলন্ত সিগারেট ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে পা দিয়ে পিশে পেটে হাত চেপে হাউ হাউ করে কাঁদতে শুরু করে অয়নী।
বাকিরা হাত বাড়ায় অয়নীর দিকে । ওকে আদর করে। মাত্রই আট থেকে ছ বছর আগে সবার শরীরে এই পিরিওডস নামক জিনিশ এসেছে। সাদা বাংলায় মাসিক। দিশা দেখেছে, পিরিওডসের রক্ত লাগা প্যান্টি বা ট্রাউজারস জিন্স, ফ্রক, বিছানার চাদর মা আলাদা করে ভিজিয়ে দিত। কাজের মাসি নাকি ওসব কাচে না। নাক শিঁটকে সরিয়ে দেয়। মা রেগে রেগে সাবানের বার আর ব্রাশ বুলোত লালচে ছোপ লাগা জায়গাগুলোতে। দাঁতে দাঁত চেপে।
স্কুল ফাইনালের পর থেকে দিশা নিজে কাচে সেসব কাপড়। দিশার বাবা কিন্তু ব্যাপারটা অন্যভাবে ডিল করত। বলত, দিশা, দাগ লেগে যাবার ভয়ে তুই অমন শিঁটিয়ে শুয়ে থাকিস কেন? দরকার হলে তোর ছোটবেলার অয়েল ক্লথ পেতে নিবি। ওরকম কষ্ট করে শুয়ে থাকবি না।
মা মুখ ব্যাঁকাত। হুঃ, বাবার আহ্লাদি মেয়ে । যা বুঝবে করো।
দিশা এখন হেভি ফ্লোর জন্য যেরকমটা বাজারে পাওয়া যায়, তেমনই স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করে।
টাচফোনে দিগ্দর্শন
ট্রেন থেকে নেমেই মানসীর নতুন ছোঁওয়া-মোবাইল ব্যাগের ভেতর বেজে উঠল। গেল মাসে এই ফোনটা কিনেছে মানসী। ছুঁলেই কথা বলা যায়। ইস্ক্রিনের ওপর ছোঁয়া দিতে হয় আঙুলের। ছেলেই কিনেছে, দেখে, বেছে, শখ করে। কিন্তু মাকে ভালবাসে, তাই নিজে না রেখে মাকে দিয়েছে। সারারাত ডিউটি করে মা, রেডিওতে গান শুনবে শুয়ে জেগে। নইলে ঘুম এসে যায়।
অমিত করেছে নিশ্চয়, ভাবল মানসী। ছেলেটা বড্ড তার একা হয়ে গেছে । এগারো বছর বয়স থেকে মা কাজে যায়। সারাদিন থাকে না। আয়ার কাজ করে ঘর পাকা করা হয়েছে বটে, মাঝে মাঝে মানসীর মনে হয় দিন আনি দিন খাই করে ঘরের ছাতে টালি দিতে দিতে আসলে অমিতের মাথার ওপরটাই ছাত পায়নি। ঘর বলতে যা বোঝায় তা আর পেল কই অমিত। বাবা বাউন্ডুলে, মা সারাদিন অন্য লোকের বাড়িতে কাজ করে। সেবা যত্ন সব অন্যের । এই করে করেই দিন গেল। শরীর শুকিয়ে আসছে। বুকে একটা ফোঁড়া। কোনদিন ফাটবে না কিন্তু সেই যেন প্রাণশক্তি সব শুষে নিচ্ছে। ডাক্তার দেখিয়ে মানসী জেনেছে, অপারেশান করাতে হতে পারে। নাঃ অপারেশান সে করাবে না কিছুতেই। প্রাণ গেলেও না। ছেলেটা নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে গেলে আর কিচ্ছু চায়না মানসী। ছেলেটা আজো নিজে রেঁধে খেয়েছে। কাল দাড়ি কামাতে গিয়ে ব্লেড লেগে ঠোঁট কেটে গেসল। ব্যান্ডেজ করেনি, সারাদিনে খুব খারাপ হয়ে গেছিল জল খাবার লেগে। সন্ধেবেলা ফিরে ওর সীমিত একটু নার্সিং জ্ঞান নিয়ে দোকানে গিয়ে ভাল মলম নব্বই টাকা দিয়ে কিনে লাগিয়ে ছোট করে ব্যান্ডেজ করে দিয়েছে।
সকাল সাড়ে আটটা প্রায়। রোদ্দুর ঝাঁ ঝাঁ করছে আকাশে। মোবাইলে কার নাম উঠেছে দেখার ফুরসত পেল না। বাঁদিক থেকে ডানদিক আঙুল চালানো শিখিয়ে দিয়েছে ছেলে। ফুস করে হাত বোলালো, তারপর ফোনটা কানে দিতেই বুকের ভেতরটা কেন জানি ধক ধক করে উঠল।
স্বপন করেছে। এদিক ওদিক তাকাল ও। এমন মনে হল, যেন ওর কথা শুনেই আশপাশের সবাই বুঝতে পেরে গেছে কে ফোন করেছে। ওর সঙ্গী যারা নিত্যদিনের সেই সবিতা, চাঁপা, মালতীরা। কিন্তু সে ভয় নেই। ট্রেনে যারা এতক্ষণ লেডিজ কামরায় ওর পাশে বসেছিল তারা যে যার মত পাতলা হয়ে গেছে।
কে আর কার কড়ি ধারে। ও একপাশে সরে গেল । বিধাননগর স্টেশন থেকে এখন পাঁই পাঁই করে দৌড় লাগিয়ে সবাই যে যার মত অটো বাস এসব ধরে সময়মত কাজের জায়গায় পৌঁছবার তাল করছে।
তবু হঠাত এতদিন পর স্বপনের ফোনের ধাক্কাটা নেওয়ার জন্য ও ঠিক হাঁটা শুরু করার মত থই পেল না। একটু দাঁড়িয়ে গেল। খানিকটা লোহালক্কড় ফেলা আছে এদিকে। লোক নেই।
স্বপন খুব যে ফোন করে তা নয়। কিন্তু সেই যে ঘেঁষ ফেলার সময় ওর সঙ্গে দরকার হয়েছিল, তারপর থেকে কখনো সখনো ফোন করে। দরকারটা আর নেই, তাই অদরকারের ফোন। অকাজের কথা । এই অদরকারের কথাটাই কেমন যেন চাপা বুকভরা গন্ধের মত। ভাল লাগে মানসীর। ভয়ও করে। ও তো আবার ওর একরকমের দেওর হয়। এই লতায়পাতায় কী যেন একটা সম্পক্কো। বিধানের কেমন একরকমের ভাই।
কেন যে বুক দুরদুর। একটু একটু ভাল লাগাও আসে।
অথচ অমিতের কথা ভাবলে ভাল লাগা উড়ে যায়। ভয়ে প্রাণ একেবারে হাঁক পাক করে ওঠে।
খুব ছাড়া ছাড়া গলায় বলল ওঃ কী বলছ। বল।
— কেমন আছ কেমন? ওদিক থেকে বেশ একটা ভরাট গলা ভেসে এল। বুকের হাঁকপাক বেড়ে গেল।
আছি তো ভালই। খুবই যেন উদাসীন, এমনি ভাব করল মানসী। গরম লাগছে, হাঁটতে শুরু করল, এবার তাড়া এসে গেছে পায়ের পাতায়। কাজের বাড়ি যেতে হবে। ডিউটি ধরতে হবে।
বিধানদা ঠিক আছে তো?
আর কত খেজুরে করবে লোকটা? ওর কি সিমে ট্যাকা ভরতে লাগে না? এমনি এমনি চলে? রাগ হল মানসীর। চোখের সামনে একটা বাস বেরিয়ে গেল দেখল ডিউটিবাড়ির দিকের।
কী দরকার বলবে তো? কাজে যাচ্ছি। অধৈর্য হয়ে মানসী বলল।
নাঃ এমনি ভাবছিলাম তোমাদের বাড়ি যাব একবার। বিধানদা দিনের বেলা ঘরে থাকে? তুমি তো থাকো না, না? একটু হাসির আভাস স্বপনের গলায়। ভাবটা ভাল ঠেকল না ওর। স্বপনের দড়ির মত পাকানো কাঁধ, হাতের গুলি, আর ভরাট চওড়া বুকের কথা ভেবে মন যেটুকু নরম হয়ে এসেছিল মানসীর, আবার ধীরে ধীরে নেতিয়ে গেল । মনে সন্দেহ দানা বাঁধল। কী চায় স্বপন? কেন ফোন করছে এভাবে? গলায় কেমন দুষ্টামি ভরা আছে যেন।
নাঃ আমার কিছু ট্যাকা দরকার ছিল। তুমি বলেছিলে দরকার হলে বলতে। এখন হাতটা খালি যাচ্ছে। পারবে? বেশি না পাঁচ হাজার। নইলে বিধানদাকে বলি। আমার দাদা ফেরাবে না।
ও ট্যাকা কোতায় পাবে , শুনি? অনিচ্ছেতেও ঝেঁঝে উঠল মানসীর গলা।
তুমি পারবে না? হাসল খুক খুক করে স্বপন।
আমি ! রোজ মুখে রক্ত তুলে ডিউটি করি আটটা আটটার। এমনি এমনি মাগনা পয়সা দেয় আমায় কেউ?
সেবার তুমি কিন্তু আমার গুদোমে এসেছিলে মানসীবৌদি। ভুলে গেছ? বিধানদা জানলে... হেঁ হেঁ... না মানে তুমি তো ভদ্দরনোকের বউ, নীলষষ্ঠীর ব্রত, শিবরাত্রির ব্রত করা বউ, এখন নাকি বেহারি বস্তির বউগুলোর দেখাদেখি করবাচৌত না কি, সেসবও করো। বরের ভালটা দেখবে না? বিধানদা জানলে দুঃখু পাবে , বড্ড কষ্ট পাবে গো।
পুরুষের মাসিক উত্তরণ
সেদিনই গ্লোরিয়া স্টেইনেমের একটা লেখা পড়ে জাস্ট বিন্দাস হয়ে গেল অলক্তিকা। পুরুষদের যদি মেনস্ট্রুয়েশন হত তাহলে কী কী হতে পারত। প্রথমত, বিষয়টা তাহলে লজ্জার বা লুকনো থাকত না আর। হত অত্যন্ত গৌরবের বিষয়। যেরকম বড় বড় যুদ্ধে কে কত রক্তপাত ঘটিয়ে আসছে তা মধ্যযুগে বীরত্বের লক্ষণ ছিল, ঠিক তেমনি , পুরুষ গলার শিরা ফুলিয়ে দাপটের সঙ্গে দাবি করত, মাসিকে তার কত গ্যালন রক্ত ঝরেছে। বলত, এই কষ্ট করে সে পিতৃত্ব পেয়েছে, তাই এর দাম সন্তানদের চোকাতে হবে। নারী, যা যা প্রাকৃতিক শারীরবৃত্তীয় কারণের জন্য ভয়ে কুঁচকে থাকে, পুরুষের যদি সেই সব ঘটনা ঘটত, সে হত বিশালভাবে পূজ্য।
যে ক্ষমতার পাল্লাভারির দিকে, সেই তো নিজের সব কিছুকে সেলিব্রেট করে, উল্লাস! বলে বুক বাজায়। শারীরিক ক্ষমতার জন্য পুরুষ নাকি নারীর ওপরে। কিন্তু তাই যদি হয়, তাহলে দাসপ্রথার সময়ে শারীরিক ক্ষমতা বেশি থাকাকে কালোচামড়ার মানুষদের ক্ষেত্রে “দাস হবার জন্য বিধাতার প্রাকৃতিক দান” বলে বিবেচনা করা হত কেন? বেশি খাটতে পারে, তাই ওদের দাস হতে হবে, সাদাচামড়ারা অতটা পরিশ্রম করতে পারেনা, এজন্যই তাদের প্রভুত্ব স্বাভাবিক, এমন যুক্তি যারা দিয়েছিল, তারাই আবার নারী পুরুষ অসঙ্গতির ক্ষেত্রে গপ্পোটাকে উলটে দিল, বলল, পুরুষ বেশি শক্তিশালী তাই সে হবে প্রভু।
যখন যেমন তখন তেমন যুক্তি। ক্ষমতার লোকেরা ঠিক এটাই করে। হ্যাঁ।
স্বাতীর সঙ্গে ব্যাপারটা ঘটেছে যেদিন, তার পরদিন ওরা স্যানিটারি ন্যাপকিনের প্যাকেট কিনে এনে ব্ল্যাক মার্কার দিয়ে বড় বড় করে প্রতিবাদী স্লোগানগুলো লিখল। “আমাদের আঘাত করছ কিন্তু জেনো, আঘাতেরও আছে প্রত্যাঘাত”।
লিখল, এই শরীর তোমার যুদ্ধক্ষেত্র নয়, পুরুষ।
লিখল, লজ্জা দিয়ে আমাদের মুখ বন্ধ রাখা আর যাবেনা।
পরদিন থেকে ছিছিক্কার, পরদিন থেকে মাধবপুর বিশ্ববিদ্যালয় আবার খবরের শীর্ষে। লোকজন বলতে শুরু করে দিল, আরেব্বাস, এ যে দেখছি পড়াশুনোর ধারে কাটছে না। হুল্লোড় আর বেলেল্লাপনার ভারে কাটছে। মাধবপুর বিশ্ববিদ্যালয় খবরের শীর্ষ থেকে কিছুতেই নামতে চাইছে না। সবই ভুল কারণের জন্য।
প্রথমে হোক ঝঞ্ঝা। তারপর হোক চুম্বন।
এখন স্যানিটারি ন্যাপকিন ক্যাম্পেন।
এই ঘুর্নিঝড়ের চোখের ভেতর থেকে উঠে এল অলক্তিকা।
চাপা ঠোঁট, চাপা রঙ। পানপাতার মত মুখ। অদ্ভুত মনের জোর। যখন প্রথম ওখানে পড়তে যায়, পাড়ায় অনেক বন্ধু ছিল। পুরনো স্কুলের বন্ধুও।
একটু একটু করে পাড়ার লোক ওকে এড়িয়ে চলতে শুরু করল। তারপর পুরনো বন্ধুরাও খসে পড়ল। একদিন নিজের মত করে থাকতে থাকতে অলক্তিকা একটা আলাদা পৃথিবীকে ছুঁয়ে ফেলল। নিজের একটা জায়গা। চিন্তার জায়গা।
বাইরে অনেক শত্রু। বাবা মাও প্রথমে ওর পাশে দাঁড়ায়নি। পারবে কি করে। সিপিএম হলেও, ওদের চিন্তারও তো লিমিটেশন আছে।
মাঝে মাঝে ও বলে, তুমি কে হে, অলক্তিকা চক্রবর্তী। তোমাকে লোকে ভুল বোঝে বুঝবেই। তোমার ক্লাস নিয়ে ঠেশ দেয় টীকা টিপ্পনী কাটে। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং এ তোমাদের কথা শুনতে শুনতে কত লোক তোমাদের মত মেনে নেয় কিন্তু তার থেকেও অনেক বেশি নিন্দেতে মুখর হয় আরো অনেকে। বলে, এরা সব বড়লোকের বেটি। ছোট থেকে যা চেয়েছে পেয়েছে। আজ পশ্চিমি স্টাইলের গিমিক দিচ্ছে, চেষ্টা করছে সস্তা পাবলিসিটি পেতে যা খুশি তাই করতে।
হ্যাঁ হ্যাঁ, আমার মা বাবা দুজনেই শিক্ষিত। একজন অধ্যাপক, অন্যজন ইস্কুল দিদিমণি। মা আবার সি পি এম ও করে। একসময় কবিতা লিখত মা। সব কবিতার শেষে একটা লাল সূর্য উঠত পূর্ব দিগন্তে।
সেই অলক্তিকা খবরের শীর্ষে উঠে গেছে। ওর বাবা মা যা কোনদিন পারেনি। ভাবেনি। এবারও বাবা মা ভয় পেয়েছিল।
অলক্তিকার পরনে ওপরে ব্রাউন ঢোলা টি শার্ট, আর নিচে আরো বেশি ঢোলা, ছোট ছোট এথনিক প্রিন্টের সালোয়ার। গুজরাতি কাপড়। ঝলমলে।
ওর চোখে কাজলের রেখা বাদ দিলে আর কোন প্রসাধন নেই।
মাধবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের “হোক ঝঞ্ঝা” আন্দোলন। সেটাই অলক্তিকাকে তুলে দিয়েছে কোথায়। টিভির সব চ্যাট শো-এর সামনের সারির মুখ এখন ও। অসম্ভব ফোকাসড মেয়ে। খুব সোজাসাপটা স্পষ্ট করে বলে আর ভাবে। দেখতে সাধারণ, গোলগাল মুখ, মিষ্টিই বলা যায়। ঘাড় অব্দি চুল, একটা পনিটেলে বাঁধা। আলাদা করে ফ্যাশনেবল নয়, কিন্তু আলগা শ্রীর সঙ্গে সামান্য কাজলটানা দুটো কালো চোখ আছে।
“হোক ঝঞ্ঝা” শুরু হয়েছিল একটা স্পেসিফিক ঘটনা থেকে। বয়েজ হোস্টেলের কাছে একটা ফেস্টিভ্যালের সময়ে একটি মেয়ে মলেস্টেড হয়েছিল। উপাচার্য থেকে শুরু করে সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট কমপ্লেন্টস কমিটি কেউ সঠিক স্টেপ নেয়নি। কোন অ্যাকশনই হয়নি প্রথমটা। পরে, যখন কমপ্লেন্টস কমিটি বসল, অধ্যাপিকা সঙ্ঘমিত্রা সরকার, ইংরেজি ডিপার্টমেন্টের হেড, কমিটির চেয়ার পার্সন মেয়েটির বাড়ি গিয়ে বলে বসলেন, তুমি সেদিন কী জামাকাপড় পরে ছিলে? তুমি কি মদ্যপান করেছিলে? ওয়্যার ইউ আন্ডার এনি কাইন্ড অফ ড্রাগস?
মেয়েটি, মেয়েটির পরিবার অপমানিত বোধ করে। ভিক্টিমের চরিত্র হনন করে, ভিক্টিম অ্যাবিউজ করে, অপরাধের গুরুত্ব কমিয়ে দেওয়া পুরনো ট্যাকটিক্স। কলেজের ইঞ্জিনিয়ারিং এর ফাইনাল ইয়ারের ছাত্রদের কেরিয়ার বাঁচাতেই , কমপ্লেন্টস কমিটি এভাবে মেয়েটির ওপর কিছুটা দায় চাপিয়ে একটা হালকাফুলকা অভিযোগ লিখিয়ে অল্প শাস্তির মধ্যে দিয়ে ছেলেগুলোকে ছাড় দিয়ে দিতে চাইছে। ছাত্রছাত্রীরা এটাই বুঝল। আর ফেটে পড়ল হোক ঝঞ্ঝা।
সেই হোক ঝঞ্ঝা পুজো প্যান্ডেল থেকে শুরু করে মেলা, খেলার মাঠ অথবা যে কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে মিছিল অথবা স্ট্রিট কর্নারিং করেছে। অদ্ভুত এক উন্মাদনা ছেয়েছে ছেলেমেয়েদের মন।
ছাত্রদের মধ্য থেকে “আমরা বিপন্ন” নামে একটা গ্রুপ উঠে এসেছে অতি সম্প্রতি। অ্যান্টি স্টেট তো বটেই। অ্যান্টি এস্টাবলিশমেন্ট। মাধবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর মহীতোষ চ্যাটার্জিকে কেস খাইয়ে দিয়েছে এই “আমরা বিপন্ন”। ভিসি জানে না, এমনকি আচার্য স্বয়ং গভর্নর জানেন না, অধ্যাপকরাও জানে না, কেউ জানে না, এদের কী করে কনট্রোল করতে হয়। কী ভাষায় বললে ছেলেমেয়েগুলো বুঝবে।
তারপরই আবার মোলস্টেড হল স্বাতী। ওর ডিপার্টমেন্টে যদি মেয়েদের টয়লেট থাকত, ওর ডিপার্টমেন্টে যদি একটা স্যানিটারি ন্যাপকিন ডিসপেনসার থাকত, ওকে বেরোতে হত না। সন্ধে সাড়ে সাতটায় লাইব্রেরি ওয়ার্ক কমপ্লিট করে তারপর মেল হোস্টেলের চত্ত্বর পেরিয়ে ও ড্রাগস্টোরে গেছিল স্যানিটারি ন্যাপকিন কিনতে। ফিরে এসে বন্ধুদের সঙ্গে একসঙ্গে বেরোবে। এর ভেতরেই দুটো ছেলে বেরিয়ে এসে ওর সঙ্গে অদ্ভুত আচরণ শুরু করে, অদ্ভুত কথাবার্তা বলে। তারপর টেনে নিয়ে যেতে চায় সিঁড়ির নীচে।
নিজের ব্যাগ দিয়ে ওদের ঠেকিয়ে, কোনমতে পালিয়ে আসে স্বাতী। ফিরেই ডিপার্টমেন্টে ব্যাপারটা জানায়। ছেলেগুলোকে ও চেনেনা, কিন্তু আইডেন্টিফাই তো করানোই যেত। উলটে হেড ডিপ ব্যাপারটা চাপাচুপি দিয়ে দিতে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন।
তদ্ভব চট্টোপাধ্যায়ের কাছ থেকে এর বেশি আর কীই বা আশা করা যেতে পারে?
ইলাস্টিকের আনুগত্য
জীবন দুই ভাগে বিভক্ত । একভাগ ইলাষ্টিক আবিষ্কারের পূর্ববর্তী । অন্যভাগ ইলাস্টিক পরবর্তী ।
ঠিক যে রকম পেনিসিলিন । পেনিসিলিন আবিষ্কারের আগে দীর্ঘজীবন কেমন প্রায় এক অবাস্তব ঘটনা ছিল ।
সূতিকাগারে সদ্য মায়েদের মৃত্যু, যুদ্ধক্ষেত্রে সৈনিকদের আহত হাত পায়ের ক্ষত পেকে ওঠা ও পরবর্তীকালে “গ্যাংগ্রিন হয়ে” বা “সেপটিক হয়ে” কাটা যাওয়া, এবং যে কোন লোকের পুঁজযুক্ত ঘায়ে সেপটিক হয়ে মৃত্যু-কেমন সহজ ও সহনীয়, গ্রাহ্য ও গ্রহণীয় ছিল ।
পেনিসিলিন নাকি আবিষ্কার হয়েছিল পাঁউরুটির ছত্রাক থেকে । এই কথা বলে, ছোটবেলায় স্বস্তিকার মা ভুজুং ভাজুং দিয়ে অনেক সবুজ ছাতাপড়া পাঁউরুটি খাইয়ে দিতেন ওদের ।
স্বস্তিকা এখন রান্নাঘরে কাজ করছে। সকাল আটটা থেকে সাড়ে আটটার চাপটা নিচ্ছে। ঘামছে কুল কুল। পরনে ম্যাক্সি। ঢোলা ম্যাক্সি। আমরা যাই নি মরে আজো । তবু কেবলি দৃশ্যের জন্ম হয় । এখন বাড়ীর ঠিকে পরিচারিকাকে ফ্রিজে রাখা দু দিনের পুরোনো বাসী পাঁউরুটি দিলে , সে পিঠটা ফেলে দেয়, আর বাকীটা না সেঁকে মুখে তোলে না।
এখন আবিস্কৃত হয়েছে- পাঁউরুটির “ইউজ বিফোর ডেট” । ফরাসীদেশে রোজ যে পাঁউরুটি বানান হয়, তার ত্রিশ শতাংশ খাওয়া হয়, বাকীটা “ইউজ বিফোর ডেট” পেরিয়ে যাওয়ায় গাটারে ফেলে দেওয়া হয় ।
স্বস্তিকাদের ছোটবেলায় গাটার ছিল, গার্টার ছিল না । ওর একটিও ইজেরে গার্টার না থাকায়, প্রথম জীবনে স্বস্তিকার প্রতিটি জাঙ্গুর দড়ি হয় ভেতরে ঢুকে নয় আপৎকালে ঢিলে হয়ে গিয়ে তাকে বেদম অপদস্থ করেছে ।
অন্তত দশ বছর বয়স পর্যন্ত স্বস্তিকা জাঙ্গুর দড়িতে ঠিক মত ফস্কা গেরো দিতে শেখেনি । সর্বদাই গিঁট বেঁধে যেত এবং যখন প্রচন্ড বাথরুম পেয়ে গেছে তখন এই আবিষ্কার, যে দড়িতে গিঁট পড়ে গেছে।
এই ঘটনা তাদের পরবর্তী প্রজন্ম দেখেইনি। দেখেনি ছেলে টিন্টো বা ভাসুরপো অর্চি। দেখেনি অর্চির বান্ধবী সুনন্দনা।
মেয়েটা কবিতা লেখে, নাকি। অর্চি বলে। ইংরিজি অনার্স পড়তে অক্সফোর্ড যাবে। নাকি। অর্চি বলে।
জীবনে, সেই থেকেই স্বস্তিকার সব দড়িতে গিঁট পড়ে যায় । ফ্রয়েড সাহেব তো বলেই গেছেন- যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধে হয় , ইত্যাদি ইত্যাদি।
ঠিকঠাক ভাবে বলতে গেলে-ইজেরে ইলাষ্টিক ব্যাপারটি চালু হল, যখন স্বস্তিকাদের বয়স বারো তেরো । এর আগে, হয়ত বা মধ্যবিত্ত জীবনে ইলাষ্টিকময় ইজের ছিল না, ছিল অপেক্ষাকৃত উচ্চবিত্ত মহলে । যেমন ,যাঁরা নিউ মার্কেটে মানে হগের বাজারে রহমানের দোকানে মাসের বাজারটি করতেন ।
সেই সব দুর্লভ মহিলারা ন্যাকড়ার পুঁটলি ফেলে উচ্চ টেকনোলজির স্যানিটারি ন্যাপকিন এবং সন্তানের জন্য গুটিয়ে নেবে আসা অথবা দড়ি বাঁধা সুতির মোজা ও সুতির জাঙ্গিয়ার বদলে, ইলাষ্টিক যুক্ত মোজা, ইলাষ্টিক যুক্ত ইজের- এমনকি পৈতের জন্য পুত্রের জন্য ইলাষ্টিক যুক্ত ধূতির আমদানি করতেন, সে তো নিউ মার্কেট থেকেই।
বাবারে কি তাড়াতাড়ি আমরা ইলাষ্টিকের দুনিয়ায় প্রবেশ করেছি !!!!
ভাবতে ভাবতে স্বস্তিকা রুটিতে দ্রুত হাতে মাখন মাখায়। টিন্টোর রুটিতে। আর সোমদত্তর রুটিতে মেয়োনিজ। কারণ মাখন খেলে কোলেস্টেরল হবে। সর্বত্র পরিবর্তিত হচ্ছে তাদের খাদ্যাভ্যাস, পরিধানের অভ্যাসের মতই।
এখুনি সে ব্রা বিহীন ম্যাক্সিতে আবির্ভূত হচ্ছে সোমদত্তের খাবার দিতে। আর টের পাচ্ছে শ্বশুরমশাইকে ফিজিওথেরাপি করতে আসা প্রিয়নাথবাবু নামের ওই গপ্পুরে বৃদ্ধের চোখ সেঁটে গেছে তার বুকে।
আবার স্বস্তিকা ভাবছে, ইলাস্টিকযুক্ত ব্রা পরে থাকলে তার সকালে ঘামাচি বাড়ত। সারাদিন তো এমনিতেই পরে থাকা বাধ্যতামূলক। যখন সে বেরোবে, অফিস যাবে। কিন্তু এখন বাড়িতে, সে ঢিলেঢালা থাকতে চায়। যে ঢিলেঢালা, পুরনো সাহিত্যে, মেয়েদের বর্ণনায়, বিস্রস্ত বেশবাশ অথবা মদির চাউনি অথবা যৌবনের উচ্ছলিত বন্ধনহীন তরঙ্গের সঙ্গে অনুষঙ্গ রাখে।
নাঃ কাল থেকে ব্রা পরেই সকালে শোবার ঘর থেকে বেরোবে সে, এবং রান্নাঘরে ঢুকবে। সকালে এই বাইরের ঘরে এত্তো লোকটোক বসে থাকাকে সে একেবারেই পছন্দ করে না, কিন্তু বাবা মায়ের মালিশ দরকার, সোমদত্তের ওই বুড়োর পেপটক, কথাবার্তা হাসি ঠাট্টা সব্বার দরকার, তাই মেনে নিতেই হয়েছে।
সে তার চিন্তাকে ফের নিয়ে আসে ইলাষ্টিকের দিকে।
মাকে যদিও সে দেখেছে ইলাষ্টিক বিহীন ব্রেসিয়ার ব্যবহার করতে , কিন্তু স্বস্তিকাদের বড় হবার সঙ্গে সঙ্গে দুরু দুরু বক্ষে প্রবেশাধিকার ঘটেছে ওই আশ্চর্য লোভনীয় বস্তুটির জগতেই। সে অর্থে স্বস্তিকারাই প্রথম ইলাস্টিক পর্যায়ের লোক। হ্যাঁ, তারপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি। শুধু নব নব ধরণের ইলাস্টিক বস্তুর সঙ্গে সমঝোতার গল্প তৈরি হয়েছে।
এর পরের সমস্যাটা অন্য স্তরের। সমস্যাটা ঢিলে হয়ে যাওয়া ইলাস্টিকের । সম্পর্কের মতই, ইলাস্টিক বহু ব্যবহারের ফলে ঢিলে হয়ে যায়। তখন তাকে পরিত্যাগ করতে হয়। এই ঢিলে হয়ে যাওয়া আর পরিত্যাগের সময়কালের মধ্যে একটা ফাঁক থাকে, কে টেনে টেনে ফাঁকটাকে কতটা বড় করে তুলতে পারে, কে ইলাস্টিককে টেনে টেনে লম্বা করার মতই , ওই ঢিলে হয়ে গেছে-বোধের দিনটি থেকে আস্তাকুঁড়ে বিসর্জনের দিনটির দূরত্ব ক্রমেই লম্বা করতে পারে, সেটা একটা অন্য হিসেব, অন্য অঙ্ক। নির্ভুল অঙ্ক কষতে শিখে গেলে অনেকবার ভুল করা প্রয়োজন।
স্বস্তিকাকেও বহুবার ফিতে ঢিলে হয়ে জামা বা ব্লাউজের থেকে ফসকে গেছে, স্ট্র্যাপ বেরিয়ে থাকা ব্রা-এর কী ভীষণ নিষিদ্ধতা, আকর্ষণ এবং বিষণ্ণতা, তা যারা ঐ বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছে তারাই জানে।
আর একটা নতুন উপদ্রব ইতিমধ্যে ঘটে গেছে। স্যানিটারি ন্যাপকিনের মতই , ওয়াশিং মেশিনও মধ্যবিত্তীয় উপমাউপমানের মধ্যে ঢুকে পড়েছে তাদের যৌবনকালেই। যদিও হাতে গোণা পরিবারের স্বামীরাই, স্ত্রীর “আমার একটা ওয়াশিং মেশিন চাই, কাজের মেয়েটা বার বার অ্যাবসেন্ট করলে হাতের নড়া ছিঁড়ে যায় কাপড় কাচতে” জাতীয় বচন শুনে ওই ফাঁদে পা দিয়েছেন, এবং ঘর জোড়া জিনিসটি কিনেও শেষমেশ কাজের লোকের দয়ার ওপরেই মূলত নির্ভরশীল থেকেছেন, কারণ দেখা গেছে শাড়ি ব্লাউজ এবং ব্রেসিয়ার জাঙ্গিয়া ওয়াশিং মেশিনে ঢোকালেই ছিঁড়ে ফর্দাফাঁই।
আঁট আন্ডারগারমেন্ট এবং আঁট দাম্পত্যকে ভুল করে ওয়াশিং মেশিনের যাবতীয় হট কোল্ড হাই স্পিড নর্মাল বিবিধ সাইকেলের মধ্যে দিয়ে চালিয়ে দিলেই ইলাস্টিকের বারোটা বেজে গিয়েছে এবং সবকিছু ঢিলে হয়ে গেছে।
এই সমস্ত ঘটনাই স্বস্তিকাদের দিদার জীবনে ছিল না। দিদা বা মা চল্লিশ বছর বয়সে প্রৌঢ়া বা মধ্যবয়সিনী আখ্যা পেতেন এবং তাঁদের জীবনে আঁট আর ঢিলে নিয়ে মাথা না ঘামালেও চলুত। এখন আর চলে না। এখন সর্বদাই আঁট থাকতে হয় কিন্তু এই নিয়ে টেনশনে থাকতে থাকতে তাদের সবকিছুই ঢিলে হয়ে যাচ্ছে।
সাহিত্যিকদেরও অব্যাহতি ঘটেছে , সদ্য ঘুম থেকে ওঠা বৌদিদের শরীর কতটা আঁট আর বেশবাশ কতটা বিস্রস্ত এই নিয়ে আলোচনা থেকে। উলটে , সরাসরিই, বলে দেওয়া যায়, একটা মেয়ের শরীরের গড়ন, মেয়েটা ডবকা বলে ইশারায় সারতে হয়না। মেয়ে লেখকগুলোও তো দিব্যি লেখে আজকাল, দেখে স্বস্তিকা, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মেয়েরাই নাকি নিজের বালিঘড়ির মত ফিগার চেক করে নেয়। লেখে, স্তনের গড়োন ভাল রাখতে কী কী করা উচিত। মেয়ে পত্রিকা নামে যে সেমি পর্নোগ্রাফিক পত্র পত্রিকাগুলো বেরোয়ে, সেগুলোও এসব লেখে অবিশ্যি, আর তাদের পেটোয়া মেয়ে ও পুরুষ সাহিত্যিকরাও।
খাবার ঘরে এবার অর্চি আর টিন্টোকে ব্রেকফাস্ট দিয়ে দেয় স্বস্তিকা, সসেজ, ডিমপোচ, পাঁউরুটি। ডাক দেয় কড়া গলায়, এসে যাও, অর্চি। এসো টিন্টো।
তারপর , তার বুকের দিকে টানা একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকা গদগদ চেহারার প্রৌঢ় প্রিয়নাথের সামনে দিয়ে অলস মন্থর পদক্ষেপে বেডরুমে ঢুকে যায়। মনে মনে বলে, না আমি কুঁকড়ে যাব না চতুর্দশী মেয়ের মত, সদ্যযৌবনবতী ছুকরির মত, পাড়ার ছেলেদের টিটকিরি আর তাকানোর সামনে যেমন যেতাম।
আমি ইলাস্টিকের ভাল মন্দ দুইই জানি।
সকালগুলো আমার। তাই আমি ইলাস্টিকের প্রবেশ নিষেধ করেছি সকালে।
সে আপনি যতই তাকান। চোখ দিয়ে চাটুন।
প্রথমার রবীন্দ্রসঙ্গীত
প্রথমা ব্যাঙ্গালোর থেকে শিফট করবে কলকাতায়। কাজের অছিলা। কিন্তু সুস্নাত বুঝতে পেরেছে। বুঝেও উদাসীন।
উদাসীন নয় সুনন্দনা। মেয়ে কষ্টটা পেয়েছে ঠিকই। কিন্তু মাকে যেতে মেয়েই বেশি করে বলেছে। মা, এবার তুমি নিজের কেরিয়ারটা দেখ। দাদুর বাড়িটাও লুকিং আফটারের অভাবে নষ্ট হচ্ছে।
মনে মনে নিজেকে দশ হাজার বার বলে প্রথমাঃ সুস্নাত পর্ব ওভার হয়ে গিয়েছে ।
এক লাইনে লেখা খুব সোজা। আসলে নিজের কাছে নিজেই হেরে যাওয়ার ইতিহাসটা কুড়ি বছরের পুরনো হতে। নিজের কাছে বিষয়টা এখনো সমান দগদগে। সমান ব্যাথাতুর।
তবু বিচ্ছেদ হতই, সেটা গত মাসে একটা কাজের অফারের সঙ্গে সঙ্গে নির্ধারিত হয়ে গেছে। সুনন্দনার অনুমতি নিয়ে, সুনন্দনার বাবা মা আলাদা থাকবে, ঠিক হয়ে গেছে। সম্মতি দিয়েছে মেয়ে। কী অদ্ভুত। এই জিনিশও জীবনে হতে পারে, কোনদিন ধারণার মধ্যে আনা যেত দশ বছর আগেও?
সুনন্দনা নিজের ঘরেই আজকাল সারাদিন থাকে। খুব মন খারাপ করেই থাকে। তবে টুঁ শব্দটি করেনা। মায়ের চলে যাওয়ায় ওর রক্তক্ষরণের কথা মাকে বা বাবাকে জানতে দেয় না।
নিজেই বলেছে, নিজের খাবার তৈরি করে নিতে পারে সুনন্দনা এখন। দাঁতে দাঁত চেপে মেয়ে ইউটিউব থেকে ডাউনলোড করছে রান্নার রেসিপি।
আঠারো উনিশ বছরের একটি মেয়েকে আজকাল আর মায়ের আদর যত্ন দিতে হচ্ছে না। বরং মেয়েটি নিজের দিকটা নিজে দেখলেই মোর কমফর্টেবল। এরকম একটা কথা মেয়ে বলেছে, মাকে।
যাবার আগের দিন, প্রথমা গত এতগুলো বছরের মধ্যে এই প্রথম বার বার মাঝরাত্তিরে জেগে উঠেছে, আর নিজের একলা ঘরের বালিশ আঁকড়ে কেঁদেছে, বলেছে, সামবডি হেল্প মি। আমাকে কেউ আদর দাও। তারপর চোখ মুছে ঘুমিয়ে পড়েছে। কেননা, পাশ থেকে আদর করার লোক নেই। আর , সে তো স্বঘোষিত স্বাধীন মহিলা।
স্বাধীন মহিলা হবার দাম দেদার বিভ্রান্তি আর অনেকটা দমবন্ধকরা একাকীত্ব। এটুকু বুঝেছে। বার বার নিজেকে বুঝিয়েছে, আজ সুস্নাতর বন্ধুরা লাইন দিয়ে এসে ওদের বিবাহের বিফলতা নিয়ে টীকা টিপ্পণী কাটলেও, গত কুড়ি বছরই আসলে প্রথমা ছিল একা। তবে হ্যাঁ, জীবনে তথাকথিত সফল সুস্নাতর বাড়ি ঘরদোরের কমফোর্ট জোনের লোভেই সে ছেড়ে যেতে পারছে না এই সংসার, অথবা সুনন্দনা বড় হওয়া অব্দি অপেক্ষা করতে হয়েছে। যে কারণেই হোক, গত এতদিন ও নিজেকে ক্ষমা করতে পারেনি, এতদিন ও নিজেকে দুষেছে।
এখন নিজের মাথার ওপর থেকে উঠে গেছে অপরাধবোধের বিশাল বোঝা। অন্যরা এখন তাকে দুষুক যতখুশি। তার নিজের বিবেক পরিষ্কার।
প্রথমা দ্রুত নিজের জিনিশ গোছাচ্ছে, আর প্রতিমুহূর্তে মাথার ভেতর কাজ করে চলেছে এই সব যুক্তি, প্রতিযুক্তি। কথা, কথার বিপরীতে আবার কত কথা। বারান্দার গাছ ছেড়ে যাবার কষ্ট, নিজের অর্ধেক জামাকাপড় যা এতদিন ধরে জমা হয়েছে আলমারিতে, এগুলো ছেড়ে চলে যাবার কষ্ট, এগুলোও কম কষ্ট নয়, নিজের সম্পর্কগুলোকে ছেড়ে চলে যাবার কষ্টের থেকে। স্মৃতি, হ্যাঁ স্মৃতিগুলোকে ছেড়ে যাওয়াও কষ্ট খুব।
ও দু তিনটে স্যুটকেস গোছাচ্ছে। আর ঘরে টিভি চলছে।
টিভিতে পৃথিবীর নানা দেশের খবর দেখাচ্ছে। আল জাজিরা, বিবিসি দেখাচ্ছে, নাইজেরিয়ার ৩০০ টা মেয়েকে ইস্কুল যাওয়ার অপরাধে বোকো হারাম কিডন্যাপ করে নিয়ে গিয়ে হোস্টেজ করে রেখেছে। দেখাচ্ছে, ইউক্রেনের সবকটা শহরে রাশিয়া পন্থী আর ইউক্রেন পন্থীদের মধ্যে মারামারি হচ্ছে। আগুন, ধোঁওয়া, কিছু সাদা মানুষের লাশ। আচ্ছা, ওরা প্রথম বিশ্বের মত সাদা চামড়া, অথচ দ্বিতীয় বিশ্ব। এতদিন লৌহ কপাটের আড়ালে ছিল। এখন স্বাধীন , কিন্তু অর্থনৈতিক অবস্থা তৃতীয় বিশ্বেরই কাছাকাছি।
কী সুন্দর দেখতে ওরা।
কোনদিন সুন্দর দেখতে ছেলেদের সঙ্গে প্রেম করা হল না। মা খুব কড়া ছিল।
কিন্তু সুস্নাত যখন জীবনে এল, তখন মায়ের থেকে দূরে, অনেকটাই দূরে প্রথমা।
সুস্নাত সুদর্শন না হতে পারে, খুব শান্ত মিষ্টি আর মাটির মানুষ। চোখের রঙ কেমন? আগে বাদামি ছিল। অনেকদিন ঠান্ডা কুঁজোর জল খাওয়া হয়নি। এরকম এক তৃষ্ণা জাগত তখন ওর মনে।
দার্জিলিং এ প্রথম যখন আলাপ, তখন যেদিন সুস্নাত ফিরে যায়, আর প্রথমা থেকে যায়, সেই দিন ও মনে মনে একটা গান গেয়েছিল। মোহরদির গলায় শোনা সেই গান । তুমি যেও না এখনই, এখনো রয়েছে রজনী।
ফিরে এসে, কলকাতায় বার বার দেখা হয়েছে। একটা বৃষ্টিভেজা বিকেলে দেখা হয়েছিল ওদের কফি হাউজে। সারা গা থেকে টপটপ জল ঝরছিল সুস্নাতের। প্রথমারও। ওরা মুখোমুখি বসে কফি নয়, ইনফিউশন খেয়েছিল। সেদিন নিজেদের পছন্দ, অপছন্দ, ভাল লাগা, মন্দ লাগা, কাজের প্রেফারেন্স অনেক কিছু বলেছিল।
শুধু একটা জিনিশ বলতে ভুলে গেছিল প্রথমা। রবীন্দ্রসঙ্গীত । মনে মনে শুধু গান হচ্ছিল। এমনও দিনে তারে বলা যায়। এমন ঘনঘোর বরষায়।
একটা বিকেলে , প্রথম চুমু খাওয়ার দিন , সল্ট লেকের বনবিতানের কুঞ্জে। কুঞ্জটায় ঢুকে সুস্নাত বলেছিল, এখানে চুমু না খাওয়াটাই অশ্লীল।
সেদিন ওরা কেউ ফিরে যেতে চায়নি। কিন্তু আলটিমেটলি বাড়ি ফিরতে হয়েছিল। যার যার বাড়ি। ওরা ভেবেছিল, আর না, এবার পরস্পরকে ছেড়ে থাকব না আর। এবার বিয়ে করে নেব।
না, সেদিন রবীন্দ্রসঙ্গীত ভাবেনি প্রথমা। শুধু সুস্নাত, সুস্নাতর শরীর ভেবেছিল। আকুল হয়েছিল, আর ভেবেছিল, এখন তো ফিজিকাল রিলেশন করাই যায়। কিন্তু মা, মা-টা! আর ফেরার পথে ও ও ভেবেছিল , মাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার একটা জাস্টিফিকেশন হিসেবেই সুস্নাতকে আঁকড়ে ধরছে না তো?
মা কী বলবে, ভেবে একটু ব্যথা। অল্প। চিনচিন। জানত না তখনো, সামনে হিন্দি ছবির মত সিমেন্টের বিশাল দেওয়াল ভাঙার কাজ। কোন রবীন্দ্রসঙ্গীত যুঝতে পারে না যার সঙ্গে।
মা, মা-ও কি বুঝেছিল? তাকে ছেড়ে চলে যেতে চাইছে প্রথমা? তাই এত রেজিস্টেন্স? এভিডেন্স ছিল? ওর চাউনিতে, ওর ব্যবহারে? ওর অফিস থেকে ফিরেই বিস্কুট কিনে না আনতে চাওয়ায়? ময়দা ফুরিয়ে গেছে শুনে ঝাঁঝিয়ে ওঠায়? রোজকার থাকায়?
তারপর একদিন প্রথমার বাড়িতে সুস্নাত যায়, ওর মায়ের সঙ্গে কথা বলতে। মায়ের মুখ কঠিন হয়ে যায়। তখনো ঐ ঘ্যাম চাকরি পায়নি সুস্নাত। তবে পাওয়ার জুতো পরে। ওর সঙ্গে সুস্নাতর কোন এক বারে গিয়ে বিয়ার খাওয়ার ছবি মাকে ইতিমধ্যেই এক মাসতুতো দাদা দেখিয়েছিল।
প্রথমা এবার বিদ্রোহ করেছিল। ওর জীবনে বিদ্রোহের ওটা শুরুও না, শেষও না। সারাজীবনটাই বিদ্রোহের সঙ্গে ঘর করতে হবে, জানত না নিজের বিধির নির্দেশ, প্রথমা।
বিদ্রোহের অব্যবহিত ফল, মায়ের চোখের ওপর দিয়ে সুস্নাতকে নিজের সংরক্ষিত অঞ্চল, বাড়ির চিলেকোঠার ঘরটায় তুলে আনা। প্রথমবার শরীরী মিলন। কিন্তু শরীরী মিলনের দিন কোন আনন্দ পায়নি সুস্নাত। প্রথমাও। বড্ড তাড়াহুড়ো ছিল। আর ভুল করে প্রথমা বলেছিল, মা তোমার সম্বন্ধে কয়েকটা কথা জানতে চেয়েছে। তুমি রেগুলার ড্রিংক কর কিনা। ইয়ে, আমি জানতে চাইনি কিন্তু।
সুস্নাত গুম হয়ে গেছিল। বড্ড শান্ত আর ঠান্ডা আর মিষ্টি ছেলে ও। তাই আর কিছু বলেনি। শুধু উঠে, প্যান্ট পরে জিপ টেনে , শার্ট গায়ে গলাতে গলাতে বেরিয়ে যেতে চেয়েছিল। পথ আটকেছিল প্রথমা। প্লিজ , যেও না, প্লিজ। তোমাকে বলতে হবে না উত্তরটা। মাকে আমি বকে দেব। ম্যানেজ করে নেব। প্লিজ।
আমি মদ খাই গাঁজা খাই ব্রাউন সুগার নিই। আমি অনেক মেয়ের সঙ্গে প্রেম করেছি, শুয়েওছি। আজ আমার শোয়া দেখে বুঝতে পারলে না? মাকে বলে দিও।
সুস্নাত এরকমই । ঠোঁটকাটা, দুর্জনে বলে সৎ।
কিন্তু প্রথমাও তো নিজে এরকম। আর চেয়েওছিল এরকমই কারুকে।
কেঁদে ফেলেছিল। প্রথমা নিজের গরম অশ্রু চাটতে চাটতে, বলেছিল, যেও না।
রবীন্দ্রসঙ্গীত মাথায় বেজেছিল। তুমি যেও না এখনই।
আর একদিন বলেছিল প্রথমা। আমি কোনদিন তোমাকে ঠকাব না সুস্নাত, আমি কোনদিন তোমাকে ভাল না বাসলে বলে দেব আর ভাল বাসি না। কিন্তু এবারও সুস্নাত চলে যেতে চেয়েছিল। রেগে। ‘মামদোবাজি! আমি তোমার ব্যাপারে পোজেসিভ, জেনে রেখো। অন্য কোন ছেলে সিনে ঢুকলে কিন্তু খুন করে দেব। যতই আমি ঠান্ডা আর মিষ্টি হই না তোমার কাছে। এই একটা ব্যাপারে আমাকে তুমি এখনো চেনোনি।‘ আবার উঠে যাচ্ছে, আবার প্রথমা রাস্তা আটকেছিল। “যেও না”।
ব্যাগ কাঁধে সারা কলকাতা চষে চষে প্রেম করে ক্লান্ত হয়ে বিয়ে করেছিল ওরা। এই কয়েক বছরে দুজনেই দুজনের সঙ্গে মান অভিমান করেছে। কিন্তু অল্প। প্রথমার ভাল্লাগতো, “তোমাকে কিন্তু যে কোন সময়ে ছেড়ে চলে যেতেই পারি “ এটাই বলতে। আর শুনলেই রেগে উঠে যেত সুস্নাত।
কিন্তু বিয়ের পর থেকে ব্যাপারটা উলটে গেল। ঝগড়া শুরু হল । প্রথমা দেখল, সুস্নাত মোটেই পোজেসিভনেসটাকে দ্বিপাক্ষিক করতে চায়না।
সুস্নাতর ব্যাপারে প্রথমা কিছুতেই পোজেসিভনেস দেখাতে পারল না। প্রেম করতে করতে হাঁই হাঁই করে হাঁপাতে হাঁপাতে সুস্নাত বলত, তোমাকে সব দিতে পারি, সব দিয়ে দেব। কিন্তু আলটিমেটলি কিছুই দিতে চাইল না, মানে দিলেও, সেটা অন্যদের, নিজের বন্ধুদের, বাবা মাকে সবাইকে ভাগ করে দেবার পর যেটুকু উদবৃত্ত সেটুকুই। কীভাবে যে বিয়ের পর সব উলটে যায়!
তারপর পনেরো বছর কেটে গেছে। মিথ্যে কথা বলা খুব ভাল, খুব প্রয়োজনীয় দাম্পত্য জীবনে, কিন্তু তাও মিথ্যে কথা বলতে শেখেনি প্রথমা।
কিন্তু মিথ্যে বলতে তো শিখতেই হয়। পনেরো কুড়ি বছরটাও তো কম নয়।
কিন্তু তবু, প্রথমা, পনেরো বছরের দাম্পত্যে একবারও সুস্নাতকে ছেড়ে চলে গেল না। প্রথমদিকে রক্ত গরম ছিল বলে, বলত যাবে। যেতেও চেষ্টা করত, কিন্তু সুস্নাত জেনে গেছিল এগুলো ওর ফাঁকা আওয়াজ । তাই আর আটকাত না। রাখাল ছেলের বাঘ বাঘ চীৎকারের মত। তাই মান ভাঙাতও না। ক্লান্তভাবে বসে থাকত, প্রথমা রেগে “ছেড়ে চলে যাবার” ভাণ করত।
তারপর ও নিজেই তিনটে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গিয়ে আবার ফিরে আসত, তারপর সুস্নাতর গলা জড়িয়ে হু হু করে কাঁদত।
তখন কোন বাড়িতে থাকা হবে তা নিয়ে তুমুল খন্ডযুদ্ধ চলছিল, ওদের ভেতরে , তখন বহুবার প্রথমা খাটের প্রতিটি মশারির রড খুলে ফেলে দিয়েছে, আলমারির জামাকাপড় বার করে ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। সুস্নাত গুম হয়ে বসে থেকেছে।
প্রথমা ওর শ্বশুর শাশুড়ির ইন্টারফিয়ারেন্স সহ্য করতে পারেনি, তাই ও বেরিয়ে যেতে চেয়েছে। তারও চেয়ে যা খারাপ, প্রথমার আসলে কোন ধৈর্য নেই। তাই ও পারত না।
উল্টোদিকে, সেই ইগোটা প্রথমা দেখাতে পারেনি। যখন উঠে চলে যেতে চেয়েছে সুস্নাত। প্রথমা তখন , প্রতিবার দরজা আটকেছে। প্রতিবার ঝগড়া থামিয়েছে। প্রতিবার ক্ষমা চেয়ে নিয়েছে, বলেছে , যেমন ইতিহাসের নারীরা বলে, তোমার পায়ে পড়ি, রাগ কোর না! সব ঠিক করে দেব আমি, সব।
তুমি! তুমি, কী করতে পার প্রথমা। কী তোমার ক্ষমতা! কী তোমার এলাকা? এতটা কনফিডেন্স কোত্থেকে পাও যে সবকিছু তুমি ঠিক করে দিতে পার? কিচ্ছু পার না ঠিক করতে তুমি, বরং সব খারাপ করে দিচ্ছ প্রথমা, সব , সব খারাপ করে দিচ্ছ।
একটা সময়ে সুস্নাত আর প্রথমা দুজনেরই বয়স হয়ে যায়। ততদিনে গোধরা হয়ে গেছে, গুজরাত দাঙ্গা হয়ে গেছে। একটা সময় সুস্নাতর বি পি হয়েছে, প্রথমার সুগার। ততদিনে পশ্চিমবঙ্গে চৌত্রিশ বছরের রাজনৈতিক ফ্রন্টটির পরিবর্তন হয়ে গেছে।
জীবনে এসে গেছে স্মার্ট ফোন। আর, ধীরে ধীরে সুস্নাতর সঙ্গে ওর সম্পর্কটাও নিভে গেছে। পাকাপাকিভাবে মেনে নিয়েছে ওরা দুজনেই। একদিন হঠাৎ দুজনে দ্বিপাক্ষিকভাবে মেনে নিয়েছে এই নেগেটিভিটি ভাল নয়। এই ছটফটানি ভাল নয়। এভাবে পরস্পরের জীবনকে ক্ষতবিক্ষত করা ভাল নয়।
আরো নেগেটিভিটির জন্ম দেবার আগেই সুনন্দনাকে সাক্ষী রেখে ওরা আলাদা হয়ে যায়। ওদের ঝগড়া দেখলে আগে সুনন্দনা কেঁদে ফেলতে, ছোট্ট সুনন্দনা।
এখন আর কাঁদেনি।
মাকে বলেছে, মা, তোমার যদি মনে হয় ইউ আর কমপ্রোমাইজিং উইথ বাবা, তাহলে তুমি নিজের মত থাকো। আমার কোন আপত্তি নেই। তবে আমাকে তো এখন পাঁচ বছর ব্যাঙ্গালোরেই থাকতে হবে। লেট মি লুক আফটার বাবা। তুমি যাও।
কী শক্ত আমার মেয়েটা। প্রথমা আশ্চর্য হয়ে গেছে। আনন্দে বুক ফুলে উঠেছে। কষ্টে বুক ফেটেও গেছে।
সব স্মৃতিকে, ভুলভাল ওই সম্পর্কটার সব পিছুটানকে দূরে সরাতে সরাতে, কষ্ট পেতে পেতেও, কলকাতায় ফিরে এল প্রথমা। মায়ের বাড়িতে গিয়ে দেখল বাড়িটা মায়ের মৃত্যুর পর কীভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। খুব কষ্ট হল, ভীষণ কষ্ট। তারপর আবার মানিয়ে নিল নিজেকে। টুকটাক রিপেয়ার করে থাকাও শুরু হয়ে গেল ওখানেই।
নিজের চেতনার আনন্দ যতটা পারা যায় খুঁড়ে তুলল। ঝড়ঝাপটার এই পর্ব একদিন কেটে যাবেই।
ভেবে দাঁতে দাঁত চেপে আবার নিজেকে স্থিতু করল, কলকাতার পুরনো পরিচিতিগুলোকে জাগিয়ে তুলল।
আবার গেল মাধবপুর। নিজের পড়াশুনোর আলমা মাতের, স্মৃতিমধুর আশ্রমের মত সেই জায়গাটায়। ফিরে গেল, কিন্তু এই গত কয়েকবছরে সব কিছু পালটে গেছে। তার মাধবপুরও গেছে । প্রথমার মনে হল অন্যরকম হয়ে গেছে আবহ। আর, এতদিন ব্যাঙ্গালোরে সুস্নাতর দামি চাকরি বিশাল ফ্ল্যাট, ওর নিজের এন জি ওর অন্যধরণের কাজ কর্ম করে ওর কলকাতার বাজারে খুঁটে খাওয়ার ক্ষমতা চলে গেছে।
যা পাওয়া যায় তাই সই, বলে ও মানবী বিদ্যাচর্চা কেন্দ্রের ডকুমেন্টেশনের কাজে ঢুকে পড়ল। ধাঁ করে।
টালমাটাল তরণী ধীরে ধীরে ঠিক হবে। মৃদু বাতাস বইবে আবার। সেই আশা, আস্থা নিজেকে দিতে চাইল।
রাত্রিবেলা সুনন্দনার সঙ্গে স্কাইপে আড্ডা দেয়। আর সকালটা লেখালেখি করে। দুপুরে অফিস যায়।
যে কোন গাড়িঘোড়ায় ,ওয়াশিংটন ডিসি থেকে কলকাতা, লন্ডন মেট্রো থেকে হাওড়া হাবড়া লোকালে, পরিপার্শ্ব ভুলতে আজকাল স্মার্টফোণ বার করে ইয়ারফোন কানে ঠুশে, বসে পড়ে সবাই। মাধবপুর যাবে বলে, অটোতে উঠেই, কানে গান গুঁজে অফিসের পথে অটোতে উঠে প্রথমা হঠাৎ খেয়াল করল, ও আবার রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনা শুরু করেছে।
রবীন্দ্রসঙ্গীত ও স্টুডেন্ট লাইফে শুনত। বিয়ের পর থেকে ওর রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনা বন্ধ হয়ে গেছিল পুরোপুরি। তারপর থেকে আজ অব্দি কখনো শোনেইনি গানগুলো।
কী যে হয়েছে প্রথমার, ও এখন রাশি রাশি এম পি থ্রি লোড করছে ফোনে, আর শুনছে।
হঠাৎ খেয়াল করল, ঠিক পনেরো থেকে কুড়ি বছর ও রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনেনা। হ্যাঁ সুস্নাতর সঙ্গে তো ওর কুড়ি বছরেরই আলাপ। সেই যে, দার্জিলিং এর ম্যালে আলাপ।
সুস্নাত, শান্ত , শিষ্ট, নরম ছেলে। ম্যাচো নয়, বড্ড ঠান্ডা ঠান্ডা ও। শুধু রবীন্দ্রসঙ্গীত ভালবাসত না , ক্ল্যাসিকাল হিন্দুস্তানি বেশি ভাল বোঝে বলেই, ওর জানত, রবীন্দ্রসঙ্গীতের পুরোটাই লিরিক, কোন গানই না ওটা, কোন সুরই নেই ওতে। ন্যাকামি করে চিবিয়ে চিবিয়ে গানগুলো শোনে কী করে লোকে!
তারপর থেকেই প্রথমাও তো হাসত, রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনলে ওরও তো হাই উঠত। আজ আবার শুনছে। এই রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনা ফিরে এল সুস্নাত জীবন থেকে বেরিয়ে চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই।
ও ভুলেই গেছিল, রবীন্দ্রসঙ্গীত ভালবাসে ও।
প্রতিবাদের রঙ পালটায়
প্রতিবাদের কোন জাত হয়না।
প্রতিবাদের কোন সময় হয়না।
প্রতিবাদ প্রতিবাদ। প্রতিদিন নতুন করে প্রতিবাদের জায়গা তৈরি হয়। প্রতিদিন আবার, একের পর এক ঘটনা সাজিয়ে তোলে প্রতিবাদের ছক। ছবি। নকশা।
কিন্তু অলক্তিকার দাদু , আটাশি বছরেও দুমড়ে না যাওয়া, অ্যাকটিভ দাদু, নীলমণি চট্টোপাধ্যায়? তাঁর প্রতিবাদের রঙ গেরুয়া কেন ?
নীলমণি সকাল সন্ধে জপ করেন , হরিনামের মালার বদলে, গান্ধী পরিবারের কেলেংকারির গল্প। সেই পুরনো বস্তাপচা গল্প শুনে শুনে কান পচে গেছে সবার। কিন্তু সেগুলোই তিনি বলে যাবেন। কেননা, কেননা, অলক্তিকা জানে, একটা ব্যক্তিগত ঘটনার অভিঘাত থেকেই গেছে নীলমণির অস্তিত্বের ভেতরে। দেশভাগ।
তাই নেহেরুর কেচ্ছা। ইন্দিরা গান্ধীর চরিত্রহনন। শুনতে জঘন্য লাগত একসময় অলক্তিকার। দাদু বিজেপিকে সমর্থন করে। দাদুর বাবা, ভারতীয় জনসংঘের মেম্বার ছিলেন। কলকাতার নামী অধ্যাপক। অসংখ্য বই লিখেছিলেন। সেই ভদ্রলোক, হারীত চট্টোপাধ্যায়ের জীবন ছিল সোজাসাপটা। ধুতি আর কেডস পরে পুরো কলকাতা চষে বেড়াতেন, বই দিয়ে ঘেরা একটা ছোট স্টাডি রুম, তার বড় সেক্রেটারিয়েট টেবিলের চারধারে চেয়ার পাতা। সেই ঘরটিতে বসে বসে দেশোদ্ধারের চিন্তা করতেন। দু বার ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন, জনসংঘের হয়ে। একবার এম পি হয়েছিলেন, অন্যবার জামানত বাজেয়াপ্ত হয়।
সেই হারীত পুত্র নীলমণি ষোল বছর বয়সে দেশভাগের তাপ গায়ে মেখে বরিশাল থেকে কলকাতায় ফিরে আসেন। চোখের সামনে দেখেছেন কলকাতার ছেচল্লিশের দাঙ্গা। দেখেছেন লাশ ভর্তি ঠেলাগাড়ি। রাজাবাজারে ওরা যে ভাড়াবাড়িতে এসে উঠেছিলেন, তার চারদিকে মুসলমানদের পাড়া, ঘুম ভাঙে আজানের শব্দে। সেই দু চারটে হিন্দু পরিবারকে আড়াল করে, তিনটে ব্যারাক প্যাটার্নের বাড়িঘেরা একটা চার চৌকো ইঁট বাঁধানো উঠোন ছিল। আর কিছু ছিল না। সরু গলির মুখ দিয়ে ঢোকা বেরোন। সেই গলির মুখের লোহার গেটে তালা দিয়ে বাইরে বসে ছিল সুলতান মিয়াঁ। সেই দারোয়ান। সেই রক্ষক।
নীলমণি আর বাকি তরুণ তরতাজা ছেলেরা দাঙ্গাবাজ মুসলিমদের ঠেকাতে অস্ত্র জোগাড় করছিল লুকিয়ে। আর তাদের মা দিদিমা জেঠিমা মাসিমারা ছাতে ইঁটের টুকরো জমা করেছিল। ঝাঁটা, লাঠি, বঁটি গুছিয়ে রেখেছিল।
এইসব গল্পই অলক্তিকা শুনেছে ছোটবেলায়।
দগদগে ক্ষতের মত ছেচল্লিশের দাঙ্গার স্মৃতি বহন করে দাদু বুকের খাঁচায়। দ্যাট ইজ এ ফ্যাক্ট। কিচ্ছু বলার নেই।
সেই দাদু, যে দু তিনবার দিনে ইসলাম সম্বন্ধে নানা রকম কটুকাটব্য না করে ভাত খায়না, সেই দাদুই বলে, সেবার সুলতান মিয়াঁ গলির গেট বন্ধ করে না রাখলে আমরা সবাই মারা যেতাম। দাঙ্গাবাজদের কাছে খবর ছিল, ভেতরে কয়েক ঘর হিন্দু পরিবার আছে। তবু সে গেট খোলেনি। ওদের ঠেকিয়ে দেয়।
সে পাড়ায় বড় রাস্তা দিয়ে ট্রামগাড়ি গেলে বাড়িঘর ঠক ঠক কাঁপত। প্যারামাউন্ট সিনেমার পাশে সেই বাড়ি এখন ভেঙে দশ তলা টাওয়ার উঠেছে। এককালে রাজাবাজার অঞ্চলের ওই পাড়াটায় থম থম করত দাঙ্গার গল্প। এখন ভাবা যায়না।
দেশভাগ, যাকে দাদুরা পার্টিশন বলে ডাকে, সেটার জন্য দাদুদের জীবনগুলো অন্যরকম হয়ে গেছিল বলে দাদুরা আড়ালে তরোয়াল খেলা প্র্যাকটিস করত। দাদুরা দেখেছিল ট্রেনে চেপে এ পারে আসা মেয়ে মদ্দের ঢল, শেয়ালদা স্টেশনে। দেখেছিল উড়ে যাওয়া পুড়ে যাওয়া মানুষের দলকে। শুনেছিল ট্রেনে চেপে আসা কাটা নারীস্তনের থলের গল্প। হরর স্টোরি।
দাদু নাকি লুকিয়ে তিনচারজন মিলে প্র্যাকটিস করত তরোয়াল চালানো, লাঠি চালানো। সেবার একটা প্র্যাকটিকাল কিছু না হলে নেহাত হচ্ছে না বলে, হাতের কাছে কিছু না পেয়ে একটা বেড়ালের গলা কেটেছিল। রক্তদর্শন করা প্র্যাকটিস করছিল বলে, পোষা মেনিবেড়ালের হত্যা।
অলক্তিকার বাবা মা বড় হয়ে উঠেছিল বাম আন্দোলনের বাতাসে।
এক পরিবারে তিন প্রজন্ম তিনরকম ভাবে দেখেছে প্রতিবাদকে। লড়াইকে।
অলক্তিকার প্রথম প্রতিবাদ, কলেজের দরজায় একটা পোস্টার সাঁটানো। দেখে বাবার বন্ধু ক্ষিতি জ্যাঠা নাক কুঁচকে বলল, তুই এসবের কী বুঝিস? তোদের এখনো গাল টিপলে দুধ বেরোয়। এই তো সেদিন জন্মালি। পুরোটাই তো আফটার লিবারালাইজেশন। আফটার মার্কেট ইকনমি। মোবাইল ফোন, ভার্চুয়াল, ফেসবুকে জনজাগরণ! ছোঃ।
বাবা মা চুপ করে থাকে। বোঝে কিন্তু কিছু বলে না। নিজেরা নিজেদের স্টুডেন্ট লাইফে এস এফ আই করেছে বলেই বলেনা। পরিবর্তনের পর নেহাতই থমকে গেছে ওদের চিন্তা। চাপা আক্রোশ নতুন জমানার বিরুদ্ধে, তাই।
অলক্তিকার প্রতিবাদের পাশে দাঁড়াচ্ছে ঠিক বলা যায় না। তবে হ্যাঁ, বাধা দিচ্ছে না। ভয় পাচ্ছে, কিছুটা বুঝতে না পারার ব্যাপারও আছে।
অলক্তিকাও তো হোক ঝঞ্ঝার সময় থেকে ছ মাসের মাথায় টের পেল, আদতে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল স্টুডেন্ট হোস্টেলে একটা মেয়ের মোলেস্টেশনের ইশ্যু থেকে, তা থেকে কেমন নিপাট সরে গেছে মাধবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের লড়াইটা।
লড়াই সরে গিয়ে এখন উপাচার্য হটাও। লড়াই সরে গিয়ে এখন স্টেট গভর্নমেন্টের বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপারে নাক গলানোর বিরোধিতা। এই বিরোধিতাটাও জরুরি। প্রতিবাদ জারি রাখা জরুরি। বোঝে অলক্তিকা।
কিন্তু মূল ইশ্যু টার কী হল?
মূল ইশ্যুটা তো ছিল মেয়েদের , ছাত্রীদের নিরাপত্তা। বিশাখা নির্দেশিকা অনুসারে কমপ্লেন্টস কমিটি গঠন। অথচ নামমাত্র যে কমপ্লেন্টস কমিটিকে দেখা গেল তারা তো কেবল ধামাচাপা দিতেই ব্যস্ত। কীভাবে বাঁচানো যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি। কীভাবে চুপ করিয়ে রাখা যায় মেয়েদের বিষয়গুলো। কেননা, মেয়েদের বিষয় মানেই অশ্লীল বিষয়। ট্যাবু বিষয়। মেয়েদের বিষয় মানেই, কতগুলো অস্বস্তির বিষয়। যেগুলো নিয়ে কথা বলতে গেলে স্যারেদের গলা শুকিয়ে আসে। চোখ তুলে তাকাতে অসুবিধে হয়।
সম্মান ও লজ্জা
“মহিলাদের ক্ষেত্রে “সম্মান” ও “লজ্জা” এই দুটি শব্দই একে অপরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। সভ্যতার ইতিহাসে বহুযুগ ধরেই নারীর শরীর, ব্যবহার অথবা তার চিন্তাকে লজ্জা ও সম্মানের গন্ডির মধ্যেই আবদ্ধ করে রাখার চেষ্টা করে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। নারিদের চলাফেরা, জীবনযাপনের স্বাধীনতা, ভাবপ্রকাশ এবং যৌনতার উপর এই সমাজ কাঠামো বিভিন্নভাবে তার নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে চায়। যারা এই প্রথাগত ধযান ধারণার বাইরে গিয়ে ভাবতে চায় তাদের উপর নেমে আসে খোলাখুলি বিভিন্নরকম পুরুষতান্ত্রিক আক্রমণ।
একদিকে যখন বিজেপি সরকারের “স্বচ্ছভারত” অভিযান চলছে, তখন গ্রামীণ ভারতে ৭৫% মহিলা তাদের প্রাথমিক স্বাস্থ্য এবং ঋতুচক্রকালীন প্রয়োজনীয় শারীরিক যত্ন সম্পর্কে একেবারেই অবগত নন। ২৩% গ্রামীণ মেয়ে বিদ্যালয়গুলিতে যথাযথ বাথরুমের অব্যবস্থার জন্য তাদের ঋতুচক্র শুরু হবার পর বিদ্যালয়ে পড়াশুনা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।
মাসিক বা পিরিয়ড শুরু হওয়া সমাজের চাপে বাড়ির চাপে একটি মেয়ের কাছে দুঃস্বপ্নের মত হয়ে দাঁড়ায়। লজ্জা ঢাকতে তাকে কালো প্যাকেটে মুড়ে স্যানিটারি ন্যাপকিন দেওয়া হয়। আবার এই পুরুষতান্ত্রিক নিয়মই ঠিক করে দেয় কোথায় একজন মহিলার ‘সম্মান’ ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। একজন মহিলা যখনই দাবী করেন যে তিনি যৌন নিগ্রহের শিকার হয়েছেন সঙ্গে সঙ্গে তার কন্ঠস্বর দাবড়ে দিয়ে বিপরীত দিক থেকে তাঁর দিকে উঠে আসে অনেকগুলি বিরুদ্ধতার আঙুল – “মেয়েটি কি ঠিকঠাক জামাকাপড় পরেছিল?” “মেয়েটি কি মদ্যপ ছিল?” “মেয়েটি কি কোন পুরুষের সঙ্গে ছিল?’ “মেয়েটির কি কোন অসৎ উদ্দেশ্য ছিল?”
এই ধরণের প্রশ্ন নিয়ে আমরা নিজদের পরিচিত মহলে সালিশি সভা করতে বসে যাই। আমরা ভুলে যাই আমাদের এই ধরণের অমানবিক এবং পুরুষতান্ত্রিক মন্তব্য নিগৃহীতার উপর কতটা মানসিক চাপ সৃশটি করে এবং সামগ্রিক পরিস্থিতিকে তার জন্য আরো প্রতিকূল করে তোলে। ঠিক একইভাবে ক্যাম্পাসে নীতিপুলিশই ঠিক করে দেয়, যে ক্যাম্পাসের ছাত্রীদের ব্যবহার ঠিক কেমন হবে। নিগৃহীতাকে এই ভাবে বারে বারে দোষী প্রমাণ করার চেষ্টা আমরা ক্যাম্পাসে, পরিবারে, সংগঠনে বহুসময় দেখি, অবশ্যই এটি একধরণের “ ভিক্টিম ব্লেমিং”। সত্য ঘটনা যাচাই করা আমাদের কাজ নয়। বরং চলুন, এই সম্মানের সংস্কৃতি, লজ্জার সংস্কৃতি এবং ধর্ষণ-এর সংস্কৃতির বিরুদ্ধে একজোট হই। এই ক্যাম্পাসটিকে লিঙ্গবৈষম্যহীন করে তোলার দিকে আরো এক পদক্ষেপ নিই।
এই লেখাটা অলক্তিকারা সবাই মিলে ড্রাফট করে একটা সাদা কাগজে ছেপে ফেলেছে। ছেপে লাগিয়ে দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের এদিক সেদিক। এটা স্যানিটারি ন্যাপকিন ক্যাম্পেনের কয়েকদিন পরের ঘটনা।
তার আগে পিছে আরো অনেক কিছু ঘটেছে। লিফলেটগুলো বিলি করতে করতে ওরা নানারকম মানুষের প্রতিক্রিয়া পেয়েছে। মন্দ অনেক, ভালোও অনেক। কাগজে কাগজে পোস্ট এডিট লেখা হয়েছে অনেক এই বিষয়টা নিয়ে।
এমনকি ঘটনাটাকে ল্যাম্পুন করে, ফেসবুকে একটা কবিতা লেখা হয়েছে, বার বার শেয়ার হয়েছে যাঃ
কেন এত ঢাক-ঢাক গুড়-গুড়, যৌনতার মত
প্রাকৃতিক বিষয়ে? — বলে, মাধবপুর! কী বলব তাকে?
— দেব ধিক্? ...লাভ নেই!--অর্ধশতাধিক বছর,
কাটিয়ে, ত দিলেম! --দেখলাম, বাড়েই, ধিক্-ধিক্
আঁচটি—ধিক্কারে—‘শেম্ শেম্’! --কমে না।–
— যেমন, আলোচনা যত হয়, নিয়ে যে-বিষয়
— বাড়ে সেটা!—ধর্ষণ, দেখছ না, ক্রমবর্ধমান!
— সুনিশ্চয় জেন, এ ধর্ষণবিষয়ক আলোচনা-সমালোচনারই সুফল!
— চাইছ কি, আরও হোক্, মর্দন, মলেস্টেশন্, নারী?
... তবে আরও স্যানিটারী ন্যাপ্কিন্ টাঙাও, নিশান!
— রক্তমাখা! খ্যাপাও, ষণ্ডকে!
— রাত-দিন! ডাক’ মাছিদলে!
— সব ঢাকা আজাড়িয়ে!--গোপন পাত্রের!
— অন্ধকারে সঞ্চিত মধুর! --মাথা খাও, তরুণ ছাত্রের!
...কোথা মধু?—হায়!—ভেলি-গুড়!..
এই লেখাটা লিখেছেন নির্বাণ লাহিড়ি ।
চার পাঁচদিন পর, ‘দিশা’ নামে যে বাজারি পত্রিকাটা নিয়মিত মেয়েদের স্তন সুন্দর করে তোলার টোটকাটা, ফর্মুলাটা, এটা,সেটা, ছাপে, তাদের একটা পুরস্কার সভা ছিল, কলকাতার সবচেয়ে দামি হোটেলের বলরুমে।
বলরুমে সাজসজ্জা, আলো, সব থমথম করছিল সেই মহতী সভায়। বাংলা সংস্কৃতির প্রবলতম শক্তির দাপটে নীরব হয়ে গেছিল এসি-র গুনগুনও।
অসংখ্য উপস্থিত অতিথি সকলেই বাংলার ক্রিম অফ সোসাইটি। মহার্ঘ শাড়ির খসখস , ভাল খদ্দরপাঞ্জাবির রঙ আর ধবধবে ধুতি ও পাজামার ঝলক। সব নিয়ে, জমজমাট।
সাংস্কৃতিক জগতের মানুষরা সেদিন স্থির শান্ত ও নীরব হয়ে শুনছিলেন বক্তৃতা। সেই বক্তাও এক বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের পন্ডিত মানুশ। এই বৃহৎ কর্পোরেট কাগজের অনুষ্ঠানে ডাক পেয়ে অত্যন্ত সম্মানিত।
কিন্তু দুঃখের বিষয়, সে বক্তা তৈরি করে এনেও, ভুলেই গেলেন পুরস্কৃত বইটি নিয়ে কথা বলতে।
বইটি সত্যি অর্থে অনন্য। এই প্রথম বাংলায় বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সেক্সুয়ালিটিকে দেখার ইতিবৃত্ত লেখা হল। সেদিনের পুরস্কার সভায় যিনি সভাপতি তিনি কিন্তু বইটির কথা বলতে ভুলেই গেলেন। তিনি খুব বিচলিত ছিলেন নিশ্চয়ই।
কী নিয়ে বিচলিত ছিলেন তিনি?
মাধবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যানিটারি ন্যাপকিন ক্যাম্পেন নিয়ে।
তাই তাঁর বক্তৃতায় নিন্দা উঠে এল। বললেন, আজকের প্রজন্ম কেন যেন মেতে উঠেছে এমন এক প্রতিবাদের ভঙ্গি নিয়ে, যা সে যুগের ইয়াং বেঙ্গলের গোমাংস আর গো –অস্থি ছোঁড়াছুঁড়ির চেয়েও বেশি তাজ্জব করে দেবার মত। আসলে লোকের চোখে পড়ার দৌড়ে, এই যুগের বিপথগামী তরুণ তরুণী, স্যানিটারি ন্যাপকিনের মত গোপন বিষয়কেও সর্বসমক্ষে তুলে এনেছে। কী প্রমাণ হয় এ দিয়ে? কিচ্ছু না। কিচ্ছু প্রমাণ হয়না এ দিয়ে। যে দেশের অগণিত সাধারণ মানুষ অন্ন সংস্থান করতে পারেনা, তাদের স্ত্রীদের হাতে স্যানিটারি ন্যাপকিন তুলে দেবে কী করে?
এই অগণিত মানুষের কথা না বলে, কিছু ধনীপুত্রকন্যা মহার্ঘ স্যানিটারি ন্যাপকিনের আদ্যশ্রাদ্ধ করছে।
আমি শুধু বলি, ছিঃ।
নেমে গেলেন বক্তা। ভুলে গেলেন পুরস্কৃত বইটির কথা বলতে।
ঘরশুদ্ধু লোক নীরবে দীর্ঘশ্বাস মোচন করল। কেননা এখানে শব্দ করা, হাসা, হাই তোলা বা বায়ুনিঃসরণ করা অসাংস্কৃতিক হবার লক্ষণ।
কেউই লক্ষ্য করল না যে এমন এক স্যানিটাইজড , নির্বীজীকৃত পরিমন্ডলে, সম্মানিত সভাপতি নিজেই নিন্দা করতে গিয়ে “স্যানিটারি ন্যাপকিন”এর মত এক নিষিদ্ধ শব্দ উচ্চারণ করে ফেললেন।
তারো দিন কুড়ি পরে, আর এক বিখ্যাত কবি মলয় রায়চৌধুরী একটি কবিতা লিখলেন , এবং ফেসবুকে এটিও পোস্ট করলেনঃ
"স্যানিটারি ন্যাপকিন"
ভালোবাসা ওই মেয়েটির মতো যার
স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল ; মাসে
সাড়ে তিন দিন কাপড়ে শুকনো ঘাস
বেঁধে, পরে থাকতে হোতো ; বর্ষায়
ঘাস তো সবুজ, তখন কাপড়ে ছাই
মুড়ে, রক্ত শুষে রাখবার তরকিবে
চুপচাপ বইহীন একা বসে থাকা ।
পুরুষতন্ত্রের ছ্যাঁকা
সোমদত্ত, মাথার মধ্যে কে যেন বলে। শরদিন্দুর গল্পও অ্যান্টি মহিলা! শেষ অব্দি এও দেখতে হল। পড়তে পড়তে বুঁদ হয়ে যায় ও। এখনো। বিশেষত পঞ্চম ষষ্ঠ খন্ড। উফফ। লোকটার লেখার গ্রিপ, তার প্রসাদগুণ, তার টেনে রাখা, এত আমোদের ভাষা। আর সেই লেখাতেও ওরা আজকাল, পলিটিকালি ইনকারেক্ট খুঁজে পাচ্ছে।
একটা নির্মল রসিকতাতেও পলিটিকালি ইনকারেক্ট। কালে কালে কতই দেখব , মা! মা গো!
এখুনি এক প্রস্থ হয়ে গেছে। কে যেন তার স্ত্রীকে সুগার বলে, কে যেন তার স্ত্রীকে হানি। ডার্লিং । কতকিছু। সোমদত্ত শুধু মাঝের থেকে বলেছিল, গুড়ের নাগরির মত চেহারা। কোন মহিলা সম্বন্ধে। শুনেই তেড়েফুঁড়ে উঠেছিল স্বস্তিকা । উফফ।
সোমদত্ত আজ বাড়িতে। স্বস্তিকাও আজ বাড়িতে। না তাদের জীবনে কোনদিন নির্বিকল্প আনন্দের নয় আবার নির্বিকল্প দুঃখও সে অর্থে নেই। একধরণের পিছল ছিরকুটে দাম্পত্য তাদের।
ছুটির দিনে বাড়িতে থাকলে দুজনে ঠোকাঠুকি লাগে।
সোমদত্ত দেখে, স্বস্তিকা সারাদিন ফোনে থাকে।
স্বস্তিকা দেখে সোমদত্ত সারাদিন নেটে থাকে।
একটা বিজ্ঞাপন বেরিয়েছিল কোন এক ফোন কোম্পানির। সার্ভিস প্রোভাইডার । মোবাইল ফোনের। দেখিয়েছিল, নায়িকা শ্রীলেখা কথা বলেই চলেছে বলেই চলেছে, কাজ করছে, কথা বলছে, হুশ হুশ করে পাখি তাড়াচ্ছে। জল ঢালছে। কথা বলেই চলেছে ফোনে বিরামহীন। এই মোবাইল ফোন কাঁধ আর কানের মাঝখানে চাপা চেহারা , মেয়েদের, কথা বলতে বলতে রান্না করা, টিভির ভল্যুম অফ করা, জানালার ঝুল ঝাড়া, কাক তাড়ানো সবটাই সবার চোখে এতটাই চেনা হয়ে গেছে যে শ্রীলেখার ঐ বিজ্ঞাপন খুব হিট হয়ে গেছিল।
এখনো স্বস্তিকার দিকে তাকিয়ে সোমদত্ত ওই সিন্ টাই দেখছে। পাখি হুশ। পাখি তাড়াচ্ছে স্বস্তিকা জানালার বাইরে। ঝুল ঝাড়ু হাতে , মাথায় রুমাল বেঁধে , চুলে একগাদা লালচে হেনা করা মধ্যবয়সী স্বস্তিকা।
মধ্যবয়স চেপে রেখেছে সে, চুলে রঙ করে , স্পঞ্জ ইলাস্টিক স্প্যানডেক্স, ছোট হাত টাইট জামা ইত্যাদি ব্যবহারযোগে। আর কথা বলে চলেছে মাদ্রাজিদের মত গলগলিয়ে, সেটা চেপে রাখতে পারছে না মধ্যবয়সের বাক্যবাগিশ অবস্থা। সবকিছু বলে ফেলতে হবে এই বাধ্যবাধকতা যেন তার। সময় ফুরিয়ে আসছে তাই সবটা বলে ফেলা দরকার। এত তাড়া।
স্বস্তিকা কথা বলছে প্রথমার সঙ্গে। সেই প্রথমা, যে ব্যাঙ্গালোরে ছিল। সুস্নাত আর প্রথমার বিয়ে প্রায় ভঙ্গুর কাচের বাসন। এই ভাঙে তো সেই ভাঙে। সেই চলল । গত কুড়ি বছর। এখন প্রথমা কলকাতায় চলে এসেছে। এটা একটা কারণ হতে পারে।
প্রথমার মেয়ে সুনন্দনা আবার কিছুদিন লটকেছিল অর্চির সঙ্গে। শেষমেশ দুবাড়ির লোকেদের প্রভূত নাচিয়ে ওদের ওই প্রেমপর্ব, মানে অ্যাফেয়ার, ব্রেকাপ হয়ে যায়।
ব্রেকাপ হয়ে যাওয়ার কারণ খুবই নগণ্য। অর্চি নাকি ওর ফেসবুক প্রোফাইলে সুনন্দনাকে অস্বীকার করে, নিজেকে সিঙ্গল দেখাচ্ছিল। সুনন্দনা নিজের প্রোফাইলে , ইন এ রিলেশনশিপ উইথ অর্চি দেখালেও। এই নিয়ে খিটমিট। এর মধ্যে ব্যাঙ্গালোর থেকে সুনন্দনা ছবার কলকাতায় এসেছে, অর্চি সোমদত্ত আর স্বস্তিকাকে প্রভূত পেন দিয়ে তিন চারবার ব্যাঙ্গালোর গেছে। তারপর টুয়েল্ভ পাশ করে অর্চির দিল্লি চলে যাওয়া পড়তে, আর সেখানে নতুন গার্লফ্রেন্ড অর্জনের একটা কানাঘুষো খবর। সুনন্দনার ইমোশনাল ব্ল্যাকমেলিং এর ফলে, অর্চি নাকি বুদ্ধি করে ফেসবুকে ইন এ রিলেশনশিপ দিয়েছিল এমন ভাবে যা শুধুই সুনন্দনা দেখতে পাবে। বাকিদের কাছে ও সিঙ্গল থাকবে। এটা টেকনিকালি নাকি সম্ভব, সোমদত্ত নেট ফেসবুক এইসব সম্বন্ধে অত শত জানে না, তবে এটা বুঝেছে এই দুনম্বরিটা সুনন্দনা ধরে ফেলেছিল। মেয়েগুলোও তো আজকাল ঝানু কম না। অন্য বন্ধুর প্রোফাইল থেকে ফেসবুক দেখলেই তো ধরে ফেলা যায়।
সেটা ধরে ফেলার পর অর্চির সঙ্গে কাট্টি হয়ে গেছে সুনন্দনার। ব্যাস। তারপর ওইদিকে দশমাইল শান্তি কল্যাণ।
সোমদত্ত আপাতত দেখছিল, স্বস্তিকা প্রথমাকে কাউন্সেলিং করছে, কারণ সুস্নাতকে ছেড়ে দিয়ে, ব্যাঙ্গালোরে স্বামী আর মেয়েকে রেখে সটান কলকাতায় চলে এসেও প্রথমা হ্যাপি নয়। এই সব খতরনাক নারীবাদী মেয়েগুলো কখনো হ্যাপি হয়না, এদের এটাই রোগ। চিরতরে চুড়ৈলের মত মাথার মধ্যে এরা ক্যারি করে অশান্তির জার্ম। বিদেশ থেকে ইম্পোর্ট করা কন্ডোম বা কোল্ড ড্রিংকের মত ফেমিনিসম ও একটা ইম্পোর্টেড জিনিশ। যেটা নাকি ৭০ দশকে মার্কিন আরো অনেক জিনিশের সঙ্গেই এসেছিল এ দেশে। দেশের মাটিতে গজায়নি এ জিনিশ। ছেলেদের সঙ্গে ঝগড়া করার, নিজের ইচ্ছেমত কাজ কর্ম করার একটা অছিলা দিয়েছে মেয়েদের এই নারীবাদ। সহজেই পুরুষের দিকে আঙুল তোলার একটা বাহানা।
তা সেই প্রথমা প্রথমে নিজের স্বামীকে ডাম্প করেছে, তারপর কলকাতা এসে মাধবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবী বিদ্যা চর্চা কেন্দ্রে কী কী সব কানেকশনবাজি করে একটা কাজ জোগাড় করেছে।
কাজটা নেহাতই ক্লারিকাল। কিন্তু এতে ওর সুবিধে হয়েছে , কারণ প্রথমা নারীবাদী ও নারীবাদী প্রবন্ধ টবন্ধ লিখে এদিক ওদিক ছেপে ইতিমধ্যেই বেশ একটা মাস্তান টাইপ হয়ে উঠেছে ও লাইনে। ব্যাঙ্গালোরে স্বামীর পয়সায় ফুটানি মারত যখন, একটা দুর্দান্ত দামি ফ্ল্যাটে থেকে, ব্যাঙ্গালোর বেসড একটা নারীবাদী এন জি ও তে জয়েন করেছিল। সেই এন জি ওর হয়ে অনেক কী কী সব সোশ্যাল ওয়ার্ক করেছে, গ্রামটামে গিয়ে দরিদ্র মেয়েদের সঙ্গে কাজ করেছে নাকি।
সবটাই “নাকি” কারণ কাগজে কলমে ও যা লেখে তা থেকে এসব জানা গেছে। কেউ সরেজমিনে গিয়ে তদন্ত তো করতে যায়নি।
স্বস্তিকার বান্ধবী যখন তখন কত আর বেশি কাজ করবে। এসি র বাতাসে না রাখলে এইসব সুখী গাছ শুকিয়ে যায়। সারাগায়ে বার্ন হয়ে যায়। ঘামাচি হয়ে যায়। অন্তত স্বস্তিকা তো সেই রোগের শিকার আজকাল। দশবছর আগেও এসি র কথা ভাবতে পারত না কেউ। আজকাল এসব ছাড়া ওরা থাকতে পারছে না।
এখন প্রথমা নিয়ে পড়েছে তার নিজের সেন্টারের হেডকে নিয়ে। ভদ্রলোক নাকি মানবী বিদ্যা চর্চা কেন্দ্রের মাথা হয়েও, নিজে বেসিকালি ভীষণরকম অ্যান্টি মহিলা। মিসোজিনিস্ট, স্বস্তিকাদের ভাষায়। বোঝ!
টানা সাড়ে বাইশমিনিট কথা বলার পর স্বস্তিকা ফোন রাখল। হাতে কাজ নামিয়ে রেখে এল, খিঁচুটে মুখে বলল, তোমার নেটের কাজ হল? উফ বাবা সারাক্ষণ কী করে নেটে থাকো!
তুমি তো সারাক্ষণ ফোনে থাক। সোমদত্ত খুব ঠান্ডা গলায় বলার চেষ্টা করল।
হ্যাঁ কিন্তু ফোন করতে করতে আমি তো কাজ করতে থাকি। নেট করতে করতে তুমি কটা ঘরের ঝুল ঝেড়েছ? তুমি তো পুরুষ তাই সদা সচেতন , পিওর কনশাসনেস। আমি প্রকৃতি তাই মাটি ধুলো ন্যাতাকানি এসব নিয়ে আমার থাকা। এর মধ্যে রান্নাঘরেও হাত লাগিয়ে এসেছি। বলার সময় ভেবে কথা বলবে।
উফফফ। শুরু হয়ে গেলে ত! ওই নারীবাদীটার সঙ্গে কথা বললেই আমি দেখেছি তুমি কিরকম যেন খেঁকুরে কুকুরের মত হয়ে যাও।
চুপ কর। দেখি , আজ নাকি ফেসবুকে কে একটা হেব্বি গালাগাল করেছে প্রথমাকে। দেখতে হবে।
আচ্ছা , একটা কথা বল। আজকাল প্রিয়নাথবাবুর সঙ্গে ওরকম খারাপ ব্যবহার কর কেন? আজ সকালেও তো দেখলাম তুমি একদম ঘরে ঢুকে বসে রইলে। ব্রেকফাস্ট বানাচ্ছিলে, হঠাৎ গ্যাস অফ করে দিয়ে বেডরুমে চলে গেলে। উনি তোমাকে ডাকছিলেন। আমি তোমাকে ডেকে তারপর বুঝলাম কেস গন্ডগোল। তাই ওনাকে বললাম ও বাথরুমে ঢুকেছে।
ডাকছিলেন? বুড়োটার আস্পর্ধা তো দেখছি মাত্রাছাড়া হয়ে গেছে। লোচ্চা, নোংরা লোক একটা।
এ আবার কী ভাষা! কী হলটা কি তোমার স্বস্তিকা।
হবে আবার কী! এতদিন বলিনি, বলতে পারিনি, এসব নোংরা কথা মুখে আনতে আমার প্রবৃত্তি হয়না বলেই।
কী নোংরামোটা উনি করেছেন তোমার সঙ্গে, অ্যাঁ? মুখ বেঁকে যায় সোমদত্তর। চোখ ছোট হয়ে যায়।
ওই দ্যাখো। তোমারও মুখ কেমন হয়ে গেল, পুরুষতন্ত্রে ছ্যাঁকা লেগে গেল, না? লোকটা আমার দিকে অসভ্যের মত তাকায়। টু বি প্রিসাইজ, আমার বুকের দিকে তাকায়। ওই লোকটার সামনে আমি যদি আর এসেছি সকালে। সারাসকাল আমার মাটি করে দিয়ে চলে যায়। কোন প্রাইভেসি তো এবাড়িতে এমনিই আমার কোণদিন নেই। বুড়ো ভামটা এখন বাবা মাকে ফিজিওথেরাপির নাম করে এসে রোজ সকালে দুঘন্টা আড্ডা মেরে, বাড়ির কেন্দ্রীয় জায়গাটায় বসে বসে কাটিয়ে চলে যায়। লোকটাকে উচ্ছেদ করা সম্ভব নয় তোমাদের ওই ওনাকে নিয়ে “কাকু, কাকু” ন্যাকামির জন্যই যখন, তখন আমাকেই ওই সময়টা ঘরে বসে কাটাতে হবে। আর কিচ্ছু করার নেই।
শোন স্বস্তিকা, খাটের ওপর কোলবালিশটা পিঠের তলা থেকে টেনে বের করে কোলে রেখে সোমদত্ত ঠিকঠাক ভাবে বসে। একটা আলোচনায়, একটা রফায় আসার চেষ্টা করে। অন্তত বডি ল্যাঙ্গুয়েজে রিল্যাক্সড অবস্থা থেকে একটা টান টান ভাব আনার চেষ্টা করে। ড্যামেজ কনট্রোল দরকার এবার।
শোণ স্বস্তিকা, একটা কথা বলি তোমায়। প্রিয়নাথবাবুর প্রতি আমার আলাদা করে কোন সফট কর্নার নেই। কোনদিন ছিল না। থাকার কথা নয়। হি ইজ জাস্ট অ্যানাদার পার্সন ইন আওয়ার নেবারহুড। আমাদের বাড়িতে আসেন এই মাত্র। তার বেশি কিচ্ছু নয়। তোমার যদি ধক থাকে তুমি মুখের ওপর বলবে, যেভাবে রাস্তাঘাটে আর চারটে লোককে বুকের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখলে বলতে।
ও , তার মানে তুমি আমার কোন কাজেই আসবে না। আমার একট অসম্মান হচ্ছে, তুমি আমার পাশে দাঁড়াবে না?
সোমদত্ত প্রায় ধৈর্যচ্যুতির দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে এ মুহুর্তে। মুখ চোখ সব সরু হয়ে আসে ওর বিরক্তিতে। এই স্বস্তিকার মুখে এসব ন্যাকা ন্যাকা কথা শুনলে তার বেজায় রাগ হয়। সেটা প্রকাশ করাও যাবেনা। তাহলেই সেই পলিটিকালি ইনকারেক্ট হয়ে যাবে। পুরুষের জীবন এখন খুব চাপের। বাড়িতে একটা গ্যাজেটও সোমদত্তের সঙ্গে কনসাল্ট করে কেনেনি স্বস্তিকা। মাইক্রোওয়েভ কিনে ফেলেছে নিজে নিজেই, স্যান্ডউইচ বানানোর যন্ত্রটন্ত্র, সবই। নিজের শাড়ি জামাকাপড় কেনার সময়েও সোমদত্তের ধার ধারেনি। নিজের অফিস নিয়েও কোন উচ্চবাচ্য করেনা, অফিসের কোলিগদের সঙ্গে এদিক ওদিক বেড়ানোর প্ল্যান বানায়। টিন্টো যখন ছোট ছিল, টিন্টোর জ্বর হয়েছে, টিন্টো কাঁদছে, টিন্টোর হোমওয়ার্ক হয়নি, এওসব বলে তাও স্বস্তিকার ওপর চাপ সৃষ্টি করা যেত। এখন টিন্টো বড়, তাই স্বস্তিকাকে কোণভাবেই কনট্রোল করা যাচ্ছে না। যা ইচ্ছে তাই করে বেড়াচ্ছে।
তার স্বাধীনতায় সোমদত্ত কোণদিনই হস্তক্ষেপ করেনি। আজ এসব কী কথা। পাশে দাঁড়ানো, সম্মান রক্ষা। মজা মারার আর জায়গা পায়না।
দ্যাখো স্বস্তিকা। তুমি কচি খুকি নও যে আমাকে তোমার বডিগার্ড হয়ে বেড়াতে হবে। বয়স যথেষ্ট হয়েছে তো। বছর পয়ঁতাল্লিশের একটি মহিলা তুমি। এমন কিছু ভীষণ সুন্দরী বা পুরুষের কাছে প্রচন্ড অ্যাট্রাকটিভ নিজেকে মনে করো না যে তোমার দিকে সব দুনিয়ার পুরুষ হাঁ করে তাকিয়ে আছে। প্রিয়নাথকাকা একবার দুবার চোখ দিয়ে চেটে নিয়েছেন সেটাতে আমি এমন কিছু অস্বাভাবিকতা দেখিনা। ওটাকে একটা ইস্যূ বানাচ্ছো এবার তুমি । এসব খেলা ছাড়ো। তোমার সবসময়েই প্রাইভেসি প্রবলেম ছিল, আছে। কিন্তু এখন যথেষ্ট বয়স হয়েছে।
গলগল করে আপাত দৃষ্টিতে পলিটিকালি ইনকারেক্ট কথাগুলোই অবাধে বলে ফেলল সোমদত্ত। বলেই প্রায় দাঁত চেপে অপেক্ষা করল সেই বিস্ফোরণটার, যেটা ঘটবেই।
হ্যাঁ ঘটলো। কাঁদল স্বস্তিকা, চীৎকার করল, তারপর দুম দাম করে বাথরুমে ঢুকে গেল কথা থামিয়ে । হু হু করে কাঁদছিল সে। ঠিক মনে হল সোমদত্তের, এক পঞ্চদশী তরুণী বুঝি স্বস্তিকা। উফফ। এই মেয়েগুলোর সঙ্গে বসবাস একটা দৈনন্দিন স্ট্রাগল।
অবনীর খসখসে জীবন
অবনী তালপাড়ের সঙ্গে মিল্ক শেক খেতে খেতেও একরকমের বিশ্বদর্শন ঘটল স্বস্তিকার। তবে সেটা করে ওর একটু নিজের জীবনটাকে বেশিই সহনীয় বলে মনে হল।
অবনী স্বস্তিকার স্কুলবেলার বন্ধু। একটা জায়গায় খুব মিল দুজনের। দুজনেই আর্মির অফিসারের মেয়ে। আসলে আর্মি স্কুলে , গুয়াহাটিতে বেশ কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ বছর একসঙ্গে কাটিয়েছিল ওরা। ক্লাস ফাইভ থেকে নাইন। জীবন গড়ে ওঠার জরুরি বছরগুলো। গল্পের বই আদান প্রদান থেকে শুরু করে, সেই সময়ের রেডিওর বিবিধভারতীর সান্ধ্য প্রোগ্রাম, রাগ মঞ্জরীতে প্রিয় গান, ক্ল্যাসিকাল মিউজিকে একসঙ্গে গিয়ে বাজনা শোনা ভাগ করে নেওয়া। কী ছিল না । ফালতু হিন্দি গানের সঙ্গে প্রথম বেলবটম প্যান্ট পরে নৃত্য, দরজা বন্ধ করে। যাতে বাবা মায়েরা দেখতে না পায়। হ্যাঁ সেটাও ছিল।
আজও বন্ধুত্ব অটুট।
অবনী এখন কেন্দ্রীয় সরকারের বাঘা অফিসার। ইনকাম ট্যাক্স ডিপার্টমেন্টে কাজ করে, বাছাই করা বন্ধু মেনটেন করে। বিয়ে করেছিল খুব দেরিতে, সে বিয়ে ভেঙে গেছে।
অবনী মহারাষ্ট্রীয়। ও নিজেকে সংস্কৃতিসম্পন্ন মনে করে। এই বাঙালিনী বান্ধবীর সঙ্গে মারাঠি নাট্যসঙ্গীতের ক্যাসেট আদানপ্রদান, একসঙ্গে চুটিয়ে ক্রসওয়ার্ড সলভ করা। এইসব করে অবনীরা প্রায় নিজেদের “ইন্টেলেকচুয়াল” ইমেজ তৈরি করে ফেলেইছিল।
দুজনেই কম্পিটিশন করে প্রেমে পড়েছিল নাসিরুদ্দিন শাহ আর নানা পাটেকরের।
আজ ও ফোন করতেই স্বস্তিকা উচ্ছ্বল। নিজের সব কাজ ফেলে আগে প্ল্যান করতে বসে, কোথায় দেখা করা যায়।
স্বস্তিকার লজ্জা করে কারুকে বাড়িতে ডাকতে। একেই এই চাপা চাপা ফ্ল্যাট বাড়ি, দুটো আয়া আর তিনজন কাজের লোক ঘুরে বেড়ানো ঘরে ঘরে, পশ্চিমবঙ্গের বর্ষার বৃষ্টির মত বিচ্ছিন্নভাবে আর বিক্ষিপ্তভাবে এদিক ওদিক ছড়ানো বই, কাগজ, জিনিশ রাখারাখির ফলে হাঁটাচলা করার বেজায় অসুবিধে। বসবার ঘরটা একটা বাজার। সকালে প্রিয়নাথ নামে এক প্রৌঢ় বাবা মাকে মালিশ করার নামে এসে এক ঘন্টা আড্ডা দিয়ে যান। মজার বুড়ো, কিন্তু মজাটা ক্রমশ কেমন কমে আসছে, দেখা হলেই ওনার ওই , মা স্বস্তিকা, কেমন আছো মা, বলে গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে চুলবুল করে ওঠা হাত, আর চোখদুটোর তিরতির করে ওর বুকের দিকে গিয়ে সেটল করা দেখলে মাথা গরম হয়ে ওঠে। তারপর চা বিস্কুট খেতে খেতে সারা পাড়ার কেচ্ছা এবং খবরের কাগজ ঘেঁটে যত রাজ্যের গসিপধর্মী খবরের আলোচনা।
এই বুড়োর এ বাড়িতে আসা আটকাতে পারে না স্বস্তিকা। এটা তো নিজের বাড়ি নয়, শ্বশুর বাড়ি। তারপর একে একে কত লোক আসে যায়। ডাক্তার আসেন। আসে এল আই সি এজেন্ট। বাবার ছোটবেলার বন্ধু আশুকাকু। আসেন শাশুড়িমার গাল গল্পের সঙ্গিনীরা।
শুধু স্বস্তিকা কখনো নিজের বন্ধুদের ডাকেনা। কারণ তার মনে হয় , ওদের সঙ্গে বসে কথা বলার প্রাইভেসি নেই এখানে। কোনওভাবেই পারেনা, নিজের এই দিনরাত কাটানোর খুপরি ঘরগুলোতে ডেকে আনতে সইদের। ছোটবেলার বান্ধবী, যথেষ্ট সফিস্টিকেটেড ব্যাকগ্রাউন্ডের অবনীকে তো এখানে আনার প্রশ্নই নেই।
তবে গত দশ বারো বছর ধরে কলকাতায় এই সমস্যাটা আর সমস্যা নেই। শুরু হয়েছিল কিছু ভাল ভাল শপিং মলের ভেতরের ছোট ছোট ব্র্যান্ডেড কফির দোকান দিয়ে। কাফে কফি ডে-র মত চেনস্টোরে দুদন্ড বসে কফি খাও, কথা বল। এখন সারা কলকাতায় গিজগিজ করছে অনেক রকমের ছোট ছোট কাফে।
এত সুন্দর সে সব কাফে, নয়ন মনোহর। তাছাড়া খাবারেও কনটিনেন্টাল স্যান্ডউইচ থেকে শুরু করে, দুর্দান্ত মোকা কফি কাপুচিনো কফি অথবা কাফে লাতে , গ্রিনটি বা দার্জিলিং চা, ঠান্ডার ভেতরে ক্রাশার অথবা লস্যি অথবা অ্যালকোহলহীন মোহিত পানীয় যে কোন ধরণের বস্তু পাওয়া যাবে। জমাটি এক পসরা। যদিও দামের দিক থেকে যথেষ্ট বেশি, বেশ উচ্চবিত্তীয়। কিন্তু হ্যাঁ, স্বস্তিকার মত লোক মাসে দু একবার এ ধরণের কফিশপে বসে সাময়িকভাবে বাড়িতেনিজের বসবার ঘর না থাকার যন্ত্রণা ভুলে বন্ধুদের ট্রিট দিয়ে মনোরঞ্জন করতেই পারে। ভারি ফুরফুরে হয়ে যায় ওর মেজাজ এইসব দোকানে বসলে।
অবনীকে ও নিয়ে গেল গড়িয়াহাট অঞ্চলের একটা মাঝারি কফিশপে। পুতুল টুতুল দিয়ে সাজানো, গোলাপি চমৎকার দু-তিন পরত সুন্দর রং-এর বাহার করা। নামেও বিলিতি ছাপ।
কেমন রূপকথা রূপকথা। অবনীর সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া বিদেশি রূপকথা বইয়ের ভারি খসখসে ক্রিমকালার কাগজের বইয়ের পাতা ওল্টানোর মত লাগে স্বস্তিকার। শিরশিরে সুখ হয় একটা।
অবনীর গেস্ট হাউজও এ পাড়ায়তেই এক বিখ্যাত সরকারি সংস্থার গেস্ট হাউজ।
দু বান্ধবী একটা করে গ্রিলড চিকেন স্যান্ডউইচ অর্ডার দিল। অবনী নিল মিল্ক শেক আর স্বস্তিকা গ্রিন টি উইথ হানি।
ঈষদচ্ছ চায়ের ভেতর ভাসছিল তুলসি পাতা। অবনীর সাদা দুধ-ভ্যানিলার লম্বা সুদৃশ্য গেলাসের গা বেয়ে জমছিল ঘাম।
অবনী অন্যদিকে তাকিয়ে বলছিল, ও ভাল আছে। কিন্তু...।
আড্ডা জমলেই ওরা কিন্তুগুলো বলতে শুরু করে। অল হেল ব্রোক লুজ বলে ইংরিজিতে একটা কথা আছে। নিজেদের ক্রাইসিসগুলো , চুটকি আর মজা করার পাশাপাশিই , ওরা বলে ফেলতে চায়। ভাঙা ইংরিজি, হিন্দি। অল্প বাংলাও। পাঁচমিশেলি ভাষায় একটা আদি অন্তহীন গল্প। আবার শুনতে হবে, ভাবেনি স্বস্তিকা।
তোর সঙ্গে অনেকদিন ক্যাচ আপ করা হয়নি। তাই না রে?
তুই বিয়ে করেছিলি, তারপরের বার যখন কথা হল, বললি দিল্লি থেকে শিমলায় পোস্টিং হয়ে গেছে। একাই থাকিস। তাই তো?
হ্যাঁ ঠিক তাইই।
তোর বিবাহবিচ্ছেদের গল্পটা বলবি এখন? না ইটস টু লেট?
টু লেট। ভুলেও গেছি রে কী থেকে কী হয়েছে। তবে হ্যাঁ, বিয়েটাই করা উচিত হয়নি। কারণ জানিসই তো, বত্রিশ বছর বয়স অব্দি আমার বিয়ে করার কোন মতলবই ছিল না।
অবনীর দিকে , বাল্যবান্ধবী হিসেবে নয়। একটু অন্যভাবে তাকায় স্বস্তিকা। সুন্দরী নয়, কোনমতেই সুন্দরী নয় অবনী। অথচ স্কুলে ডিবেটে ফার্স্ট হত। তার্কিক , পড়াশুনোয় ভাল, সেই মেয়ের চেহারা সুন্দর নয় বলে ছেলেরা কাছে ঘেঁষেনি। এখন ও ভুরু প্লাক করে, চুল স্টেপ করে কাটে। দারুণ সব পোশাক পরে।
এই মুহূর্তে স্বাভাবিকভাবেই বেশ দামি চিকনের কুর্তি পরে আছে , পাতলা হালকা সাদা কটনের। সঙ্গে জিনস। এই মেয়ের বিয়ের বর, কোন আশ্চর্য কারণে , প্রায় হাঁটুর বয়সী এক যুবক ছিল। ভাবাই যেতে পারে, সবটাই সুবিধের জন্য বিয়ে।
অবনী বলে, ছাড় ও কথা। নালায়ক টাইপ ছিল আমার বর। ভারি সেলফিশ। কিছুদিন আমাকে ইনটেলেকচুয়াল কম্প্যানিয়ন হ্যানত্যান বলে তারপর ডাবল ক্রসিং শুরু করল। সুভাষ। ওর নাম। হাতে নাতে প্রমাণ পেয়ে গেলাম এক্সট্রা ম্যারিটাল অ্যাফেয়ারের।
তারপরই সেপারেশন হল।
যাক গে ছাড়...
অবনী স্ট্র দাঁতে নিয়ে বলে তোর কী খবর? তোর বরটা কিউট ত, মাঝে মাঝে ফেসবুকে দেখি ত , ফোটো দিস। বেশ খুশ খুশ।
না সে ঠিক আছে। তা ছাড়া ছেলেটাকে নিয়ে বেজায় চাপে আছি।
স্বস্তিকা বেশি বলতে চায়না। অবনী নিঃসন্তান। ছেলে মেয়ের গল্পের ঝাঁপি ওর কাছে খুললে, বেচারি মেনস্ট্রিম ছাপোষাদের দ্বারা আরো কোণঠাশা হয়ে যাবে।
অবনী বলে, তোরা কাগজে দেখেছিলি, আমার একটা কেস? আমি আমার এক কলিগের নামে কেস করেছিলাম? ছেলেটার ডিমোশন হয়। জয়েন্ট সেক্রেটারি ক্যাডার থেকে ডেপুটি সেক্রেটারি ক্যাডারে নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
তাইই? নড়ে চড়ে বসে স্বস্তিকা। সে ত বিশাল ভিক্টরি রে। তুই বলিস নি তো আমাকে।
আমার শিমলার থেকে দিল্লি ফেরার কথা ছিল। এই অভিযোগ, এবং তারপর সেই উজবুগ ক্যারেকটার লেসটার শাস্তি , এই সময়ের পর পরি আমাকে গোরখপুর পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কোন কাজ নেই অফিসটায়। গাঁ গঞ্জের মাঝখানে নো ম্যানস ল্যান্ডে। কেন বলত?
কেন?
পাজিটা নিজে শাস্তি পেয়েছে কারণ গভর্মেন্ট রুলস ফ্রেম করেছে, তা থেকে পালানো যায়না। কিন্তু আমার বিরুদ্ধে ভার্বাল ক্যাম্পেন করাটা তো আর কোথাও বারণ করা নেই। উইস্পারিং ক্যাম্পেন হয়েছে। লোকজন বলেছে, ওই তো রূপ, ওই মেয়ের সঙ্গে অভব্য আচরণ করবে রাজীব শ্রীবাস্তব, ওর কি আর মেয়ে জোটেনি? আসলে অবনী তালপাড়ে একটি ফ্রাস্ট্রেটেড মাল, বর পালিয়ে গেছে, চিপ পাবলিসিটি পাওয়ার জন্য এখন রাজীবের নামে নালিশ করেছে।
লোকজন বলেছে মানে কারা বলেছে?
তারা বেশিরভাগই মহিলা। আমার সিনিয়রদের মধ্যে প্রায় সবাই কনভিন্সড এটা আমারই বানানো, সাজানো দোষারোপ। বুঝতেই পারিস যারা আমাদের পোস্টিং দেয় তারা একটা লবি। সব উত্তর ভারতীয়। আমরা মহারাষ্ট্রীয় গোটা সিভিল সার্ভিসে সংখ্যায় কজন বলত? রিজিওনাল কার্ড আর জেন্ডার কার্ড, দুটোই আমার ক্ষেত্রে ব্যাকফায়ার করে গেছে।
উফ। দম আটকে এসেছে স্বস্তিকার।
তোর ঐ ইউপি বাসী কলিগ কী করেছিল রে?
অসভ্যতা করত। রোজ। কথায় কথায় সোফায় পাশে বসে হাঁটু চাপড়ে কথা বলত। অশ্লীল জোকস বলত। প্রায়ই নানান অফিশিয়াল পার্টিতে নিজে বোতল বয়ে এনে খুলে বসে পড়ত, বসগোত্রীয় পুরুষগুলো তো সবাই ছুপা রুস্তম সেক্সিস্ট , মিসোজিনিস্ট। তাদের হাতে রাখত, মাল খেত। অন্য মেয়েরা ভয়ে লজ্জায় উঠে যেত। আমি যেতাম না। কেন উঠে যাব রে। মেয়ে বলে কেন গুডি গুডি হয়ে থাকতে হবে?
তাই তোকে অ্যাভেলেবল ভেবে ফেলল?
হ্যাঁ অবভিয়াসলি। আমার বিয়ে ভেঙ্গে গেছে, বাচ্চাকাচ্চা নেই। ওর লাইসেন্স আছে যেন আমার সঙ্গে অসভ্যতা করার। সুতরাং অসভ্যতা করল। অসম্ভবরকম । তারপর অস্বীকার করল, বলল ওই শুকনো কাঠের মত মহিলার সঙ্গে আমি অসভ্যতা করব? কীসের আকর্ষণে করব, বলুন ধর্মাবতার? ... আমার এভিডেন্স পোক্ত ছিল বলে শাস্তি পেয়েছে, তার প্রতিশোধ এখনো নিয়ে যাচ্ছে। ডিপার্টমেন্টে আমি একটা ব্যানড অবজেক্ট। আমাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে সমাজে। চাকরির জগতে কেউ আমাকে ছোঁয় না। আমি আনটাচেবল।
গলা শুকিয়ে আসছিল স্বস্তিকার। এক চুমুক সবুজ চা দিয়ে ঠোঁট ভেজাল। ভাবল, আমিও তো তোকে এখনি অসুন্দর ভেবে, কেমন নিচু নজরে দেখলাম। মনে পড়ল একবার সোমদত্ত বলেছিল, তোমার বস তোমাকে সামনে বসিয়ে রাখে সারা সকাল, রাখবে নাই বা কেন? তোমার ওপর বিধাতার আশীর্বাদ আছে, এই সব লাবণ্য, এই সব ঝরে পড়া স্নেহপদার্থ। কোমরের চামড়ায় আঙুল জড়িয়ে চিমটি কেটেছিল, মনে আছে।
শুকনো, খসখসে অবনীর দিকে যে করুণাভরা চোখে তাকিয়েছিল স্বস্তিকা, সেটা ফিরিয়ে নিল, আবার ক্ষমা চাইল। আমি আমার লাবণ্যের কারণে একভাবে এক্সপ্লয়েটেড হলে, তুই তোর রূপ না থাকার কারণে। উই আর অন দ্য সেম বোট। অবনীর সামনে টিন্টোকে ফোন করতে ইচ্ছে ছিল না। মেয়েটির বাচ্চা নেই। সন্তান নিয়ে মায়েদের হুজুগ, মাথাব্যথা, অতিরিক্ত তোলা তোলা করা, এসব দেকলে শুষ্ক অবনীর চোখ মুখ পালটে যেতে পারে।
কিন্তু অ্যাভয়েড করা গেল না। কী করে করবে? টিন্টো আর সোমদত্ত বার বার ফোন করে তার প্ল্যান ঘেঁটে দিল।
টিন্টো প্রথমে ।
মা, আমার এ মাসের ফি দেওয়া হয়নি।
এখন সেটা তোমার মনে পড়ল, টিন্টো? ক্লাস টেনে উঠে গেছিস বাবু, এখনো এগুলো নিজে মনে রাখতে পারিস না?
আরে, কী অদ্ভুত । তুমিই তো এগুলো সব দেখ, তুমি এ মাসে ভুলেই গেলে? কাল ম্যাম বলেছে, এর পর নাম কেটে যাবে।
কেটে গেলে যাবে। কাল ম্যাম বলেছে তো আজ এত বিকেলে বলছ কেন? সকালে বল নি কেন?
ভুলে গেছিলাম।
বাঃ টিন্টো, তুমি ভুলে যেতে পার, আর আমি ভুলে গেলেই দোষ। আমারও অনেক কাজ ছিল , কবে দশ তারিখ হয়ে গেছে খেয়াল নেই। যাকগে রাখো এখন, কাল দিয়ে দেব।
এর পর সোমদত্তর ফোন।
কী রাজকার্যটা কর বলতো? টিন্টোর স্কুল ফি দেওয়া হয়নি।
ভুলে গেছিলাম তো। গলায় অনুনয় আর অনুতাপের সুর এসে গেল অটোমেটিকালি। বলা হল না, তাতে তোমার কী হয়েছে সোম। তুমি তো কোনদিনই টিন্টোর স্কুল ফি জমা কর না।
সত্যি, কী করে ভুলে যাও বুঝতে পারিনা। সেদিন টিন্টোর ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্টও ভুলে গেছিলে। তোমার কী হয়েছে বলতো?
কী আবার হবে? মনটা অবনীর মুখোমুখি বেশ হালকা হয়ে এসেছিল। আবার তেতো হতে শুরু করে। মুখের রেখাগুলিকে নির্বিকার রাখতে হবে স্বস্তিকাকে। সেই চ্যালেঞ্জ নিয়ে নিরুত্তাপ বলে।
কোথায় এখন তুমি? যখন তখন বেরিয়ে যাচ্ছ অফিস থেকে! ল্যান্ড লাইনে করে দেখলাম নেই!
আমার এক বন্ধুর সঙ্গে ক্যাফেতে এসেছি।
কে বন্ধু।
( সে খোঁজে কাজ কী তোমার, সোম? মনে মনে বলল স্বস্তিকা) অবনী, আমার পুরনো বন্ধু। মারাঠি। মনে নেই?
বান্ধবী না বন্ধু? এক্সট্রা ম্যারিটাল অ্যাফেয়ার করছ কারুর সঙ্গে? সত্যি মাল হয়ে যাচ্ছ তুমি একটা।
“টিন্টোর মা”
স্বস্তিকা একজন মা।
একজন কারুর স্ত্রী, একজন কারুর মেয়ে, একজন কারুর বোন। এবং মা। এইসব পরিচয় তৈরি হয় সমাজে। তারপর সারাজীবন সেই ছাপ্পা গুলো নিয়ে চলতেই হয়। সেটাই দস্তুর।
এই ক্ষেত্রে স্বস্তিকা মা, মায়ের ডেটা কালেকশন করে চলেছে। মায়ের ডেটাবেস তৈরি হয়েছে অনেকদূর। স্বস্তিকার ছেলে টিন্টো এখন বছর চোদ্দর।
আশা রাখা যায় এর পর টিন্টোর বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বস্তিকার মাতৃ ডেটাবেসে পরিবর্তন আসবে।
প্রথম যেদিন সে মাতৃত্বের রণডংকা বাজতে শুনেছিল, সেদিন ছিল তুমুল দুর্যোগের দিন। বিবাহিত জীবনের মোটে আট কি ন মাসের মাথায় সেই দিন।
তার আগে সে তার বরকে, যৌন সঙ্গমের সময়েও , নানা বিধিনিষেধের মধ্যে রেখে, নিজের গর্ভাধান আটকানোর চেষ্টা করেছে। তার বর সোমদত্তও কিছু কম শিক্ষিত পরিশীলিত নয়। সে নিজেও চাইত না বিয়ের পরের রাত্তিরেই বউকে প্রেগনেন্ট করার মত “নীচকর্ম” করতে। যেটা তার অনেক বন্ধু করেছে, এবং আড়ালে খিঁকখিঁক হেসেছে তারা , এরা সব ফার্স্ট নাইট কেস।
শিক্ষিত স্বামী হবার নাতে, স্ত্রীর সঙ্গে বসে ক্যালেন্ডার দেখে সংসর্গ ঠিক করেছে। দু হাজারের দম্পতি তারা।
বহু স্ত্রীর এই সৌভাগ্য হয়না স্বস্তিকা জানে। সে দিক থেকে তার কোন আপশোস অভিযোগ নেই সোমদত্তর প্রতি।
সেটা অন্য গল্প, যে তথাপি অ্যাক্সিডেন্ট ঘটিয়া থাকে, এবং ঘটিলে তাহা “ঈশ্বরের দান” হিসাবে মানিয়া লইতে হয়।
অ্যাক্সিডেন্ট ঘটল এবং পিরিওড মিস হল। স্বস্তিকা দেখল, মুহূর্তে পৃথিবীর রঙ পালটে পাটকিলে, ধোঁয়াটে এবং অসম্ভব ক্লান্তিকর হয়ে গেল তার কাছে। গুরুভার হয়ে উঠল জীবন।
কিন্তু সে তো তার নিজের কাছে। অফিসে একটা নতুন অ্যাসাইনমেন্ট। সেটাতে দক্ষতা দেখাতে পারবে না , ভেবে বসের কাছে কুঁকড়ে যাওয়া। শরীরের নানা আশ্চর্য নতুনত্বের ঝড় , তাকে বহন করার জন্য দক্ষতা অর্জন। সব ছিল কার্যক্রমে। প্রথম তিনমাসের অসম্ভব গা গুলনো এবং আর যা যা হয়ে থাকে। সকালে ঘুম থেকে উঠে রান্নাঘর থেকে আসা এমনকি সাদা পটল আলুর ছেঁচকির সেই সম্বর দেবার গন্ধেও অন্নপ্রাশনের ভাত উঠে আসতে থাকছিল তার।
এইসব পেরিয়ে সে দেখল, পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যার পুরাতন, আদিম, প্রাচীনতম খেলা শুরু। শ্বশুর এবং শাশুড়ি আনন্দে আটখানা। অন্য সবকিছু গোপনীয়তার চাদরে ঢাকা থাকলেও, সন্তানসম্ভাবনা একধরণের প্রোমোশন।
ভয়ানক পরিশীলিত এবং বাঙালি ভদ্রলোকের এপিটোম স্বস্তিকার শ্বশুরমশাই হঠাৎ বসবার ঘরে সবার সামনে আবেগ থরথর কন্ঠে প্রায় আবৃত্তির ঢঙে বলে ফেললেন, প্রথমে মা স্বস্তিকা তুমি ছিলে কন্যা। তারপর স্ত্রী হলে। এখন হবে মা। নারীত্বের সম্পূর্ণতাই তো মাতৃত্বে। তোমার পদোন্নতি হল। জীবনের সর্বোচ্চ ধাপে উঠে গেলে তুমি।
তার শাশুড়ি কেমন ভয়ানক গুরুত্ব দিতে শুরু করলেন তাঁকে। এবং তার জা , সুনীতা, কীরকম যেন ঈর্ষ্যার ঝোঁকে, তাকে বলে ফেলল, আমারও আর একটা ইশ্যু নেওয়ার প্ল্যান আছে। যার ছ সাত বছরের ছেলেকে নিয়ে সে ভয়ানক নাজেহাল রোজ, সেও, ভাবছে, এই এক প্রেগনেন্সি কর্ম দিয়ে স্বস্তিকা বুঝি এক পাল্লা বেশি ইম্পর্টেন্স পেয়ে গেল সবার কাছে। এ এক লোভনীয় ঈর্ষ্যণীয় পোজিশন, সংসারে।
একমাত্র আনন্দ জন্মেছিল তিনমাসের মাথায় প্রথম সোনোগ্রাফির দিনে, অপরিচিত এক নতুন ধুকপুকুনির শব্দ ডাক্তার যখন শোনালেন, আর সোনোগ্রাফির স্ক্রিন তার দিকে ঘুরিয়ে দিয়ে বললেন কী ভীষণ দৌড়চ্ছে আপনার বাচ্চা জলের ভেতর। মাছের মত ঘাই মারছিল একটি ছায়া। সেই ছায়াকেই ভালবাসল সে। মুখহীন এক শিশু।
সন্তানটির আসার আগে, সোমদত্তের ফুর্তি আর পুলক তাকে খুবই বিচলিত করলেও, সে মেনে নিল মাসে একবার করে ডাক্তার দেখিয়ে আসা।
তারপর, মেনে নিল সবার তার ওপরে নানা খবরদারি। এটা করবে না ওটা ধরবে না। এভাবে শোবে না, ওখানে বসবে না। কিচ্ছু বাইরের খাবে না।
ফুচকা চুরমুর চিকেন রোল আদি দীর্ঘ কয়েক মাসের জন্য বন্ধ হল।
তারপর সেই মহা মুহূর্ত। সে ঢুকে গেল ভীত চকিত এক স্ফীতোদর শরীর নিয়ে, নার্সিং হোমের গর্তে। সেই রাতেই তার যৌনকেশ ব্লেড দিয়ে শেভ করতে করতে বয়স্কা নার্স বললেন অমোঘ বাণীঃ মেয়েদের এই এক জ্বালা। যতই পড়ো আর যতই বড় চাকরি কর, এর থেকে নিস্তার নেই।
সাতদিনের নার্সিং হোম বসবাসে সে দেখে শুনে বুঝে ফেলল সন্তানজন্ম নিয়ে আয়াদের উল্লাস, নতুন শাড়ি পাওয়ার আশ্বাস। চোখে মুখে অশ্লীল ভঙ্গি করে কত না রসিকতা, সন্তানজন্মের গূঢ় তত্ত্ব নিয়ে।
সোমদত্ত অপারেশনের আগে দেখতে এল, তারপর কেমন বিচ্ছিন্ন হয়ে বাড়ি চলে গেল, একটু মিষ্টি কথাও না বলে। গলা আটকে এল কান্নায় , স্বস্তিকার। বাচ্চাটা আমাদের দুজনের তো, সোম। তাহলে কেন আমাকেই শুধু থাকতে হবে ঠান্ডা সাদা এই নার্সিং হোমটায়। আর তুমি ভিতু আত্মীয়ের মত, অসুস্থা গিন্নিকে দেখে কাষ্ঠ হাসি হেসে চলে যাবে, তারপর পরদিন বলবে, সারা সন্ধে ছেলে বন্ধুরা তোমাকে ঘিরে রেখেছিল মালের আড্ডায় , কেননা, বাচ্চা হলেই স্বস্তিকার প্রেম চলে যাবে, সব অ্যাটেনশন কেন্দ্রীভূত হবে বাচ্চার দিকে, তাই একলা হয়ে যাবে সোম, এই ভয়ে সে পারছিল না একা একা সন্ধেটা কাটাতে।
অপারেশনের দিনের সেই ধক করে নাকে আসা ক্লোরোফর্মের গন্ধ আর তার আগের মুহূর্ত অব্দি ডাক্তারদের হাসাহাসি, অ্যানেস্থেটিস্টের নানা টুকরো কথা, এ বাবা, পেশেন্ট অ্যাতো ফ্যাকাশে কেন, ব্লাড কাউন্ট দেখি তো! আর গোটা ব্যাপারটার প্রবল শীত-করা প্রাইভেসিহীন নিশ্ছিদ্র নৈর্ব্যক্তিক একটা পরিবেশে দম আটকে এসেছিল স্বস্তিকার। উলঙ্গ সে এক সবুজ বিটকেল জামার তলায়। এই বোধ এসেছিল। তলপেট উন্মুক্ত করে তাকে কেটেকুটে বাচ্চাকে বার করবে পুরুষ ডাক্তার, অন্তত আজকের জন্য সোমদত্তের চেয়ে সে বেশি প্রিভিলেজড, ভাবতে গিয়ে অসংখ্য গোল গোল জোরালো আলোর বৃত্ত দেখতে দেখতে সে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল।
জ্ঞান ফিরেছিল চাপ চাপ অনির্দেশ্য ব্যথায়। অবশ হয়ে আছে সারাটা তলপেট অঞ্চল। কিছু জানে না। অথচ প্রচন্ড ব্যথা। চোখ খুলতে একটা ন্যাকড়ার পুটলি এনে তাকে দেখানো হয়েছিল। এই তো বাচ্চা, ছেলে হয়েছে, ছেলে।
সোমদত্ত এসে হাত ধরেছিল বিবর্ণ মুখে।
আবার কেবিনে ঢুকে ঘুম, ঘুম, ওষুধের ভেতর।
পরদিন থেকে ক্ষতচিহ্ন, ব্লিডিং, শিশুকে দুধ খাওয়ানোর নতুনত্ব, নার্সের বকুনি, আয়ার ধমক।
সবকিছুর মধ্যে ছোট একটা নতুন মাংসদলার ধুকপুক, ভয় আর আনন্দের জোট বাঁধা অদ্ভুত এক ফিলিং।
এই ডেটাবেসের প্রান্তে ছিল আবার বাড়ি ফিরে আসা। বালতি বা কোণ ভারি জিনিশ না তুলতে পারা ইত্যাদি ইত্যাদি, প্রায় দু মাস।
একটু ইনফেকশন, ব্লিডিং বন্ধ না হওয়ায় অনেকটা ওষুধ পালটানো, ভয় ডর। ক্যাথিটার লাগিয়ে রাখার পর যন্ত্রণা আর চুলকুনি তার যোনিদ্বারে। এই অস্বস্তিগুলি তো কিছুই নয়। তারপর যা আরম্ভ হল তা জীবনের নতুন দিক।
তোমার মাতৃভাব নাই
কন্টিনুয়াস সারভেইলেন্সে বন্দিদশায় থাকা শুরু হল। শিশুটির জন্য আয়া আছে। তবু সে বই পড়ে শিখে নিয়ে টিন্টোকে স্নান করাতে চেষ্টা করত, জামা পরাত, হাগু পরিষ্কার করে দিত। হিসির কাঁথা পাল্টাত। কিন্তু যারা কিছুই করত না , সেই সব বাড়ির লোকেরা তার আশেপাশে ঘুরত। মা ছিল না বলে মায়ের বাড়িতে গিয়ে থাকা হয়নি স্বস্তিকার। শ্বশুরবাড়ির লোকের পুলিসগিরি তার সহ্য হত না।
বাচ্চা কাঁদলে অভিযোগের আঙুল উঠত, কাঁদছে কেন? খাওয়াচ্ছ না ঠিক করে?
খাওয়াতে গেলে বলা হত, ধরা ঠিক হয়নি।
শুইয়ে রাখলে শাশুড়ি এসে নাতির মুখচন্দ্রমা নিরীক্ষণ করতে করতেই ইম্যাজিনারি পিঁপড়ে খুঁজে পেত, অথবা ঠিক করে কাঁথা দিয়ে ঢাকা হয়নি ওকে, বলে স্বস্তিকাকে এক প্রস্ত জ্ঞান দিয়ে যেত।
টিন্টো ছ মাস হতে হতে অলটারনেটিভ খাবার দেওয়া শুরু। সেই সময়ে বোতল ঠিক ঠাক পনেরো মিনিট ধরে না ফোটানোর অপকারিতা আর বুকের দুধ অনেকক্ষণ ধরে খাওয়ানোর উপকারিতা নিয়ে লেকচার শোনানো হত তাকে। কে না এসে জ্ঞান দিয়ে যেত। কে না এসে বক্তব্য রাখত। যেখানে পৃথিবীতে যত মহিলা আছে যারা কখনো না কখনো বাচ্চা রেখেছে বা পেটে ধরেছে, তাদের বক্তব্য রাখার অধিকার জন্মে যায় কীভাবে যেন। আর নতুন মায়ের কাজ সবার কাছ থেকে তাদের নিজস্ব টিপস শুনে যাওয়া। জমা করা। ডেটাবেসে। শুধু শ্বশুর শাশুড়ি নয়, বাবা, কাকা, পিশি, পিশে, মাসি শাশুড়ি , কে নয় এই জ্ঞানদাতাদের দলে। এমনকি আয়া, বাড়ির ঘরমোছার লোক। এমনকি রাস্তার অপরিচিত মহিলা। ডাক্তারখানার হেল্পার।
ঠিক করে ধরুন। ধরা ঠিক না আপনার।
বাব্বা, ছেলেটাকে সামনে দিয়ে জামা পরিয়েছে দ্যাখো, হি হি , পেছনটা পুরো বেরিয়ে আছে...
কেন দাঁত উঠল না এখনো? আমার নাতনির তো ক—বে...
কেন টিন্টো কথা বলতে শিখল না আজো? আমার ছেলে তো কত আগে...
কেন টিন্টো হাঁটতে পারে না? আমাদের টা তো এরই মধ্যে...
এরপর স্কুলিং নিয়ে বিস্তর জলঘোলা হল। তালিকা তৈরি হল। লাইন লাগানোর জন্য অনুপ্রাণিত হল সোমদত্ত।
স্কুলে যেতে গিয়ে টিন্টো কাঁদল না। সেটাও বিস্ময়ের। কেন কাঁদল না? টিন্টো স্কুলে কিছু শিখছিল কিনা, তা নিয়েও সংশয় ছিল। প্রশ্ন ধরা হত ওকে, বাইসাইকেলে কটা আই বলতো? গাজর দেখিয়ে জেঠিমা জিগ্যেস করত, এটা কি কালার টিন্টো? রেড বলেছিল বলে আ আ ছি ছি শুরু হল, স্বস্তিকা ওকে অরেঞ্জ কালারটা চেনাও নি?
সবকিছুর শেষেও, ভাল মা হয়ে উঠতে পারল কি, স্বস্তিকা? খুব সন্দেহ আছে তাতে।
টিন্টোর ক্লাস টু। একদিন অফিস থেকে ফিরে এসে স্বস্তিকা দেখল শাশুড়ির মুখ হাঁড়ি। টিন্টোর ক্লাস টিচার ওর খাতায় লাল কালি দিয়ে লিখে দিয়েছেন, হোম ওয়ার্ক নট ডান।
শাশুড়ি ঝাঁঝিয়ে উঠে স্বস্তিকাকে জবাবদিহি চাইলেনঃ ওর হোমওয়ার্কটা ও করল কিনা এটাও দেখতে পারো না?
ডিসিপ্লিন অ্যান্ড পানিশ, মিশেল ফুকো নাকি লিখেছিল। একজন মা শুধু বায়োলজিকালি মা হয়ে ওঠেনা। পেট থেকে পড়লেই বাচ্চা পয়দা করা যায়না। মা হওয়া শিখে উঠতে হয়।
আজকের দিনের মায়েদের কত না চাপ। তাকে সর্বংসহা ও সর্বকর্মা হতে হবে। কে যেন গোটা একটা বইই লিখে দিয়েছে, আমার মা সব জানে। তাই তাকে সেই বইটা কিনে পড়ে ফেলতে হবে ও টিন্টোর সব প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে।
টিভির বিজ্ঞাপনে যেরকম দেখায়, মা কখনো বকবে না অধৈর্য হবে না বিরক্ত হবে না। নিজের সুখের কথা ভাববে না। সারাদিন ছেলের মুখে জলের গেলাস খাবারের থালা এবং কুলকুচি হয়ে গেলে গামছা তুলে দেবে। জামা বার করে রাখবে, পরিয়ে দেবে। জুতো পরিয়ে দেবে। স্কুলে র থেকে এলে গ্লুকন ডি গুলে দেবে। পরীক্ষায় ভাল করলে কিটক্যাট কিনে দেবে।
মা কখনো নিজের কাজ করবে না, বাড়িতে যতক্ষণ থাকবে ছেলের সঙ্গে খেলবে কথা বলবে, ছেলের পড়া দেখবে। অফিসে গেলে তো আরো বেশি অপরাধী হয়ে মাকে ফিরে আসতে হবে, আরো দ্বিগুণ উৎসাহে ছেলের সেবাযত্ন করতে হবে, সে সময়টা সে ছিল না সেই সময়টার অভাব পুষিয়ে দিতে হবে।
মাতৃত্ব কত আনকন্ডিশনাল তা নিয়ে অনেক ভাল ভাল কথা পড়া যাবে, বলা হবে অনেক সুন্দর কবিতা গান আর বাণী, মা হল সবার ওপরে।
এইভাবে , কন্ডিশনড হতে হতে, স্বস্তিকা দেখেছে, সে এক রোবট মা এখন।
সারাদিন অফিস করে বাড়িতে ঢুকেই চুড়িদার কামিজের ওপর থেকে চুন্নিটা নামিয়ে রেখে সে রান্নাঘরে ঢুকে টিন্টোর দাবি অনুসারে কোনদিন চাউমিন কোণদিন পাস্তা কোনদিন ভাত নেড়ে বিরিয়ানি করে দেবে। অনায়াসে তারপর টিন্টোর হোমওয়ারক দেখবে, অনায়াসে তার প্রয়োজন হলে বেরিয়ে কিনে এনে দেবে সেলোফেন পেপার অথবা ফেভিকল, কলম পেন্সিল বা রুলটানা খাতা। যখন যেটা দরকার।
রাত এগারোটায় ঘুমে ঢুলে পড়তে পড়তেও, টিন্টোর দাঁত মাজা জামা পালটানো সুপারভাইজ করবে, বিছানা পাতবে।
সোমদত্ত করে না এসব? না তা নয়। সোমদত্ত অনেক কিছুই করেছে, করে হালকা করেছে গুরুভার সন্তানপালনের দায়। সে জুতো পরিয়ে দিয়ে চুল আঁচড়ে দিয়ে শার্ট পরিয়ে দিয়ে নিয়ে গেছে টিন্টোকে টিউশনে। কিন্তু জুতোটা কিনে এনেছে স্বস্তিকা, চিরুনি হারিয়ে গেলে কথা শুনতে হয়েছে স্বস্তিকাকে, শার্টের বোতাম না থাকলে স্বস্তিকার সামনে ছুঁড়ে ফেলে বলা হয়েছে, দেখে রাখতে পারো না, আদ্ধেক শার্টের বোতাম নেই?
আসলে , একটাই তফাত থেকেছে। সোমদত্ত যা যা করেছে, সেগুলো সোমদত্ত ইচ্ছায় করেছে। ওর করার কথা ছিল না বাধ্যতা ছিল না তাও করেছে।
বাই ডিফল্ট ওগুলো সব স্বস্তিকার করার কথা ছিল। সোমদত্ত করে, তাকে ধন্য করেছে, হেল্প করেছে। সোমদত্তের করাটা সোমদত্তের ক্রেডিট। আর স্বস্তিকার না করাটা, স্বস্তিকার ত্রুটি। তাকে চিরজীবন অপরাধী হয়ে থাকতে হয় এই তথ্যের জন্য, যে, সে যখন অফিসে থাকত তখন তার সন্তানকে শাশুড়ি দেখত, আয়া দেখত, অনেক সময় আগে ফিরে এসে সোমদত্তও দেখত।
অন্যেরা যে যা অবদান রেখেছে টিন্টোর জীবনে, কোনটাই বাই ডিফল্ট ছিল না। সেগুলো অবদান ছিল। আর স্বস্তিকা যা করেছে? একজন মায়ের তো তা করারই কথা। সেজন্যে আলাদা করে কোন থ্যাঙ্কস প্রাপ্য আছে নাকি আবার? ওটাকে কোন কাজ বলতেই নারাজ তো, সমাজ। ওগুলো তো তার কর্তব্য।
পেট থেকে পড়েছে কার, বাচ্চাটা, শুনি?
করবে না মানে?
টিন্টো একদিন বড় হয়ে যাবে, শিগগিরি একদিন সে নিজের জীবন খুঁজে নেবে। তারপর অচিরেই নিজের জীবন সঙ্গিনীও।
তখন , সেই জীবন সঙ্গিনীও , টিন্টো কি চাইবে, করুক সব কাজ বাই ডিফল্ট?
কমিটিতে এক বিকেল
মাধবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের চোখে ঘুম উড়ে গেছে। প্রথমে খুবই কড়া স্ট্যান্ড নিয়েছিলেন ওঁরা। ইনডিসিপ্লিন সহ্য করা হবে না।
বলা হয়েছিল।
গোটা চত্বরে নানা ধরণের কথা উড়ে বেড়ায়।
ছাত্রদের প্রথম ও প্রধান দাবি ছিল , সুপ্রিম কোর্টের বিশাখা গাইডলাইন , যা পরে রূপান্তরিত হয়েছে আইনে, সেই অনুযায়ী একটি কমিটি তৈরি করতে হবে। কমপ্লেন্ট কমিটি। সেটা কোথায় হল। সেটা যতক্ষণ না হচ্ছে, হোক ঝঞ্ঝা চলবেই। বলেছিল ছাত্রেরা।
ইতিমধ্যে আরো একবার একটা মেয়ের সঙ্গে অসভ্যতার ঘটনা ঘটল। এবার ছাত্রীদের ঐ গ্রুপটা এগিয়ে এল,পিরিওডস গ্রুপ।
এবারও, ওপর থেকে খাঁড়া নামল, কিন্তু শেষমেশ ধোপে টেঁকেনি। একটু সাবধান করে দেবার চেষ্টা হল।
স্যার ম্যাডামরা বসলেন। চা বিস্কুট খেলেন। ওদের চারজনকে ডাকা হল।
ওরা এল। নরম দেখতে সব ছেলেপুলের বয়সী ছাত্রী এরা। এসব তুখোড় স্লোগান লিখে বিশ্রি বিশ্রি পোস্টারিং কেন করে? কী পায় এরা? সত্যি! ম্যাডাম রত্নমালা বসু ঘাম মুছলেন। সামনে বিরাট যুদ্ধ।
একে একে সবাই প্রশ্ন করলেন। প্রশ্নগুলি কেমন বাসনের মত ঝনঝন করে পড়ল, কোন দাগ কাটল বলে মনে হল না কোথাও।
তোমাদের এই ধরণের প্রোটেস্টের উদ্দেশ্য কি?
ধাক্কা দেওয়া। ঝাঁকুনি দেওয়া।
এই মেয়েটাই নাটের গুরু। কী ভাজা মাছটি উলটে খেতে না জানা চেহারা। প্রিন্টেড টপ পরা, মিষ্টি মুখ। উফ। ধানী লংকা একেবারে।
এই ঝাঁকুনির ফল তো বিরূপও হতে পারে। সে কথা ভেবে দেখেছ কি?
হ্যাঁ সেটা তো একটা রিস্ক ফ্যাক্টর বটেই।
চুপ করে গেল ওরা। কিন্তু চোখ নামিয়ে নিল না। মাথা নিচু করল না। সটান তাকিয়ে রইল।
শোন, এভাবে ওই সব জিনিশের ওপর পোস্টার না লিখে কাগজে পোস্টার লিখলেই ভাল হত না কি?
ওই সব, মানে, কোন সব? এত এঁচড়ে পাকা একটা মেয়ে, বলে বসল।
খুবই ভাল জান কোনসব। শোন, যে বস্তুটি গোপনীয়তার তাকে গোপন রাখাই ভাল। পেচ্ছাপ পায়খানা এগুলো যেমন। মানুষ তো সভ্যতার সরণি ধরে অনেকদূর এসেছে, না কি?
কিন্তু আমরা ত এই গোপনীয়তাটার বিরুদ্ধেই লড়ছি স্যার। কেন এত গোপনীয়তা মাসিক অর্থাৎ পিরিয়ডস নিয়ে? এটা অশুদ্ধ, এটা খারাপ। এটা অপবিত্র। এগুলো তো মধ্যযুগীয় ব্যাপার। আজকের দিনে যখন অনেক ভাবে স্বাস্থ্য রক্ষার উপায় বেরিয়ে গেছে, তখন এসব কেন?
সবই বুঝলাম, কিন্ত এটা তো মানবে যে ঐভাবে মানুষের ব্যক্তিগত রুচিতে আঘাত দেওয়াটা একটু বাড়াবাড়ি? বলেই অধ্যাপক সুভদ্র সেন চুপ করে গেলেন। চোখ নামিয়ে নিলেন নিজেই । ওরা প্যাট প্যাট করে তাকিয়ে রইল।
সুতো টা তুলে নিলেন রত্নমালা বসু। জানো, সারা ভারতে কত কত মহিলার একটা স্যানিটারি প্যাড কেনার পর্যন্ত সামর্থ্য নেই। সেই জিনিশটাকে নষ্ট করেছ তোমরা। ওয়েস্টফুল এক্সপেন্ডিচার।
আমাদের লিফলেটে ত আমরাও সেটা লিখেছি ম্যাম। আসলে এই বিষয়ে চেতনা জাগ্রত করার একটা উদ্দেশ্যও তো আমাদের আছে। যদিও আমাদের শুধু মৌখিক ভাবে নয়, ভার্চুয়ালিও অ্যাটাক করা হচ্ছে। আমাদের ফেসবুক পেজে নানারকমের কমেন্ট করছে অনেকেই। কেউ কেউ তো ওপেনলি বলছে মেয়েরা অশিক্ষিত, মেয়েরা নির্বোধ। অকারণে মুখ খারাপ করছে... আমার মনে হয় ম্যাম, এই অ্যাটাকগুলোই প্রমাণ করে যে আমরা একটা ঠিক জায়গায় ঘা দিতে পেরেছি। বছরের পর বছর মেয়েরা নীরব থেকে গেছে। চেঁচিয়ে কথা বলবে না, ছুটবে না দৌড়বে না। আস্তে আস্তে হাঁটবে। হাসবে না। কাউকে নেগেট করবে না। জোরের সঙ্গে না বলবে না।
অন্য একটি মেয়ে মুখ খুললঃ জানেন ম্যাম, আমরা তো কোন ছাড়, একজন এস্টাবলিশড লেখক , যিনি বাই দ্য ওয়ে মহিলা, তাঁকে একটা লোক ফেসবুকে বলেছে, 'হাই প্যান্টিদি'। তিনি জিগ্যেস করেছেন, 'মানে ! কী নাম বললে !!' সে তখন বলল, 'কেন? তোমার লেখায় তো কেবল ব্রা, প্যান্টি এসবের কথা থাকে। প্যান্টি বলে তোমাকে ডাকতেই পারি' !!!!!
মুখ খুলল অলক্তিকা। স্যার, আমাদের এখানে আসলে পুরুষদের সব রকমের অসভ্যতা করার লাইসেন্স আছে। তারা যে কোন খারাপ কথা মুখে আনতে পারে, যে কোন কথা অশ্লীলভাবে ইঙ্গিত করে বলতে পারে। আর মেয়েরা নিজেদের হকের কথাটা বলতেই লজ্জা পায়। এটাই মুশকিল।
ঠিকাছে ঠিকাছে। অস্বস্তি প্রকট হয় সুভদ্র সেনের মুখে। খুব আলতো করে, যেভাবে নোংরা কাগজ তুলে নিয়ে ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া হয়, সেভাবে বলেন, ওকে ওকে, আমি আপাতত এই মিটিং শেষ করতে চাইছি। তোমারা ভবিষ্যতে এই ধরণের প্রোটেস্ট আর করবে না এইটুকু কথা দিতে হবে। অন্য প্রোটেস্ট কর, ইফ ইউ ওয়ান্ট টু মেক এ পয়েন্ট। কী, কথা দিচ্ছ তো, এই সব প্যাডফ্যাডের ওপর লিখবেনা?
মুখ টিপে হাসে অলক্তিকা। বলে, সেটা আমরা ভেবে দেখতেই পারি স্যার। এনিওয়ে, একই ধরণের প্রোটেস্ট করলে চমক থাকে না। ভবিষ্যতে অন্য কোন মেথড ভাবা যেতেই পারে। আমরা এখনো সেসব নিয়ে ভাবিনি। তবে স্যার, আমাদের মেন দাবিগুলো যেন নোট করে কমিটি। যেন একটু ভেবে দেখা হয়, সব ডিপার্টমেন্টে একটা করে লেডিস টয়লেট চাই, যেটা সন্ধে সাতটার সময় চাবি দিয়ে কেউ চলে যাবে না। আর একটা করে স্যানিটারি প্যাড ডিস্পেন্সার চাই।
হ্যাঁ, আমরা নোট করে নিলাম। আমরা লিখে দেব যে এইসব দাবি জানাতেই তোমরা ওই শকিং ক্যাম্পেনটা করেছিলে। বাকি সব আমি নোট করছি না। ধাক্কা ফাক্কা ওসব আবার কি। বাচ্চা বাচ্চা মেয়ে সব।
হুম।
প্রথমার শেষ ক্রোধ
“নারী ও পুরুষের অবস্থা ও অবস্থান বিচারে প্রকৃতির মধ্যেই একটা শক্তির ভারসাম্যহীন ত্রুটি অাছে। সেই ত্রুটির সুযোগ নিয়ে নারীকে নিগ্রহ না করে নারীর সহযাত্রী ও সহমর্মী হওয়াটাই হচ্ছে কালচার।নিজের জন্মের বা অামাদের অনাগত সন্তানদের জন্মের প্রয়োজনেই নারীদেহের দুর্বলতাকে শক্তিকেন্দ্র রূপে বিবেচনা করে, নারীর কাছে নতজানু হতে হয় পুরুষকে। নারীকে পীড়ন করার মধ্যে পুরুষের শক্তি নয়,তার অসভ্যতা ও দুর্বলতা প্রকাশ পায়। “- লিখেছেন বাংলাদেশের বিখ্যাত কবি নির্মলেন্দু গুণ। আজ। ফেসবুকে!!!!
দেখে ঝাঁট জ্বলে গেল প্রথমার। প্রথমা এখনই উত্তর দিতে যাচ্ছিল বেশ একটা কড়া করে, কিন্তু দিল না। অনেক কাজ পড়ে আছে। যে পেপারটা লিখছে, সেটার ভেতর অনেকগুলো অংশ এখনো ঢলঢল করছে, টাইট দিতে হবে স্ক্রুগুলোয়। পেপার লেখা তার নেশা আর পেশা , নানা জায়গায় ছাপানোর পথও আগের চেয়ে অনেক প্রশস্ত। কিন্ত মাঝে মাঝেই মনে হয়, এইসব আন্দোলন, পেপার লেখা, এইসব এন জি ও দের কাজ, সাধারণ মানুষের মাইন্ডসেট পাল্টাতে কতটুকুই বা কাজে লাগছে।
ভাবতে ভাবতে প্রথমা সংসারের কাজও করে। সুনন্দনা হোস্টেলে চলে গেছে বলে তার ফাঁকা ভাব এখনো আছে। এমপ্টি নেস্ট সিনড্রোম।
নিজের প্রাক্তন স্বামী সুস্নাতর কথা ভাবে প্রথমা। রাগ হয় একটু একটু। যদিও ভুলেই গেছে, তবু মনে পড়ে যায় একটা সময়, এই সুনন্দনাকে মানুষ করার জন্যই কত কথা শুনতে হয়েছিল ওকে। সুস্নাতরকাছে। ফিজিকাল টর্চারই কি শুধু একটা হাতিয়ার? অথবা অনিচ্ছুক স্ত্রীর ওপর রতিক্রিয়ার জন্য চড়াও হওয়া, এরকম কত না উপভোগ, যাকে ধর্ষণ নাম দিতেও আমাদের সমাজ নারাজ? সেগুলো বাদে, মানসিকভাবে , সমাজ যেহেতু পুরুষের স্বপক্ষে, কত সহজেই মেন্টালি একটা মেয়েকে দাবিয়ে রাখা যায়। শুধু একটা ভুরু তোলা, শুধু একটা নাক শিঁটকোন। ড্রাইভিং যখন শিখছিল প্রথমা, শুরুর দিকের নার্ভাসনেসটুকু মনে আছে। সুস্নাত সেভাবে উৎসাহ দেয়নি কখনো ওকে, উলটে সাবধান, সাবধান, চাপা টাপা দিয়ে দিও না লোকজনকে ইত্যাদি বলে মনোবল আরো কমিয়ে দিয়েছিল।
পরে প্রথমা রীতিমত ভাল চালিয়েও কোনদিন গাড়ি চালানোর ব্যাপারে সুস্নাতর সার্টিফিকেট আদায় করে উঠতে পারেনি।
অন্যদিকে রাস্তায় বেরোলেই, সব সময়েই, এই রে , ওই একটা মেয়ে গাড়ি চালাচ্ছে, সাবধানে হাঁটো, ঘাড়ের ওপর তুলে দেবে গাড়িটা, বলতে কখনো অসুবিধে হয়নি সুস্নাতর।
এই মহামান্য সিনিয়র কবি বলে দিলেন, নারীদেহের দুর্বলতাকে শক্তিকেন্দ্র রূপে বিবেচনা করে, নারীর কাছে নতজানু হতে হয় পুরুষকে। বোঝ! নিজের ভেতরের গেঁড়ে বসা পুরুষতন্ত্র... কীভাবে ফুটফাটা দিয়ে বেরিয়ে আসে, কেউ জানেওনা। অথচ উনি আসলে বাংলাদেশের নারী নিগ্রহের প্রতিবাদে এসব লিখেছেন, এই তার নমুনা। পেট্রনাইজ করা ছাড়া আর কোন্ ভাবেই বা পুরুষ নারীর প্রশংসা করেছে। এই আর কি, আমি তোমাকে ভাল বলে দিলাম তুমি ধন্য হয়ে গেলে। আমি তোমাকে করুণা দিলাম দয়া দিলাম, তুমি আমার কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকো।
নিজের জন্য কালো কফি বানিয়ে নিচ্ছিল এক কাপ, প্রথমা। এবার লিখতে বসবে। তার আগে রান্নাঘরের মার্বেল টপ কাপড়ের টুকরো দিয়ে পরিষ্কার করে নিতে নিতে ভাবছিল, এই পুরুষ সাহিত্যিকদের দয়াদাক্ষিণ্য আমার অসহ্য লাগে। অবলাবান্ধব পোজিশন নিয়ে এই যে উনি সহমর্মিতার কথা বললেন নারীবাদীদের রাগ দেখলে তো উনি বমকেই যাবেন। তাই এই অবলাবান্ধবদের ইচ্ছেমত মুখ তোড় জবাব দিতেও মায়া হয়। নিজের মা বা বোন ছাড়া এনারা মেয়েদের ভাবতেও পারেন না।
আর মেয়েরাও তেমন । কী কনফিউজড সবাই। এই সব স্ট্রিং এ মেয়েরাও তো লেখে। সকলেই অবান্তর চীৎকার করতে থাকে। নানা সময়ে মনে হয়েছে প্রথমার, আসলে থিওরেটিকালি আমরা খুব শক্তপোক্ত জায়গায় নেই। অধিকাংশ মেয়েকেই এসব পড়তে কেউ উৎসাহও দেয়না, হাতের কাছে জুগিয়েও দেয়না।
নিজের কাজ শেষ করে, দুপুরে কাঁধে কাপড়ের বড় ঝোলায় করে, বেশ কিছু কাগজপত্র নিয়ে বেরোয় প্রথমা।
লেখার কাজগুলো আজকের মত শেষ।
এইবার আসল যুদ্ধ। এই শহরের একমাত্র মানবীবিদ্যাচর্চাকেন্দ্র সেন্টার ফর উইমেন্স স্টাডিজ। তার মাথায় বসে আছেন যিনি, ভাগ্য বা দুর্ভাগ্যক্রমে তিনি একজন পুরুষ । এবং পন্ডিত। পান্ডিত্যগর্বে তাঁর মাটিতে পা পড়ে না।
অটো থেকে নেমে দ্রুতপায়ে হেঁটে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে থাকে প্রথমা।
আপনি মহামহোপাধ্যায় ডাঃ তদ্ভব চট্টোপাধ্যায়। কাজেই আপনি ভুল হইতেই পারেন না। হইলে আমিই ভুল।
এই ভাবনা ভেবে কাচের দরজা ঠেলে ঢোকে সে। প্রথমা। চাকরির জায়গায়, সর্বদা তার মনে হয়েছে, গ্লাস সিলিং সে দেখতে পায়না, কিন্তু কাচের দেওয়ালগুলো তো পায়!
প্রথমা পুরুষ কলিগদের ঘৃণা সন্দেহ অপবাদ আর লালসামাখানো চোখ দেখেছে। তাদের বন্ধুত্বও দেখেছে। ভাল লাগার মত সমমনস্ক কজন তো আছে। তা থাক, তারা তোলা থাক মনের নানান খুপরিতে।
বাইরে যে কটা আছে, তার মধ্যে একটা পিস হল এই তদ্ভব চট্টোপাধ্যায়।
প্রথমত যে লোকের জন্মের সঙ্গে সঙ্গে তার বাবা নাম রাখে তদ্ভব সে আর কতটা আই কিউ সম্পন্ন হতে পারে। বাবার থেকেই তো ছেলের আই কিউ জন্ম লয়। বাবা, শ্রী নিবারণ চাটুজ্জে। শিক্ষিত হয়েই ক্ষান্ত দেননি। দুনিয়াশুদ্ধ লোককে জানাবার ব্যবস্থা করেছিলেন যে শিক্ষিত তিনি। অধ্যাপনা করেছিলেন, তা করুন না গিয়ে। তাই বলে বাংলা ভাষাবিদ্ ভদ্দরলোক শেষ মেশ নিজের দুই ছেলের পর পর নাম রাখলেন তৎসম আর তদ্ভব!
সেই তদ্ভব আপাতত মানবী বিদ্যা বিভাগের অন্যতম অধ্যাপক এবং প্রথমার বস। কেননা নিজের লেখালেখি বাদ দিলে, এই ডিপার্টমেন্টে কিন্তু প্রথমার কাজটা কিছুটা ক্লেরিকাল। সে এই বিশালমাপের আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম অতি সাধারণ নাটবল্টু মাত্র।
কিন্তু নারী তো বটে।
মানবীবিদ্যা বিভাগ বলে নারীর মর্যাদা অন্য বিভাগের একশো গুণ হবে এমন কোন মুচলেকা দিয়ে কেউ এখানে চাকরি করতে ঢোকেনি। মাধবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে এমনিতেই একটু অ্যাটিচ্যুড সম্পন্নদের ভিড়। উপরন্তু, ইঞ্জিনিয়ারিং এর শিক্ষকদের মধ্যে মহিলাদের অপ্রতুলতা বশত ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর শিক্ষিকা মঞ্জুলা সেন সম্প্রতি এক সেমিনারে যেমন তুলে ধরেছিলেন, অদৃশ্য গ্লাস সিলিং এর উপস্থিতির কথাটা, তেমনটা মানবীবিদ্যায় নেই বলেই যেহেতু সবাই ধরে নেয়, সেই হেতুই একটা বিপুল শ্লেষ হয়ে আসে এটা প্রথমার কাছে যে, তাদের ডিপার্টমেন্টে না আছে ভাল একটা লেডিজ টয়লেট, না আছে তদ্ভবদার তাঁর জুনিয়র মহিলা কর্মীদের প্রতি বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা।
বাজে বাজে প্লাইউডের তক্তায় তৈরি দরজাগুলোর একটা, হেডের ঘরে, কাচ হয়েছে। সেই কাচের দরজার ওপারে এ সি আছে।
তদ্ভবদা সেখানে বসেন। আর বাকিরা, অন্যান্য ঘরে বসে ঘামেন।
কিন্তু সেটা তত খারাপ নয়। খারাপ ব্যাপারটা হল, তদ্ভবদা নিজের এই আলাদা অবস্থান সম্বন্ধে একধরণের মানসিক দৈন্যে ভোগেন। ওনার ধারণা উনি আলাদা ঘরে বসেন তাই অন্য ঘরটায় যা কিছু হয় সবই ওনার বিরুদ্ধে।
ওনার ধারণা প্রথমার মত অধ্যাপক নয় কিন্তু চালাক চতুর কেরাণিরা বিশেষভাবে সন্দেহের যোগ্য। পারলে প্রথমা ওনার ফোন ট্যাপ করতেই পারে, অথবা শ্রেডার মেশিনে ফেলে দেওয়া চিঠিগুলো পরে আঠা দিয়ে জুড়ে জুড়ে পড়ে নেবে। অথবা সে ড্রয়িং অ্যান্ড ডিসবার্সিং অফিসার সুকোমলবাবুর সঙ্গে ফ্লার্ট করে কোন বিশেষ সুবিধে হয় নিজে পেয়ে নিচ্ছে, নয়ত অন্যদের পাইয়ে দিচ্ছে।
ওনার আর কী কী ধারণা না জানলেও, আন্দাজ করতে পারে প্রথমা। ওনার বডি ল্যাংগুয়েজে সন্দেহপ্রবণতা।
সবচেয়ে বড় কথা, উনি নিজে সবরকমের সুযোগ নেবেন, ধান্ধাবাজি করবেন, আর ভাববেন, যে অন্যরা সুযোগ নিচ্ছে , ধান্ধাবাজি করছে।
এটাই প্রথমার সহ্য হয়না। আর সেই কারণেই ভদ্রলোক ওকে দেখতে পারেন না।
উনি নিজের মসৃণ কেরিয়ার গ্রাফে উঠছেন শুধু উঠছেন। বই এডিট করে কাগজে নাম বেরোবে, দু তিনটে বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দিয়ে নাম করবেন, এটা ওটা সেটা। তারপর টি এ বিলে জালি করবেন। সেটা প্রথমা ধরে ফেললেও তার মুখ বন্ধ যাতে থাকে সেজন্য তদ্ভবদা আরো অনেক কিছু করবেন, যেগুলো নামান্তরে ব্ল্যাকমেলিং।
যেমন, সন্ধে অব্দি বসিয়ে রেখে দেবেন ওকে, কাজের ছুতোয়। বাড়ি যেতে দেবেন না। সামনে নোটপ্যাড আর পেনসিল নিয়ে বসে থাকতে থাকতে দেখবে প্রথমা, ঘড়ির কাঁটা গড়িয়ে যাচ্ছে আর উনি ফোনে হ্যাজাচ্ছেন কাদের কাদের সঙ্গে যেন।
তারপর সাড়ে আটটা নাগাদ উনি বলবেন, টি এ বিলের ফাইল আনতে।
বাড়ি যাবার তাড়ায় যাতে ততক্ষণে অধৈর্য প্রথমা আর ছোট ছোট সমস্যাগুলো নিয়ে কথা বলতে না পারে।
প্রথমা জানে, সাড়ে আটটা অব্দি অফিসে থাকাই যায় যদি কাজ থাকত। কিন্তু কাজ নেই। বসে বসে তদ্ভবদার গল্প শোনাটাই কাজ এখন।
তদ্ভবদা জানেন, সাতটার পর সব লেডিজ টয়লেট বন্ধ হয়ে যায়।
ছাত্রীরা দেরি অব্দি বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে যে পড়াশুনো করবে, তা তাদের নিজেদের রিস্ক এবং কস্টে। কষ্ট করো, নইলে কেষ্ট পাবে না।
ছেলেদের টয়লেটগুলো খোলা থাকে সারারাত। মেয়েদের গুলোয় তালা পড়ে। সংখ্যার হিসেবেও মেয়েদের টয়লেট অসম্ভব রকমের কম। নিজেদের ডিপার্ট মেন্টে নেই, যেতে হয় পাশের ইংরিজি ডিপার্টমেন্টেরটায়। সাতটার পরে সেটায় কে বা কারা তালা দিয়ে যায় কেউ জানে না।
প্রথমা দাঁতে দাঁত চেপে বসে থাকে। তার বাড়ি কলকাতার সম্পূর্ণ অপর প্রান্তে। বাস ঠেঙিয়ে বাড়ি ফিরতে দশটা বাজবে।
প্রিয়নাথের পেনশন
প্রিয়নাথের গিন্নি সুরমা দেবির চেহারাটা বর্তুলাকার। বাহুমূলের কাছটা মেদবৃদ্ধির ফলে থলথলে, এখন বাড়িতে স্লিভলেস হাতা ব্লাউজের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা বৃহত দুটি মাংসথলির মত হাত, আর হাতের বাজুবন্ধ, তামার তৈরি, গ্রহশান্তির জন্য যেটা বহুদিন আগে তৈরি করা হয়েছিল, দেকলে প্রিয়নাথের দীর্ঘশ্বাস উঠে আসে।
গৃহিণী যদি এই পরিমাণ মিষ্টান্ন সেবন না করতেন। বেলা চারটের সময় কষে ডাল আর ভাতের সঙ্গে একগাদা মাছের মাথা না চিবোতেন, শেষ পাতে দুধ আমটুকুও বর্জন করতেন। তা তো তিনি করবেন না, আর করবেনই বা কেন, শেষ বয়সে এসে তিনি মোক্ষম জেনেছেন, রসনায় সেরা বাস বাসনার।
সুরমার দিক থেকে যদি ব্যাপারটা দেখা যায় , তাহলেও সেম টু সেম যাকে বলে।
হুঁ , বুড়ো বয়সে ভিমরতি ধরেছে। সারাপাড়া টো টো করে আসবেন, বেলা দশটায় একগাদা মাছ তরকারি ফল কিনে এনে ঢুকবেন। এত বাজার করার কী আছে বাপু। বলেনা, কামনা বাসনা সব গিয়ে ওই জিভে এসে ঠেকেছে।
এ বাদে, প্রিয়নাথ মাঝে মাঝেই পুরো হিসেব দেননা, নিজের পৌরুষের গর্বেই দেননা। আমি হলুম গে বাড়ির কর্তা। আমাকে বাজারের হিসেব চাইছ?
এতদিন চাকরি করেছেন, এখন পেনশন পান, সবটাই তো তাঁর কারিকুরি, এই সল্ট লেকে নাহোক একটা একতলা বাড়ি তো তুলেছেন। এখনো শক্তপোক্ত, সকালে ছটা নাগাদ স্কুটারটা নিয়ে বেরিয়ে যান , এক এক পাড়ার বুড়োবুড়িদের ধরে ধরে হাত পা নাড়াচাড়া দিয়েও আমদানি মন্দ হয়না।
বুড়োবুড়িদেরও ক্ষতি নেই, বরং লাভ। একটু ফিজিওথেরাপিও হয়, মেন্টাল থেরাপিটাই বেশি হয়। যাকে বলে ভোকাল টনিক। মানুষের তো দুঃখের শেষ নেই। ভাল পয়সা রোজগার করেও তো কোন লাভ হবে না যদি না ভোগ করার মত শরীর বুড়ো বয়সে রাখতে পারে। অধিকাংশই ওই রোগের রোগী। ষাটের কোঠাতেই ঝিমিয়ে পড়েছে।
প্রিয়নাথের মত শরীর চর্চা করে ভোগের ক্ষমতা ঠিক রাখা মানুষকে দেখলে ওরাও একটু উজ্জীবিত হয়। ওদের মেন্টাল টনিক দেন প্রিয়নাথ, গান গেয়ে গল্প করে। সব সময় পজিটিভ থেকে।
এ বাড়ি ওবাড়ি চা বিস্কুট, সেদিন হয়ত কারুর ছেলে ছেলের বউ পুরী থেকে ফিরেছে, সেই খাজা পড়ল সঙ্গে। কারুর বিদেশ থেকে ঘুরতে আসা মেয়ে জামাইয়ের আনা ছোট্ট ছোট্ট চকোলেট ফ্রিজ থেকে বেরোল। এসব খেয়ে, তারপর ফেরার পথে বাজারে থেমে, বাজারের মিষ্টির দোকান থেকে ফ্রেশ ফ্রেশ কচুরি তরকারি অথবা গরম ফুলকপির সিঙাড়া, ভেতরে ছোট ছোট কুচি চিনেবাদাম দেওয়া... খেয়ে, ফেরেন।
তারপর দুপুরে গিন্নির হাতের রান্না।
শরীরটি ধুমসি হয়ে গেছে বহুদিনই। কিন্তু তাতে কী আর হল। রান্নার হাতটি এখনো চমৎকার। বেজায় ভাল মাছের তেলের বড়া অথবা পোস্তর বড়া বানায়। ঝোল, অম্বল, ঝাল, কোনটাতেই বাদ নেই। বাজার করার সময় কখনো কখনো তাই এক্সেস হয়ে যায়। এটাও নিই, ওটাও নিই।
তারপর সুরমার মুখঝামটা খেতেই হয়।
আজ প্রিয়নাথের মনটা ভাল নেই। মন ভাল নেই এমন ব্যাপার তাঁর সচরাচর একটা হয়না।
আসলে কয়েকদিন ধরেই খুব অপমানিত বোধ করছেন।
প্রাংশুবাবুর বাড়িতে আগে চাঁদের হাট লেগে থাকত। প্রাংশুবাবু, তাঁর স্ত্রী দুজনেই মাটির মানুষ। প্রাংশু অ্যালজাইমারের পেশেন্ট, এখন প্রায় অথর্ব। চোখের দৃষ্টিতে চেনা নেই। একদা যখন টাকী স্কুলে পোস্টেড ছিলেন প্রিয়নাথ, খুব ঘনিষ্ঠতা ছিল। প্রাংশু তখন সেখানে অ্যাসিস্টেন্ট হেড মাস্টার। সেই থেকে মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে চেনা পরিচয়।
দুই ছেলে প্রাংশুবাবুর, বড় ছেলে বউমা এখন ওঁদের সঙ্গে থাকে না, তাদের বছর উনিশকুড়ির ছেলেটি থাকে। কী যেন নাম, অর্চি। ছেলে সল্ট লেকের ল কলেজে পড়ে। কাছে পড়ে এ বাড়ি থেকে। সে অবিশ্যি কথাটথা বলেনা, নিজের ঘরে গ্যাঁট হয়ে বসে থাকে। আজকালকার ঘাড়ের রোঁয়া ফোলানো যুবা।
তা ছাড়া প্রাংশুবাবুর ছোট ছেলে আর তার বউ, তাদের একটি পনেরো বছরের ছেলে আছে। সে একটা গোবলা গাবলা , গোবেচারা।
প্রাংশুবাবুর এই ছোট ছেলেটি , সোমদত্ত, খুব মিশুকে, সদাহাস্যময়। তার বউটি, নাম স্বস্তিকা। তাকে নিয়েই একটা ঝামেলা ।
কথাটা ভাবতে গিয়েও প্রিয়নাথ সরিয়ে রাখতে চান। ইচ্ছে করে না ভাবতে। কেনই বা মিছিমিছি লোকের কু গাইবেন।
আসলে স্বস্তিকাকে ভগবান অনেক দিয়েছেন। যাকে বলে উচ্ছলিত যৌবন। খুব হাসিখুশি, খুব মিশুকে বলেই মনে হয়েছিল প্রথমটায়। ঘরে থাকে, কাজ কর্ম করে, সবটাই ভাল, ভাল।
কিছুদিন যাবত ওর আচরণে কেমন যেন এক অস্বাভাবিকতা দেখেন প্রিয়নাথ। ও যেন প্রিয়নাথকে এড়িয়ে এড়িয়ে যেতে চায়। সেটায় একরকমের সুড়সুড়ি লেগেছিল প্রিয়নাথের মনেও। আহা, নারীর এই লজ্জাবনত দৃষ্টি বড় সুখকর। কতদিন এমনটা দেখেননি। “মা” “মা” করে কথা বললেও, প্রিয়নাথের নিজের মনের অগোচর ছিল না ওই কথাটিও, যে স্বস্তিকার দিকে তাকাতে তাঁর বেশ ভালই লাগে।
স্বস্তিকাও যেন সেই দৃষ্টিটি উপভোগ করতে করতেই কবে কোথায় বেধে গেল।
কিন্তু কেন? এককালে বাংলা গল্প উপন্যাস পড়তেন প্রিয়নাথ। অনেক পড়েছেন শরদিন্দু পরশুরাম। এখনকার লেখাটেখা বিশেষ বোঝেন না। পড়েনও না। টাকা নষ্ট করে গাদা গাদা পূজাসংখ্যা কিনে ফেলে রেখে কী হবে। সে পাট চুকেছে।
পরশুরামের গল্পে সেই যে ছিল, মেয়েদের যাঃ মানেই হ্যাঁ।
সে কথা বার বার মনে হয় প্রিয়নাথের।
স্বস্তিকা তো একসময় তাঁকে খুব কাকু কাকু করত। অনেক মজার কথা বলতেন ওকে, সোমদত্তকে। আজকাল সামনেই আসে না। আর সেটা বড্ড বুকের মধ্যে ঢেউ তুলছে তাঁর। এক অন্যরকমের ভাল লাগা।
কিন্তু টানা এই গত এক সপ্তাহে ও বাড়ি গিয়েও এক মুহুর্তের জন্য স্বস্তিকাকে দেখতে পাননি। আর সোমদত্তও যেন কেমন একটা কাঠ কাঠ ভাবে কথা বলল। কীসের এই আড়ষ্টতা?
এদিকে হয়েছে আর এক বিপত্তি। প্রিয়নাথের জীবন এখন পেনশন নির্ভর। বন্ধুবান্ধব যারা আছে অনেকেই প্রাক্তন সহকর্মী, সবাই পেনশনার। তারা সবাই মিলেই আলোচনা করেন, গতবছর সরকারি যে পে রিভিশন হল, তার এফেক্ট কিন্তু পেনশনে পাওয়া গেল না। এজি বেঙ্গলে বলে চলেছে, হচ্ছে হবে। এক গাদা টিচারদের কেস নাকি জমা পড়ে আছে। কী এক পেনশন সেল হয়েছে, তারা একটি একটি করে পেনশন কেস ধরবে আর সেটল করবে, রিভিশন করবে।
মানে হতে হতে আরো দুই বছর।
এতদিন ধরে পড়ে থাকা কেস। কবে রিভিশন হবে। এফেক্ট কবে থেকে পাওয়া যাবে। এরিয়ার কিছু পাওয়া যাবে কিনা, যদি এফেক্টিভ ডেট হয় সেই গত বছরের পে রিভিশনের তারিখ, তাহলে তো এরিয়ার পাওয়াই উচিত।
এসব নানা প্রশ্ন জমেছে পেনশনারদের মাথায়। সবটার উত্তর নেই। পাওয়া যাচ্ছে না। এজি বেঙ্গলে প্রতিপত্তি খাটানোর দরকার, চেনাশুনো কাউকে বার করার দরকার।
হঠাৎ মাথার মধ্যে চিড়িক করে উঠল প্রিয়নাথের। আরে, স্বস্তিকা মা না এজি বেঙ্গলের কেরানি? সেইরকমই তো শুনেছিলেন বটে। সোমদত্ত যদিও প্রাইভেট সেক্টরে আছে, স্বস্তিকা সরকারি চাকরি করে তো।
আসলে অনেকদিন স্বস্তিকার সঙ্গে দেখাই নেই। তাই এসব প্রসঙ্গ উত্থাপন করা যায়নি। ইতিমধ্যে বন্ধু পেনশনারদের ফোন আসা শুরু। প্রিয়নাথ , ভায়া, দেখো না, তোমার তো কত চেনাশুনো। হাত পা টিপে তো এখনো প্রায় ঘরে ঘরে অবাধ গতি।
তো, সেদিন সকালে প্রাংশুবাবুকে বরাদ্দ সময়ের চেয়ে বেশিই দিলেন প্রিয়নাথ। অনেক খন ধরে হাত পা ডলে মুচড়ে, জয়েন্টগুলো নেড়েচেড়ে দিলেন। তারপর বৌদিকেও। সকাল গড়িয়ে গেল, সোমদত্ত, দেখলেন টেবিলের ওপর ঢাকা দেওয়া পাঁউরুটি ডিম নিয়ে খেল, তার মানে বোঝা যাচ্ছে, উনি আসার আগেই সব খাবার রেডি করে রেখে গেছে স্বস্তিকা, করে, নিজের শামুকের খোলে গিয়ে ঢুকেছে। মাঝে মাঝে ঘর থেকে কথার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে, ইস্কুল যাবে বলে রেডি হচ্ছে টিন্টো। ওদের ছেলে। ঠিক সাড়ে আটটায় ওর স্কুল বাস আসে।
কথাটা গলার কাছে এসে আটকে আছে প্রিয়নাথের। বলেই ফেলবেন, মরিয়া হয়ে গেলেন। সোমদত্তকে বললেন, স্বস্তিকা মা আছেন নাকি? ওর তো এজি বেঙ্গলেই কাজ, তাই না? পেনশন নিয়ে একটা ভীষণ বিপদে পড়েছি সেইটা নিয়ে কথা বলার ছিল।
সোমদত্ত সামান্য থমকে যায়। অথবা সেইটে প্রিয়নাথের দেখার ভুল হয়ত বা। হয়ত এসব কিছুই তেমন ব্যাপার নয়। পুরো ঘটনাই তাঁর মনের কল্পনামাত্র। দু মুহূর্তের মধ্যে সোমদত্ত বন্ধ দরজার আড়াল থেকে ডাকে, স্বস্তিকা, একটু শুনে যাবে, প্রিয়নাথ কাকু কিছু বলবেন তোমায়।
প্রাংশুবাবু ও ঘরেই বসা। শিবনেত্র, বোধ হীন। বৌদি সামান্য কুঁকড়ে। বেতো রোগী তিনি।
সোমদত্ত চেয়ারে নিজের ডিম পাউঁরুটি থেকে মন তুলে স্বস্তিকাকে ডাকছে। ওদিক থেকে উত্তর আসছে না।
দুম করে ওদের ঘরের দরজা খুলে ইস্কুল ড্রেস পরা টিন্টো বেরিয়ে আসে। খুব তাড়া । ব্যাগটা বসবার ঘর থেকে টেনে তুলে নিয়ে কাঁধে গলাতে গলাতে বলে, মা বাথরুমে গেছে, অফিসের জন্য তৈরি হচ্ছে। এখন কথা বলতে পারবে না।
বলেই সাঁ করে দরজা টেনে বেরিয়ে যায়।
কান মাথা গরম হয়ে যায় প্রিয়নাথের । অপমানে ঝাঁ ঝাঁ করে ওঠে।
প্রিয়নাথ তবু নিজের শান্ত সৌম্যতা বজায় রাখেন, হাসি হাসি মুখে বলেন, ও আচ্ছা, হ্যাঁ হ্যাঁ, আমারই ভুল, এখন তো অফিসের সময়ই বটে। ঠিক আছে পরে কথা বলব। শরীর স্বাস্থ্য সব ঠিক আছে তো বৌমার? তোমাদের সবার? আচ্ছা উঠি তাহলে। ইয়ে, ওকে একটু জিগ্যেস কোরে রেখো তো রিটায়ার্ড স্কুল টিচারদের পেনশনের রিভিশন কবে নাগাদ শেষ হবে?
সোমদত্ত ডিম পাঁউরুটি থেকে মুখ তোলে না। অন্যমনস্কভাবে বলে – হুম।
বোঝা যায় , ওভাবে খবর পাওয়ার কোন সম্ভাবনাই নেই।
চা না খেয়েই উঠে যান প্রিয়নাথ আজ। বৌদি সাধাসাধি করতেই থাকলেন যদিও। তবু।
আচ্ছা, পরশুরাম ঠিক লেখেনি তাহলে, মেয়েদের নাঃ মানেই হ্যাঁ নয়, সব সময়ে!
উপসংহার
মানসী ফোন হাতে করে দাঁড়িয়েছিল। নিজের স্টেশন ছাড়িয়ে তিনটে স্টেশন পর এই হরিপুর। লোক কম। বাসরাস্তাও দূরে। এই লাইনে কখনো আসেনা।
আচ্ছা, বাড়ি থেকে আরো দূরে চলে যাচ্ছে মানসী? অমিতকে ফোন করতে ইচ্ছে করছে ভীষণ। মনে হচ্ছে কাজটা ঠিক হল না।
স্বপন বলেছিল আসবে। এল না তো?
মানসীকে ওর স্বামীর মুখ দূর থেকে হাতছানি দিচ্ছে। ছেলেটার মুখ আরো কাছে থেকে ডাকছে। এত ডাক, এত কাতর কাছে টানা, সব উপেক্ষা করে, কী করে দূরে চলে যাচ্ছে মানসী?
কাছে রেল পুলিশের লোক দাঁড়িয়ে আছে। অনেকটা জায়গা জুড়ে বালির বস্তা রেখে আড়াল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একজন খাকি উর্দিধারী। বিপদ বুঝলে, মানসীও তো ওদের কাছে সাহায্য নিতে পারত।
সে বিপদ এই বিপদ নয়। সে বিপদ দেশলাইয়ের আগুন অথবা ছোটখাটো একটা বান। কিন্তু বিপদ যখন সমুদ্রের ঢেউ হয়ে যায়, আগুনের গোলা হয়ে যায়, মাথা একেবারে গুলিয়ে যায়।
স্বপন বলেছিল মানসীর বরকে বলে দেবে। বলে দেবে বাড়ি বানানোর চক্করে, কিছু টাকা কম পড়ায়, মানসী গিয়েছিল ওদের গুদোমে। গুদোমের পেছনের ঘরটায় স্বপন মানসীকে নিয়েছিল, ঘেঁষের টাকা মেটাতে পারবে না বলেই দায়ে পড়ে মানসী তখন এই ভয়ানক ব্যাপারটা চেপে গেছিল।
তারপর থেকে ক্রমাগত টাকা নিয়ে গেছে স্বপন তার কাছে। কত টাকা যে দিয়ে গেছে শুধু বিধানের মুখ চেয়ে মানসী।
শেষদিন মানসী রেগে উঠেছে, আর পারেনি সহ্য করতে। বলে দিয়েছে, কিচ্ছু পাবে না আর। যা খুশি কর গে যাও। বলে দাও তোমার বিধানদাকে। কিচ্ছু এসে যায়না আমার। আর বেশি বাড়াবাড়ি করলে, পুলিশে খবর দেব আমি।
বলেই মনে হয়েছিল, ভীষণ ভুল করে ফেলল না ত?
ততক্ষণে স্বপনের গলা পালটে গেছে। সেই তেজ আর নেই। নরম হয়েছে। বলেছে, টাকা লাগবে না। তুমি শুধু একবার এসো। দেখা করব। আমার বউ মাগিটা খুব ঝাম করে রেখেছে। বাড়ি যাচ্ছি না অনেকদিন। হরিপুরের দিকে একটা ছোট ঘর নিয়েছি। আমাকে একটু লুকিয়ে থাকতে হচ্ছে।
তার আমি কি করব? তেজ কমে এসেছে মানসীর। তবু চোপা করেছে। তোমার বদ স্বভাব, বউ জানতে পারলে এমনি এমনি ছেড়ে দেবে, না? বোঝ এখন।
ওইরকম বল না। তোমার ঠান্ডা আঁচলে একটু জায়গা হবে না গো? তোমাকে না দেখে ভাল থাকিনা আমি। সত্যি বলছি। এসো।
কষ্ট হয় মানসীর। খুব কষ্ট। চোখে জল আসে। ঠোঁট দাঁতে চেপে সে দাঁড়িয়ে আছে। স্বপন আসতে বলেছিল , না এসে পারেনি। এসে ভুল করল না তো।
এখনো পাপী মন তার। এত খারাপ ছেলে, এত মন্দ লোক স্বপন। তবু সে কেন যেন মনের ভেতর থেকে স্বপনকে ফেলে দিতে পারেনা। কেন যে পারেনা।
এখনো রাতে পেশেন্ট দেখতে দেখতে মনে পড়ে, একদিন স্বপন তাকে কীরকম হাত চেপে ধরেছিল। কতটা মরদের মত। গায়ে ঘাম আর বিড়ি মেশানো উগ্র গন্ধ। স্বপনের বুকটা ভাবে ও। কান্না পায়।
দুটো লোক এসে দাঁড়ায় তার দু পাশে।
অস্বস্তিতে, ভয়ে কাঁটা হয়ে দুদিকে তাকায়।
খুব আস্তে লোকদুটো তাকে বলে, চলো।
তারপর তারা চলতে থাকে।
অন্ধকারের দিকে। মানসী সিঁটিয়ে যেতে যেতে ভাবে, আচ্ছা স্বপন সত্যি আছে তো , যেখানে ও যাচ্ছে?
হয়ত নেই। হয়ত এই লোকদুটোকে স্বপন পাঠিয়েছে, ওকে গুম করে দেওয়ার জন্য। জানে না মানসী। জানতেও চায় না।
ফোনটা বার করে ও, ছেলেকে একবার ফোন করবে বলে।
হঠাৎ ফট করে পাশের ষন্ডা মত লোকটা হাত বাড়িয়ে ওর ফোন কেড়ে নেয়, এই খানকি, ফোনটা দে!
ফোনটা টেনে নিয়ে ছুঁড়ে পাশের জলায় ফেলে দেয়। কচুরিপানার মধ্যে আস্তে আস্তে ডুবতে থাকে ফোন।
ওহ, ওই ফোন কত কষ্টে নিজের টিউশনির টাকা জমিয়ে জমিয়ে ছেলে আমাকে কিনে দিয়েছিল গো!
অন্য লোকটা ওর কোমরে হাতের বেড় দেয়। বলে , ফোন দিয়ে কী করবি। এখন তুই অনেক দূরে যাবি। ওখানে মোবাইলের টাওয়ার নেই।
পুলিশটাকে ছাড়িয়ে অনেকটা চলে এসেছে মানসী এখন। একবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে। দেবে নাকি এক ছুট। এখনো দরকার পড়লে বাস ধরতে দৌড় লাগায়। ভিড়ের ভেতর চেঁচিয়ে রাস্তা করে নিতে পারে। অত সোজা?
মানসী উল্টোদিকে ফিরে ছুটতে শুরু করে আচমকা।
এ্যাই , এ্যাই , পালাল! দুটো স্যাঙাত, স্বপনের , ওর পেছনে আসতে থাকে।
মানসী জানে, কাঠের মত পুলিশখোকাটা দাঁড়িয়ে থাকবে, ওর জন্য একটা আঙুলও তুলবে না। মাথা নিচু করে ও পাশের লোহার বেড়াটার তলা দিয়ে গলে নিচে নেমে যেতে থাকে। নয়ান জুলিতে। দূরে একটা ছোট জটলা, আগুনের ধোঁয়া, চায়ের দোকান। একবার ওদিকে গেলে, আর ওকে পায় কে।
* *
প্রথমা অটোতে উঠেছিল। সুনন্দনার একটা ওয়াটস্যাপের চ্যাট পড়ছিল। সুনন্দনা লিখেছে, মামসু, তুই কবে আসবি? আমার খুব মন খারাপ।
প্রথমার এমনিতেই মন ভাল ছিল না। সুনন্দনাকে ও লেখে, আসব শিগগিরি। এদিকে একটু গুছিয়ে নিই সোনা। তোদের সবাইকে অসুখী করেছি আমি। সবাইকে কষ্ট দিয়েছি। তবু আমি এই জীবনটা কাটিয়ে যেতে চাই। আমার আঁধার ভাল।
সুনন্দনা ওকে গানটা পাঠায়, নিজে গেয়ে , রেকর্ড করে। ভয়েস মেসেজে।
কানে ইয়ারফোন গুঁজে চোখ বন্ধ করে সুনন্দনা শোনে। ও আমার আঁধার ভাল। আলোরে যে লোপ করে খায় সেই কুয়াশা সর্বনেশে।
অটো থামে। মাধবপুর। দিদি। দশ টাকা।