শিল্পী রবীন মণ্ডলকে আমি প্রথমবার দেখি তাঁরই এক চিত্রপ্রদর্শনীর শুরুর দিনে - অবশ্য এই লাইনের খবরটবর রাখলে জানবেন, এইধরণের প্রদর্শনীর শুরুকে শুরু না বলে ওপেনিং বলাই দস্তুর - সে যা-ই হোক, রবীনবাবুর প্রদর্শনীর সূচনা অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত ছিলাম আমিও।
এসব দিনে যেমন হয়, একদল উজ্জ্বল পোষাকের মানুষের ভিড়, বাতাসে বহুমূল্য সুগন্ধী, অধিকাংশ হাতে শাদা কিম্বা লাল পানীয়ের সরু লম্বা গ্লাস, দাঁত খোঁচানোর খড়কেকাঠিতে বেঁধানো চিজ চেরি আর হিমশীতল আনারসের টুকরো।
বিরাট হলঘরের একপাশে দাঁড়িয়ে তিনি। একা। শিল্পী রবীন মণ্ডল।
হলের বিভিন্ন কোণায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে মানুষের জটলা। সমকালীন শিল্পীরা একত্রে হাসিঠাট্টায় মগ্ন। গ্যালারিমালিক সাধ্যমত শিল্প-সংগ্রাহকদের আতিথেয়তায় ব্যস্ত। যশস্বী শিল্পীকে ঘিরে যশোপ্রার্থী তরুণ শিল্পীদের ভিড় - কয়েকজন প্রায় চাটুকারিতা করছেন। কৃত্রিম আন্তরিকতায় বাতাস ভারি হয়ে আছে।
এসব থেকে দূরে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। শীর্ণকায় বলেই কিনা জানি না, রবীন মন্ডলকে সেদিন বড় ঋজু আর দীর্ঘদেহী বলে বোধ হয়েছিল।
গ্যালারির দেওয়াল থেকে অজস্র মুখ, তাঁর সৃষ্টি, আদিম বিস্ময় নিয়ে লক্ষ্য করছিল আমাদের। রবীনবাবুর চোখে কিছুটা অস্বস্তি - না, এই জগতে তিনি বিলং করেন না - ছবির জগতে থেকেও তিনি অনিবার্য আউটসাইডার - সেইদিন অনুভব করেছিলাম নিশ্চিত।
রবীন মণ্ডলের সাথে আলাপ আমার সেইদিনই।
অবশ্য, আলাপ আরো আগেই। তিনি এবং তাঁর ছবি - এই দুইয়ের ফারাক করা অনুচিত। শিল্পীর সৃষ্টির সাথে পরিচয় থাকলেই শিল্পীকে চেনা হয়ে যায় - বরং, সামনাসামনি আলাপ দিয়ে শিল্পীকে চিনতে গেলেই বিভ্রমের সম্ভাবনা - এমনটাই বিশ্বাস করি। কাজেই, রবীন মণ্ডলকে চিনতে হলে তাঁর শিল্পকর্মের সাথে পরিচয় জরুরী। ভাবীকালের যে মানুষেরা তাঁর ছবির সামনে দাঁড়িয়ে নিজেদের মুখোমুখি হবেন - তাঁদের তো আর সুযোগ থাকবে না এমন অসামান্য মানুষটির সাথে সামনাসামনি পরিচিত হওয়ার - কিন্তু, তাঁর শিল্পকর্ম থেকেই রবীনবাবুকে পুনর্নিমাণ করে নিতে তাঁদের এতটুকু সমস্যা হবে না বলেই বিশ্বাস করি। তাঁর ছবিতে জাদুকরের পোশাক জীর্ণ, রাজা কিম্বা রাণী বিষণ্ণ, ক্লান্ত, আক্রান্ত - সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন যাপনের ঘামের গন্ধ মালুম হয় তাঁর ছবির সামনে দাঁড়ালেই। নিজের সৃষ্টির সাথে স্রষ্টা মানুষটি এমন ওতপ্রোতভাবে মিশে আছেন আর ঠিক কোন শিল্পীর কাজে, বলা মুশকিল - অন্তত, এই একটি ক্ষেত্রে রবীন মণ্ডল সংশয়াতীত মাস্টার।
আরেক অর্থে, রবীনবাবুর ছবি থেকে রবীনবাবুকে চেনার চাইতে বেশী সম্ভব নিজেদের চিনতে পারা - একেবারে নিরাবরণ নগ্ন অকপট নিজের মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনাই বেশী - কেননা, তাঁর ছবির জৌলুষহীন আদিমতা আমাদের সামনে আয়না হয়ে থাকে।
সমকালীন ফরাসী শিল্পী সুলাজস বলতেন, তিনি দেওয়ালে ছবি টাঙিয়ে ডিসপ্লে করায় বিশ্বাসী নন - কেননা, সেক্ষেত্রে ছবি যেন জানালার মতো, এই বিভ্রমের সৃষ্টি করে - আর জানালা তো বাইরের দিকে তাকানোর জন্যে - কাজেই, তিনি চান, ছবি থাকুক ঘরের মধ্যে দেওয়াল হয়ে, আমাদের দৃষ্টি সেই দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসুক নিজেদের দিকে - ছবি দিয়ে আমরা যেন নিজেদের চিনতে পারি, পুনরাবিষ্কার করতে পারি নিজেকেই।
একেবারে ভিন্নধর্মী শিল্পী হলেও, রবীন মণ্ডলের ছবি, একইভাবে বাধ্য করে নিজেদের দিকে তাকাতে - তাঁর আঁকা ছবি দিয়ে রবীন মণ্ডলের জীবনের পুনর্নিমাণ করা সম্ভব নিশ্চয়ই - কিন্তু, আরো বেশী সম্ভব, নিজেদের জীর্ণ অস্তিত্বের টুকরোগুলো খুঁজে পাওয়া, অকপট হয়ে নিজের মুখোমুখি হওয়া - নাঃ, ব্যাপারটা খুব জটিল আর দুর্বোধ্য হয়ে যাচ্ছে - একই কথায় ফিরে আসছি আর বারবার বলে চলেছি সেই একই কথা - নিশ্চিত বুঝতে পারছি, আপনি বিরক্ত হচ্ছেন, কেননা আমি একেবারেই বোঝাতে পারছি না আপনাকে।
সেইদিন প্রথম সামনাসামনি পরিচিত হয়েছিলাম। এগিয়ে গিয়ে আলাপ করেছিলাম, এক বয়োজ্যেষ্ঠ শিল্পীবন্ধুর মধ্যস্থতায়। তাঁকে কিছুটা বিভ্রান্ত মনে হয়েছিল - হয়ত বয়সের কারণে, তিনি তখন আশি পার করেছেন - হয়ত তিনি কিঞ্চিৎ নেশাগ্রস্ত তখন - কিন্তু, বিশ্বাস করেছিলাম, এই দিকভ্রান্ত ঔদাসিন্য কৃত্রিম উষ্ণতার মেকি পরিবেশের কারণে।
পরেও কথা হয়েছে বেশ কয়েকবার, ঘনিষ্ঠতার পর্যায়ে যাওয়া হয়নি অবশ্য। চোখের সেই উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি লক্ষ্য করেছিলাম বারবারই। আজীবন বিভিন্ন আঙ্গিকে মানুষ, শুধু মানুষের মুখ এঁকে চললেও, মনে হয়েছিল, মানুষের ভিড়ে তিনি অস্বচ্ছন্দ - তাঁর জার্নি একাকিত্বের, নিঃসঙ্গ - সামনে দাঁড়ানো মানুষটার সাথে কথা বলার মুহূর্তেও, তাঁর দৃষ্টি কোনো এক সুদূরে নিবদ্ধ। না, কেউ এগিয়ে তাঁর সাথে আলাপ করতে চাইলে তিনি আগ্রহী হতেন না, এমন নয় - যথেষ্ট উষ্ণতা ও আন্তরিকতার সাথেই কথাবার্তা বলতেন - কৃত্রিম ভদ্রতায় তাঁর অভ্যেস ছিল না একেবারেই - কিন্তু, প্রতিমুহূর্তেই মনে হত, এই মুহূর্তটিতে দাঁড়িয়ে থেকেও তিনি যেন মুহূর্তটিকে অতিক্রম করছেন।
ছবির বাজারের মধ্যিখানে থাকার ব্যাপারে তাঁর আকুলিবিকুলি ছিল না কখনোই - কিন্তু, শিল্পীদের টিকে থাকার জন্যে বাজারটা যে জরুরী, সেই নিয়ে ভণিতা দেখিনি। বলতেন, আমাদের ছবি কেনার দরকার নেই - আমাদের তো হয়েই গেছে, আমরা তো জীবন পার করেই এসেছি - নতুন ছেলেমেয়েদের ছবি কিনুন - ছবি আঁকা আর কবিতা লেখা তো এক নয় - ছবি আঁকার অনেক খরচ আছে - রঙ-তুলি-ক্যানভাস সবই ব্যয়বহুল - আপনারা যদি ওদের ছবি না কেনেন, তাহলে নতুন শিল্পীরা ছবি আঁকড়ে বাঁচার ভরসা পাবে না।
নিজের ছবির বাজার নিয়ে ভাবেন নি কখনোই তেমনভাবে। তাঁর সহশিল্পীদের ছবির দাম বেড়েছে, তাঁর সমকালীন শিল্পীদের ছবির চাহিদা বেড়েছে - অনেকে সেই চাহিদা মেটাতে বাজারের পছন্দমাফিক জোগানদারে পরিণত হয়েছেন - তিনি নিজের পথ আঁকড়ে থেকেছেন - সেই পথের ফসল অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাজারের মনপসন্দ হয়নি - কিন্তু, রবীন মণ্ডল পথ বদলান নি।
যত মত, তত পথ - কথাটা শিল্পের ক্ষেত্রেও অনিবার্যভাবে প্রযোজ্য - কিন্তু, রবীন মণ্ডলের শিল্পযাপন একটি নির্দিষ্ট পথানুসারী - যদিও, আবারও মনে করিয়ে দেওয়া যাক, সেই পথ বাজারের স্নেহধন্য হয়নি - তাঁর সিদ্ধিলাভ ওই পথেই।
এক প্রদর্শনীর শুরুত্ব দুচারকথা বলার অনুরোধ এলে, তরুণ শিল্পীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেছিলেন - কবিগুরুর ওই গানটা আছে না, যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক, আমি তোমায় ছাড়ব না - ওই কথাটুকু মাথায় রাখা জরুরী - ছাড়বে না, ধরে থাকো, আর কিছুর তোয়াক্কা না করে লেগে থাকো - শুধু ওইটুকু করতে পারলেই হবে। হ্যাঁ, এই কথা বলার অধিকার, নিঃসন্দেহে, তাঁর ছিল - আর পাঁচজনের চাইতে কিঞ্চিৎ বেশীই ছিল - আজীবন বাজার বিক্রিবাটা সমকালীন শিল্পীদের আর্থিক মোক্ষলাভ ইত্যকার অপ্রাসঙ্গিক ডিটেইলসের দিকে না তাকিয়ে তিনি আশ্রয় করতে পেরেছিলেন শিল্পকেই - শিল্পের ক্ষেত্রেও বেছে নিয়েছিলেন একটিমাত্র পথকেই - না, অন্য অনেক শিল্পীর কাজের মতো, তাঁর ছবিতে ধারাবদল বিশেষ ঘটেনি, তাঁর শিল্পযাপন একান্ত মনোগ্যামিস্ট - আর সেই এক পথ আঁকড়ে তিনি সিদ্ধিলাভ করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
না, শুনতে যতখানি সহজ লাগছে, পথ অতোটা সহজ ছিল না। শিল্পজগতে যে কঠোর বর্ণাশ্রম ও জাতিভেদ প্রথা আছে, সে বিষয়ে যিনি ওই জগৎ নিয়ে কিছুমাত্র খবর রাখেন, তিনি বিলক্ষণ অবগত। অবনীন্দ্রনাথের বেঙ্গল স্কুল বনাম অতুল বসুদের ইউরোপ-ঘেঁষা প্রকরণ দিয়ে শুরু - প্রতিযোগিতায় হেরে যাওয়াদের কেউ মনে রাখে না - অতুল বসুদের উৎকৃষ্ট শিল্পকর্ম শেষমেশ শিল্পরসিকের বিস্মৃতির শিকার। পরবর্তীতে সরকারি আর্ট কলেজ নাকি শান্তিনিকেতনী কলাভবনের রীতি - সে নিয়েও মনকষাকষি - যা এখনও বিদ্যমান। গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজেও ফাইন আর্টসের ছাত্ররা কমার্শিয়াল আর্ট বিভাগের ছাত্রদের অনুকম্পার দৃষ্টিতে দেখে থাকেন।
আর, রবীন মণ্ডলের মতো শিল্পী - যাঁর কিনা সেভাবে প্রথাগত কোনো শিল্পশিক্ষার সুযোগই ঘটেনি - তিনি তো প্রায় অপাংক্তেয় - আউটসাইডার।
দ্বিতীয়ত, শিল্পের জগতে, অন্তত বঙ্গদেশের শিল্পের জগতে, একটি কথা বহুলপ্রচলিত - কব্জির জোর। অর্থাৎ চিত্রাঙ্কন দক্ষতা। এই দক্ষতার মোহে পড়ে অনেক শিল্পী প্রায় জাগলারে পরিণত হয়েছেন - দক্ষতার হদ্দমুদ্দ প্রকাশের ক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিয়েছেন ক্যানভাসটি - ছবি দেখে শৈল্পিক বোধ জাগার চাইতে দর্শকের মনে জেগেছে দক্ষতার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা - একশ্রেণীর দর্শকের আনুকূল্য পেলেও সময়ের সাথে সাথে সেই ছবি আকর্ষণ হারিয়েছে - কিন্তু, বৃহদংশের শিল্পীদের কাছে "কব্জির জোর"-এর কদর কমেনি।
রবীন মণ্ডলের ছবি দেখতে থাকলে বুঝতে অসুবিধে হয় না, কব্জির জোর ব্যাপারটা তাঁর খুব একটা ছিল না - অন্তত, সেই দক্ষতা অর্জন করতে তিনি সেভাবে আগ্রহীও হন নি - কাজেই, তাঁর ছবি যে সমকালীন শিল্পী, এমনকি অনেক তরুণ শিল্পীদের কাছেও তাচ্ছিল্য আর উপেক্ষার বিষয় হবে - এতে, সম্ভবত, বিস্মিত হওয়ার কারণ নেই।
শিল্প ও শিল্পীর যাত্রাপথ, সেই পথে দেশের শিল্প-ঐতিহ্য এবং সমকালের ছায়া - এইসব নিয়ে বারকয়েক ভেবেছেন তিনি - না, খুব যুগান্তকারী বা চমকপ্রদ ভাবনার পরিচয় রেখেছেন, এমন নয় - যে বারকয়েক লিপিবদ্ধ করেছেন তাঁর ভাবনা, ঘুরেফিরে এসেছেন একই জায়গায় - আধুনিক চিত্রকলার সৃজনের ক্ষেত্রে, তিনি দেশের শিল্প-ঐতিহ্যকে মাত্রাতিরিক্ত গুরুত্ব দেওয়ার পক্ষে নন।
উনবিংশ শতকে ফ্রান্সের বাস্তবতাবাদী শিল্প-আন্দোলনের অন্যতম প্রাণপুরুষ গুস্তাভ কুর্বে-র কথাটি তাঁর কাছে ছিল ভারি পছন্দের - মিউজিয়ামগুলো অন্তত বছরকুড়ি বন্ধ করে রাখা দরকার - তাহলেই একমাত্র এখনকার শিল্পীরা নিজেদের চোখ দিয়ে জগৎটাকে দেখতে শিখবে।
এ বিষয়ে রবীন মণ্ডলের বক্তব্য ছিল খুব স্পষ্ট -
"... দেখা গেছে সভ্যসমাজে সজীব ঐতিহ্য মাত্রেরই একটা ভূমিকা থাকে। কিন্তু তাকেও সমকালীনতার সাথে তাল রেখে চলতে হয়। সে কারণে বলা যায় ঐতিহ্য-বিলাস বা প্রীতির আতিশয্য অনেক সময় স্রষ্টার অগ্রগতিতে বাধার সৃষ্টি করে। ফলে শিল্পকলার গতিপ্রকৃতিতে স্তব্ধতা আসতে পারে।"
(প্রসঙ্গ : শিল্পে ঐতিহ্য ও সমকালীনতা)
কিন্তু, এক পরম্পরা ভাঙার পথে যদি আঁকড়ে ধরা হয় আরেক পরম্পরা - সে ভাঙায় যাক ভাঙা গিয়েছে এধরণের আত্মপ্রসাদ লাভ করা গেলেও, ঐতিহ্যের শিকড় ছড়িয়ে থাকে দেশজ সংস্কৃতির গভীরে - সেই ঐতিহ্যকে উৎপাটন করে অন্য মূর্তি স্থাপন করতে হলে, বিশেষত সেই মূর্তিকে আমজনতার কাছে গ্রহণযোগ্য হিসেবে পেশ করতে হলে - জরুরী হয়ে পড়ে গভীর অনুসন্ধান এবং মেধা - আর তার থেকে বেশী জরুরী, সম্ভবত, দেশের সংস্কৃতিকে চেনা, ঐতিহ্যকে জানা এবং যে মূর্তিকে নিয়ে আসর জমানোর আশা, তাকেও গভীরে জানা - সে অবগাহন তেমন সুলভ নয়।
গত শতকের শুরুতেই, আধুনিক চিত্রকলার সূচনাকালে, ইউরোপীয় শিল্পীরা ছবির আঙ্গিকের সন্ধানে চেয়ে দেখছিলেন ইউরোপের বাইরে। বহু ব্যবহারে জীর্ণ ইউরোপীয় চিত্রকল্পের অনুষঙ্গ ছেড়ে, আফ্রিকা কিম্বা দক্ষিণ আমেরিকার উপজাতিদের সনাতন শিল্পচর্চার মোটিফ তাঁদের আকৃষ্ট করেছিল বিশেষভাবে। আদিম মুখোশ ইত্যকার ফর্মকে আত্মস্থ করে যাত্রা শুরু করে মডার্ণ আর্ট - কিন্তু, সে মডার্ন ইউরোপীয়ান আর্ট - অবশ্য, আমাদের মন থেকে ইউরোপীয় শব্দটি বাদ পড়ে গেল, কেননা, ইউরোপীয় কথাটি অপ্রাসঙ্গিক, কেননা, যা কিছু ইউরোপীয় তা-ই বিশ্বজনীন - বিশ্বের নামজাদা শিল্পীদের সাধারণীকরণ করতে হলে দেখা যায়, দুচারটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে তাঁরা প্রায় সবাই শ্বেতাঙ্গ পুরুষ - গত শতকের মাঝামাঝির আগে সবাই ইউরোপীয়, পরবর্তীতে কয়েকজন মার্কিন। কিন্তু, সে আরেক বিশদ আলোচনার বিষয় - আপাতত রবীন মণ্ডলের কথায় ফিরি।
এই ইউরোপীয়ান মডার্ন আর্ট, থুড়ি মডার্ন আর্টের পথ ধরেই রবীন মণ্ডলের যাত্রা। মডার্ন আর্টের অন্তর্গত আদিমতাকে আশ্রয় করেই তাঁর শিল্পযাপন। আর, এক্ষেত্রে বলা যায়, আদিমতাকে ইউরোপীয় বীক্ষণে ফেলে নির্বীজ ও নির্বিষ করে যে শিল্পপথ বেছেছিলেন বেশ কিছু ইউরোপীয় শিল্পীই - শুনতে বাড়াবাড়ি ঠেকলেও বলা যাতে পারে, তাঁদের চাইতে আদিমতাকে অনেক বেশী অক্ষুণ্ণ ও অথেনটিক রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন রবীনবাবু।
অথচ, এ আদিমতা, এ সরলতা অনায়াসেই আসতে পারত এদেশের উপজাতিদের শিল্পযাপন অনুসরণ করে - আত্মস্থ করে - কিন্তু, উপনিবেশের দুর্ভাগ্য বা নিয়তি সম্ভবত এটাই, যে, নিজেদের সম্পদ প্রভুদের হাতফেরতা না হয়ে আপনাআপনি হাতে পেলে, সে সম্পদ নজরে পড়ে না।
কাজেই, ইউরোপীয় ধাঁচের ছবি আঁকা ছেড়ে যামিনী রায় যখন আত্মস্থ করছেন বাংলার লোকশিল্প - আর সেই লোকশিল্পকে নিজস্ব শিল্পদীক্ষা মিশিয়ে পেশ করছেন রসিকের দরবারে - সে চর্চা রবীনবাবু মেনে নিতে পারেন না। এবং যে সমালোচনা করেন, তার ভাষা উপনিবেশবাদী শ্বেতাঙ্গ সমালোচকের বলে বিভ্রম হয় -
"ইউরোপীয় আধুনিক শিল্পকলার জগতে একাধিক ধুরন্ধর শিল্পী আদিম এবং লোকশিল্প এবং বিদেশী রীতিনীতি থেকে প্রেরণা নিয়ে যেভাবে স্বীকরণ করে নিজস্ব পথে রূপায়িত করে গেছেন নিজের চিন্তাভাবনা, তাতে যে সমকালীনতার প্রসঙ্গ নানাভাবে জড়িত ছিল তা আজ শিল্পমনস্ক মানুষ মাত্রেউ অনুভব করতে পারেন। কি বিষয়, কি আঙ্গিক - সব দিক থেকে আত্মীকরণে তাঁরা যে ব্যক্তিত্বের প্রকাশ করেছেন, যামিনী রায় কি সেই ভাবনার আলোকে নিজেকে আলোকিত করতে পেরেছেন?" (যামিনী রায় - গ্রন্থ : আমার কথা - রবীন মণ্ডল)
অর্থাৎ সেই ইউরোপীয় ভাবনার আলোকে আলোকিত না হতে পারলে উৎকর্ষটুকু দৃষ্টিগোচর হতে পারে না। তবু, আবারও বলা জরুরী, ইউরোপীয় শিল্পভাবনাকে শিরোধার্য করেও, আদিমতাকে আত্মস্থ করার ক্ষেত্রে এবং মেক-আপ ছাড়া সে আদিমতাকে খোলাখুলি দর্শকের সামনে পেশ করার ব্যাপারে, রবীন মণ্ডল অনেক খ্যাতনামা ইউরোপীয় শিল্পীর চাইতে বেশী সফল।
আর, পথচয়নের ক্ষেত্রে সমকালীন অনেক শিল্পী যখন দ্বিধাগ্রস্ত - এবং সেই দ্বিধার শেষে দাঁড়িয়েছেন ঘরেও নহে পারেও নহে, একেবারেই মাঝখানে - সেই দোলাচল দ্বিধাগ্রস্ত করে দর্শককেও - রবীন মণ্ডলের ছবি সেখানে দ্বিধাহীন অকপট - তাঁর সাফল্য এজন্যেই আরো বেশী করে উল্লেখযোগ্য।
না, শুধুমাত্র ইউরোপীয় প্রকরণ মেনে একই ছবি জীবনভর এঁকে যাওয়ার শিল্পী হিসেবে রবীন মণ্ডলকে দেখতে চাইলে তা অনুচিত হবে। আজীবন মানুষ এঁকে গেছেন তিনি। প্রাগৈতিহাসিক গুহামানবের সরলতায় এঁকে গেছেন সমকালের ছবি - সমকালীন মানুষের ভেঙেচুরে যাওয়ার ছবি - সে মানুষ একেবারেই আমার বা আপনার পাশের মানুষ, এই বঙ্গদেশেরই জলহাওয়ায় লালিত মানুষ, হয়ত আমি বা আপনিই - সাধারণ মানুষের প্রাত্যহিক যাপনের নুন-তেল-ঘামের গন্ধ, রক্তের দাগ মিশে তাঁর ছবিতে - এতটাই জীবনমুখী সে ছবি, সে ছবি এতখানিই নগ্ন, যে প্রায় কখনই প্রকৃতির নির্মল সৌন্দর্য এসে আমাদের দৃষ্টিকে আরাম দেয় না - বা আপাতস্বচ্ছন্দ করে বলে না, নাঃ, শান্তিতে থাকা যাক, সব ঠিক হয়ে যাবে - এতখানিই নির্মম তিনি শিল্পী হিসেবে।
তাঁর যাত্রা একমাত্রিক, যাত্রাপথ বন্ধুর। তাঁর নিজের ভাষায়, "কলকাতায় কাজ করি, হাওড়ায় থাকি। দারিদ্র্য ও দুঃখ যন্ত্রণা তো সেই শৈশব থেকেই সঙ্গী। দুচোখ ভরে দেখছি।"
সেই দেখায় মিশে থেকেছে দেশভাগ, দাঙ্গা, সাম্প্রদায়িক অবিশ্বাস - বাড়ির শহর হাওড়ার শিল্পাঞ্চল থেকে বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানার প্রত্নাবশেষে পরিণত হওয়া - বৃহত্তর রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের জাঁতাকলে পড়ে মানুষের ভেঙেচুরে যাওয়া মুখ।
১৯৬৫ সালে, ক্যালকাটা পেইন্টার্সের কলকাতায় প্রথম প্রদর্শনী উপলক্ষে ঘোষণাপত্রে লেখা হয়েছিল -
"আজকের ভারতীয় পরিস্থিতির দিকে এক নজর তাকিয়ে দেখাই যে কোনো সংবেদনশীল মানুষকে হতাশাবাদী করে তোলার পক্ষে যথেষ্ট। আমরা জানি, যদি অলৌকিক কিছু না ঘটে, তাহলে ক্রমেই গভীরতর বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হবে আমাদের। আমরা দেখেছি, দুর্নীতি জীবনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গেছে। মানুষের জন্য মানুষের ভালোবাসা নেই, ঘৃণা বাড়ছে ক্রমশ। দেশকে ভালোবাসি না আমরা। সামান্যতম সুযোগে আমাদের পাশের মানুষটিকে প্রবঞ্চনা করি। এবং সবচেয়ে যা পরিতাপের, তা হল, সত্য ও ন্যায় আজ পরিহাসের বিষয়।"
এই ঘোষণাপত্রের অন্যতম স্বাক্ষরকারী ছিলেন তিনিও। হ্যাঁ, এই অস্থির আর হতাশার সময়ের চিত্রকর তিনি। তবু, হতাশাবাদী নন তিনি। একই ঘোষণাপত্র লিপিবদ্ধ থাকে -
"এ সমস্ত নঞর্থকতা ও বিনষ্টি সত্ত্বেও সৃষ্টিশীলতা থেকেই যায়। সৃষ্টিশীলতাকে রুদ্ধ করা যায় না। এই সত্যই জেগে থাকে শেষ পর্যন্ত যে, সমস্ত কিছুর গভীরেই মহত্তর জীবনীশক্তি প্রবাহিত হয়ে চলে। যতদিন পর্যন্ত মানুষ গান গাইবে, নাচবে বা ছবি আঁকবে, অর্থাৎ যতদিন সৃষ্টিশীল থাকবে মানুষ, ততদিনই আশা বেঁচে থাকবে।"
না, রূপকথা এঁকে যান নি তিনি। রবীন মণ্ডল - মানুষ হিসেবেও যেমন ছিলেন নিরহঙ্কার আটপৌরে সাদামাঠা মাটির মানুষ - শিল্পী হিসেবেও তা-ই। যেমনটি বলেছি আগেও, নির্মম বাস্তবকে ফুল পাখি দিয়ে সাজিয়ে সহজপাচ্য করে পেশ করেননি তিনি। তাঁর ছবিতে রঙ গাঢ় - স্পেস্টুকু ছেড়ে দর্শককে স্বস্তি দেওয়ার দায় নেই তাঁর - গাঢ় আর মোটা রঙে ভরাট তাঁর ক্যানভাস - যে ছবি চোখ বন্ধ করার পরেও আক্রমণ বন্ধ করে না।
এমনকি, তিনি রাজা-রাণী আঁকলেও তা দৃষ্টিসুখকর হয় না - এবং সেই দৃষ্টিসুখের অনুপস্থিতি ডেলিবারেট - কেননা, তাঁর বিখ্যাত রাজারাণী সিরিজের ছবি নিয়ে শিল্পী নিজেই বলেন -
"...অর্থাৎ ছবি দেখে তৃপ্তি বা মজা পাওয়া বোধ হয় বেশ মুশকিল। কারণ emotional element দিয়ে ছবিগুলোকে নয়নসুখকর করে তোলার চেষ্টা হয়নি। ফলে, তৃপ্তির নিশ্বাস নিয়ে ছবিগুলোর সাথে ঘর করা যায় কিনা আমার পক্ষে বলা শক্ত।
রাজার প্রবল প্রতাপান্বিত অস্তিত্বের পিছনে একাধিক tragedy আছে - সেগুলো সাধারণত আমাদের ভাবনার মধ্যে পড়ে না। রাজার প্রতাপ, বৈভব - এসবের বাইরে অনেক আপাত অদৃশ্য দিক থাকে, যা রাজার tragedy-র দিক - যেখানে বিষণ্ণতা, নিষ্ঠুরতার সাক্ষাৎ পাওয়া যায়।"
(প্রসঙ্গ : রাজারাণী সিরিজ - রবীন মণ্ডল, স্বকাল, ১৯৮৫)
ঠিক কোন ধরনের শিল্প বা ঠিক কোন শিল্পী বাজারের আনুকূল্য লাভ করতে সক্ষম হবেন, তা আগাম অনুমান করা ভারি কঠিন। কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম, সম্ভবত, নেই। তবু, দৃষ্টিনন্দন ছবি, বা ছকভাঙা কোনো শিল্প-আন্দোলনের পুরোধা শিল্পকৃতি অথবা শিল্পীর ব্যক্তিগত ক্যারিশমা - এই ফ্যাক্টরগুলো বাজারে বেশ চলে। বলা বাহুল্য, এর একটি 'গুণ'ও রবীন মণ্ডলের নেই।
"একটি বিষয়ে আমি সচেতন যে আমার কাজ নয়নসুখকর নয়। ফলে সে দিক থেকে বৃহত্তর দর্শক-চেতনায় আমার শিল্প অস্তিত্ব সফল কি বিফল তা আমার হিসাবের বাইরে। তবে যে কোন শিল্পীর কাজের মধ্যে একটা আত্মজৈবনিক দিক প্রকাশ পায় - না পেলে সেটা মিথ্যাচার বলে আমার মনে হয়। ফলে সাফল্য বা বিফলতা নিয়ে আমার ভাবার অবকাশ কম। পুরস্কার না তিরস্কার - কোনটা আমার প্রাপ্য। আমি জানি না। তবে এটুকু জানি কাজ করে তা যেন দর্শকদের দিকে ছুঁড়ে দিতে পারি। দর্শকরা যেন তা দেখেন। দেখার পর তাঁরা যেন দর্পনের মুখোমুখি হন।"
(দেশ - সাহিত্য সংখ্যা ১৯৯২)
অতএব, এ ছবি যে সহজে দর্শকের আনুকূল্য পাবে না, সে অনুমান ততখানি দুঃসাধ্য নয়। আর্ট মার্কেট আর পাঁচটা বাজারের মতোই - এইখানে শিল্প কাঁচামাল - বাজার সেই কাঁচামালটিকে প্রোডাক্ট হিসেবে সাজিয়েগুছিয়ে ক্রেতার সামনে পেশ করে - ক্রেতার পছন্দ হলে নীলামে কাড়াকাড়ি হয়, দর বাড়ে - সাথে সাথে শিল্পীও কুলীন হয়ে ওঠেন। যাঁর ছবি নয়নসুখকর নয়, যাঁর ছবি পছন্দসই ও সহজ বার্তা বহন করে না, যে শিল্পীর জীবনে আকর্ষণীয় গল্প নেই, নেই এমনকি নিজেকে প্রোডাক্ট হিসেবে সাজিয়ে তোলার চেষ্টা - তাঁর পক্ষে নীলামের ঝলমলে জগতে কল্কে পাওয়া মুশকিল। কাজেই, নীলামের বাজারে রবীন মণ্ডলের ছবির দাম খুব বেশী বাড়ে নি, এতে আশ্চর্য হওয়ার চাইতে ঢের বেশী বিস্মিত হতে হয় - এই নিস্পৃহ একাকিত্ব ও একমুখিনতা সত্ত্বেও তিনি নীলামঘরের নির্বাচিত শিল্পী তালিকায় ঠাঁই পেলেন কী ভাবে!! তবে কি, সংখ্যায় কম হলেও, সৎ শিল্পচর্চারও খরিদ্দার মেলে সেই বাজারে?
রবীন মণ্ডল এ নিয়ে ভাবতেন না, নিশ্চিত। নিজের ছবির বাজার গড়তে ফেরিওয়ালা হয়ে উঠতে পারেন নি তিনি - চানও নি কখনও।
"শিল্পী তার ভাবনাচিন্তাকে ফেলে বৃহত্তর জনসমাজের চাহিদা অনুযায়ী ভাবনাকে রূপায়িত করতেও ইচ্ছুক হয় না। এখানেই তার ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্য। অথচ সে জনসমাজে পরিচিত, প্রতিষ্ঠিত হতে চায়। কার্যত অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা ঘটে না। এবং দেখা গেছে যে একাধিক শিল্পীর জীবিতকালে তাঁদের রচনা অনাদরে থেকে গেছে। হয়ত পরবর্তীকালে তাঁদের সৃষ্টি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে।"
(আধুনিক শিল্পকলা কি দুর্বোধ্য - মহানগর, ১৯৮৩)
দিন বদলেছে। সুকুমার মনোবৃত্তি, নান্দনিকতা, শিল্পযাপন ইত্যকার স্টেশন পার হয়ে শিল্পকলা আপাতত একটি আকর্ষণীয় বিনিয়োগের ক্ষেত্র - শিখে নেওয়া জরুরী, আর্ট ইজ আফটারঅল অ্যান অ্যাসেট ক্লাস - যেমন শেয়ার, বা ফ্ল্যাট, রিয়াল এস্টেট। সেই বাজারে রবীন মণ্ডল কোথায় রইলেন?
এক চিত্রপ্রদর্শনী উপলক্ষে আয়োজিত পার্টিতে উপস্থিত ছিলাম। এক গ্যালারিমালিক শাঁসালো খরিদ্দারকে সুপরামর্শ দিচ্ছিলেন। কিছু কিছু কথা কানে এলো -
- টেক মাই অ্যাডভাইস। ইনভেস্ট ইন রবীন মণ্ডল। এইটা একেবারে পার্ফেক্ট টাইম।
- কেন? রবীন মণ্ডল কেন?
- দেখুন, আর্টিস্ট আর নেই। হি ইজ নো মোর। নতুন ছবি তো বাজারে আর আসবে না। যেগুলো আছে সেগুলোই হাতবদল হবে।
- সে তো বুঝলাম। কিন্তু, দাম বাড়বে গ্যারান্টি কোথায়?
- না, গ্যারান্টি কিছু নেই। কিন্তু, ইউ সি, হি ইজ এ মাস্টার। আনডিসপিউটেড মাস্টার। অকশনে রেগুলার ওঠেন। প্রাইস ইজ গোয়িং আপ। মে বি আ বিট স্লোলি অ্যান্ড গ্র্যাজুয়ালি, বাট প্রাইসেস আর গোয়িং আপ শিওরলি।
- হুমমমম…
- আর দেখুন, রবীন মণ্ডল তো কলকাতার লোক কেনে নি। কিনেছে দিল্লী আর মুম্বাইয়ের বায়াররা। লাস্ট ফোর-ফাইভ ইয়ার্স, দে আর বায়িং টু বিল্ড আপ দেয়ার স্টক। এরপর কী হবে? মার্কেটে যা পড়ে আছে, ওরাই কিনে নেবে - দরকার হলে, বেশী দামে হলেও। দেন, দে উইল ক্রিয়েট আ ডিমান্ড, আ ক্রাইসিস - প্রাইস চড়চড় করে বাড়বে। দিস হ্যাপেনড উইথ সুজা অ্যান্ড টেক মাই ওয়ার্ডস, দ্য সেম ইজ গোয়িং টু হ্যাপেন উইথ রবীন মণ্ডল।
বেশ কথা। শাঁসালো কালেক্টর কদ্দূর সহমত হলেন, বলতে পারি না। আমার শুধু মনে পড়ে গেল, রবীন মণ্ডল চেয়েছিলেন, তাঁর ছবি দেখে দর্শক যেন দর্পণের মুখোমুখি হন। কে সেই দর্শক? দর্পণের মুখোমুখি হয়ে ডিজাইনার হেয়ার-সালোঁ থেকে ছেঁটে আসা চুলটুকু গুছিয়ে নেওয়া বাদে সেই ধনী মানুষটি আর কী করবেন?
একেবারে ভণিতাহীন আর অকপট মানুষ ছিলেন তিনি। জীবনের শেষ দিকে ক্যানভাসে কাজ করা কমিয়ে দিয়েছিলেন। প্রশ্ন করায় বলছিলেন - দ্যাখো, ঠিক বোঝাতে পারব না, একটা ফাঁকা ক্যানভাস আমাকে সরাসরি আক্রমণ করে - আমি কেমন বিহবল আর কনফিউজড হয়ে যাই - অনেকখানি প্রস্তুত না হয়ে ক্যানভাসের সামনে দাঁড়ানো যায় না - সেইদিক থেকে কাগজই ভালো।
একথা মাথায় রাখলে, অনুমান করা যায়, আমার সংগ্রহে তাঁর ২০১৯ সালে স্বাক্ষরিত যে ছোট ক্যানভাসখানি আছে, সেটি তাঁর জীবনের শেষ কিছু ক্যানভাসের একটি। মাদার অ্যান্ড চাইল্ড। মা ও মেয়ে। মোটা তুলির আঁচড়ে শিল্পীর সিগনেচার কাজ।
মা আর মেয়ে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে - দৃষ্টি সরাসরি দর্শকের প্রতি, নাকি ঠিক তা নয় - আমি সামনে দাঁড়াই - মায়ের সাথে চোখাচোখি হওয়ার মুহূর্তে অনুভব করি, মা ঠিক যেন আমার দিকে তাকিয়ে নেই - এক আশ্চর্য বিষণ্ণ, ক্লান্ত আর উদাস চোখে তাকিয়ে আছেন আমাকে অতিক্রম করে - মা আর মেয়ে পাশাপাশি দাঁড়িয়েও কোনো আবেগের বহিঃপ্রকাশ নেই, যে আবেগ ও বহিঃপ্রকাশ আমরা মা ও সন্তানের ছবিতে পেয়ে অভ্যস্ত - পেছনের ব্যাকড্রপে গাঢ় নীল আর লাল - দুটি রঙের বিভাজন হিসেবে মোটা কালো অনুভূম রেখা - মা বা মেয়ে, দুজনকেই রঙে ধরার ক্ষেত্রে কিছু অনিশ্চয়তা যেন শিল্পীর মনে কাজ করছিল - রঙ অসমান কিছু ক্ষেত্রে - মায়ের ডান গালের ওপর আবছা সবুজ ছোপ ইচ্ছাকৃত নাকি শিল্পীর অনবধান বশত, তার উত্তর আর জানা হবে না কখনোই - পাশে মেয়েকে নিয়ে মা অমন চোখে ঠিক কী খুঁজছেন, এই প্রশ্নের উত্তরও জানা হবে কি?
ছবি দেখে দর্পণের মুখোমুখি হয়ে রবীন মণ্ডলের ঘোষিত প্রত্যাশা পূরণ করতে পারি না - কেননা, ছবিখানা দেখা শেষ হয়ে উঠল না আজও।
শুধু অনুভব করি, রবীন মণ্ডলের ছবি দেখার - এবং বারবার দেখার - সে ছবি লাখ লাখ টাকায় বিক্রি হলে শিল্পী হিসেবে, হয়ত, আরো জাতে উঠতে পারবেন তিনি - দেশবিদেশে প্রদর্শনী ও স্বীকৃতির পরেও নীলামঘরের দামই তো ইদানিং শিল্পের স্বীকৃতি - কিন্তু, এটুকু নিশ্চিত বলা যায়, শিল্পী রবীন মণ্ডল, ভারতীয় চিত্রকলার প্রেক্ষিতে এক আশ্চর্য শিল্পী - যিনি প্রকৃত অর্থেই স্বতন্ত্র, একক। এদেশের কোনো পূর্বসূরির উত্তরাধিকার নিয়ে রবীন মণ্ডল আসেননি, হয়ে ওঠেন নি - বিদেশের চিত্র-আন্দোলন দ্বারা অনুপ্রাণিত আর প্রভাবিত হয়েও, শেষমেশ ছিলেন এই বাংলারই জল-হাওয়ামাখা সাধারণ মানুষের শিল্পী - আর, ব্যক্তিজীবনের মতো শিল্পীজীবনেও, তিনি কোনো উত্তরসূরী রেখে গেলেন না।