হিমালয়ের পথে পায়ে হেঁটে বেড়ানোর আনন্দ যে একবার পেয়েছে,সে বারেবারে পেতে চায়।পথশ্রম,যত্রতত্র রাত্রিবাসের কষ্ট সব ভুলিয়ে দেয় অপার্থিব সৌন্দর্য্য।বয়স বাড়ার সাথেসাথে দুরূহ পথ আকর্ষণ করলেও সাধ্যে কুলায় না,খোঁজ করি সহজ পথের।সন্ধান পাওয়া গেল এক তুলনামূলকভাবে সহজ গন্তব্যর-উত্তরাখণ্ডের ডোডিতাল।
উত্তরকাশী জেলায় ৩০২৪মিটার উচ্চতায় প্রাকৃতিক হ্রদ ডোডিতাল-এখান থেকেই জন্ম নিয়ে আশিগঙ্গা নদী মিশেছে গঙ্গাতে।পথ শুরু হয়েছে উত্তরকাশী থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরের সঙ্গমচট্টি থেকে।আগোডা,বেবরা হয়ে ডোডিতাল।প্রথমদিন পেরোতে হবে ৮ কিলোমিটার,গন্তব্য বেবরা গ্রাম, এপথের শেষ গ্রাম।থাকা যায় আগোডাতেও,গ্রামের লোকের বাড়িতে হোম-স্টে প্রথায় অথবা নিজেদের তাঁবুতে।ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পথ গিয়েছে।প্রথম দু কিলোমিটার অবশ্য ‘পথ’ কিনা তা নিয়ে ঘোর সংশয় জাগে।গাইড জানালেন ২০১৩ সালের বৃষ্টি,ধ্বসে ভেঙ্গে গিয়েছে পথ।এখন তো সবে ২০১৮,সারানোর সময় হয়নি বোধহয়।মনে পড়ল –হৃষিকেশ থেকে শুরু করে সারা রাস্তা জুড়ে দেখে এসেছি কর্মকাণ্ড,চারধামের জন্য তৈরি হচ্ছে সুপ্রশস্ত রাজপথ পাহাড় কেটে, গাছ কেটে।সময় কোথায় গ্রামের পথের দিকে নজর দেওয়ার, হোক না সে গ্রামের একমাত্র পথ।সে যাক,দু কিলোমিটার পর ‘পথ’ চোখে পড়ল।সবুজ বনের মধ্যে আশিগঙ্গাকে পাশে নিয়ে চড়াই পথ,কিন্তু প্রাণান্তকর নয়।নাম না জানা ফুল,পায়ের তলায় হলুদ ঝড়া পাতা,মাথার উপরনীল আকাশ,বনের ছায়া ভুলিয়ে দেয় সব ক্লান্তিকে।লোকালয়ের কাছাকাছি আসতেই পথের আরেক রূপ-চারপাশে যেন রঙের আগুন লেগেছে।পাহাড়ের ধাপেধাপে লাল রামদানা ক্ষেত,সে এক অপরূপ দৃশ্য।এসে পড়েছি আগোডা গ্রামে।ছোট্ট গ্রাম-শ’চারেক লোকের বাস।আমাদের গাইড এই গ্রামেরই ছেলে।শুনলাম ছোটখাটো ক্ষেত আছে প্রায় সবারই, কিন্তু সারা বছর চাষ হয় না।গ্রামের অল্পবয়সী সব ছেলেরাই কাজ করে গাইড বা পোর্টারের।আগোডা ছাড়িয়ে প্রায় দু কিলোমিটার পরে বেবরা গ্রাম।খরস্রোতা আশিগঙ্গার উপরে ছোট্ট কাঠের সাঁকো,সাঁকো পেরিয়েই একটি বাড়ি,সামনে খোলা চত্বর।শুনলাম এখানেই হবে আমাদের রাত্রিবাস।খোলা চত্বরে তাঁবু খাটিয়ে আছে একদল ছেলেমেয়ে, মহারাষ্ট্র থেকে এসেছে,ডোডিতাল থেকে ফেরার পথে রাত কাটাচ্ছে।আমাদের জায়গা বাড়ির ভিতর।মাথার উপর ছাদ যে কি আরামের, তা উপলব্ধি করলাম এই চড়াই ভাঙ্গার পর।
পরের দিন ভোরেই আবার যাত্রা শুরু-আজ যেতে হবে ১৪ কিলোমিটার।পথ গিয়েছে দেওদার,ওক,পাইন আর রডোড্রেন্ডনের ঘন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে,গাছের ছায়া চড়াইর ক্লান্তি ভুলিয়ে দেয়।সারা পথে পেরোতে হয় অজস্র ঝর্ণা আর ছোট ছোট জলের ধারা।৯ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে পৌঁছালাম মাঞ্জি,সবুজ গালিচা মোড়া উপত্যকা,ছড়ানো ছেটানো ভেড়াওয়ালাদের কুঁড়েঘর,সামনে তুষারশুভ্র হিমালয়ের চূড়া।এটাও একটা চমতকার ক্যম্পসাইট – আমরা অবশ্য এগিয়ে গেলাম ডোডিতালের পথে।শেষ দু কিলোমিটার পথ যেন শেষ হতেই চায়না।মাঝেমাঝেই মনে হতে থাকে এই বয়সে এমন অভিযানের সিদ্ধান্ত বোধহয় হঠকারীই হয়েছে।কিন্তু পথের শেষে যখন চোখে পড়ল দেওদার গাছে ঘেরা স্বচ্ছ জলের হ্রদ, নিমেষে সব ক্লান্তি দূর হয়ে গেল।নীল হ্রদ থেকে বয়ে চলেছে জলের ধারা,জন্মনিয়েছে আশি গঙ্গা।জনহীন প্রান্তরে হ্রদের এক কোণে সুন্দর এক ছোট্ট মন্দির,আরাধ্য দেবতা গনেশ।মন্দিরের পূজারি জানালেন-গনেশের জন্মভূমি এই দেবস্থান।এই হ্রদের নাকি আসল নাম ‘ঢুন্ডিতাল’-যার অর্থ গনেশের হ্রদ।গল্প শোনালেন গনেশের জন্মর পর পার্বতী নাকি এই হ্রদে নিয়মিত স্নান করতেন গনেশকে পাহাড়ায় বসিয়ে।একদিন শিব এলেন সেই সময়ে,গনেশ শিবকেও বাধা দিলেন।শিব নিজের সন্তানকে চিনতে পারেন নি, রুষ্ট শিব শিরচ্ছেদ করলেন গনেশের।পরে পার্বতীর কাছে সন্তানের পরিচয় পেয়ে প্রাণ ফিরিয়ে দিলেন,কিন্তু গনেশের মাথার পরিবর্তে বসালেন হস্তীর শির।পুর্ণজন্ম হল গনেশের।
হিমালয়ের কোলে সবুজে ঘেরা স্বচ্ছজলের হ্রদ-এ সত্যিই দেবভূমি।দুর্গম পথের কষ্ট সহ্য করেই ত দেবভূমিতে প্রবেশাধিকার পেতে হবে।
[ডোডিতাল যাওয়া যায় বর্ষা ছাড়া যে কোন সময়ে।আমরা গেছিলাম অক্টোবরে।যারা বরফে মোড়া পথে ট্রেক করতে চান,তারা আসেন ডিসেম্বর থেকে মার্চের মধ্যে।এখানে শীতকালীন ট্রেকিং খুব জনপ্রিয়।ট্রেকিংএর জন্য অবশ্যই দরকার গাইড।উত্তরকাশী বা সঙ্গমচট্টিতে খোঁজ পাবেন গাইড আর পোর্টারের।ডোডিতালে থাকতে হবে নিজেদের তাঁবুতে।একটা ছোট বনবাংলো আছে,বুকিং হয় উত্তরকাশী থেকে।
ডোডিতাল থেকে পাঁচ কিলোমিটার চড়াই পেরিয়ে যেতে পারেন ৪১৫০ মিটার উচ্চতায় দারোয়া পাস।এখান থেকে দেখা যায় এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে নানা শৃঙ্গ, হাত বাড়ালেই যেন ছুঁয়ে ফেলা যাবে বন্দরপুচ্ছ শৃঙ্গকে।কিন্তু মনে রাখতে হবে এই পাঁচ কিলোমিটার পথ খাড়া চড়াই,নিজের শারীরিক ক্ষমতা বুঝেই যাওয়া উচিত এই পথে।আর যে পথেই যান না কেন, অন্তত একমাস আগে থেকে শারীরিক প্রস্তুতি নিতে হবে।]