কলকাতা ছেড়ে দিল্লি বসবাসের শুরুতে যে কয়েকটা জায়গায় ঝাঁকুনি খেয়েছিলাম তার প্রথমটি ছিল প্রথমদিনের অফিসে। _—ছোট ব্রাঞ্চ অফিস। সাকুল্যে পাঁচজন লোক। আমায় নিয়ে ছয় হ'ল। অফিসে রিপোর্ট করার পর প্রাথমিক আলাপ পরিচয়ের মধ্যে যে প্রশ্নটায় ধাক্কা খেলাম - তা হ'ল "কৌনসে কাস্ট সে হো?" ভারতীয়, বাঙালি, হিন্দু - এইসব নানাবিধ উত্তরে প্রশ্নকর্তা সন্তুষ্ট নন। বুঝিয়ে বললেন ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় এইরকমের মধ্যে কোনটি তুমি? হেসে বললাম - আমার তো বিয়েও হয়ে গেছে তাহলে এসব জানাব কেন খামোখা? আর তাছাড়া এই রকম কাস্ট আমার কী- তা আমি ছাই নিজেও জানিনা।
পরে চাকরি বদলে চেহারা বহর ও চাকচিক্য সব মিলিয়ে এক "বড়" অফিসে জয়েন করার দিনে দেখি সেই এক প্রশ্ন ছোবল তোলে। ততদিনে শিখে গেছি কিছুটা। এইসব আমার জানা বা জানানোটা দরকার মনে করছি না বলে দিয়েছিলাম।
আমাদের বাড়িতে ঝাঁট দেওয়া, ঘর মোছা ও বাসন মাজতে একজন বৃদ্ধা আসতেন। তাকে আমরা কাজে বহাল করিনি। তার বৌমাকে কাজটি দেওয়া হয়ছিল, তা সেই বৌমা পরে নিজে কোনও আরও ভাল কাজের খোঁজ পেয়ে তার শ্বাশুড়ি কে আমাদের বাড়িতে গছিয়ে দেয়। তা সেই বৃদ্ধা যতটুকু পারতেন কাজ করতেন। নিয়মিয় আসতেন তাই ম্যানেজ হচ্ছিল। আর একজন সকালে আসতেন রুটি বানিয়ে দিতে যা আমরা টিফিনে অফিস নিয়ে যাব। সেই বৃদ্ধা সকালের কাজ সেরে তার জন্যও সেই রুটি নিতেন। একবার সেই রুটি বানানো মহিলাটি কাজ ছেড়ে দিলে অন্য একজন কে বহাল করি। পরের দিনই সেই বৃদ্ধা বললেন - তাহলে আমার রুটি তো পাব না আর। আমরা বললাম - তা কেন? একেও বলব তোমার জন্য রুটি বানাতে। সে বৃদ্ধা বলে - এর হাতে তো রুটি আমি খেতে পারি না - এ ধোপা!
দেশের সংবিধানে আর্টিকল ১৫ লেখা থাকাটাই বেশ হাস্যস্পদ লাগে। ওটা থাকা মানে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া হয় - দেখ, এতদিন লেখাপড়া করেও দেশের লোক এখনও জাতপাত নিয়ে ছোঁয়াছুঁয়ি খেলে যাচ্ছে। জাতপাতের অঙ্কে ভোটে জিতে সংসদে এসে সেই আর্টিকল-১৫ লেখাওলা সংবিধান ছুঁয়ে শপথ নিলে কি এরা প্রায়শ্চিত্ত করেন? এ প্রশ্ন ভাবায়।
"আর্টিকল -১৫" নামের সিনেমায় আয়ুষ্মান খুরানার চোখ দিয়ে পরিচিত হতে হয় উত্তর প্রদেশের "লালগাঁও" এর সঙ্গে। বলা ভাল তার "সংস্কৃতি" সঙ্গে। সিনেমার চরিত্রায়ণ যথাযথ, চরিত্রগুলি কে সময়ও দেওয়া হয়েছে দর্শকের সঙ্গে পরিচিত হ'তে। পরে সিনেমার গতি বাড়ালেও দর্শকের অসুবিধা হয় না। সায়নী গুপ্তা র অভিনয় মনে থাকে হয়ত সামান্য অতি-অভিনয়ের জন্যই। "নিষাদ" চরিত্রে জীশান আয়ুবের ডায়লগ - "আমরা কখনও হরিজন, কখনও বহুজন হলেও কখনোই জন-গণ-মন এর জন হই না। " মনে থাকে।
সিনেমার গল্প টানটান। সামাজিক বার্তা দিচ্ছে বলে জ্ঞান দিতে গিয়ে গল্পের রাস্তায় বাম্প বসানো হয় নি। জায়গায় জায়গায় কিছু স্যাটায়ার এসেছে। সিনেমাটোগ্রাফি যথাযথ।
অনুভব সিনহা র সিনেমাটির শুরুতে কৃতজ্ঞতা স্বীকারের তালিকায় সবার প্রথমে নাম উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর। "সব চরিত্র কাল্পনিক" বলে দেওয়াও আছে। দেখতে দেখতে অনেকবার মনে হবে - এই রকম সিনেমা ছাড়পত্র পেল কীভাবে? সরকার কি এতই প্রগতিশীল যে সিনেমায় খুল্লামখুল্লা সরকারী কর্মচারীদের মধ্যেও জাতপাতের নোংরামি দেখাতে দিচ্ছে। তারপর অবশ্য বোধদয় হয়। আজকাল এইসব সিনেমা সমুদ্রে এক বোতল বিসলেরি ঢেলে তাকে পেয় জল বানানোর চেষ্টার মতো। ২৮ শে জুন মুক্তি পাওয়া সিনেমা ৬ই জুলাই শনিবারের সন্ধ্যায় ফরিদাবাদের মাত্র তিনটে হলে চলছে। যেটায় আমরা গেলাম তাতে টিকিটের জন্য ৩০০ টাকা চাইল। এত দাম কেন জানতে চাইলে জবাব এল - গোল্ড ক্লাস।
তা সেই "গোল্ড ক্লাস" মানে দেখলাম বিশাল চওড়া রিক্লাইনার সোফাওলা সীট। সেই কারণেই সাধারণ প্রেক্ষাগৃহের তুলনায় হয়ত অনেক কম আসন, খুব বেশি হলে ১০০ জনের। এই ডোজের অ্যান্টিবায়োটিকে এই বিষের কিচ্ছু ছেঁড়া যায় না, তা প্রশাসন এখন সম্যক জানেন। দিনের শেষে তাই সংবিধানের "আর্টিকল ১৫" যেন অনেকটা ট্রেনের টাইমটেবিলের মতো - যা থাকে শুধু গাড়ি কতটা লেট করল তা জানার জন্যই।