অন্যান্য দিনের মত ডুয়ার্সের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন একজন মানুষ। যেমনটা তিনি প্রায়ই যান। পরনে একটা হলুদ লক্ষ্নৌ চিকনের চুড়িদার, কাঁধে সবুজ ওড়না। যেমনটা তিনি প্রায়ই পরেন। হাতে একটা লাল-সবুজ ছাতা। যেমনটা তিনি বর্ষাকালে প্রায়ই রাখতেন। বলা তো যায় না, কখন বৃষ্টি নামে। তাঁর চোখে কাজল, ঠোঁঠে লিপস্টিক।যেমনটা তিনি প্রায়ই পরতেন। সাজগোজ শেষ করে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে একবার আপাদমস্তক দেখে নিতেন তিনি। মেপে নিতেন, ঠিক কতটা শোধরানো গেল বিধাতাপুরুষের ভুলচুক। শরীরে পুরুষ, পোষাকে নারী এই মানুষটির নাম সম্ভবত: মনীষা।
অন্যান্য দিনের মত সেদিনও মনীষা রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। অন্যান্য দিনের মত ঠিক করে নিচ্ছিলেন তাঁর অবাধ্য চুল। হঠাৎ কিছু মানুষের কিছু সন্দেহ হল। কোনও কারণ ছিল না, তবু হল। এবং শুধুমাত্র সন্দেহের বশে, তাঁরা দলবেঁধে মণীষাকে পিটিয়ে, পাথর দিয়ে থেঁৎলে মেরে ফেললেন। ছিঁড়ে ফেলা হল মণীষার হলুদ চুড়িদার, সবুজ দোপাট্টা, ভেঙে দেওয়া হল তাঁর লাল-সবুজ ছাতা, আর সবুজ মাঠের একধারে জল কাদা রক্তে মাখামাখি হয়ে পড়ে রইল মণীষার প্রায় নগ্ন মৃতদেহ।
নাহ, এ লেখা গণপিটুনির জন্য নয়। সেটা গা-সওয়া হয়ে গেছে। ভারতের মত সভ্য দেশে অ্যায়সি ছোটি ছোটি বাতে হোতি রহতি হ্যায়, সোনেরিটা। আজ সে, কাল ও, পরশু আমি, তারপরের দিন আপনার ছেলে বা মেয়ে, রাস্তায় গণপিটুনিতে মারা যেতেই পারে। সেটাই স্বাভাবিক। রোড অ্যাক্সিডেন্ট হয় না? ওই রকম আর কি। রাস্তায় বের হলেন, কিছু লোকের মনে হল আপনার চুলের স্টাইলটা ঠিক নয়, তাঁরা আপনাকে পিটিয়ে মেরে ফেলল। আপনার স্বামী বা স্ত্রী অফিসে গেছেন, ফেরার সময় তাঁর টিফিনবক্সে লেগে থাকা স্যান্ডউইচের মাংসের টুকরোটা দেখে কারুর ভাবাবেগে আঘাত লাগল, সে দল বেঁধে আপনার স্বামী বা স্ত্রীকে থেঁৎলে দলা করে দিল। তাঁর অর্ধনগ্ন মৃচদেহটা পড়ে রইল রাস্তার ধারে, আর তার পাশে দোমড়ানো টিফিন বাক্সটা, যেটায় ছিল সেই অপরাধী স্যান্ডউইচ। হয়তো আপনার সন্তানের সঙ্গীকে কারুর পছন্দ হল না, কারোর ভাল লাগল না আপনার গাড়ির রং, আপনার লেখা বা আঁকা, ব্যাস, মেরে ফেলা হল আপনাকে। বাড়িয়ে বলছি না, এটাই হচ্ছে এবং হবেও। তাই যত তাড়াতাড়ি সেটাকে মেনে নিতে পারবেন ততই ভালো থাকবেন। ভবিতব্য।
তবে, এবার যেটা আমাকে অভিভূত করেছে তা হল, মানুষজনের শিল্পপ্রীতি। যাকে বলে অতুলনীয়। একজন জলজ্যান্ত মানুষকে পিটিয়ে মারার ভিডিও তুলেছেন তাঁরা। বিভিন্ন অ্যাঙ্গেলে। ওই, নাকটা ফেটে গলগল করে রক্ত পড়ছে, ক্যামেরাটা জুম ইন হল, হাতটা কনুই থেকে ভেঙে উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া হল, ক্যামেরা চলে এল এখানে। কি সুন্দর থরো এ্যান্ড ডিটেইল্ড ডকুমেন্টেশান। ওই ওই, চুড়িদারটা ছেঁড়া হচ্ছে বুকের কাছে। জুম ইন, জুম ইন। ছেলে না মেয়ে এইবার পাক্কা বোঝা যাবে।
সেই ভিডিও থেকেই দুটো ফ্রেম কেউ পোস্ট করেছেন। একটিতে দেখলাম, যখন মানুষটিকে আক্রমণ করা হচ্ছে, তখন সেই ভিড়ের মধ্যে রয়েছে একটি শিশুও। হাসছে। যেমন আমরা ভালুক নাচ দেখে হাসতাম। হাততালি দিতাম। আর দ্বিতীয় ফ্রেম, একটা নগ্ন, থ্যাঁৎলানো, রক্তাক্ত মৃতদেহ পড়ে রয়েছে ক্ষেতের ধারে। দুজন লোক দাঁড়িয়ে সেই দেহের ছবি তুলছেন। এনারা হয়তো ভিডিওটা তোলার সুযোগ পান নি। অথবা, স্টিলতুলতেই বেশি পছন্দ করেন। ওই যেমন আগে আমরা কাঞ্চনজঙ্ঘার তুলতাম আর কি।
আরেকটা যেটা ভালো লাগে সেটা হল মানুষের সাহস। ক্যামেরার সামনে একের পর এর খুন হয়ে চলেছে। খুনীদের চেহারা ক্যামেরায় স্পষ্ট। অথচ তাঁদের কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই। ক্যামেরা বন্ধ করানোর কোনও চেষ্টা নেই। বরং, বীরত্ব, জিঘাংসা আরও ফুটে বের হচ্ছে। আইনের শাসনের প্রতি মানুষের মনে কতদূর অবজ্ঞা জন্মালে এটা হতে পারে, সেটা ভেবে দেখুন। ধরুন, আমি গয়নার দোকান থেকে চুরি করছি। ক্যামেরা চলছে জেনেও আমার কোনও হেলদোল নেই। কেন না, অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে আমি জানি, কোই মাই কা লাল, আমার কিছুটি বাঁকা করতে পারবে না।
আমরা কোন সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি ভাবলেও কেমন যেন গা শিউরে ওঠে।