অনেকে একথা বলছেন যে আজকের জীবনে কবিতার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। অনেকে বলছেন কবিতার কোনো ভূমিকাই নেই আর, কবিতা আজ সম্পূর্ণই অপ্রাসঙ্গিক। কেউ বা অভিযোগ করেন সমসময়ের সঠিক চেহারা কবিতাতে নেই। আজকের কবিতা ও কবিরা, সেহেতু, ব্যর্থ। কিন্তু, প্রশ্ন এসে গেল, কবিতার কি কোনো সামাজিক দরকার নেই? কবিতার সামাজিক উপযোগিতা নিয়ে লিখতে আমি সার্বিকভাবে অক্ষম হলেও দু-চারটি জরুরী প্রশ্ন উত্থাপন করি। এর উত্তর দেওয়ার দায় কারুর খুব একটা নাই থাকতে পারে, এইসব প্রসঙ্গ চাইলে ফেলেও দিতে পারেন, তবু লিখছি:
১) কি কারণে একটি কবিতা লিখেই জীবনানন্দ চাকরি খোয়ালেন? কি এমন বিস্ফোরক বস্তু ছিল তাতে যে একজন ছাপোষা মধ্যবিত্ত চাকরি হারাতে পারেন? তিনি তো ততদিন অবধি খুব একটা কেউকেটা কবি ছিলেন না।
২) কি কারণে হাংরির তদ্যবধি নাম না জানা কবিদের পেছনে রাষ্ট্র পুলিশ লেলিয়ে দেয়? ব্যাপার মামলা ও কোর্ট অবধি গড়ায়। সুদূর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে গিন্সবার্গ আবু সাইদ আয়ুবকে চিঠি লিখে জানান, আপনারা প্রতিবাদ করুন।
৩)কেনই বা আজকের জনপ্রিয় এক কবির একটি কবিতা নিয়ে তাঁর বিরূদ্ধেও মামলা হয়, হামলার ভয় দেখায় উগ্র ও অন্ধ সাম্প্ৰদায়িক লোকজন? ফেসবুক উত্তাল হয়ে ওঠে? ব্যাপার এতদূর গড়ায় যে মুখ্যমন্ত্রীর আশ্বাস প্রয়োজন হয়ে পড়ে।
৪) কেন একটি নকশালপ্রভাবিত ছাত্র সংগঠন লেনিন দিবসে সুভাষ মুখোপাধ্যায় নামক এক কবির কোটেশন তাদের পোস্টারে দেয়? মনে রাখতে হবে ইউনিয়নে থাকার কমপালশন এবং ভোট পাওয়ার দায় তাদের রয়েছে। উক্ত কবির বিরুদ্ধে জয়দেব বসু ‘ঘেন্না’ শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন।
৫) কেন আমরা বই না দেখে জনপ্রিয় গদ্যও কোট করতে পারিনা, অথচ, এমনকি অনেক আধুনিক কবিতা নির্ভুল গড়গড় করে অনেকেই বলে যেতে থাকেন?
৬) মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধারা ব্যানারে কেন জীবনানন্দের একটি অরাজনৈতিক কবিতা, যার তেমন এক রাজনৈতিক ঝাঁঝ নেই, শ্লোগান হিসেবে ব্যবহৃত করেছিল?রূপসী বাংলার উক্ত ব্যবহৃত কবিতাটি:
'বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি...'
৭) কিভাবে বেস্ট সেলার 'মাধুকরী' উপন্যাসে জনপ্রিয় সাহিত্যিক বুদ্ধদেব গুহ এতগুলি সমকালীন বাংলা কবিতার অংশ তুলে ধরলেন? যদি সমকালীন বাংলা কবিতা সম্পর্কে পাঠক এতই বিমুখ তাহলে এই বই বাজারে কাটলো কি করে? মার্কেট রিস্ক ছিল না?
৮) কেন ‘ফিরে এসো চাকা’র ‘একটি উজ্জ্বল মাছ’ সৃজিত তাঁর একটি থ্রিলারধর্মী ছবিতে ব্যবহার করলেন? ওই ছবি কি বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়েছিল?
৯) 'দেখতে ভালো মাখতে খারাপ' একটি সাবানের বিজ্ঞাপনের ক্যাচলাইন। এই লাইন কতটা গদ্য, কতটা কবিতা?
১০) পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'আমি শ্রী শ্রী ভজহরি মান্না' গদ্যের না কবিতার, কিসের কাছাকাছি?
১১) চন্দ্রবিন্দুর গান প্রসঙ্গেও একই প্রশ্ন। এগুলি বিক্রয়যোগ্য সঙ্গীত হলেও কিছু উত্তরাধুনিক কবিতার এলিমেন্ট কি নেই?
১২) নীহার রঞ্জন রায়ের আকরগ্রন্থ 'বাঙালির ইতিহাসে' কি কোনো কবিতা বা কবির উল্লেখ নেই?
এইসব প্রশ্নগুলির উত্তর নিয়ে স্পষ্ট ধারণা না থাকলেও নিজের আবছা প্রতিক্রিয়া জানাতে পারি। কিন্তু, প্রশ্নগুলিতে কবি ও কবিতার ব্যবহারিক ও বাস্তবসম্মত দিকগুলিই রাখলাম।সংবিগ্ন পাঠককূল, সম্ভাব্য উত্তরগুলি নিয়ে একটু ভাবুন। সামাজিক জীবনে কবিতার উপযোগিতা ও প্রাসঙ্গিকতা হিসেবে হয়তো এগুলি বিবেচিত হতে পারে।
~~~~~~
চর্যা কি আজও প্রাসঙ্গিক? স্থানাঙ্ক যদি হয়, কালাঙ্ক বলে কিছু হয় না?
প্রথমে যে প্রসঙ্গ তুলেছিলাম সেই প্রসঙ্গে ফিরে আসি। কি উপায়ে কবিতা তৈরী হয় কেউ কি আদৌ জানে? মনে পড়ছে, সত্তরের কোন এক সালে, সম্ভবত ১৯৭৮(ভুল হতে পারে), 'অমৃত' নামক পত্রিকায়, সমকালীন দশ বারোজন কবিকে কবিতাসংক্রান্ত বেশ কিছু প্রশ্ন রাখা হয়েছিল। কয়েকটা প্রশ্ন স্মৃতি থেকেই লিখছি।
১) কেন লেখেন?
২) কবিতায় শব্দের গুরুত্ব কি?
৩) কিভাবে লেখেন?
৪) সমকালীন কোন কোন কবি আপনাকে প্রভাবিত করেন?
৫) আপনি কি সামাজিকভাবে দায়বদ্ধ?
বলাই বাহুল্য, বিভিন্ন কবির উত্তর বিভিন্ন ধরনের ছিল। এটাই স্বাভাবিক, কেননা শিল্প বা সাহিত্যে কোনোদিনই স্থির সিদ্ধান্তে আসা মুশকিল ও অনুচিত। তাছাড়া ব্যক্তি থেকে ব্যক্তির উত্তর এমনকি পদার্থবিদ্যার সামান্য উত্তরপত্রে যদি আলাদা হয়, তাহলে কবিতাতে আরো বেশি হওয়ারই কথা।কবির তালিকায় জয় গোস্বামী, রণজিৎ দাশ, বীতশোক ভট্টাচার্য, অনন্য রায়, তুষার চৌধুরী প্রমুখ ছিলেন। এটুকু মনে আছে যে জয় গোস্বামী ও বীতশোকের উত্তরগুলি ছিল বেশ দীর্ঘ। রণজিৎ দাশের উত্তর ছিল এতটাই সংক্ষিপ্ত যে মনে হবে যেন অবজেক্টিভ প্রশ্নের উত্তর লিখছেন। মনে পড়ছে রনজিতের 'কেন লেখেন' এর জবাবে লেখেন এই ধরণের এক লাইনের উত্তর:'আমার লিখনপ্রতিভা ও লিখনঅভ্যাস আছে তাই লিখি।' রণজিৎ জীবনানন্দ হলে 'হৃদয়ের মধ্যে রয়েছে এক বোধ, তারে আমি পারিনা এড়াতে'-হয়তো বা বলতেন। কিন্তু, পাঠক, ভেবে দেখুন, রণজিতের কথা ও জীবনানন্দের কথা কি এক নয়?
'সমকালীন কোন কোন কবি আপনাকে প্রভাবিত করেন?' এই প্রশ্নের উত্তরে বীতশোক সম্ভবত উত্তর দিয়েছিলেন, তিনি কালের বিভাজন মানেন না এবং চর্যার কবিরা তাঁকে খুবই প্রভাবিত করেন। প্রসঙ্গত, বীতশোকের তরুণ বয়সের এক দুঃসাহসিক কাজ ছিল, 'হাজার বছরের বাংলা কবিতা' বলে এক সম্পাদিত গ্রন্থ, যা সম্ভবত অধুনালুপ্ত। এখানে একটি তথ্য দিয়ে রাখি। তরুণ কবি সোমনাথ রায়ের ২০১২ তে প্রকাশিত 'ঘেন্নাপিত্তি'তে ও চর্যার কবিতাপ্রয়াস পাচ্ছি। লক্ষ্য করুন সোমনাথের এই প্রয়াস:
মূল পদঃ কাহ্নুপাদানাম্
চর্যাপদ-১০ (রাগ দেশাখ)
নগরবাহিরি রে ডোম্বি তোহোরি কুড়িআ।
ছোই ছোই জাহ সো বাহ্মনাড়িয়া॥
আলো ডোম্বি তোএ সম করিব মা সাঙ্গ।
নিঘিন কাহ্ন কাপালি জোই লাংগ॥
এক সো পদুমা চৌষঠ্ঠী পাখুড়ী।
তহিঁ চড়ি নাচঅ ডোম্বী বাপুড়ী॥
হা লো ডোম্বি তো পুছমি সদভাবে।
আইসসি জাসি ডোম্বি কাহরি নাবেঁ॥
তান্তি বিকণঅ ডোম্বি অবরনা চাংগেড়া।
তোহোর অন্তরে ছাড়ি নড়পেড়া॥
তু লো ডোম্বী হাঁউ কপালী।
তোহোর অন্তরে মোএ ঘেণিলি হাড়ের মালী॥
সরবর ভাঞ্জিঅ ডোম্বী খাঅ মোলাণ।
মারমি ডোম্বি লেমি পরাণ॥
প্রেম (কাহ্নপার পদ থেকে)
প্রেমের আশ্চর্য বাড়ি সব হিসেবের থেকে দূরে
জাতিভেদে বিত্তভেদে সবাই কখনও আসে ঘুরে
এইবারে, দ্যাখ প্রেম আমিও দেখতে যাব তোকে
ঘৃণাজয়ী যোগী আমি, লজ্জা ছেড়েছি নির্মোকে-
সৃষ্টির রহস্যমূলে রতিকলা কামনার ঘোর
সেইখানে লীলাময়ী প্রেম তোর নাচের আসর
আমিও মোহিত হই, বিনম্রে রাখি জিজ্ঞাসা
অজানার কোন পথে আশ্চর্য এই যাওয়া-আসা?
যে সুতোয় বেঁধে দিস অদৃশ্য আলোর উজানে
রঙের নেশায় মজে ভুলে গেছি বাকি সব মানে
সেই পথে পথ হেঁটে পথ ভুলে আমি কাপালিক
কামনাও হারিয়েছে এই শব, হাড়ের অধিক-
শুকায় করুণাধারা, খায় প্রেম জীবনের সার
সেই প্রেম খাব আমি সৃষ্টিচক্র করে ছারখার।
কাহ্নু আজ বেঁচে থাকলে এই দেখে খুশি হতেন যে হাজার বছর পরে তাঁর কবিতা কিভাবে, কোন এক আশ্চর্য শুশ্রূষায় বেঁচে আছে। হরপ্রসাদও হয়ত অখুশি হতেন না।রবীন্দ্রনাথের 'আজি হতে শতবর্ষ পরে' এই কবিতা কি কোনো আশাবাদ না কি এক ধরণের অমরত্বের প্রত্যাশা? এই সেই অমরত্বের প্রত্যাশা যাকে সুনীল কবিতার তাচ্ছিল্য দিয়েই নেগেট করেন।কবীর সুমন 'মুখে মুখে ফেরা গানে', বেহুলার ইমেজ দিয়ে জানান যে বৈধব্য বাংলার রীতিই নয়। মনে প্রশ্ন ও সংশয় আসে, লখিন্দর কেন 'কালকেউটের' ছোবলে মারা গেলেন।লখিন্দরের মৃত্যু তো কালনাগিনীর কামড় বলেই তো ছোটবেলা থেকে জেনে এসেছি। প্ৰশ্ন পায়, উত্তরও তো জানাই, তবু, মাঝে মাঝে মনে হয় একটু স্তব্ধতার গান শুনি। সুমনের গান কি গান না কবিতা? পল সাইমন কি গায়ক না কবি? ববি ডিলান কি নোবেল পেলেন কবিতার কারণে? তাহলে সুমনকে আমাদের দেশ, আমাদের বাংলা কেন সাহিত্যে পুরস্কার দিতে পারে না।
কিন্তু, চর্যার স্রষ্টারা কি আজকের সোমনাথের এই ভাষা বুঝে ফেলতেন? হালকা আন্দাজে বলছি, তাঁরা কি জানতেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নামক এক দেশ রয়েছে, যেখানে বসে হয়তো এই কবিতা লিখছেন এক গবেষক তরুণ কবি সোমনাথ।
হাজার বছর আগের কবিরা এমনকি আজকের ফেসবুকে স্টেটাস আপডেট দেওয়া কবিদের সঙ্গেই যেন কিভাবে এক অলীক আত্মীয়তায় রয়েছেন। তাই , কাহ্নু, কৃত্তিবাস, জয়, বিনয় , সুনীল, মৃদুল, জয়দেব(বসু), সোমনাথ যেন নিরবচ্ছিন্ন কালপ্রবাহে একই সূত্রে বাঁধা, কিন্তু তাদের দেশ একই।সে আমাদের বাংলাদেশ, আমাদেরই বাংলা রে।মনে পড়ে গেল সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের এই কবিতায় সত্যজিৎ রায়ের কথা। মনে পড়ে গেল বিভূতি ভূষণ। অপুর হাতে ধরা গ্লোব, সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের এই কবিতা আবৃত্তি করে অপু এই পুরস্কার জিতেছিল। সুদুরের পিয়াসী, কৌতূহলী, অপু এই গ্লোব সবসময় হাতে রাখত, সত্যজিতের ‘অপরাজিত’ সাক্ষ্য দেয়। কিন্তু এও মনে পড়ে গেল সত্যেন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের অভিযোগ: ' সত্যেন করতেন কিছু/যদি না ছুটতেন ছন্দের পিছু পিছু'।
ভাষার ধরণ ভিন্ন কবিতে কবিতে, স্থানে আর কালে। যদি স্থানাঙ্ক বলে কিছু হয়, কালাঙ্ক বলে কি কিছু হয়? চর্যার প্রসঙ্গ আবার উত্থাপন করে বলি বীতশোক তাঁর একটি নিবন্ধে লিখেছেন যে চর্যার যুগে কবি বলে কোনো আলাদা পেশাদার ছিলেন না। চর্যার কবিরা জাল বুনতেন, চাষ করতেন, শিকার টিকার করতেন, এমনকি ফাঁসিও দিতেন।এই নিবন্ধ লেখা হয়েছিল আনুমানিক আশির দশকে। বীতশোকের পরবর্তী যুক্তি, আজকের আশির দশকে একই রকম প্রবণতা। অর্থাৎ, কবি বলে এখন আলাদা কেউ নেই। অধ্যাপক কবি, ব্যবসায়ীও কবি, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, প্ৰমুখও কবি। যদি এই হাইপোথিসিসে কিছু সারবত্তা থাকে, তাহলে কি ২০১৮ এ একথা সত্য নয়? ২০০০ সন থেকে কি বিশ্বে, ভারতে, তথা বাংলায় কোনো গুণগত উল্লমফন হয়নি ভাবনায়, ভাষায়, ভঙ্গিতে?আজকের কবিতার ভাষা বোঝাতে বেছে নিলাম আপাতত একটি নাম, সায়ন কর ভৌমিক, তুলছি কবিতার অংশ, যেখান থেকে ব্যক্তি সায়নকে খুঁজুন, দেখুন স্থান ও কালকেও:
'আজকাল সব ছন্নছাড়া হয়ে গেছে, রক্তচাপ, ক্ষুধামান্দ্য, সংসার, এমনকী যৌন সততা পর্যন্ত, রাতে ঘুম নাই, বাটামের ভয় আছে না?
কিন্তু সে যাই হোক; এইসব শূন্য দশক, একের শতক এইসবই কিন্তু গাপ হয়ে ছিল নব্বইয়ের ভাঁজে।
দহরম মহরম ছিল বাপু, তাহাদের সাথে। সাতে পাঁচেই ছিল সব, নয়ে ছয়ে, বাহান্ন তিপান্নতেও ছিল সব বাইপাসের ধারে ভুট্টাপোড়ার সাথে দুইটি ছিলিম।'
যদি পড়তে পড়তে অনভ্যস্ত পাঠক অবিরত ধাক্কা খান, তবে পড়ুন পরের অংশটি:
'টরেটক্কা সংকেত পাঠাই, পদ্য লিখি এখানে ওখানে
ইউক্যালিপটাসের পাতা, ভেজাল দিই, এদিক ওদিক, একপাতায় ছাপিয়ে দিই টরেটক্কা,
ক্যাপ্টেন স্পার্ক হলে ধরে ফেলতো ঠিক, বুঝে নিত সন্ধে নামার ঝোঁকে
জনবহুল সাইকেলরিক্সাসঙ্কুল পথের কোনাখামচি ঘেঁষা
ভুলভাল কোড।'
এখানে পড়তে পড়তে প্রশ্ন আসতে পারে যৌন সততা আবার কি জিনিস? বাইপাস এই শব্দটি কবে থেকে কলকাতায় ঢুকে পড়ল তা ধরতে নির্ণায়ক কি এই কবিতা? 'ছিলিম', 'বাটামের ভয়', 'ভুলভাল' এগুলি তো চালু আড্ডার শব্দ যা আমরাও বলেছি। কিন্তু এই কবিতার প্যাটার্ন কি শক্তি, জয়, মৃদুল, জয়দেব থেকে কি অন্যরকম নয়?
কোড বললে তা কতটা সফটওয়ার কোড? মনে পড়তে পারে কি ড্যান ব্রাউন? তাছাড়া সেমিওটিক্স বা চিহ্নবিদ্যা দিয়ে তৈরি 'মিনিং মেকিং' প্রকল্পের কথা বলা হচ্ছে? কি এখানে 'কোড'? মনে পড়তে পারে 'অথর ইজ ডেড' র প্রকল্প? ব্যানাল এই শব্দটি কবিতায় লেখা সঙ্গত? পাঠক কি কবির কবিতা ধরতে পারছে না? ধরার জন্য কি ক্যাপ্টেন স্পার্ক হতে হয়? কবি কি শক্তির পুরনো কিসসা আনলেন : পাঠককে এগিয়ে আসতে হয়, হৃদয় দিয়ে, দরদ দিয়ে, মগজ দিয়ে?কবি-পাঠকের সহাবস্থান কি এইসব কথায় রয়েছে? তাছাড়া শূন্য দশকের নির্মাণে কি নব্বইয়ের ভূমিকা ছিল?
~~~~~~
কামিনী রায়ের কবিতা কি রবি ঠাকুর লিখতে পারতেন? যশোধরার কবিতা কি পুরুষ কবি লিখতে সক্ষম?
ফেমিনিজমের অতিচর্চিত পুরনো কচকচানিতে না গিয়ে বলি সেই ঊনবিংশ শতাব্দীতে যখন দেশ তথা ভারত, বাংলা আসলে ব্রিটিশ ভারত বা ব্রিটিশ বাংলা, ততদিন থেকে কামিনী রায় সহ একাধিক কবি তাঁদের কবিতা লিখছেন। এবং কামিনী রায়ের, 'পাছে লোকে কিছু বলে' আজও সমান প্রাসঙ্গিক না হলে এক ধরণের দ্বিধাগ্রস্ততা আজও কেন মহিলা কবির গলায়? পুরুষ বা নারী বিভাজন যদি নাই থাকে তাহলে কিভাবে তৃতীয় লিঙ্গ বলে একটা ব্যাপার থাকবে?
তবুও মেয়েদের ঋতুকালীন প্রসঙ্গ আজ অনেক অকপট। তাই তাঁরা সেদিনের দ্রৌপদীর রূপা গাঙ্গুলির মত মেক আপ চড়িয়ে বস্ত্রহরণের সময় কনফিউজড স্বামীর হঠকারিতার জন্য কৃষ্ণকে বা নীতিশ ভরদ্বাজকে ডাকবেন না। কালকের দ্রৌপদী আজকের মহাশ্বেতার রক্তাক্ত দোপদী মেঝেন হয়ে এগিয়ে বলছেন: কাউন্টার কর, কাউন্টার কর। আজকের মহিলাদের কবিতার সুর বরং লিরিকস্বভাব হারিয়ে ফেলছে, আবার পুরুষ কোনো কবি ছন্দের ঝোঁক এত বেশি লিরিক লিখছেন যে তাতে যেন ধার ও ভার কমে যাচ্ছে।
আজকের মেয়েদের দায়িত্ব নিতে অনেক বেশি হয়, অথচ তারা পুরোনো ট্রাডিশনের সিঁদুর মুছে ফেলছেন, কেমন একটা ছন্নছাড়া ভাব যেন তাদের, এমন এক পুরুষতান্ত্রিক অভিযোগ বাড়ছে। কেমন হয় তাঁদের কবিতা, যারা ফর্ম ফিলাপে বাধ্যত বা স্বতঃস্ফূর্ত কিনা জানিনা, জেন্ডারের জায়গায় F এ টিক দেন ?
'মায়ামমতায় ভরা এ সংসারে এসে
তুমি তো করেছ শুধু তুমুল অশান্তি, মাগো, বাড়ি যাও, বাড়ি যাও,
আমাকে বলেছে সব প্রতিবেশী, পাড়াপড়শি , এমনকি নিজের ছেলেটিও।
আমাকে বলেছে আমি অলক্ষ্মী পিচেশ।
কেন বা বলবে না বল, আমি তো খেয়েছি সিগারেট আর আমি তো সন্ধে পার করে
বাড়িতে ফিরেছি, কোন সন্ধেবাতি, হুলুধ্বনি, শঙ্খের বাতাস
আমাদের বাড়িতে বহেনি।
তারপর এসেছে বন্ধু, কবিদের দল, মধ্যরাতে আড্ডা দিতে
ছেলে অন্য ঘরে বসে পড়া করছে, দোর দিয়ে, সেও তো জেনেছে
তার মা অদ্ভুত, খাপছাড়া, কোন সাধারণ সতীলক্ষ্মী নয়।
সবাই বলেছে তুমি বাড়ি যাও বাড়ি যাও, তার জন্য ফ্ল্যাট কিনে ফেলেছি নিজের।
শুধু যেই নিজের আনন্দ আমি রাখতে গেলাম সেই ঘটে
ঘটটি গড়িয়ে পড়ল।
স্বামী ও সংসার কোন কথাই বলল না। ছেলেও এবার চুপচাপ।
আমি কি আমার সুখ নিজে নিজে রচনা করব , গো?
আমি কি আমার ফ্ল্যাট একা একা সাজিয়ে ফেলেছি?
আমার উনুনে আজ একজনের রান্না হবে নাকি?
এই দুঃখে এই কষ্টে, আমি ঘট গুঁড়িয়ে ভেঙেছি...
তারপর অলক্ষ্মী মায়ের মত একা একা ফিরে এসে ঘরে
আমি সন্ধ্যা অবদি ঘুমাই, আর চুল খুলে বেপাড়ায় ঘুরি...
অশান্তি বানাই আমি, মুখে মুখে ছড়া কাটি সমস্ত বিকেল...
আর, আমি সারা পথ নিজের এ পদচিহ্ন ছড়িয়ে এসেছি... মনোদোষে।
নিজের শরীর খান খান করে আমি আজ রোগজীর্ণ একজোড়া জ্বরতপ্ত চোখ...
তৃতীয় নয়ন কই, সে তো ছিল, কুলুঙ্গিতে তোলা, আজ নামিয়ে পরে নি?'
যশোধরা রায়চৌধুরী লিখছেন এই কবিতা। ফেসবুকে শেয়ার করলেন অপর এক কবি, যিনিও নারী। শেয়ারের দিন হলো এ বছরের লক্ষীপুজো। এর বেশি কিছু বলা এক ধরনের অর্বাচীনতা হয়ে যেতে পারে। পাঠক, পড়ুন। আপনিও পড়ুন, হে পাঠিকা।
শুধু বলি এই কবিতায় কতটা রক্তক্ষরণ, দ্বিধায় দীর্নতাই বা কতটা? সনাক্ত করুন। কামিনী রায়ের 'পাছে লোকে কিছু বলে' কবিতার কিছু অংশ তুলে দিচ্ছি। কামিনী রায়ের সংশয়- প্রকল্পের চেয়ে কি যশোধরার সংশয়ের ধরণ কিছু আলাদা? কোথায় বা তা ভিন্ন? পাঠক, পড়ুন, সনাক্ত করুন। অল্পই তুলে দিচ্ছি কামিনী রায়:
'করিতে পারি না কাজ
সদা ভয় সদা লাজ
সংশয়ে সংকল্প সদা টলে,
আড়ালে আড়ালে থাকি নীরবে আপনা ঢাকি
সম্মুখে চরণ নাহি চলে
কাঁদে প্রাণ যবে, আঁখি-সযতনে শুষ্ক রাখি
নির্মল নয়নের জলে
পাছে লোকে কিছু বলে'
এই দুটি কবিতা থেকে কান্না সনাক্ত করা যায় , ধরা যায় দুই সময়ের দুই কবির সংশয় ও সমস্যার যন্ত্রণা, যা প্রসূত কবিতায়। নারীর নিজস্ব অধিকার নিয়ে সমাজ কতদূর এগিয়েছে, এই প্রশ্নও এসে যেতে পারে।
এবারে মিতুল দত্তের কবিতায় চোখ রাখি, পেয়ে যেতে পারি অন্য এক ঝোঁক:
'সন্ধিবয়সের দিকে মুখ ছিল, করুণার দিকে
কাকলির দিকে আর ক্ষুধিত পাষাণে লেখা আলোর অপেরা, আলো
মিছরির ছুরির মতো আলো তার স্বভাবে ঢুকেছে
শরীরের খানাখন্দে, যুবক, জ্বালানি আর গান
উনুনে দিয়েছি আমি, তালপাতা খোঁপায় পরে শুয়ে আছি
পিঁড়িতে সাজিয়ে সাদা, হে সাদা, হে শ্বেতপত্র, আমি তার রবিবাসরের
সম্রাজ্ঞী-কেচ্ছার পাশে পাত্র চাই পাত্রী চাই ভরিয়ে তুলেছি
আমি সেই চৈতন্যহারানো বিষ্ণুপ্রিয়া হতে চেয়ে
হয়ে গেছি সূর্পনখা, নাক কেটে গুরুদন্ডবৎ
মিশেছি তোমার খুরে, গোক্ষুর আমার
তোমার মাথায় চড়ে ত্রিকাল দেখাব ভাবি আর
ত্রিকাল আমাকে দেখে, আমি যেন সঙ, দর্জিপাড়া
মর্জিনা নাচিয়ে যেন ঝুমঝুমি বাজাব'
এখানে ‘ক্ষুধিত পাষাণে’র উল্লেখ কি সেই নারীচরিত্রের ওপর পুরুষ কর্তৃত্বের আভাস? সূর্পনখা, বিষ্ণুপ্রিয়া, মর্জিনা সবকটি নারীর উল্লেখের মধ্যে কি কোনো মিল আছে, যেগুলি এক ধরনের কষ্ট ও বঞ্চনার ইঙ্গিত দেয়? কাকলী ও করুণাও তো কোনো নারীরই নাম। নির্মাণ কৌশলে হয়ত বা মনে পড়তে পারে ইউরোপিয়ান বা ভারতীয় চলচ্চিত্র, যেখানে সমস্ত চরিত্রই নারী। তাছাড়া দর্জিপাড়া সমকালীন প্রান্তিক নারীর দিকেই যেন দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এই কবিতার সঙ্গে নাটকের কোনো যোগ আছে? সন্ধিবয়েস কি বয়ঃসন্ধি নাকি তা আড়ি-ভাবের কবিতা। পুরুষচরিত্র-বিবর্জিত এই কবিতা কি এক সচেতন নির্মাণ নয়?
~~~~~~
কবিতায় ধরা পড়ে সমকাল, ইতিহাস, প্রযুক্তি, অর্থনীতিও
কবিতা থেকে কবিকে চেনা যায়,সমকাল অদ্ভূত ধরা পড়ে। একটি সাম্প্রতিক কবিতা পড়ুন:
'অবশেষে বোতামের অক্ষরে অক্ষরে উপগ্রহ যোগ যদি যায় খুলে
আমরা পৌঁছতে চেয়েছি চাঁদে-মধ্যরাত্রির সিকি ভাগ মাশুলে।
নিতান্ত মামুলি কথা, তবু অনর্থক নয়, সীমিত সামর্থটুকু
নিঙড়ে বরাতমাফিক কথার ক্ষরিত সুখ সামান্য আশয়
পার করে দেয় তার পরদিন থেকে আরও কিছু চন্দ্রহীন তট।
কেউ বুঝি আড়ি পেতেছিল সেইখানে? কেউ বুঝি লিখেছিল পট?
সে-ই বুঝি পথ জুড়েছিল, বটঝুরি দোল দিয়ে দেওয়াল গেঁথেছে?'
সুমন মান্নার ‘ফোনঘর’ এই কবিতায় যেন ফিরে আসছে ফেলে আসা এসটিডি যুগ, যা এখন গল্পের ও কবিতার বিষয়। উপগ্রহ যোগ আসলে স্যাটেলাইট মনে হয়, যা আজকের যোগাযোগের এক আবশ্যিক শর্ত। সিকি ভাগ মাশুল বললে মনে পড়ে কোনো এক রাত এগারোটার পরের তড়িৎদার বুথ, যেখানে উদ্বেগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রেমিক ও প্রেমিকা। এখানে উল্লেখ্য, প্রেম করতে রাষ্ট্রীয় মাশুল লাগে, কবি জানিয়ে দিলেন। উদ্বিগ্ন প্রেমিক- প্রেমিকাকূল, উদ্বেগের কারণ লম্বা কিউ এবং সমস্ত লাইন ব্যস্ত। মনে পড়ে অল লাইনস আর বিজি, যা আজকের দিনেও মাঝে মাঝে শোনা যায়। সুমন যেন এক অজানা বান্ধবীর কথা বলছেন। সেই বান্ধবীর জন্য যেন মন খারাপ। তাই শেষ লাইনটি এরকম বিষণ্ণ : ' মাঝে মাঝে তাকে মনে পড়ে'। সুমন এক মারাত্মক কথা জানাচ্ছেন : ' নিতান্ত মামুলি কথা, তবু তা সাধারণ নয়'। মনে পড়ে বুদ্ধদেব বসুর লাইন: যা কিছু ব্যক্তিগত, তাই পবিত্র।