কিছু কবিতা আখ্যানধর্মী। এই গল্পগুলি ব্যক্তিগত হয়েও আশ্চর্যরকমের সার্বজনীন হয়ে উঠতে পারে। রূপক চক্রবর্তীর এই কবিতাটি পড়ুন, পেতে পারেন এক সজল অনুভব:
“তখন আমি বাবার পাশেই ঘুমিয়েছিলাম
আমাকে কেউ ডাকেনি।
তখন খুব জ্বর বাবার।
মাথায় জলের ধারা দিতে দিতে মা গাইছিল,
একা মোর গানের তরী...
মা কি করে জানতো! আমি তো তখন ছোট
আমি তো তখন ঘুমে।
দুপুরেই বাবা পাশ ফিরতে ফিরতে চলে গেল,
শুধু ঠোঁট নেড়ে বলেছিল, আগুনের পরশমণি...
আমার বাবা কেজিবি ছিল
আমার বাবা সি পি আই ছিল
ঘাটকাজের পর গীতবিতানের প্রথম খন্ডে উপুড় হয়ে পড়ি
৯৪ পৃষ্ঠায় ২১৯ নম্বর গানটা নেই।
উঠোনে তখন অনেক লোক, থৈ থৈ করছে লোক ঘরে-বারান্দায়।
যাত্রা শুরুর মুহূর্তে শিশিরজেঠু বলেছিল,
হরিধ্বনি দিও না কেউ।
তবে কি মা।
মা তখন ওই ৯৪ পৃষ্ঠার ২১৯ নম্বর গানটা
আগুনের পরশমণি বাবার ঠান্ডা হাতের মধ্যে
রেখে দিতে দিতে বলেছিল,
আমার তো কোনও ঠাকুর নেই
তুমি ওকে দেখো রবিঠাকুর।“
পিতৃহারা সন্তানের লেখা এই কবিতায় একই তলে অবস্থান করে সিপিআই, কেজিবি ও রবীন্দ্রনাথ। আর তাতেই যেন মনে হয় এমন ভীষণ অসম্ভবের আখ্যান কবিদের পক্ষেই লেখা সম্ভব। একথাও মনে হয় যে আন্তরিকতায় লিখিত ব্যক্তিগত কাব্য-আখ্যান, পাঠকমনে দাগ কাটতে সক্ষম, তা ব্যক্তিগত থেকে অনেকের হয়ে ওঠে। এই কবিতা সাক্ষ্য দেয় ব্যক্তির পাশাপাশি এক বিশেষ সময়েরও, যেখানে মার্কসবাদী পিতার সহধর্মিণী হয়ে ওঠেন সেই মা, যার ঈশ্বরের নাম রবিঠাকুর।
কবিতার সবুজ, জল, মাটি, জঙ্গল, জীবন, ক্ষুধা
আজকের নাগরিক জীবনের থেকে ঘাস, পাখি হারিয়ে যাচ্ছে, হারিয়ে যাচ্ছে শুদ্ধ রোদ। কিন্তু সেই কারণেই কি নাগরিক কবিতা আজ চাইছে শুশ্রূষার সবুজ? যদি কলকাতায় গাছ লাগানোর কথা বলেন কোনো পরিবেশবিদ, তবে নাগরিক কবিদের প্রকৃতির প্রসঙ্গ তোলা মানা? তাহলে কবি কি পয়সা খরচ করে হিমালয়ের বুগিয়াল বা রোটাং পাস গিয়েও বি এম ডব্লিউ এর কথা ভাববেন? প্রশ্নটি তোলা রইল। আপাতত যাই অন্য একটি কবিতায়। এক সময়ের মাস্টারমশাই, বর্তমানের বন্ধুর সুবাদে এই কবিতা পেলাম:
'আহারে বৃষ্টির রা, সোহাগি লো, আমি থাকি দূর পরবাসে।
কান্দে না তোমার বুকে একঝাঁক বুনোপাখি অবুঝ কৈতর?
কেমনে ফুরায় নিশি? বলো সই, কেমনে- বা কাটাও প্রহর?
পরাণ ছাপায়ে নামে বাউরি বাতাস, দারুণ বৃষ্টির মাসে।
যে বলে সে বলে কথা, কাছে বসে, হাতে খিলিপান দিয়ে কয়-
এতো জল ঝরে তবু পরান ভেজে না কেন, কও তো মরদ?
দুয়ারে লাগায়ে খিল যদি কেউ থাকে তারে কে দেবে দরদ।
শরীরের মোহনায় দেখি তার বুনো ঢেউ রক্ত-মাংসময়।
শরীর গুটায়ে রাখি, শামুকের মতো যাই গুটায়ে ভেতরে।
অন্ধকার চিরে চিরে বিজুলির ধলা দাঁত উপহাসে হাসে,
আমি বলি- ক্ষমা দাও, পরান বন্ধুয়া মোর থাকে পরবাসে,
দেহের রেকাবি খুলে পরানের খিলিপান কে খাওয়াবে তোরে।
গতবার আষাঢ়ও পার হয়ে গেলো তাও নামে না বাদল,
এবার জ্যোষ্ঠিতে মাঠে নেমে গেছে কিষানের লাঙল-জোয়াল।
আমাদের মাঝে দেখো জমির ভাগের মতো কতো শত আল্,
এই দূর পরবাস কবে যাবে? জমিনের আসল আদল।
কবে পাবো? কবে পাবো আল্ হীন একখণ্ড মানব-জমিন?
পরবাস থাকবে না, থাকবে না দূরত্বের এই রীতি-নীতি।
মহুয়ার মদ খেয়ে মত্ত হয়ে থাকা সেই পার্বনের তিথি
কবে পাবো? কবে পাবো শর্তহীন আবাদের নির্বিরোধ দিন?'
এই আশ্চর্য কবিতাটি পড়ুন এবং কবির স্থানাঙ্ক নির্ণয় করুন। শুধু বলে দিই এই কবিতায় অনেক ভাবনার খোরাক পেলেও পেতে পারেন, যা জৈবিক প্রসঙ্গ থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে দেয় মৌলিক দার্শনিক প্রশ্নে, পাঠককে ভাবতে বাধ্য করে। এই আল্ হীন একখণ্ড মানব-জমিনের রচয়িতা রুদ্র মহম্মদ শহীদুল্লা। অচেনা শব্দগুলি, ভাষা ও প্রকাশের ভঙ্গি দেখে যেন মনে হয় ওপার বাংলার কবির পক্ষেই হয়ত বা এমন সজল, সবুজ কবিতা লেখা সম্ভব।
নির্মল হালদার বলে এক কবি আছেন সুদূর পুরুলিয়ায়। শুনেছি তিনি হাটে চাল নিয়ে বসতেন। চরম দারিদ্র্যে, কষ্টে জীবনযাপন করতেন। তাঁর একটি কবিতা খুঁজে পাচ্ছি না। মূল ভাবনাটি এরকম: একটি মেয়ে খুব জল ভালবাসত। জল ধরতে যেতে হত খুব। মেয়েটা জল ভালবাসত। জলও একটু একটু করে ভালোবেসে তার হাত পায়ের আঙ্গুল খেয়ে নেয়।
আসলে মেয়েটির হাত ও পায়ের আঙুলে হাজা হওয়ার কথা লিখেছেন নির্মল। প্রান্তিক জীবনকে খুব কাছ থেকে দেখতে না পেলে কি এই ধরনের সমব্যথী ভাবনা লেখা সম্ভব? নিৰ্মলের কবিতায় আকাশ, জল, ধান, পাখি, রোদ, প্রজাপতি, ফড়িং সবের স্বতঃস্ফূর্ত সহাবস্থান। তাঁর একটি কবিতা দৈবাৎ পেলাম। পড়ুন:
‘চিংড়ি রাজা এসেও
পাতালের মাটি চিমটি কেটে তুলেও
সৃষ্টি করতে পারেনি এই পৃথিবী।
কাঁকড়া এসেও
পাতালের মাটি চিমটি কেটে তুলেও
সৃষ্টি করতে পারেনি এই পৃথিবী।
কেঁচো এসে পাতালের মাটি খেয়ে
সোনার থালায় মল ত্যাগ করে করে
সৃষ্টি করলো এই পৃথিবী।‘
এই কবিতায় যেন বর্ণিত হয় এক বাস্তুতন্ত্র, পরিবেশের প্রাকৃতিক ভারসাম্য। মনে হতে থাকে চিংড়ি আর কাঁকড়া- লোভী মানুষের প্রতি এ এক হালকা বিদ্রূপ। পাশাপাশি উপেক্ষিত কেঁচো কি ততটা কাজে আসে? অথচ তার মল বাড়িয়ে দেয় মাটির উর্বরতা, ফলায় সবুজ ফসল। একটি প্ৰশ্ন আসে, আদ্যন্ত নাগরিক কবি কি এই কবি লিখতে পারবেন? নিৰ্মলের নিজের ভুবন মাটি, জল, কাঁকড়া আর কেঁচো দিয়েই ঘেরা বলেই হয়তো তাঁর কবিতায় প্রাকৃতিক সত্য এসে সহজে ধরা দেয়।
লোককবি ভবতোষ শতপথীর নাম শুনেছেন? অবিভক্ত মেদিনীপুর জিলার কবি। তাঁর একটি পংক্তি প্রবাদের মতো, ঠাট্টা হিসেবে, গ্রাম থেকে শহরে ঘুরে বেড়াত। পংক্তিটি এরকম:
'ভালবাসা ভেস্তাইয়া গেলে যার বাবা হওয়ার কথা সে মামা হইয়া যায়!'
কেমন কবি ছিলেন? একটা কবিতা পড়ে ধারণা করুন:
‘পাত তুলতে যে যাবি টুসু দেশে কি আর বন আছে
শালমহুল গাছ কাটা নিয়ে পরদেশী পালাই গেছে
দেখনু মুড়াতাড়া
কাঠ জুটে না পোড়াতে বাসী মড়া
ভাঙ্গা ইঁট বনাবি কিসে, টুটা বটা আধভাঙ্গা
হাল ভরাই চাষ করতে দিল খাল ধারের শুকনা ডাঙা।
থোতনা লাড়িস্ না আর
কামারশালে কাম পাতে নাই জাত কামার
থোতনা লাড়িস্ না আর।
হামার টুসুর একটা বেটা গো গরু চরায় ইঁদু কাড়ে
ভখে শকে কাঁদে বাছার, পেট ভরে নাই জল মারে।
মায়ের মনটা কাঁদে।
হায় গো মায়ের মনটা কাঁদে
হড়কা বহি ঠেকাই কী বালির বাঁধে।
উপরের পাড়ে ওদের কুড়ায়
সাফা সুতরা লক গিলা
যে ডাকে ভাই সইতে লারে রাইতে মাথায় পায় দিলা,
ছি ছি লাজের কথা
মানুষ ভুলায় ভোট নিতে ভাড়ুক নেতা
ছি ছি লাজের কথা।‘
এই কবিতা পরে গণসঙ্গীত হয়েছে। প্রসঙ্গত এই কবিতায় উপেক্ষিত, বহুচর্চিত জঙ্গলমহলের বঞ্চিত মানুষের কন্ঠস্বর শুনতে পাওয়া যায় না? শুনতে পাওয়া যায় না তাদের হাহাকার? মনে হয় না, আসলে ভবতোষের কণ্ঠস্বর তাঁদেরই বঞ্চনার কথা বলে? এই শব্দপ্রয়োগ কি অসঙ্গত? আঞ্চলিক ভাষায় যদি গল্প বা উপন্যাস লেখা যায় তাহলে কবিতায় তা মানতে অসুবিধে কোথায়? এই কবিতা থেকে ভবতোষের স্থানিক বা কালিক অবস্থান খুঁজতে চাওয়া কি অন্যায়?
শেষ কথা, তবু শেষ নয়, বাকি কথা পরে হবে
চর্যার কবিদের সঙ্গে তো এখন আলাপ করার উপায় নেই। তাদের সঙ্গে আলাপ কবিতার মাধ্যমেই । কাল যদি কোনো কারণে বাংলা ধ্বংস হয় এবং কতিপয় কিছু কবিতা কোনো কারণে কোনো রাখালদাস বা হরপ্রসাদ খুঁজে পান তার থেকে কি আজকের নাগরিক ও গ্রামীণ জীবন সনাক্তকরণে কিছু চিহ্ন ও সংকেত দিলেও দিতে পারে না? কিন্তু, এর জন্য কি কবিদের ব্যক্তিগত জীবন জানা আবশ্যিক? আবশ্যিক হলেও সেটা কতটুকু? সব ক্ষেত্রে কি সেই সুযোগ থাকে?
তাই, আমি কবিতা থেকে কবিকে খুঁজে নিতে পক্ষপাতী। কবিতা থেকেই খুঁজতে চাই কার বাড়ি রানাঘাট, কার মেদিনীপুর, কার শিমুলপুর, কার বাড়ি অজয় নদীর ধারে। স্থানাঙ্ক জানা মানে শুধু স্থান নয়, অবস্থানও। কোন কবির কোন ঝোঁক, তাও বেরিয়ে আসতে পারে। কে কোন জাতীয় মদ খান, কার কোন পোশাক প্রিয়, কে চাইবাসা কতবার গেছেন, কে ধলভূমগড়, এই নিয়ে বহু চর্চা হয়েছে। গায়ত্রী চক্রবর্তী প্রসঙ্গ এখনো বিনয় প্রসঙ্গ এলে যেন আগে এসে পড়ে। কিন্তু, আগে তো কবির কবিতা পড়ি, কবিতা নিয়েই আলোচনায় প্রবৃত্ত হই। সেখানে কবিকে খুঁজতে চাওয়াই তো সঙ্গত। রবীন্দ্রনাথের ' কবি কোনখানে তোর স্থান' বলে একটি লাইন মনে পড়ে গেল। তাঁর এই কবিতায় হয়ত আমার ভাবনার কিছু সমর্থন মিললেও মিলতে পারে।
প্রয়োজনে কবির নিজের লেখা প্রামাণ্য গদ্য পড়ুন। কবিতা বুঝতে, কবিকে বুঝতে তা সহায়ক হলেও হতে পারে। পড়ুন নৈর্ব্যক্তিক নানান কিসিমের কবিতা সংক্রান্ত আলোচনা। কবিতা নিয়ে নানান আঙ্গিকে আলোচনায় মেতে উঠুন। একটি কবিতা নিয়ে আলোচনা হতে পারে, একটি বই নিয়ে, সমগ্র কবিতা নিয়ে, সমকালের কবিদের নিয়ে, তুলনামূলক আলোচনায় একাধিক কবিদের বেছে নেওয়াও যেতে পারে। পশ্চিমে কবিতার টেক্সট নিয়ে সেমান্টিক্স, সেমিওটিক্স এবং নানান রকমের বস্তুনিষ্ঠ পদ্ধতিতে কবিতার পাঠ অনেকদিন যাবৎ চলছে। তাঁরা মনে করেন কবিতা যতটা কবির, ততটাই পাঠকের। একই কবিতা গড়ে তুলতে পারে নানান পাঠ-প্রতিক্রিয়া। পাঠকের রুচি ভিন্ন, দেখবার চোখও ভিন্ন। এ-কারণেই ভিন্নতা।
এবং আমি কবিতার পক্ষে। কবিতাই বেশি প্রবাদ চিরকাল তৈরি করে এসেছে। কবিতার প্রয়োজন প্রেমে ও বিপ্লবে, যুগপৎ। আজকের কবিতা, তুমি শহরে, গঞ্জে, গ্রামে, স্টেশন, টার্মিনাসে একটু জীবনীশক্তি দিও, দিও ক্লোরোফিল আর খাদ্যপ্রাণের শুশ্রূষা। মুখ থেকে মুখে, ফেসবুক ও হোয়াটস আপে ছড়িয়ে পড়ুক নতুন, নতুন কবিতা। কবিতার ফিডব্যাক দিন, কবির কবিতা পড়ে, যদি সহসা খুঁজে পান মন ভালো করা লাইনগুলি। কারণ, কবিতা ও কবিও কিছু জলসেচ চায়।
আজকের জটিল নাগরিক ক্লান্তিতে, কবিতা, শেষ পর্যন্ত তোমাকেই চাই।