১।
ব্রিটিশপূর্ব মুঘল যুগে, মূলত শাহজাহান বা আওরঙ্গেবের সময়, বা বাংলায় মুর্শিদকুলি-আলিবর্দি-সিরাজ জমানায়, বাংলায় সতীদাহের বর্ণনা বিরল। জাঁ ব্যাপতিস্ত তাভার্নিয়ের, যিনি শাহজাহান (১৫৯২ - ১৬৬৬) যুগের শেষে এবং আওরঙ্গজেবের (১৬১৮ - ১৭০৭) জমানার শুরুতে ভারতবর্ষে ছিলেন, একটি চোখে-দেখা সতীদাহের বর্ণনা দিয়েছেন পাটনায়। সেটি বাংলা সুবার অংশ হলেও, প্রথাগত অর্থে বাংলা নয়। তাঁর বাকি চিত্রধর্মী বর্ণনাগুলি সবই ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের। প্রায় সমসময়েই ভারতে এসেছিলেন ফ্রাঁসোয়া বার্নিয়ের। তিনিও যে কটি সতীদাহের বর্ণনা দিয়েছেন, সেগুলি দিল্লি, সুরাত বা লাহোরের। পূর্ব ভারতের নয়। অথচ এঁরা দুজনেই, অন্তত তাভার্নিয়ের বাংলা ঘুরেছেন খুব ভালো করে। নানা বিষয়ে খুব বিশদ বর্ণনাও দিয়েছেন। বস্তুত 'বাংলা রাজত্ব' (Kingdom of Bengal) তে সতীদাহের প্রকরণ নিয়ে দীর্ঘ বিবরণ দিয়েছেন তাভার্নিয়র, কিন্তু সেই বাংলাও আজকের ভৌগোলিক বাংলা নয়। তিনি পাটনাকেও বাংলার একটি শহর বলেই লিখেছেন। সেখানে দূরদূরান্ত, উত্তর দিক থেকে, এমনকি ভূটান থেকেও সতীদাহের জন্য সদ্যবিধবারা আসতেন, কিন্তু আজকের ভৌগোলিক বাংলার কোনো এলাকার নাম তাঁর বর্ণনায় নেই । তাভার্নিয়ের এও লিখেছেন, পূর্বাঞ্চলে এই প্রথার আবশ্যিক অঙ্গ ছিল গঙ্গাস্নান। কাজেই প্রত্যন্ত অঞ্চলে আলাদা করে ব্যাপকহারে এই ঘটনা ঘটত, এ কথা কার্যত তাভার্নিয়েরে অনুল্লেখিত।
এই অনুল্লেখের একটি কারণ হতে পারে, এই, যে, ভারতের সর্বত্র একই ভাবে সতীদাহ প্রথা চালু ছিলনা। বাংলায় হয়তো এর সংখ্যা কমই ছিল। বার্নিয়ের খুব স্পষ্ট করে লিখেছেন, যে সতীদাহের সংখ্যা মুঘল রাজত্বে কমে এলেও, 'রাজা'-শাসিত এলাকাগুলিতে এর সংখ্যা ছিল উল্লেখযোগ্যরকম বেশি (the number of self-immolations is still very considerable, particularly in the territories of the Rajas, where no Mahometan governors are appointed)। বাংলা ছিল মুঘল সুবার অংশ। ফলে বাংলায় যৌক্তিকভাবে সতীদাহের সংখ্যা কম হওয়াই স্বাভাবিক। অবশ্য এই কম-বেশির কোনো আঞ্চলিক চরিত্রও থাকতে পারে। এই দুই ইউরোপিয়ানের বর্ণনায় অবশ্য সেরকম কিছু ইঙ্গিত না পাওয়া গেলেও মুঘল-শাসিত এলাকায় সতীদাহের সংখ্যা কম ছিল কেন, এ বিষয়ে তাঁরা একবাক্যে একটি কারণ লিখেছেন। মুঘল এবং মুসলমান রাজত্বে রাজ্যশাসক (সম্ভবত সুবাদার বা ফৌজদার)এর অনুমতি ব্যতিরেকে কোনো সতীদাহ হতনা। তাঁরা প্রথমে যাচাই করতেন, মেয়েটি সম্পূর্ণ স্ব-ইচ্ছায় মরতে চায় কিনা। তাকে সুবেদারের কাছে সশরীরে অনুমতি চাইতে আসতে হত। তারপরেও তাকে বিরত করার চেষ্টা হত নানা উপায়ে (বুঝিয়ে, ভয় দেখিয়ে)। তারপরও কাজ না হলে তবেই অনুমতির প্রশ্ন। তাতেও, মেয়েটি নিজে নাবালিকা হলে, বা তার নাবালক সন্তান থাকলে অনুমতি দেবার চল ছিলনা। ফলে জোর করে ধরে জ্বালিয়ে দেবার প্রশ্ন মুঘল রাজত্বে একেবারে ছিলনা বললেই চলে। যেটুকু হত, তা অত্যন্ত সুদৃঢ় স্ব-ইচ্ছা ছাড়া সম্ভব ছিলনা। কয়েকটি ক্ষেত্রে, বার্নিয়েরের বর্ণনায় পাওয়া যায়, উত্তর এবং পশ্চিম ভারতে, আগুন জ্বলে যাবার পর মনের জোর হারিয়ে বা যন্ত্রণায় কোনো মহিলা চিতা থেকে নেমে পড়তে চেয়েছেন, সেক্ষেত্রে বাঁশে করে তাঁকে চেপে রাখা হয়েছে। অন্য কয়েকটি বর্ণনায় মহিলারা নিজের হাতে অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে আগুন জ্বালাচ্ছেন। যেটাই হোক, সজ্ঞান সম্মতি ছাড়া কোনো নারীর জ্যান্ত অবস্থায় চিতায় ওঠা মুঘল শাসনে কার্যত অসম্ভব ছিল।
এত বিধিনিষেধের পরেও সতীদাহ হত কীকরে? এই প্রশ্নের উত্তরে ইওরোপিয়ানরা মূলত উত্তর-রহিত। প্রথাটি যে অত্যন্ত খারাপ, এ নিয়ে তাঁদের কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু ইউরোপিয়ান চোখে কিছুটা ভয়মিশ্রিত বিস্ময়ও দেখা যায়। এই স্বইচ্ছায় অনায়াস মৃত্য়্র কোনো ব্যাখ্যা তাঁদের কাছে নেই। তাভার্নিয়ের পাটনায় এরকমই একটি ঘটনা নিজের চোখে দেখেছিলেন। সেটি এই সময়ের সতীদাহের প্রতিনিধিত্বমূলক একটি বিবরণই বলা যায়। বর্ণনাটি অত্যন্ত কৌতুহলোদ্দীপক। বার্নিয়ের যে সময়ের কথা লিখেছেন, তখন, পাটনার ফৌজদার ছিলেন প্রায় আশি বছর বয়সী এক অভিজাত বৃদ্ধ। সেই ফৌজদারের কুঠিতে আরও কিছু ডাচের সঙ্গে বার্নিয়ের বসে, এমন সময় সেখানে একটি অতীব সুন্দরী যুবতী প্রবেশ করে। তার বয়স বড়জোর বাইশ। তার স্বামী মারা গেছে, সে সহমরণে যাবার অনুমতি চায়। স্বভাবতই ফৌজদার তাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বিরত করার চেষ্টা করেন। মেয়েটির জেদ তাতে আরও বেড়ে যায়। সে দৃঢ়চেতা হয়ে তাঁকে জিজ্ঞাসা করে, ফৌজদার কি ভাবছেন যে তার আগুনে ভয় আছে? শুনে ফৌজদার বলেন, আগুন কি জিনিস মেয়েটি কি তা জানে? কোনোদিন হাতে বা কোথাও ছ্যাঁকা খেয়েছে? মেয়েটি এই প্রশ্নে ঘাবড়ানোর বদলে আরও সাহসী গলায় তাঁকে বলে, "আমি আগুনে ভয় পাইনা। যদি দেখতে চান তো একটা এখানে একটা মশাল আনার ব্যবস্থা করুন না"।
এই উত্তরে বৃদ্ধ যুগপৎ ভয় পেয়ে যান এবং রেগেও যান। কথাবার্তা বন্ধ করে দিয়ে মেয়েটিকে বলেন, যে সে নির্দ্বিধায় শয়তানের কাছে যেতে পারে।
সেখানে অন্য দু-একজন কমবয়সী সভাসদও উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা ফৌজদারকে বলেন, যে, মেয়েটি আগুনের সামনে এত সাহস দেখাতে পারবেনা। ছাড়পত্র দেবার আগে তিনি একবার পরীক্ষাই করে নিন না। ফৌজদার অনিচ্ছাসত্ত্বেও রাজি হন। কুঠিতে মশাল আনা হয়। আগুন জ্বালানো হয়। ভালো করে জ্বলে ওঠার পর, মেয়েটি তার হাত বাড়িয়ে অকম্পিতভাবে জ্বলন্ত আগুনে ধরে থাকে। তার কনুই পর্যন্ত পুড়ে দগদগে হয়ে যায়।
এই বর্ণনাটিকে প্রতিনিধিত্বমূলক বলা হল, কারণ পূর্ব ভারতের এটিই একমাত্র বর্ণনা হলেও, সামগ্রিকভাবে গোটা উপমহাদেশে এইরকম ঘটনা একটি না। প্রত্যক্ষদর্শনে বার্নিয়েরও একইরকম একাধিক ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন। প্রতিটি বর্ণনাতেই মিশে আছে ভয়মিশ্রিত বিস্ময়। এর অনেকগুলিতেই মুসলমান শাসকরা সতীদাহ থামানোর জন্য় যুদ্ধ করছেন মরণেচ্ছু কোনো বিধবার সঙ্গে। কোনো যুদ্ধে জিতছেন, কোনোটিতে হারছেন। এরকম একটি যুদ্ধে বার্নিয়েরকে প্রতিনিধি করে পাঠিয়েছিলেন আওরঙ্গেবের উচ্চপদস্থ কর্মচারী দানেশমন্দ খান। সদ্যবিধবাটিকে কার্যত ভয় দেখিয়ে বার্নিয়ের সে যুদ্ধ জেতেন। বার্নিয়ের মেয়েটিকে যুগপৎ ভয় এবং লোভ দেখিয়েছিলেন, যে,সে মরলে তার সন্তানরাও দুর্ভিক্ষে মরবে, আর সে যদি বেঁচে থাকে তো মাসে দুই মুদ্রা মাসোহারার ব্যবস্থা করা হবে। এতে তার প্রতিজ্ঞার জোর থেমে যায়। কৌতুহলোদ্দীপক ব্যাপার হল মেয়েটির এক আত্মীয়ও পরবর্তীতে মেয়েটির প্রাণ বাঁচানোর জন্য বার্নিয়েরকে ধন্যবাদ জানান। এই বর্ণনাগুলি পড়ে, স্পষ্টতই মনে হয় এই দ্বিপাক্ষিক যুদ্ধটি সরাসরি মুসলমান শাসক বনাম মরণেচ্ছু মহিলার। মহিলা সরাসরি নিজের মৃত্যুর শর্ত নিয়ে শাসকের সঙ্গে দরাদরি করছেন। তাঁর পক্ষেও কিছু সৈন্যসামন্ত আছে, যারা মূলত কুচক্রী ব্রাহ্মণ, কিন্তু সিদ্ধান্তটি একান্তই মহিলার। তাঁর দর-কষাকষি সরাসরি, কখনও মুসলমান পুরুষ, কখনও ইউরোপিয়ান পুরুষের সঙ্গে কথা বলছেন, সেখানে পর্দা জাতীয় কোনো প্রথার লেশমাত্রও নেই। এবং এর চেয়েও কৌতুহলোদ্দীপক ব্যাপার হল, ইউরোপিয়ান বিস্ময় এবং ভারতের মুসলমান শাসকের বিস্ময় কীরকম দুটো বর্ণনাতেই এক হয়ে যায়। এই ঘটনার বর্ণনায় উভয়ের শব্দভান্ডারই কীরকম কাছাকাছি। পাটনার ফৌজদার ভয় পেয়ে মরণাকাঙ্খী মেয়েটিকে বলেন শয়তানের (দেভিল) কাছে যেতে। আর বার্নিয়ের অনুরূপ একটি ঘটনায় অন্য একটি মেয়ের তীব্র ইচ্ছাশক্তির বর্ণনায় লেখেন 'শয়তানি আত্মা' (দিঅবোলিল স্পিরিত)। এই অবোধ্য শয়তানির হাত থেকে নারীকে বাঁচাতে আওরঙ্গজেবের উচ্চপদস্থ কর্মচারী দানেশমন্দ খান, ইউরোপীয় চিকিৎসক বার্নিয়ের আর পাটনার ফৌজদার নানা ধরণের ছলা-কলা-কূটকৌশল অবলম্বন করেন, যা আলাদা-আলাদা ঘটনা হলেও একই ন্যারেটিভে গাঁথা। উল্টোদিকে দুর্জ্ঞেয় প্রহেলিকা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে মরণেচ্ছু হিন্দু নারী আর নিষ্ঠুর ব্রাহ্মণরা। ইউরোপিয়ানদের বর্ণনায় যে প্রহেলিকা ভেদ করা যায়না। প্রচলিত প্রথা, মেয়েদের মনোজগৎ তৈরির প্রক্রিয়া নিয়ে ব্য়াপারটিকে বার্নিয়ের ব্য়াখ্য়া করার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু তারপরেও তাঁর বর্ণনায় 'শয়তান' এর উপস্থিতির প্রাধান্য দেখিয়ে দেয়, যে সদ্য়বিধবার আত্মবলিদানের বিষয়টি তাঁর কাছে বহুলাংশেই আধিভৌতিক, শয়তানের এলাকায় পড়ে।
২।
জীবন্ত মহিলার আগুনে পুড়ে মরা সংক্রান্ত ইউরোপীয় বিস্ময়, এবং তৎসংলগ্ন শয়তানের রূপকল্প, দুটিই বেশ চিত্তাকর্ষক। কারণ, জীবন্ত মহিলাকে আগুনে পুড়িয়ে মারার প্রথা ইউরোপে একেবারেই অপ্রচলিত কিছু ছিলনা। যে সময়ের কথা হচ্ছে, অর্থাৎ আওরঙ্গজেবের শাসনকালের শুরুর দিক, সে সময়ে ডাইনি পুড়িয়ে মারার প্রথা ইউরোপে বহুল-প্রচলিত। যদি শুধু গ্রেট ব্রিটেনের কথাই ধরা হয়, সেখানে এই কারণে আইনী হত্যাকান্ডের সংখ্যা বিপুল। শুধু স্কটল্যান্ডেই ১৫৬৩ সালে 'ডাকিনীবিদ্যা' নিষিদ্ধ হবার পর আইনীভাবে হত্যা করা হয় সব মিলিয়ে মোটামুটি দেড় হাজার মহিলাকে। এমনকি তাভার্নিয়ের বা বার্নিয়েরের সময়কালের শতাধিক বছর পরেও স্কটল্যান্ডে পুড়িয়ে মারা হয়েছে মহিলাদের। অনেক পরে, ১৭২৭ সালেও পুড়িয়ে মারার ঘটনা নথিভুক্ত আছে। সময়কালের হিসেবে যে বছর বাংলায় মুর্শিদকুলি খান মারা যান। ব্রিটিশ এবং ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তখন বাংলায় জাঁকিয়ে ব্যবসা করছে। আওরঙ্গজেব তার কুড়ি বছর আগে গত হয়েছেন।
এই সমস্ত হত্যার বিবরণে বা বিচারে, কৌতুহলোদ্দীপক ভাবেই, বারবার এসেছে 'শয়তান' এর কথা, যে 'শয়তান' অব্যর্থভাবেই একটি ইউরোপীয় নির্মিতি। ১৭২৭ সালের ঘটনাটিই যদি দেখা যায়, তো সেখানেও 'শয়তান'এর হাত সুস্পষ্ট। ঘটনায় মৃত মহিলার নাম জ্যানেট হর্ন, যা সম্ভবত আসল নাম নয়, কারণ স্কটল্য়ান্ডে সব ডাইনিরই নাম দেওয়া হত জ্যানেট। একদম একবিংশ শতকের দৃষ্টিভঙ্গী থেকে ঘটনাটির একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়েছেন জেমস মর্টন। তা থেকে যা জানা যায়, যে, জ্যানেটের বাড়ি ছিল স্কটিশ হাইল্যান্ডের ডর্নখ (ডোর্নোচ) নামক একটি গ্রামে। তাঁর একটি মেয়ে ছিল, যে শারীরিক ভাবে ছিল কিছুটা অস্বাভাবিক, সম্ভবত বিকলাঙ্গ। মেয়েটির হাত এবং পায়ের গড়ন ছিল পশুর খুরের মতো। এইটিই ছিল জ্যানেট এবং তাঁর মেয়ের অপরাধ। জ্যানেটের পড়শীদের ধারণা ছিল, এই বিকৃত চেহারার কারণ হলেন জ্যানেট নিজেই। তিনিই ক্ষমতাবলে নিজের মেয়েকে ঘোড়ায় পরিণত করেছিলেন, যাতে শয়তান তার পিঠে চড়ে ঘুরতে পারে। কিন্তু তারপর আর ঠিকঠাক করে মানুষে রূপান্তরিত করতে পারেননি। এইটিই ছিল তাঁর অপরাধ।
এই নিয়ে প্রতিবেশীরা অভিযোগ জানালে জ্যানেট এবং তাঁর মেয়ে দুজনকেই গ্রেপ্তার করে বন্দী করা হয়। মেয়েটি অবশ্য কোনো এক ফাঁকে পালিয়ে যায়। জ্যানেটের বিচার হয় শেরিফের কাছে। বিচার ছিল সংক্ষিপ্ত। জ্যানেট সম্ভবত সেসময় বার্ধক্য এবং বিস্মৃতি জনিত অসুখে ভুগছিলেন। বিচারের সময় ঠিকঠাকভাবে ঈশ্বরের প্রার্থনাও আবৃত্তি করতে পারেননি, যা থেকে নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হয়, যে তিনি আসলে শয়তানের উপাসক। বিচারে তাঁর মৃত্যুদন্ড হয়। গায়ে আলকাতরা মাখিয়ে গোটা গ্রামে ঘোরানো হয়, তারপর আগুনের কাছে নিয়ে আসা হয় তাঁকে। অসুস্থ জ্যানেট সম্ভবত নিজের সম্ভাব্য় পরিণতির কথা বুঝতে পারেননি। শীতের দিনে আগুন দেখে উৎফুল্ল হয়ে তিনি নাকি হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলেছিলেন "উফ কী দারুন আগুন (হ, ্হত অ বোন্ন্য ব্লএ)"। সেই আগুনেই তাঁকে পুড়িয়ে মারা হয়।
এর শখানেক বছর আগের পাটনার ঘটনার সঙ্গে এর তুলনা করলে দেখা যায়, শয়তান, আগুন এবং মৃত্যু, এই তিনটি উপাদানই দুই ক্ষেত্রেই আছে। মৃত্যুর প্রদর্শন, মৃত্যুযন্ত্রণার উদযাপন দুটিতেই। বীভৎসতার প্রকরণে ইউরোপ সম্ভবত অনেকটাই এগিয়ে থাকবে। কারণ স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণের তুলনায় জোর করে ধরে এনে আগুনে জ্বালিয়ে দেওয়া আপাতদৃষ্টিতেই অধিকতর বীভৎসতার দাবী রাখে। কিন্তু স্পষ্টই সমকালীন ইউরোপীয়রা বিষয়টিকে এইভাবে দেখেননি। দেখার ভঙ্গীতে আকাশ-পাতাল তফাত। তার কারণ শয়তানের প্রভাব এবং আগুনে মৃত্যুর ক্রমের উল্টে পাল্টে যাওয়া। ইউরোপে শয়তানের প্রভাবে নারী বিপজ্জনক কাজকর্ম করে। তখন রাষ্ট্র তাকে ধরে এনে শাস্তি দেয়। আগুনে পুড়িয়ে মারে। আইন সেই মৃত্যুকে বৈধতা দেয়, প্রদর্শনের বীভৎসতাকে ঢেকে দেয়। আর এই অদ্ভুত প্রাচ্যদেশে রাষ্ট্র নারীকে বাঁচাতে চায়। তার মৃত্যুকে বৈধতা দেয়না। কিন্তু শয়তানের প্রভাবে নারী নিজেই আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। রাষ্ট্র অসহায় হয়ে দেখে। শয়তানকে শাস্তি দেওয়া নয়, এটা শয়তানের কাছে রাষ্ট্র এবং ব্যবস্থার চরম পরাজয়। শয়তান আত্মহনন ঘটায়, এবং তার বিপুল প্রদর্শনের ব্যবস্থা করে, রাষ্ট্র দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে। প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থার এই অপারগতা, অসহায়তাই বিষয়টিকে বর্বরতার সীমান্তে নিয়ে যায়, যেখানে আইনের শাসন চলেনা। ইউরোপীয় পর্যবেক্ষকরা, এবং তাঁদের বর্ণনানুযায়ী মুসলমান শাসকরাও স্রেফ এই বর্বরতার কাছে পরাজয়ের বিমূঢ় পর্যবেক্ষক হয়ে থাকেন।
৩।
জ্য়ানেটের ঘটনার ঠিক ১৫ বছর পরে বাংলায় আরেকটি সহমরণের ঘটনার বর্ণনা পাওয়া যায় অন্ধকূপ-হত্যা খ্যাত(বা কুখ্যাত) জন হলওয়েলের লেখায়। লেখাটি এরও কয়েক দশক পরে প্রকাশিত হলেও ঘটনার সালটি স্পষ্ট করেই বলা আছে -- ১৭৪২-৪৩। তখন বাংলায় আলিবর্দি খানের রাজত্ব সবে শুরু হয়েছে। শুরু হয়েছে মারাঠা আক্রমণ। ৪২ সালেই প্রথম কাটোয়ার যুদ্ধে মারাঠাদের হারিয়ে জিতেছেন আলিবর্দি। পলাশীর যুদ্ধ অপেক্ষা করে আছে আর ১৫ বছরের দূরত্বে। সেই সময়েরই ঘটনা এটি।
প্রসঙ্গত বলে রাখা ভাল সৎ বিবরণকারী বলতে যা বোঝায়, হলওয়েলের পরিচিত ঠিক তার উল্টো প্রান্তে। শুধু অন্ধকূপ হত্যার রূপকথাই নয়, হিন্দুদের আদি 'বাইবেল' বা 'শাস্ত্র' (হস্তহ) তিনি আবিষ্কার করে ফেলেছেন বলে দাবী করেছিলেন, যে বইটি আবার নাকি হারিয়ে যায়। এইরকম বিশ্বাসযোগ্যতার অভাব এই বিবরণটির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হতে পারে। কিন্তু তা সত্ত্বেও বিবরণটি গুরুত্বপূর্ণ। অন্তত এই লেখার ক্ষেত্রে। কারণ, এখানে সতীদাহ প্রসঙ্গে ইউরোপীয়রা কী ভাবছেন, কেমন ভাবে ভাবছেন এবং তার মধ্যে থেকে বাস্তবতার কোন রূপ বেরিয়ে আসছে সেটিই বিবেচ্য। কোনো একটি ঘটনা সত্যিই ঘটেছিল কিনা ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। হতে পারে ঘটনাটি হলওয়েল সত্যিই দেখেছেন, কিংবা তাঁর কানে শোনা। অথবা ঘটনাটি এইভাবে ঘটেইনি, এটি ইংরেজদের সমষ্টিগত নানা টুকরোটাকরা দেখা ও ভাবার যোগফল। এর যেটিই হোক, ঘটনার উপস্থাপনাটিই এখানে গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের চালু ইতিহাস তো মূলত ইউরোপীয় বর্ণনার ইতিহাস। চোখে দেখা বা না দেখা সবকিছুই ইউরোপীয় কাচের সম্পাদনার মধ্যে দিয়ে এসে তবেই বর্ণনায় পরিণত হয়, কোনোটিই আকাঁড়া বাস্তবতা নয়। এখানে সেই বর্ণনাগুলিই উল্টেপাল্টে দেখা হচ্ছে, দেখা হচ্ছে ফাঁকফোকর দিয়ে অন্য কোনো বাস্তবতা উঁকি মারছে কিনা। ফলে একটি নির্দিষ্ট ঘটনা সত্যি কিনা তার আলাদা করে খুব বেশি মূল্য নেই এখানে।
তা, নিখুঁত সত্যকথন হোক বা না হোক, হলওয়েলের বর্ণনানুযায়ী, এই সহমরণের ঘটনাটি ঘটে কাশিমবাজারে। সে আমলে কাশিমবাজার ছিল একটি বৃহৎ গঞ্জ। ইংরেজের বড় কুঠি ছিল সেই গঞ্জে এবং স্বভাবতই জায়গাটি ছিল বাণিজ্যের একটি বড় কেন্দ্র। সেখানেই এক সমৃদ্ধ পরিবারের যুবক রামচাঁদ পন্ডিত, মারা যায় ২৮ বছর বয়সে (প্রসঙ্গত, পরিবারটি বাঙালি ছিলনা, ছিল অভিবাসী মারাঠি, পরবর্তীকালে শিবনাথ শাস্ত্রীর লেখায় পাচ্ছি)। তার একমাত্র স্ত্রী, প্রায় তৎক্ষণাৎ, ব্রাহ্মণদের কাছে সহমরণে যাবার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। পরিবারটির এলাকায় পরিচিতি ছিল। সেজন্য কাশিমবাজারের প্রায় সমস্ত বণিকরা এবং পরিবারের লোকজনও মেয়েটিকে বোঝানোর কোনো চেষ্টাই বাদ রাখেননি। ইংরেজদের তরফেও চেষ্টা হয়েছিল। স্যার ফ্রান্সিস রাসেলের স্ত্রী লেডি রাসেলও মেয়েটিকে অনেকগুলি বার্তা পাঠান। তার সন্তানদের ভবিষ্যৎ থেকে শুরু করে পুড়ে মরার যন্ত্রণার ভয়াবহতা পর্যন্ত সবকিছুই তাকে বলা হয়। কিন্তু কোনো ফল হয়না। আগুনের ভয় দেখালে মেয়েটি আগুন জ্বালিয়ে তাতে তার হাত ধরে থাকে। সে লেডি রাসেলকে ধন্যবাদ জানায়, কিন্তু নিজের সঙ্কল্প বদলায়না। বরং তাঁকেই বলে, যেন তিনি তার সন্তানকে রক্ষা করেন। পরে আরও লোকজন অনাথ শিশুগুলির ভবিষ্যতের কথা ভাবতে বললে সে বলে "যিনি ওদের পৃথিবীতে এনেছেন, তিনিই দেখাশুনোর ব্য়বস্থাও করবেন (he that made them, would take care of them)"। সহমরণের অনুমতি না দেওয়ার সম্ভাবনার কথা বললে, সে বলে সেক্ষেত্রে সে অন্যভাবে মৃত্যুবরণ করবে।
রামচাঁদ পন্ডিত মারা যায় ভোর পাঁচটায়। বেলা দশটা নাগাদ তার দেহ জলের পাশে নিয়ে যাওয়া হয়। সঙ্গে যায় মেয়েটি, তার সমস্ত আত্মীয় পরিজনরা এবং কয়েকজন বিশেষ ব্রাহ্মণ। ফৌজদারের অনুমতিপত্র বেলা একটা পর্যন্ত এসে পৌঁছয়না। অপেক্ষা করতেই হয়, কারণ মুসলমান শাসকদের অনুমতি ছাড়া এই কাজ করা যায়না। একজন বিশেষ আধিকারিক সেই অনুমতি নিয়ে আসেন একটার পরে। তাঁর উপর নির্দেশ ছিল, পুরোটাই মেয়েটির ইচ্ছানুযায়ী হচ্ছে কিনা দেখার। এরপর লম্বা এক প্রক্রিয়া চলে। মেয়েটি তার বাবা-মা, সন্তান এবং আত্মীয়-পরিজনদের কাছ থেকে রাজকীয়ভাবে বিদায় নেয়। ব্রাহ্মণরা মেয়েটিকে প্রণাম করেন। মেয়েটি আশীর্বাদ করে। ব্রাহ্মণরা কাঁদতে কাঁদতে কয়েক পা পিছিয়ে যান। মেয়েটি চিতায় উঠে মৃত স্বামীর পাশে যায়। তারপর নিজের হাতে চিতায় আগুন দেয়। চিতা দাহ্য পদার্থে ভর্তি ছিল, তাই দপ করে জ্বলে ওঠে, কিন্তু হাওয়া ছিল উল্টো দিকে, আগুন মেয়েটি এবং মৃতদেহের উল্টোদিকে চলতে থাকে। মেয়েটি এবার ঠিক জায়গায় আগুন দেয়। শেষবারের মতো। তারপর ধোঁয়া এবং জ্বলন্ত শিখায় ঢেকে যায় তার শরীর।
এই পুরো বিবরণের সঙ্গে শতাধিক বছর আগের বার্নিয়ের বা তাভার্নিয়েরের প্রত্যক্ষদর্শনের বিশেষ তফাত নেই। এমনকি মুসলমান শাসকের বাধ্যতামূলক অনুমতির প্রসঙ্গটি পর্যন্ত হুবহু এক। এর পর ইংরেজ আমলের গোড়ার দিকে একই জিনিসের কিছু বর্ণনা পাব (যার প্রতিটি এই লেখায় ধরানো যাবেনা), তারাও মোটামুটি ভাবেই একই। কেবল মুসলমান শাসকের অনুমতির প্রশ্নটি সেখানে থাকবেনা। ফলত এই বর্ণনাটি, যদি হুবহু নাও ঘটে থাকে, সম্ভবত বাস্তবানুগই। তাভার্নিয়েরের বর্ণনার মতোই এটিও ঘটে গঙ্গার তীরেই। এমনকি বার্নিয়ের মতই, হলওয়েলও, উল্লেখ করেন সহমরণের কোনো কোনো ক্ষেত্রে চিতায় ওঠার পর "সাহস" হারিয়ে ফেললে সহমরণগমনাকে বাঁশ দিয়ে চেপে ধরেও রাখা হয়। যদিও তার কোনো বর্ণনা তিনি দেননি। এবং বার্নিয়েরের মতোই তিনিও বলেছেন, সহমরণে যাবার স্ব- ইচ্ছা ঘোষণা না করলে চিতা পর্যন্ত বিধবারা কেউই পৌঁছননা।
এসবই পূর্বেকার বর্ণনামাফিকই। কিন্তু যেটা হলওয়েলে নতুন, তা হল দেখার ভঙ্গী। এই পুরো বর্ণনায় 'শয়তান'এর প্রসঙ্গ একবারও আসেনি। ব্রাহ্মণদের খলনায়ক বানানো হয়নি (তারা কান্নাকাটিও করে), মেয়েটির মাথায় শয়তান বা ভূত চেপেছে, এও একবারও নেই। বরং পুরো প্রক্রিয়াটিকে হলওয়েল যৌক্তিকভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন। সেই ব্যাখ্যার বিশদে যাবার প্রয়োজন এখানে নেই, কিন্তু মূল কথাটি, সংক্ষেপে এই, যে, মহিলাদের এই ইচ্ছার মূল জায়গা হল ছোটো থেকে তৈরি হওয়া তার বিশ্বাস, যে, সহমরণে যাওয়া হল নিজের পক্ষের সম্মানের, গৌরবের ব্য়াপার, এবং সন্ততিদের পক্ষেও উপকারী। ব্রাহ্মণরা এই চিন্তা তাদের মাথায় ঢুকিয়ে দেয়। এবং একথাও সত্য যে, সতীর সন্তানরা সমাজে উচ্চস্থান পায়, কখনও কখনও উচ্চতর জাতিতেও তাদের উত্তরণ ঘটে। এ সবেরই ফসল হল কোনো কোনো নারীর মৃত্যুর বাসনা।
বার্নিয়েরও এর কাছাকাছি একটি সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু 'শয়তান'ই তাঁর বা তাভার্নিয়েরের ব্যাখ্যার বৃহদংশ জুড়ে আছে। হলওয়েলের ব্যাখ্যা শয়তান নেই, আছে ইউরোপীয় নব্য যুক্তিবাদ। বার্নিয়েরে তার চিহ্ন আছে, কিন্তু হলওয়েলে এসে তা একরকম পরিপূর্ণতা পায়। এর সঙ্গে সঙ্গেই ইউরোপীয় যুক্তিবাদের আরও কিছু বৈশিষ্ট্যও খুব নির্দিষ্ট করে হলওয়েলের চিন্তায় দেখা যায়। যুক্তিবাদ, খুব নির্দিষ্ট করে বললে বহুত্বকে অস্বীকার করে, তৈরি করে এককেন্দ্রিক একটি মডেল, যাকে সে সর্বত্র আরোপ করে। একটা সময় পর, সেটার উপরই 'স্বাভাবিকত্ব'র একটি আবরণ চড়ে যায়। কিন্তু আরোপ করার সূচনাবিন্দুতে দেখলে চাপিয়ে দেবার চিহ্নগুলি সুস্পষ্টভাবে দেখা যায়। হলওয়েলের আখ্যান, সামগ্রিকভাবেই এই প্রক্রিয়ার একটি ধ্রুপদী উদাহরণ। ভারতবর্ষকে তিনি তাঁর ব্যাখ্যায় নিয়ে আসেন ইউরোপীয় এককেন্দ্রিক ধর্মের মডেলে ( ধর্ম এই নয়া যুক্তিবাদের অঙ্গাঙ্গী অংশ)। এমনকি আবিষ্কার করে ফেলেন সেই ধর্মের এক আদি বাইবেল, যা থেকে বিচ্যুতির কারণেই নানাপ্রকার আচার-বিচার-প্রকরণ-বিকৃতি। এই আবিষ্কৃত আদি ধর্মটির নাম জেন্টু(এন্তূ) ধর্ম, যে ধর্মটি, ইউরোপীয় চশমায় দেখা একটি অলীক কল্পনা মাত্র। কিন্তু যুক্তিবাদ আরোপিত কল্পনাকেই বাস্তবতা হিসেবে চাপিয়ে দেয় ক্রমশ। বস্তুত ধর্ম প্রসঙ্গে 'হিন্দু' শব্দটি হলওয়েল একবারও ব্যবহার করেননি। বলাবাহুল্য, 'জেন্টু' শব্দটি হলওয়েলের উদ্ভাবন নয়। এ সময়ের বা তার আগের সমস্ত ইংরেজ বর্ণনাতেই শব্দটি পাওয়া যায়। এমনকি জোব চার্নকের সময়ের বিবরণকারী হ্যামিল্টনও শব্দটি ব্য়বহার করেছেন। বার্নিয়েরও অমুসলমান অধিবাসীদের প্রসঙ্গে ব্যবহার করেছেন জেন্টিল (এন্তিলে) শব্দটি, যা সম্ভবত ইংরেজের জেন্টুতে এসে পরিণতি পায়। শব্দটির উৎপত্তি, কেউ বলেন পর্তুগিজ, কেউ বলেন ভারতীয় 'জন্তু'। যাই হোক ইউরোপিয়ানরা অমুসলিম ভারতীয়দের আওরঙ্গজেবের সময় থেকেই জেন্টু নামে ডেকে আসছেন, হিন্দু নয়। 'হিন্দু' শব্দটি এর আগে ছিলনা তা নয়। ভারতীয় সমাজব্যবস্থায় বিভিন্ন অঞ্চল একে অপরের থেকে সম্পূর্ণ চিনের প্রাচীর দিয়ে ঘেরা ছিল তাও নয়। যেমন 'ব্রাহ্মণ' ব্য়াপারটির উপস্থিতি সর্বত্রই পাওয়া যায়। কিন্তু ইউরোপীয় ধাঁচের এককেন্দ্রিক 'ধর্ম' হিসেবে হিন্দুত্বকে একটি ধর্ম হিসেবে তৈরি করা, হলওয়েলের বর্ণনা থেকে যা আন্দাজ করা যায়, অনেকটাই একটি ইউরোপীয় কীর্তি।
হলওয়েলের 'সতী'র ব্যাখ্যাও এই ইউরোপীয় নির্মিতির আলোকেই দেখা উচিত। হলওয়েল একটি ধর্ম হিসেবে জেন্টুত্বকে (পড়ুন হিন্দুত্বকে), তার একমাত্রিক প্রচারক হিসেবে ব্রাহ্মণদের, এবং সহমরণের একমাত্র কারণ হিসেবে মগজধোলাইকে চিহ্নিত করেন। কিন্তু অঞ্চলভেদে এবং প্রথাভেদে এই প্রক্রিয়াটি নানারকম হওয়ারই কথা। পদ্ধতি এবং সংখ্যা, দুইয়ের বিচারেই (যেমন, ধরা যাক, বাংলায় এর সংখ্যা খুবই কম হতে পারে, গুজরাতে বেশি। পদ্ধতির রকমফেরও থাকতে পারে)। তাভার্নিয়ের এই নানাপ্রকার পদ্ধতির বিভিন্নতা লিপিবদ্ধ করেছিলেন। বার্নিয়ের লিপিবদ্ধ করেছিলেন সংখ্যার তারতম্যের কথা। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক এককেন্দ্রিক ধর্মের পূজারি হলওয়েল এই বিভিন্নতাকে অস্বীকার করেন। বার্নিয়ের মুসলমান শাসকদের ভূমিকার কথা ব্য়ক্ত করেছেন। কিন্তু হলওয়েল মুসলমান শাসকদের সঙ্গে 'জেন্টু'দের আন্তঃসম্পর্ককে এড়িয়ে গেছেন। যদিও শাসকদের নজরদারির ব্য়াপারটা তিনি অস্বীকার করেননি, কিন্তু সহমরণের অনুমতিপ্রদান শুধু একটি আনুষ্ঠানিক ব্য়াপার হিসেবেই উপস্থাপিত হয়েছে তাঁর লেখায়। সতীদাহের সার্বজনীন কারণ হিসেবে তিনি স্রেফ একটি সার্বিক মগজধোলাই-প্রক্রিয়াকে দায়ী করেছেন। কিন্তু স্থানীয় শাসকদের ভূমিকা,'জেন্টু'দের সঙ্গে তাদের আন্তঃসম্পর্ক, এবং 'জেন্টু' সমাজের নিজস্ব বৈশিষ্ঠ্যের কারণে সতীদাহের প্রক্রিয়া এবং সংখ্যার যে বিপুল তফাত হতে পারে, এই সম্ভাবনাই তাঁর লেখায় নেই।
৪।
ফলে হলওয়েলের এককেন্দ্রিক যুক্তিবাদী মডেলের কিছু ফাঁকফোকর আছে। কিন্তু কত বড় ফাঁকফোকর, সেটা কি বলা সম্ভব? কাজটা কঠিন। কারণ বাংলায় সতীদাহের সংখ্যা ব্রিটিশ-পূর্ব ভারতে ঠিক কেমন ছিল, তার সঠিক মাপ-জোক অসম্ভব। আওরঙ্গজেবের আমলে বার্নিয়ের লিখেছিলেন, মুসলমান-শাসিত এলাকায় সতীদাহের সংখ্যা কমে এসেছে। যৌক্তিকভাবে সেটা মেনে নেওয়া গেলেও সংখ্যাটা কত কম তিনি লেখেননি। বাংলার ক্ষেত্রে আলাদা করে কম-বেশিও তিনি কিছু লেখেননি। হলওয়েল আলিবর্দির আমলে সহমরণের ঘটনা নিয়ে লিখলেও সংখ্যা নিয়ে কিছু জানাননি। এরপর মারাঠা যুদ্ধ হয়। রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হয় বাংলা জুড়ে। সিরাজ ক্ষমতায় আসেন, বৃটিশের সঙ্গে দ্বন্দ্ব বাড়ে। পলাশীর যুদ্ধ হয় ১৭৫৭ সালে। এই অস্থির পরিমন্ডলে সতীদাহের সংখ্যা নিয়ে আর বিশদ কিছু জানা যায়না। পলাশীর যুদ্ধের অব্য়বহিত পরে, সম্ভবত ১৭৬৮ সালে ব্রিটিশ ফৌজের লেফটেন্য়ান্ট আলেকজান্ডার ডাও 'হিন্দুস্তানের ইতিহাস' নামক একটি বই লেখেন। বইটি সতীদাহ প্রসঙ্গে লেখা নয়। কিন্তু ভারত প্রসঙ্গে লিখতে গেলে সতীদাহ আসবেই। এবং সেই প্রসঙ্গে লিখতে গিয়ে ডাও খুব স্পষ্ট করে জানান, সতীদাহ প্রথাটি ভারতের বেশিরভাগ অঞ্চলে অবলুপ্তপ্রায় (The extraordinary custom of the women burning themselves with their deceased husbands, has, for the most part, fallen into desuetude in India)।
ইতিহাসের বিশ্বস্ত বর্ণনাকারী হিসেবে ডাও হলওয়েলের থেকে অনেকগুণ এগিয়ে থাকবেন। বহুভাষাবিদ, সুপন্ডিত এই মানুষটি সংস্কৃত ভাষায় মুগ্ধ হয়েছেন। 'জেন্টু' নয়, 'হিন্দু' ধর্মের কথা তাঁর লেখায় পাওয়া যায়, পাওয়া যায় ন্যায়শাস্ত্রের উল্লেখ। আদি সনাতন ধর্মের বর্ণভেদ প্রথা তিনি মোটামুটি যথাযথভাবে বর্ণনা করেন। কিন্তু এর পরেও তাঁর ভাবনা ইউরোপকেন্দ্রিকই। একটা উদাহরণ দিলেই ব্যাপারটা বোঝা যাবে। 'হিন্দু'দের উৎস কী? বর্ণনা করতে গিয়ে আদমকে ডাও মানবসভ্যতার সূচনাবিন্দু হিসেবে ধরেছেন। পরে মহাপ্লাবনের পর নু সারা পৃথিবীকে পুনরায় মানবপূর্ণ করেন। নু এর নানা বংশধরদের মধ্যে 'রুশ', 'চিন'এর মতো একজন ছিলেন হিন্দ। তাঁর চার পুত্রের নাম হল পূরব, বঙ্গ, দক্ষিণ এবং নেরওয়াল (Hind had four fons, one of whom was named Purib, another Bang, a third Decan, and a fourth Nerwaal)। এইভাবে উপকথার ঢঙে গল্প এগোয়। তাতে মিশে যেতে থাকে জনজাতির অজানা আখ্য়ান, রূপকথা, বাইবেল। আজকে পড়তে অবিশ্বাস্য লাগলেও ডাও একেই ইতিহাস বলেছেন। তাতে আলাদা করে দোষের কিছু নেই, কারণ ডাও এই আখ্যান লিখছেন ১৭৬৮ সালে। তার বছর চারেক আগেই তিনি ভারত ছেড়ে যান। অর্থাৎ তাঁর অভিজ্ঞতা অর্জন তারও আগের, একেবারেই পলাশীর যুদ্ধের সমসাময়িক বা অব্যবহিত আগে-পরের। ফরাসী বিপ্লব এবং তার উপজাত ল্যামার্কের তত্ত্ব তখনও অর্ধশতাব্দী দূরে, ডারউইন প্রায় এক শতাব্দী। তাঁর পূর্বসূরী হলওয়েলের মতো ডাওও বস্তুত ইতিহাসের অন্ধগলি হাতড়াচ্ছেন -- ইতিহাস আর উপকথার মধ্যের পার্থক্য় তখনও সুস্পষ্ট নয়। এবং যেটা আকর্ষণীয়, হাতড়াতে গিয়ে বাইবেল-ঘরানার একটি এককেন্দ্রিক হিন্দুত্বের তত্ত্বকে আবিষ্কার করছেন, যে এককেন্দ্রিক হিন্দুত্বের বিকাশ এবং পরিপুষ্ট হবার প্রক্রিয়া চলবে গোটা ইংরেজ জমানা জুড়েই। এবং এই এককেন্দ্রিক হিন্দুত্বের বয়ানে মুছে দেবার চেষ্টা করা হয়ে আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যগুলিকে। ডাওয়ের বর্ণনাতেও এই প্রক্রিয়া প্রতীয়মান। বর্ণভেদ প্রথায় চারটি জাতকে তিনি নিখুঁত ভাবে বর্ণনা করেন। কিন্তু বাংলার আঞ্চলিক জাতগুলি তাতে মুছে যায়। সুশীল চৌধুরি পরবর্তীকালে দেখিয়েছেন, বাংলায় জাত-পাত অত সুদৃঢ় চারটি বর্ণের জল-অচল সীমারেখায় বাঁধা ছিলনা। যেমন আলেকজান্ডার হিউমের লেখা থেকে দেখা যাচ্ছে, ১৭৩০ সালে অস্টএন্ড কোম্পানির তালিকাভুক্ত ২৪ জন কারবারির মধ্য়ে ২১ জন ছিলেন হিন্দু, ৩ জন মুসলমান এবং ১ জন আর্মেনিয়ান। হিন্দু কারবারিরা বিভিন্ন জাতের -- সেন, দত্ত, মজুমদার, খান, নন্দী, মল্লিক -- এই শেষ দুজন জাতিতে তাঁতি (সুশীল চৌধুরির ফ্রম প্রসপারিটি টু ডিক্লাইন থেকে উদ্ধৃত) । এঁরা দিব্বি একসঙ্গে জোট বেঁধে কারবার চালাতেন, এবং এই উদাহরণ অজস্র। অনেক পরে অ্যাডামস রিপোর্টেও দেখা যায় নানা জাতের ছাত্ররা একসঙ্গে পাঠশালায় পড়াশুনো করছে। খুবই সম্ভব, জাতের এই প্রকরণ একটি আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য়, যা ডাওয়ের লেখায় পাওয়া যায়না। তাঁর এককেন্দ্রিক মডেলে এর কোনো স্থান নেই, তাই সম্ভবত বিষয়টিকে এড়িয়ে যাওয়া হয়। একই কারণে, আন্দাজ করা যায়, তিনি খুব স্পষ্ট করে "সতীদাহ একটি ধর্মীয় প্রথা নয় (nor was it ever reckoned a religious duty)" বললেও প্রথাটি ভারতের কোন কোন অঞ্চলে, কী কারণে অবলুপ্তপ্রায়, তাও এড়িয়ে যান। বাংলার ক্ষেত্রে এরকম একটি সম্ভাব্য কারণ আমরা জানি। মুসলমান শাসন। দ্বিতীয় একটি সম্ভাব্য কারণের কথা বলেছেন আশিস নন্দী, তাঁর "Sati: A Nineteenth Century Tale of Women, Violence and Protest" প্রবন্ধে (যদিও তাঁর সময়কাল কিছু পরের, কিন্তু যুক্তিটি এই সময়েও প্রযোজ্য) । তাঁর মতানুসারে সতীদাহ তথাকথিত সৈনিক জাতিগুলির প্রথা এবং বৃটিশ সৈন্যবাহিনী প্রায় পুরোপুরিই এই সমস্ত জাতিগুলি থেকে নিয়োগ করত। বাংলায় ধ্রুপদী ক্ষত্রিয় জাত আলাদা করে ছিলনা এবং এলাকাটি মূলধারার হিন্দুত্বে ছিল প্রান্তিক ("given that (1) traditionally sati had been associated with the so called martial races, (2) the British Indian Army was drawn almost entirely from these races, and (3) the earlier epidemics of sati (such as the one in Rajasthan towards the end of the Mughal period and the one in South India during the decline of the Vijayanagar kingdom) had a clear kshatriya (martial or princely caste) connection. Offset these against the facts that Bengal did not have a proper kshatriya caste and that the region was marginal to mainstream Hinduism, and one is forced to conclude that the eighteenth century epidemic of sati was not a pure product of traditions and that it drew upon a different configuration of political, cultural and psychological forces.")।
তৃতীয় একটি সম্ভাব্য কারণ হতে পারে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি। সে সময় বাংলা ছিল ভারতের সমৃদ্ধতম এলাকা। আওরঙ্গজেবের আমলের বাংলা প্রসঙ্গে বার্নিয়ের লিখেছেন, বিশ্বের শ্রেষ্ঠ দেশের যে তকমা মিশরকে দেওয়া হয়, তা আসলে বাংলার প্রাপ্য। খাদ্যের উদ্বৃত্ত, শিল্পে উন্নত (রেশম, বয়ন, চিনি, জাহাজ নির্মান ইত্য়াদি)। রেশম এবং তাঁত, এই দুটি ছিল বাংলার রপ্তানির দুটি স্তম্ভ। তার বিস্তৃত বিবরণ এখানে দেবার প্রয়োজন নেই, কিন্তু সুশীল চৌধুরি পূর্বোক্ত পুস্তকে দেখিয়েছেন, যে, মূলত বয়নশিল্পের কর্মী হিসেবে মহিলাদের অংশগ্রহণ ছিল বিপুল। ব্রাহ্মণ থেকে নিচু জাত পর্যন্ত সব মহিলারাই এতে অংশগ্রহণ করতেন এবং উপার্জনে তাঁরা পুরুষদের চেয়ে খুব বেশি পিছিয়ে ছিলেননা। ফলে পারিবারিকভাবে মহিলারা ছিলেন একটি অর্থনৈতিক যন্ত্র। একটি পরিবারে একটি মৃত্যুর পর আরেকটি উপার্জনের উৎসকেও একই সঙ্গে চিতায় বিসর্জন দেওয়ার প্রথার সম্ভাবনা অর্থনৈতিকভাবে খুবই কম। একটি-দুটি ব্যতিক্রমী ঘটনা অবশ্যই ঘটা সম্ভব, কিন্তু এখানে সাধারণভাবে চালু একটি প্রথার অর্থনৈতিক সম্ভাবনার কথা বলা হচ্ছে। তবে এগুলি সবই আন্দাজ। কেন সতীদাহ বেশিরভাগ অঞ্চলে অবলুপ্তপ্রায় তার কারণ ডাও স্পষ্ট করে কিছু লিখে যাননি।
ডাওএর পর সতীদাহের বিখ্যাত বর্ণনা উইলিয়াম কেরি এবং মার্শম্যানের, ডাওয়ের তিরিশ বছর পরে। এর মধ্যে ঘটে গেছে ৭৬ (ইংরিজি মতে ১৭৬৯-৭০)এর কুখ্যাত মন্বন্তর, ব্রিটিশ শাসনের কুড়ি বছরের মধ্যেই। প্রাণ হারিয়েছেন বাংলার প্রায় এক তৃতীয়াংশ মানুষ। একদা সমৃদ্ধ বাংলার অর্থনৈতিক বনিয়াদ সম্পূর্ণ ধ্বসে গেছে। সেসব পালা চুকে যাবার পর, ১৭৯৩ সালে কলকাতায় পা রাখেন আধুনিক মিশনারি কাজকর্মের প্রাণপুরুষ উইলিয়াম কেরি। এর এক বছর আগে তিনি লিখেছেন, তাঁর বিখ্যাত বই "An Enquiry into the Obligations of Christians to Use Means for the Conversion of the Heathens"। বইটির প্রতিপাদ্য, ছোটো অক্ষরের অংশগুলি সহ পুরো নামটা পড়লেই পরিষ্কার বোঝা যায় --An Enquiry into the Obligations of Christians to Use Means for the Conversion of the Heathens in which the Religious State of the Different Nations of the World, the Success of Former Undertakings, and the Practicability of Further Undertakings, are Considered.। এইখানেই আমরা পাই, ভারতবর্ষ সম্পর্কে নতুন একটি শব্দ। হিদেন। গোটা বইয়ে হিন্দু শব্দটি কেরি একবারও ব্যবহার করেননি। কেরির হাত ধরেই অষ্টাদশ শতকের শেষে জেন্টু থেকে হিন্দু হয়ে ভারতীয়ত্বের এককেন্দ্রিক পরিচয় হয় হিদেন। বইয়ের নাম থেকেই বোঝা যায়, এই হিদেনদের যীশুর আলো দেখানোই কেরির উদ্দেশ্য ছিল। হিদেনদের বর্বরতা, এবং সে কারণে তাদের অসীম দুর্গতি -- এছাড়া হিদেনদের মধ্যে কেরি আর বিশেষ কিছু দেখতে পাননি। ব্রিটিশ উপস্থিতিকে তিনি হিদেনদের পক্ষে আশীর্বাদ বলেই ভাবতেন, গোটা লেখায় একটিবারের জন্যও ৭৬ এর মন্বন্তরের কোনো উল্লেখ নেই। বরং কেরি লিখেছেন "আমরা কি শুনতে পাই না, তারা (হিদেনরা) যীশুনামগানহীন, সরকারহীন, আইনহীন, কলাহীন, বিজ্ঞানহীন? মানুষের অভিব্যক্তি, ক্রিশ্চানদের অভিব্যক্তির সঙ্গে তাদের পরিচিত করানোর জন্য নিজেদের প্রয়োগ করা কি আমাদের উচিত নয়?(Can we hear that they are without the gospel, without government, without laws, and without arts, and sciences; and not exert ourselves to introduce amongst them the sentiments of men, and of Christians?)" এরকম উদ্ধৃতি অজস্র। কিন্তু এইটি বিশেষ করে উল্লেখযোগ্য, খ্রিষ্টানত্ব এবং বিজ্ঞানকে এখানে একসঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। এবং এটা আকর্ষণীয়, কারণ কেরির কলকাতায় পদার্পণের বছর ১৭৯৩। এর তিন বছর আগেই বিশ্বখ্যাত ফরাসী বিপ্লবের সূচনা হয়েছে এবং এই ১৭৯৩ সালেই ক্যাথলিক চার্চকে বিসর্জন দিয়ে 'যুক্তির রাজত্ব (উল্ত ওফ Rেঅসোন)' নামক একটি বিশ্বাস চালু করবে জ্যাকোবিনদের নেতৃত্বাধীন ফরাসী রাষ্ট্র, নোৎরদামের নাম বদলে করে দেওয়া হবে 'যুক্তির মন্দির'। সেই একই সময় বিজ্ঞান এর সঙ্গে ক্রিশ্চানত্বকে জুড়ে কেরি একটি স্বর্গরাজ্যের ছবি আঁকছেন, যেখানে অগণিত বেচারা হিদেনদেরও প্রবেশাধিকার আছে, তারা ব্রিটিশদের সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছে সেই সুখের মরণোত্তর স্বর্গে। এর জন্যই তিনি আত্মবলিদান করতে চান। বস্তুত কেরির স্বর্গের কল্পনার সঙ্গে সতীর স্বর্গরাজ্যের কল্পনার বিশেষ অমিল নেই। এবং ইউরোপীয় চিন্তাভাবনার কক্ষপথ যদি লক্ষ্য করা যায়, অজ্ঞেয় জেন্টিল বা জেন্টুদের একটি কেন্দ্রীয় বাইবেল আবিষ্কার থেকে, হিন্দুদের বাইবেলীয় উৎস সন্ধান অতিক্রম করে ভারতবাসীরা অবশেষে পরিণত হয় নামহীন 'হিদেন'এ। কেন্দ্রিকরণের প্রকল্পটি পুরো সময় জুড়েই থাকে, কিন্তু এবার সরাসরি তা হয় খ্রিষ্টানত্বের হাত ধরে। বলাবাহুল্য কেরির প্রকল্প সর্বাংশে সার্থক হয়নি। আবার একরকম করে হয়েও ছিল। ক্রিশ্চানত্ব অধিকাংশ ভারতবাসীকেই কোনো অমৃত দেয়নি, কিন্তু এই হিদেনিকরণের বিপরীতেই তৈরি হয় কেন্দ্রীয় হিন্দুত্বের নানা মিশন। ব্রাহ্মধর্ম থেকে রামকৃষ্ণ মিশন পর্যন্ত সবই এই প্রক্রিয়ার অংশ। এমনকি এর কিছুদিন পরে হিন্দুত্বের নাম করে রাধাকান্ত দেব প্রমুখরা সতীদাহের পক্ষে প্রচার করবেন, এও একরকম করে কেন্দ্রীয় হিন্দুত্বের প্রকল্পেরই ফসল। মুঘল বা মুর্শিদকুলি-আলিবর্দির আমলে 'হিন্দু' ধর্মের ধ্বজা উড়িয়ে কেন্দ্রীয় ভাবে সতীদাহের পক্ষে দাঁড়ানো হচ্ছে, এ কথা কল্পনাই করা যায়না।
রাধাকান্ত দেব বা রামমোহন অবশ্য আরও কিছুদিন পরে। কেরি প্রথমবারের মতো সহমরণ দেখেন ১৭৯৯ সালে। হুগলী নদীর পারে সম্ভবত বিহারের নয়াসরাই নামক একটি এলাকায়। সেটিও একটি স্বেচ্ছামৃত্যু, কেরি নিজেই তার বিবরণ দিয়ে গেছেন। ইতিপূর্বে দেওয়া বাকি বর্ণনাগুলির থেকে তা আলাদা কিছু নয়। কিন্তু উল্লেখ্য দুটি জিনিস। এক, কেরি নিজে মহিলাকে বোঝানোর পরেও মহিলা আত্মবিঅসর্জন দেবার সংকল্প ত্যাগ করেননি, তা সত্ত্বেও কেরি এটিকে দ্বর্থ্যহীন চিত্তে 'খুন' বলেছেন, আত্মবিসর্জন নয়। এবং সতীদাহের মধ্যে তিনি বিস্ময়ের কোনো উপাদান পাননি, ভয়াবহ বর্বরতার পেয়েছেন। কারণ হিদেনত্ব এবং বর্বরতা তাঁর জগতে মোটামুটি সমর্থক। দুই, পুরো সতীদাহের ঘটনায়, সরকারের অনুপস্থিতি ভীষণভাবে লক্ষ্যণীয়। কর্তৃপক্ষের অনুমতি নামক বিষয়টির কোনো অস্তিত্ব আছে বলে কেরির লেখায় দেখা যায়না, যা মুসলমান আমলে অকল্পনীয় ছিল। অর্থাৎ কেরি যে সরকারহীনতার কথা বলেছেন, তা বাংলায় মূলত ব্রিটিশদেরই অবদান।
যেহেতু কেরি হিদেনত্বকে বর্বরতার সমার্থক মনে করতেন, তাই তাঁর বর্ণনার কেন্দ্রীয় বিষয় ক্রমশ হয়ে উঠতে থাকে নিষ্ঠুরতা। একই কথা মার্শম্যানের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। মার্শম্যান একটি সতীদাহের বর্ণনা করেন, যেখানে আগুনের কুন্ডটি ডিনার বানানোর পক্ষেও ছোটো। সেখানেই দুইটি দেহ, একটি জীবিত এবং একটি মৃতকে একসঙ্গে পোড়ানোর চেষ্টা হচ্ছিল। হাত-পা বাইরে বেরিয়ে আসছিল বলে সেগুলিকে বাঁশপেটা করে ভেঙে দেওয়া হয়। এতে সামান্য অতিশয়োক্তি থাকলেও থাকতে পারে, নাও পারে, কিন্তু এখানে লক্ষ্যণীয় ইউরোপীয়দের দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন। ক্রমশ নিষ্ঠুরতা এবং বর্বরতাই মূল আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠছে ইউরোপীয়দের আলোচনায়। সেগুলি মিথ্যেও নয় সম্ভবত। কিন্তু লক্ষ্যণীয়, যে, সামগ্রিক ভাবে এতে বৃটিশদের কোনো দায়-দায়িত্ব নেই,পুরোটাই অন্ধকারাচ্ছন্ন এক উপমহাদেশের বর্বরতার দায়, এই লেখালিখির এই অভিমুখটি পরিষ্কার। সময়কালে লাফিয়ে যদি একটু এগিয়ে যাওয়া যায়, তো দেখা যাবে, ধীরে-ধীরে ইউরোপীয় চিন্তার এই ঘরানাটিই আধিপত্য বিস্তার করে। ১৮২৫ এ লেডি আমহার্সট একটি ঘটনার কথা লিপিবদ্ধ করেন, যেখানে এক সদ্য়বিধবা সহমরণে যাবেন মনস্থ করেও শেষ মুহূর্তে চিতা থেকে নেমে পালান। ক্রুদ্ধ জনতা পরে ব্যাপারটা খেয়াল করে মহিলাকে ধরে এনে একটি ডিঙিতে তোলে এবং মাঝনদীতে জলে ফেলে দেয়। মহিলা আর ওঠেননি। আরও পরে একটি স্টিরিওটাইপ তৈরি হয় ঘটনাগুলির, যেখানে সতীদাহ এমন একটি ঘটনা, যেখানে ভারতের অন্ধকারাচ্ছন্ন কুচক্রী লোকজন (বিশেষ করে ব্রাহ্মণরা) সম্পত্তির লোভে অনিচ্ছুক বিধবাকে নেশা করিয়ে, জোর করে, বা দুটোই, পুড়িয়ে মারে, এবং সেখানে উদ্ধারকারী হিসেবে উপস্থিত হন ব্রিটিশ শ্বেতাঙ্গরা। জুল ভার্নের 'অ্যারাউন্ড দা ওয়ার্ল্ড ইন এইট্টি ডেজ' এইরকম স্টিরিওটাইপের একটি অব্যর্থ উদাহরণ।
তবে ইউরোপীয় চিন্তনের অভিমুখ যাই হোক, উনবিংশ শতকের একদম গোড়ার দিকে (কেরির প্রথম বিবরণ ১৭৯৯ এর) কলকাতার নিকটবর্তী এলাকায় এ ধরণের ঘটনা যে ঘটছিল এবং বাড়ছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এই সময় থেকেই সতীদাহের সংখ্যার একটি মোটামুটি মাপজোক পাওয়া যায়। কেরি নিজ উদ্যোগে সতীদাহের সংখ্যা নিরূপণের একটি চেষ্টা করেন। সেই হিসেব অনুযায়ী কলকাতার একেবারে নিকটবর্তী এলাকাতেই ১৮০৩ সালে ২৭৫ টি সতীদাহের ঘটনা ঘটে। এই সংখ্যাগুলিকে সূত্র হিসেবে ধরে ১৮১৩ সালে ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ উইলিয়াম উইলবারফোর্স ব্রিটিশ সংসদে এই প্রথা নিয়ে একটি ভাষণও দেন। পূর্বতনদের বিবরণ সম্পর্কে তিনি দস্তুরমতো ওয়াকিবহাল ছিলেন। ভাষণে তিনি বলেন, বার্নিয়ের বলেছিলেন মুসলমান আমলে সতীদাহ কমে এসেছে। আলেক্সান্ডার ডাও লিখেছিলেন, সতীদাহ প্রায় অবলুপ্ত। কিন্তু তিনি দুঃখের সঙ্গে জানান, যে ব্রিটিশ শাসনে আসার পর এই সংখ্যা উল্লেখযোগ্য়ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। উইলবারফোর্স নিজেও ছিলেন ইভানজেলিস্ট, ফলে খ্রিস্টান আদর্শ তাঁর লেখাতেও পরিব্যাপ্ত, কিন্তু লক্ষ্যণীয় যে, সংখ্যার বিচার করতে গিয়ে তিনিও ব্রিটিশ শাসনের সঙ্গে সতীদাহের সংখ্যাবৃদ্ধির একটি সরাসরি সংযোগ উল্লেখ করতে বাধ্য হয়েছেন। এই সরাসরি সংযোগই দেখিয়ে দেয়, যে, সতীদাহের একমাত্র দায় অন্ধকারাচ্ছন্ন ভারতবাসীর, এই স্টিরিওটাইপে বিস্তর ফাঁকফোকর আছে।
এ ব্য়াপারে সংখ্যাগতভাবে দ্বিতীয় ফাঁকফোকরটিও দেখা যায় কয়েক বছর পরের হিসেবে। কয়েক বছর পর থেকেই সরকারি ভাবে সতীদাহের হিসেব রাখা শুরু হয়। কলকাতা বিভাগে ১৮১৫ সাল থেকে প্রাপ্ত হিসেব অনুযায়ী, পরপর বছর অনুযায়ী সতীদাহের সংখ্যা এইরকমঃ ২৫৩, ২৮৯, ৪৪২, ৫৫৪, ৪২১, ৩৭০, ৩৯২, ৩২৮, ৩৪০, ৩৭৩, ৩৯৮, ৩২৪, ৩৩৭, ৩০৮ (শেষ সংখ্যাটি ১৮২৮ সালের, যার পরের বছর সতীদাহ নিষিদ্ধ হয়। সংখ্যাগুলি সরকারি হিসেব, এই লেখায় আনন্দ ইয়াং এর 'Whose Sati?: Widow Burning in Early 19th Century India' প্রবন্ধ থেকে নেওয়া)। চোখের দেখা থেকেই দেখা যায়, ১৮১৫-১৯ এই ক বছরে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে সতীদাহের সংখ্যা। কিন্তু তার চেয়েও কৌতুহলোদ্দীপক হল ১৮২৫ থেকে উল্লিখিত সংখ্যাগুলি। ১৮২৫ সালেই লেডি আমহার্সট লিবিবদ্ধ করেন সতীর একটি ঘটনা, যা উপরেই সংক্ষেপে বর্ণনা করা হয়েছে। এবং ওই বছরই লর্ড আমহার্সট সতীদাহের ব্যাপারে কিছু নিয়ম করেন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল সহমৃতা বিধবার মৃত পতির কোনো সম্পত্তি থাকলে তা সরকার বাজেয়াপ্ত করবে। লক্ষ্যণীয় এই, যে, তার পরেও সতীদাহের সংখ্য়ার বিশেষ তারতম্য় হয়নি। ১৮২৬ থেকে ২৭ এ বস্তুত সংখ্য়ার কিঞ্চিৎ বৃদ্ধিই হয়েছে। ফলে এটা স্পষ্ট, যে, সম্পত্তির লোভে কিছু কুচক্রী বিধবাদের পুড়িয়ে মারছে, এই সরলীকরণ একেবারেই যুক্তিযুক্ত না।
৫।
অতএব সতীদাহের যে প্রচলিত ইউরোপীয় স্টিরিওটাইপ, অর্থাৎ, অন্ধকারাচ্ছন্ন ভারতবাসী, মূলত কুচক্রী ব্রাহ্মণরা, মূলত সম্পত্তির লোভে বিধবাদের পুড়িয়ে মারছে, এবং এ হল স্রেফ মধ্যযুগীয় কুসংস্কারের ফল, এই স্টিরিওটাইপে বড় ছিদ্র আছে। ইউরোপীয় বর্ণনাতেই পাওয়া যাচ্ছে, মুঘল যুগে সতীদাহ কমে আসছিল। ১৭৬৪ পূর্ব অবস্থার বিবরণ দিয়ে ডাও লিখেছেন সতীদাহ অবলুপ্তপ্রায়। অথচ ১৮০০ সাল থেকে যে হিসেব পাওয়া যাচ্ছে, তাতে দেখা যাচ্ছে সতীদাহ বেড়েই চলেছে। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে উইলবারফোর্স পরিষ্কার জানাচ্ছেন এই সংখ্যাবৃদ্ধির সঙ্গে ব্রিটিশ শাসনের একটি সম্পর্ক আছে। ফলে ইউরোপীয় বিবরণের প্রচলিত ধারণার ফাঁকফোকরের জায়গাটি পরিষ্কার।
কিন্তু প্রশ্ন হল, মধ্যযুগীয় কুসংস্কার যদি মূল কারণ না হয়, তো সতীদাহের মূল কারণটি কী? আশিস নন্দী খুব পরিষ্কার ভাবে বলেছেন, যে, কলকাতার নিকটবর্তী এলাকায় ব্রিটিশ শাসনকালে সতীদাহের ক্রমবৃদ্ধি স্পষ্ট করেই দেখিয়ে দেয়, যে, সতীদাহ ব্রিটিশ-পোষিত ভদ্রলোকদের সংস্কৃতি। এর প্রত্যক্ষ প্রমাণ হিসেবে তিনি পূর্বোল্লিখিত কলকাতা বিভাগে সতীদাহে মৃত্যুর তালিকাটি পেশ করেন। পরবর্তীতে আনন্দ ইয়াং দেখান, যে, কলকাতা বিভাগের হিসেব, মোটেই কলকাতা সংলগ্ন এলাকার হিসেব নয়, ওটি একটি বিরাট এলাকা, এমনকি কটকও তার মধ্যেই পড়ে। ফলে আশিস নন্দীর অনুমানটি ঠিক নয়। সতীদাহ মোটেই কেবল ভদ্রলোকের সংস্কৃতি নয়।
সতীদাহের পরিসংখ্যান দেখলেও ব্যাপারটি পরিষ্কার হয়। ১৮১৮ সালের হুগলী জেলার পরিসংখ্য়ানে দেখা যাচ্ছে, ৪০ জন ব্রাহ্মণ, ২৬ জন কায়স্থ, ৪ জন বৈদ্য এবং বাকি ৭১ জন নিচু জাত। এটি একটি উদাহরণ, বাকি পরিসংখ্যানগুলিও একই রকম চিত্র তুলে ধরে। শুধু এইটুকুই না, আরও কিছু কৌতুহলোদ্দীপক তথ্যও পাওয়া যায়, পরিসংখ্যান ঘাঁটলে। যেমন, এই সময়কালে সহমৃতাদের দুই-তৃতীয়াংশই চল্লিশোর্ধ্ব। ২৫ এর নিচে মৃতাদের সংখ্যা ১১।৬% এর মতো। এখানে আরেকটি মিথ ভেঙে পড়ে, যে, সতীদাহ মূলত অপ্রাপ্তবয়স্কাদের ভুল বুঝিয়ে করানো হত। তৃতীয় যে জিনিসটি খুব গুরুত্বপূর্ণ, তা হল সহমৃতার পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা। এর নিখুঁত হিসেব নেই, কিন্তু রিপোর্ট থেকে সামগ্রিক চিত্র যা পাওয়া যায়, তা হল সহমৃতাদের বিরাটাংশই ছিলেন গরীব (উদাহরণ স্বরূপ আনন্দ ইয়াং থেকে উদ্ধৃত নিম্নলিখিত অংশটিঃ Hughli's 98 cases evoked the observation that the "greater proportion of the husbands appear to have been in poor or middling circumstances"; Nadia's 45 "female sacrifices . . . [involved] parties . . . for the most part ... in poor circumstances; and the widows were, generally speaking, of an advanced age.") এক্ষেত্রেও "সম্পত্তির লোভ" নামক ন্যারেটিভটি পুনরায় ব্য়াহত হয় ( এই সবকটি পরিসংখ্যানই সরকারি, কিন্তু এই লেখায় ইয়াং এর রচনা থেকে নেওয়া হয়েছে)।
চতুর্থ আরেকটি জিনিসও আনন্দ ইয়াং এর পর্যবেক্ষণে পাওয়া যায়, কোনো কোনো ইউরোপীয়, যেমন লেডি আমহার্স্টও যার উল্লেখ করেছেন। সেটি হল, সামাজিক দুর্যোগ, মৃত্যুর হার বা মড়কের সঙ্গে সতীদাহের সংখ্যার সরাসরি যোগাযোগ। কলেরা বা অন্য মহামারীর আক্রমণের সঙ্গে সতীদাহের সংখ্যা বাড়ার একটি সরাসরি যোগাযোগ দেখা যায় সর্বত্র। যেমন ১৮১৭-১৮ সালের কলেরার উপদ্রব যে যে এলাকায় বেড়েছিল, সেখানেই সতীদাহের সংখ্যা বাড়ে। একই জিনিস হয় ঢাকা এবং বারাণসীতেও। ফলে মহামারী, খরা দুর্ভিক্ষের সঙ্গে সতীদাহের একটি সরাসরি যোগ ছিল। একেবারে পরিসংখ্যানগত ভাবেই তা দেখা যায়। এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণটি আরেকটি অনালোচিত প্রসঙ্গের দিকে আমাদের ঠেলে দেয়, যে প্রসঙ্গটি ইয়াং তোলেননি। সেটি হল, সামান্য কলেরার বাড়াকমার সঙ্গেই যদি সতীদাহের সংখ্য়া অত্যন্ত স্পর্শকাতরভাবে কমতে বা বাড়তে থাকে, তাহলে যৌক্তিকভাবেই, ১৭৭০ সালের বিরাট মন্বন্তরে (৭৬ এর মন্বন্তর) সতীদাহের সংখ্যাএকটি অকল্পনীয় বিরাট লাফ মেরে বেড়েছিল, মানতেই হয়। কারণ ৭৬ এর মন্বন্তরের সঙ্গে বাকি অন্য কিছুর তুলনাই হয়না। অনেক পরে ১৯৪৩ এর দুর্ভিক্ষ বাদ দিলে, এত বড় বিপর্যয় বাংলা দেখেনি। এতে মারা যান বাংলার এক তৃতীয়াংশ (এক কোটি) মানুষ।
এ কেবল অঙ্কের নিয়মের যান্ত্রিক পূর্বাভাস নয়, যৌক্তিকভাবেই এরকম হবার সম্ভাবনা প্রবল। সেই যৌক্তিক কাঠামোটি খুঁটিয়ে দেখা যাক। ব্রিটিশ আমলের যে সরকারি হিসেব আগেই দেওয়া হয়েছে, সেই অনুযায়ী একজন গড়পড়তা সহমৃতা কে? কী তার সামাজিক চরিত্র? যদি একটি সাধারণীকরণ করা হয়, তো দেখা যাবে, খুব সম্ভবত তিনি একজন চল্লিশোর্ধ্ব পরিণত মহিলা, জীবনের নানা দিক দেখেছেন। তিনি উচ্চবর্ণ বা নিম্নবর্ণ যা খুশি হতে পারেন, সম্ভাবনা প্রায় সমান সমান। কিন্তু জাতের বিচারে যাইই হোন, তিনি খুব সম্ভবত গরীব ঘরের মহিলা। অর্থাৎ, ব্রিটিশ আমলে পরিণতবয়স্ক দরিদ্র মহিলারাই মূলত সহমৃতা হয়েছেন। নিশ্চয়ই এর ব্যতিক্রম আছে, কিন্তু আমরা এখানে সাধারণ প্রবণতাটির কথাই বলছি। ১৭৭০ সালের পরিপ্রেক্ষিতে এই চরিত্রচিত্রণটিকে যদি ফেলি, তো অন্য একটি শব্দ উঠে আসতে বাধ্য়। সহায়সম্বলহীন। এর একটি কারণ সহজবোধ্য়। মন্বন্তরে যাঁরা দলে-দলে মারা যাচ্ছেন, তাঁরা শুধু গরীবই না অতি অবশ্যই অত্যন্ত খারাপ অবস্থায় আছেন এবং বস্তুত সহায়সম্বলহীনই। কিন্তু সহজবোধ্যতার গভীরে এর একটি সামাজিক ইতিহাসও আছে। আগেই বলা হয়েছে, ব্রিটিশপূর্ব বাংলা ছিল ভারতের সমৃদ্ধতম অঞ্চল এবং বস্তুত বিশ্বের সমৃদ্ধতম অঞ্চলগুলির মধ্যে একটি। কৃষি এবং শিল্পে (সবচেয়ে বড় শিল্প ছিল তাঁত এবং রেশম) বাংলার উৎকর্ষ এবং বাংলার পণ্যের আন্তর্জাতিক চাহিদা অনস্বীকার্য ছিল। ১৭৫৭ সাল থেকে ১৭৭০, মাত্র এই ১৩ বছরে ব্রিটিশ শাসন চাকাটিকে সম্পূর্ণ উল্টে দিতে সক্ষম হয়। সমৃদ্ধতম এলাকা থেকে চরমতম দুর্ভিক্ষপীড়িত একটি এলাকায় পরিণত হয় বাংলা। কোনো যাদুকাঠির প্রভাবে এই পরিবর্তন হয়নি। পুরোটাই বৃটিশ শাসনের অবদান। তারা শিল্প এবং কৃষির যে প্রক্রিয়া ছিল, সেটিকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিতে সক্ষম হয়। মহিলাদের উপরে যৌক্তিকভাবে এর তীব্র প্রভাব পড়ে। বাংলার ঘরে-ঘরে আগেই বলা হয়েছে, মহিলারা ছিলেন উপার্জনক্ষম, মূলত তাঁত-শিল্পের কল্যাণে। কিন্তু এই শিল্পটিই সমূলে ধ্বংস করে ব্রিটিশ-শাসন, ফলে মহিলাদের নিজস্ব উপার্জনের বেশিরভাগ রাস্তাই বন্ধ হয়। এর প্রভাব অবশ্য যৌক্তিকভাবে অনুমানই করতে হবে। কারণ ১৭৫৭ সালের আগে মহিলাদের কাজ সম্পর্কে তথ্য আছে, ৫৭ থেকে ৭০ -- এই সময়ের নেই। কিন্তু যখন তাঁতশিল্প ধ্বংস হচ্ছে, এক কোটি লোক মারা যাচ্ছেন, তখন মহিলাদের উপার্জনের রাস্তা বন্ধ হয়ে গেলে তাঁরা যে সহায়সম্বলহীন হয়ে পড়বেন, এ খুব কঠিন যৌক্তিক হিসেব নয়। এবং চল্লিশোর্ধ্ব একজন সহায়সম্বলহীন মহিলা, বাড়ির পুরুষটির মৃত্যু হলে যাঁর টিকে থাকার আর কোনো উপায় নেই, হয় আত্মহনন, নয় অনাহারে মৃত্যুই যে তাঁর একমাত্র রাস্তা, এ নিয়েও খুব বেশি সন্দেহ থাকার কথা নয়। এই দুইটির মধ্য়ে তফাত সামান্যই, কিন্তু আছে। অনাহারে মৃত্যুর কোনো গৌরব নেই, সতী হবার অন্তত একটি সামাজিক গৌরব ছিল সে সময়। সঙ্গে ছিল দুঃখ-দুর্দশা থেকে চিরমুক্তি পেয়ে অক্ষয় স্বর্গলাভের অমোঘ হাতছানি। মুসলমান শাসনের বিধিনিষেধ চলে যাবার পরে স্বর্গ অর্জনের সেই পথে কাঁটাও বিশেষ ছিলনা।
ফলে, যৌক্তিক বিচার যদি মানতে হয়, ব্রিটিশ আমলের সতীদাহ এক গণআত্মহত্যার সুচিন্তিত সামাজিক প্রকল্প, ব্রিটিশ শাসন যার প্রাথমিক কারণ। একে খুনও বলা যেতে পারে, যদি মন্বন্তরে এক কোটি মানুষের মৃত্যুকেও অবশ্য খুন বলা হয়। কিন্তু ব্রিটিশ আখ্যানে মন্বন্তরকে খুন বলা হয়নি। কেরি বস্তুত মন্বন্তরকে এড়িয়ে গিয়েই মানবহিতৈষণার কাজে হাত দিয়েছিলেন। তাঁর আখ্যানে হিদেনদের দুর্দশার একমাত্র কারণ হিদেনরাই। ফলে সতীদাহের সঙ্গে ব্রিটিশ সংযোগ আবিষ্কার করা তো অসম্ভব ব্যাপার। সে কারণেই পুরো দায়িত্বটি মধ্যযুগীয় হিন্দু সংস্কারের ঘাড়ে। অথবা কোনো কুচক্রীর সম্পত্তি দখলের অভিপ্রায়ের উপর নিবেদিত। অথচ, আমরা আগেই দেখেছি, সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার পরও সতীদাহ কমেনি। কারণ সম্ভবত, যারা মারা যাচ্ছিলেন, তাদের বাজেয়াপ্ত করার মতো কিছু ছিলনা। উল্টোদিকে প্রায় সমসময়ের অ্যাডামস রিপোর্টে দেখতে পাই উচ্চবিত্ত জমিদার হিসেবে বিধবা মহিলারা নিজেরাই জমিদারি চালাচ্ছিলেন। অ্যাডামস রিপোর্টে পাওয়া যায় উনবিংশ শতকের শুরুতে রাজশাহীর ৮০ জন বড় জমিদারের মধ্য়ে অর্ধেকই ছিলেন বিধবা মহিলা। তাঁরা সহমরণে যাননি। বরং কেউ যাতে এইরকম অবস্থায় তাঁদের ঠকিয়ে না নিতে পারে, সেজন্য জমিদারবাড়ির মেয়েদের ছোটো থেকেই লেখাপড়া শেখানোর চল ছিল। উল্টোদিকে সহমৃতাদের মধ্য়ে দরিদ্রদের ছড়াছড়ি। কেরির সমসাময়িক মার্শম্যানের সতীদাহ সংক্রান্ত যে বিবরণটি আগেই দেওয়া হয়েছে, সেটি পড়লেই দেখা যায়, শুধু নৃশংসতা নয়, সেখানে দারিদ্র্যের চিহ্নও প্রকট। এমন একটি কুন্ডে দুটি শরীরকে, তাদের মধ্যে একটি আবার জীবিত, পোড়ানো হচ্ছে, যেখানে, মার্শম্যান সায়েবের ডিনারও তৈরি করা যায়না। এ যদি সম্পদের অপ্রতুলতার চিহ্ন না হয়, তো অপ্রতুলতা আর কাকে বলা হবে?
আন্দাজ করা যায়, অষ্টাদশ শতকের শেষ তিরিশ এবং উনবিংশ শতকের প্রথম তিরিশ, মোটামুটি ষাট বছর ধরে এই কান্ড চলেছে। সহায়সম্বলহীন বিধবারা, এমনকি পোড়ানোর কাঠও যারা জোগাড় করতে পারেননা, উপায়ান্তর না দেখে ঝাঁপিয়েছেন অগ্নিকুন্ডে। চারদিকে হরিবোল ধ্বনি উঠেছে। বেজে উঠেছে ঢাক-ঢোল। ব্রাহ্মণরা মন্ত্র টন্ত্র পড়েছেন। আত্মহত্যার এই বীভৎস কার্নিভ্যালে সশরীরে স্বর্গারোহণ করেছেন একের পর এক সতী। ব্যাপারটি একেবারেই এমন নয়, সতী নামক লোকাচারটির ধারণা বৃটিশ আমলের আগে ছিলনা, বা কোনো বিত্তশালী মহিলাও সেই ধারণার বশবর্তী হয়ে সহমরণে যাননি। কিন্তু যতদূর জানা যাচ্ছে, ব্রিটিশ আমলের আগে সেসব অবলুপ্তপ্রায় হয়ে গিয়েছিল (কয়েকটি জানা ক্ষেত্র বাদ দিয়ে, যেমন রাজস্থানে মুঘল আমলে সতীর মহামারী দেখা গিয়েছিল, মূল রাজনৈতিক কারণে)। বস্তুত জাতিগতভাবে বাঙালি কোনো মহিলার সহমরণে যাবার কোনো বর্ণনাও ব্রিটিশপূর্ব বাংলায় পাওয়া যায়না ( যে ঘটনাগুলির বর্ণনা পাওয়া যায়, সেগুলি পাটনায়, এবং কাশিমবাজারের ঘটনাটির সহমৃতা ছিলেন মারাঠি)। অথচ ব্রিটিশশাসিত একের পর এক মৃত্যুর ঘটনা ঘটে গেছে দীর্ঘদিন ধরে। একের পর এক মহিলা কেন এই পথ বেছেছেন? কেন তাঁরা নিরূপায় সহায়সম্বলহীন? তা নিয়ে ইউরোপীয় আখ্যানে বিশেষ নাড়াচাড়া হয়নি। কারণ এই বীভৎস উৎসবে ঢাক বা কাঁসি তো ব্রিটিশরা বাজাননি। আগুনও তাঁরা লাগাননি। অতএব এই খুনের কোনো দায় তাঁদের নেই। দায় কেবলমাত্র অন্ধকারাচ্ছন্ন হিদেনদের। এভাবেই হয়েছে আমাদের ঐতিহ্যেরর পুনর্নির্মান। এইভাবেই লেখা হয়েছে ইতিহাস। ইউরোপীয় অঙ্গুলীহেলনে।
সূত্রাবলীঃ
১ম পরিচ্ছেদ।
বার্নিয়ের এবং তাভার্নিয়েরের সমস্ত বিবরণ নিচের দুটি বই থেকে নেওয়া হয়েছে। পরবর্তী পরিচ্ছেদগুলিতে আর আলাদা করে উল্লেখ করা হয়নি।
Travels in India
Jean-Baptiste Tavernier
Travels in the Mogul Empire, A.D. 1656–1668
François Bernier
২য় পরিচ্ছেদ।
জ্যানেট সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য এসেছে নিম্নলিখিত বইটি থেকেঃ
Justice Denied: Extraordinary miscarriages of justice
James Morton
৩য় পরিচ্ছেদ।
Interesting historical events, relative to the provinces of Bengal (Volume 2)
John Zephaniah Holwell
রামতনু লাহিড়ি ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ
শিবনাথ শাস্ত্রী
৪থ পরিচ্ছেদ।
History of Hindostan (Volume 1)
By Alexander Dow
FROM PROSPERITY TO DECLINE - EIGHTEENTH CENTURY BENGAL
Sushil Chaudhury
Sati: A Nineteenth Century Tale of Women, Violence and Protest
Ashish Nandi
An Enquiry into the Obligations of Christians to Use Means for the Conversion of the Heathens
William Carey
Bengal as a Field of Missions
By Macleod Wylie
Substance' of the Speeches for Promoting the Religious Instructioin and Moral Improvement in India.
By William Wilberforce
Whose Sati?: Widow Burning in Early 19th Century India
Anand A Yang
Adam's Report on Education
৫ম পরিচ্ছেদ।
Sati: A Nineteenth Century Tale of Women, Violence and Protest
Ashish Nandi
Whose Sati?: Widow Burning in Early 19th Century India
Anand A Yang
Adam's Report on Education
রামতনু লাহিড়ি ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ
শিবনাথ শাস্ত্রী