কারোর কারোর মাতৃদিবস শুরু হবে গোলাপফুলের তোড়া দিয়ে, সন্তানের চুমু দিয়ে। সেদিন সকালের ব্রেকফাস্টের ঝামেলা নেই – ব্রাঞ্চের প্ল্যান করা আছে আগে থেকেই। এরা হলেন মা, ‘স্বর্গাদপি গরিয়সী’ মা-জননী। যাঁদের ছাড়া মিথ্যে হত সকল তারার ফোটা। কারোর কারোর দিন কাটবে খুব ব্যস্ততায় – নিজের শিশুটিকে, নিজেকে সাজিয়ে গুছিয়ে হাজির হতে হবে হসপিটালের দেওয়া পার্টিতে- ফ্ল্যাশবাল্বের মুহুর্মুহু আলোয় মাতৃত্বের উদযাপন।
তবে এ বাইরেও থাকেন আরেক রকমের মা। সুমনের “সব আমাদের-ই জন্য “ গানটা শুনলেও তার মর্ম যাঁদের বোধগম্য হয় না। সব আমাদের, এমন আবার হয় না কি? এঁরা হলেন সর্বহারা মা - ফুল, চুমু, ব্রাঞ্চের সীমানার বাইরে এঁদের বাস। এতকাল ভাবতাম আমাদের শ্রেণী-বিভক্ত সমাজে এঁরাই হলেন ‘দীনের হতে দীন’। কিন্তু না, ধারণাটা ভুল বুঝলাম যেদিন জানলাম আসামের ডিটেনসন ক্যাম্পে আটকে থাকা মায়েদের কথা, যারা বছরের পর বছর বিনা কারণে জেলে আটকে থাকেন, সন্তানদের চোখের দেখাও দেখতে পান না । বা যখন শুনলাম বাংলাদেশের রোহিঙ্গা উদবাস্তু শিবিরের মা’দের কথা।
বাংলাদেশের রোহিঙ্গা-সমস্যার কথা আমরা সবাই কম-বেশি জানি। ‘অহিংসার ধর্ম’ অনুসারী বৌদ্ধ-রাষ্ট্র মায়ানমার যাঁদের নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়েছিল, সেনাবাহিনীর অত্যাচারে তাঁদের একটা বড় অংশ সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে এসে ঘাঁটি গাড়ে। ইউনিসেফের রিপোর্ট বলছে, এপ্রিল ২০১৯ নাগাদ প্রায় ৯১০,০০০ রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছেন বাংলাদেশে। এদের অধিকাংশ-ই শিশু। অবশ্য শিশু কথাটা খাটে কিনা জানিনা, কারণ যে শৈশব জুড়ে তীব্র হিংসার ছায়া, দেশত্যাগের আতংক – তাকে কি বলব? পালিয়ে আসা মানুষদের ৫২% শতাংশ মেয়ে।
১৩,৫০০র বেশি মেয়েরা যৌন অত্যাচারের কথা জানিয়ে সাহায্য চেয়েছেন। আরও কত যে রিপোর্টেডই হয় নি তা কে জানে। বিয়ে হয় নি যে মেয়ে সে মা হবে – এই লজ্জার কথা পাঁচকান করতে আছে নাকি? তাই জড়ি-বুটি টোটকা দিয়ে গর্ভপাত করাতে গিয়ে যদি সে মেয়ে মারা যায়, যদি আনাড়ী হাতে গর্ভপাত করাতে গিয়ে পেটের ভিতর কাঠির টুকরো ভেঙ্গে ঢুকে যায় কি-ই বা করা যাবে! ক্যাম্পগুলিও তো আর যৌনকর্ম তথা যৌন-অত্যাচার বর্জিত জায়গা না। বরং আমরা সবাই জানি যে ধর্মনির্বিশেষে যে কোন উদবাস্তু শিবিরেই কিভাবে মেয়েরা আরও প্রান্তিক স্তরে সরে যেতে বাধ্য হয়, নতুন লাঞ্ছনার শিকার হয়। তাই রিফুউজি ক্যাম্পে অনাকাঙ্খিত মাতৃত্বের লজ্জার হাত থেকে বাঁচতে চাইল্ডম্যারেজ বেড়েছে হু হু করে। রোটি-কাপড়া-মকানের দায় নেবার-ই কেউ নেই, সেনাদের হাতেই হোক আর নিজের লোকের হাতেই হোক, অত্যাচারিত কন্যাদের মানসিক ক্ষতের আরাম করার দায় কেই বা নেবে?
যেহেতু ২০১৭ সালে মায়ানমারে সেনাবাহিনীর অত্যাচার চরমে উঠেছিল, তাই গত বছরের মাঝামাঝি রিফিউজি ক্যাম্পে শিশু-জন্মের ঢল নেমেছিল। তখনই ইউনাইটেড নেশন জানিয়েছিলেন যে প্রতি দিনে প্রায় ৬০টি করে শিশুর জন্ম হচ্ছে। এই শিশুদের অধিকাংশই জন্মায় সরকারী বা বেসরকারী স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সীমানার বাইরে। গ্রাম্য দাই-এর হাতে জন্ম। জন্মের পরে এদের কোন রেজিস্ট্রেসন হয় না। তাই সরকারী ভাবে এরা অদৃশ্য – কোন সুযোগ-সুবিধা, শিক্ষা-স্বাস্থ্যের সুযোগ এদের কাছে আকাশের চাঁদ। উদবাস্তু শিবিরের পানীয় জল, সামগ্রিক স্বাস্থ্যের অবস্থা যেমন, তাতে এই শিশুগুলির সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার সম্ভাবনা কতটা সেটা বেশ চিন্তার। শিশুমৃত্যুর হার বোঝার চেষ্টাও বাতুলতা কারণ সরকারী হিসেবে শিশুগুলি স্রেফ নেই।
অবশ্য সেই আইনত অস্তিত্বহীনতার সমস্যাটা উদবাস্তুদের নিজেদের যে কতটা স্পর্শ করতে পেরেছে তা বোঝা দায়। জীবন থেমে থাকে না - উদবাস্তু ক্যাম্পে জন্ম-মৃত্যু-বিবাহ তিন-ই চলছে রমরমিয়ে।
বিশেষতঃ এই জন্মের হার ক্রমশঃ বাংলাদেশের সরকারের এক মাথাব্যথার জায়গা হয়ে দাঁডিয়েছে। ধর্ষণ জাতীয় চেনা-দুর্যোগ বাদ দিলেও, এমনিতেও এঁদের নিজেদের সন্তান-জন্মের হার বেশ বেশি। এর কিছুটা কারণ নিহিত আছে অতীতে। বাংলাদেশে আসার আগে মায়ানমারে এঁরা যে জীবন কাটিয়েছেন, সেটা এক ধরণের নিজভূমে পরবাসীর জীবন। সেখানে সরকারের বিন্দুমাত্র মাথা ব্যথা ছিল না, এঁদের ভালো মন্দ কোন কিছুতেই। এঁরা ছিলেন বস্তুত সব সুবিধা কেড়ে নেওয়া একটা পিছিয়ে পড়া জাতি। ১৯৮২ সালে নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া দিয়ে শুরু। তারপর একে একে এল নতুন নতুন নিয়ম - এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে হলে অনুমতি লাগবে, স্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজা তাদের জন্য বন্ধ, আর অন্যত্র তো যাওয়ার অনুমতিই নেই, সরকারী পরিষেবাও তাদের জন্য নয়। তাদের জমি কেড়ে নেওয়া হয়। পারশ্রমিক-হীন শ্রমদানে বাধ্য করা হয়। তাদের বিয়ের জন্য সরকারী অনুমতি লাগে। তাদের অধিকাংশ সরকারী কাজে যোগ দেওয়ার অধিকার নেই। নিষেধের তালিকাটা বিশাল। তাই রিফিউজি ক্যাম্পের দুর্দশা হয়ত আমাদের কাছে যতটা শ্বাসরোধকারী মনে হয়, ওঁরা হয়ত নিজেদের জীবনে তার থেকেও খারাপ দেখেছেন! অন্তত কিছুটা হলেও তো নিরাপত্তা বেশি!
শিশু-জন্মহারের বিষয়ে বলতে গেলে, শিক্ষা, স্বাস্থ্য সচেতনতা আর পরিবার-নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে জ্ঞান হল জন্ম-নিয়ন্ত্রণের মূল। যে অঞ্চলের ৩৬ শতাংশ মহিলা স্কুলের দরজা মাড়ান নি আর ৪০% র দৌড় শুধু প্রাইমারী স্কুল অবধি, ছেলেদের ক্ষেত্রে সংখ্যাটা ২৫% আর ৩৭%, সে এলাকার শিক্ষার প্রভাব নিয়ে কথা না বলাই ভাল। এমনিতেই ধর্মীয় পর্দাপ্রথার জন্য বড় হলেই মেয়েরা ঘরের ভিতর ঢুকতে বাধ্য হয়, তারপর সরকার বিরূপ হলে তার কথা ভাববে কে? সরকারী সুবিধা যেমন হাসপাতাল ইত্যাদি অ-নাগরিক রোহিঙ্গাদের নাগালের বাইরে ছিল, হাসপাতাল গ্রামের বাইরে হলে সেখানে যাওয়ার অনুমতিও সহজলভ্য ছিল না। ফলতঃ এঁদের প্রচলিত ধ্যান-ধারণায় তাই জন্ম-নিয়ন্ত্রণ এক প্রায় অচেনা শব্দ। আর যত হাত, তত খেটে খাবার লোক, গরীব মানুষদের এই ধারণাটির প্রকট প্রভাব রয়েছে এখানেও। মায়ানমারে রোহিঙ্গাদের মধ্যে শিশুমৃত্যুর হারও ভায়ানক ছিল। ধর্মীয় ছুতোয় বহুবিবাহ যেমন প্রচলিত, তেমনি প্রচলিত পরিবার-পিছু একাধিক সন্তান। ২০১৮ সালের জানুয়ারী মাসে বাংলাদেশের শরণার্থীদের মধ্যে জনগণনাতে দেখা গেছে দু লক্ষের কাছাকাছি পরিবারের মধ্যে ৩৭% পরিবারের জন সংখ্যা ১-৩ আর ৩৯% শতাংশ পরিবারের ৪-৫ জন সদস্য। আটের উপর সদস্য আছে ৩% পরিবারের।
আমাদের নিজেদের ১০০ বছর আগের ইতিহাস মনে পড়তে পারে। সে সব সুযোগ সুবিধার জেরে আমরা আজ একশ বছর পরে আজকের চেহারায় এসে দাঁডিয়েছি, সেই সুযোগসুবিধাগুলো যখন কোন মানুষের থেকে সিস্টেম্যাটিকালি কেড়ে নেওয়া হয়, তখন তার মাথা তুলে দাঁড়ানোর জায়গা থাকে কি?
রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের আর একটা অন্য দিকও আছে। ২০০৫ সাল থেকে উত্তর রাখাইন রাজ্যের কয়েকটি জায়গায় বিয়ের শর্ত হিসেবে বাধ্যতামুলক ভাবে দুয়ের বেশি সন্তান বারণ হয়। না মানলে জেল ও জরিমানা। একদিনে জন্ম-নিয়ন্ত্রণের শিক্ষা নেই, কনডোম, পিল, ইনজেকশন এসবের জোগান নেই – অন্য দিকে দুই শিশুর সীমারেখা, অথচ মায়ানমারে মায়ের জীবনসংকট না হলে গর্ভপাত চলে না আর সরকারী হাসপাতালের পরিষেবা রোহিঙ্গা মায়ের হাতের – মাঝখান থেকে বেআইনি আনাড়ী হাতের গর্ভপাতের ঠেলায় প্রাণ যায় মা’দের। জন্ম হয় ফ্যান্টম শিশুর। নারীর প্রজনন রাজনীতির হাতে বলি হয়।
বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরে তাই প্রথম দিকে মেয়েদের জন্ম-নিয়ন্ত্রণ ব্যাপারটা বোঝাতেই বেগ পেতে হয়েছে। ছেলেরা কনডোম ব্যবহারে ভয়ানক অনুৎসাহী ছিলেন। ধীরে ধীরে স্বল্পমেয়াদী জন্ম-নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা মেনে নিলেও ভ্যাসেকটমি, টিউবেক্টমি জাতীয় ব্যবস্থার প্রতি ঘোর অনীহা এঁদের। অনেক চেষ্টার পরে এখন পিল বা কনডোম মেনে নিলেও মাঝপথে ব্যবহার ছেড়ে দিচ্ছেন। তাই UNFPA র সাহায্যে সেখানে সরকার এখন IUD আর ইমপ্ল্যান্ট নিয়ে যুদ্ধে নেমেছে। তবে মেয়েদের মধ্যে injectable contraceptives র ব্যবহার বেড়েছে।
কে না জানে মাতৃত্বের দায় যেমন মেয়েদের, তেমনই জন্ম-নিয়ন্ত্রণের দায়ও বেশিটা তারই। এমনিতেই গোটা পৃথিবীতে জন্ম-নিয়ন্ত্রণের সব ব্যবস্থার মধ্যে ছেলেদের নেওয়া ব্যবস্থা মোটে ২৫% ( ভ্যাসেকটমি, কনডম, উইথড্রয়াল, রিদম সব মিলিয়ে ), আমাদের দক্ষিণ-পুর্ব এশিয়ায় এই শতাংশ আরও কম – ১৭.৪%। গত ৩০ বছরের ট্রেন্ড বলছে যে কনডমের ব্যবহার আগের থেকে বাড়লেও ভ্যাসেকটমির হার কমেছে – আমাদের দক্ষিণ-পুর্ব এশিয়াতে যত রকমের জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নেওয়া হয়, তার মাত্র ০.৩% ভ্যাসেকটমি। প্রসঙ্গত ভারতেও মেয়েদের মধ্যে এই ধারণা আছে যে ভ্যাসেকটমির ফলে নাকি ছেলেরা দুর্বল হয়ে পড়ে, তাই সংসারের একমাত্র অর্থ উপার্জনকারী মানুষটিকে তাঁরা ছুরি-কাঁচির মুখে যেতে দেন না – বরং নিজেদের বার বার বাচ্চা হওয়ার ধকল নেওয়া বা গর্ভপাতের টেবিলে ওঠা তাঁদের কাছে বেশি কাম্য। কতটা সচেতনতা ছড়ানোর চেষ্টা করা হয় এসব ক্ষেত্রে? পরিবার-পরিকল্পনার দায় মায়ের মত বাবারও, এই সাধারণ কথাটা বোঝার মত বিদ্যা-বুদ্ধি কবে সারা পৃথিবীর সবার আসবে?
এই রোহিঙ্গা মেয়েদের অবস্থা আরও করুণ। একদিকে অশিক্ষা, ধর্মীয় শিক্ষা, চিরাচলিত বিধির আগড়ে আটকে সে ভাবতে শিখছে, ‘সন্তান ভগবানের দান’। ‘জীব দিয়েছেন যিনি আহার দেবেন তিনি’ এসব তো কদিন আগে আমাদেরও ভাবনা চিন্তার অংশ ছিল, তাই না! অন্যদিকে তার স্তরে এসে, তাকে অসম্মান না করে, ধীরে ধীরে তাকে জন্ম-নিয়ন্ত্রণের কথা বোঝাবার পরিকাঠামোর আর লোকের বড় অভাব। বিশেষত কিশোরী কন্যাদের একথা বোঝানোর কাজটি সহজ না। আর শুধু তো একবার বলে দিলেই হয় না, ব্যবহারের অসুবিধা হলে সে সবের সমাধান করা, তাকে ক্রমাগত সাহস জোগান, পরিবারের আপত্তি কাটিয়ে ওঠার পরামর্শ দেওয়া – তবেই না কাজটা ঠিকমত সম্পন্ন হবে। ধীরে ধীরে পরিকাঠামো তৈরি হচ্ছে, শিক্ষিত ধাত্রীর সংখ্যা বাড়ছে, এখনো সংখ্যায় অপ্রতুল হলেও বুঝিয়ে বলার লোকও আসছে - এগুলো আশার কথা। তবে রোহিঙ্গা সমস্যার জন্য ইউনাইটেড নেশন যে ফান্ড সংগ্রহ করছিল, তার পূর্ণ হতে বহু দূর। অর্থের অভাব সমস্যার স্বল্পকালীন সমাধানের বড় বাধা।
মাতৃত্বের সঙ্গে সন্তান না আনার অধিকার দুই-ই যে তার একজন ‘মা’ হিসেবে না হলেও একজন নারী হিসেবে প্রাপ্য, এটা যতদিন না ওই রোহিঙ্গা মায়েরা না বুঝছেন, ততদিন বোধহয় তাদের মাতৃত্ব সম্পুর্ণ হবে না। আর ঠিক ঠিক মা হয়ে ওঠার সঙ্গে নিজের ও নিজের জাত সন্তানগুলির শিক্ষা-স্বাস্থ্যের আর বেসিক জীবনযাপনের অধিকার বুঝে নেওয়াও খুব জরুরী। অবশ্য জানি না সে আদৌ হবে কিনা, গোটা বিশ্বেই বড় কঠিন দশা রিফিউজিদের – ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই ছোট সে তরী।
যতদিন সেটা না হচ্ছে ততদিন ওই মায়েদের একমাত্র প্রাপ্য অন্যলোকের ক্ষোভ এবং কদর্য হাসি-ঠাট্টা। তার সদ্য নারী হয়ে ওঠা শরীরটির উপর হামলা চালায় একদিকে তার পরিবারের পুরুষটি ( অবশ্য সেনা বাহিনীর পুরুষেরাও ছাড়ে নি তাকে ), অন্যদিকে রাষ্ট্রও জন্মনিয়ন্ত্রণের জন্য তার দখল নিতে হাত বাড়ায়, দশের দায় তার ঘাড়ে ফেলে তাকে দিশাহারা করে দেয়। প্রতিবেশী নিজের জমি-জায়গা বাঁচানোর জন্য তার গর্ভের দিকে বিষ নজরে চায়, আর আরও দূরের ভদ্রজনেরা দাঁত-নখ বার করে বিদ্রূপ-বিষের থলি উজাড় করে তার গায়ে।
রোহিঙ্গা শিবিরের উদ্বেগজনক জন্মহারের বিষয়টি গত বছর মে জুন মাসে বেশ কিছুদিন দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক খবরের শিরোনামে ছিল। এবছর ৮ই মে আবার সংবাদ প্রতিদিন এ নিয়ে একটি খবর করে। এমনিতেই ইসলামফোবিয়ায় জর্জরিত পশ্চিমবাংলার মানুষেরা খবর পড়ে ভারী খুশি – বলেছিলাম না মুসলমানদের মত খারাপ লোক হয় না! দেখেছ কেমন পালে পালে বাচ্চা জন্ম দিচ্ছে – বসে আছিস রিফিউজি শিবিরে, তাও বাচ্চার জন্ম দিচ্ছিস! ভাবতেও ভালো লাগে যে আমাদের রাণাঘাট-দন্ডকারণ্যের বিখ্যাত শরণার্থী শিবিরগুলি নিশ্চয় কোন সদ্যজাত’র কান্নায় কখনো আলোড়িত হয় নি। কেন-ই বা হবে – আমাদের সেই পূর্বজরা তো আর মুসলমান ছিলেন না। আমরা আরও ভুলে যাই মাত্র চল্লিশ বছর আগেও আমাদের বিহার, উত্তর-প্রদেশে মা পিছু সন্তানের সংখ্যাটা প্রায় এরকমই ছিল। অনেক চেষ্টায় তাকে আজকের স্তরে আনা গেছে। রোহিঙ্গাদের জন্য তো সেই চেষ্টাটুকু তো করতে হবে কাউকে! এর মধ্যে অনেকে আবার বাংলাদেশ ছাড়িয়ে ভারতেরও বিপদ দেখছেন। অবশ্য জানি না এই ভাবনাটা সুচারু ভাবে ছড়ান হচ্ছে কিনা – বিপদের ভয় ধরিয়ে দিলে অনেক কিছ কাজ হাসিল করা সহজ হয়।
তাই আমরা এঁদের নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করি বরং। নিজদের যাবতীয় ক্ষোভ উগড়ে দিই। ভুলেই যাই যে এই প্রত্যেকটা রূঢ় বাক্য আসলে গিয়ে বিঁধছে একজন অসহায় মা’র গায়ে, আমাদের চোখে তিনি একটা সংখ্যামাত্র অবশ্য। শুধু সন্তানের জন্ম দিলেই কি আর আমাদের মত দশজন মায়ের সমান হওয়া যায়! বিশ্বব্যাপী মাতৃ-দিবসের রং-রস-সজ্জা ওই দেশ-হীন বাস্তুচ্যূত শিশু-কোলে মা’টির শরণার্থী শিবিরের দরজায় থমকে দাঁড়িয়ে যায়।